জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
আগের পর্বগুলো– পর্ব–১, পর্ব ২, পর্ব ৩, পর্ব ৪, পর্ব ৫, পর্ব ৬
(জো টাসকার-এর লেখা সহ)
দুজন অভিযাত্রী। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের দুরূহতম ঢাল। সকলেই ভেবেছিল, এমনকি বিখ্যাত পর্বতারোহীরাও, এ অসম্ভব। এ তো আত্মহত্যার নামান্তর। মাত্র দুজন, তাও হিমালয়ের গহন প্রান্তরে, শৃঙ্গ অভিযান? সঙ্গে আর কেউ নেই? যাহ অবিশ্বাস্য! সেকারণেই ১৯৭৬ সালের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। দুই দক্ষ পর্বতারোহী পিটার বোর্ডম্যান এবং জো টাসকার চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের অতুলনীয় কীর্তি স্থাপন করলেন। ২২ আগস্ট ব্রিটেন থেকে রওনা হয়ে ১৫ অক্টোবর পশ্চিম গাড়োয়ালের চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ১ নভেম্বর দুজন অভিযাত্রী দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮২ সালে এভারেস্টের উত্তর পূর্ব গিরিশিরা বরাবর আরোহণ অভিযানের শেষ পর্বে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে দুজনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যান। ব্রিটিশ তথা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পর্বতারোহীদের মধ্যে এই দুই পর্বতারোহীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
৭
রিকভারি
৩ অক্টোবর – ৮ অক্টোবর
তেসরা অক্টোবর সকালে কোনো প্রাতরাশ ছিল না। লম্বা দিন সামনে পড়ে আছে, বেস ক্যাম্পে নেমে যাবার জন্য অঢেল সময়। জো ঠিক করেছিল সকালের আলোটা পড়লে ও চ্যাঙাব্যাঙ-এর আপার টাওয়ারের ছবি তুলবে। পশ্চিম দেওয়ালের বাঁহাতি ধারটা, যে বরাবর আমরা চড়ার কথা ভেবে রেখেছি, মেঘটেঘ ঝামেলা না করলে সকালেই সাধারণত উঁকি মারে ওটা। জো ওর সমস্ত ক্যামেরার যন্ত্রপাতি একত্র করে হিমবাহের ওপরে জমে থাকা নতুন পড়া তুষারের ওপর দিয়ে চলল।
আমি ভাবছিলাম, শেষবার ও যখন ওখানে ছিল, সেটা ছিল দুনাগিরি থেকে ফেরবার পথে। তখনই ও পশ্চিম দেয়ালের ছবি তোলে যা পরবর্তীতে ওকে এমন মুগ্ধ করে রাখবে। ও স্বয়ংক্রিয়ভাবে তুলে ফেলেছিল ছবিগুলো, সেসময় খাবার নেই, দৃষ্টিবিভ্রম ঘটছে, স্রেফ রেকর্ড করে রাখা তাইই। দুনাগিরিতে ও আর ডিকের কাছে চ্যাঙাব্যাঙ ছিল কেবল একটা পাহাড় মাত্র যেটা ওদের ওপরে সকালের রোদ পড়াটা আটকায়। এখন আবার ওটা তেমন একটা পাহাড় যেটায় চড়া থেকে ওকে কোনোকিছুই আটকাতে পারবে না। আপার টাওয়ারে আমরা চড়বই, এব্যাপারে ও এতটাই আত্মবিশ্বাসী ছিল যে অভিযানটা ঘটার আগেই ও দৃশ্যটা তুলে রাখছিল। আমি ভেবেছিলাম “এই না হলে পেশাদারিত্ব,” আর সত্যিই এজন্য ওকে তারিফও করেছি। সদ্য সদ্য যা ঘটিয়ে এসেছি আমরা, তারপর আমি যখন খালি বিশ্রামের কথাই ভাবছি, ও ইতিমধ্যে চড়ার কথা ভাবতে শুরু করে দিয়েছে দেখে আমি সত্যিই মুগ্ধ। ও যখন বেশ খানিকটা দূরে চলে গেছে পেছনে বরফের ওপর ওর পায়ের ছাপগুলো আঁকাবাঁকা এলোমেলো লাগছিল। ভার নেমে গেল, মনে হল, ‘তাহলে পুরোপুরি ফিট হয়নি ও।’
চেনা রাস্তা ধরে বেস ক্যাম্পের দিকে রওনা হতে হতে আমার সাড়ে এগারোটা বেজে গেল। ‘বোধহয় আমেরিকানরা নীচে থাকতে পারে’ আমাদের চেনা উপত্যকার দিকে মোড় নিতে নিতে ভাবছিলাম। গ্রাবরেখার পাশ দিয়ে নামতে নামতে চারপাশের জমিটা দেখে অদ্ভুত একটা অনুভূতি হচ্ছিল, কিন্তু ঠিক নিশ্চিত হতে পারছিলাম না, যত পায়ের ছাপ দেখছি সেগুলো আমার আর জো-র আগে করে যাওয়া কিনা। হতে পারে কোনো জন্তু জানোয়ারের করা। মাঝে মাঝে ছোটো ছোটো পাথর ছড়ানো ছিটানো; কয়েক ফুট যেতে না যেতেই কিছু না কিছু সামান্য অন্যরকম ঠেকছে। বেসক্যাম্পের দিকে বাঁক ঘুরতেই কেমন একটা আশঙ্কা বোধ হল। এগোতেই দেখি যথারীতি কুয়াশা নেমে এসেছে নীচে আর আমাদের ঘাঁটিটা কেমন ভুতুড়ে লাগছে। নাহ্ কিচ্ছু ঘাঁটেনি। অজানা অভিযাত্রীর জন্য আমাদের ছেড়ে যাওয়া বার্তার কাগজটা অবধি একচুল এদিক ওদিক হয়নি। আমি বাক্সগুলোর ওপর হামলে পড়লাম আর খুঁজে পেতে মার্স-চকোলেট বার করে মুখে পুরে দিলাম, খুব অভাব বোধ করেছি ওটার। কবে থেকে ভাবছি ওটার কথা!
স্টোভে চায়ের জল চাপিয়েছিলাম, সেটা সবে ফুটতে আরম্ভ করেছে ঠিক সেসময়েই জো পৌঁছোলো।
“নীচে আসবার সময় চারপাশটা অন্যরকম কিছু খেয়াল করেছ?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
না, ও দেখেনি। আমরা হুইস্কির বোতলটা খুলে আয়েস করে বসলাম, দুজনেই নিরুদ্বিগ্ন ছিলাম, কথা বলতে ইচ্ছে করছিল দুজনেরই, কিন্তু আগের দিনের পরিশ্রমটার পর দুজনের মধ্যে একটা দূরত্ব তৈরি হয়ে গিয়েছিল। আমি হাতের আঙুলগুলো অ্যান্টিসেপটিক দ্রবণে ভিজিয়ে পরিষ্কার করে নিয়ে ব্যান্ডেজ বেঁধে নিলাম, সেসময়টায় জো খাবার বানাল। সংক্রমন না হয়ে যায় এজন্য সেপট্রিন ওষুধ চালু করে দিলাম। অফুরন্ত খাবার, অফুরন্ত চা-কফি – পুরো স্বর্গে আছি যেন। আমরা নীচ থেকে সবচেয়ে ছোটো এবং সবচেয়ে কার্যকরী প্রাইমাস স্টোভ নিয়ে এসেছিলাম, ওটা সোঁ সোঁ করে জ্বলছিল, পরপর পানীয়, ধোঁয়া ওঠা পুডিং, আর বড়ো করে খাবারদাবার বানানো হচ্ছিল তাতে।
বেস ক্যাম্পে পরের দিনটাও আরাম করা আর পেটের “ক্ষতিপূরণ” চলল। ভবিষ্যতের কথা আলোচনা না করে সমতল জমির নিরাপত্তা, উষ্ণ ও সহজ জীবন চেটেপুটে উপভোগ করছিলাম।
জো, ছোটো ছোটো মজার গল্প বলায় ওস্তাদ। ও এক একটা গপ্প বলবে খুব হালকা মেজাজে সহজ করে, আর প্রায় সব ক্ষেত্রে গল্পের শেষটায় একটা সূক্ষ্ম মোচড় বা একটা বিষয় থাকত। ওগুলো কখনোই বিশেষ করে নিজেকে জাহির করার জন্য ছিল না, যদিও ওগুলোর মধ্যে দিয়ে ও একজন সাধারণ মানুষ হিসেবে প্রতিভাত হত যে কিনা সবসময় অদ্ভুত এবং আশ্চর্য সুন্দর জায়গা অথবা ঘটনায় কিংবা বিপদসংকুল পরিস্থিতিতে জড়িয়ে পড়ে ।
অক্টোবরের চার তারিখ সকালে বেস ক্যাম্পে ও খুব মজা করে ‘খাওয়া’ এবং ‘পড়া’র দ্বৈরথ নিয়ে বকবক করছিল। ও সবসময়েই দার্শনিকতার জায়গাটাকে এড়িয়ে যেত, ওর গল্পগুলোর মূল শাঁস থেকে নৈতিক উপদেশ বা নীতিকথা বার করে আনার চেষ্টাই করত না। যেন মনে হত ও কথাবার্তা চালাতেই চাইছে না। আমিও তাইই করতাম। ওর গল্পগুলো একটেরে হয়ে থাকত। বাকিটা আমার বোঝার ওপর। কখনো কখনো ও একই গল্প বলত যেটা আমি আগেও শুনেছি, অথবা দুবারও শুনে থাকতে পারি অথবা পাহাড় সংক্রান্ত ওর কোনো লেখাতেও পড়ে থাকতে পারি। আমি ওকে ধরিয়ে দিইনি, বলিনি সেসব – সম্ভবত আমিও ওই একই কাজ করছিলাম! আমাদের নিজেদের ব্যক্তিগত জীবনের খুঁটিনাটি নিয়ে একে অন্যেকে কদাচিৎ জানার উৎসাহ দেখাতাম – কেউ একটা কিছু উল্লেখ করতে চাইলে, সেটা তার ব্যাপার। পাহাড়িয়াদের জগতে জো এত এত লোকের সঙ্গে যোগাযোগ তৈরি করে ফেলেছিল যে ওকে হিংসে হত, আর সেটা ও করেছিল স্রেফ নিজের ব্যক্তিত্ব এবং সাফল্যের শক্তিতে। ও ছিল সত্যিসত্যিই “ছেলের মতো ছেলে”। আমার কখনোকখনো মনে হয়েছে আমার সঙ্গে লোকজনের চেনাজানা হয়েছে বেশিরভাগই ব্রিটিশ মাউন্টেনিয়ারিং কাউন্সিলের জাতীয় আধিকারিক হিসেবে। ক্লাইম্বারদের সামাজিক দুনিয়ায় আমি তেমনভাবে ঘনিষ্ঠ মাখোমাখো সম্পর্ক কখনোই তৈরি করতে পারিনি। ওই বৃত্তের ব্যাপারটা এমনই ছিল, যে তারা যতটা প্রকাশ করত আড়ালেও রাখত ততটাই।
