ধারাবাহিক অভিযান-দি শাইনিং মাউন্টেন-পিটার বোর্ডম্যান-অনুবাদ ইন্দ্রনাথ-শীত ২০২১

জয়ঢাকের অভিযান লাইব্রেরি- ভারেস্ট-এরিক শিপটন(অনু-বাসব চট্টোপাধ্যায়)  অন্নপূর্ণা-মরিস হারজগ(অনু তাপস মৌলিক) কন-টিকি অভিযান- থর হেয়ারডাল (অনু-শান্তনু বন্দ্যোপাধ্যায়)

(জো টাসকার-এর লেখা সহ)

obhijaanHead piece Shining mountain (1)

দুজন অভিযাত্রী। হিমালয়ের একটি শৃঙ্গের দুরূহতম ঢাল। সকলেই ভেবেছিল, এমনকি বিখ্যাত পর্বতারোহীরাও, এ অসম্ভব। এ তো আত্মহত্যার নামান্তর। মাত্র দুজন, তাও হিমালয়ের গহন প্রান্তরে, শৃঙ্গ অভিযান? সঙ্গে আর কেউ নেই? যাহ অবিশ্বাস্য! সেকারণেই ১৯৭৬ সালের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ এক যুগান্তকারী ঘটনা। দুই দক্ষ পর্বতারোহী পিটার বোর্ডম্যান এবং জো টাসকার চ্যাঙাব্যাঙ-এর পশ্চিম ঢাল বরাবর আরোহণের অতুলনীয় কীর্তি স্থাপন করলেন। ২২ আগস্ট ব্রিটেন থেকে রওনা হয়ে ১৫ অক্টোবর পশ্চিম গাড়োয়ালের চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ আরোহণ সেরে ১ নভেম্বর দুজন অভিযাত্রী দেশে ফিরে যান। পরবর্তীকালে, দুর্ভাগ্যজনকভাবে ১৯৮২ সালে এভারেস্টের উত্তর পূর্ব গিরিশিরা বরাবর আরোহণ অভিযানের শেষ পর্বে চূড়ায় ওঠার ঠিক আগে দুজনেই দুর্ঘটনার কবলে পড়ে চিরকালের মতো হারিয়ে যান। ব্রিটিশ তথা পৃথিবীর সর্বকালের সেরা পর্বতারোহীদের মধ্যে এই দুই পর্বতারোহীর নাম স্বর্ণাক্ষরে লেখা রয়েছে।   

স্যাংচুয়ারির ধার বরাবর

২২ আগস্ট – ৭ সেপ্টেম্বর

বর্ষার আগস্টে দিল্লির প্যাচপেচে গরম আর ভিড়ভারাক্কা তোমার চিন্তাভাবনা, নড়াচড়ার সমস্ত ইচ্ছেই নিংড়ে বার করে দেবে। অস্বস্তিকর গরমের মধ্যে জনপথ লেনের কাছে একটা সস্তার হোটেলে নোংরা বিছানায় জো আর আমি শুয়েছিলাম। মাথার ওপরে একটা বড়ো পাখা ফুটিফাটা সিলিং থেকে ঝুলছে, খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে ঘুরে চলেছে, যেন একটা আহত পাখি। এজায়গাটার ম্যানেজার লোকটা তোষামুদে আর সুবিধের নয় – ও আমাদের মোটেই বিশ্বাস করে বলে মনে হয় না, ফলে আমরাও ওর ওপর কোনরকম নির্ভর করা যায় বলে মনে করিনি। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব জায়গাটা থেকে বেরোতে চাইছিলাম।

আগের বছরে দুনাগিরি অভিযানে যাওয়া আর ফিরে আসার সময়ে এরকমই একটা জায়গায় জো থেকেছিল। আগের বার নেপাল থেকে ফেরার সময় আমি দিল্লিতে ছিলাম দুদিন, এভারেস্ট অভিযাত্রী দলের সঙ্গে। জো আর আমি চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণের চেষ্টা করছিলাম ১৪০০ পাউন্ড বাজেট নিয়ে, অন্যদিকে এভারেস্ট আরোহণের জন্য সহায়তা করেছিল বার্কলেস ব্যাঙ্ক ইন্টারন্যাশনাল, পরিমাণ ছিল ১১৩০০০ পাউন্ড। সেবারে আমরা পাঁচ-তারা হোটেলে উঠেছিলাম, প্রতিজন মানুষের প্রতিরাতের জন্য ভাড়া ছিল দেড়শো টাকা করে। এবারে আমাদের দুজনের প্রতিরাতের জন্য গুণতে হচ্ছে সাত টাকা।

একটা মেয়ে এল, ভারতীয় কায়দায় শাড়ি পরা, উচ্চারণ একেবারে লন্ডনের লোকেদের মতো, পিঠ চুলকাচ্ছিল মেয়েটা। মেয়েটা ওর ছেলেবন্ধুর সঙ্গে মালারির কাছে একটা কুঁড়েটুড়ে বানিয়ে গাঁজার পুরিয়া বানিয়ে পশ্চিমি লোকেদের কাছে বেঁচে দিন চালাচ্ছিল। দিল্লিতে এসেছিল হেপাটাইটিস থেকে বাঁচতে গামা গ্লবিউলিন ইঞ্জেকশন নিতে।

“আমি আমার সিরিঞ্জ নিয়ে এসেছি,” মেয়েটা বলল। রোগা পাতলা চেহারা, কাশছিল খুব। কথাবার্তার মাঝে মাঝে থেমে গিয়ে বাথরুমেও দৌড়োচ্ছিল। “ও ঠিক আছে, ” মেয়েটা বলছিল, “শরীরটা একটু খারাপ, আসলে কাল রাতে পুরোনো দিল্লিতে একটু বেশি আফিম নেওয়া হয়ে গেছে।” মেয়েটার বয়েস বড়ো জোর আঠারো।

রাস্তা দিয়ে হাঁটছিলাম আমরা। প্যাচপেচে গরমে দরদর করে ঘাম গড়াচ্ছিল। বুক ভরে শ্বাস নিয়েও সুবিধে হচ্ছিল না। চতুর্দিকে ফেস্টুন, শ্লোগানে ছয়লাপ, কারণ ভারতে তখন জরুরি অবস্থা তুঙ্গে।

ইংরিজি শ্লোগানগুলো থেকে আমরা আধাআধি ধারণা করতে পারছিলাম আর একইসঙ্গে বুঝতে পারছিলাম যে উপমহাদেশের আসল সমস্যাগুলো থেকে কয়েক যোজন দূরে বসে আছি আমরা, “প্ল্যান্ট এ ট্রি”, “অনলি টু চিলড্রেন”, রুট আউট করাপশন”, “দেয়ার ইজ নো সাবস্টিটিউট ফর হার্ড ওয়ার্ক”, “সেভিংস উইল হেল্প ইউ”। একটা ভিড় বাসের পেছনে লেখা “টক লেস, ওয়ার্ক মোর।” হ্যাঁ, কাজে নেমে পড়ার জন্য ছটফট করছিলাম। অভিযানের প্রস্তুতির সময়টাতে, সপ্তাহের পর সপ্তাহ লোকজনকে বলতে হয়েছে, আমাদের পরিকল্পনাটা কী, ব্যাখ্যা করতে হয়েছে ঠিক কীভাবে কাজটা করব আমরা। কিন্তু মনের গভীরে, সত্যি সত্যি, কথাগুলোর মধ্যে একটা শূন্যতা বোধ হত। আমি সত্যিই বিশ্বাস করিনি যে ওই রুটে আমরা চড়ে ফেলতে পারব। আমি কথাবার্তা থামিয়ে কাজে মন দিতে চাইছিলাম।

জো-র বন্ধু, টনি এবং রোসমেরি বিউমন্ট, লন্ডনের কাছাকাছি থাকত। টনি বিউমন্ট, আন্তর্জাতিক কম্পানি গেস্ট কিন এন্ড নেটলফিল্ডস-এর একজন অন্যতম অধিকর্তা ছিল, আর ওদের ভারতে একটা শাখা কম্পানি ছিল, নাম গেস্টকিন উইলিয়ামস, নয়াদিল্লিতে অফিস। আগের বছর এই কম্পানি জোকে সাহায্য করেছিল, আর ভারতে এই বিউমন্টদের বন্ধুরাই আমাদের চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণের আবেদনটা নিজেরা গিয়ে ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনে জমা করেছিল। বিউমন্টরা নিজেরা মন্টেকার্লো র‍্যালিতে যোগ দেয়, সামুদ্রিক দৌড়েও নামে, ফলে আমাদের অভিযানের দর্শনটায় ওরা বিশেষভাবে সহানুভূতিশীল ছিল, আর ওদের কাছে এজন্য আমরা ঋণী ছিলাম। তো পার্লামেন্ট স্ট্রিটে ওদের অফিসে যাওয়া হল, যোগাযোগটা আরেকবার ঝালিয়ে নিতে। ওখানে জে ডি কাপুর ছিলেন, উষ্ণ অভ্যর্থনা জানালেন। বৃষ্টিভেজা রাস্তা ছেড়ে শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত অফিসে ঢুকতেই মনে হল পশ্চিমি দুনিয়ায় চলে গেলাম, অজানা অচেনা পরিবেশ থেকে অভ্যস্ত এলাকায়। জে ডি তক্ষুনি আমাদের ডেকে নিল। ও বেল টিপতেই শরবৎ এসে গেল।

