ধারাবাহিক অভিযান-দি শাইনিং মাউন্টেন-পিটার বোর্ডম্যান- পর্ব ৪-অনুবাদ ইন্দ্রনাথ-বর্ষা ২০২২

জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- ভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়)  অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)

আগের পর্বগুলো– পর্ব, পর্ব ২, পর্ব ৩

(জো টাসকার-এর লেখা সহ)

obhijaanHead piece Shining mountain (1)

দুজন অভিযাত্রী। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের দুরূহতম ঢাল। সকলেই ভেবেছিল, এমনকি বিখ্যাত পর্বতারোহীরাও, এ অসম্ভব। এ তো আত্মহত্যার নামান্তর। মাত্র দুজন, তাও হিমালয়ের গহন প্রান্তরে, শৃঙ্গ অভিযান? সঙ্গে আর কেউ নেই? যাহ অবিশ্বাস্য! সেকারণেই ১৯৭৬ সালের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। দুই দক্ষ পর্বতারোহী পিটার বোর্ডম্যান এবং জো টাসকার চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের অতুলনীয় কীর্তি স্থাপন করলেন। ২২ আগস্ট ব্রিটেন থেকে রওনা হয়ে ১৫ অক্টোবর পশ্চিম গাড়োয়ালের চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ১ নভেম্বর দুজন অভিযাত্রী দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮২ সালে এভারেস্টের উত্তর পূর্ব গিরিশিরা বরাবর আরোহণ অভিযানের শেষ পর্বে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে দুজনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যান। ব্রিটিশ তথা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পর্বতারোহীদের মধ্যে এই দুই পর্বতারোহীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।   

প্রথম পাথুরে এলাকা

obhijaanshininig mountain

৮-২০ সেপ্টেম্বর

একটা দিন বিশ্রাম নিলাম। সারা রাত প্রচুর বরফ পড়েছে, তারপর বরফ পড়া বদলে গেল শিলাবৃষ্টিতে। আমাদের চারপাশের পৃথিবী বলতে আমাদের তাঁবুটা, কিছু শুকনো মরা ঘাস, একটা ছোট্ট ধারা, আর ঘন বৃষ্টির মধ্যে দিয়ে দেখা বোল্ডার আর অন্ধকার মোরেনের ঢিবি। আমি সকাল সাড়ে আটটা নাগাদ ঘুম থেকে উঠলাম, বারো ঘণ্টা ঘুমোনোর পর, খুব দরকার ছিল ঘুমটা। তাঁবুতেই শুয়ে রইলাম, উচ্চতার জন্য কেমন থম মেরে, মুখের সামনে নীল নাইলনের দিকে চেয়ে। জো আর আমি আলাদা আলাদা বেশ হালকা তাঁবুতে ছিলাম, জো উঠে পড়েছে, বেসক্যাম্পের টানেল তাঁবুতে চায়ের জল চাপাল, শুনতে পেয়ে স্বস্তি হল। খুব যে খিদে পেয়েছিল তা নয়, তাও খানিকটা ঠান্ডা পরিজ আর গমের খিচুড়ি (হুইটজার্ম) গিললাম, তারপর ভাত আর সামুদ্রিক পিলচার্ড মাছ। জো চায়ের সঙ্গে একটা জেলিমতো বানিয়েছিল। আমার মাথাব্যথা করছিল, ঠিক চোখের পেছনটায়, উঠে দাঁড়াতেই বুঝলাম মাথাটা হালকা ঘুরছে। এইসমস্তকিছুর সঙ্গে পেট নিয়ে আমার আশঙ্কা আর কোমরের পেছনের ব্যথা, সব মিলিয়ে নিজেকে পাক্কা একটা বুড়ো ঢ্যাপের মতো মনে হচ্ছিল। তা সত্ত্বেও জানি এটা উচ্চতার কারণে স্বাভাবিক একটা নিস্তেজভাব, আর সেটাই আমার মধ্যে দুশ্চিন্তা তৈরি করছে, আর জো-এর কাছে যখনই এসব কবুল করছি ও ব্যাটা বলছে, “আরে, জানো না, শিপটন কী বলেছেন – কোনো অসুস্থতাই একজন মানুষকে শীর্ষারোহণ থেকে আটকাতে পারে না, যদি সে সত্যিই চড়তে চায়।”

“উচ্চতার কারণে তোমার কীরকম লাগছে?” ওকে জিজ্ঞাসা করি।

“ওহ, এক্কেবারে বাড়ির মতো লাগছে।”

“তাই নাকি, রাতে ভরপুর মাল টানার পরদিনের মতো।”

“তুমি যদি ভাবো, আমি অসুবিধেটা লুকিয়ে বলছি, তাহলে তোমার একবার ডিক-এর সঙ্গে ক্লাইম্ব করা  উচিত – তাহলে বুঝতে আমি কতটা নরম লোক।”

জো-র ছোটোবেলাতেই অ্যাপেন্ডিক্স অপারেশন হয়ে গেছিল, আমারটা তখনও ছিল। ওটার অবশ্য ঝামেলা করার সম্ভাবনা বেশ কম, ফলে ওটা নিয়ে চিন্তা করা বাদ দিলাম। কিন্তু জো ওই নিয়ে খেপাতে ভালবাসত।

“আজকে পেট কেমন, পিট? ব্যথা ট্যাথা? ভেবো না। আমি সব যন্ত্রপাতি আর বই নিয়ে এসেছি। একটা ছোট্ট অপারেশন বই তো নয়।”

আমরা আমাদের তাঁবুতে ঢুকে গেলাম, আমাদের যার যার ছাতার তলায়। খুব আহ্লাদ নিয়ে দেখছিলাম তাঁবুটা। এটা আমার ঠাকুমা আমায় উপহার দিয়েছিল আমার একুশতম জন্মদিনে। ঠাম্মি যদি দেখতে পেত এখন! আধো ঘুম আধো জাগরণে একটা বই পড়ছিলাম, “জেন অ্যান্ড দ্য আর্ট অব মোটর সাইকেল মেনটেনেন্স”। জো গোর্কি পড়ছিল, “দ্য থ্রি”। সময় কাটানোর জন্য আমরা সঙ্গে বেশ গুরুগম্ভীর বইপত্র বেছে এনেছিলাম। এছাড়াও আলাদা আলাদা তাঁবুতে বসে আমরা আমাদের ডায়েরিতে ছোটো ছোটো স্বীকারোক্তি লিখে রাখছিলাম, আর একে অন্যের ওপর মন্তব্য। জো ভাবছিল যদি হাই অল্টিচুডের এই পরিশ্রম আর কষ্টটার অভ্যাস ওর না থাকত। ও লিখছিল,

“ডিক-এর চেয়ে পিট-এর সঙ্গ বেশি আরামের, কিন্তু ওর ঘুমের ব্যাপারটা কখনও কখনও বিষ্ময়কর। এমন নয় যে ও অলস, ও স্রেফ ভাবেই না।”

মাঠের অন্যপাশে হানস ওর বিভক টেন্ট-এর মধ্যে গুটিশুটি মেরে বসে ছিল। সারাদিন বেরোয়ইনি।

রোদ উঠছিল, আকাশ পরিস্কার হয়ে আসছিল, আমাদের মাথাও, এবং ঠিক করা হল গ্লেসিয়ারের ওপর উঠে দেয়ালটা একবার দেখে নেওয়া হবে আর অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পের জন্য একটা জায়গা খুঁজে নেব। হানস সুবিধে মতো জায়গা থেকে এলাকাটার কয়েকটা ছবিটবি তুলে ফিরে যাবে। বাইরে বেশ কয়েকঘণ্টা রোদ পুইয়ে, যন্ত্রপাতি গোছগাছ করে ওকে বিদায় জানিয়ে আমরা আমাদের অভিযানকল্পে বেরিয়ে পড়লাম।

উপত্যকার একেবারে মাথায়, গ্রাবরেখার ধারে  প্রায় ১৫০০ ফুট উঁচুতে পৌঁছে, আমরা রামানি হিমবাহ ঘিরে গোল হয়ে থাকা থাকা বরফচূড়ার পাহাড়গুলো দেখতে পেলাম, যার শেষ মাথায় মাথা তুলে দাঁড়িয়ে চ্যাঙাব্যাঙ। এই হিমবাহের একটা ধারা দুনাগিরির দিকে ঘুরে চ্যাঙাব্যাঙ আর দুনাগিরির মাঝে বাগিনি গিরিপথের দিকে গেছে, ১৯০৭ সালে লঙস্টাফ যেটা পার করেছিলেন। ১৯৭৪ সালে ক্রিস বনিংটনের দল যেপথে গিয়েছিলেন আমরা সেটাও দেখতে পাচ্ছিলাম। আমি আর জো এখন যেখানে দাঁড়িয়ে ওরা এইখানে এসে পৌঁছেছিলেন। ওই অভিযাত্রী দলের এক সদস্য, মারি বয়সন, লিখেছেন,

“ আমরা পশ্চিম গাত্র চড়ার ইচ্ছে নিয়ে এসেছিলাম, ওটা একটা পাথুরে রুট, আমাদের আবছা ছবিগুলো দেখে যা বেশ আকর্ষক মনে হয়েছিল। এখন আমাদের খুব খাড়া একটা পাথুরে দেয়ালের মোকাবিলা করতে হচ্ছে, এরকম রুট আমি প্যাটাগোনিয়ার বাইরে আর দেখিনি – বিশাল একটা খাড়া পাথরের দেয়াল, সামনের দিকে ঝুঁকে আসা, এখানে ওখানে খাবলা খাবলা খাড়া বরফের দেওয়াল তার গায়ে। যে রুটে আমরা চড়ব বলে গোড়ায় ভেবে রেখেছিলাম, এতটাই কঠিন সেটা যে হাস্যাষ্পদ হয়ে গিয়েছিল।”

বদলে, চ্যাঙাব্যাঙের দক্ষিণ আর পশ্চিম দেয়ালের মধ্যের সংযোগকারী খাড়া ধারটা টপকে ওরা অন্যপাশ থেকে চূড়ায় ওঠার মনস্থ করেছিল। শেষমেষ যেখান দিয়ে ওরা ধারটা টপকে ছিল সেটা ছিল শিপটন কল। ১৯৩৬ সালের সেপ্টেম্বরে, শিপটন উলটো দিক থেকে এসে এই বিন্দুতে পৌঁছোন, সেটা স্যাংচুয়ারিতে ওর দ্বিতীয় অভিযান। ওখানে ঘণ্টাখানেক ধরে বসে চারপাশের সাদা চূড়াগুলো দেখতে থাকেন।