জো-র মধ্যে নিষ্ঠুরতা এবং বিবেচনার অদ্ভুত মিশেল ছিল। মাঝে মাঝে ও চিন্তাভাবনার ক্ষেত্রে অসাধরণ নিদর্শন রাখত। যাইহোক, আমরা কেবল দুজনমাত্র ছিলাম; কাজ ভাগাভাগি করে নিতে হতই, এবং প্রায়ই তর্কাতর্কি করে ও আমাকে দিয়ে কোনো কাজ করিয়ে নিত – ছোটোখাটো জিনিস, যেমন জল নিয়ে আসা অথবা পরের খাবারটা বানানো – অন্যথায় যেটা আমি থেবড়ে বসে ভাবতাম ওইই করবে। আমায় ‘সুরক্ষিত’ ক্লাইম্বার বলে আমার পেছনে লাগত ও, যাদের কপাল খুব ভালো আর কখনোই সত্যিসত্যি ভুগতে হয়নি, বলত আমি নাকি অন্যদের দিয়ে আমার জন্য কাজ করিয়ে নিতে একরকম পারদর্শীতা অর্জন করেছি। ইয়ে, এটা বলে ও কোনো সমবেদনা দেখাত না, তা আমি জানতাম। আমি আশঙ্কিত হয়ে ওকে অভিযোগের সাফাই দিতাম। সমস্যাটা ছিল আমি বসে বসে ভাবনায় বিভোর হয়ে যেতাম আর যদি ছোটোখাটো কাজও কিছু করার থাকত, ঘাড়ের কাছে না এসে পড়া পর্যন্ত তা নিয়ে ভাবতামও না, স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে করতামও না। ক্যাম্পের চৌহদ্দিতে জো অনেক বেশি গোছানো এবং কর্মদক্ষ ছিল।
জো আর আমার সম্পর্কের মধ্যে একটা ‘খোঁচা’ সবসময় ছিল। এই ভঙ্গুর অতি-পরিচিতি নিয়ে আমরা একে অন্যেকে খেপাতাম, মজা করতাম, প্রায়ই সরাসরি মারাত্মক কিছু বলার মুখে দাঁড়িয়ে থাকতাম। ব্যাপাটা জো আমার চেয়ে কম গুরুত্ব দিয়ে দেখেছিল –
“একে অন্যের প্রতি বিভিন্ন জিনিসে একটা অসহযোগিতার বৈরিভাব ছিল, তেমন কিছু নয়। যদি কোনো তক্কাতক্কি বেশি উত্তপ্ত হয়ে উঠত আমরা ক্রমশ একটা প্রবচনে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছিলাম, ‘চিন্তা কোর না, আমরা যখন ফিরে আসব, সব ঠিক হয়ে যাবে’ এটা একটা সঙ্কেত ছিল যার মানে আমরা দুজনেই মেনে নিচ্ছি যে যেকোনো উত্তেজনাই আমাদের অস্বাভাবিক পরিস্থিতির জন্যই তৈরি হচ্ছে।”
দেখা যাচ্ছে আমাদের কেউই কখনো নিজেকে সম্পূর্ণ মেলে দেয়নি। একটা উদ্বেগ-উত্তেজনা ছিলই যা আমাদের আলাদা করে রেখেছিল আর এটাই আমাদের ব্যক্তিসত্তা ধরে রাখতেও সাহায্য করেছিল। আমাদের একে অন্যের চড়ার দক্ষতা সম্পর্কে দুর্দান্ত পারস্পরিক শ্রদ্ধা ছিল। এটা, আমার ক্ষেত্রে, আমার যৌবনের দিনগুলোয় কঠিন কঠিন ক্লাইম্বিং করবার সময়ের এক্কেবারে উলটো ঘটনা, হিন্দুকুশে সেসময়ে নিজেকে বডডো একলা লাগত। সেখানে দলে আমিই একমাত্র লোক ছিলাম যার মধ্যে নৈপুণ্য এবং অনবধানে দল বেকায়দায় পড়ে গেলে টেনে তোলার ক্ষমতা দুইই ছিল। জো-র সঙ্গে আমি জানতাম, ও যখন লিড করবে, আমি নিশ্চিন্তে আরাম করতে পারি, কারণ ও এতটাই অনুপ্রাণিত ছিল যে সামনের পাথরখণ্ডটা ও চড়ে ফেলবেই।
সেদিন অবশ্য পাথর-চড়ার বিষয়টা প্রায় ওঠেইনি। জো কথা বলছিল, যা ও কখনোসখনো করে থাকে, নিজের ছেলেবেলা আর বাড়ি নিয়ে। ও খুব গোঁড়া ক্যাথলিক পরিবার থেকে আসা, ওর বাবা মিড্লসবরোতে স্থানীয় একটা স্কুলের তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন। ও ছিল বড়ো ছেলে, চার ভাই আর পাঁচ বোন। এবারে অভিযানের জন্য বাড়ি ছেড়ে আসার আগে সপ্তাহান্তে অল্প সময়ের জন্য বাড়িতে কাটিয়ে আসে। অবশ্য বাড়িতে ও এটা বলে আসেনি যে এটা ওর শেষ দেখাও হতে পারে। ওরা খুশিই হয়েছিল ওকে পেয়ে। এমন বিপজ্জনক কাণ্ডকারখানা করতে ওরা তাকে বারণই করত, তবে কিনা বহুদিন বলে বলে ওকে নিরস্ত করতে চেয়ে ব্যর্থ হয়েছে, কেবল মাঝে মাঝে এখন ওকে হালকা করে উপদেশ দেয় যে এবারে কাজের মতো কাজে সময়টা দিক। ও যখন ক্লাইম্বিং আরম্ভ করে বাড়ির প্রবল আপত্তির কারণে ওর চিন্তা হত – ওর আত্মবিশ্বাসেও চিড় খেয়ে গিয়েছিল। ক্রমশ দিনের পর দিন আল্পস থেকে চড়ে-টরে সশরীরে গোটাগুটি ফিরে আসতে থাকলে বাড়ির লোক এটায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েন। ক্রমে ওরাও বুঝতে পারে পাহাড়ে আরোহণে আরো অনেক কিছু আছে, শুধুই ঝুঁকির জন্য ঝুঁকি নেওয়া নয়, তখন ওরা ওর ক্লাইম্বের ব্যাপারে বেশি বেশি আগ্রহ দেখাতে শুরু করে। আগের আরোহণগুলোতে জো-র মা জো-কে নানান সাধুসন্তদের মাদুলি দিয়ে দিত সঙ্গে নিয়ে যাবার জন্য; চ্যাঙাব্যাঙের জন্য কিছু দেননি। ও বেরোনোর সময় এই প্রথমবার “সাবধানে থেকো”-র বদলে তিনি বলেছিলেন, “আনন্দ করো।”
তেরো থেকে একুশ বছর বয়েসের মধ্যে জো অ্যাশো কলেজে যাজক হবার জন্য প্রশিক্ষণ পায়। ও একটেরে ঘেরাটোপে থাকা ওই জায়গাটার অদ্ভুত, কৌতূককর গল্পগুলো বলত; মানসিক পীড়ণ এবং অস্বাভাবিকতা যাকিছু সমস্ত আবাসিক প্রতিষ্ঠানগুলিতে থাকত, ওখানে তার সবটাই বেশি বেশি ছিল। আট বছর ওকে বাইরের পৃথিবীর সঙ্গে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন করে রাখা হয়েছিল; খবরের কাগজ, টেলিভিশন, মদ, বান্ধবীদের সংসর্গ সবকিছু থেকে বঞ্চিত করে রাখা হয়েছিল। ভোর ছটা থেকে শুরু করে সারা দিনে সাতবার ধর্মীয় ভজনসাধন করতে হত। জো-র কিশোরবেলায় ও যখন বড়ো হয়ে উঠছে, ক্রমশ অ্যাশো-র কর্তৃপক্ষের সঙ্গে ওর ঝামেলা বাড়ছিল, এত কড়া অনুশাসন ওর কাছে অর্থহীন মনে হত, ফলে ও তীব্র প্রতিবাদ করত এসবের। একবার বিরাট ঝামেলায় জড়িয়ে পড়েছিল, এক ক্রিসমাসের সময় সহপাঠিদের সঙ্গে পালিয়ে গিয়ে কাছের একটা বাগান থেকে নিয়ে এসে ক্রিসমাস ট্রি পুঁতেছিল। প্রতিষ্ঠানের জীবন জো-র জন্য ছিল না, ও অনুভব করেছিল যে ও যদি ‘যা হচ্ছে হতে দাও’ গোছের করে সংগঠনের ঢেউতে ডুবে যায় ও ওর নিজের ব্যক্তিসত্তা হারিয়ে ফেলবে আর ক্রমশ অল্প অল্প করে এক্কেবারে বদলে যাবে। তারপরই, কলেজের কাছেই একটা খাদানে ও আবিষ্কার করে ‘ক্লাইম্বিং’। গোড়ার দিকে ওর পাথগর-চড়া ছিল কোনো তালিম ছাড়াই। অনেক বন্ধুবান্ধবও ছিল না যে একসঙ্গে চড়তে যাবে, ফলে প্রায়ই একলা যেত। ওর বন্ধুরা ওকে বরাবরই কুঁড়ে বলত, ওও কখনো প্রথাগত খেলাধূলার প্রতিযোগিতা বা রেষারেষিতে উৎসাহ পেত না। কিন্তু ক্লাইম্বিং-এ ও অন্যরকম কিছু খুঁজে পেয়েছিল। এতে শঙ্কিত হয়েছিল বটে তবু মুগ্ধও হয়েছিল। ওটা এতটা উদ্দেশ্যহীন এবং যুক্তির বাইরে ছিল যে ওর বিদ্রোহী উলোঝুলো ভাবটা একটা মুক্তির পথ খুঁজে পেয়েছিল তার ভেতর।
অ্যাশো ছেড়ে জো বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজবিজ্ঞান পড়তে যায়। তার সাত বছর পর আমরা চ্যাঙাব্যাঙ চড়ার চেষ্টা করছিলাম আর আমার কাছে মনে হচ্ছিল জো তখনও অ্যাশোর দিনগুলোর বিরুদ্ধে লড়াই করছে। বেস ক্যাম্পে থাকার সময় সারাটা দিনের মধ্যেও ওর মনমেজাজ পালটে পালটে যেত। খুব কথা বলছে, বলতে বলতে হঠাৎ গম্ভীর আর থমথমে হয়ে গেল। ওর এই গুরুগম্ভীর ভাব আমায় ভয় পাইয়ে দিত, আমি ভাবতাম আমারও যদি এই গুণ থাকত – ভাবতাম চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণের জন্য এই গুণটাই থাকা দরকারি কিনা। ও কি আমার আমার চেয়েও একধাপ বেশি ঝুঁকি নিতে প্রস্তুত ছিল? আমি যেমন পাহাড়ে থাকলেই সবসময় মহা খুশি, জো-কে ঠিক তেমনটা মনে হত না। মনে হয় একটা বিষয়ে ওর দুশ্চিন্তা থাকত যে ইংল্যান্ডে ফেরার পর, সেখানে ওর জন্য স্থায়ী কোনো কাজ নেই। তথাপি ও বিদ্রোহী। হয়তো এই পাহাড়টাই কি আমাদের দুজনের ভেতরেই কিছু ধুয়ে মুছে সাফ করে দিচ্ছিল? আমি স্ক্যানডেনেভিয়ার তীরভূমির কথা ভাবছিলাম, শেষ হিমযুগের বিপুল ভার লাঘব হবার পর সামঞ্জস্য আনতে এখনও প্রতি বছর কয়েক ইঞ্চি করে উঠে চলেছে, যদিও হিমযুগ শেষ হয়েছে কয়েক হাজার বছর আগে। জো-কে ওই রকম লাগত, ক্রমাগত নিজেকে ঠিকঠাক করেই চলেছে। ও কি বরাবরই এমনি থাকবে?
