জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- এভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়) অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)
(জো টাসকার-এর লেখা সহ)
দুজন অভিযাত্রী। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের দুরূহতম ঢাল। সকলেই ভেবেছিল, এমনকি বিখ্যাত পর্বতারোহীরাও, এ অসম্ভব। এ তো আত্মহত্যার নামান্তর। মাত্র দুজন, তাও হিমালয়ের গহন প্রান্তরে, শৃঙ্গ অভিযান? সঙ্গে আর কেউ নেই? যাহ অবিশ্বাস্য! সেকারণেই ১৯৭৬ সালের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। দুই দক্ষ পর্বতারোহী পিটার বোর্ডম্যান এবং জো টাসকার চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের অতুলনীয় কীর্তি স্থাপন করলেন। ২২ আগস্ট ব্রিটেন থেকে রওনা হয়ে ১৫ অক্টোবর পশ্চিম গাড়োয়ালের চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ১ নভেম্বর দুজন অভিযাত্রী দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮২ সালে এভারেস্টের উত্তর পূর্ব গিরিশিরা বরাবর আরোহণ অভিযানের শেষ পর্বে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে দুজনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যান। ব্রিটিশ তথা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পর্বতারোহীদের মধ্যে এই দুই পর্বতারোহীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।
পরদিন সকাল সাতটার সময় জো পোর্টারদের জন্য পনেরোটা বোঝা তৈরিতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল। তীর্থযাত্রীদের চটি থেকে সোজা আরেকজনের ছাতের ওপর দিয়ে গিয়ে আমরা বোঝাগুলো সরাসরি বাসের মাথায় নিয়ে ফেলতে পারলাম। এখানে একজন সুইস ট্রেকার, হান্স জুড়ে গেল আমাদের সঙ্গে, তারও ইচ্ছা আমাদের মতো ওই একই সময়ে ওই এলাকাতে যাওয়া।
রওনা হতেই বেড়াতে যাবার অনুভূতির রোমাঞ্চটা টের পেলাম, শুধু চলতেই থাকো, উদ্দেশ্যহীন, এতে অনেক ঝঞ্ঝাট কেটে যায়। বাইরের দিকে তাকিয়েছিলাম, ভাবছিলাম যেসব জায়গাতে যাবার কথা ভেবেছি, পৃথিবীর অন্যান্য প্রান্তে যেসব বেড়ানোর কথা ভেবে রেখেছি, সেসব। বাস ঘুরে ঘুরে তপোবনে নামছিল, ছোট্ট জনপদ, একটা দুটো চা-দোকান, একটা পোস্ট অফিস আর প্রচুর ধুলো। ১৯৭০ সালের আগেকার গাড়োয়ালের অভিযাত্রীরা যে পথে এসেছিলেন সেটা কুয়ারি গিরিপথ পেরিয়ে এইখানে এসে আমাদের পথের সঙ্গে মেশে। দেখতে পাচ্ছিলাম অলকানন্দা উপত্যকা ধরে আরেকটা পথ এঁকেবেঁকে উঠে গেছে বদ্রিনাথের দিকে, কিন্তু এখন আমরা ডানদিকে ঘুরে ধৌলি নদীর উপত্যকায় ঢুকে পড়েছি।
ইতিহাসে সবসময়ই বাণিজ্য আর অভিযাত্রায় একটা ভুল পার্থক্য টানা হয়। এটা মনে করা বেশ সহজ যে হিমালয় অঞ্চলে এক্সপ্লোরেশন জিনিসটা শুরুই হয় যবে থেকে ইউরোপীয়রা তাদের যাত্রার এবং আবিস্কারের ফলাফল নথিবদ্ধ করা শুরু করে। আমরা এখন সেই উপত্যকায় চলেছি, যেপথে প্রাচীন জনজাতির লোকেদের পায়ের ছাপ পড়ে আছে, তারা এপথকে ভারত ও তিব্বতের বাণিজ্যপথ হিসেবে ব্যবহার করত। ধৌলির উৎসে রয়েছে নিতি গিরিপথ এবং অলকানন্দার উৎসে ১৮৪০০ ফুট উঁচু মানা