জো আর আমি হিমবাহের পাশের গ্রাবরেখার এবরোখেবড়ো পাথরের ওপর দিয়ে চ্যাঙাব্যাঙের দিকে চলা শুরু করি –চারপাশের সীমাপরিসীমাহীন ছড়ানো তুষার, বরফ এবং গ্রানাইটের অ্যাম্ফিথিয়েটারে দুটি ক্ষুদ্র প্রাণী। আমি দিবাস্বপ্ন দেখছিলাম। ‘যেভাবেই হোক, পাহাড়ে কখনও একলা লাগে না আমার। চারপাশের এইসব দৃশ্য আমার মনে শক্তির সঞ্চার করে। সারাক্ষণ সুপ্ত পাহাড়চড়ার স্মৃতিগুলো আবার মনে পড়তে থাকে, একশো রকমের চড়ার সমস্যা, আর মনোযোগ দিয়ে সেগুলো সমাধান করে ফেলার স্মৃতি। উচ্চতাজনিত সমস্যাগুলো আমি সমাধান করি অভিজ্ঞতার জোরে, অনিশ্চিতভাবে, বলা যায় অবিশ্বাস্যভাবে। বড়ো কোনো ক্লাইম্বের আগে এগুলো কাটিয়ে উঠি আমি কেননা এগুলো আমার চেনাজানা। এগুলো আমি আগেও অনুভব করেছি। আমি একেবারেই আত্মবিশ্বাসী নই যে ওই বড়ো দেয়ালটা আমরা চড়ে ফেলতে পারব, কিন্তু এটা জানি যে আমরা এই ক্লাইম্বটা খুব ভেবেচিন্তে, বুদ্ধি করে মোকাবিলা করছি। স্মৃতিগুলো যুক্তিগ্রাহ্য, নিশ্চিত – ঘটনা পরম্পরাও যুক্তিসঙ্গত ও অবধারিতভাবে একের পর এক আসে। পাহাড়ের ছবিগুলোর ওপর চড়ার রেখাগুলোও এত নিশ্চিত ও স্পষ্ট দেখায় এবং ওখানে পৌঁছোনোর যন্ত্রণা সম্পর্কেও মনে একটা ধারণা জন্মিয়ে দেয়। কিন্তু আমরা এখন এখানে, এই দেয়ালটার একেবারে তলায়, সামনে আমাদের ক্লাইম্বটা, আর সেটা কেমন হবে সেটা আগাম বলে দেবার মতো এক্কেবারে কোনো রাস্তাই নেই। জেন-এর বইটায় কী যেন বলেছিল? “…যার ওপর তোমার চূড়ান্ত আত্মবিশ্বাস তাতে তুমি কখনোই নিবেদিতপ্রাণ হতে পারো না। কেউই পাগলের মতো চিৎকার করে এই কথা বলতে থাকে না যে কাল সকালে সূর্য উঠবে। মানুষ যখন কোনো রাজনৈতিক বিশ্বাস বা অথবা ধর্মবিশ্বাস কিংবা অন্য কোনো রকম ধারণা বা উদ্দেশ্যের কারণে উন্মত্ত হয়ে ওঠে, চরমভাবে নিবেদিত প্রাণ হয়ে ওঠে, তখন এটা সেকারণেই ঘটে যে এই মতবাদ বা উদ্দেশ্য নিয়ে সংশয় আছে …”’

দূরে গ্রাবরেখার একটা সরু অংশ হিমবাহ বরাবর পশ্চিমগাত্রের পাদদেশ অবধি গেছে। জায়গাটা অ্যাডভানস বেসক্যাম্প তৈরির জন্য ভালো। জমিটা এবরোখেবড়ো। মাঝে মধ্যে গ্রানাইটের বিরাট বিরাট চাঁই ফেলা সংকীর্ণ খাতের মধ্যে দিয়ে যেতে হচ্ছে, আমরা একটা থেকে আরেকটা পাথরে লাফিয়ে লাফিয়ে যাচ্ছিলাম। রোদ্দুরে হিমবাহের বরফ গলে গলে অদ্ভুত সব প্যাটার্ন তৈরি করছিল , আমাদের পায়ের চাপে পাতলা বরফের পাত মচমচ করে ভেঙে বরফগলা জলের মধ্যে ডুবে যাচ্ছিল। গ্লেসিয়ারের ওপর তিন চারটে নালা তৈরি হয়েছে, দুপুর গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেগুলোয় জল বাড়ছে। সারাটা সময় জুড়ে দেখার অভিমুখ বদলানোর সঙ্গে সঙ্গে পশ্চিম দেয়ালটা নানান রূপে ধরা দিচ্ছে আর আমরা প্রায়শই থামছি, খানিকটা এই উচ্চতায় একটু দম নিয়ে নিতে, তবে মূলত দাঁড়াচ্ছি পশ্চিম দেয়ালটা দেখে নিতে। এপথেই দারুণ দারুণ গ্রানাইটের ক্লিফগুলোর তলা দিয়ে পেরিয়ে এলাম, যেগুলো রামানি এবং তার উপহিমবাহগুলোর মধ্যেকার গিরিশিরার ওপরে দাঁড়িয়ে আছে এবং দুনাগিরির দক্ষিণ দিক অবধি বিস্তৃত। রামানির উলটো দিকে দেখতে পাচ্ছি ঋষিকোটের বরফের ঢাল আর পরপর খাড়া পাথুরে চূড়া, শিপটন কলের তলা দিয়ে চ্যাঙাব্যাঙ অবধি ছড়ানো।

বলতে বলতে জো-র গতবছরের দুনাগিরি অভিযানের রাস্তা আমাদের চারপাশ থেকে উঁকি দিল। পথটা খুবই দুরূহ লাগছিল, কিন্তু পশ্চিম দেয়ালের তুলনায় তেমন কিছু নয়, আর ওদিকেই বারবার আমাদের দৃষ্টি চলে যাচ্ছিল। আমরা এই দেয়ালটা নিয়ে আলোচনা কমই করেছি, মাঝে মাঝে নিজেদের মধ্যে যা বলেছি তা হল ওর সম্ভাব্য দুর্বল অংশ, চড়ার পথ, এবং আপাত অসম্ভাব্যতাটাকে অনেকগুলো যুক্তিগ্রাহ্য এবং সম্ভাব্য চড়ার পথে ভাগ করে নেওয়া। এর সমস্ত পাথুরে ঠেলে বেরোনো অংশ, নব্বই ডিগ্রি খাড়া ঢাল, অপেক্ষাকৃত কম ঢাল বা স্ল্যাব, এর ফাটলগুলো, মাঝে মাঝে বরফের চাপড়া, সব সঅব আমাদের মনে ছবির মতো আঁকা হয়ে গিয়েছিল। জো-ও আমার মতোই মোহিত হয়ে ছিল।

“ বর্ষার বরফ আর তুষার এখনও পাহাড়ের বেশিরভাগ অংশেই জমে আছে। দূর ব্রিটেনে বসে ফটোগ্রাফ এবং রঙিন স্লাইডগুলো ঘূণাক্ষরেও এই বিশাল দেয়ালটার নির্দয় নির্লিপ্ততার কোনোরকম আভাস দেয়নি। এটাকে আমরা সামনে দেখছি যেন জমে যাওয়া একটা ঢেউ, যার কিনার থেকে বরফ গলে গলে পড়ছে। শেষ ওকে দেখার পর মাঝখানের মাসগুলোতে আমার স্মৃতিও ঝাপসা হয়ে এসেছিল, আর আমি ভাবছিলাম একে দেখার অভিঘাতটা পিটের ওপর কেমন হতে পারে। আমাদের দুজনের কেউই একে অন্যের কাছে আমাদের উদ্বেগটা প্রকাশ করিনি……..ভাবছিলাম বাড়াবাড়ি করে ফেলিনি আশা করি

গ্রাবরেখার শেষে মালপত্রগুলো নামিয়ে বাইনোকুলার দিয়ে দেয়ালটা দেখলাম, এক বন্ধু আমাদের ধার দিয়েছিল এই অভিযানের জন্য। একটা প্রায় তিরিশমনি ওজনের পাথরের আলগা অংশ ওভারহ্যাং হয়ে ওপরের আইসফিল্ডে যাবার আগে বাধা হয়ে দাঁড়িয়ে আছে, আইসফিল্ডটায় পৌঁছনোর বিকল্প যে পথটা, ‘দি লিংক পিচ’, দেয়ালের আরো মাঝামাঝি অংশে, সেটা ভয়াবহ লাগছিল। সম্ভবত সবটাই – বনিংটন যাকে বলেছিল, একেবারেই অসম্ভব। গত আট মাসে আমরা যখনই কোনো কোটেশন বা অ্যানেকডোট পেয়েছি,যা একটু হলেও আমাদের উৎসাহ দিতে পারে, আমরা সেগুলো একে অন্যের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেছি ভরসা হিসেবে। সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য ছিল লংস্টাফ-এর একটা কোটেশন, “কোনো জায়গায় যাওয়া যাবে না নিশ্চিত হবার জন্যে তুমি অবশ্যই আগে যাও গিয়ে নাক টাক ঘসে দেখো তারপর বলো।” ওঁর এই অনুশাসন আরো জোরদার করতে আমরা ঋষিগঙ্গার অন্যপাশে অনেকটা তফাতে থাকা লংস্টাফের সর্বকালের সেরা সাফল্য ত্রিশূলের কথাই বলতে পারি। ১৯০৭ সালে কোউরমেয়ার অঞ্চলের দুই ভাই হেনরি ও আলেক্সিস ব্রোকারেল এবং একজন গোর্খা খারবিরকে সঙ্গে নিয়ে উনি একদিনে প্রায় ৬০০০ ফুট চড়ে শৃঙ্গ আরোহণ সেরে সেদিনই সন্ধের মধ্যে ৭০০০ ফুট নেমে রাতে ক্যাম্প করেন। সেসময়ে ওঁরা যে উচ্চতা আরোহণ করেছিলেন, সেটাই ছিল সর্বোচ্চ, আর কেউ তখনও তা চড়েননি।

গ্রাব উপত্যকা থেকে আমি আর জো বেসক্যাম্পের দিকে যখন ফিরছি, অস্তসূর্যের আলো ত্রিশূলের বরফঢাল রাঙিয়ে দিয়েছিল। আমাদের পেছনে চ্যাঙাব্যাঙের ঝুলে থাকা পাথরটাও আলো হয়ে ছিল, তার চারপাশে মেঘের আস্তর, বোঝা যাচ্ছিল ওর উচ্চতা কতখানি, আর মেঘের চলাচল বুঝিয়ে দিচ্ছিল ওর স্থায়ীভাব।