শেষ বিকেলে আমরা বই খুলে বসলাম। জো এখন পড়ছে ‘জেন অ্যান্ড দ্য আর্ট অব মোটরসাইকেল মেনটেনেন্স’। আমার মনে হয়েছিল ওটা গোঁড়া এবং গোলমেলে বই কিন্তু এমন একটা বই যেটার জন্য কেতাবি পরিবেশ এবং পড়াশোনার নিয়মনিষ্ঠার প্রয়োজন, একটা অভিযানে অমন একটা বই আমি তালিকায় রাখতাম না। জো স্রেফ এব্যাপারটাকে সম্পূর্ণ নাকচ করেছিল। ব্যাপারখানা এমন যে ও ভেবেছিল জীবনের সূক্ষ্ম দার্শনিক কথাবার্তার আলোচনায় অনেকটা সময় নষ্ট করেছি। এবারে হাতেকলমে চাই, আরোহণে পুরোপুরি জড়িয়ে পড়তে চাইছিল ও। সামান্য কিছু জিনিসের মধ্যে এই একটা কাজ ওকে বেশ তৃপ্তি এনে দিত।
জো নিজেকে দেখত বাস্তববাদী এবং সাদামাটা লোক হিসেবে। আমি ছিলাম রোমান্টিক এবং ভাববাদি। আমার মধ্যে এমন অনেক কিছু জো দেখতে পেত যা থেকে মুক্তি পেতে ও সেসব ছেড়ে দেবার চেষ্টা করছিল। ফলে কোনো কোনো বিষয় বা অনুভূতি আমার কাছে বিশাল গুরুত্বপূর্ণ হলেও আমি উভয়কেই বিব্রত না করে সেগুলো আলোচনা করতে পারতাম না।
আমি জোলা-র ‘জার্মিনাল’ পড়ছিলাম। বই পড়াটা আমায় সাহায্য করে কেননা এর সঙ্গে পাহাড়ের এক্কেবারে কোনো সম্পর্ক নেই আর আমাকে সম্পূর্ণ অন্য এক জগতে নিয়ে যায়। পর্বতারোহীদের কাছে অনুক্ষণ এক জিনিস চিন্তা করাটা সবসময়েই বিপদের – আমি দেখেছিলাম সেই বিকেলে দীর্ঘ সময় ধরে পড়াশোনাটা আমার চিন্তাভাবনা এবং নীতিবোধে একরকমের স্বাভাবিক ভারসাম্য ফিরিয়ে দিয়েছিল। কেননা এমন এক জনশূন্য এবং প্রবল বৈষম্যপূর্ণ জগতে আমরা ছিলাম, ভয় এবং উল্লাসের মধ্যে, বিপদ ও নিরাপত্তায়, জীবন ও মৃত্যুর মধ্যে, যে কঠিন পরিশ্রম করে বেঁচে থাকা মানুষগুলোর আশঙ্কা ও কামনার মধ্যেকার সূক্ষ্ম ভারসাম্যের নতুন অর্থ তৈরি হচ্ছিল। ভয়াবহ কাজের পরিবেশ এবং সামাজিক অবস্থানে থাকা উত্তর ফ্রান্সের খনিতে কাজ করা লোকগুলোর কঠিন সংগ্রাম আমাকে ভাবাচ্ছিল, আমাদের অভিযানের দিকে একটা প্রশ্নচিহ্ন ছুঁড়ে দিচ্ছিল।
ফ্রান্সের খনিশ্রমিকদের মতো নয় কিংবা প্রায় একইরকমভাবে গাড়োয়ালের মানুষদের প্রতিদিনকার কঠিন পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার লড়াই করার মতোও নয়, জো আর আমি এখানে টিকে থাকার পরিবেশ-পরিস্থিতি খুঁজছিলাম। আমরা টিকে থাকার লড়াই চালাচ্ছিলাম পারিপার্শ্বিক চাপে নয়, কেননা ওরকম একটা অবস্থা আমরা নিজে থেকে জোর করেই বেছে নিয়েছিলাম। আমাদের অভিযানটা একটা শখের বিলাস ছিল, আমাদের সামর্থ্য ছিল তা উপভোগ করার, ওটা ছিল পুরোপুরি নিজেদের অভিলাষ। পাহাড়িয়া লেখক জিওফ্রে উইনথ্রপ ইয়ং, একবার লিখেছিলেন, “আমাদের গ্লানিকর অভিযান, অকারণের রাস্তায় অযাচিত পাহাড়ের মাথায় চড়তে গিয়ে ডেকে আনা বিপদের কোনো যৌক্তিকতা বা নীতিগত সাফাই থাকতে পারে না।” এটা একটা সৎ ভাবনা ছিল, জো সেটা মানত বলে আমার মনে হয় না। পড়তে পড়তে জার্মিনাল-এর ভিড়ের দৃশ্যগুলো আমার মনের চারপাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে এসে আছড়ে পড়ছিল আর আত্মজিজ্ঞাসা তুলছিল, উইনথ্রপ ইয়ং ক্রমে আমার মনের গভীরে মিলিয়ে যাচ্ছিল। আমার হেড-টর্চটা ভেঙে গিয়েছিল। জো ওটা মেরামত করে দেওয়ায় আমি পড়তে পারছি। একশো বছর পেরিয়ে জোলা আমার হাত ধরে উত্তর ফ্রান্সের অন্ধকার দিনগুলোয় নিয়ে ফেলেছিল, রোমাঞ্চিত করে তুলেছিল। ইতিমধ্যে বাইরে আবহাওয়া শান্ত হয়ে আসছিল। ঋষিকোটের ওপর ঝকঝকে চাঁদ উঠেছিল। রাত সাড়ে দশটায় আমি শেষ পাতাটা পড়া শেষ করলাম। শাইনিং মাউন্টেন-এর চিন্তাভাবনারা একটা গোটা দিন অপেক্ষায় ছিল।
৫ অক্টোবর সকালে আমাদের মন আবার ধীরে ধীরে সমস্যাগুলোর দিকে ফিরতে শুরু করল। জো আর আমি লন্ডনে ফিরে যাবার জন্য ১৮ অক্টোবরের বিমানের টিকিট কেটেছিলাম। আমরা জানতাম এখন আমরা আবার চড়ার জন্য পাহাড়ে ফিরে গেলে বিমান ধরতে পারব না, পরে টিকিট পেতে সমস্যাও হতে পারে। পরিকল্পনা বদলের কথা এখন আমাদের বাবা-মায়েদের জানাতেও পারব না, ওরা আমাদের অপেক্ষায় থাকবেন এবং দুশ্চিন্তা শুরু করে দেবেন। ১৮ অক্টোবরের বিমান যদি ধরতেও পারি, তাও আমার কাজে যোগ দিতে দু-সপ্তাহ দেরি হয়ে যাবে। আর যদি আরও পরে গিয়ে পৌঁছাই, খুব সম্ভব আমি চাকরিটা খোয়াব। কিন্তু চড়ার ভাবনাটা ত্যাগ করার কথা মাথাতেও আসেনি। এমনকি বেস ক্যাম্পে নেমে আসার সময়েও আমরা ফের চড়ার বিষয়টা সম্পর্কে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ ছিলাম। কোনো প্রশ্ন ছাড়াই সিদ্ধান্তটা নেওয়া হয়েছিল, বেছে নেওয়াটা খুব সহজ ছিল, বাড়ি থেকে ৬০০০ মাইল দূরে জীবনের ঝুঁকি নেওয়া। দুজনে মিলে একটা শক্তপোক্ত, শক্তিশালী দল তৈরি করেছিলাম আমরা, একমন একপ্রাণ, একটাই লক্ষ্য একটাই প্রেরণা – চ্যাঙাব্যাঙের পশ্চিম দেওয়াল চড়তে হবে। আমরা যদি বড়োসড়ো কোনো অভিযানে আসতাম পুরো অবস্থাটা আরো অনেক জটীল হত। ওটা খুব সম্ভবত আরও হালকা চালেরও হত। হতে পারত সেসময় প্রচুর জ্ঞানট্যান দেবার সুযোগও থাকত যা এধরনের আয়েসি আরোহীদের দলে সবসময়েই থাকে। আমরা পশ্চিম দেয়ালটা চড়ব আর এটাই এখন পৃথিবীর সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠছে। কিছুই আমাদের রুখতে পারবে না। ঝুঁকি নেবার অনবরত চাপ, সপ্তাহের পর সপ্তাহ যা আমাদের সতর্ক হয়ে থাকতে বাধ্য করেছিল, এমন একটা তীব্রতা এনে দিয়েছিল যে ফিরে দেখার সময়ও, ভীতিজনক ছিল। পুরো ঝুঁকির কাজটাই আমাদের জীবনের চেয়ে বড়ো হয়ে উঠেছিল। তবু একই সঙ্গে আমাদের যৌথ সামর্থ্য আমাদের দুজনের গুণাবলীর বাইরে, একটা তৃতীয়, অদৃশ্য গুণের জন্ম দিয়েছিল, যার ওপরে আমাদের দৃঢ় বিশ্বাস ছিল।