গিরিপথ। সবচেয়ে বেশি ব্যবহার হত মানা গিরিপথ। প্রথম ইউরোপীয়রা যাঁরা মানা পাস অতিক্রম করেন তাঁরা পর্তুগিজ জেসুইট পাদ্রি, বিশেষ প্রচারের উদ্দেশ্যেই তাঁরা তিব্বতে গিয়েছিলেন। এই যাজকদের কেউই ভূগোলবিদ ছিলেন না, কিন্তু নিজেদের লক্ষ্যে নিবেদিত, নির্ভয়ে যাত্রা করতেন, বছরের কোন সময়ে যাচ্ছেন, গিরিপথে বরফ আছে কি নেই, এসবের তোয়াক্কা না করে ঈশ্বরের ওপর আস্থা রেখে চলতেন, তিনিই তাঁদের রক্ষা করবেন ভেবে।
তপোবন ছাড়ানোর পরপরই ঋষি পার হলাম, যা ঋষিগঙ্গা নদী থেকে বেরিয়েছে। ১৯৫০ সালে বিল মোরে এখানে একটা তিব্বতি শৈলির মন্দির দেখেছিলেন, মসৃণ স্লেট পাথরের তৈরি; তার চারপাশে অনেকগুলো লাঠির ডগায় ছোটো ছোটো বিচ্ছিন্ন পতাকা উড়ছিল। ওগুলো ছিল ঋষিগঙ্গা স্যাংচুয়ারিতে বসবাস করা সাত ঋষির প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য। কিংবদন্তি বলে, এই সাত ঋষি, আসলে সাতজন অশরীরী প্রহরী যারা নন্দাদেবীর স্যাংচুয়ারির দ্বাররক্ষক। গাঢ় ধূসর পাহাড়ের ফাঁক দিয়ে উঁকি দিলাম, দেখার চেষ্টা করছিলাম কোনো পর্বতচূড়া দেখা যায় কিনা আর ভাবছিলাম ১৮৮৩ সালে ডব্লিউ ডব্লিউ গ্রাহামের এবং ১৯৩৪ সালে বিল টিলমানের এই পথে গিরিসঙ্কটে ঢোকার চেষ্টার কথা। শেষমেষ ১৯৭৬ সালের বসন্তে এসে জাপানিদের চ্যাঙাব্যাঙ দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরা অভিযান এই নিষিদ্ধ গভীর গিরিখাত-এর মধ্যে দিয়ে পথ করে ঢুকে পড়তে পেরেছিল। ওদের পারতেই হত; প্রচলিত রাস্তা গভীর তুষারে ঢেকে ছিল আর সত্যি বলতে ততদিনে সেপথে ভিড় ছিল বেশি, বেশ কয়েকটা অভিযান চলছিল, ভারত-জাপ অভিযান, এবং ভারতীয়দের ত্রিশূল অভিযান। আজ, ঋষিগঙ্গার মুখে একটা মিলিটারি ব্রিজ এবং প্রহরা। মন্দিরের চিহ্নই নেই।
বাস আমাদের মালপত্র সহ রাস্তার পাশে নামিয়ে দিল আর কিছুক্ষণের মধ্যেই লতা গ্রামের মুখিয়া, জগত সিং উদয় হলেন। লোকটি বেশ বুঝদার আর সাহায্যকারী, ওর গায়ের পোশাকে একটা লাল ফুল আটকানো। পলটা খুব দ্রুতই পনেরোজন কুলি ব্যবস্থা করে ফেলল পরের দিন আমাদের বোঝাগুলো বয়ে নেবার জন্য। নির্দিষ্ট পারিশ্রমিক ঠিক থাকায় নেপাল বা আফগানিস্থানের চেয়ে ভারতে কুলিদের সঙ্গে দরাদরির ব্যাপারটা অপেক্ষাকৃত অনেক সহজ। পলটার খুব বেশিক্ষণ লাগল না বিষয়টা মেটাতে। লতার লোকেরা নেমে এসেছিল তাদের বোঝাগুলো দেখেশুনে নিতে। ওদের মধ্যে গেলবারের একজনকে চিনতে পেরে জো খুব খুশি হল, গ্রামেরই তথাকথিত এক অচ্ছুৎ লোক সে। ওদের দুনাগিরি থেকে ফেরবার সময় শীতের বরফপড়া শুরু হয়ে গিয়েছিল, একটু আগে আগেই; ঋষিগঙ্গার ওপর ডিব্রুঘেটায় আটকে পড়েছিল জো।এই কুলি লোকটা, পিঠে অমানুষিক বোঝা নিয়ে চারদিক সাদা হয়ে আসা অবস্থায় পথ চিনে ফেরার আশ্চর্য দক্ষতা দেখিয়েছিল। “ও স্রেফ কুয়াশার মধ্য দিয়ে তাকাত আর চলতে থাকত,” জো বলেছিল, “আর প্রত্যেকবারই ও সঠিক প্রমানিত হত। ওকে ছাড়া পাহাড় ডিঙিয়ে ফেরাটা আমার পক্ষে যথেষ্টই কঠিন হত। পরে ব্যাগ ঘাঁটাঘাঁটি করছিল বলে ওকে আমায় থামাতে হয়, লোকটা এখনও পাজিই আছে, আমি ওর নামও জানি না – আমাকে উদ্দেশ্য করে কেবল ঘড়ঘড়ে শব্দ করেছিল।”