হিমবাহে প্রথম দিনের হাঁটাটা ছিল ৯-১৪ সেপ্টেম্বর অবধি টানা ছ’দিন লোড ফেরির প্রথম দিন আর পরের দিনগুলো ছিল স্রেফ প্রথম দিনের পুনরাবৃত্তি। সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে আমরা উঠে পড়ে স্যাকে চল্লিশ থেকে পঁয়তাল্লিশ পাউন্ড মতো ক্লাইম্বিং-এর সাজসরঞ্জাম নিয়ে হিমবাহের ধারাগুলো পেরিয়ে যেতাম জল কম থাকতে থাকতেই, সক্কাল সক্কাল। অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পের রুটটা আমরা কেয়ার্ন দিয়ে চিহ্নিত করে রেখেছিলাম কিন্তু অল্পসময় পরে ওগুলো আর দরকার হত না কেননা আমরা একএকটা বোল্ডারকেই চিনে নিতে পারছিলাম। সেটা সাহায্যে এসেছিল। বোল্ডার থেকে বোল্ডারে ভারী বোঝা নিয়ে যেতে যেতে আমি আধা-ভেবলে থাকতাম আর চড়া রোদে আমার ঠোঁট জ্বলত। মনের মধ্যে নানানরকম ভাবনা চলত ফলে আমায় আর রাস্তা চিনে নেবার জন্য খুব একটা মনঃসংযোগ করতে হত না। নিজের শরীরের আসুরিক ভার থেকে মনটাকে বিচ্ছিন্ন করে অনেক দূরে নিয়ে ফেলতাম। সাধারণত আমার মন চলে যেত বাড়িতে, ভাবতাম শেষবার চলে আসার সময় যেকথা বলে এসেছি, বন্ধুদের সঙ্গে যা যা করেছি, সেইসব। মনে দুঃশ্চিন্তা যেমন ছিল, মজার স্মৃতিও ছিল।

দ্বিতীয়দিন জো চড়ার সরঞ্জাম গোছগাছ করবে বলে বেসক্যাম্পে থেকে গিয়েছিল, তাছাড়া ওর মাথা ধরেছিল আর পেটও গড়বড় করছিল, ফলে আমি একাই গিয়েছিলাম। ওইদিন ছাড়া আমরা মোটামুটি একসঙ্গেই পথ চলতাম, ঠোক্কর খেতে খেতে, যে যার চিন্তায় বিভোর হয়ে। আমি ব্যাখ্যাতীত একটা প্রয়োজন অনুভব করতাম জো-র একশো গজের মধ্যে থাকতে। আমি আমার হতাশাটা বেশ অনুভব করতে পারি, যার জন্য আমার আলাস্কার চড়াটাই বন্ধ হয়ে গিয়েছিল, কেবল ভাবনা হত, পা পিছলে হাঁটু না মচকে যায়। ঘুম থেকে উঠে একটু নাক থেকে রক্ত গড়িয়েছে, কি কাঁধে এবং বুকের ওপরের দিকটায় সামান্য ব্যথা অনুভব করেছি – ভাবনা হত, প্রায় মানসিক রোগীর মতো হয়ে উঠছিলাম। আগের অভিযান গুলোর তুলনায় আমি এবারে অনেক বেশি শারীরিক এবং পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতার দিকে খেয়াল রাখছিলাম। খেয়াল করে অন্তর্বাস বদলানো, সেগুলো কাচা, চুল আঁচড়ানো, দাঁত মাজা, নিজেকে উষ্ণ এবং স্বচ্ছন্দ রাখা। ধারাবাহিকভাবে পালস মাপছিলাম, কতটা কর্মক্ষম আছি, কতটা উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পেরেছি, সেটা বুঝে নেবার জন্য। আমি জানতাম আমার উনিশ-বিশ অথচ মারাত্মক কিছু ঘটলে জো ভীষণরকম আশাহত হয়ে পড়বে। ভাবছিলাম ও’ও ওইরকমই ভাবে কিনা। 

আমরা অ্যাডভান্স ক্যাম্পে মালপত্র ফেলে নীচে ফিরে আসার আগে সেখানেই বসে একটু চকোলেট খেয়ে নিতাম আর দেয়ালটার দিকে তাকিয়ে থাকতাম। দেখতেই থাকতাম, চড়ার পথের কোনো নতুন সম্ভাবনার জন্য, দেয়ালটা দেখতে থাকাটা আমাদের অনুক্ষণের চিন্তা হয়ে গিয়েছিল। শিগগিরই আমাদের চড়ার একটা লাইন ঠিক করে ফেলতে হবে। রামানির মাথায় যে গিরিশিরাটা গিয়ে পশ্চিম দেয়ালে মিশেছে সেটা বরাবর যতটা সম্ভব সোজাসুজি উঠে গিরিশিরার ওপরের কলে পৌঁছোতে হবে তারপর আশা করছি ওখানে একটা ক্যাম্প করে ওখান থেকে বাঁদিকের গিরিশিরা ধরে ওঠার চেষ্টা চালানোর। এতে করে আমরা ১০০০ ফুট উচ্চতা অতিক্রম করতে পারব। বিকল্প পথটা হল দেয়ালের মাঝ বরাবর লিঙ্ক পিচ-এর তলায় পাথরের স্ল্যাবের ওপরে যে তুষার স্তম্ভগুলো রয়েছে তার মাঝে একটা বরফের-গুহা খুঁজে বার করা, সেটা অতটা জোরদার লাগেনি, ফলে আমাদের মতামত ওটার বিপক্ষেই গিয়েছিল। আইসফিল্ডে পৌঁছোতে পারাটা মনে হচ্ছিল একটা প্রধান সমস্যা হবে।   

প্রতিটা যাতায়াতের পর আমরা বেশ বুঝতে পারছিলাম একটু একটু করে উচ্চতার সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিচ্ছি, প্রতিবার আগের চেয়ে ভালো, আর আমাদের হাঁটার সময়েরও উন্নতি হয়েছে। আমরা একে অন্যের ছবি তুলতাম, বেকায়দায় পড়া, বেকুব অবস্থায়, যেমন বিকেলের দিকে হিমবাহ-নালার জলে ভিজে অবস্থায়, হিমবাহের ওপর বিশাল মাশরুমের মতো বোল্ডার ঠেলে ফেলার চেষ্টা করছি, বরফের লম্বা ডান্ডা চেপে ধরে আছি, এমন। ব্যাপারটা যেন একটা যুদ্ধ, ফট করে ক্যামেরা বার করো আর ছবি তোলো। রাস্তা আর চারপাশের দৃশ্য পরিচিত হয়ে গিয়েছিল। এই চেনাজানাটা আমাদের মানিয়ে নিতে তো সাহায্য করেইছিল, আমাদের নিশ্চিন্তও করেছিল।

আমরা যখন ফিরে আসতাম, তখন বেসক্যাম্প বিকেলের মেঘে ঢেকে থাকত, আমরা নাম দিয়েছিলাম “ব্লিক হাউস”। তবুও ঘরে ফেরার মতো লাগত। ফিরে এসে ভারী খাবার বানিয়ে খেয়ে, আলসেমি করে, বই পড়ে, গপ্প করে, ক্লাইম্বিং আর বাড়ির কথা নিয়ে আলোচনা করে কাটাতাম। জো-র হাতে নির্দিষ্ট কোনো কাজ ছিল না যাতে সে ফিরে গিয়ে যোগ দেবে, ও বলত ফিরে গিয়ে যে কী কাজ করবে! গত কয়েকবছর ধরে এটা সেটা কাজকর্ম করে ক্লাইম্বিং চালিয়ে যাওয়াটা ক্লান্তিকর হয়ে উঠছিল ওর কাছে। উলটোদিকে আমার, মোটামুটি সবসময় একটা স্থায়ী কাজ কিংবা কলেজে পড়ার ব্যাপার ছিল, ফলে জো-র স্বাধীনভাবে এত কাজকর্ম করা দেখে আমার একটু ঈর্ষাই হত। তারপর আমরা পরদিন হিমবাহ ধরে হাজার দুয়েক ফুট ওঠার ব্যাপারটা নিয়ে আলোচনা করতাম।  জো সকালে ওঠাটা মোটেই পছন্দ করত না।

“পাথরে চড়ার থেকে এই মাল বওয়াটা বেশি শক্ত।” ও বলত। এই পর্যায়ে মাল বওয়ার জন্য কয়েকজন পোর্টার যদি রেখে দেওয়া যেত কিংবা এই সময়ে সাহায্যের জন্য একজন লিয়াজঁ অফিসার – যাইই হোক আমাদের “ভারতের অন্যতম শ্রেষ্ঠ ক্লাইম্বার” দেওয়া হবে কথা দেওয়া হয়েছিল।

আমাদের কাছে একটা ফোল্ডারে ফেস-টার ছবি ঠাসা ছিল, ওগুলো আমাদের একইসঙ্গে সন্দেহ আর আশার মুহূর্ত জোগাত। কিন্তু সেসব মুহূর্তরা একেবারেই ব্যক্তিগত। কথাবার্তা যা হত তা সাধারণ এবং বাস্তবোচিত। দিনের পর দিন আমরা এই দেয়ালের নীচে ঘোরাফেরা করেছি, নিজেদেরই রসদের ভিড়ে-র কারণে চড়ার চেষ্টা থেকে বিরত থেকেছি, যা অবশ্য একেবারেই আমরা এড়াতে চেয়েছিলাম। তারপর স্লিপিং ব্যাগে সেঁধিয়ে গিয়ে নিজেদের ভাবনা চিন্তায় ডুবে যেতাম। মাসের পর মাস আমি নিজেকে এই রুটের জন্য প্রস্তুত করেছিলাম। আমরা দুজনেই প্রচুর খেটেছি, নিজেদের মধ্যে বিশ্বাস আর পারস্পরিক শ্রদ্ধা তৈরি করেছি। আমি বাড়ির কথা ভাবতাম, সব বাড়িগুলোর কথা, যেখানে যেখানে আমি থেকেছি। জো এমিল জোলার নানা পড়ছিল, ওতে মেয়েদের সম্পর্কে বিষণ্ণ করা সব কথা। ও স্বপ্ন দেখত নানান দিক থেকে নানারকম লোকজন এসে পৌঁছোচ্ছে। ডন হুইল্যান্স এসে পড়ল আর তারপর আমেরিকান দলের অভিযান, যেটা আমরা শুনেছিলাম, দুনাগিরি চড়তে যাচ্ছে।  জো-র স্বপ্নে ওটা ক্যালিফোর্নিয়ার সোনালি চুলের সার্ফিং করা মেয়েদের অভিযান।

১৪ সেপ্টেম্বর শেষমেশ আমরা বেসক্যাম্প ছাড়লাম। তাঁবুর দরজার ঠিক ভেতরে একটা পলিথিন ব্যাগে একটা চিরকূট পাথর চাপা দিয়ে রেখে এলাম। “টু হুম ইট মে কনসার্ন।” সামান্য বার্তা, যে, আমরা যাচ্ছি, চ্যাঙাব্যাঙ চড়ার চেষ্টা করতে, কিন্তু কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই ফিরব। তারপর কাঁধে ইয়াব্বড়ো মাথাভারী বোঝা তুলে নিলাম আমরা, মোটামুটি একেকজনের ভাগে সত্তর পাউন্ড মতো, ওর মধ্যে যা যা বাকি ছিল, আমাদের সেই সমস্ত যন্ত্রপাতি এবং রসদ, যা যা দরকার হবে বলে ভেবেছিলাম।

“ব্রিটেনে থাকতে এত মাল বইতে হবে ভাবিনি, ১৭০০০ ফুট অবধিও ঠিক আছে।” জো বলেছিল।

শেষ বিকেলে আমরা বেরোলাম, হিমবাহের ওপর অন্ধকার নেমে এল, পশ্চিম দেওয়ালের ওপর ধীরে ধীরে সূর্য অস্ত যাওয়া দেখলাম।

একটা ছোটো নাইলন টেন্ট কোনোমতে পেতে নুনে জারানো গরুর মাংস আর সেদ্ধ আলু রান্না করে খেয়ে স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে পড়লাম, বাইরে বাতাস বেশ ঠান্ডা। আশা করি কয়েকদিনের জন্য হিমবাহ পেছনে পড়ে রইল। মাথার ওপরে ফুটফুটে তারাভরা আকাশ। সেরাতটা বেশ অস্বস্তিকর ছিল – পিঠে পাথর ফুটছে, চ্যাঙাব্যাঙের উলটোদিকের গিরিশিরার দুটো চূড়া থেকে পাথর পড়ার শব্দ। যে মোরেনের ওপরে তাঁবু পেতেছি সেটা গুড়গুড়, ক্যাঁচক্যাঁচ শব্দ করে চলেছে। সকালবেলা যখন উঠলাম, তাপমাত্রা মাইনাস ১৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস।

খাবার আর যন্ত্রপাতি যখন আলাদা আলাদা করছি আবিস্কার করলাম আমাদের খাবারে এর মধ্যেই হানা দিয়েছে কেউ, আর বাকি সব খাবারদাবার ছেড়ে প্লাস্টিকে মোড়া একটা বাক্স খুলেছে যাতে ছত্রিশটা মার্স-চকোলেট বার রাখা ছিল। ছেঁড়া বাক্সটা ছাড়া র‍্যাপার বা চকোলেট-এর একবিন্দুও কোথাও পড়ে নেই। ছত্তিরিশটা, আলাদা আলাদা মোড়া, দু-আউন্সের বারগুলো একেবারে গায়েব, কিচ্ছুটি পড়ে নেই। বরফের ওপর কোনো দাগটাগও নেই, যেইই নিয়ে থাক চকোলেটগুলো, মোরেনের ওপর দিয়েই এসেছিল।

“মনে হয়, ছোটো কোনো ইঁদুর জাতীয় প্রাণী”, জো বলল, “আগেরবার ঠিক যেমনটা হয়েছিল, দুনাগিরি বেসক্যাম্পে। প্রতি রাতেই আমার খাবারে কেউ একটা হানা দিয়ে যেত – আর চকোলেট, ক্রিসমাস কেক, মিন্টকেক নিয়ে যেত – এমনকি আমার দাঁতমাজার ব্রাশ! পাঁচদিন ধরে ওটাকে ফাঁদে ধরার চেষ্টা করেছিলাম কিন্তু কখনো দেখতে অবধি পাইনি।”

সম্ভবত ওটা বা ওর সমগোত্রীয় কোনো প্রজাতি হিমবাহেও থাকে। কিন্তু তা সত্ত্বেও আমরা বুঝে উঠতে পারলাম না ওটা কী করে একটা একটা চকোলেট বার বয়ে নিয়ে গেল।

“ওটা যাইই হোক,” জো বলেছিল, “অতটাও চালাক নয়। ও ব্যাটা ফ্রি-ভাউচার গুলো নিয়ে যেতে ভুলে গিয়েছিল, আরো একটু পেতে পারত।”

সারাটা দিন আমাদের যন্ত্রপাতি নিয়ে খুটখাট করে কাটালাম, ডাবল বুটে গেটারগুলো লাগিয়ে চিপকে নিলাম, পরার জন্য সঠিক পোশাক বেছে নিলাম, ক্র্যাম্পনগুলো ঘসে ধার দিয়ে নিলাম, জুতোর সঙ্গে ঠিকঠাক লাগিয়ে কাজের জন্য তৈরি করে নিলাম, যাতে হঠাৎ করে অপ্রস্তুত না হতে হয়। সবকিছু এক্কেবারে সঠিক হওয়া দরকার, যন্ত্রপাতি নিয়ে একেবারেই নিশ্চিত হওয়া যায় স্বচ্ছন্দ থাকলে, সেটার সঙ্গে পরিচিত থাকলে, নাড়াচাড়া করা এবং সেটা যথাস্থানে ব্যবহার করার অভ্যাস থাকলে, এগুলোর ওপরেই এতটা নির্ভর করতে হয় যে! এই শিল্পের যন্ত্রসমূহ। বিকেল গড়ালে, দেখেশুনে সন্তুষ্ট হলাম যে খাবারদাবার আর যন্ত্রপাতি সব তৈরি, যতটা নিখুঁত হওয়া সম্ভব, তার কাছাকাছিই রয়েছে সবকিছু, এখন জুতোর ভেতরের পা-দুটো আর হেলমেটের ভেতর মাথাটার ওপর নির্ভর করছে, করে দেখাবার। প্রথম লক্ষ্য হল রিজের ওপর একটা ক্যাম্প তৈরি করা।

ষোলো তারিখ সকালে ছায়ায় ছায়ায় রওনা হওয়া গেল। পেটের মধ্যে টেনশনে গুড়গুড় করার ভাবটা ভুলেই গিয়েছিলাম কয়েকমাস, যেটা অজানা অনির্দিষ্ট কোনো কিছু করতে গেলেই আমায় পেয়ে বসে, সেটা ফিরে এসেছিল। হারনেস আর ক্র্যাম্পন পরাই ছিল, আইস অ্যাক্স আর হাতুড়ি হারনেসের যথাস্থানে রাখা। শিগগিরই চারপাশে কেবল ক্র্যাম্পনের নীচে বরফ ভাঙা আর হাঁফ ধরা নিঃশ্বাসপ্রশ্বাসের শব্দ, হিমবাহ আড়াআড়ি পার হয়ে এগোনোর সময় উচ্চতার সঙ্গে সঙ্গে বুকে হাতুড়ি পেটার মতো আওয়াজ, এখানে হিমবাহ বেঁকে ওপরে বরফ-ঢালের গোড়া অবধি উঠে গেছে। মাথার ওপরে বরফের ঢালটা বিস্তৃত, তাতে অজস্র বাঁকাচোরা জল নামার জায়গা, সঙ্কীর্ণ খাত বা গালি, পাথরের চাঙর বরাবর একেবারে গিরিশিরা অবধি। বরফে লাথি মারতেই বরফের টুকরোগুলো শব্দ করে নাচতে নাচতে ঢাল বেয়ে নীচে চলে গেল।

বার্গশ্রুন্ড পেরোলাম, ওটার ফাঁকে ওপর থেকে বরফ পড়ে একটা জোড়মতো তৈরি হয়ে ছিল। হঠাৎ করে খাড়াইটা বদলে গেল, আমরা টিপ-টো করে হাতে আইস অ্যাক্স এবং হাতুড়ি দিয়ে আলতো করে বরফে মেরে তার সাহায্য নিয়ে বুটের ডগা দিয়ে বরফে মেরে মেরে উঠতে থাকলাম। আমরা এক অস্তিত্ব থেকে অন্য অস্তিত্বের দিকে পা ফেলছিলাম।

“বেশ ভালোই আছে এটা।” জো বলে ওঠে।

“দড়ি বার করার কোনো মানে হয় না।” আমি বলি, তারপর আমরা উঠতে থাকি, মাঝে মাঝে থেমে একে অন্যের ছবি তুলি। ছবির মধ্য দিয়ে খাড়াই আর অবস্থানের ব্যাপারটা ধরা পড়ে কিন্তু এই উচ্চতার কারণে আমাদের যে পরিশ্রম সেটা নয়। দশ-বারোটা ধাপ ওঠার পর আমায় থামতে হয়, হাঁফিয়ে শ্বাস টেনে মাথাটা পরিষ্কার হওয়া অবধি অপেক্ষা করি। দড়ি ছাড়া উঠছি বলে ঢালের ওপর যে যার নিজের গতিতে উঠতে পারি, আর দেখা যায় সেটা মোটামুটি একইরকম। আমার ওজন জো-র থেকে একটু বেশি, ওর হালকা চলন দেখে নিজেকে ক্যাবলা লাগে। একটু চিন্তাতেই ছিলাম, কেননা যেখানটায় আমরা চড়ছিলাম সেখানে জায়গায় জায়গায় বরফ মাত্র ছ’ইঞ্চি পুরু। আমরা মোটা বরফের চাদরের ওপর দিয়ে চড়ছিলাম যেটা আলগা পাথর আর নুড়ির ওপরে পড়ে ছিল। ফলে আমি আমার বপু নিয়ে ওপরে উঠতেই বরফে ফাটল ধরার এবং ক্যাঁচকোঁচ আওয়াজ হচ্ছিল।

আমার সমস্ত ইন্দ্রিয় টানটান আর সজাগ হয়ে ছিল। হঠাৎ একটা তীক্ষ্ণ ফাটল ধরার আওয়াজ আমার কানে বন্দুকের গুলির মতো লাগল। আমি মুহূর্তে থেমে গেলাম, ভয়ে আড়ষ্ট, ভাবছি গোটা বরফের চাদরটাই বুঝি আমাকে নিয়ে ভেঙে পড়ছে, আর মনে হল নিমেষে আমি পাহাড়ের কয়েকশো ফুট নীচে আছড়ে পড়ছি। কিন্তু কিছুই ঘটল না।