জো সামনের অসমাপ্ত কাজটার সম্ভাব্য বিপদটা টের পেয়েছিল-
আমরা দুজনেই কাজটা শেষ করে ফেলতে চাইছিলাম। আমি নিজের জেদে নিজেই অবাক হয়ে যাচ্ছিলাম। আর কোনো আনন্দ ছিল না ওতে, শুধুই প্রবল পরিশ্রম বাকি ছিল; এমন এক ভাগ্য পরীক্ষা যার কদর করতেই হত, এই অন্ধকার এবং নিরুৎসাহ সময়ের প্রেক্ষিতে, বিশ্বাস রাখতে হত ক্লাইম্বটা শেষ করার পরেও ছিঁটেফোটা তৃপ্তি হবে না।
কাটাছেঁড়াটা পুঙ্খানুপুঙ্খ হয়েছিল। ঝড়ের মধ্যে হ্যামকে কাটানো তিন তিনটে দুঃস্বপ্নের রাত্রি কাটানোর সময় আমরা কী কী ভুলচুক করেছিলাম তা নিয়ে বারবার আলোচনা করেছি। বারবার ফিরে গেছি যেসব সরঞ্জাম ব্যবহার করেছি, সেগুলো এবং কৌশলগত দুর্বলতাগুলোর কাছে। আমরা হেরে গিয়েছিলাম কারণ যেমন আবহাওয়ায় আমরা পড়েছিলাম হ্যামকগুলো তা সামলানোর মতো উপযুক্ত ছিল না। আমরা রান্না করতে পারিনি, আর তার ফলে, চার দিন ধরে খাবার-দাবার বা জল খাওয়া ঠিকমতো হয়নি। রান্না যদি না করতে পারি, তাহলে আমরা দেওয়ালটা কোনোদিনই চড়তে পারব না। অত উচ্চতায় হ্যামকে ঢোকা বেরোনোর পরিশ্রমটা বড্ড ক্লান্তিকর ছিল আর দরকারি কোনো জিনিস হাত ফসকে ফেলে দেওয়াটা ছিল স্রেফ সময়ের অপেক্ষা। সম্ভবত সবচেয়ে অসুবিধেটা ছিল গোটা সময়টা জুড়ে আমাদের একে অন্যের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে থাকা। সন্ধেবেলা যখন তাঁবুতে একসঙ্গে থেকেছি তখনও কোনো হালকা, সহজ আলোচনা দুজনের মধ্যে হয়নি। বেশ কয়েক ফুট দূরত্বে আলাদা আলাদা, পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগ করতে না পেরে, যে যার নিজের চিন্তায় বিভোর, একা একা আবহাওয়ার সঙ্গে লড়াই ছিল কেবল। কোনো হালকা চালের রসিকতা করে ঘটনার প্রেক্ষিতটা বোঝানো অসম্ভব ছিল। আমরা অ্যডভান্স বেস ক্যাম্পের তাঁবুর ভেতরের অংশটা সঙ্গে নিয়ে যাবার ব্যাপারে আলোচনা করলাম, যাতে ওটাকে প্ল্যাটফর্মের ওপরে বরফ কেটে জায়গা বার করে লাগানো যায়। ছোট্ট তাঁবুটাকে শক্তপোক্ত করতে আমরা দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরার নীচে জাপানিদের ফেলে যাওয়া সরু সরু বাঁশের লাঠিগুলোর কয়েকটা নিয়ে যেতে পারি। খালি ঠাকুর ঠাকুর করে যথেষ্ট চওড়া একটা সমান অংশ যদি কেটে নিতে পারি আর তাঁবুর কাপড়টা বাতাস আর বরফের ঝাপটাটা সামলে দিতে পারে।
আমরা থাকাকালীন ওপরের দিকে হাওয়ার বেগ প্রতিদিন ক্রমাগত বেড়েই চলেছিল, সুতরাং পাহাড়ের দেওয়ালটা চড়বার জন্য ফের লেগে পড়ার আগে আমাদের পোশাক আশাকের ব্যাপারটা ফিরে ভাবা হল। এমনকি বেস ক্যাম্পেও এক মাস আগের চেয়ে অনেক বেশি ঠান্ডা। জো একটা অতিরিক্ত ডুভেট খুঁজে বার করল, ওটা সঙ্গে আনা হয়েছিল বেস ক্যাম্পে পলটার সঙ্গে যে পোর্টার থাকবে তার জন্য। আমি ঠিক করলাম আমার এভারেস্টে ব্যবহার করা ডাউনস্যুটটা নেব।
আমরা জানতাম যে এবারেরটাই আমাদের শেষ চেষ্টা আর এবারে সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দৌড়োতে হবে। গতবার এই এলাকা থেকে বেরিয়ে যাবার সময় জো-কে শীতের ঝঞ্ঝার পাল্লায় পড়তে হয়েছিল, সেটা ছিল অক্টোবরের ১৫ তারিখ। এটা পরিষ্কার যে পাহাড়ের ওপরে এমাসের শেষের দিক অবধি থাকাটা আত্মহত্যার সামিল হবে। আমাদের কাছে যেহেতু একসপ্তাহ চলবার মতো হালকা ওজনের, প্যাকেট করা খাবার যথেষ্ট পরিমানে আছে আমরা স্থির করলাম ওপরের রিজ ক্যাম্প অবধি সঙ্গে করে আমাদের প্রাইমাস স্টোভ আর প্রেসার কুকারটা নিয়ে যাব যাতে যতক্ষণ অবধি পারা যায় স্থানীয় খাবার, ডাল-ভাতটা ফুটিয়ে নিতে পারি।
আমাদের সরঞ্জাম গোছগাছের সময়, একটা ফোল্ডার-ভর্তি পাহাড়ের গোটা ঢালটার অনেকগুলো ছবি খুঁজে পাওয়া গেল। ঘণ্টাখানেক ধরে ওগুলো দেখলাম, দুজনকেই দুজনকে বোঝাবার চেষ্টা করলাম যে সাফল্য থেকে আমাদের বিচ্ছিন্ন করে রেখেছে স্রেফ হাজার ফুটের কিছু বেশি উচ্চতার একটা কঠিন আরোহন। জো কয়েকটা ছবি ওষুধের বাক্সে পুরে নিল। আপার টাওয়ারে রাস্তা খুঁজে পাওয়াটা আপাতভাবে গোলমেলে মনে হচ্ছিল, তো চড়বার সময়ে রাত্রে আলোচনায় ওগুলো কাজে লাগতে পারে যাতে কতটা এবং কোনদিকে চড়েছি বোঝা যায় ।
সেই সকালে সবচেয়ে বড়ো সিদ্ধান্ত যেটা নিতে হয়েছিল যে আমরা কি আমাদের গোড়ার যে পরিকল্পনা, অর্থাৎ যদি চড়তে পারি এবং চড়বার পর পাহাড়ের অন্যপাশ দিয়ে নেমে আসব, সেটাতেই স্থির থাকব নাকি নয়। হ্যামকের কাণ্ডটা ঘটার পর আমাদের হালত দেখেটেখে ধার বরাবর অন্যপাশ দিয়ে নামার ব্যাপারে আমার একটু দুশ্চিন্তাই হচ্ছিল। এছাড়াও আমি ভাবছিলাম, দক্ষিণ-গাত্র বরাবর পর্বতাভিযানের অভিযাত্রীরা অ্যাদ্দিনে চ্যাঙাব্যাঙ গ্লেসিয়ার ছেড়ে চলেও গেছে, ফলে আমরা হাল-খারাপ অবস্থায় নামলে তারা আমাদের সাহায্য করতেও পারবে না। যাহোক, এর বিকল্প হিসেবে পশ্চিম দেয়াল বরাবর নেমে আসাটা অবশ্য যে খুব একটা মনোহারী ব্যাপার তা নয়, তবে কিনা আমাদের দড়িদড়াগুলো আমরা উদ্ধার করে নামতে পারব। দেওয়াল বরাবর প্রায় বেশিরভাগটাই আমাদের অ্যাবসেইল করে নামতে হবে, সঙ্গে পথ দেখানোর জন্য ফিক্স রোপের কোনো সাহায্যও পাওয়া যাবে না।
খুবই কঠিন ছিল সিদ্ধান্তটা নিয়ে ফেলা, ঠিক করলাম পরের দিন যখন অ্যডভান্স বেসক্যাম্প থেকে শিপটন কলে ওঠার জন্য ঝুলতে থাকা দড়ির গোড়া অবধি হেঁটে যাব, ততক্ষণের জন্য ওটা মুলতুবী থাক। ওখানে পিটনগুলো ভালো করে দেখে টেখে নেওয়া যাবে, পাছে যদি এদিক দিয়েই নামতে হয়, এছাড়াও উদ্দেশ্য ছিল খানিকটা দড়ি যদি উদ্ধার করে আমাদের মূল চড়ার পথের নীচের দিকটাতে লাগিয়ে রাখা যায় পাছে পশ্চিম দেওয়াল বরাবর নেমে আসতে হয়!