গ্রামের লোকেদের মধ্যে একজন, বেশ বড়োসড়ো চেহারার, তাইত সিং নাম, সর্দারের কাজ করছিল। ওদের অনেকেরই হাতে পশমের গোলা জড়ানো, খুব নিবিড় মনোযোগে তার একপ্রান্ত থেকে সুতো বার করে টাকুতে জড়িয়ে নিচ্ছিল, টাকুটাকে ওরা আঙুল দিয়ে অনবরত ঘোরাচ্ছিল। জো আর আমি আমাদের প্রিং তুলাটা লুকিয়ে রেখেছিলাম (আমরা দুজনেই চাইছিলাম ওজন নিয়ে আকচা আকচিতে সময় নষ্ট হওয়াটা এড়াতে, আগের অভিযানেই অভিজ্ঞতাটা হয়েছিল।) আর এমনভাবে বোঝাগুলো দিলাম যেন সব আগে থেকেই মাপ ঠিকঠাক করাই আছে, আর নড়চড় নেই।
আমাদের ভাগ্য ভাল আমরা ইতিমধ্যেই আমাদের কুলি ঠিক করে ফেলতে পেরেছিলাম, এদিকে সাউথ-ফেস অভিযানের সদস্যরা তখনো বাছাবাছিতেই লেগে। ওরাও একই জায়গায় এসে নেমেছিল, ওদের সাদা লরিতে চেপে – দি আইসক্রিম ভ্যান –ওদেরই এক সদস্য, জিম ডাফ নাম দিয়েছিল। ওদেরটা তুলনায় তত বড়ো অভিযান ছিল না, বসন্তে জাপানিরা পঞ্চাশজন পোর্টার আর আমেরিকার নন্দাদেবী অভিযান আশিজনের ওপর পোর্টার এবং একশো কুড়িটা বকরি নিযুক্ত করেছিল। দক্ষিণ গাত্র অভিযাত্রী দল তাদের চল্লিশজন পোর্টারদের অর্ধেক জোশিমঠে ভাড়া করেছিল । তবুও আমি আমাদের ছোট্টো একজোট আঁটোসাঁটো করা মালপত্র দেখে তৃপ্ত না হয়ে পারছিলাম না, বিশেষত ওদের লম্বা লেবেল দেওয়া বাক্সের লাইন দেখে, আর আমার মনে হয় সাউথ-ফেস টিমের কেউ কেউ আমাদের দিকে ঈর্ষা নিয়েই তাকাচ্ছিল। জো অবশ্য ভাবছিল, যে ওও কখনও বড়োসড়ো কোনো অভিযানে যাবে, অনেকটা সময় আর যথেষ্ট টাকাপয়সা নিয়ে যাতে সব কাজ সামলানো যায়।
পরদিন সকালে, সেপ্টেম্বরের চার তারিখ, টিপটিপ বৃষ্টির মধ্যে আমরা রওনা হলাম, গমখেতের মধ্যে দিয়ে সরু পথ একেঁবেঁকে উঠে গেছে। আধঘণ্টা পর লতাগ্রাম ছাড়ালাম, যাকে বিল মোরে বলেছিলেন, গোটা হিমালয়ে এমন চমৎকারভাবে পাহাড়ের কোলে বসানো গ্রাম উনি আর একটিও দেখেননি। আমরা অবশ্য ওর ওপরটা আর চারপাশটাই শুধু দেখতে পেলাম। শুধু গ্রামটাকেই দেখলাম আমরা, পাথরেরর ধাপে ধাপে ওর বাড়িঘর বসানো। প্রতিটা বাড়ির নিজস্ব উঠোন রয়েছে, অর্ধেক কাঠের অর্ধেক পাথরের তৈরি, পরিবারের লোকেরা কাঠের অংশে থাকে ওপরের তলায়, ওপরের বারান্দা থেকে নীচে মই নামানো, তা বেয়েই উঠতে হয়। ওদের নুন-চা খাবার অভ্যেস, গয়নাগাঁটি, সস্তা ধাতুর বালা-দুল এসব পছন্দ করা, মাঝে সাঝে মঙ্গোলীয় ধাঁচের মুখ সব মিলিয়ে বোঝাচ্ছিল আমরা তিব্বতি প্রভাবিত এলাকার ধার বরারবর এসে পড়েছি। লতা বেশ সমৃদ্ধ গ্রাম, উচ্চতা কম হওয়ায় চাষাবাদ ভালই হয়, ফলে সীমান্ত বন্ধ হয়ে গেলেও, ধৌলিগঙ্গার উজানে ইনার লাইনে থাকা গ্রামগুলোর তুলনায় অতটা বিপাকে পড়েনি। রাস্তাঘাট হওয়ায় আয়ের সুযোগ হয়েছে আর ১৯৭৪ সাল থেকে, অভিযানের সংখ্যা বেড়ে যাওয়া মানেই গ্রামের শক্ত সমর্থ লোকেদের কুলির কাজে বহাল হওয়া। এইসব পরিবর্তনও কিছুটা আর্থিক স্বচ্ছলতা বয়ে এনেছে, কিন্তু স্থিতিশীলতা নয়। অভিযানের বেশিরভাগ টাকাপয়সাই জোশিমঠের বা অন্য কোনো জায়গার দালালদের হাতে চলে যায় যদিও টাকাপয়সা ভালই দেওয়া হয় আর কাজটা মরশুমী।
