আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি, বাঁশপাতি, মোহনচূড়া , হাট্টিমাটিমটিম থেকে হটিটি, রামগাংড়া, ডাহুক কেন ডাকে
কোকিল, তাও আবার নাকি বাদামি(Sirkeer Malkoha), এ কীরকম! যখন একে প্রথম দেখি আমার ছাতারে মনে হয়েছিল। তখন তো আমি এই পাখি আগে কখনোই দেখিনি তাই নামও জানি না। পাখিদের কোন পরিবারের অন্তর্ভুক্ত তাও জানি না। পাখির দর্শন হয়েছিল হিমালয়ের পাদদেশে, শিবালিক পর্বতমালা অঞ্চলে জিম করবেট টাইগার রিজার্ভে। গভীর অরণ্যে বাঘ দর্শনের পর মন ভীষণ আনন্দিত। মানুষে জিম করবেট যায় ব্যাঘ্র দর্শনের জন্য আর আমার মতো পর্যটক যায় বাঘ আর পাখি, দুইয়ের জন্যেই। ইনি ছিলেন জঙ্গলের মহারানি, হেলতে-দুলতে এসে আমাদের জিপ গাড়ির সামনেই বসে পড়লেন। অনেকক্ষণ ওই অবস্থায় ছিলেন আর ওদিকে আমরা ভয়ে জুজু হয়ে রয়েছি, যদি ঝাঁপিয়ে পড়ে। যাই হোক, স্বস্তি পেলাম জেনে যে ইনি মানুষখেকো নন। আমাদের পাশেই আরেক জিপ গাড়িতে ছিলেন এক বন্যপ্রাণী চিত্রগ্রাহক, তাঁর হাতে বেশ বড়ো দামি ক্যামেরা। তাই দিয়ে অবিরাম ছবি তুলে চলেছেন। একবার আমাদের দিকে তাকিয়ে বললেন, “ভয় পাবেন না, ও মানুষখেকো নয়, ওকে বিরক্ত না করলে আক্রমণ করবে না। এই সু্যোগ সবাই পায় না মশাই, মন ভরে জঙ্গলের পথে বাঘ দেখে নিন আর প্রাণভরে ওর ছবি তুলুন। আপনি হয়তো কয়েক হাজার টাকা খরচ করে জঙ্গল দেখতে এসেছেন, কিন্তু এর দর্শনে আপনি কয়েক লক্ষ পেয়ে গেলেন জীবনে।”
আমি উপলব্ধি করলাম যে উনি ঠিকই বলেছেন। কেবল বাঘ দর্শন নয়, এই পরিবেশ, অন্যান্য জীবজন্তু ও পাখি দেখে আমি সত্যিই পরিপুর্ণ হয়ে গেছি যা অর্থ দিয়ে মাপা সম্ভব নয়। বেশ কিছুক্ষণ বসে থেকে বাঘ মামি চললেন বনের ঝোপের ভীতর। আমাদের গাইড রশিদ, ওর কথা আগেও অনেক লেখায় উঠে এসেছে, এখানকার ‘জাঙ্গল বয়’, সব চেনে আর সব জানে। ও বলল যে এই বাঘিনী এখন ওই ঝোপের মধ্যেই থাকবে, তার চেয়ে বরং আমরা ততক্ষণে অন্য কিছু দেখে আসি। এই বলে রশিদ জিপ ঘুরিয়ে কিছুটা এসে এক খোলা ঘাসজমির কাছে এসে দাঁড়িয়ে পড়ল। বড়ো বড়ো সোনালি রঙের ঘাস, একটা বড়ো আকারের বাঘ অনায়াসে এই ঘাসের ভিতর ঘাপটি মেরে পড়ে থাকতে পারে শিকার ধরার জন্য, ঘুণাক্ষরে কোনও প্রাণী বুঝতে পারবে না। মনে সেই ভয়ে ছিল না বলা যাবে না। রশিদকে সেই কথা বলামাত্র ও তো হেসেই কাহিল। আমাদের নিশ্চিন্ত থাকতে বলল; বাঘ আসবে না বলে আশ্বস্ত করল। ও জানাল যে আবার আমরা ওই বাঘিনী দেখব একটু পরে, কারণ ওর ওই ঝোপ থেকে বেরোবার সময় হয়নি। আমি ভাবি রশিদ ওই বাঘিনীর মনের কথা কী করে জানল! না বলে পারলাম না, রশিদ বলে ওরা এরকমই করে। যখন বুঝতে পারবে যে আর মানুষ আসা-যাওয়া করছে না, তখনই ও বেরোবে ঝোপের ভিতর থেকে। ততক্ষণ আমরা এখানকার এই ঘাসজমির মধ্যে ঘোরাফেরা করে দেখি আর কী দেখা যায়।