গত কয়েক সপ্তাহ এত পাহাড়-চড়া হয়েছে যে আমাদের সরঞ্জামগুলো বিচ্ছিরিরকম ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। জো সারাটা সকাল ধরে সেলাই টেলাই করে, ফেটেফুটে যাওয়া অংশগুলো ফের জায়গায় বসিয়ে আঠা লাগিয়ে, ওর গেইটারটা সারালো। আমাদের উলের দস্তানাগুলো রিফু করতে হত, ওভারস্যুটগুলোতে তাপ্পি লাগাতে হত আর ক্র্যাম্পনগুলোয় ধার দিতে হত; বোতাম লাগানোও বাকি ছিল। কাজটা বেশ মজাদার উপশমের ছিল। যথারীতি আমাদের বেরোনোর সময়টা পেছোতে পেছোতে বিকেল হয়ে গেল, আমরা ঠিক করলাম দুপুরের খাওয়া সেরে বেরোবো। তাঁবুর দরজায় রেখে যাবার জন্য নতুন করে বার্তাটা লিখলাম কাগজে, আগের ২৮ সেপ্টেম্বরের হেক্কর লেখাখানা কুটি কুটি করলাম।
একটু দূরে প্রেসার কুকারটা খুব জোর হিস হিস শব্দ করছিল, জো আর আমি গুছিয়ে রাখা রুকস্যাকের ওপর হেলান দিয়ে আধশোয়া হয়ে ছিলাম, এমন সময় দুজনেই দেখলাম নীচের গ্রাবরেখার উপত্যকা দিয়ে একটা লোক উঠে আসছে। খুব অবাক হয়ে গিয়েছিলাম। আমার নাড়ির গতি বেড়ে গিয়েছিল। এমন একটা অবস্থার কথা, ভুলেই গিয়েছিলাম যে এটাকে কীভাবে সামলাব – অন্য মানুষ! লোকটা আমাদের ভূতুড়ে বাড়ির সামনের প্রশস্ত জায়গাটায় আসতে আসতেই আমি আমার ক্যামেরায় জুম লেন্স লাগিয়ে সন্তর্পণে ওর কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম। জো-ও, লোকটা আসতে আসতে ওর ক্যামেরা বার করে ফেলেছিল, কিন্তু খোলাখুলি শান্তভাবে অন্যদিকের ছবি তুলছিল।
“হ্যালো”, আগ্রহের সঙ্গেই বললাম আমরা।
“হাই দেয়ার।” লোকটা আমেরিকান। আমাদের দেখে মনেই হল না ও আশ্চর্য হয়েছে।
আমরা ওর খবরাখবর সব চেটেপুটে নিলাম। লোকটার নাম নেকো কোলভিনস, দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরা বরাবর দুনাগিরি পর্বতাভিযানের সদস্য। অভিযাত্রী দলে নজন আমেরিকান, একজন মেক্সিকান এবং একজন ভারতীয় লিয়াজঁ অফিসার। কদ্দুর এগিয়েছে ওদের অভিযান সেসম্পর্কে বরং ভাসা ভাসা কথা বলল। মনে হল সপ্তাহখানেক আগে বেস ক্যাম্পে পৌঁছেছে।
“তোমাদের বেস ক্যাম্পটা কোথায়?” আমি জিজ্ঞাসা করলাম।
“খানিকটা নীচে, বাঁক ঘুরে কয়েকশো গজ দূরে।” ও উত্তর দিল।
“মরণ, বাঞ্চোত,” জো বলে ওঠে, “এই হল এক্কেবারে পোর্টারদের কাজ। কুঁড়ের দল। তোমাদের ঢপ মেরে ওখানেই ক্যাম্প করিয়েছে যাতে এই ওপর অবধি মালপত্র বয়ে আনতে না হয়।”
নেকোকে দেখলাম খুব আত্মবিশ্বাসী ওদের অভিযান নিয়ে আর তা নিয়ে আসল কথা না বলে এটা সেটা বকল। আমাদের খাবার তৈরি হয়ে এসেছিল, ওকে বললাম খেতে – মনে হল ও অবাক হল, তাড়াতাড়ি না করে দিল। তারপর দুনাগিরিতে ওরা কত কত ঠান্ডা-করা প্যাকেটের খাবার খাচ্ছে সেসব বলতে শুরু করল। ওগুলো জোগাড়যন্ত্র ওইই করেছিল। আমরা ওকে আমাদের চড়ার রাস্তাটা বললাম, আমাদের হ্যামক-পর্বও, কিন্তু ওকে তাতে খুব একটা আগ্রহী বলে মনে হল না।
“ও হ্যাঁ, জানতাম তোমরা এখানে আছ, নিশ্চই, আমরা তো এদিক দিয়ে কয়েকদিন হল আসছি যাচ্ছি। আচ্ছা ঠিকাছে, আমি এবারে এগোই। আমাদের অভিযানের দলনেতা এখন আসছে। শিগগিরিই এখানে এসে পড়বে। ও আমাদের ভারতীয় লিয়াজঁ অফিসারকে নিয়ে নীচে নামছে, বেচারা শরীরটা খুব ভালো বোধ করছে না। উচ্চতার জন্য, মনে হয়।” নেকো চলে গেল তারপর বাঁক ঘুরে অদৃশ্য হয়ে গেল।
“ওর সাজসরঞ্জাম সব ভালো ভালো আর নতুন, তাই না?” আমি বললাম।
“ও নিজে লোকটা তো পুরোনো।” জো উত্তর দিল।
আমাদের পরের দুজন অতিথি যখন পৌঁছোলো, ওদের জন্য আমরা তৈরিই ছিলাম।
“আমি গ্রাহাম স্টিফেনসন, লস অ্যাঞ্জেলেস” লম্বা লোকটা বলল। মধ্য পঞ্চাশের লোকটার একমুখ দাড়ি। “এ হল আমাদের লিয়াজঁ অফিসার, মনদীপ সিং।”
মনদীপ সিং-কে খুব একটা সুস্থ মনে হল না। আমি গ্রাহামকে জিজ্ঞাসা করলাম ওরা চড়ার জন্য দুনাগিরি কেন বেছে নিল। যুক্তরাষ্ট্রে বক্তৃতা দিয়ে বেড়ানোর সময় সিয়েরা ক্লাবে এরিক শিপটন একটা বক্তৃতা দিয়েছিলেন, সেই সন্ধ্যায় গ্রাহাম স্টিফেনসন ওঁকে বলেন হিমালয়ে চড়ার জন্য একটা ভালো কোনো শৃঙ্গের উল্লেখ করতে। শিপটন সেসময়ে যুক্তিযুক্ত লক্ষ্য হিসেবে দুনাগিরির দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরার নাম করেন। ১৯৩৬ সালে শেরপা আঙ থারকে-কে সঙ্গে নিয়ে তিনি ওটি চড়ার চেষ্টা করেছিলেন এবং প্রায় চড়েও ফেলেছিলেন। আমরা ওই অঞ্চলে অন্যান্য অভিযানের কথা জানতে চাইলাম গ্রাহামের কাছে। ও নন্দা দেবী আনসেওল্ড-এর মৃত্যুর খবর জানায়, কিছু ইটালির পর্বতারোহীদেরও আসার কথা ইতিমধ্যে, কলঙ্ক শৃঙ্গ অভিযানের জন্য। আমরা মনোযোগ দিয়ে খবরগুলো শুনছিলাম, মনে হচ্ছিল ইংল্যান্ড থেকে সদ্য সদ্য শ্যামোনিক্স ক্যাম্প সাইটে এসে উপস্থিত হয়েছি। জো যখনই কথা বলছিল, মুখ খারাপ করে ফেলছিল, মনে হয় না নিজেও টের পাচ্ছিল। এতদিন ধরে আমরা একা একা ছিলাম বলে আমাদের ভাষা খুব খারাপ হয়ে গিয়েছিল – কেউ কিছু মনে করার ছিল না। আমি বিব্রত বোধ করছিলাম। গ্রাহাম বিভ্রান্ত হয়ে গিয়েছিল কিন্তু ভদ্রই ছিল। আমরা ওকে চ্যাঙাব্যাঙের একটা ছবি দেখিয়ে সর্বোচ্চ উচ্চতার যে বিন্দুতে পৌঁছেছিলাম সেটা দেখালাম। ওর চোখমুখে প্রশংসা। আমরা ওকে বেস্ট অব লাক জানাতে, সে বলল, আমরা শীর্ষারোহন করে ফিরে এলে দেখা করবে – ওরা এখান থেকে ১২ অক্টোবর ফিরে যাবার পরিকল্পনা করছে। তারপর মনদীপকে সঙ্গে নিয়ে সে নেমে গেল।
জো আর আমি কিছুক্ষণ বসে রইলাম, সূক্ষ্মাতিসূক্ষ্ম সমস্ত কিছু উপলব্ধি করছিলাম, লোকটার হাবভাব, প্রতিটা শব্দ, গত আধঘণ্টা ধরে ওর বলা কওয়া সমস্ত ইশারাগুলি অবধি। আমাদের কথোপকথনের সুর, আমাদের পারস্পরিক সম্পর্ক বদলে গিয়েছিল। আমরা গত সাতাশ দিন ধরে অনুভব করে চলা একাকিত্বকে আর বোধ করছিলাম না। আমরা আবার প্রায় খেলোয়াড় হয়ে উঠেছিলাম – এমন কেউ যারা জানে আমরা কী করছিলাম। পাহাড়ে লোকজন রয়েছে। বোঝা কাঁধে তুলতে তুলতে আমরা এই সাক্ষাতের কথা অন্তহীনভাবে আলোচনা করে চললাম, শেষ অবধি কেবলমাত্র স্মৃতি হয়ে যাবার আগে ওগুলোর জরুরী কথাগুলো আমাদের মগজের পুষ্টি জুগিয়ে যাচ্ছিল।
“স্টিফেনসনের হাতের চুইনার্ড আইস হ্যামারটা দেখেছ?”