লতা পেরিয়ে আসার সময়, কেম্ব্রিজ ইউনিভার্সিটির দুজন ছাত্রের সঙ্গে দেখা হল আমাদের, রোজমেরি স্কট এবং অ্যান্থনি কোহেন। রোজমেরি লতাগ্রামের পঁয়ষট্টিটা পরিবারের মধ্যে পাঁচটা পরিবারের খাবারের পৌষ্টিক গুণাগুণ নিয়ে একটা নিরীক্ষা সবে শেষ করে উঠতে পেরেছে তখন।
আমাদের পাহাড়ি-যাত্রায় লতা ছিল শেষ গ্রাম, শিগগিরই ঋষিগঙ্গার ভেড়বকরি-আলাদের পুরোনো রাস্তাটা ধরে আমরা গ্রামের অনেকটা ওপরে চলে এলাম। ডব্লিউ ডব্লিউ গ্রাহাম, ঊনবিংশ শতাব্দীর অভিযাত্রার রহস্যময় কাউবয় যাকে বলা হয়, ছিলেন প্রথম ইউরোপিয়ান যিনি এটা খুঁজে পেয়েছিলেন। আমরা একটা স্পার ধরে চড়ছিলাম, এটা ঋষিগঙ্গার মুখে একেবারে আর সেদিনের সারাদিনের চড়াই ছিল মোটামুটি ৫০০০ ফুট, লতাখড়ক অবধি, ধৌলির অনেকটা ওপরে ১২০০০ ফুট উঁচু এক বুগিয়ালে। আমরা পথ চলতে চলতেই ক্রমশ আকাশ পরিষ্কার হয়ে এল, সূর্যও উঁকি মারল আর আমরা একটা নালা পেরোলাম। “ওপরে পৌঁছোনোর আগে এটাই শেষ জলের জায়গা।” জো বলল। নালাতে এক বৃদ্ধা মহিলা কাপড় কাচছিলেন, তার নাকে ইয়াব্বড়ো একটা রিং, এত বড়ো যে ওনার টুপি থেকে ক্লিপ দিয়ে সেটাকে ধরে রাখতে হয়েছিল। আমি ওনাকে জিজ্ঞেস করলাম, একটা ফটো তুললে ওর আপত্তি আছে কিনা। উনি বললেন আছে এবং খুব রেগেও গেলেন। পশ্চিমি লোকেদের স্বভাবতাই এই, সে ভাবে তার সবই চাই, এমনকি তা সেলুলয়েডে একটা ছবিই হোক না কেন!
সেই সকালটায় আমার খুব তৃপ্ত আর ভারহীন লাগছিল। অ্যাডভেঞ্চারের রহস্য আর দুর্ভাবনা হারিয়ে যায় একবার সেটা শুরু হয়ে গেলেই। সবকিছুই ধীরে ধীরে রূপ পেতে থাকে। আগেরবারের এভারেস্ট অভিযানের যেকোনো মুহূর্তের তুলনায় এবারে আমার বেশি ভালো লাগছিল। পুরো ট্রিপটা এক্কেবারে আমাদের নিজেদের মতো, কোনো বাহুল্য নেই। এভারেস্ট-এ যেমন অতিরিক্ত ব্যবস্থাপনা ধরাই ছিল, অভিযানের তেমন আতিশয্য কিছুই এবারে ছিল না । এছাড়াও আমি গতবারের তুলনায় অনেক বেশি শারীরিকভাবে সক্ষম ছিলাম – দৌড়োনোটা নির্ঘাত বেশ ভালো কাজে দিয়েছে। হিমালয়ে আবার হাঁটা, নিঃসন্দেহে দারুণ ব্যাপার। এমন মনে হচ্ছে আমি যেন এখানেই ছিলাম, এর মাঝের বছরটা যেন একটা স্বপ্ন মাত্র।
লতাখড়ক থেকে অল্প একটু লোভ দেখানোর মতো করে ঋষিগঙ্গার ওপারে বেথারতলী হিমল এবং নন্দাঘুন্টির বরফ দেখা গেল। নীচের জঙ্গলটায় একটা ঝরনা, বাইরে থেকে দেখা যায় না। তার কাছেই একটা কুঠিয়ায় এক যোগী থাকেন। পুরো গরমকাল উনি নিজেকে লোকজনের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন রাখেন, এবং আমাদের চোখের আড়ালে নিজের অভয়ারণ্যে থাকেন। বৃষ্টি আসতেই একটা ত্রিপলের নীচে আমাদের কুলিরা একজোট হয়ে আগুন জ্বালাল। ওদের কারো কারো প্রবল কাশি হচ্ছিল, এবং সম্ভবত আগামী কয়েক বছরের মধ্যে টিবি রোগে ক্রমশ মারাই যাবে সে। আমি একটু হাতমুখ ধুয়ে নিতে গেলাম, ঠিক করেই ছিলাম নিজের পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার ব্যাপারটায় গুরুত্ব দেব, খামোখা অসুস্থ হয়ে অভিযানটা ঘেঁটে যাতে না যায়।