“বলো, কীভাবে সাহায্য করতে পারি?” ও জিজ্ঞাসা করল।

ওদের অফিসটা দারুণ, বেশ ঘরোয়া গোছের, আমাদের বিপুল সাহায্য করেছিল, কেননা ভারতীয় এক্সাইজ আর কাস্টমসের লালফিতের নিয়মের ভুলভুলাইয়ার মধ্যে কাজ হাসিল করার জন্য ওদের অফিসের যথেষ্ট দক্ষতা আর অভিজ্ঞতা ছিল। যাই হোক, তবু আমাদের দু’দুটো দিন লেগে গেল অফিসে চক্কর কেটে কেটে বিমানে আসা মালপত্রগুলো ছাড়ানোর অনুমতির কাগজপত্র পাবার জন্য, যেন কাফকার গল্পের সোঁদামারা অন্ধকার আমলাদের অফিস একেকটা। প্রত্যেকে আমাদের সঙ্গে অত্যন্ত নম্র ও ভদ্র ব্যবহার করছিল, চা-টাও খাওয়াচ্ছিল, কিন্তু সর্বত্রই ধৈর্য ধরে দেরির কারণ আমাদের ব্যাখ্যা করা হচ্ছিল, কেননা, নিয়মানুযায়ী কাজ করতে হচ্ছে। আমরা অভিযোগ করলে ওরা অসহায়ভাবে চোখ ওপরে তুলে বলছিল, “কিন্তু আপনারা, ব্রিটিশরাই তো এইসব নিয়মকানুন আমাদের শিখিয়েছেন।” আমার লম্বা লম্বা চুল, জো-র একমাথা ঠাসা কোঁকড়ানো চুল, গায়ে ডেনিমের জিন্স আর পায়ে রাবার সোলের জুতো, এই চেহারায় অফিসে হয়তো অত পাত্তাফাত্তা পাওয়া যায়নি! একদিন কাস্টমস অফিসে ঝাড়া দু’ঘণ্টা বসে রইলাম স্রেফ একটা কাউন্টার সিগনেচারের জন্য। ঠিক আমাদের মাথার ওপরেই জহরলাল নেহরুর লেখা একটা বাণী ফ্রেমে বাঁধিয়ে আটকানো রয়েছে: “আমি কাজে দেরির জন্য কৈফিয়ত শুনতে রাজি নই, আমি কেবল কাজ হওয়া নিয়ে আগ্রহী।”

আধুনিক ভারতের নানান মুখ। ধনীদের মহল্লা যেমন আছে, গরিবদেরও আছে। আমার কাছে এইধরনের অভিযানের অন্যতম আকর্ষণ হল এতে বেড়ানো আর পর্যটনের একটা মানে, একটা উদ্দেশ্য খুঁজে পাওয়া যায়। স্নো-লাইনের নীচে, এদেশের মানুষদের সঙ্গে থাকার অভিজ্ঞতা, পাহাড় চড়ার অভিজ্ঞতার মতই, বাড়ি ফিরে যাবার পরও মনে পড়ে। কোনো দেশে তুমি যদি কিছু করতে চাও বা সেখানে কোনো একটা কিছু জটীল ব্যাপার স্যাপার আয়োজন করতে চাও তাহলেই সে দেশের সমস্ত দিকগুলো তুমি দেখতে পাবে। যদি বিমা করাতে যাও বা বিপুল পরিমানে খাবার দাবার কেনো, স্থানীয় পরিবহনের সাহায্যে অনেক পরিমানে পাহাড়-চড়ার সাজসরঞ্জাম পাঠাতে যাও, বা মাল বইবার কুলি ঠিক করতে যাও, যারা স্থানীয় পাহাড়ি ভাষা ছাড়া কিচ্ছু জানে না, তবে দেখবে তুমি অনেক কিছু শিখে গেছ। এসবই তোমাকে দেশটার আরো কাছাকাছি নিয়ে আসবে –এমনকি যারা এই দেশে থাকে তাদের চেয়েও বেশি কাছাকাছি।

আমাদের এক বন্ধু কিছু পাহাড়-চড়ার সরঞ্জাম এক উচ্চবিত্ত ভারতীয় পরিবারের কাছে রেখে গিয়েছিল, আমরা সেগুলো নিয়ে এসেছিলাম। সেবাড়ির মহিলা এমন ভাবসাব নিয়ে কথা বলছিলেন যেন রাজবাড়ির কোনো কেউকেটা রানি, কথাবার্তায় একটা বড়োলোকি তাচ্ছিল্য আর উদাসীনতা। আমার ওঁর সঙ্গে কথা বলতে অস্বস্তি হচ্ছিল, কারণ জো সেদিন একেবারে তেরিয়া মেজাজে ছিল। ও একেবারে চুপ মেরে গেল, আর সেটা খারাপ দেখাচ্ছিল। আমি দু-একটা মামুলি কথা, এটাসেটা বললাম, তারপর চাকরবাকর আর পাহারাদার কুকুরগুলোকে পাশ কাটিয়ে, একরকম পালিয়েই এলাম, ট্যাক্সি চেপে ধনীমহল্লার বাইরে, ফের রাস্তায়।

আমরা কিছু জিনিসপত্র ধার নিয়েছিলাম এক ইংরেজ ভদ্রলোকের থেকেও, ওর ফ্ল্যাটের আলমারিতে পড়ে থেকে থেকে পচছিল জিনিসগুলো, ও এখানে একটা ব্যাঙ্কে কাজ করত। আমরা ওগুলো যখন আনতে গেলাম, নিঃসঙ্গ ইংরেজ লোকটার সঙ্গে কথা হল আমাদের – প্রায় আমাদেরই বয়েসি। গরমে আর ঘামে লোকটা ব্যতিব্যস্ত হয়ে ছিল, এ জীবন ওর আর ভালো লাগছিল না, ফ্ল্যাটটা নিয়েও গাদা অভিযোগ। আমাদের কাছে যদিও সেটা প্রাসাদের মতো ঠেকছিল। সস্তা চাকরবাকর আর অন্যান্য খরচের জন্য যথেষ্ট বেতন তার। ওর সামাজিক জীবন বলতে রাজধানীর গুটিকয় ইংরেজদের মধ্যেই ঘোরাফেরা। ও বলল, ভারতীয়রা মাঝে মধ্যে খেতেটেতে নেমন্তন্ন করে বটে, কিন্তু খুব শিগগিরই কথাবার্তা গড়ায় ব্যাঙ্কলোন পাওয়া যাবে কিনা সেই বিষয়ে। মনে হল লোকটা একটেরে বুদবুদের মধ্যে জীবন কাটাচ্ছে, ভারতের গ্রামজীবনের উষ্ণতা, গন্ধ আর আতিথেয়তা থেকে বহু দূরে।

রাস্তাঘাটে নেমে পড়লেই একটা সাংস্কৃতিক ধাক্কা এসে লাগে, ঠিক যেভাবে পশ্চিম থেকে হুট করে উড়োজাহাজ আমাদের এখানে এসে নামিয়ে দেবার পরে হয়, আচমকা, ঠিক তেমন। এই আসল ভারতবর্ষ, – প্যাচপেচে, কটুগন্ধ, বাচ্চারা আমার জামা টেনে ধরছে আর করুণভাবে আরো ছোটো ভাইবোনদের দিকে দেখাচ্ছে। আগেরবারের নেপাল এবং আফগানিস্থানে ঘোরার অনেক ছবি, অনেক স্মৃতি, গন্ধ, দৃশ্য আর অনুভূতি ফিরে এল; যেন তারা ছিলই, বুকের মধ্যেই ঘুমিয়ে ছিল, ইংল্যান্ডের ব্যস্ত জীবনে তাদের ভুলেই গিয়েছিলাম। এখন সব হুড়মুড় করে ভিড় করে এল আর মনে হচ্ছিল হ্যাঁ এটাই বাস্তব – যেন আমি কখনোই এখান থেকে ফিরে যাইনি অথবা দুটো আলাদা জীবন কাটাচ্ছিলাম।

একটা ছোটো দোকানে ঢুকে দুপুরের খাবার অর্ডার দিলাম। কনট সার্কাসে এটা সবচেয়ে সস্তার দোকান। পর্দা সরিয়ে একবার পেছনে রান্নাঘরে উঁকিও দেওয়া হল।

“এখানে মাংসটা বরং নাইবা খেলাম!” জো বলল। গ্লাসে করে জল এল। “কলেরা ককটেল” ও আবার বলল। এশিয়া মহাদেশে মুক্তকচ্ছ হয়ে ঘুরছে এমন ইউরোপীয়দের নিয়ে যত ঠাট্টা তামাশা চুটকুলা মনে আছে সব উপুড় করে দিলাম দুজনে।