“মনে হচ্ছিল এক্কেবারে নতুন।”
“ওরা কোথায় এসে পড়েছে, ওরা জানেই না হয়তো।”
“ওকে দেখে মনে হল যেন অনেককাল আসছে।”
“আমেরিকান পর্বতারোহীদের মাপাটা কঠিন – ওরা এত রকমের হয়। তুমি সরঞ্জাম-পাগল “সিয়েরা কাপ” নামের লোকগুলোর নাম শুনেছ – ওই যে যারা অ্যালুমিনিয়ামের কাপ কোমরে ঝুলিয়ে রাখে, যে কাপে খেলে তোমার মুখ পুড়ে যায়।”
“আমেরিকার বিভিন্ন এলাকার এবং আলাদা আলাদা দলের আরোহণকারীদের মধ্যে যোগাযোগটা এতটাই বাজে যে ওদের মধ্যে আরোহণের মানের পারস্পরিক সম্পর্কটাও খুব কম। প্রত্যেকটা ছোটো ছোটো দল তাদের নিজেদের বিশেষজ্ঞ তৈরি করে নেয়।”
“আমি ভেবে নিয়েছিলাম ওরা বুঝি ক্যালিফোর্নিয়ার সার্ফিং-করা মেয়েদের মতো।” সদ্য আলাপ হওয়া মানুষগুলোর সম্পর্কে আমরা একটা মূল্যায়ন করছিলাম, মোটামুটি একটা সাধারণ গড় ধারণার ওপর ভিত্তি করে। তুলনামূলকভাবে আমাদের অভিযান এক্কেবারে আলাদা এবং অনেক সাহসী হওয়ায় হঠাৎ করে আমাদের মধ্যে ভরপুর একটা আত্মবিশ্বাস জেগে উঠেছিল। আমরা ওদের ঝেড়েপুঁছে বিপক্ষের আসনে বসিয়েছিলাম। কথাবার্তা শুনে বা কীরকম সাজসরঞ্জাম ব্যবহার করে তা দেখে আরোহণকারীদের সম্পর্কে একটা ধারণা তৈরি করে নিতে আমাদের দুজনেরই কষ্ট হয় না, অভ্যাস আছে। বিশেষ করে কেয়ার্নগর্মসের পর্বতারোহন স্কুলে প্রশিক্ষন দিতে গিয়ে আমি শিখেছিলাম একদল লোকের সঙ্গে পাহাড়ে যাবার আগে চট করে কীভাবে তাদের বুঝে নিয়ে শ্রেনীবিভাগ করে ফেলা যায়। আমরা ওদের কেবলমাত্র আমাদের মতো করে খুব অল্প পরিসরে বিচার করেছিলাম।
“নিশ্চই ওদের কাছে অনেক কুলিটুলি ছিল।” উপত্যকার চড়াই ভাঙতে ভাঙতে জো বলল।
এতক্ষণে বুঝতে পারলাম আমি মাটিতে এর আগে অত পায়ের ছাপ মোটেই কল্পনা করিনি। ওগুলো দুনাগিরি অভিযানের ভাড়া করা পোর্টারদের পায়ের ছাপ, বেস ক্যাম্প তৈরিতে সাহায্যের জন্য এসেছিল। কিন্তু আমাদের দুজনের পথ দুদিকে চলে গেছে। ওদের রাস্তাটা বাঁদিকে হিমবাহ পেরিয়ে দুনাগিরির দিকে চলে গেল আর আমরা গ্রাবরেখা ধরে চ্যাঙাব্যাঙের দিকে। হিমবাহের ওপর অর্ধেক রাস্তা পেরোতে পেরোতেই সূর্য অস্ত গেল, আমরা আধ ঘণ্টা ধরে বসে বসে দেখলাম পশ্চিম দেওয়াল ক্রমে দ্রুত ছায়ায় ঢেকে যাচ্ছে। শেষ সূর্যের আলো পশ্চিম দেওয়ালের ওপরের দিকটা সোনালি কিংবা টকটকে লাল করে তুলেছিল। তারপর আলো মরে নিভে এলো, আর ঠান্ডায় আমরা হিহি করে উঠলাম। বরফের ওপর দিয়ে আলাদা আলাদা পথে তাঁবুর দিকে যাবার সময় আলো দেখানোর কাজটা চাঁদ নিল, রুপোলি জ্যোৎস্না ছড়ানো আলো। বিল মারে জ্যোৎস্নাকে বর্ণনা করেছিলেন ‘চোখের বালি’ নামে – “চ্যাঙাব্যাঙ…মৃদু আলোয় ঝকঝক করছিল, যেন নতুন বউয়ের মুখের ওপর ওড়নার আড়াল…তুষার-শলাকার মতো ভঙ্গুর; মাটি ও আকাশের অনন্ত থেকে নির্মিত এক বিরল ও অনন্যসাধারণ, এর প্রাণময়তারও তুলনা নেই, যে জানে না তার বুক নেচে উঠবে, মনে মনে সে ধন্যবাদ দেবে, বলবে – এই পাহাড় যেমনটি আছে তেমনটিই থাক।” আমার বুক ঠেলে খুশির জোয়ার উঠছিল, আমি ভাবছিলাম, জো-ও কি আমার মতোই এতটা গাঢ় ভালোলাগায় ভাসছিল। এমন উজ্জ্বল সন্ধ্যা নামতে দেখে ওর কল্পনাতেও কি এমন দোলা লাগেনি?
পরের দিন, ৬ অক্টোবর, পরিকল্পনা মতো আমরা শিপটন কল থেকে ঝুলতে থাকা দড়িগুলোর দিকে চললাম। সক্কালবেলা জলখাবারে ভাত খেয়ে সাড়ে এগারোটা নাগাদ বেরিয়ে পড়লাম, বেসক্যাম্প থেকে উঠে আসার অপেক্ষাকৃত মসৃণ পথের মতো নয়, হিমবাহের নতুন একটা দিকে চলতে চলতে বেশ মজাই লাগছিল। পরিচিত পাহাড়গুলোকে অন্য দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যাবে, ফলে এতে করে অঞ্চলটা আরো ভালো করে জানা-বোঝা যাবে।
শিপটন কলের নীচে পায়ের কাছে পাহাড়ের দেওয়াল অবধি একটা লম্বা তুষারঢাল ছিল। ওর ওপরে উঠে আসতে পেরে ভালো লাগছিল বেশ, গত সপ্তাহগুলোতে যেমন সর্বক্ষণের সঙ্গী ছিল ঢাউস স্যাক, এবার একবার অন্তত পিঠ-বেঁকিয়ে-দেওয়া বোঝা ছাড়া চলছি।
পৌঁছে হতাশ হলাম, যে দড়িদড়াগুলো ঝুলছে সেগুলো জীর্ণ আর ফ্যাকাশে, কাপড় শুকোতে দেবার দড়ির মতো, মোটেই ভরসা করার মতো নয়। কিছু পুরোনো পলিপ্রপলিন ছিল, সূর্যের তাপে ফ্যাটফেটে আর মলিন হয়ে গেছে। ওর পাশে কিছু লাল নাইলন দড়ি ছিল। বসন্তে ভারতীয় এবং ব্রিটিশ দলের যৌথ চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণের পর ১৯৭৪ সালের শরৎকালে জন প্রসারের নেতৃত্বে একটি ব্রিটিশ দল কলঙ্ক আরোহন করার চেষ্টা করে। ওরা নন্দা দেবী স্যাংচুয়ারির মধ্যে ঢুকে চ্যাঙাব্যাঙ হিমবাহ অবধি, অর্থাৎ কলঙ্কের পায়ের গোড়া অবধি, নিজেদের মালপত্র সাজসরঞ্জাম বয়ে নিয়ে যাবার জন্য কুলিদের বোঝাতে ব্যর্থ হয় কেননা ওতে অতিরিক্ত আরো দিন তিনেকের হাঁটা ছিল। তার বদলে কুলিরা বনিংটনের অভিযানের সময়ে যেখানে মালপত্র ফেলেছিল, সেখানেই ওদেরও মালপত্র ফেলে যায়। সুতরাং, আবার একটা ছোটো দলে শিপটন কলের ওপর দিয়ে পেরোনোর কষ্টকর যাত্রাটা ফের একবার অভিনীত হয়। নীচের দিকগুলোতে ওরা বনিংটনের পলিপ্রপলিনের সঙ্গে নিজেদের নাইলন দড়ি বেঁধে মজবুত করে নিয়েছিল। পরে, যাহোক, খারাপ আবহাওয়ার জন্য, দীর্ঘপথ রসদ পরিবহনের কারণে এবং সময়ের টানাটানির জন্য কলঙ্ক অভিযান ব্যর্থ হয়, কেবল পাহাড়ে খানিকটা ফিক্স রোপ লাগানো গিয়েছিল। জো আর আমি দড়িগুলোর দিকে তাকিয়ে দেখলাম। বেশ কিছু কিছু জায়গায় সেগুলো অদৃশ্য, আবার কয়েকফুট পর বরফের নীচ থেকে বেরিয়ে এসেছে। আমরা একশো ফুট মতো হেঁটে উঠে দেখলাম। এই দড়িগুলোর ওপর আমরা কখনোই নির্ভর করতে পারতাম না। আমরা যদি ওপাশ থেকে আসি তবে অ্যাবসেইল করে নিজেদের নামার ব্যবস্থা নিজেদেরই করতে হবে।
“আমরা নিশ্চই অন্যদের খুব কাছাকাছিই রয়েছি,” জো বলল। দক্ষিণ-গাত্র অভিযাত্রী দলের অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্প কল-এর ঠিক ওপাশেই হবে। আমরা ওদের নাম ধরে ডাকাডাকি করলাম – কিন্তু ওটা ছিল ডাকার জন্য ডাকা।
কয়েকটা পিটন ছিল, পুরোপুরি বরফে ডুবে যায়নি। মাথার মধ্যে একটা ভাবনা ঘুরঘুর করছিল, ওই পিটনগুলো আড়াই বছর আগে যে পুঁতেছে সেই হাতদুটো আমি চিনি। আমি ভাবছিলাম, ওটা কি মার্টিন না ডুগ, অথবা ক্রিস কিংবা ডুগল। ওরা সক্কলে এভারেস্টে আমার সঙ্গী ছিল। পর্বতাভিযানের ইতিহাসে এটা অনেকটা পুরাতাত্বিক খননের মতো, তফাৎটা এইই – যে সরঞ্জামগুলো আমরা খুঁড়ে বার করছিলাম, তাদের ব্যবহারকারীদের আমি চিনি। আমরা খানিকটা দৈর্ঘ্যের দড়িদড়া কেটে নিলাম।
“আপৎকালে এই টুকরোটাকরাগুলোকে সবসময়, হাতে-একটা-কিছু-ধরার মতো করে ব্যবহার করতে পারি।” আমি বলে উঠি। নীচে আসার সময় জো একটা পিটন ধরেছিল, সেটা খুলে এল – একেবারে কানের পাশ দিয়ে গেল। “এই পাহাড়ে বেঁচে থাকাই শালা বিপজ্জনক,” ও বলে। কিন্তু নামার পথ সম্পর্কে কোনোরকম সিদ্ধান্তে পৌঁছোনো গেল না – সময়মতো হবে ’খন।”
হিমবাহে পৌঁছে, আমাদের ক্যামেরার সরঞ্জামগুলো নিয়ে নাড়াচাড়া করছিলাম আর অভিযানের ছবি তোলা নিয়ে রসিকতা করছিলাম। ছবিগুলোর সঙ্গে ব্যঙ্গ করে ধারাবিবরণী দেবার নকলও করছিলাম। আমি গলাটা একটু গম্ভীর এবং আধা বৃটিশ আধা আমেরিকান উচ্চারণে বলছিলাম, “ওই যে দুজন যুবক, একেবারেই আলাদা, ভিড়ভাট্টা এড়িয়ে হিমবাহের নিরালা এককোণে বসে আছে। কেউ খেয়াল করতে পারেনি, পারবে না ওদের কঠিন পরিকল্পনার কথা, খুবই সতর্কভাবে সাজসরঞ্জাম বেছে নেওয়া এবং বহু বহুদিন ধরে পেছনের পাহাড়টাকে তীক্ষ্ণ পর্যবেক্ষনের কথা – এমন একটা পাহাড় যা পর্বতারোহী হিসেবে ওদের দক্ষতার সর্বোচ্চ সীমা, সহনশক্তি এবং সাহসকে শুধু নয়, মানুষ হিসেবে ওদের সমগ্র নৈতিক সত্ত্বাটাকেও পরখ করতে চলেছে।”
জো হাসছিল। আমরা অভিযানের বিধিমতো একটা ঠিকঠাক ছবি তুলে রাখব বলে ঠিক করেছিলাম কিন্তু আমাদের সাতপুরোনো সরঞ্জাম এবং পোশাকআশাকে নিজেদের ডাকাতের মতো দেখাচ্ছিল। তাছাড়া আমাদের সঙ্গে তোলার জন্য কোনো পতাকা ছিল না। আমরা শৃঙ্গ আরোহণের সময় ঠিক কী হবে তা নিয়ে কথা বলেছিলাম। “ও চূড়ার ওপর একটা লাথি মেরে দারুণ উল্লাসে হাতের আইস অ্যাক্স আর স্কি-পোলগুলো আকাশের দিকে উদ্দাম, জয়ের আদিম ভঙ্গীতে, তুলে ধরল।”
হিমবাহ ধরে নামার সময় জো হঠাৎ লাফাতে শুরু করল, অদ্ভুত বেয়ারা আদিম অঙ্গভঙ্গী করতে থাকল, আমি এইফাঁকে ওর ছবি তুলে রাখছিলাম। সওয়া তিনটে নাগাদ আমরা অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে ফিরে এলাম।
অনেক কিছু ছোটো ছোটো কাজ মনে করে রেখেছিলাম বিকেলের বাকি সময়টায় করব বলে, আমি এগুলোকে বলি “খুটুরখাটুর” করা। জুমারগুলোয় টেপ লাগালাম – শুনেছিলাম, ঢালাই লোহায় তৈরি বলে ওর কোনো কোনো অংশ ফট করে ভেঙে যেতে পারে। জো-র গুলোতে টেপ লাগানোই ছিল – ও সেগুলো একটা মেয়ের কাছ থেকে ধার নিয়ে এসেছিল, সে জানত এমন বিপদের কথা।
দিন ফুরিয়ে আসার সময় জো আরেকদফা হাঁটতে বেরোলো-
“পড়ন্ত সূর্যের আলোয় চ্যাঙাব্যাঙের পশ্চিম দেওয়ালের ওপরের অংশটায় গোলাপি রঙ লেগেছে। ছায়ারা দীর্ঘ হয়ে আসতে আসতে আমি ছবিটা নিতে চাইছিলাম, আমি রান্নাবান্না ছেড়ে হিমবাহের ওপর দিয়ে বাগিনি শৃঙ্গের দিকে দৌড় লাগালাম। আমি দাঁড়ালাম, অপেক্ষা করলাম, তারপর আবার এগিয়ে গেলাম সুবিধেজনক জায়গা খুঁজে নিতে। সঠিক সময় এবং রঙটা ঠিক আসেনি – আমি অপেক্ষায় রইলাম। একটা মেঘ ভেসে গেল। পাহাড়টা গোলাপি রঙে চোবানো কিন্তু চুড়োটা মেঘের আড়ালে। মেঘ জমছিল। একটু ফাঁক দিয়ে চূড়া দেখা গেল। আমি কয়েকটা ছবি নিলাম, কিন্তু আমি যা চাইছিলাম তা ঠিক এলো না – মেঘের ফাঁক দিয়ে একটা আবছা গোলাপি আভা। অভিযানের সময়ে আর এমন সুযোগ আসবে না। আমি ফিরে চললাম। ঠান্ডা লাগছিল, মনে হয় তাঁবু থেকে অনেকটা দূরে চলে এসেছি।”
রাতে আমরা ইদানীং যা খাচ্ছি, তাই খেলাম, ভাত আর কর্নড বিফ, তার পরে যথেষ্ট ক্যালরিযুক্ত ক্রিসমাস পুডিং আর কাস্টার্ড। তারপর সন্ধের নিয়মমাফিক মাল্টিভিটামিন আর রনিকল-এর বড়ি।
গোধূলি আমার প্রিয় সময়। প্রায়শই এটা আমার মেজাজ বদলে দেয় এবং আমাদের মধ্যের আলোচনার বিষয়বস্তুও। কেমন একটা যাদু-আয়নার মতো কাজ করে, যেন আমার মনে একই সঙ্গে অতীত বর্তমান এবং ভবিষ্যত এসে মিলিত হচ্ছে। আমার ভেতরের প্রতীকিবাদকে জাগিয়ে তোলে। কয়েকদিন আগেকার ডায়েরির পাতা লেখা শেষ করছিলাম –
একটা কোনো রাস্তায় চড়ার সময় আমি সবসময়েই খানিকটা নিরালম্ব হয়েই থাকি, আর এটা কোনো ব্যতিক্রমী ঘটনা নয়। অন্তত আমি অনুভুতিটা ঠাহর করতে পারি। জো মাঝে মাঝে বিষণ্ণ হয়ে থাকে মনে হয়। আবহাওয়াটা শান্ত আর বাতাসহীন হয়ে আসার পর নীচের উপত্যকা দিয়ে মেঘের আনাগোনা ভালো লাগে না। তবুও দেখা যাবেখন – আগামীকাল সাড়ে পাঁচটায় অ্যালার্ম বাজার পর, আমার পালা, আমায় ঠান্ডার জন্য মানসিক ভাবে প্রস্তুত হয়ে স্টোভ ধরাতে হবে। আর এই এখন, মনের মধ্যে অতীতের চিন্তা – স্মৃতি, লোকজন, নানা জায়গা, নানান ঘটনা, আর ভবিষ্যতের পরিকল্পনা – এই পথে চড়াটা শেষ হলে, আর কে জানে, আমরা তো করে ফেলতেও পারি! একটা স্থির সংকল্প তো আছেই। সন্ধে ৮টা ৪৭
পরদিন ৭ অক্টোবর, আমরা ধারের ওপরের শিবিরে উঠে গেলাম, এটাকে এখন আমরা আশাবাদী হয়ে এক নম্বর শিবির বলছি, অর্থাৎ আশা করছি, ওপরের তুষারক্ষেত্রের ওপরে আমরা দুনম্বর শিবির তৈরি করতে পারব। আমি আমার ডায়েরির ছোটো নোটবুকটা এক নম্বর শিবিরেই রেখে যাব ঠিক করেছি, ওজন বাঁচবে, কারণ পাহাড়ের আরও ওপরের দিকে মনে হয় না আমার আর লেখার ইচ্ছে হবে আর আমি ওটা হারিয়ে ফেলার ঝুঁকিও নিতে চাই না। হয়তো হাত ফসকে গেল কিংবা কোনো দুর্ঘটনা ঘটলে ওটাও আমাদের সঙ্গেই গেল, আমাদের অভিযানের একমাত্র দলিল। আমি জানতাম পাহাড়ের সঙ্গে শেষ মোলাকাতটা আসন্ন আর তাই একই সঙ্গে উত্তেজিত ও বিচলিত লাগছিল। ৭ অক্টোবরই আমি কোনো ঘটনা বা সৌন্দর্য বা সন্দেহ নিয়ে শেষবারের মতো কোনোকিছু লিখে রাখতে পারছি।
সন্ধে ৭টা ১৫। এক নম্বর শিবির। হিমালয়ে কি বাজটাজ পড়ে না কখনো? চ্যাঙাব্যাঙে কি রাতে বরফ পড়ে না? এগুলো এখন আমি জানি মিথ। জো রান্না চাপিয়েছে (আমরা প্রেসার কুকার আর প্রাইমাস স্টোভটা তুলে এনেছি এখানে)। আজ সকালে আমার কাঁধে ৫০ পাউন্ড ওজন ছিল! ভোর সাড়ে পাঁচটা নাগাদ উঠে (অ্যালার্মে) কয়েক কাপ চা আর পরিজ খেলাম। আমরা অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পের তাঁবুর ভেতরের অংশটা তুলে এনেছি, সেইসঙ্গে প্রচুর খাবারদাবার আর ছোট্ট স্টোভটা। ফলে অনেক কিছু গোছগাছ করবার ছিল। উইন্ডস্যুটটা পরে নিয়ে প্রায় সকাল পোনে নটার সময় বেরিয়ে পড়লাম, ধার-এর ওপরে ওটা পরে বেশ ভালো লাগছিল। তরতাজা লাগছিল নিজেকে – ফলে খিদে পাচ্ছিল সারাক্ষণ।
এখানে পৌঁছোলাম যখন, তাঁবুটা বার করে ফেলা হল – ওটা মনে হচ্ছে খানিকটা ঝুলে গেছে! যদিও এতক্ষণ লাগানো সত্ত্বেও আশ্চর্যজনকভাবে পোক্ত রয়েছে ওটা। একটা পলিব্যাগে কাল রাতে রান্না করা ডাল ভাত নিয়ে এসেছি, ঠান্ডা করা। এখানে বেশ কয়েকদিন কাটানোর জন্য যথেষ্ট জ্বালানি রয়েছে আমাদের। আমার বুড়ো আঙুল আর তর্জনীতে ফের একবার নতুন করে পট্টি বেঁধে নিলাম। ওভারবুটটাকে সারালাম – মোটা সুতো, এভোস্টিক আর অ্যারালডাইটটা শেষ করে ফেললাম। দুপুর একটা থেকে টানা সন্ধে সাড়ে ছটা অবধি কাজ করলাম! এখন আমার মাথাটা ব্যথা করছে। রোজকার মতো মাংস-ভাত খেলাম, পেটটা বেশ ভর্তি – তারপর এক কাপ চা ও মার্স বার।