সকালবেলা, কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গিরিশিরা ধরে উঠে, একটা গিরিপথ পেরিয়ে, উলটো দিকের খাড়াই পাহাড়ের গায়ের প্যাঁচ-মারা অসংখ্য স্পার ধরে নামতে নামতে ধারানসি পৌঁছোলাম, এটা খোলা একটা গিরিশিরা। এখানে একটা তাঁবু খাটানো, দুজন মেষপালক পোর্টারদের সঙ্গে কথাটথা বলল। ওরা ওদের কাছ থেকে একটা ভেড়াও নিল তারপর ভাগ্যাহত জানোয়ারটাকে নিয়ে খাড়াই ঢাল ধরে ঋষিগঙ্গার দিকে নেমে গেল – ওটা ওদের রাতের খাদ্য হবে।
নীচে ডিব্রুঘেটার পাথুরে বুগিয়ালটা দেখতে পাচ্ছিলাম, লঙস্টাফ যাকে বলেছিলেন, “বিশৃঙ্খলার মাঝে পড়ে থাকা একটুকরো স্বর্গ” যেখানে “ চারদিকের খাড়াই প্রাকৃতিক ভূখণ্ডের মাঝে সমতলভূমিটা তৎক্ষণাৎ শান্তি ও স্বস্তির ভাব বয়ে আনে।” গুঁড়িগুঁড়ি বৃষ্টির মধ্যে নীচের দিকে ছুটে চললাম। আমাদের চারপাশ ঘিরে দাঁড়িয়ে থাকা তির্যক অভ্রের স্তরগুলো কুয়াশার মধ্যে চিকচিক করছিল।
নীচে গিয়ে হান্সকে দেখতে পেলাম ওর দুজন পোর্টারকে নিয়ে একটা গুহার মধ্যে জুটেছে, আগুন জ্বালানো হয় বলে গুহাটা কালো হয়ে আছে। “ছেলেটার দম আছে” পলটা বলল। পলটা তো বুঝতেই পারেনি দুটো লোক কেন খতরনাক পাহাড়ে গিয়ে চড়তে চায়, কিন্তু একটা এলাকায় ঘুরে বেরিয়ে চারপাশের দৃশ্য দেখে যে অনুভব বা মজা হয় তা সে বেশ বুঝতে পারে। যাই হোক ও কিন্তু হতবাক হয়ে গেছিল এটা জেনে যে হান্স ওই এলাকায় ঢোকার পারমিট ছাড়াই স্রেফ চলে এসেছে।
আমরা যখন হানসের সঙ্গে রয়েছি সেসময় আমেরিকানদের নন্দাদেবী অভিযানের ডাক-পিয়ন এসে উপস্থিত হল এবং ঘোষণা করল যে তিনজন সদস্য পয়লা সেপ্টেম্বর শৃঙ্গে আরোহণ করেছে। আমরা ফুলে ঢাকা ময়দানটা পেরিয়ে লম্বা লম্বা পাইনগাছের বনে, পুরোনো ক্যাম্পফায়ারের কালি লাগা বোল্ডারের মাঝে আমাদের ক্যাম্পের দিকে এগোলাম। দুর্ভাগ্যবশত আমাদের তাঁবু যে পোর্টারদের কাছে তারা বেশ কয়েকঘণ্টা পেছনে ছিল ফলে ছাতা খুলে অনেকক্ষণ অপেক্ষা করতে হল। যখন তাঁবু লাগালাম তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। আমরা পলটাকে একটা প্রাইমাস স্টোভ জ্বালাতে বললাম, কিন্তু ও পারল না। ‘আশ্চর্যের কি যে বেসক্যাম্পে ওর সঙ্গে একটা পোর্টার দরকার হবে’ , আমি ভাবলাম।
“তোমরা দুজন বড়ো বাইরে করতে কখন যাও?” পলটা জিজ্ঞাসা করে, “ সকালবেলা না সন্ধেবেলা?”
পরে, জো বিড়বিড় করছিল, “হাঁটার সময় তো দিব্যি ঠিকঠাকই পারে, কিন্তু আশপাশে ঘুরঘুর করার সময় সবকিছু এত জটীল করে তোলে কেন? এমনকি একটা সহজতম কাজ, যেমন রান্না বা স্টোভ ধরানো নিয়েও যত বিভ্রান্তি!”,
আমি একটু বন্ধুর মতো মেশার চেষ্টা করছিলাম, যাতে ও সহজ হতে পারে, কিন্তু ব্যাপারটা বেশ শক্ত কাজ।”
পরদিন ডিব্রুঘেটার পেছনদিকের খাড়া চড়াইটা উঠলাম। জো আগে মাথায় পৌঁছেছিল। “ওপরে উঠে এসো” জো ডাকল, “এই যে বিরাট নন্দাদেবী।”
ও জানত আমি ওই পাহাড়টা দেখার জন্য কী হাকুপাকু করছি। আমি একেবারে সঠিক সময়েই পৌঁছোলাম, মেঘের আস্তরের ফাঁক দিয়ে দেখা নীচের পবিত্র ভূমি, ওঁরই স্যাংচুয়ারি থেকে নন্দাদেবীর চূড়া, মাথা তুলে দাঁড়িয়ে, চারপাশে দুর্ভেদ্য প্রাচীর। আমাদের থেকে অনেক অনেক নীচে সরু সুতোর মতো ঋষিগঙ্গা বরাবর আবার পাহাড়ের দিকে দৃষ্টি গেল। একঝলক দেখলাম, তারপরেই আমাদের সামনে থেকে কুয়াশায় সমস্ত পাহাড় উধাও হল।