“তুমি শুনতে পেলে?” জোকে জিজ্ঞাসা করি।

“হ্যাঁ।” ও বলে, “আমিও একইরকম অনুভব করেছি। যদিও সব ঠিকঠাকই থাকবে, ওটা স্রেফ আমাদের ওজনের সঙ্গে ফের খাপ খাইয়ে নিচ্ছে। যাই হোক এব্যাপারে আমাদের কিছুই করার নেই। এই ঝুঁকিটা নিয়েই আমাদের উঠতে হবে।”      

একা একা চড়াটা আর ততটা একাকী লাগে না যদি আরেকজন কেউ কয়েক ফুট দূরেই চড়তে থাকে, কিন্তু এইবারে আমরা দ্রুত সিদ্ধান্ত নিলাম ন্যুনতম পঞ্চাশ ফুট সরে যাব একে অন্যের থেকে যাতে বরফের ওই বিশেষ অংশে চাপ কম পড়ে।

যখনই বিশ্রামের জন্য থামছিলাম, আমি গিরিশিরার ওপরে একটা পাথরকে নজর করছিলাম, কিন্তু ওটা একটুও কাছাকাছি হয়েছে এমন কখনোই মনে হচ্ছিল না। বরফের ঢালে সবচেয়ে স্থিতিশীল অংশ খোঁজার কাজটা বেশ জটীল। এক হাজার ফুট উচ্চতা। সকালের সূর্যের উত্তাপ আস্তে আস্তে দুনাগিরির ওপর ছড়াচ্ছে, কিন্তু পাহাড়ের পশ্চিম দিকে আমাদের থেকে অনন্তদূর মনে হচ্ছে। চ্যাঙাব্যাঙ এতটাই ঢ্যাঙা যে সূর্যের আলো টপকে আসাটা কঠিন। আমি পায়ের আঙুলগুলো একেবারেই টের পাচ্ছি না – ঠান্ডায় অসাড় হয়ে গেছে। আমি একটা পরীক্ষা করছিলাম, একটা আইডিয়া, শুনেছিলাম আলাস্কায় আমেরিকান ক্লাইম্বাররা চেষ্টা করেছিল, কুপরিবাহী স্তর হিসেবে ব্যবহার করে নিওপ্রিন মোজা পরা। ওটা মোটেই কাজ করছিল না। আমি বুঝে গেলাম, যখন সূর্যের আলো এসে পড়বে গায়ে, আমায় জুতোটা খুলে ফেলে পাটা গরম করে নিতে হবে – পায়ের আঙুল অনেক ঘণ্টা অসাড় হয়ে থাকলে ওটা অপরিবর্তনীয় ক্ষতি করে দেবে। একটা নির্বোধের মতো ভুল গোটা অভিযানটাকেই বানচাল করে দেবে।

শেষ চারশো ফুট আমরা একটা সরু খাতের মধ্যে, একটা গালিতে ঢুকে গেলাম। শেষ কয়েকফুট, যখন উচ্চতা ১৮০০০ ফুট, মনে হচ্ছিল আর শেষই হচ্ছে না। কিন্তু তারপরে হঠাৎ করেই শেষ হয়ে গেল। গিরিশিরার ওপরে উঠতেই একঝলক ঠান্ডা বাতাস আমাদের অভ্যর্থনা করল। উলটোদিকে নীচে বাগিনি গ্লেসিয়ার, প্রায়ই ভেবেছি, কিন্তু এই প্রথমবার চাক্ষুস হল।

আমাদের ডানদিকে চ্যাঙাব্যাঙের উত্তরমুখী গ্রানাইটের খাড়া দেয়াল। ওই ঠান্ডা, অন্ধকারবরফাবৃত দেয়ালটা কখোনোই সূর্যের স্পর্শ পায় না। এর উচ্চতাটা গথিক আবছায়াটাকে আরো সুদৃঢ় করেছে। আমি আশা করেছিলাম আমাদের চড়ার পথটা ওর ওপর দিয়ে ঘুরে যাবে না। ওর মাথায় চ্যাঙাব্যাঙের হর্ন, শিংগুলো চূড়ার গিরিশিরার ওপরে রয়েছে যেটা দক্ষিণ দিক থেকে তোলা পাহাড়টার ছবিতে আমরা দেখেছি। বাতাস ওখানে স্বভাবতই বেশ জোরদার – আলগা তুষার পাগলের মতো পাক খাচ্ছে ঠিক আমাদের মাথার ওপরে সরাসরি হাজার চারেক ফুট ওপরে। আরেকপ্রস্থ গোল হওয়া পাহাড়ের সারি আমাদের নজরে এল। কলঙ্কের উত্তর-পশ্চিমমুখী ঢাল সোজা ওপরে উঠে একটা বরফের অ্যারেট তৈরি করে ওর চূড়ায় পৌঁছেছে – এদিক থেকে দৃষ্টিকোণটা নতুন, যেটা আগে সবসময় মনে হত চ্যাঙাব্যাঙের নরমসরম বোন আর কি। এই পাহাড়ের ওপাশে ঋষিপাহাড়, হরদেওল আর তারপরে তিরশূলি, যেটায় আন্দ্রে রশের সুইস অভিযানের দলটাকে তুষারধ্বসে তলিয়ে দিয়েছিল, ওরা ১৯৩৯ সালে দুনাগিরি আরোহণ সেরে তিরশূলি ওঠার চেষ্টা করতে গিয়েছিলেন। আমাদের বাঁদিকে, বিরাট দুর্গের প্রাচীরের মতো বেঁকে দাঁড়িয়ে, পুর্বী দুনাগিরি। উত্তর দিকে লাটাক চূড়া, ১৯৫০ সালে স্কটরা এসেছিলেন। কিন্তু গোটা জায়গাটাই নিষিদ্ধ অঞ্চল, আমি আর জো ঠিক ইনার লাইনে দাঁড়িয়ে। সীমানা ঠিক ওদের ওপারেই।

এইসব সাদা চূড়াগুলোর ওপাশে, এদের মাঝের ফাঁক দিয়ে তিব্বতের বাদামিরঙা মালভূমি একঝলক দেখতে পাচ্ছিলাম। অবশেষে আমি তিব্বত চাক্ষুস করতে পারলাম – এভারেস্টের চূড়ায়, যেখানে দিগন্ত প্রায় আড়াইশো মাইল দূরে থাকার কথা, এক ঝড়ের ঠেলায় তা প্রায় একশো ফুটের মধ্যে এসে গিয়েছিল।

এশিয়ার ছাদ ও তারও দূরের দৃশ্য আমাদের মধ্যে আরো বিচ্ছিন্নতাবোধ জাগিয়ে দিল। তাকিয়ে তাকিয়ে দেখার সময়ে ক্লাইম্বের টেনশনটা আর ছিল না। এখন আমার পা দুটো পাথরে শক্তভাবে রাখা, হাতও পাথরের গায়ে আমায় স্থির রেখেছে, আর এর আগে আমার প্রাণটা চারটে ক্র্যাম্পন পয়েন্টে আর ধরে-আসা কাফ মাস্‌লের ওপরে ঝুলে ছিল। রামানি হিমবাহের দিকে ফিরে তাকিয়ে দেখছি মোরেনের ওপর একটা ছোট্ট নীল ছোপের মতো বেসক্যাম্প। পেছনের গিরিশিরার ওপাশ থেকে নতুন পাহাড়ের সারি উঁকি দিচ্ছে। ঋষি কোট মনে হচ্ছে ঝুঁকে থাকায়, আবার আড়াল হয়েছে, আর আরেকবার, মেজাজও পরিবর্তন করেছে। জো আমার আনন্দে যারপরনাই আশ্বস্ত হয়েছিল।

“আমি দ্রুত দৃশ্যবদলের জন্য কোনো তাড়া অনুভব করিনি, কিন্তু রামানিতে পিটের খুব মুহ্যমান লাগছিল, ওখানে আমাদের চারপাশটা এত চাপা ছিল, দৃষ্টি সংকুচিত হয়ে পড়েছিল। একদিক থেকে ওকে এখানে নিয়ে আসার জন্য নিজেকেই দায়ী মনে হচ্ছিল আর এর ত্রুটিগুলি সম্পর্কে দোষীও লাগছিল। কিন্তু এখন, এই এখুনি, পিট কেমন শান্ত হয়ে এসেছে; একটা ক্লস্ট্রোফোবিক লোককে একঝলক বাতাস আর স্বাধীনতা দিলে যেমন হয়, তেমনি।”

পশ্চিম দিকে, বেশি দূরে নয়, যে গিরিশিরায় আমরা দাঁড়িয়ে, তার ওপরেই বাগিনি খাল, যেটা টম লংস্টাফ ত্রিশূল আরোহণের আগে একটা অনুসন্ধানী অভিযানে এসে পার হয়েছিলেন। সঙ্গী চার্লি ব্রুস, ব্রোকারেল ভাইয়েরা এবং চারজন গুর্খা নিয়ে ওরাও প্রকৃতপক্ষে এই একই দৃশ্য দেখেছিলেন, যা এখন আমরা দেখছি। বাগিনি গ্লেসিয়ারের পাদদেশে বেসক্যাম্প থেকে বেরোনোর তিনদিনের মাথায় ১৯০৭ সালের ২২ মে সকাল ১০টার সময় ওরা বেশ কয়েকঘণ্টা ধাপ কেটে কেটে খালের মাথায় পৌঁছোন। ওরা বিপুল বোঝা বয়ে নিয়ে উঠেছিলেন, রাইফেল, কার্তুজ আর দশদিনের খাবারদাবার। উলটোদিকে কী আছে ওঁরা জানতেন না, কেবল, হিমবাহ-গলা জল সম্ভবত অন্যদিকে গিয়ে ঋষি গঙ্গায় মিশেছে, এইটুকু ধারণা ছাড়া। ওঁরা জানতেন না ওঁরা কি ইনার স্যাংচুয়ারিতে ঢুকছেন নাকি কেবল স্যাংচুয়ারির বাইরের অশ্বক্ষুরাকৃতি জায়গাটাতেই ঢুকছেন। তাঁরা এও জানতেন না একবার যদি ঋষিগঙ্গা বেসিনে নামেন সেখান থেকে আবার বেরোতে পারবেন কিনা। ওঁরা একটা ঝুঁকি নিয়েছিলেন। আদ্যিকালের কিছু পিটন নিয়ে এবং তাঁদের সঙ্গে থাকা কেবলমাত্র ছশো ফুট দড়ি নিয়ে এক হাজার ফুট নীচের  রামানিতে পৌঁছোতে ওদের পাঁচঘণ্টা সময় লেগেছিল। ওঁদের কাছে, নিশ্চিতভাবেই, বরফে চড়ার মতো অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি ছিল না, যা আমি আর জো ব্যবহার করছিলাম। লংস্টাফ ওঁদের এই অবরোহণটাকে হিমালয়ের ওঁর যাবতীয় ক্লাইম্বিং-এর মধ্যে একমাত্র ক্লাইম্ব বলে অভিহিত করেছেন যা আল্পসের নিরিখে বেশ কঠিন বলা যেতে পারে। এর পরের কয়েকদিনে ফুরিয়ে আসা খাবারদাবার নিয়ে ওরা বেরোনোর রাস্তাও খুঁজে নিয়েছিলেন, যেপথে আমি আর জো এখানে ঢুকেছিলাম। লংস্টাফের কাছে এটা ছিল “পাহাড়ে কাটানো সবচেয়ে আনন্দের এবং সুখের একটা সপ্তাহ।” নিজের জায়গা ছেড়ে যোগাযোগহীনভাবে কোনো লোক যতটা চরম সীমা অবধি যেতে পারে ওরা ঠিক সেইখানে পৌঁছেছিলেন। ওর সমসাময়িক একজন মন্তব্য করেছেন, “লংস্টাফ হলেন সেই মানুষদের একজন যাঁর ওপর ঈশ্বরের আশীর্বাদ আছে।”  আজ, জো আর আমার কাছে এটা একটা সময়ের কষ্টিপাথরে যাচাই হওয়া সাফল্য আর আধুনিককালে হিমালয়ে ক্লাইম্বিং-এ শেষ যেকটা সমস্যা রয়ে গেছে তার পেছনে প্রতিযোগিতার দৌড়ে যোগ দিয়ে আলোকিত হবার মতো ঝুলিতে কিছুই নেই।

অনেকক্ষণ খর চোখে নীচের বাগিনি হিমবাহটা দেখতে থাকি। সত্তরের রাজনৈতিক আবহাওয়া যেকাউকে লংস্টাফ-এর অভিযানের পথ অনুসরণ করতে বাধা দেবে আজ। যাই হোক, ১৯০৭ সালে লংস্টাফ এভারেস্ট যেতে চেয়েছিলেন। নেপালের দরজা সমস্ত বিদেশীদের কাছে বন্ধ ছিল আর তিব্বত, সেসময়ের বৃহৎ ক্ষমতার রাজনীতির চক্করে, বড়ো অভিযানের অনুমতি দিত না। সুতরাং উনি গাড়োয়ালে চলে আসেন।

জো আর আমি গিরিশিরার অনেকটা তলায় আর দেয়াল থেকে অনেক অনেকটা দূরে ছিলাম। গিরিশিরার ওপর থেকে ঝুলে থাকা কর্নিশের অংশগুলো শঙ্কিতভাবে দেখে আমরা  দুজনের মধ্যে একটা দড়ি বেঁধে নিয়েছিলাম। গিরিশিরার ওপর দিয়ে সাবধানে যাছিলাম আমি, পাথর থেকে পাথরে ছুঁচোলো বরফের চাঁইগুলো এড়িয়ে এড়িয়ে। দড়িটায় টান পড়লে জো এগোচ্ছিল আর এইভাবে একসঙ্গে চলছিলাম। এখানটা দুর্দান্ত – হাওয়ায় কেটে কেটে বরফের ভাষ্কর্য আর অসাধারণ মাশরুম এবং গোলাকার বরফের আকৃতি গিরিশিরা জুড়ে, কখনও কোনো মানুষের পা পড়েনি। এর মধ্য দিয়ে বুদ্ধি করে একটা পথ করে ছাপ রেখে একটা নিরাপদ রাস্তা বুনে দেওয়া সত্যিই বেশ তৃপ্তির। ছোটোবেলায় যেমন হত ঠিক তেমনি, ঠান্ডা পরিষ্কার শীতের সকালে, প্রচুর বরফ পড়ার পর, আমি তাড়াতাড়ি উঠে সাদা ধবধবে বরফে নিজের চলার পথে পায়ের ছাপ ফেলতাম আগেভাগে। সম্ভবত আধিপত্য দেখানোর একটা তীব্র আর্তি থেকে হত ওটা। আমি জানি না, তবে ব্যাপারটা বেশ উপভোগ্য ছিল আর আমায় একলা করে তুলত।

সকালের সূর্য এখন ঝটপট বাগিনি শৃঙ্গ বেয়ে নামছে, ২০০০০ ফুটের শৃঙ্গটা আমাদের থেকে দুনাগিরির দিকে যাওয়া আঁকাবাঁকা গিরিশিরার ওপরে রয়েছে। খুব শিগগিরই আমাদের এখানে এসে পৌঁছোবে রোদ্দুর। প্রথমে ওটা জোর ওপরে এসে পড়ল তারপর আমার ওপর, একটা দশ ফুটের আলোছায়া তৈরি করল গিরিশিরার ওপরে। চোখ তুলে দেখি চ্যাঙাব্যাঙের দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরার ওপর সূর্যের আলো সবে ছুঁয়েছে, পশ্চিম দেয়ালটার ওপর তার আলো চুঁয়ে পড়ছে, তখনও সেটা ছায়ায়।

“এই পথে সূর্যের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আমাদের চড়াটা বেশ ক্রিটিক্যাল।” জো বলল,“শালা, সক্কালবেলাটা বহুত ঠান্ডা হবে, শক্ত ক্লাইম্বিং করা মুশকিল।”

আমি ঘড়ি দেখলাম। দশটা বাজে। পাহাড়ের এদিকের গায়ে  ঠিকঠাক রোদ পড়তে আরো দুঘণ্টা।

পাহাড়ের ধারটা হঠাৎ করে খাড়া দেয়ালের দিকে উঠে গেছে। “আর ওপরে কিন্তু তাঁবু লাগানোর জন্য এজায়গাটার মতো কোনো চওড়া অংশ পাব না।” আমি বললাম। আমি একটা গ্রানাইটের স্ল্যাবের ওপর থেকে তুষার সরিয়ে জুতো খুলতে শুরু করেছিলাম। ঠান্ডায় পায়ের আঙুলগুলো সাদা হয়ে গেছে, হাত দিয়ে ঘসে ঘসে ওগুলো গরম করতে থাকলাম যতক্ষণ না আবার লালচে আর সাড় ফিরে আসে। ভেতর থেকে কেউ বলে চলেছিল, “নিজের খেয়াল রাখো, বেদম হয়ে পোড়ো না, ঠিকঠাক খাওয়াদাওয়া করো, উষ্ণ থাকো, তাহলেই চলতে পারবে।”  বড়োসড়ো অভিযানে শারীরিক সক্ষমতার অনেকরকমের তুলনা টুলনা করা যায়। আমি সবসময়েই আমার দুঃশ্চিন্তাগুলো বলে ফেলি, আর দেখা যায় আমারই অভিযোগ বেশি, শারীরিক টুকটাক সমস্যাও বেশি। জো-কে কিছুতেই আমি কায়দা করে ওর দুর্বলতা প্রকাশ করাতে পারতাম না। একটা খেলা ছিল যেন।

“তোমার পা কি ঠান্ডা, জো?”

“না। তোমার?”

“ওহ না না, এই জুতোর ফিতেটা আলগা হয়ে গিয়েছিল।”

ধারটার ওপরে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ আনছিলাম। আমরা ধারের ওপর একটা চওড়া অংশ কেটে সমান করে নিতে নিতে টের পেলাম ধারটার নীচের দিকে যে নির্ভরতা আমি অনুভব করেছিলাম সেটা ফিরে আসছে। যেটা ছিল একটা বিবর্ণ, প্রতিকূল, ঝোড়ো বাতাসের বরফের ধার সেটাকেই একটু একটু করে নিজেদের বাসস্থান বানিয়ে তুলছিলাম, যদিও আমাদের ১৫০০ ফুট ওপরে বিশাল বিশাল পাথরের ওভারহ্যাং আমাদের দৃষ্টিপথ আড়াল করে রেখেছিল।

নামাটা ছিল চরম কষ্টকর, কিন্তু অল্প সময়ের, আর আমাদের পিঠে ছিল খালি স্যাক, মালপত্র ধারটার ওপরে ডাঁই করে আসা। ওপরে চড়তে আমরা সময় নিয়েছিলাম তিন ঘণ্টা – আর নেমে আসতে সময় লাগল মোটে দেড় ঘণ্টা। হিমবাহের ওপর দিয়ে হেঁটে হেঁটে আমাদের অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে ফেরার সময় হালকা বরফ পড়া আরম্ভ হয়ে গিয়েছিল। বিকেল হতে হতে এতবার পশ্চিম দেওয়ালটা মেঘে ঢাকল আবার তার ওপর থেকে মেঘ সরে গেল, যে গুণতে ভুলে গেলাম। দশবার তো হবেই। আবহাওয়ার ধাঁচটা মোটামুটি একইরকম, সুস্থিত – কিন্তু এমনটা কদ্দিন থাকবে?

সকালের চড়াটা নিয়ে উচ্ছ্বসিত ছিলাম। আমার একটা বিচ্ছিন্ন সত্তা কৌতূহলী ছিল খুব যে আমি ঠিক কতটা উপভোগ করছি এটা। একবার দেয়ালটায় চড়া সড়গড় হয়ে গেলে, সম্ভবত এই ক্লাইম্বটার সঙ্গে আগে আমি যা চড়াচড়ি করেছি তার সেভাবে কোনো তফাৎ থাকবে না। আমাদের প্রস্তাবিত চড়ার পথে সেভাবে কোনো প্রাকৃতিক বিপদও নেই, কিন্তু প্রতি মুহূর্তে আমাদের অনবরত একটা প্রচেষ্টা চালিয়ে যেতে হবে।

শেষ বিকেলের দিকে আমি একা একা হাঁটতে বেরোলাম, দেখি, যদি দক্ষিণ-পশ্চিম গিরিশিরার নীচে জাপানিদের বেসক্যাম্পের অবশিষ্টাংশও খুঁজে পাই। ওরা সব চিহ্ন খুব ভালোভাবে মুছে দিয়েছিল, এবং বেশ অনেকক্ষণ লাগল ওদের আবর্জনা পুড়িয়ে ফেলার পর যে কালো মণ্ডটা পড়ে ছিল সেটা আবিষ্কার করতে। একটা বোল্ডারের তলা থেকে এক বোতল ভর্তি প্যারাফিন পেলাম, আর কয়েকটা বাঁশের লাঠি কুড়িয়ে আনলাম, গিরিশিরার ওপরে তাঁবুটাকে অ্যাঙ্কর করতে কাজে লাগবে। ওখান থেকে ঘুরে আসার সময় নীচে আমাদের অ্যাডভান্স বেসক্যাম্পটা দেখতে পাচ্ছিলাম, তাঁবুর পাশে জো-র ছিপছিপে চেহারাটাও। ও রাতের খাবার বানাচ্ছিল। জনহীন প্রান্তরে চারপাশের পাহাড়চূড়ার মাঝে ওকে প্রকৃতপক্ষেই অকিঞ্চিৎকর লাগছিল।

রাত্রিটা অস্বস্তিতে কাটল, ভোর তিনটেয় ঘুমও ভেঙে গেল। দূরে পাথরপড়ার শব্দে অসুবিধে হচ্ছিল। পেটের মধ্যে গুড়গুড় করছিল আর ঘুমোতে পারছিলাম না। তাঁবুর ভেতরটা খুব চাপা আর আমি দুটো স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে গুটিশুটি মেরে ছিলাম। বাইরের তাপমাত্রা নেমে গিয়েছিল মাইনাস ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াসে। ঠিক এমন সময়ে একটা আওয়াজে গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল – বাইরে একটা চাপা গরগর আওয়াজ। তিরিশ সেকেন্ড মতো স্থায়ী ছিল শব্দটা। তারপর কিছু শোঁকার শব্দ, দ্রুত ছুটে যাবার আওয়াজ, আর শুনতে পেলাম আমাদের একটা প্যান ঠোক্কর খেয়ে উলটে গেল। নড়ার সাহস হল না আমার। পাঁচ মিনিট বাদে আর কোনো শব্দ না পেয়ে ভাবলাম এবারে নিরাপদে জো-কে ডাকা যাবে। আমি ওকে কনুই দিয়ে ঠেলা দিলাম।

“এই জো, তাঁবুর বাইরে কিছু একটা এসেছে।” আমি ফিসফিসে অথচ খসখসে গলায় বলি।

ও পাত্তা দিল না। “দরজাটা খুলো না, ঠান্ডা আসবে।” আমিও একমত হলাম। আমি দরজাটা খুললে ওটা যাইই থাক সম্ভবত সেটা এতটাই ভীরু যে জিপ খোলার আওয়াজেই ভেগে যাবে। আর যদি সেটা দৌড়ে না পালায়, আর অতটা ভীতু না হয়, তাহলে তো শুরুতেই আফশোষ করতে হবে দরজা খোলার জন্য! যাই হোক, দশ মিনিট বাদে কৌতূহল আর চাপতে না পেরে আমি বাইরে উঁকি দিলাম। অসাধারণ চাঁদের আলো – গোটা হিমবাহের গোল হয়ে ঘিরে থাকা অংশটা অবর্ণ আলোয় ধুয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু চারপাশে জীবিত কোনোকিছুর চিহ্নমাত্র নেই।

সকালে হিমবাহের ওপরে আগের বিকেলে পড়া টাটকা তুষারে পায়ের ছাপের কাটাকুটি। ওরা সম্ভবত হিমবাহের উত্তর কোণে, বাগিনি পাসের তলা থেকে এসেছিল আবার ওদিকেই ফিরে গেছে। একটা পায়ের ছাপ তাঁবু অবধি এসেছে আবার ফিরে গেছে। পায়ের ছাপগুলো চারপেয়ে কোনো জন্তুর – গুঁড়ো নরম তুষারের জন্য আন্দাজ করা শক্ত সেগুলো কতটা বড়ো ছিল, অথবা কতগুলো জন্তুর। ভালুক? লেপার্ড? ইয়েতি? মার্স-চকোলেট খানেওয়ালা? আমরা উত্তরটা জানতাম না।

সেদিন, ১৭ সেপ্টেম্বর, আমরা গিরিশিরার ওপরে গিয়ে কিছু যন্ত্রপাতি বয়ে নিয়ে রেখে এলাম আর অন্য একটা হালকা তাঁবু পেতে এলাম। এটার মতো ছ-পাউন্ডের হালকা তাঁবুর চেয়ে বেশি ভারী কোনোকিছু বইবার মতো শক্তি থাকবে না আমাদের। যাই হোক, আলটিমেট ইকুইপমেন্টের বিল উইলকিনস (মার্কিন লোক, যাকে আমরা ডাকি আলটিমেট বিল বলে।) আমাদের এই তাঁবু দেবার সময় বেশ দুশ্চিন্তায় ছিল। “খুব উঁচুতে বা খুব হাওয়ার মধ্যে এটা ব্যবহার কোরো না,” ও সাবধান করেছিল, “এগুলো কেবল ব্যাকপ্যাকারদের জন্য।” ও এর ওপর দিয়ে একটা কাপড় সেলাই করে দিয়েছিল বরফের জন্য আর সেটা সরু জায়গাটায় বসানোর জন্য খুব কাজের কাজ হয়েছিল। আমি একটু বেশি উৎসাহিত হয়ে পড়েছিলাম আগের দিনের সমান করা জায়গাটাকে আরেকটু চওড়া বানানোর জন্য।

“এর মধ্যে দিয়ে দেখো, জো,” আমি কর্নিশের ওপরে একটা ফুটো করেছিলাম, তাঁবু যেখানে পাতার প্রস্তাব, সেখান থেকে ১০০০ ফুট নীচে সোজা বাগিনি হিমবাহ অবধি দেখা যাচ্ছে।

“ভাল হয় তাঁবুটাকে একটু অন্যপাশে সরিয়ে নিই আমরা।” জো বলল।   

বাতাসে তাঁবুটা ফরফর করে উঠছিল কিন্তু ওটাকে টানটান করে আইসঅ্যাক্স, ডেডম্যান স্নো অ্যাংকর আর বাঁশের খুঁটিগুলোর সঙ্গে বেঁধে রেখে সাবধানে টিপ-টো পদ্ধতিতে অ্যাডভান্স বেস ক্যাম্পে নেমে এলাম। সেখানে ঝাড়া দেড়ঘণ্টা ধরে বরফ পড়ল আর আমাদের ভেবে রাখা সামান্য কিছু প্রস্তুতির কাজ আর হল না। বরফ পড়া থামলে চ্যাঙাব্যাঙকে মনে হচ্ছিল পুরো প্লাস্টার করা, যেন বিশাল কোনো এক নাপিত পুরোটায় শেভিং ক্রিম লাগিয়ে দিয়েছে।

“এখানে এই অসীম এবং উজ্জ্বল জনহীন প্রান্তরে আমি মানুষের পৃথিবী থেকে আরও আরও দূরে সরে যাই……” আমি হেস-এর কবিতার বইটা বন্ধ করি আর একটা ঘুমের বড়ি খাই, আশা করি আরেকটা অসুবিধেজনক রাত এড়াতে পারব। ফলে যা হল, বেশি ঘুমিয়ে ফেললাম। সকালে ওঠার ব্যাপারে জো চিরকালই এক্কেবারে যা তা, আর ওকে অ্যালার্ম হিসেবে নির্ভর তো কখনোই করা যাবে না। ফলে বেরোতে বেরোতে সকাল গড়িয়ে গেল। সূর্যের আলো পড়ছে আমাদের ওপর ফলে নিঙড়ে নিচ্ছে শরীর, দুজনেরই খুব আলস্য লাগছে, হিমবাহের ওপর এক এক বারে এক লপ্তে কোনোমতে কুড়ি পা যাচ্ছি। বরফের ঢালে পৌছোতে পৌঁছোতে দুজনেই ঠিক করে ফেলেছিলাম, কোনো আলোচনা ছাড়াই, যে স্যাকটা বরফের ওপরেই সকাল অবধি থাক, এখন ফিরে যাব, আজ বিশ্রামের দিন হোক। 

জো আর আমি চ্যাঙাব্যাঙ থেকে নামার প্রস্তাবিত রাস্তাটা নিয়ে আলোচনা করছিলাম (এটা ভেবে নিয়ে যে পাহাড়টার মাথায় চড়েই গিয়েছি।)। বাইনোকুলার দিয়ে দেখতে পাচ্ছিলাম বনিংটনের দলের ব্যবহার করা ফিক্স রোপগুলো শিপটন কল থেকে এখনও ঝুলছে। পশ্চিম দেয়াল দিয়ে আরোহণ শেষ করে ওদের মতো উত্তর-পূর্ব দিক দিয়ে নেমে শিপটন কলের ওপর চড়ার  ভাবনাটা বেশ চিত্তাকর্ষক ছিল। কপাল ভালো থাকলে আমরা হিমবাহের ওপরে সাউথ ফেস টিমের কোনো একটা ক্যাম্পের পাশ দিয়ে যাব, আর থেমে এক কাপ চা-ও খাওয়া যাবে। আমাদের এই পরিকল্পনাটা নিয়ে প্রথম চড়িয়েদের নানান মন্তব্য এসেছিল। মার্টিন বয়সেন ভেবেছিলেন, “একদমই ঠিকঠাক আছে।” ক্রিস বনিংটন ওঁর মতামত পরিবর্তন করে উৎসাহের বদলে নিরুৎসাহই করেছিলেন, “খুবই গোলমেলে গিরিশিরা,” শেষমেশ বলেছিলেন উনি, “আমি হলে যেপথে তোমরা এসেছ সেপথেই ফিরে যেতাম। অচেনা শয়তানের চেয়ে চেনা শয়তান ভালো।”

সেদিনটা ছিল কয়েকদিনের কষ্টের মধ্যে একটা শান্তির দিন, দারুণ একটা নিরুদ্বিগ্ন আরামের দিন। আমার স্মৃতিতে তার পরবর্তী দিনগুলোর মধ্যে ওটা একটা মণিকণার মতো দিন, ঝড়ের আগে যেমন শান্ত থাকে। খুব সামান্য বাতাস বইছে, আকাশে মাঝে মধ্যে হালকা মেঘ। চারপাশের শৃঙ্গ এবং হিমবাহের ওপরে পাথর আর বরফ সরে যাবার শব্দ শুধু, আর এই শব্দগুলো নৈঃশব্দকেই বাড়িয়ে তুলছিল। পাহাড়গুলো স্বেচ্ছা-শ্রমের মুখোশের নীচ থেকে উঁকি দিচ্ছিল, যা অনায়াসে ওদের আমার দৃষ্টিপথ থেকে মুছে দিতে পারত। মনে করতে পারি, এরকমই একটা দিন, চার বছর আগে দুই বন্ধুর সঙ্গে হিন্দুকুশে গিয়েছিলাম, হিমালয়ে সেই আমার প্রথম অভিযান। সেদিনটা ছিল কোহি খাইক-এর উত্তরদিকের খাড়া ঢাল চড়তে যাবার আগের দিন। তিন দিন বাদে খুব কঠিন এবং বিপজ্জনক রাস্তা পেরিয়ে শৃঙ্গের মাথায় আমরা, ডিহাইড্রেটেড এবং নিঃশেষিত, সামনে রয়েছে কোনও খাবারদাবার ছাড়া দীর্ঘ অবরোহণ এবং বেসক্যাম্প অবধি ষাট কিলোমিটার হাঁটা। মনে হয় আমাদের শক্তি আর ইচ্ছের পরীক্ষা নেবার আগে এটাও এমনই একটা শান্ত দিন।