মনে হচ্ছিল আমরা ভারতের এপ্রান্ত থেকে ওপ্রান্তে ঘুরে বেড়ানো হিপিদের যাত্রাপথের মাঝে কোনো একটা আস্তানায় আছি। অথবা কারো ক্ষেত্রে হয়তো যাত্রাপথের শেষপ্রান্তে। এখানে কয়েকজন অস্ট্রেলিয়া ও নিউজিল্যান্ডের লোকও দেখলাম – খুব ডলার দেখাচ্ছিল, তবে বেশিরভাগ টেবিলেই হয় ইউরোপীয় বা ভারতীয় লোক। মেঝেয় একটা এদেশি লোক, খাকি পোষাক পড়া, উবু হয়ে একটা বড়ো ভেজা ন্যাতা দিয়ে মেঝেটা মুছছে। টেবিলের তলায়, লোকজনের পায়ের ফাঁক দিয়ে দ্রুত কাজ করে চলছিল লোকটা। আমি মুগ্ধ হয়ে ওকে লক্ষ করছিলাম। মাথার ওপরে ঘটে চলা দোকানের যাবতীয় কাণ্ডকারখানা নিয়ে ও উদাসীন, কোনো হেলদোল নেই। সামনের ন্যাতাটা ছাড়া ওর নজর আর কোনোদিকে নেই। আমি বিস্মিত হয়ে ভাবছিলাম ওর মাথায় কী চিন্তা ঘুরছে? ঠিক তখুনি একজন ইউরোপীয়ান লোক আমাদের দিকে এগিয়ে এসে আলাপ করল। আমিই কথা বললাম । জো –র চোখেমুখে সন্দেহ। লোকটা অস্ট্রিয়ান আর চমৎকার ইংরিজি বলছিল। আস্তে আস্তে লোকটা তার গল্পের সুতো ছাড়তে শুরু করল, আর একটা লম্বা দুঃখের কাহিনি শোনাল যে কীভাবে সে এই নয়াদিল্লিতে এসে উপস্থিত হল। তার এমব্যাসি তাকে সাহায্য করবে না, সেখানে ইতিমধ্যে এমন ঘটনার পাহাড় জমে রয়েছে। আমাদের কাছে তার আর্জি হল, কেবল বেনারস পর্যন্ত ট্রেনভাড়াটুকু যদি দিই, ইউরোপীয়ান হিসেবে যদি সাহায্য করি। আমি বিশ্বাস করে নিয়েছিলাম, আর যদিও আমাদের অবস্থাটা অন্যকে সাহায্য করার মতো ছিল না, তবু কিছু টাকা ওকে অফার করতে যাচ্ছিলাম। লোকের সঙ্গে অযথা বাকবিতণ্ডাকে আমি ভয় পাই – হতে পারে, কাপুরুষতা। জো সটান অস্ট্রিয়ানটাকে বলে উঠল, “ না; তোমার ওপর আমার কোনোরকম, ছিটেফোঁটা সহানুভূতিও নেই। ভারতে লক্ষ লক্ষ লোক আছে যাদের তোমার চেয়ে বেশি সাহায্য আর টাকাপয়সার প্রয়োজন আর তুমি, এখানে এসে এই হাল করেছ নিজের – আমার তো মনে হয় একজন ইউরোপীয় হিসেবে ব্যাপারটা যথেষ্ট লজ্জা আর হতাশার। এইভাবে ভারতীয়দের কাছে আমরা হাত পেতে ভিক্ষা চাইলে, ওরা কী ভাববে আমাদের সম্পর্কে? আমার কাছে একটুও টাকাপয়সা থাকলে আমি বরং কোনো ভারতীয়কে দিতাম, যার সত্যি সত্যিই দরকার।”

এর পরের সমস্যাটা ছিল, কাস্টমস থেকে আমাদের মালপত্র ছাড়াবার পর আমাদের লিয়াজঁ অফিসারকে খুঁজে পাওয়া। গাড়োয়াল হিমালয়ের যে অঞ্চলে চ্যাঙাব্যাঙ শৃঙ্গ সে জায়গাটা বিদেশিদের জন্য গত পনেরো বছর ধরেই নিষিদ্ধ, ভারত-চীনের সীমান্ত সমস্যার জন্য। অনেক সমস্যার মধ্যে একটা হল গাড়োয়ালের উত্তরে নিতি পাসের কাছাকাছি চারণভূমি নিয়ে দু’দেশের গোলমালের সূত্রপাত আর তা থেকেই ১৯৫৪-এর ঠান্ডা যুদ্ধ শুরু। ১৯৭৪ সালের মার্চে জায়গাটা যখন আবার খুলে দেওয়া হল, অভারতীয় কোনো অভিযাত্রী দলকে ওই অঞ্চলে যেতে হলে বাধ্যতামূলকভাবে একজন লিয়াজঁ অফিসার নিয়ে যেতে হবে এমন নিয়ম বলবৎ হল – আর এই অফিসাররা সাধারণত পর্বতারোহণের কিছুটা অভিজ্ঞতাসম্পন্ন সেনাবাহিনীর লোকেরাই হন। এদের একটা কাজ থাকত, সম্ভবত, এটা দেখা যে অভিযাত্রী দল যেন ইনার লাইনের (চিনা/তিব্বতী সীমান্তের নিকটবর্তী এলাকা যেখানে সবরকম যাতায়াত সীমাবদ্ধ।) ওপাশে না চলেটলে যায় আর পাশাপাশি এটাও দেখা যে অভিযাত্রী দলের লোকেরা পর্বতাভিযানের আড়ালে গুপ্তচরবৃত্তি করছে কিনা, সামরিক এলাকার ছবি তুলছে কিনা, অথবা, এমনও হতে পারে, কয়েক বছর আগে যেমনটা রটেছিল (যদিও যন্ত্রটা তুষার ধ্বসে চাপা পড়ে গেছে), সীমান্তের ওপারে চীনাদের গতিবিধি জানার জন্য শ্রবণযন্ত্র বসানো হচ্ছেটচ্ছে কিনা।

আমাদের কাস্টমসের কাগজগুলো, শৃঙ্গ আরোহণের অনুমতিপত্র, আর লিয়াজঁ অফিসার এই তিনটেই ইন্ডিয়ান মাউন্টেনিয়ারিং ফাউন্ডেশনের মাধ্যমেই পেতে হয়েছিল। ভারতের পর্বতারোহণের বেশিরভাগটাই এখনও সামরিক বাহিনিই করে আর আইএমএফ-এর অফিসটাও সামরিক সুরক্ষা ব্লকের ভেতরেই। ওখানে পৌঁছোতে হলে তোমায় প্রবেশপত্র জোগাড় করতে হবে। একটা বড়ো ব্লকের এক কোনায় অফিসটা। এখানে যতবার একটা না একটা নয়া সমস্যা নিয়ে গেছি, আইএমএফ-এর সেক্রেটারি, ছোটোখাটো, টাকমাথা আর ব্যস্তবাগীশ মিস্টার মুনসিরাম সবসময় আমাদের তাঁর দরাজ গলায় হা হা করে হেসে আমাদের আপ্যায়ণ করেছেন। লোকটার কিছুতেই হজম হচ্ছিল না এই কথাটা, যে আমরা দুজনের মধ্যে কেউই নিজেকে এই দলের নেতা বলছি না। আমাদের কাছে এটার কোনো দরকারও ছিল না, কেননা দলে তো কেবল আমরা দুজন! ভদ্রলোক আমাদের পরামর্শ দিলেন, যাতে আমরা একটা ট্রেকিং আর ট্রাভেল এজেন্টকে ঠিক করে নিই, যারা কাস্টমসের কাজ, মালপত্র পরিবহনে নিয়ে যাওয়া আর শেষমেশ সেগুলোর জন্য কুলি জোগাড় করে দেওয়ার ব্যাপারগুলো দেখে নেবে। এই ট্রাভেল এজেন্টগুলো একেকটা পরজীবী, এরা ভারতের ঢিমেতালে চলা ব্যবস্থার সুযোগ নিয়ে সোজাসাপটা সাধারণ কাজের জন্যও প্রচুর টাকাপয়সা আদায় করে নেয়। এরা অসহায় শিকারকে লেজে খেলাতে থাকে ততক্ষণ, যতক্ষণ না লোকটা একের পর এক সমস্যা মেটাতে মেটাতে জেরবার হয়ে তাদের সাহায্য চাইছে – অবশ্যই কিছু অর্থের বিনিময়ে। কিন্তু জো এর আগেও এদের ছাড়াই কাজকর্ম সামলেছে আর এবারও ওদের ছাড়াই সামলে নেবে!

শেষমেষ, ছাব্বিশে আগস্ট বিকেল পাঁচটার সময় আমরা আমাদের লিয়াজঁ অফিসারের দেখা পেলাম, ফ্লাইট লেফটান্যান্ট ডি এন পলটা, ভারতীয় বায়ুসেনার একজন বৈমানিক। উনি ভেবেছিলেন স্ত্রী-পরিবারের কাছে, ১৫০ কিলোমিটার দূর চন্ডিগড়ে ফিরবেন, একেবারে শেষমুহূর্তে সেসব বাদ দিয়ে ওকে আমাদের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল। তিরিশের কোঠায় বয়স, সুন্দর করে ছাঁটা গোঁফ, লোকটা নম্র, ভদ্র এবং বেশ গম্ভীর, একেবারে আমার আর জো-র ঠিক উলটো। জীবনের প্রতি এবং ভারতের জনতার প্রতি প্রখর কর্তব্যজ্ঞান লোকটার, সেই তুলনায় নিজেকে অস্থিরচিত্ত, নৈরাজ্যবাদী আর স্বার্থপর মনে হচ্ছিল।

লিয়াজঁ অফিসার থাকার একটা বাধ্যবাধকতা হল যে তোমায় তার খাওয়া পরা দিতে হবে এবং যাতায়াতের পয়সা গুণতে হবে। সেদিন সন্ধ্যায় পলটা আমাদের ‘গেস্ট হাউসে’ এল। এমন একটা নোংরা হতচ্ছেদ্দা করা জায়গায় আছি দেখে বেচারা একটু ঘাবড়েই গেল, কিন্তু কিছু বলল না। আমরা যে জুতোজোড়া এনেছিলাম সেটা ওর পক্ষে বেশ বড়ো, আর যেসমস্ত পুরোনো জামাকাপড় ওকে দেওয়া হল, আমার বেশ বিব্রতই লাগছিল। জিনিসগুলো ভালো, কাজের জিনিস, কিন্তু খানিক পুরোনো, জো আর আমি আগে ওগুলো ব্যবহার করেছিলাম। আমার বেশ অস্বস্তি লাগছিল কেননা পলটার হিসেবে যাকে ‘অভিযান’ বলে আমি আর জো ঠিক তার কাছাকাছিও নেই। পলটা ওর জিনিসপত্র নিয়ে বেরিয়ে যাবার সময় আমাদের এখানকার ম্যানেজার ওকে আটকাতে চেষ্টা করে কেননা ওর ধারণা হয়েছিল, আমরা নিষিদ্ধ কিছু চালান-টালান করছি।

সে-রাত্তিরে একটা ইঁদুর আমার পেটের ওপর দিয়ে দৌড়ে গেল, ঠিক পরপরই ওটাকে তাড়া করে আরেকখানা। করিডোরের উল্টোদিকে দুটো সিড়িঙ্গে আমেরিকান কথা বলছিল। ওই দুই মূর্তিমানই আদর্শ হতচ্ছাড়া মানুষের উদাহরণ, ছিরকুটে এবং ছত্রাখান। আমার পাশের খাটে এক কানাডিয়ান, তুমুল জ্বরে শয্যাশায়ী।

পরেরদিন বড়োবাজারে গেলাম, অভিযানের অধিকাংশ খাবারদাবার কিনে নেবার জন্য। তিনজন মিলে ঘুরে ঘুরে চাল, চিনি ইত্যাদি আরও নানান প্রাথমিক জিনিসপত্র বাছাই করে কিনলাম। তিনজন থাকাতে মালপত্র টানার সুবিধে হল ঠিকই কিন্তু প্রতিটা কেনাকাটাতেই একগাদা মতামত, সহমত, সিদ্ধান্ত, পূনর্সিদ্ধান্ত, ফের হিসেবনিকেশ, ফের আলোচনা এসব হতেই থাকল। জো আর আমার মধ্যে সাধারণত কাজ ভাগাভাগি করে নিয়ে যে যার ভাগের কাজ নিজের মতো করে সেরে নেওয়া হত। পলটা এখানে থাকায়, আর ও সাহায্য করতে এত ব্যস্ত, যে আমরা ভাবলাম ওর মতামতটা নেওয়াও জরুরি, নইলে ও বেচারা অসন্তুষ্ট হতে পারে এবং নিজেকে ব্রাত্য ভাবতে পারে। ব্রিটেনে থাকতে থাকতেই ভাবা হয়েছিল অভিযানে বেরোনোর আগেই সমস্ত খাবারদাবার আর ইকুইপমেন্ট গুছিয়ে রাখা দরকার, কিন্তু সেসময়টা এখন পেরিয়ে এসেছি। দিল্লিতে বিরাট বিরাট দোকান কিন্তু কিছু খাবার এখানে পাওয়া অসম্ভব। যা হোক সন্ধের মধ্যে আমরা সমস্ত মালপত্র শক্ত কার্ডবোর্ডের বাক্সে, রুকস্যাকে আর কিটব্যাগে গুছিয়ে ফেললাম। তারপর সমস্ত কিছু দুখানা ট্যাক্সিতে বোঝাই করে পুরোনো দিল্লির রেলস্টেশনের দিকে রওনা দিলাম। চারপাশে ঠেলা, প্রাগৈতিহাসিক বাস, আর এতোলবেতোল ছুটতে থাকা স্কুটারের ভিড় ঠেলে। এর মধ্যে একটা ট্যাক্সি আবার এক সাইকেলে চড়া লোককে ধাক্কা মেরে ফেলেও দিল। বিরাট একটা হই হই রই রই উঠল বটে কিন্তু কেউই আঘাত পায়নি। আবার আমরা ভ্যাঁ ভোঁ, প্যাঁ পোঁ, চিৎকার চ্যাঁচামেচির মধ্যে দিয়ে চলা শুরু করলাম, এখানে নিয়মটাই হল কাউকে জায়গা ছেড়ো না।

আমরা যদি বড়োসড়ো কোনো অভিযানে আসতাম তাহলে স্রেফ একটা বিশাল ট্রাক ভাড়া করা হত, মালপত্র তাতে গাদিয়ে তিনশো কিলোমিটার দূরের পাহাড়ে পাঠিয়ে দেওয়া হত। তার বদলে আমাদের প্রভূত মজা আর উত্তেজক ব্যাপার স্যাপারের মুখোমুখি হবার ছিল, ষোলোখানা মাল, নানানরকম বাহনে চাপিয়ে এইবারে ওই একই পরিমাণ দূরত্ব নিয়ে যেতে হবে। টাকা-পয়সারও বিরাট সাশ্রয় এতে, কেননা আমরা এখন টাকা-পয়সার বিষয়ে বেশ সচেতন, টিপে টিপে হিসেব করে চালাতে হবে যাতে পাহাড়ে অভিযান শেষ করে ফিরেও আসতে পারি।

একটা ট্রেনে যত লোক গাদাগাদি করে আটতে পারে, ভারতবর্ষের সমস্ত রেলস্টেশনের বুকিং হল আর প্ল্যাটফর্ম মিলিয়ে তার তিনগুণ লোক সমসময় মজুত। ভিড়ের মধ্যে একএকটা গোটা পরিবার শুয়ে বসে আছে, যেন কোত্থাও যাবার নেই। মিটমিটে আলো, ধুলোময়লা, ট্রেনের ভেঁপু আর ভিড় সব মিলিয়ে একটা হুলুস্থুল পরিবেশ। লাল-জামা পড়া কুলিরা আমাদের মালপত্র একটা বড়ো ট্রলির ওপর চাপিয়ে দু-দুটো লিফটে চড়িয়ে, রেললাইনের নীচের একখানা সুড়ঙ্গ পেরিয়ে আমাদের নির্দিষ্ট প্ল্যাটফর্মে নিয়ে চলল। নীচের সুড়ঙ্গপথটা মাটির নীচের জলতল বরাবর, দেওয়াল থেকে ঝরঝর করে জল পড়ছে অনবরত, তার মধ্যে কুলিরা ঘেমে নেয়ে একশা।

“নরকটা এরকম হলে জায়গাটা নির্ঘাত খুবই উত্তেজক।” জো বলল।

পূর্ব গোলার্ধে এই এতএত মানুষ দেখে আমার বিস্ময় কিছুতেই শেষ হয় না। ইস্টিশনে, রাস্তায় হাজারে হাজারে লোক, ভিড়ে ভিড়ে ভিড়াক্কার রাস্তায়, অন্ধকারে; ফুটপাথে, দেয়ালের কিনার ঘেঁষে লোক ঘুমোচ্ছে।

বাষ্পচালিত বিরাট রেলগাড়িটা আমাদের সারারাত ধরে উত্তরের দিকে বয়ে নিয়ে চলল। ছেলেবেলা থেকেই আমার স্মৃতিতে রয়েছে এর উত্তেজনা, আওয়াজ আর অবিশ্বাস্য শক্তির কথা। ভোর হল, ততক্ষণে ভারতের সমতলভূমি প্রায় পেরিয়ে এসেছি আমরা। বাতাসে হালকা ঠান্ডার আমেজ, সকালের তেরছা রোদ্দুর ছোটো গাছপালায় ঢাকা পাহাড়ের আঁকাবাকা রেখা স্পষ্ট করে দিয়েছে। গোটা রাস্তায় ঝঞ্ঝাট আর দুর্দশা থাকা সত্ত্বেও আমার দিব্যি লাগছিল, নিজেকে ফুরফুরে আর ভারহীন বোধ হচ্ছিল। এইবারে সত্যি সত্যিই পাহাড়ে যাচ্ছি, আর এখন সত্যি বলতে গেলে যেমন যেমন সমস্যা আসবে তেমন তেমন সেটার মুখোমুখি হওয়া, এইই তো আর কি! গাড়োয়ালের এক বিখ্যাত অভিযাত্রী টম লঙস্টাফ যেমনটা বলেছেন, “একজন ভ্রমণকারীকে জীবনের প্রতিটা বর্তমান মুহূর্তে বেঁচে থাকা অবশ্যই শিখতে হবে।” বিশ শতকের গোড়ার দিকের এই লাল দাড়িওয়ালা আগুনখেকো অভিযাত্রীটি ছিলেন তিরিশের দশকের অভিযাত্রীদের গুরু, আমি আর জো প্রায়ই ওঁকে নিয়ে প্রচুর কথা বলতাম।

হরিদ্বার রেলস্টেশন থেকে উলটোদিকের বাস টার্মিনাসে গেলাম। চারদিকে লোকের যথেষ্ট ভিড়। বেশিরভাগ ভিড়ের মধ্যেই যা হয় আমাদের, মনে হল এখানেও নির্ঘাত এমন লোকজন আছে যাদের আমরা বিশ্বাস করতে পারব না। যখন তোমরা তিনজন আছ, তখন একই সঙ্গে মালপত্র বয়ে নিয়ে যাওয়া আর পাহারা দেওয়া বেশ কঠিন কাজ। ফলে প্রথমে সব মালপত্রই একজায়গায় জড়ো করে রাখো। তারপর মালপত্রগুলো যেখানে নিয়ে যেতে হবে, গেলে সুবিধে হবে, কেউ একজন সেখানে বয়ে নিয়ে দ্বিতীয় একটা মালের স্তূপ বানিয়ে পাহারা দিতে থাকো। সেদিন সকালটায় আমি বেশ চনমনে ছিলাম। ফলে জো আর পলটা নিজেদের পাহারায় বহাল করে নিল। আর আমি কেবল দুজনের মধ্যে ছোটাছুটি করে সমস্ত মালপত্র টানাটানির কাজটা করতে থাকলাম।

১৯০৫ এবং ১৯০৭ সালে টম লঙস্টাফ যখন নন্দাদেবী স্যাংচুয়ারি অভিযানে আসেন তখন উনি সমতল থেকেই হাঁটা শুরু করেছিলেন। ১৯৩০ সালে বিল টিলম্যান এবং এরিক শিপটন যখন এলেন, ওঁরা শুরু করেছিলেন রানিক্ষেত থেকে, কয়েক সপ্তাহের পথ। আর এখন আমি আর জো বাসে করে এমন জায়গায় পৌঁছোব যেখান থেকে আমাদের হাঁটাপথ হবে কয়েকদিনের মাত্র।

হরিদ্বার থেকে হৃষিকেশের বাস ধরলাম। ওখানে আবার খচ্চরে-টানা ঠেলায় চাপিয়ে আরেকটা বাস স্টপেজে গেলাম। ঠেলার ওপরে এত ভারী মাল চাপিয়ে ভয় হচ্ছিল, একদিকে ভারের চোটে খচ্চরটা না মাটি ছেড়ে শূন্যে উঠে যায়। এইবারে আমরা হিন্দু তীর্থযাত্রীদের পথ বরাবর উত্তরে চলেছি। এই বরাবরই তিনটি পবিত্র তীর্থস্থানে যাবার রাস্তা, গঙ্গোত্রী, কেদারনাথ এবং বদরিনাথ। হৃষিকেশ থেকে বাসে করে শ্রীনগর গেলাম। শ্রীনগরে পৌঁছোনোর আগেই জোশিমঠের শেষ বাস ছেড়ে চলে গিয়েছিল, ফলে ওখানে তীর্থযাত্রীদের থাকার একটা সরকারি চালাঘরে ঠাঁই হল আমাদের। চালাঘরের দায়িত্বে থাকা লোকটা চাইছিল আমরা যাতে নির্দিষ্ট ফর্ম পূরণ করি আর আমাদের সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দিই। হয়তো এটা একটা খুবই স্বাভাবিক ও বাস্তবোচিত নিয়ম, কিন্তু এই ফর্ম, কাগজপত্র, নিয়মকানুন এসব আমাকে যথেষ্ট অস্বস্তিতে ফেলে দেয়, বিশেষ করে যখন পাহাড়ে চড়তে আসি।এগুলোকে অযথা একটা বাধার মতো লাগে।

“যাতায়াতে একটা নিয়ন্ত্রণ থাকা জরুরি।” পলটা ব্যাখ্যা করে, ‘প্রতিটা শহরে সরকারি স্বাস্থ্যকেন্দ্র রয়েছে। এবং সাপ্লাই ইন্সপেক্টর।

চালাঘরে শোবার জন্য কেবল তক্তাপোশ রয়েছে তবে তা বেশ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন আর বাথরুমও রয়েছে। ভারতে পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতেই হয়, সেভাবেই আমি ক্রমশ চারপাশে সারাক্ষণ ঘিরে থাকা ভিড়ের লোকজন, তাদের হাঁ করে তাকিয়ে তাকিয়ে আমাদের প্রতিটা কাজকর্ম লক্ষ করা, সবকিছুর সঙ্গে ধীরে ধীরে অভ্যস্ত হয়ে উঠছিলাম। এক মহাদেশ থেকে আরেক মহাদেশে এসে মানিয়ে উঠতে আমার বেশ কয়েকটা দিন লেগে গেল, তারপরই স্বাভাবিক হওয়া গেল আর স্পষ্টভাবে ভাবনা-চিন্তাও করতে পারছিলাম।

বেলা বাড়তে রোদ্দুরের তেজ বেড়ে গেল আর তেমনি গরম। এই গরমে আলসে লাগছি; বিশ্রাম-টিশ্রাম নিয়ে, আমরা কেনাকাটায় বেরোলাম। অনেক সময় লেগে গেল। ব্রিটেনে, সম্ভব হলে, আমি সবসময় এসব কেনাকাটার ব্যাপার এড়িয়ে যাই। আমি কেবল হুড়মুড় করে কাছাকাছি কোনো দোকানে যাই, আর যা যা কিনতে চাই দোকানে তার কাছাকাছি যা পাওয়া যায় তা নিয়ে ফিরে আসি। পলটাসাহেব, এদিকে, তাড়াহুড়োর মধ্যে নেই, ও জোরাজুরি করতে লাগল যাতে বাজারে ঘুরে ঘুরে বিভিন্ন দোকানে জিনিসপত্র দেখেশুনে দরাদরি করে কেনাকাটা করা যায়। বাজার এলাকায় বিভিন্ন মালপত্র আর কাজকর্মের জন্য আলাদা আলাদা দোকান বা এলাকা নির্দিষ্ট করা। আমরা পরপর একটা নাপিতের দোকান, চাল-গমের দোকান, মুচি আর চায়ের দোকান পেরোলাম। আমরা যেন একটা টাইম-মেশিনে রয়েছি, পেছোতে পেছোতে ক্রমশ ডিকেন্সের সময়ে এসে পড়েছি, কিংবা তারও আগে, হগার্থে।

শ্রীনগরে জীবনযাত্রা খুবই ধীর লয়ে চলে। আমাদের পছন্দসই দানার চিনি খুঁজেপেতে কিনতেই অনেকটা সময় লেগে গেল – আমাদের কোনো র‍্যাশনকার্ড ছিল না।

“শোনো ভাইয়েরা!” পলটা বলল, “আমার মনে হয় সমস্ত খাবার দাবার একেকজন মানুষের হিসেবে ভাগাভাগি হিসেব করে নাও নইলে কতটা কী কিনতে হবে বুঝতে পারবে না।”

এই সহজতম হিসেবটাও আমার গুলিয়ে যায়, আর আমি আরো গুটিয়ে যাই।

“এক বস্তা কিনে নেব।” জো বলে।

একটা দোকানি তার পসরার পেছনে পা মুড়ে বসেছিল, সে আমাদের এক কৌটো প্যারাফিন বেচতে রাজি হল না। পলটা কারণটা আমাদের ব্যাখ্যা করে বলল। “লোকটা বলছে যে ওর ভগবানের ভয় আছে, একসঙ্গে অতটা মাল আমাদের বিক্রি করতে পারবে না। অনুমতি চাই। পলটা ওকে রাজি করানোর জন্য একটা অফিসিয়াল চিঠি লিখে দিল।

জো আর আমার মধ্যে একটা সোজাসাপটা সম্পর্ক ছিল। টেলিফোন নম্বর আর নাম মনে রাখার ব্যাপারে জো-র অসামান্য স্মৃতিশক্তির তুলনায় আমার তো একেবারেই ভাসাভাসা। আমরা সবসময় পরবর্তী সমস্যাটা নিয়ে কথা বলতাম। মানুষের মূল সমস্যাগুলো নিয়ে আমরা অত আলোচনা করতাম না। আমি ঠিক নিশ্চিত ছিলাম না যে ওইরকম গূঢ় আলোচনার ব্যাপারে জো কতটা এগিয়ে বা পিছিয়ে। ও তেরো বছর বয়স থেকে একুশ বছর বয়েস অবধি যাজক হবার জন্য পড়াশোনা করেছিল; মঠের সীমাবদ্ধ গণ্ডীর মধ্যে জীবনযাপন করে শেষমেশ ও বিদ্রোহ করে। কিন্তু কোনো না কোনো বিশ্বাস বা প্রেরণা একটা সময় ছিল তো। জো-র শান্ত মুখ, কোঁকড়ানো চুল, দাড়ি আর নীল চোখ দেখে, পলটার প্রথম প্রতিক্রিয়া ছিল যে, ওর ‘জেসাস ক্রাইস্ট সুপারস্টার’-এর জন্য অডিশনের আবেদন করা উচিত। পলটা যখন আমাদের দুজনের সঙ্গে যোগ দিত, আলোচনার বিষয়বস্তু বদলে যেত। সেই সন্ধ্যায় আমরা চা-পানের পর, বই, ছায়াছবি আর পর্বতারোহণের নীতিগত মূল্য নিয়ে আলাপ-আলোচনা করলাম। পলটা কিছুতেই বুঝে উঠতে পারছিল না কেন আমরা আমাদের শ্রম আর সময় স্রেফ হিমালয় পর্বতের মাঝখানে একটা আখাম্বা পাথর চড়ার কাজে ব্যয় করছি। ওর কাছে বুদ্ধিমান, উচ্চশিক্ষিত এবং ভারতে বসবাস করছে এমন লোকের কাছে এদেশের সমস্যাগুলোই যথেষ্ট পরিমানে চ্যালেঞ্জের, যা একজন শিক্ষিত লোক চাইতে পারে। যেমন ওর রয়েছে, দেশের প্রকৃত শত্রুর বিরুদ্ধে দেশকে বাঁচানো, স্ত্রী-পরিবারের প্রতিপালন করা। ওর কথা শুনতে শুনতে নিজেকে তরুণ লাগছিল। আমি ভাবছিলাম, আমার চেয়ে তিন বছরের বড়ো জো নিশ্চই জব্বর একটা উত্তরটুত্তর দেবে। ও কিছুই বলল না। ছটফটে, আত্মবিশ্বাসী ব্যাক্তিস্বাধীনতাপ্রিয় জো কোনো কৈফিয়তই দিল না। সম্ভবত এর আগে ও এমন প্রশ্নের জবাব দেয়নি অথবা দেবার প্রয়োজন বোধ করেনি। কিন্তু আমার অভ্যেস ছিল। মাউন্ট এভারেস্ট চড়ে ফেলার পর আর ব্রিটিশ মাউন্টেনিয়ারিং কাউন্সিলে কাজ করে, পর্বতারোহণ বিষয়টা লোকজনদের বোঝানোটা আমার অভ্যেসেই ছিল, বিশেষ করে যারা এসম্পর্কে সামান্যই জানেন, আর সেইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে যেগুলো পর্বতারোহীদের কাছে অত্যন্ত হাস্যকর বলে মনে হয়। এছাড়াও অসংখ্য কমিটির মিটিং-এ উপস্থিত থাকার অভিজ্ঞতাটা আমাকে শিখিয়েছে কেমন করে সামাজিক গিরগিটি হয়ে থাকতে হয় – মৃদু মৃদু হাসি আর মাথা নাড়ানো। আমাদের আলোচনার মাঝে আমার এইই মনে হল। আমি জানতাম খুব শিগগিরি আমরা একে অন্যের ওপর এতটাই নির্ভরশীল হয়ে পড়ব যে নিজেদের মধ্যে প্রবল মতভেদের আর তেমন সুযোগই থাকবে না। আমার আর জো-র আলোচনা থেকে বোধ করি পলটাও লক্ষ্যবস্তুর প্রতি আমাদের গুরুত্বটা টের পেতে শুরু করেছিল। আমি চমকে গেলাম যখন জো সোজা ওকে ব্যাখ্যা করে বলল, যে এই আরোহণটা আমাদের দুজনের জন্য, বহু বছরের অভিজ্ঞতা আর প্রায়োগিক কৌশলের একটা চূড়ান্ত রূপ এবং সেখানে, মূল আরোহণের সময় ওর অংশগ্রহনের সামান্যতম সুযোগও নেই। পলটা বুঝতে পেরে গিয়েছিল যে ও আমাদের সঙ্গে যোগ দিচ্ছে একেবারেই একক, বিচ্ছিন্ন একজন হিসেবে।  