সারাটা দিন কাটল নদীখাতের ২০০০ ফুট ওপরে ঢালটা আড়াআড়ি পাড় হতে। আমি একটু ক্লান্ত বোধ করছিলাম, কিন্তু অচিরেই ঢালে ছাওয়া হাজার হাজার ফুল দেখে মোহিত হয়ে পড়লাম। আকাশটা ধূসর, ফলে মাটিই দিকেই আমার চোখ চলে গেল। গাড়োয়ালকে যে হিমালয়ের বাগান বলা হয় তাতে আশ্চর্যের কিছু নেই। আশ্চর্যের কিছুই নেই যে ১৯৩৮ সালে ফ্রাঙ্ক স্মাইথ জোশিমঠের কাছে ভুইন্দার ভ্যালি নিয়ে একটা বই লিখেছিলেন সেটা ‘দি ভ্যালি অব ফ্লাওয়ার্স’। ফুলের পাপড়ির ওপর লেগে থাকা জলের বিন্দুগুলো অকপট সৌন্দর্য আর সজীবতা বয়ে আনছিল। হরেক রকম রঙের , চারপাশের হা হা ভূপ্রকৃতির মাঝে ছড়িয়ে থাকা যেন সৌন্দর্যের কোমল ছোঁয়া।
“ওই লুপিনগুলোর ছবি তুলছ কি জন্য, জো? ওগুলো আমাদের ওখানে সব্বার বাগানেই ফোটে।”
বর্ষায় গিরিসঙ্কটের দুপাশের নালাগুলোর জল বেড়ে ফুলে ফেঁপে উঠেছিল, ওগুলো আমাদের পেরোতে হবে। একটা তীব্র নালার কাছে যখন পৌঁছোলাম, তাইত সিং নাটকীয়ভাবে দায়িত্ব নিয়ে নিল, স্রোতের একেবারে মাঝখানে দাঁড়িয়ে গেল ও আর মালপত্র এবং লোকজনকে পার হতে সাহায্য করল।
“সর্দার বেশ ভালো ছেলে মনে হচ্ছে।” জো বলল।
নীচে মেঘের মধ্যে দিয়ে ঋষিগঙ্গা দেখা যাচ্ছে। মাঝে মাঝে বেশি খাড়াই অংশে চারহাতপায়ে চড়তে হচ্ছে – একটু অসাবধান হলেই বহু নীচে গিয়ে পড়তে হবে।
খাড়াই ঢালে ক্যাম্পসাইটটা হল একচিলতে জায়গায়, আর আমি পলটার ওপর ভয়ানক বিরক্ত হয়েছিলাম, সে একরকম অসহায়ের মতো বসে ছিল, এদিকে আমি আর জো মিলে তাঁবু খাটিয়ে তার ওপর দিয়ে পলিথিন শিট চাপিয়ে স্টোভ ধরালাম। আগের সন্ধে থেকেই তাঁবুগুলো ভিজে ভিজে হয়ে ছিল। আবার বৃষ্টি নেমেছিল। আগামীকাল আমরা বেসক্যাম্পে পৌঁছোবো – পোর্টাররা ছদিনের পড়াও চার দিনে হেঁটে ফেলবে।
জো আর আমি সকাল সকালই উঠলাম। “যেমন লিয়াজঁ অফিসার পাঠিয়েছে আমাদের নজরে রাখার জন্য”, জো বলেছিল, “ওদের মতো করেই ওদের শিক্ষা দিতে হবে। এই সাহায্যকারী / গাইড ব্যাপারটাই ফালতু!”
দারুণ সকাল। কুয়াশা কেটে গেছে আর আমি আমাদের ক্যাম্পসাইটের উন্মুক্ত অবস্থানটা দেখে কেঁপে গেলাম, চারপাশের শূন্যতার অনুভব, ঋষিগঙ্গা গিরিখাত স্যাংচুয়ারির দিকে চওড়া হয়ে গেছে, তার ওপরে নদীর উচ্চপ্রবাহ এবং হিমবাহগুলি। এবারে আমাদের রামনি হিমবাহ এবং চ্যাঙাব্যাঙের দিকে যেতে হবে। পলটা যথারীতি নেই, বড়ো বাইরে গেছে, আমি আর জো মিলে তাঁবু গুটিয়ে সকালের খাবার বানালাম।
পলটা ফিরে এসে আশ্চর্যরকম চরম শর্ত দিল। হয় আমরা লোক পাঠিয়ে টাটকা সবজি আনাব নয়তো ও পোর্টারদের নিয়ে শহরে ফিরে যাবে। ও বলল, “দেখো, বাপধনেরা, তোমরা আর তোমাদের মালপত্র যাতে বেসক্যাম্পে পৌঁছায় আমি নিশ্চিত করব সেটা। কিন্তু আমি তো তোমাদের অভিযানে কোনো কাজে আসব না, সুতরাং আমি ফেরত চলে যেতেই পছন্দ করব। এরকম অখাদ্য খাবার আমি আমার সারা জীবনে কখনও খাইনি। আমি জানি না ভারতীয় রান্না সম্পর্কে তোমাদের ধারণা এদের রান্নাবান্না দেখে তৈরি করেছ কি না,” পলটা হাত নাড়িয়ে পোর্টারদের দিকে দেখিয়ে যোগ করে, “আমার বাড়ির চাকরেরাও তোমরা দুজন যা খাচ্ছ তার চেয়ে ভালো খাবার খায়।”
ও আমাদের ওপর চাপ তৈরি করছিল সিদ্ধান্তটা নিতে, কিন্তু নিশ্চিতভাবেই ও খুশি ছিল না, বাড়ি ফিরে যেতেই চাইছিল। সঙ্গে এতখানি গরুর মাংস নিয়ে আসার জন্য আমার একটু অপরাধবোধ হচ্ছিল। আমি, হিন্দুদের যে গরুর ব্যাপারে স্পর্শকাতর ধারণা রয়েছে, সেটা একেবারেই ভুলে গিয়েছিলাম। যাই হোক ওকে আমাদের ভাঁড়ারের ভেড়ার মাংস আর মাছ দেওয়া হল। এছাড়াও ওর ওপর জো-র আগেকার কঠিন মনোভাবের জন্যও আমার খারাপ লাগছিল। সে যাইই হোক পলটা তো স্রেফ দুদিনের নোটিশে আমাদের সঙ্গে এসে যোগ দিয়েছে, আর তারও দুবছর আগে ও নিজের নাম নথিভুক্ত করেছিল এক্সপিডিশন অফিসার হিসেবে। কিন্তু আমাদের পক্ষে ওর একবগগা শ্রেণীচেতনা এবং বুদ্ধিমত্তার গর্ব নিয়ে হাসি-তামাশা করা কঠিন হয়ে পড়ছিল, বিশেষ করে জো-এর পক্ষে, কেননা যেকোনোরকম দেখনদারী ও চট করে ধরে ফেলতে পারে। নানা ভাবে জো-র যথেষ্ট বেশি শ্রদ্ধা ছিল পোর্টারদের ওপরে, তাদের কঠিন কষ্টসহিষ্ণুতার জন্য, দারিদ্র্যের মধ্যেও আনন্দে থাকার জন্যে। শুরু থেকেই এটা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল যে আমাদের অভিযানটা ঠিক সেইরকম নয় পলটা যেমন অভিযানের লিয়াজঁ অফিসার হতে চেয়েছিল । প্রথমেই ও হাহুতাশ করল রেডিও ট্রান্সমিটার নেই বলে; তারপর ও চাপ দিতে থাকল বেস ক্যাম্পে ওর সঙ্গে থাকার জন্য একটা পোর্টার নেবার জন্য। এখন আবার খাবার বিষয়ে। ওকে সাহায্য করা গেল না, আর এমন ঠোঁট ওলটানো লোক হলে অযথা ভোগান্তিই হবে। সুতরাং আমাদের একলা হতেই হল।
পলটার ঝামেলাটা নিয়ে মনেমনে ভাবনা ছাড়া পাহাড়ে সকালের হাঁটাটা চমৎকার ছিল, চোখে পড়ছে চারপাশের জনমানবহীন অঞ্চল, যেখানে আমাদের অ্যাডভেঞ্চার। শেষ অবধি, চ্যাঙাব্যাঙ চোখের আড়ালেই।
আমাদের অগোচরে, সেদিনই, নন্দাদেবী শৃঙ্গের ওপরে একটা ট্র্যাজেডি ঘটছিল, গল্পের চেয়েও অদ্ভুত। ২৪০০০ ফুট ওপরে চারজন আমেরিকান আরোহী দ্বিতীয়বার শৃঙ্গ আরোহণের জন্য উত্তর-পশ্চিম ঢাল / উত্তর গিরিশিরা ধরে চড়ছিল। ওইখানে তুষারঝড় শুরু হয় এবং একজন আরোহী পেটের অসুখে ক্রমে দুর্বল হয়ে পড়তে শুরু করে। পরদিন সকালে মহিলা আরোহীটি মারা যায় এবং বাকি তিনজন আরোহী ওর দেহটা ওখানে বরফেই শুইয়ে দেয়। ১৯৪৮ সালে উইলি আনসোউল্ড ঘোষণা করেছিলেন উনি ওঁর মেয়ের নাম রাখবেন ওঁর দেখা জীবনে সবচেয়ে সুন্দর পর্বতের নামে। উইলি ওঁর মেয়ের সঙ্গেই এই অভিযানটিতে এসেছিলেন, আর মেয়েটা ওইই যে মারা গেছে। রক্তমাংসের, তরুণ এবং সুকুমারী নন্দাদেবী আনসোউল্ড, তার নিজের ঘরে ফিরে গেছেন, অনেক ভারতীয়ই একথা বলেছেন – ও ছিল মানুষরূপী দেবীনন্দা।
আমাদের পথ যেহেতু রামনির দিকে বেঁকেছে আমরা একটা ধার ঘুরে এলাম আর হঠাৎ আমরা দেখে ফেললাম ওকে। তিনটে শৃঙ্গের ধার দিয়ে এক চিলতে ফাঁক তৈরি হয়েছিল, হনুমান দেবতার নামে হনুমান শৃঙ্গ, বিনাশকারী নামে, কলঙ্ক শৃঙ্গ এবং ঋষিদের দুর্গ হেন ঋষিকোট শৃঙ্গ, সেই ফাঁকে ঝকঝক করছে দুধসাদা চ্যাঙাব্যাঙ-এর ছুঁচোলো ধারালো দাঁত – “ দি শাইনিং মাউন্টেইন।”