জো খুব আরামে ছিল ওইদিনটা। “এখানে কিন্তু অত কিছু চাপের নেই, ডিক থাকলে যা হতে পারত,” ও ওর ডায়েরিতে লিখেছিল, “এটা বেশ হালকা চালের।” মাঝে মাঝে আমি ভাবি ডিক বুঝি আমাদের সঙ্গেই রয়েছে, জো এতটাই ওদের একসঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতাগুলো বলেছিল! ও সবসময় বেশ আহ্লাদ আর বিষ্ময় নিয়ে ডিক-এর নিজের নিয়মানুবর্তিতা, সংযম এবং নিষ্ঠার কথা বলত।

দিন গড়ালে জো আর আমি নিজের নিজের বইয়ে ডুবে গেলাম। জো পড়ছিল “নাইট রানার্স অব বেঙ্গল” আর আমি ডুবেছিলাম “দি ওডেসা ফাইল”-এ। বইগুলো হালকা ধাঁচের, সহজ, আর তাতে করে খানিকটা সময় ভুলে থাকা যায়।

পরের দিন, ১৯ সেপ্টেম্বর বেশ কিছু মালপত্র তুলে বয়ে গিরিশিরার ওপরের ক্যাম্পে নিয়ে আমরা এগোনোর জন্য প্রস্তুত হলাম। ২০ সেপ্টেম্বর বাকি আর যা যা খাবার আর যন্ত্রপাতি লাগবে সেসব স্যাকে ভরে নিয়ে গিরিশিরার ওপরে তাঁবুতে উঠে এলাম। খাবার যা আছে তাতে টেনেটুনে চোদ্দো দিন চলে যাবে এবং আশা রাখি এই সময়টুকু এই রুটটা চড়ার জন্য যথেষ্ট লম্বা সময়। বোঝাগুলো বেশ ভারী ছিল প্রায় পঞ্চাশ পাউন্ড করে, আর বরফের ঢালটা চড়তে বেশ কৌশলী কাজ করতে হচ্ছিল। ওটা ছিল আমাদের চতুর্থবারের মাল নিয়ে যাওয়া, আর আশা করছিলাম ঢালটায় এটাই শেষবার পা রাখছি।

আমাদের সঙ্গে হাজার ফুটের আট মিলিমিটার টেরিলিন ননস্ট্রেচ দড়ি রয়েছে এছাড়া কিছু নিজেদের পুরোনো চড়ার দড়ি। আমাদের পরিকল্পনার কৌশলটা ছিল ফিক্স রোপ পুরোটা শেষ করে ফেলা আর প্রতিদিন ক্যাম্পে ফিরে আসা। আমরা ভেবেছিলাম আমাদের কাছে আইসফিল্ড অবধি পৌঁছোনোর জন্য যথেষ্ট দড়ি আছে। তারপর সবটুকু দড়ি লাগানো হয়ে গেলে, কেবল খাবার দাবার আর হ্যামক নিয়ে বেরিয়ে পড়ব আর চড়তে চড়তে নীচের চড়ার দড়িগুলো টেনে তুলে নেব। আইসফিল্ডের ওপরে হ্যামক থেকে আবার সবটা দড়ি লাগিয়ে ফেলব ওপরের রক টাওয়ার অবধি, সেখান থেকে শৃঙ্গারোহণ সেরে উলটো দিক দিয়ে নেমে যাব। সবটাই শুনতে আপাত-সহজ একটা ব্যাপার।

সবে সকাল পেরিয়েছে বলে আমরা ঠিক করলাম সেদিন বিকেলের দিকে দেয়ালটা চড়া শুরু করব। ঠিক করলাম একএক বারে চারটে দড়ির দৈর্ঘ্য চড়ব আমরা। এইভাবে যে সামনে থাকবে সে নিজের ছন্দ নিয়ে গোড়ার চড়ার কাজটা করতে পারবে, আর যে পেছনে থাকবে সে তার অ্যাড্রিনালিন সুইচটা বন্ধ করে কিছুক্ষণ মনশূন্য করে থাকতে পারবে। প্রথমে আমার পালা। আমি স্যাক ছাড়া, এভারেস্টের নীল স্যুটটা পরে আমার বডি-হারনেসে যত রাজ্যের চড়ার যন্ত্রপাতি ঝুলিয়ে চড়ছিলাম। পেছনে জো, ওর স্যাকে ফিক্স করার জন্য সমস্ত দড়ি বয়ে নিয়ে উঠবে।

“আমি কোনোদিন এই জিনিসগুলো ব্যবহার করিনি,” জুমার ক্ল্যাম্পটা দেখিয়ে বলল ও, আমার পরে ওটা দড়িতে আটকেই উঠে আসবে ও।

“যেকোনো জিনিসই শেখার জন্য এজায়গাটা দারুণ, আর এটা শেখারও।”  আমি বললাম।

কর্নিশ থেকে যথেষ্ট ডানদিক চেপে, চড়াটা ছিল এক্কেবারে সোজাসুজি, আমাদের তাঁবু থেকে একশো ফুট ওপরের একটা জায়গা অবধি। গিরিশিরাটা মুছে যাচ্ছিল, বদলে একটা বরফে মোড়া ঢাল ফুটে উঠছিল। আমি একটা ফাটলে একটা পিটন গাঁথলাম আর টাল সামলাতে সামলাতে বরফে ক্র্যাম্পনের সামনে লাগানো কাঁটা গেঁথে ওপরে উঠলাম। আমার আইস অ্যাক্সটা দিয়ে বরফ চেঁচে হাত দিয়ে ধরার মতো অংশ কিছুটা পরিষ্কার করে, নিজেকে টেনে ওপরে তুলে পাঁচিলে ওঠার মতো করে ওই অংশটার ওপরে উঠে এলাম। ওর ওপরে ঢালটা আবার একরকম, রোদ্দুরে বরফে লাথি মেরে মেরে ওঠাটা অবশ্য বেশ শক্ত কাজ। বিকেল শেষ হতে হতে আমি চারটে দড়ির সমান দৈর্ঘ্য চড়ে ফেললাম, আর তারপর জো একটা দড়ির সমান দৈর্ঘ্য – সাতশ ফুট ক্লাইম্বিং। আমরা দেওয়ালের গোড়ায় পৌঁছেছিলাম যেটা সটান ওপরে ওভারহ্যাং-এর মতো পাথুরে বাধা অবধি উঠে গেছে যেটা আবার আইসফিল্ডের গোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে পাহারাদার হয়ে। আমরা খুবই উৎফুল্ল হয়েছিলাম।

“এই হারে, আমরা কালকেই আইসফিল্ডে পৌঁছে যাব।”

“যেকরেই হোক, একটা চিন্তা কেটে গিয়েছিল – আমরা শুরু করে দিয়েছি; পুরোনো সুপরিচিত বদ্ধমূল ধারণাটা আর তার হাতে গরম সমস্যা; সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ভয় আর দুশ্চিন্তা চলে গেছে, এখন শুধু যা করতে পারি আমরা, তা হল দেখা আর পাহাড়টা নিয়েই ভাবা, এতে কী থাকতে পারে সেকথা না জেনে, ও কী করতে পারে আমাদের তা না জেনেই… আমরা হিসেব করে দেখলাম আমরা এক সপ্তাহের মধ্যেই শৃঙ্গে পৌঁছোতে পারব।”

দ্রুত আমরা দড়ি ধরে অ্যাবসেইল করে নীচে নেমে এলাম, এক্কেবারে তাঁবুর দরজায়, ক্র্যাম্পনটা খুলে ভেতরে ঢুকেই ধপাস। হঠাৎই খুব ক্লান্ত লাগছিল। চড়ার কাজটা এত সুন্দর আর সদর্থকভাবে শুরু করা গেছে, কিন্তু উচ্চতার প্রভাব খুব নিঙড়ে নেয় শরীর। স্লিপিং ব্যাগে ঢুকে ঠান্ডা শুকনো মাংস রান্না করলাম খাবার জন্য, তাতে আলুর পাউডার মিশিয়ে নিলাম। ওর পরে একটু মধুর পুর দেওয়া পুডিং খেলাম আর একটা ফ্রুটকেক, মা বানিয়ে দিয়েছিল আমাদের জন্য, তারপর একটু চা খেলাম। এই প্রথমবার আমি একটা রনিকল টাইমস্প্যান খেলাম, আমাদের বলে দিয়েছিল এই ওষুধে কোনো ক্ষতি করবে না বরং আমাদের রক্তচলাচল সহজ করবে, আট ঘন্টার জন্য শিরা উপশিরাগুলো স্ফীত থাকবে। এর সঙ্গে আমরা একটা করে ভিটামিন বড়ি আর ভ্যালিয়াম বড়ি খেতাম যাতে ঘুমোতে পারি। “আমরা একজোড়া হাই-অলটিচুড নেশাড়ু,” আমি বলেছিলাম।  

আমাদের কেউই বিশ্বাস করতাম না যে এটা কোনো শারীরিক উপকার করে, কিন্তু এটা ছিল একটা ভরসার মতো ব্যাপার আর রাত্তিরের একটা অভ্যেস।

তাঁবুর ভেতরটা বেশ আরামের, শুধু মাথা থেকে দুপাশের খাড়া খাদটা ঝেড়ে ফেলতে হবে। আমরা সমস্ত দড়ি আর হ্যামকদুটো তাঁবুর মেঝেতে পেতে দিয়েছিলাম তাতে তাঁবুর মেঝের পাতলা কাপড়ের নীচে বরফ থেকে খানিকটা ঠান্ডা আটকাবে। তাঁবুর ওপর দিয়ে সর্বক্ষণ বাতাস বইছে, তাঁবুর কাপড়টা ফরফর করে উঠছে, ঝাপটা খাচ্ছে। শব্দটা বিরক্তিকর, তাঁবুটা এখানে পাতা নিয়ে আমার অস্বস্তি হতে থাকল। কিন্তু এখন আমার কিস্যু করার নেই এবং আমি ঘুমে তলিয়ে গেলাম।

ক্রমশ

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s