“আক্ষেপের ব্যাপার, আমাদের সঙ্গে রেডিও-সেট নেই যাতে আমরা নিজেদের মধ্যে অথবা বাইরের কারো সঙ্গে যোগাযোগ করতে পারি।” সে বলল।

সেরাতে স্লিপিং ব্যাগের মধ্যে শুয়ে শুয়ে, আমিও একটু একটু করে অনুধাবন করছিলাম। পাহাড়ের জন্য আলাদা আলাদা র‍্যাঙ্ক দেবার কিছু আর থাকবে না। উইকেটে খালি টিকে থাকো, বাড়ি ছাড়ার আগে এক বন্ধু বলেছিল। পাশের ঘরে তীর্থযাত্রীরা নাক ডাকাচ্ছিল।

রাত্রে তেড়ে বৃষ্টি হল আর বেশ ঠান্ডাও পড়ে গেল। পরদিন যখন জোশিমঠের জন্য বাসের অপেক্ষায় আছি, হাজার হাজার মাছি ভনভন করে চারপাশে সর্বত্র উড়ে বেড়াচ্ছে, সেটা আমায় ওথেলোর অশ্লীল দৃশ্যের কথা মনে পড়িয়ে দিল। কুয়াশা আর মেঘে আমাদের চারপাশের জঙ্গল-পাহাড় ঢেকে ফেলছে। ফুল আর পাতাগুলো জলে ভিজে ভারী হয়ে আছে। আমি একটারও নাম জানি না। এতরকম গাছপালা পশুপাখি ভারতে, অগুনতি। মেঘের মধ্যে আলো-ছায়ার খেলায় নানারকম রঙ হয়েছে, ফাঁকফোকর দিয়ে সূর্যের নরম আলো এসে পড়েছে।

পলটা মালপত্র বয়ে নেবার বিষয়ে কথা বলতে চাইছিল। আমাদের চারপাশে কুকুর ঘুরঘুর করছিল। ক্রমশ এক এক করে লোক আর আগ্রহী কুলিরা জড়ো হচ্ছিল আমাদের ঘিরে। ওদের হামলে পড়ার ভাবটা বেশ ভীতিজনক, মনে হচ্ছিল যেন হিচককের দা বার্ড সিনেমার শেষ দৃশ্য দেখছি। “কোত্থেকে আসছেন আপনারা?” “যাচ্ছেন কোথায়?” “এই ব্যাগগুলোয় কী আছে?” একই প্রশ্ন ঘুরে ফিরে চলল, আর আমি তেতোখাবার মতো করে উত্তর দিয়ে চললাম। আমার বিল মুরের বলা গল্পটা মনে পড়ল, ও ছিল ১৯৫০ সালের স্কটিশ হিমালয়ান এক্সপিডিশনের নেতা, আর ওটাই ছিল শেষ বৃটিশ অভিযান যারা গাড়োয়ালের ইনার লাইন টপকে ছিল। বিল এইসব প্রশ্নের উত্তর দিতে দিতে ক্লান্ত হয়ে একদিন ঘুরে দাঁড়িয়ে পাল্টা বলেছিল, “কেন জানতে চাইছ এসব?” “যাতে আমি তোমায় সাহায্য করতে পারি।” শান্ত স্বরে জবাব এসেছিল।

এরই মধ্যে বাস ছেড়ে দিল, অলকানন্দার তীর বরাবর ১০০ মাইল উজানে ৬০০০ ফুট উচ্চতার জোশিমঠের দিকে, আট-ঘণ্টার যাত্রাপথ। লম্বা রাস্তা, পাকে পাকে উপরের দিকে, গঙ্গার এক উপনদীর অভিমুখে। হাল্কা পরিহাসের ব্যাপার হল, স্থানীয়রা রাস্তাটাকে বলে চীনদেশের উপহার। কেননা এটা বানানো হয়েছিল যাতে ভারতীয় সৈন্যবাহিনী সীমান্ত রক্ষার জন্য চটপট পৌঁছে যেতে পারে। শ্রীনগরে তিব্বতী চেহারার বহু মানুষ দেখে মালুম হয়েছিল আমরা হিমালয়ের মাঝ বরাবর চলে এসেছি। ভারতের সৈন্যদলের অর্ধেক এখন উত্তর সীমান্ত রক্ষায় মোতায়েন আর এই রাস্তায় পশ্চিমিদের আসা অনুমোদন পেয়েছে মাত্রই তিন বছর।

“অ্যাই জো,” আমি বললাম, “ওই ব্রিজটা দেখো, আমি ওটার একটা ছবি তুলে চীনা দূতাবাসে বেচে দিলে অভিযানের খরচ উঠে আসবে।” পলটা বুঝতে পারল না রসিকতাটা কীভাবে নেবে, খুব জোর দিয়ে কেবল বলল, খবরদার যেন ছবি না তুলি।

জো আর আমার পক্ষে এটা বোঝা সত্যিই কঠিন, বিশেষত আমরা যে দ্বীপ থেকে এসেছি গত হাজার বছরে সেটা কেউ দখল করেনি, যে হিমালয়ে রাজনৈতিক টানাপোড়েনটা ঠিক কী স্পর্শকাতর হয়ে রয়েছে। আমরা হাসলেই তার কারণ ব্যাখ্যা করে দিতে হচ্ছিল। পলটার ভযাবাচেকা বেকুব মুখ দেখে আমাদের মনে হচ্ছিল যে ও ভাবছে ওকে নিয়েই আমরা হাসাহাসি করছি।

আমরা প্রথম শ্রেনির আসনে বসেছিলাম, ঠিক ড্রাইভারের পেছনেই, যার মানে হল আমাদের হাঁটুদুটো নাকে ঘসার বদলে ঠিক থুতনির নীচেই ভাঁজ করা। রওনা হতেই, ছোট্টোখাট্ট বাস ড্রাইভারটি জানিয়ে দিল স্টিয়ারিংটা পাওয়ার স্টিয়ারিং নয়, বলেই একগাল হাসি, আর তারপর সামনের চড়াই রাস্তার একটা বাঁক দেখাল, নদী থেকে হাজার দুয়েক ফুট ওপরে। বলল, “প্রতি বছরই ওখানে আটটা নটা বাস খাদে পড়ে।” এত বলে ও কয়েকটা ধূপকাঠি জ্বালিয়ে বাসের সামনে গুঁজে রেখে হাতটাত নাড়ল। আর অমনি বাসসুদ্ধ লোক একসাথে জয়ধ্বনি করে উঠল। লোম-খাড়া-করে-দেওয়া বাঁকগুলোর মুখে পাথরের গায়ে নানারকম উৎসাহব্যঞ্জক লেখা লিখে মনে করিয়ে দেওয়া হয়েছে, যেমন “জীবন ক্ষণিকের। একে আরও ছোটো করে ফেলো না।” মাঝে মাঝে বর্ষার জলে পাহাড়ের গা থেকে ধস নেমে কাদা-মাটি পাথর এসে রাস্তা বন্ধ করে দিয়েছে, রাস্তা সারাইয়ের লোকেরা প্রাণপণ কাজ করছে সেগুলো সরিয়ে দেবার। বাস যাবার মতো খানিকটা পরিষ্কার হতেই বাস আবার চলতে শুরু করছে। সেসমস্ত জায়গায় বাসটা দুলতে দুলতে পার হবার সময় আমি আর জো ভয়ে ভয়ে দরজার দিকে দেখছি। দরজা আর আমাদের মধ্যে একজন পুরোহিত, একটা মুরগি আর একজন বৃদ্ধা মহিলা বসে ছিলেন। ড্রাইভার মুখ ফিরিয়ে বলল, আরে রোসো, বাস উলটে যাবার সময় আজ অবধি কেউ দরজা দিয়ে বার হয়ে যায়নি।

কিছু সময় পরপর বাসের যাত্রী বদলে বদলে যাচ্ছে, মাঝে মাঝে চা-পানের বিরতি নিতে বাসটা থামছে। পাহাড়ের গা বরাবর হৃষিকেশ থেকে আসা পুরোনো তীর্থপথটা ওপরের দিকে উঠে গেছে, বাসরাস্তা থেকেই কখনো কখনো আমরা দেখতে পাচ্ছি। এলাকায় বিভিন্ন ধরনের তীর্থযাত্রী মজুদ, নানানরকম মনোকামনা, নানারকম মানত তাদের। বাসের বেশিরভাগ লোকই, মনে হচ্ছে, ছুটির মধ্যে তাদের তীর্থ সম্পূর্ণ করার জন্য বাসটা ধরেছে। এমনকি কেমব্রিজ থেকে আসা এক শিখকেও দেখলাম। কিন্তু আরও বহু লোক, যারা হেঁটে চলেছে। তাদের মধ্যে অদ্ভুত উদাসী ভাব। কারও পরনে লাল রঙের কাপড়, কারও কেবল লেংটি, গায়ে সাদা ছাইমাখা। এই পদযাত্রীদের চোখ লাল, ঘোলাটে দৃষ্টি, মুখে হাসি আর কথা কম। আমি ভাবার চেষ্টা করছিলাম এই তীর্থযাত্রীরা কোত্থেকে এসেছেন, তাঁদের জীবনে এই তীর্থযাত্রার তাৎপর্যই বা কি? পরতে পরতে নাটকীয়ভাবে দৃশ্য বদল হয়, বহুদিন সমতলে থাকার পর পাহাড়ে বেড়াতে এলে, এটাই অবশ্য যথেষ্ট রোমাঞ্চের। তবে এঁদের তীর্থযাত্রার মূল গুরুত্বটা এই কষ্টকর শারীরিক পরিশ্রমে, এই প্রচেষ্টার ভেতর।

জোশিমঠে আবহাওয়া বেশ ঠান্ডা। সারা সপ্তাহে এই প্রথমবার আমার মনে হচ্ছিল যে পরিষ্কারভাবে চিন্তাভাবনা করতে পারছি। আমরা যাত্রীনিবাসের কাছে বাস থেকে নেমে সেইখানেই উঠলাম, তারপর মূল রাস্তার দিকে ঘুরতে গেলাম। জোশিমঠ একটা তীর্থ-শহর, অলকানন্দার পাড়ে পাহাড়ের বেশ উঁচুতে থাকা একটা জনপদ। একটাই মূল রাস্তা, দুপাশে টিনের ছাউনি দেওয়া দোকানপাট। এক দুটো দোকান পরপরই হয় একটা মিষ্টির দোকান কিংবা চা-দোকান। চারপাশের পাহাড় বাদল-মেঘে ঢাকা, তবু ওরই মাঝে তার ফাঁক দিয়ে সূর্যের তেরছা রশ্মি এসে পড়ছে। শহরের ওপরের দিকটায় বিরাট সেনা-ছাউনি, স্বয়ংসম্পূর্ণ, কিন্তু শহরের নীচের দিকে সেসব সুযোগ সুবিধে সামান্যই নজরে এল। জো-র কিছু বন্ধু আছেন এখানে, নীলকণ্ঠ হোটেলের মিস্টার ভূপাল সিং, আর স্থানীয় একটা যুবক, যাসু। আমরা ওদের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। ভূপাল সিং দেখামাত্র আমাদের একগাল হাসি দিয়ে অভ্যর্থনা করল, আর অমনি আমার মনে হল একে সম্পূর্ণ বিশ্বাস করা যায়। এইরকম দিলখোলা ব্যবহার সমতলে বিরল, যেখানে নম্রতা আর ভদ্রতা, বোঝা যায়, লোকজনের বহু মতলব আড়ালে রেখে দেয়। রাত্তিরে পলটার সঙ্গে বসলাম, অভিযানে ওর ভূমিকা নিয়ে আলোচনা করলাম আমরা। পলটা সঙ্গে করে অনেকগুলো ম্যাপ আর লিয়াজঁ অফিসার হিসেবে ওর ভূমিকা নিয়ে বিশদ লেখাজোখা এনেছিল। এগুলো ও সন্তর্পণে রক্ষা করত। আমি দেখছিলাম, জো ভয়ানক খেপচুরিয়াস এই লিয়াজঁ অফিসারের ব্যাপারটায়, বেশ অস্বস্তিকর জো-র আচরণ, ওর কোনোরকম শ্রদ্ধাই ছিল না এদের ওপর। আগেরবারের অভিযানে লিয়াজঁ অফিসার প্রথম দিনের হাঁটার পরেই আর টেকেনি। আমরা জানতাম পলটার কাছে যা নির্দেশ আছে, তার একটা হল এটা দেখা, আমাদের যে শৃঙ্গে চড়ার অনুমতি আছে সেটা ছাড়া অন্য কোনো শৃঙ্গে আমরা যেন না চড়ি। জো আর আমি পলটাকে বহুসময় ধরে বুঝিয়েছি, বিশ্বের পর্বতাভিযানের ধারা-বদল সম্পর্কে, এখনকার অভিযান যে আর আগের মতো নেই, এখন ছোটো ছোটো দল, প্রায় প্রথাগত নিয়ম ছাড়াই বড়ো বড়ো শৃঙ্গে ওঠার কাজটা করছে। “

পর্বতারোহণ বিষয়টা একেবারেই ব্যক্তিকেন্দ্রিক, আমরা বোঝাচ্ছিলাম, “এটা সেনাবাহিনীর কুচকাওয়াজের মতো ব্যাপারস্যাপার নয়, এটাতে একটা স্বেচ্ছা-অনুপ্রেরণা থাকা দরকার। কিন্তু পলটার কেবল পর্বতারোহণের এক মাসের একটা ট্রেনিং ছিল, তাও পাঁচ বছর আগে, ফলে ব্যাপারটা ওর পক্ষে বেশ চাপের। ঘুরেফিরে একই প্রশ্ন আবার উঠে এল, “আমি এখনও বুঝে উঠতে পারছি না, তোমরা দুই ছোকরা কীভাবে এই ক্লাইম্বিংটাকে যুক্তিসংগতভাবে সমর্থন করছ। তোমাদের পেশার ব্যাপারটা কী, মানবতার উন্নয়নের ব্যাপারে, সমাজের প্রতি তোমার ভূমিকা, দেশের প্রতি তোমার কর্তব্য এগুলোর কী হবে?” আমি বিড়বিড় করে একগাদা কারণ বললাম, সে কৈফিয়ৎগুলো অবশ্য বেশিরভাগই অন্য লোকের বলা কথা, আমি শুনেছিলাম।

“এটা তোমার চরিত্রের উন্নতি করতে পারে,” আমি বলি, “আর তোমাকে আরো স্বাবলম্বী এবং বাস্তবতার নিরিখে সমস্ত কিছু দেখতে শেখায়। পাহাড়ে ঘুরে বেড়ানো, এবং পর্বতারোহণের নানান কলাকৌশলে পারদর্শী হওয়া তোমার অভিজ্ঞতাকে আরো বিস্তৃত করে যাতে তুমি আরো বেশি কার্যকরী হয়ে ওঠো, আরো আকর্ষক,  বিশেষত যখন তুমি অন্যেকে কিছু শেখাতে যাবে, কিংবা নিদেন যখন কোনো নতুন মানুষের সঙ্গে আলাপ হবে। এছাড়া, পর্বতারোহণের মধ্যেই একটা নিখাদ অনুসন্ধানের ধকল আছে – মানুষের সম্ভাব্য ক্ষমতার অনুসন্ধান, এমন কাজ করে ফেলা যা তার আগে কেউ কখনও করবার কথা ভাবেনি, অজানা জায়গায় কোনো কিছু খুঁজে বার করা। আমাদের মতো মানুষদের জন্য, যারা মূলত শহুরে, তাদের এটা জীবনের ভারসাম্য রাখতে সাহায্য করে। যাহোক, আমি মনে করি যেকোনোরকম উৎসাহ বা কৌতূহলই থাকাটা কিছুই না থাকার চেয়ে ঢের ভালো। আমার কাছে উৎসাহহীন, জীবনে স্রেফ ভেসে চলা মানুষের চেয়ে এমন কোনো মানুষের প্রতি সহানুভূতিশীল হওয়াটা বেশি সুবিধেজনক, যার কোনো না কোনো বিষয়ে উৎসাহ এবং কৌতূহল আছে, – সে যে বিষয়েই থাক না কেন। এরিক শিপটন বিশ্বাস করতেন, যে, সেই মানুষটাই ভাগ্যবান এবং বিরল, যিনি বলতে পারেন যে তিনি জীবনে এমন কিছু খুঁজে পেয়েছেন যা তাঁকে তৃপ্তি দিয়েছে, যা তিনি প্রভূত উপভোগ করতে পেরেছেন। আর,” একটু রক্ষণাত্মকভাবে যোগ করি, “আমি পাহাড়েই আনন্দ পাই।”

জো কমই কথা বলেছিল, কিন্তু আমি নিশ্চিত জানি ও ভাবছিল, “কীসব ভুলভাল বকছে!” আমি সম্ভবত এসবকিছু বলে নিজের স্বপক্ষে যুক্তি সাজাচ্ছিলাম। “এই ধরনের কথাবার্তা একটা ক্লাইম্বিং-এর পরই বেশি মান্যতা পায়, তার আগে ততটা নয়।” ভাবলাম, “আমরা তো তেমন কিছু করিইনি এখনও।”

ঠিক করেছিলাম দুটো গোটা দিন জোশিমঠে কাটাব, কিন্তু শেষ অবধি কার্যত তিন দিন হয়ে গিয়েছিল।

পরদিন সকালে ঘুম ভাঙল আমার স্বপ্নরাজ্য, নরম সবুজে ঢাকা ডার্বিশায়ারের পাহাড়ের স্বপ্ন চোখে নিয়ে। তীর্থযাত্রীদের বাসের আওয়াজ একঝটকায় আমাকে ভারতে এনে ফেলল। সারা রাত ধরে প্রচুর হই চই, তীর্থযাত্রীরা আসছে যাচ্ছে, কাকভোরে রেডিও খুলে শুনছে। জো বলল, “সবসময় কী এত ছাতার মাথা বকবক করার আছে?”  