কিন্তু আজকের মূল যে ব্যাপারটা লেখার সেটা হল আবহাওয়া – রোদ ওঠা অবধি গত তিন চারদিনের তুলনায় এক্কেবারে উলটো। আজ বিকেলেই জো-কে বলছিলাম যে আল্পসে যেধরনের ঝড়ঝঞ্ঝা হয় হিমালয়ে ঠিক তেমনটা হয় না, ঠিক তার পরেই দুঘন্টা ধরে বজ্রবিদ্যুৎ সহ ঝড়বৃষ্টি হল। ও জিজ্ঞেস করল, “এটা কি তাহলে চিনদেশের?” ঝড়টা থেমে গেলে পর্দার মতো সব সরে গেল, পুরো উপত্যকাটা, ঋষি পাহাড় অবধি, তুষারে ঢেকে গেছে। সম্ভবত এটা আলাস্কার ‘টারমিনেশন ডাস্ট’, “শেষ গ্রীষ্ম”-এর মতো – শীতের প্রথম তুষারপাত, গ্রীষ্মকাল শেষ হয়ে এল তার চিহ্ন। এখন খুব ঝোড়ো বাতাস হবে, শোঁ শোঁ আওয়াজে বইবে, মাঝে মাঝে তুষারকণা আছড়ে পড়বে। সবটাই একসপ্তাহ আগে হ্যামকে থাকার দিনগুলোর স্মৃতি মনে করিয়ে দিচ্ছে। তবুও এখানে নীচে তাঁবুর মধ্যে আমরা সুরক্ষিতই আছি – ভালো যে ওপরে নেই, কিন্তু উদ্বিগ্ন হচ্ছি ভেবে ওপরে যখন যাব তখন সেখানে একটা উপযুক্ত আস্তানা বানাবো কীভাবে।
খুব ঠান্ডা – ভালো কথা যে আমি আমার ডাউনস্যুটটা এনেছি। আমাদের চড়ার রাস্তাটা খুবই উন্মুক্ত অবস্থানে রয়েছে, আবডাল নেই। সন্ধে ৭টা ৫৫
পরদিনটা খুব অস্বস্তিকর, আমাদের অসাড় করে রেখে দিল। এগোনো হবে কিনা সে-নিয়ে আলোচনা করলাম – যা করে থাকি, দুজনেই পালটা যুক্তি সাজিয়ে একে অন্যকে পরখ করে নিচ্ছিলাম। জো থেকে যাবার পক্ষে ছিল, আর কিছুক্ষণ পর পরিষ্কার হয়ে গেল ও ঠিক বলেছে। আমরা দেরি করে ঘুম থেকে উঠেছিলাম, বাইরে তখন তুমুল ঝড় চলছে। এ অবস্থায় আবার দড়ি বেয়ে ওঠার ঝুঁকিটা পাগলামির সামিল – বিশেষ করে যখন আমরা সঙ্গে হ্যামক-টেন্টগুলো আনিনি। ওগুলোকে আমরা তুষারক্ষেত্রে সর্বোচ্চ যেখানে উঠেছিলাম সেখানেই রেখে এসেছি। ঠিক করলাম পরদিন খুব সকালে বেরিয়ে পড়ব, আবহাওয়া যেমনই থাকুক।
“আহা, যাক যাক,” আমি বলি, “ক্রিসমাস পুডিং এর বাকিটা আরাম করে খেতে পারব।”
সকালটা একটু গড়ালে, আবহাওয়া, যতটা ভয় পেয়েছিলাম আর ততটা খারাপ লাগছিল না। তবে আমাদের সিদ্ধান্ত বদল করার পক্ষে ততক্ষণে যথেষ্ট দেরি হয়ে গেছে। এবারে আমরা সঙ্গে করে কয়েকটা বই নিয়ে এসেছিলাম। জো জমিয়ে বসে ‘জার্মিনাল’ পড়া শুরু করল এবং আমি স্টাইনবেকের ডায়েরিটা পড়ার চেষ্টা করলাম। স্টাইনবেক মূল লেখাটা শুরুর আগে প্রতিদিনই সকালে কিছু না কিছু লিখে রাখতেন, কিছু প্রকাশক ঠিক করেছিল হুবহু সেই পাতাগুলোও ছাপবে। ওগুলো ওর বাসস্থান এবং পরিবার সম্পর্কে সব তুচ্ছ খুঁটিনাটি, এটা সেটা, সাতসতেরো, এক্কেবারে ক্লান্তিকর। মনে হয়েছিল স্টাইনবেককে প্রকাশকেরা ঠকিয়েছে, উনি বেঁচে থাকলে কখনোই এসব জিনিস ছাপানোর অনুমতি দিতেন না। এমন একটা সুদূর জায়গাতে বইটাকে নিয়ে এসে মনে হচ্ছিল যেসব রীতিনীতি সভ্যতাকে শাসন করে চলে এমন বহু রীতিনীতি আমি দ্রুত ও কঠোরভাবে বিচার করার জায়গাতে আছি। জনমনিষ্যিহীন জায়গাই কেবল এমন অযথা গর্ব এনে দিতে পারে মনে, এমন একটা ভাব নিয়ে আমি তাঁবুর পেছন দিকে রেখে দিলাম বইটা। যে বইগুলো আমরা পড়ছিলাম, আমাদের মনমেজাজে তার একটা জোরালো প্রভাব পড়ছিল – ব্যাপারটা এমন যে তাঁবুর মধ্যে তারা নতুন কোনো ব্যক্তিত্বের আমদানি করছিল।
বাকি দিনটা আমি ধীরে সুস্থে শিপটন কল থেকে উদ্ধার করে আনা জীর্ণ দড়িগুলো গোছগাছ করলাম। মনে মনে পাহাড়-চড়াটা ভাবছিলাম যাতে সূক্ষ্ম বিষয়গুলোতে মনোযোগ আনা যায়। বাড়িতে কখনোই খুব একটা বাস্তবজ্ঞান ছিল না আমার, যে কাজটা অন্য লোকে আমার চেয়ে অনেক তাড়াতাড়ি করে দিতে পারে তাতে সময় নষ্ট করার কোনো যুক্তি আমি দেখতে পেতাম না। এখানে ব্যাপারটা আলাদা – সাহায্যের জন্য কেউ নেই। চার বছর আগে, বাঙ্গোর বিশ্ববিদ্যালয়ে একটা একবছরের আউটডোর কোর্সে গিয়েছিলাম, সেলাই ফোঁড়াই এবং সাজসরঞ্জাম বানানো শিখতে। একবছরে আমি বেঢপ একটা ওভারট্রাউসার বানিয়েছিলাম আর রুকস্যাকের একটা ছাঁচ কেটেছিলাম। রুকস্যাকের অসমাপ্ত কাপড়টা আমি তাপ্পি দেবার কাজে রেখে দিয়েছিলাম আর সঙ্গে করে এক নম্বরও শিবিরেও নিয়ে এসেছিলাম। তিন ঘণ্টা ধরে আমি সেগুলোর লম্বা ফালি কেটে তার সঙ্গে পলিপ্রপলিন সেলাই করে লাগালাম। যদি পশ্চিম দেওয়াল ধরে নেমে আসার সিদ্ধান্ত নিই, এগুলো আমাদের নিশান-পতাকা হবে, নামার সময় ওগুলো দেখে আমরা আমাদের পথ ঠিক করব। অবচেতনে আমি ভেবে চলেছিলাম ব্যাপারটা এটাই হবে। পরদিন যখন দড়ি দড়া নিয়ে ওপরে উঠে যাব, বেশিরভাগ অ্যাংকর পিটন তাদের জায়গাতেই রেখে যাব। যাতে, শেষমেষ যখন নেমে আসব, ওদের কিছু কিছু যদি ওভারহ্যাঙ বা কুয়াশা বা ঝড়ের কারণে দেখা নাও যায় নীল নিশানা-পতাকাগুলো ওদের খুঁজে পেতে সাহায্য করবে। ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে জানি নিশানা-পতাকা কতটা গুরুত্বপূর্ণ জিনিস হতে পারে। এভারেস্টের চূড়া থেকে নামার সময় আমি বেঁচেই থাকতাম না যদি না প্রায় বরফে ডুবে যাওয়া একটা অক্সিজেন সিলিন্ডারে হোঁচট খেতাম। ওটা নির্দেশ করছিল, ফিক্স রোপ শেষ। তাঁবুর ঘেরাটোপের ভেতর আমার পাশে শুয়ে জো বিষণ্ণ হয়ে পড়ছিল।
কোনো কারণে শরীরটা ঠিক ভাল্লাগছে না আমার, হয় সাধারণ স্রেফ ক্লান্তিজনিত ব্যাপার অথবা কিছু একটা খেয়ে ফেলেছি। এক নম্বর শিবিরটা ক্রমে অপরিষ্কার হয়ে উঠছে। মনে হয় আমার দুশ্চিন্তাটা হ্যামকের খারাপ অভিজ্ঞতাটার জন্য। আমি নিজেকে প্রবোধ দিলাম যে আমি আর ডিক মাত্র এক বছর আগেই দুনাগিরির দেওয়ালে দশ রাত্রি তাঁবু না খাটিয়ে খোলা আকাশের নীচে ‘বিভক’ করে কাটিয়েছিলাম। কিন্তু এই চড়ার রাস্তায় ফের ফিরে আসার জন্য আমার আগেকার উৎসাহ যেন ক্রমে ফ্যাকাসে হয়ে আসছে। আমি আগের বাঁধাধরা গতের চলনবলনে ফিরে গেছি, যা যা দরকার করছি, কেন করছি জানি না।
তাঁবুর বদ্ধ জায়গার মধ্যে আমরা একে অন্যের প্রতিটি নড়াচড়া, কাজকর্ম, এমনকি চিন্তাভাবনা সম্পর্কেও ওয়াকিবহাল। নিজেদের মধ্যে কোনো তর্ক নেই, কোনো কথাবার্তা নেই, নিথর নিষ্ক্রিয়তা, চাঁছাছোলা উত্তর, অসহযোগী একটা ‘নিজের কাজ নিজে করো” গোছের হাবভাবই পরষ্পরের প্রতি নিজেদের মনোভাবের যথেষ্ট ঈঙ্গিত ছিল।
টানা একমাস ধরে আমরা একলা রয়েছি, প্রতিদিনই প্রায় কাজ করছি, অভিযানের গোটা বোঝাটাই আমাদের দুজনের কাঁধে রয়েছে। আমরা একা একা সফল হতে পারতাম না, একজনের আরেকজনকে দরকার ছিল।
নিশান-পতাকাগুলো বানানো হয়ে গেলে আমি ‘নানা’ পড়তে শুরু করলাম কিন্তু আলো মরে আসছিল আর আমি এত অস্থির হয়ে ছিলাম যে জোলার লেখাতে মনঃসংযোগ করতে পারছিলাম না। আমরা যদি পরের দিন ওপরে গিয়ে যথেষ্ট রসদ নিয়ে একটা সুরক্ষিত ক্যাম্প তৈরি করতে পারি তাহলেই লড়াই শুরু হতে পারে। এটা খানিকটা যুদ্ধের মতো – আমরা সারাক্ষণ বিপদ এবং ঝুঁকির মধ্যে বাস করছি, আমাদের কৌশলী ও সতর্ক নড়াচড়া এতখানি বাড়িয়ে তুলতে হয়েছিল, যেন আমরা ঠিক সেই কমান্ডোদের মতো যারা শত্রুপক্ষের সীমানার ভেতর এসে পড়েছে। কেবল এখানে বিজয়ী বা বিজেতা বলে কিছু হয় না – তবে সম্ভবত শত্রু যখন ঘুমিয়ে, সেই ফাঁকে আমরা চুপিচুপি ওপরে উঠে নেমে আসতে পারি তো?
ক্রমশ