আমি নামগুলো মনে মনে আউড়ে নিলাম। তারপর চ্যাঙাব্যাঙ-এর দিকে ক্যামেরা তাক করে পরপর ছবি তুলে যেতে লাগলাম, ২৮ মিমি, ৫০ মিমি., ৭৫মিমি, ১৫০ মিমি একের পর এক লেন্স লাগিয়ে। যতই কাছে আরো কাছে দেখতে পেলাম আমার ভেতরটা ভয়ে বিষ্ময়ে গুড়গুড় করে উঠল। আশ্চর্যের নয়, টম লঙস্টাফ চ্যাঙাব্যাঙকে বলেছিলেন, “আমার দেখা সবচেয়ে অসাধারণ সুন্দর এই শৃঙ্গ।” ফ্রান্সিস সিডনি স্মাইথ-এর বর্ণনায় বেঁচে আছে, “ একটা শৃঙ্গ যেটা চূড়া থেকে হিমবাহ পর্যন্ত একটা দেয়াল, যেন ছুরি দিয়ে কেউ এককোপে কেটে বসিয়েছে। ” আগে আগেই দর্শনের ফলে একে যে অনন্যতা দেওয়া হয়েছিল, তা সার্থক হল।
জো আমার দিকে তাকিয়ে ছিল। “মাথায় কোনো স্তুতিই আসছে না,” ও বলেছিল।
আস্তে আস্তে চিন্তাটা ফিরে এল – “আমরা কি দুঃসাহসে ওর মাথায় চড়ার কথা ভেবেছি? ফটোতে খুব ভালোভাবে দেখার পর এখন আমি সরাসরি পশ্চিম দেয়ালটা দেখতে পাচ্ছি। “হ্যাঁ,“লিঙ্ক পিচ”, বরফের ঢালু পাটাতন মতো পথ, যেটা প্রথম দেখি ছবিতে, এক সুইস মাউন্টেনিয়র, আন্দ্রে রশে-র তোলা, ১৯৩৯ সালে দুনাগিরি শৃঙ্গের ওপর থেকে, এখনও টিকে আছে ওটা, সম্ভবত মাঝামাঝি তুষার ময়দানটিতে যাবার একমাত্র সম্ভাব্য পথ। আমাদের চেষ্টাটা যথেষ্ট দুসাহসিক, কিন্তু জো ছাড়া আর কাউকে ভাবতেই পারছি না যাকে নিয়ে ওই চেষ্টাটা করা যায়। শিগগিরিই আমরা গ্রাবরেখার মধ্যে ঢুকে গেলাম আর চ্যাঙাব্যাঙও মাথা নামিয়ে নিল।
৮ সেপ্টেম্বর, পোনে বারোটার সময়, আমরা যে ঘাসজমিটায় পৌঁছোলাম সেখানে আগেরবার দুনাগিরিতে জো ওর বেস ক্যাম্প লাগিয়েছিল, এখানেই সব মালপত্র জড়ো করা হল। হাঁফ ধরা হাঁটা ছিল বটে। আমাদের অল্টিমিটারে দেখাচ্ছে ১৫২৫০ ফুট। ময়দানটার চারপাশ জুড়ে কুয়াশা জড়ো হচ্ছিল আর পোর্টাররা ভিড় করে দাঁড়িয়েছিল পাওনা-গণ্ডার জন্য। আমরা টাকাপয়সা দিয়েটিয়ে মোটামুটিভাবে বলে দিলাম যে আমরা জানিয়ে দেব যে কবে আমাদের মালপত্র আবার ফিরিয়ে নিয়ে যেতে হবে।
“ব্যক্তিগতভাবে তোমাদের দুজনের বিরুদ্ধে কিন্তু আমার কিছু নেই,” পলটা বলল। আর আমাদেরও কিছু ছিল না। ও পোর্টারদের সঙ্গে চলে গেল।
জো আর আমি বাক্স আর কিটব্যাগের মধ্যে বসে বসে দেখছিলাম কুয়াশায় একটা একটা করে বোঝা অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে। “আমাদের গ্রীষ্মের ছুটি কাটানোর জন্য বেশ একটা নির্জন জায়গা বটে।” আমি জো-কে বলি।
“গত বছর ডিক চলে যাবার পর এইখানে আমি একা একা ছদিন ছিলাম,” জো বলল। “শেষ দিকে তো নানা জিনিস কল্পনা করতে শুরু করেছিলাম।”
আমরা তাঁবুগুলো লাগালাম। তারপর হানস এসে উপস্থিত হল ওর দুই পোর্টারকে নিয়ে। “এখানে দুদিন আছি আমি।” ও ওর চাপা অস্ট্রিয়ান উচ্চারণে বলল। “তারপর স্যাংচুয়ারিতে যাব।”
জো আর আমি সেদ্ধ আলু আর ভেড়ার মাংসের টুকরো খেলাম চায়ের সময় আর ক্রিসমাস পুডিং, রাম এবং কাসটার্ড ওর সঙ্গে ভাগ করে খেলাম। “যত ডেজার্ট খেয়েছি তার মধ্যে এইটিই সেরা।” হানস বলল।
অন্যান্য সব সমস্যা থমকে গিয়েছিল। এখন আমদের যুঝতে হবে কেবল প্রাকৃতিক উপাদানগুলির সঙ্গে – ঠান্ডা, উচ্চতা, পাথর, তুষার, সবকিছুই আমাদের চেনা আর জানা। সারা পৃথিবীতেই সমস্ত পর্বতমালাতেই, কিছু কিছু জিনিস একই থাকে। আমি বুঝতে পারছিলাম চারপাশ জুড়ে এইসব নিয়ে এখন অনেক আরামে আছি……এরকমটা আর মনে হচ্ছে না, যে আমরা ভারতে আছি। আমি এর সবটা বুঝতে পারছিলাম।