দুদিন ধরে মালপত্র ভাগ করে করে এক একটা পঞ্চাশ পাউন্ডের লোড বানানো হল পোর্টারদের জন্য আর বাজার থেকে কেনা হল চাল, ডাল, মটরদানা, আচার, মশলা, পেঁয়াজ এইসব। মাল ভাগাভাগির কাজটা জো-ই করল, আর ও একবার কোনো কাজের মধ্যে ঢুকে গেলে, সেটার পুরো দায়িত্ব নিজেই নিয়ে নেয়। আমি আর পলটা ঘরের এককোণে দাঁড়িয়েই রইলাম। 

“তুমি খুব কাজের লোক, জো,” পলটা বলল।

এর মধ্যে ঘরের ছাত থেকে একটা মাকড়সা ইকুইপমেন্টের ভেতর কোথাও একটা খসে পড়ল আর আমাদের ভেতর কেউই ওটাকে ঘাঁটাতে চাইলাম না।

জো, পলটাকে নিয়ে তিতিবিরক্ত হয়ে ছিল, যদিও প্রকাশ্যে নয়। ও বুঝেছিল, পলটা সবসময় চাইত আমরা সবাই একসঙ্গে সব কাজ করি, প্রতিটা খুঁটিনাটি কাজ, যেমন বাজারে চা খেতে যাওয়া, সেটাও আলোচনা করে আগে সিদ্ধান্ত নিয়ে যাওয়া হোক। ও কখনোই এমন ভান করতে পারছিল না যে লিয়াজঁ অফিসারটা আমাদের ওপর চাপিয়ে দেওয়া নয় এবং প্রকৃতপক্ষে পলটা কী ভাবছে না ভাবছে তার চেয়ে চ্যাঙাব্যাঙ আরোহণ অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জো-র এই স্পষ্টবাদিতার জন্যই পলটা ওকে দলনেতা বলে মেনে নিয়েছিল।

জো আর আমি টাকাপয়সার ব্যাপারে একটু চিন্তায় ছিলাম, কেননা পলটা চাইছিল, যদিও অমূলক নয়, ওর সঙ্গে বেসক্যাম্পে থাকার জন্য একজন পোর্টার নেওয়া হোক। তার মানে আরও একটা লোকের জামাকাপড়ের, খাওয়ানোর ব্যবস্থা করা।

এরই মধ্যে সাউথ ফেস-এর দলের তিনজন এসে হাজির, আর আমরা ওদের সঙ্গে আমাদের পছন্দের কাফে, দি ডিলাইট-এ খেতে গেলাম। ওটা ঠিক ফাইভ-স্টার ছিল না, আমরা নিজেদের মধ্যে পেটখারাপের নানান কাহিনি নিয়ে হাসিঠাট্টা করছিলাম, ভয়ে ভয়ে জল আর গ্লাসভর্তি বীজানুর দিকে তাকিয়ে নিঃশব্দে প্রার্থনাও করছিলাম। পেটখারাপ মানে ক্লাইম্ব বন্ধ। জো আর আমি ওদের নিয়ে অপেক্ষায় ছিলাম সাউথ ফেস-এর ট্রাক আসবে বলে, ওতে আমাদের জন্য দু’বাক্স খাবার আর গ্যাসের ক্যানিস্টারগুলো ছিল। ট্রাকটা, ওদের বাকি দলের লোকদের সঙ্গে নিয়ে নীচের রাস্তায় ধসে কোথাও আটকে গিয়েছিল।

অগ্রবর্তী দলের এই তিনজন সেজন্য একটু  মনমরা হয়ে ছিল, জো আবার সেটা দূর করতে চাইছিল। বড়ো দলের সদস্য হবার কারণে ওদের অভিযানটা অনেকটাই প্রথাগত আর ভারতে এসে ওরা খানিক ভেবলেও ছিল। আমার চেয়ে জো ওদের বেশি চিনত, আমি তাই মাঝে মাঝে সরে গিয়ে ওদের একটু সহজ হবার সুযোগ করে দিচ্ছিলাম।

২ সেপ্টেম্বর আমরা সবাই মিলে জোশিমঠ থেকে বিকেল তিনটের লতাগ্রামের বাস ধরব, সেখান থেকে চ্যাঙাব্যাঙের দিকে হাঁটা শুরু হবে। সাউথ ফেস-এর দলটা এসে পড়েছিল, আর পলটা একটা কুলি যোগাড় করে নিয়ে এল আমাদের মালপত্র বাসস্ট্যান্ডে বয়ে নিয়ে যাবার জন্য। তখুনি আবিষ্কার করলাম এইমাত্র আমরা একটা মহড়া দিয়ে ফেললাম। প্রকৃত তিনটের বাসটা দুপুর দুটোতেই ছেড়ে চলে গেছে, কিন্তু সেটা গেছে পাঁচ কিলোমিটার আগে একটা ব্যাক্তিগত কাজে। এখন পরদিন বেলাবেলির আগে ওটা আর লতায় যাচ্ছে না। “ভেবো না,” কিপলিং-এর একটা কথা ভুল উদ্ধৃতি দিয়ে জো বলল, “এখানে একজন মানুষ শায়িত আছেন, যিনি প্রাচ্যে যেতে হুড়োহুড়ি করেছিলেন।” এই বলে ব্যাটা টুক করে নিজের দুঃখ ভুলে এককাপ গরম দুধ চা নিয়ে চা-দোকানের পেছনে একটা চেয়ারে গিয়ে ধপাস করে বসল। কিছু করার না থাকলে জো আয়েস করার জন্য এক পায়ে খাড়া।

বিকেলের দিকে আমরা হেঁটে হেঁটে সেনাছাউনিরও একটু ওপরের দিকে গেলাম। ওখানে আমাদের পায়ে ডাবল বুট নিয়ে কয়েকটা বড়ো বোল্ডারে চড়া হল, স্থানীয় বাচ্চাদের বেশ খোরাক হল তা দেখে, যতক্ষণ না বিছুটির জঙ্গলে এসে ছিটকে পড়লাম। নন্দাদেবীকে দেখতে পাব ভেবেছিলাম কিন্তু আকাশ মেঘে ঢেকে ছিল, আর গুঁড়ি গুঁড়ি বৃষ্টিও শুরু হল।

অবশেষে অনেক উঁচুতে আমরা পাহাড়ের ঢালে এক আপেল বাগানে এসে পড়লাম আর সেখানে এক ফোকলা দাঁতের বুড়ি, কানে একগাদা মাকড়ি ঝোলানো, আমাদের দেখে এগিয়ে এলেন। উনি আমাদের বেশ বড়ো বড়ো কয়েকটা আপেল দিলেন। দারুণ খেতে ছিল। পয়সা নিতে চাইলেন না, হেসে সরে গেলেন, আমরাও এগোলাম, উনি তাকিয়ে রইলেন। এই আপেল-উপহারটা খুব সহজ সোজাসাপটা এবং স্বাভাবিক ব্যবহার, এই পাহাড়েই কেবল মিলবে এরকম, নীচের ছেড়ে আসা শহর বা রাস্তাঘাটে দেখা যাবে না।

সন্ধেবেলা পলটা আমাদের জোশিমঠের সিনেমায় নিয়ে গেল। আগেরবার একটা হিন্দি ছবি দেখতে গিয়ে বৈদ্যুতিক গোলযোগে দেখা হয়নি। তিন ঘণ্টার ছবি, ‘জমির’, মানে বিবেক। এক ধনকুবের তার হারানো ছেলেকে আবার ফিরে পাবেন, এইই গল্প। ছবিটাতে গান, নাচ, ঘোড়া, তাড়া করার দৃশ্য, খানিক গুলিগোলা আর রোমান্টিক প্রেমের দৃশ্য ছিল, সবটাই যেন বাস্তব থেকে দূরের এক কল্পনার জগৎ। এটা যেন গত সপ্তাহের দেখা ভারত নয়, কোনো ভিখারি নেই আর কেউ ঘামে ভিজছে না। আমাদের পশ্চিমি চোখে নায়ক নায়িকাদের একটু ভারী শরীর লাগছিল বটে, কিন্তু ভারতীয় ধারণায় সৌন্দর্য মানেই ছিপছিপে নয়। “আশ্চর্যের কিছু নেই যে আমাদের ছোট্ট অভিযানটাকে, ছোটো বলেই তুচ্ছ আর মূল্যহীন মনে করা হচ্ছে।” জো বলেছিল।

আমার পাশে বসা বাচ্চা ছেলেটা একেবারে বুঁদ হয়ে প্রাণ ঢেলে থিম-টিউনটা গাইছিল। চ্যাঙাব্যাঙের নীচের হিমবাহ অবধি ওটা আমার মনের মধ্যে সারাক্ষণ বেজে চলেছিল। বিরতির সময় বাইরের ছোটো একটা দোকান থেকে বাদাম কিনে নিয়ে দ্বিতীয় অর্ধ জুড়ে হলের অন্ধকারে বসে বসে খেয়েছিলাম। আলো জ্বলার পর খোলার মধ্যে বাস করা পোকাগুলোও দেখেছিলাম। ওইই ছিল বাইরের সভ্যজগতের সঙ্গে শেষ গা ঘসাঘসি। এবার আমরা অন্তরমহলে চললাম, স্যাংচুয়ারির ভেতর।

খেলার পাতায় সমস্ত ধারাবাহিক অভিযান একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s