দুপুর গড়িয়ে এখন সায়াহ্নের দিকে। রশিদ গাড়ি চালিয়ে এক মুক্ত ঘাস অঞ্চলে নিয়ে এসে দাঁড় করাল। চমৎকার ঘাসজমি, তার মধ্যে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে অনেক গাছপালা। দু-দিকেই প্রায় মানুষ সমান উঁচু সোনালি রঙের ঘাস আর চারপাশের জঙ্গল ছাড়িয়ে দেখা যায় শিবালিক পর্বতমালা শ্রেণি। এক পাহাড়ের কিছুটা ওপরে রয়েছে সূর্য, ঢলে পড়ার অপেক্ষায়। আমাদের গাড়িতে সকলেই হয় চোখে দূরবীন দিয়ে, নয়তো ক্যামেরার লেন্সে চোখ লাগিয়ে, আবার কেউ খালি চোখে কিছু খুঁজে বেড়াচ্ছে—বন্য আকর্ষণ একই বলে। অথবা ভয়, যদি ঘাসের ভিতর থেকে অন্য কোনও বাঘ এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে! রশিদ আর কতটা জানবে কখন কোন বাঘ কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে—হালুম, মানুষের গন্ধ পেলুম বলে এক লাফ দিয়ে আমাদের একটাকে তুলে নিয়ে চলে গেলে কী হবে। ঈশ্বরের কৃপায় সেরকম কিছু ঘটেনি, না হলে বসে আর এই লেখার উপায় থাকত না। রশিদের ওপর আমার কিন্তু পুরো ভরসা ছিল। ও এখানেই বড়ো হয়েছে—এই জঙ্গলে, এই গাছপালা, ঘাসজমি ও এখানকার জীবজন্তুদের ও খুব ভালো করে চেনে। আমরা তো দু-দিনের যোগী মাত্র।
কিছুটা দূরে এক গাছের ডালে একটা পাখি দেখতে পেয়ে প্রথমে আমার স্ত্রী তার দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করল। আমি ক্যামেরার জুম লেন্সে চোখ দিয়ে বললাম, এটা তো ছাতার পাখি। আমার স্ত্রী, সেও এখন পাখি দেখতে ও চিনতে বেশ আগ্রহী, আবার ভালো করে দেখতে বলল। দেখলাম যে পার্থক্য রয়েছে একাধিক। প্রথমেই চোখে পড়ে ওর লম্বা লেজ, ছাতারের থেকেও। মিল কেবল গায়ের রঙে।
আরও একটা মিল রয়েছে, সেটা পরে জেনেছি। সেদিন ভেবেছিলাম নিশ্চয়ই হিমালয়ের কোনও পাখি হবে। পাখিটির নাম জানার জন্য অনেকদিন অপেক্ষা করতে হয়েছিল। কারণ, জিম করবেট অভয়ারণ্যে কোনও বিদ্যুৎ সংযোগ নেই, যা আছে সৌর আলো, নেই কোনও মোবাইল ফোনের টাওয়ার। বাইরের জগৎ থেকে পুরোপুরি বিচ্ছিন্ন। তাই গুগল ঘেঁটেও জানা যাবে না এই পাখির নাম। একদিক থেকে ভালোই, বিদ্যুৎস্পৃষ্ট হয়ে অনেক জায়গাই বহু বন্য পশুদের মৃত্যু ঘটে, অন্তত তার থেকে রক্ষা পায় এরা এখানে। কাশ্মীরের পহলগাঁও গিয়ে এক পাখি দেখেছিলাম, ছোট পেঙ্গা (Streaked Laughinthrush)। সেই পাখিও অনেকটা আমাদের ছাতারের মতো দেখতে আর মাটিতে লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করে। গায়ের রঙেও মিল রয়েছে। কেবল পার্থক্য বোঝা গেছে এই পাখির বুকের সামনে ছোটো ছোটো ছিট দাগ, সম্পূর্ণ পাহাড়ি, হিমালয়ের পাখি।
ভ্রমণ শেষে ফিরে এসে প্রায় চারদিন লেগেছিল করবেটের পাখির নাম জানতে ও বিশেষজ্ঞদের মতামত পেতে। জানতে পারি, এই পাখি কোকিল পরিবারের একটি পাখি, আলাদা প্রজাতির। তবে কোকিল হলে কী হবে, গলায় মোটেও কোনও সুর নেই, সুরেলা ও মিষ্টি কণ্ঠস্বর নয়। ওপরে যা লিখেছি, ছাতারের সঙ্গে মিল দুটো ব্যাপারে—গায়ের রঙ ও ডাক, প্রায় একইরকম। কোনও কোণ থেকেই কোকিল মনে হয় না—না চেহারায়, না কণ্ঠে। তবে আমার মনে হয় ওকে যদি সেইভাবে দেখা যায়, এও কোনও অংশে কম সুন্দর নয়, বরং আমাদের দেখা কোকিল থেকেও সুন্দর দেখতে। [২-ছবি] আমরা তো আমাদের বাড়ির কাছে কোকিল বলতে বুঝি কালো রঙের সুরেলা কণ্ঠের অধিকারী, পাখিদের গানের পাঠশালার গুরু।
আমাদের দেখা গায়ক সুকণ্ঠী কোকিলের সঙ্গে এই বাদামি কোকিলের আরও একটা পার্থক্য রয়েছে এদের আচরণে। বাদামি কোকিল পরনির্ভরশীল নয়, অর্থাৎ এই কোকিল কিন্তু আত্মনির্ভর। আত্ননির্ভর মানে আমি বোঝাতে চাইছি যে এই প্রজাতির কোকিল নিজেরা বাসা তৈরি করে এবং তাতে ডিম পাড়ে আর নিজেদের বাচ্চাদের নিজেরাই বড়ো করে তোলে। অন্যের বাসায় ডিম পেড়ে গান গেয়ে উড়ে বেড়ায় না। তাহলে চেহারায় ও আচরণে কোনও মিল নেই, সাদৃশ্য রয়েছে কেবল নামে।
একটা ব্যাপারে আমার কিন্তু খটকা রয়েই গেছে। ওর ইংরেজি নামটা নিয়ে। সিরকিয়ার মালকোহা (Sirkeer Malkoha), মালকোহা নিয়ে কোনও দ্বন্দ্ব নেই, কিন্তু সিরকিয়ার নামটা আমি কোনও অভিধানে খুঁজে পেলাম না। এমনকি বিশেষজ্ঞরাও কোনও আলোকপাত করতে পারল না। তারপর গুগল ছাড়া আর কোনও উপায় থাকল না। গুগলে উইকিপিডিয়া ঘেঁটে যা পেলাম তা এইরকম :
এই প্রজাতির পাখির শ্রেয় যায় ফরাসি উদ্ভিদবিজ্ঞানী জিন ব্যাপটিস্ট লেশেণঁ ডে লা টুরকে স্মরণ করে এবং জেমস জোবলিং নামে আরও এক উদ্ভিদবিজ্ঞানী গুজরাটের একটি পাখির জন্য ব্যবহৃত স্থানীয় নাম ‘সিরকি’ বলে দাবি করেছেন যদিও ব্ল্যানফোর্ড উল্লেখ করেছেন যে ‘ভারতীয় নামগুলি’ সুকুল ‘বা ল্যাথামের সিরসিয়া’ অবিরত ছিল। একটি তত্ত্ব হল এগুলি প্রায়শই উত্তর ভারতে সিরকান্দা নামে পরিচিত নদনদীর সাথে পাওয়া যায়, যেখান থেকে সর্কি (বহুবচনে সিরকিয়ান) নামে পরিচিত পর্দা হিসাবে ব্যবহৃত মাদুর তৈরি করা হত। উত্তর ভারতের বেশিরভাগ অঞ্চল জুড়ে, এটি স্থানীয়ভাবে পরিচিত জংলি তোতা বা টিয়া নামে পরিচিত।
এই নামের উৎপত্তির ব্যাপারে আমার একটা কৌতূহল কিন্তু থেকেই গেল। যেমন ছাতারের ইংরেজি নাম ব্যাবলার (Babler), অর্থাৎ আড্ডাবাজ। এদের একসঙ্গে আড্ডায় দেখা যায়। ব্যাবলার শব্দের অর্থ অভিধানে পাওয়া যায়, কিন্তু সিরকিয়ার শব্দ পাওয়া গেল না। আমার এই ব্যাপারে আরও জানার আগ্রহ থাকল এখনও। মালকোহা প্রজাতির পাখিদের নাম তাদের চেহারার সঙ্গে মিলিয়ে রাখা হয়েছে, যেমন ব্লু ফেসড মালকোহা, গ্রিন বিল্ড মালকোহা, রেড ফেসড মালকোহা ইত্যাদি। কিন্তু বাদামি কোকিলের বেলায় ইংরেজি নামকরণ কোনও স্থান বা জায়গার নামে রাখা হয়েছে।
ছবি- লেখক
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে