বনের ডায়েরি-পাখি দেখা -হাট্টিমাটিম টিম থেকে হাটিটি-অলোক গাঙ্গুলী-শীত-২০২১

আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি, বাঁশপাতি, মোহনচূড়া 

bonerdiarypakhidekha

হাট্টিমাটিম টিম
তারা মাঠে পাড়ে ডিম
তাদের খাড়া দুটো শিং
তারা হাট্টিমাটিম টিম

উপরোক্ত ছড়ার শেষ চারটি পঙক্তি আমরা সবাই জানি, শৈশবেও পড়েছি এবং এখনও ভালো লাগে। একটা অদ্ভুত ধরনের জীবের ছবি চোখের সামনে ভেসে ওঠে। দুটো বড়ো বড়ো শিংওয়ালা কোনও জন্তু মাঠের ওপর দিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছে। এটা আসলে রোকনুজ্জামান খানের ৫২ লাইনের সুন্দর ছড়া। যিনি রচয়িতা, তিনি লেখার সময় কোন জন্তু অথবা পাখিকে কল্পনা করেছিলেন সেটা জানা নেই। কিন্তু এই ছড়াটি আমাদের শৈশব ও পূর্ণ বয়সেও একইরকম অনুভূতি জাগিয়ে তোলে। তাহলে তো এমন কোনও জীবজন্তু, পাখি নিশ্চয়ই আছে যারা মাঠে ডিম পাড়ে! পরবর্তীকালে সেই হাট্টিমাটিম টিম অন্য কোনও জীব বা পাখিতে রূপান্তরিত হয়ে থাকতে পারে। হ্যাঁ, অবশ্যই হয়েছে, আর সেই পরিবর্তিত রূপ এখনকার এক পক্ষী হাটিটি, ইংরেজি নাম ল্যাপউইং (Lapwing)।

আমি নিজে চার প্রজাতির হাটিটি দেখেছি, যার মধ্যে সবথেকে বেশি যেটা আমাদের গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে দেখা যায় তা হল রেড ওয়াটল্ড ল্যাপউইং (Red Wattled Lapwing)। এই পাখিকে বাংলায় লাল লতিকাও বলা হয়। ১৭৮১ সালে এক ফরাসি সাহেব জর্জেস লুই লেকলর্ক, কমতে দা বুঁফো তাঁর বই ‘হিসত্যের ন্যাচারেল দা ওয়েসু’-তে [Georges-Louis Leclerc, Comte de Buffon in his Histoire Naturelle des Oiseaux ] প্রথম বর্ণনা করেছিলেন। এদের চোখের পাশ দিয়ে ঠোঁটের উপরিভাগ পর্যন্ত একটা টানা লাল দাগ রয়েছে, তার থেকেই এই নাম। এই পাখি না দেখেই চেনা যায় ওদের ডাক শুনে কেবল। উড়তে উড়তে ডাকে আর ভারি অদ্ভুতরকমের ডাক – ইংরেজিতে ডাকে – ডিড ইউ ডু ইট – (Did you do it)।

একবার শীতের দিনে হল কী, পরপর চারদিনের একটা ছুটি পেয়ে গেলাম। কোথাও যাওয়ার ছিল না, কী করি ভেবে পাচ্ছিলাম না। তাই ঠিক করলাম ছবি তুলতে যাই পাখিদের। আমাদের বাড়ির খুব কাছেই দুটো বড়ো দিঘি আছে মৎস্য দফতরের। একটা সরু রাস্তা মাঝবরাবর চলে গিয়েছে আর দু-দিকে বড়ো দুটো দিঘি। এত কাছে এক অপূর্ব দৃশ্য, আর যখন এই ঝিলেই পরিযায়ী পাখিদের কিচিরমিচির আওয়াজ পাওয়া যায় সেটা হয় আরও সুন্দর। একদিকের ঝিলটা খোলা রাখা হয়েছে মানুষের জন্য আর অন্য দিকটা তারের জাল দিয়ে ঘেরা। পরিযায়ী পাখিরা বেশ বুদ্ধিমান, ওরা এই জাল দিয়ে ঘেরা জলা জায়গা বেছে নিয়েছে। মৎস্য দফতর এখানে কাউকে প্রবেশ করতে দেয় না, কিন্তু ক্যামেরা হাতে নিয়ে গেলে ওরা খুব একটা বাধাও দেয় না। তাই সেই ছুটির মধ্যেই আমি গেলাম সেখানে সঙ্গে আমার এক সাথীকে নিয়ে। যদিও শীতের দিন, তবুও আমার সরীসৃপে খুব ভয়। তাই সাবধানতা অবলম্বনের জন্যেই এই সঙ্গীকে কাছে রাখা।

শীতের নরম রোদে এখানে পাখির অভাব নেই, বিভিন্ন প্রজাতির পাখি এই সময় দেখতে পাওয়া যায় যেটা অনেকে সাঁতরাগাছি ঝিলে, চুপির চরে দেখতে যায়। বর্ধমানের চুপির চর অবশ্য অনেক বড়ো এলাকা জুড়ে এবং ওখানে আরও অনেকরকমের বেশি পাখি দেখা যায়। আর আমাদের এই জায়গা হল ঘোলে দুধের স্বাদ মেটানো। একটা ফাঁকা জায়গা দেখে আমি আর আমি সঙ্গী, দুজনে ক্যামেরার সরঞ্জাম নিয়ে বসলাম। সঙ্গী আমাকে দাদা বলেই ডাকে। ছেলেটি আমাদের বাড়ির অনেক কাজ করে দেয়, মাঝে মাঝে গাড়িও চালায়। আর এরকম প্রয়োজনে ওকেই আমি আমার সঙ্গে নিয়ে থাকি, অনেক কাজেই এসে যায়। শুধু কথা বলতে বারণ করে রাখি, চোখের ইশারা ও হাতের ইঙ্গিতে বোঝাতে বলে দিয়েছি। তাতে সুবিধাই হয়, আমার পেছনে কী হচ্ছে সেটা ও খেয়াল রাখে আর আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করে।

ভীষণ মনোরম এই পরিবেশের আনন্দ নিয়ে পাখিদের ছবি তুলে যাচ্ছি, এমন সময় সেই ডাক – ডিড ইউ ডু ইট, ডিড ইউ ডু ইট – বেশ কয়েকবার ধরে হল।

bonerdiary (1)

আকাশে দেখলাম, মাটিতে দেখলাম, গাছের ওপরেও তাকালাম, কোথাও কিছু দেখতে পেলাম না। কিছুক্ষণ পরে আবার। আমার বলতে ইচ্ছে করছে, আমি তো কিছু করিনি রে বাবা, তুই তো জিজ্ঞেস করে চলেছিস। কী পাখি রে বাবা, ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না, বিলেত থেকে এসেছে নাকি? ফরাসি সাহেবের আবিষ্কার, হয়তো বিলেতেই কোথাও, তাই পক্ষীটি ইংরেজি ছাড়া কথা বলে না। আমি আর আমার সাথী, ওর নাম রাজু, ঝিলের ধারে খোলা জায়গায় বসে শীতের রোদ আর প্রকৃতিকে উপভোগ করছি। আমি ক্যামেরায় চোখ লাগিয়ে এদিক ওদিক কিছু বেলে হাঁস, জলপিপির ছবি তুলে যাচ্ছি। এমন সময় রাজু আমাকে ইঙ্গিত করল আমার পেছনে কিছু আছে। আমি আস্তে করে ঘুরে বসলাম। দেখলাম, আমার থেকে ২৫ মিটার মতো দূরে সুন্দর একটা পাখি। যা বর্ণনা দিয়েছি ঠিক সেইরকম। হ্যাঁ, এটা লাল লতিকা, হাটিটি। চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে। এই মাঠই ওদের স্থান, এখানেই এরা ডিম পাড়ে যার জন্য হাট্টিমাটিম টিম এদের জন্যই প্রযোজ্য। কিন্তু খাড়া দুটো শিং! কই, নেই তো! কবি কল্পনায় কত কিছু ভেবে নেন। যখন তিনি রচনা করেছিলেন, তখন হয়তো এই হাটিটি পাখির কথা চিন্তায়ও আসেনি। রাজুকে জিজ্ঞাসা করলাম ও ছোটবেলায় কখনও হাট্টিমাটিম টিম ছড়াটি পড়েছে কি না। ও কিছু ভেবে পেল না আমি হঠাৎ ওকে এই প্রশ্ন করছি কেন। তবে ও পড়েছে এবং দেখলাম ওর এখনও মনে আছে সেই ছড়া, ও মুখস্থ চার পঙক্তি বলে গেল। আমার শুনে খুব আনন্দ হল যে ওর লেখাপড়া বেশি দূর গড়ায়নি, কিন্তু এই ছড়াটা ও মুখস্থ বলতে পারল। আমি ওকে আরও জিজ্ঞাসা করলাম এই ছড়াতে হাট্টিমাটিম টিম কী জিনিস সেটা ও জানে কি না। ও মাথা নেড়ে বুঝিয়ে দিল যে এই নামের কোনও প্রাণীর সঙ্গে ও পরিচিত নয়। আমি বললাম, ও যদি দেখতে পায় তাহলে কেমন লাগবে। ও বলল, “আমি গিয়ে আমার মাকে, দিদিকে গিয়ে বলব যে আমি আজ হাট্টিমাটিম টিম দেখে এসেছি।”

আমি তখন ওকে হাটিটিকে দেখালাম। ও ভ্রূ কুঁচকে তাকিয়ে থাকল কিছুক্ষণ, তারপর আমাকে খুব স্বাভাবিক একটা প্রশ্ন করে বসল, “দাদা, ওর তো কোনও শিং নেই। সেটা কি পরে উঠবে? ও কি এখনও বাচ্চা?”

আমি ওকে আর কী বলি। “না রে, ওর রূপের পরিবর্তন হয়েছে। এখন আর শিং গজায় না। যেমন আমরা মানুষেরা আগে বনমানুষ ছিলাম, বানর থেকে রূপান্তরিত হয়ে এখন মানুষ হয়েছি, তেমন এরাও হয়তো হাট্টিমাটিম টিম থেকে হাটিটি হয়েছে।”

ও এমন করে মাথা নাড়াল যেন সব বুঝে গিয়েছে। ও বলল, “দাদা, আমাকে পাখিটার ছবি একটু আমার মোবাইলে হোয়াটস অ্যাপ করে দেবেন? বাড়িতে, বন্ধুদের সবাইকে দেখাব, হাট্টিমাটিম টিম থেকে হাটিটি।”

আমার মনে মনে খুব হাসিও পেল আবার আনন্দও হল।

এবারে আসি পরের হাট্টিমাটিম টিমে, থুড়ি হাটিটি, (Yellow Wattled Lapwing)। অন্য কোনও নাম যেহেতু আমি কোথাও খুঁজে পাইনি, তাই লাল লতিকার মতো আমি একে হলুদ লতিকা নাম দিতেই পারি। এর পিঠ থেকে বুকের রঙ বাদামি ও মাথা কালো, পেটের নীচে সম্পূর্ণ সাদা, পা হলুদ। সবথেকে সুন্দর যেটা লাগে তা হল এর মুখের সামনে, যেন কেউ হলুদ রঙের একটা মাস্ক পরিয়ে রেখেছে।

bonerdiary (2)

২০১৬ সালে আমি পরিবার নিয়ে পুরী বেড়াতে যাই জানুয়ারি মাসে। বেশ ঠান্ডা তখন কলকাতায়, কিন্তু পুরী যেহেতু সমুদ্রতট তাই ওখানকার তাপমাত্রা তুলনামূলক একটু বেশি। তবুও শীতের পোশাক নিতে কার্পণ্য করিনি। পরে দেখলাম আমাদের নির্ণয় ভুল হয়নি। ভোরে ও সন্ধের পরে ঠান্ডা বেশ জমিয়ে লাগছে। পুরী মানুষ বেড়াতে যায় দুটো কারণে, এক জগন্নাথের মন্দির দর্শন ও সমুদ্রসৈকত উপভোগ করা। আমরা দুটোই করেছি। তাছাড়া আশেপাশের দ্রষ্টব্য যেসব স্থান রয়েছে সেগুলিও ভ্রমণ করেছি। কিন্তু আমার সবথেকে ভালো লেগেছে পুরীর মূল সদর থেকে একটু দূরে একটা সম্পূর্ণ নির্জন পরিবেশে এক অপূর্ব মোহনা, সমুদ্রের সঙ্গে এসে মিলেছে দয়া নদী। দু-ধারেই প্রচুর গাছপালা, পাখির কিচিরমিচির, ঠিক যেমনটা আমি পছন্দ করি। একটু দূরে জেলেরা মাছ ধরছে। সেই মাছ জালে তুলে তাদের হাঁড়িতে রাখছে। নদীর আশেপাশে প্রচুর পরিমাণে গো বক, কোর্চে বক ও কোঁচ বক রয়েছে। বোঝাই যায় যে ওদের খাদ্য এখানে ভালোই আছে। আমার সঙ্গে রয়েছে আমার পরিবারে আমার স্ত্রী ও কন্যা এবং আরও একটি পরিবারের কেবল স্বামী-স্ত্রী।

আমার স্ত্রী কিন্তু আমার সঙ্গে থেকে এখন একজন পক্ষী-প্রেমিক হয়ে উঠেছে। এতটাই যে এখন অনেক পাখিরই কেবল ডাক শুনেই নাম বলে দিতে পারে। পক্ষীদের প্রতি তার এ আগ্রহ আমার জন্য খুব ভালো হয়েছে। অনেক সময় বাড়িতে না থাকলেও আমি তার কাছ থেকে রিপোর্ট পাই নতুন কোনও প্রজাতির পাখির আনাগোনা হল কি না। লাল লতিকার ছবি তুলে তাকে দেখাই ও পরে ডাকও শুনিয়েছিলাম। ও কিন্তু একবার একটা কিছু দেখে বা শুনে নিলে আর ভোলে না। আরও একটা ভালো দিক হল, সে আমার সঙ্গে থাকলে প্রায় ক্ষেত্রেই প্রথমে পাখিটা তার চোখেই পড়ে। পুরীর এই স্থানেও তার কোনও ব্যতিক্রম হয়নি।

আমরা ঘুরতে ঘুরতে একদিন পুরীর সেই মোহনার দিকে চলে গেলাম। চারপাশের দৃশ্য অবশ্যই কোনও বর্ণনার প্রয়োজন পড়ে না, এতটাই সুন্দর। যাঁদের এখনও পর্যন্ত পুরী বেড়াতে গিয়ে এদিকটা আসা হয়নি, পরেরবার ভ্রমণ পরিকল্পনায় জুড়ে নেবেন। অনেকরকম চেনা পাখিই রয়েছে এখানে। নদীর কাছেই কিছুটা সমতল ভূমি, সেখানে ধীবররা মাছ ধরছে। আমি খুব মন দিয়ে তাদের মাছ ধরার কায়দা দেখা চলেছি। কী সুন্দর জালটাকে হাতে নিয়ে ছড়িয়ে নদীর জলে ফেলছে। কিছুক্ষণ জলে রাখার পর আস্তে আস্তে গুটিয়ে নিচ্ছে। তারপর ডাঙায় বসে জাল খুলে নিয়ে তাতে আটকে পড়া মাছ বেছে বেছে একটা বড়ো হাঁড়িতে রাখছে। এই প্রক্রিয়া বেশ কয়েকবার ধরে চলল। আমার তো মজাই লেগে গেল। মাছ ধরার ব্যাপারটা এত কাছ থেকে আমি কোনোদিনও দেখেনি। মাঝ-নদীতে নৌকায় ধীবরদের মাছ ধরতে দেখেছি, তবে তা খুব একটা স্পষ্ট নয়। আমি যখন এদিকটায় মত্ত, তখন আমার স্ত্রী আমার হয়ে কাজ করে যাচ্ছে। আমার পিঠে একটু টোকা দিয়ে আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল সে। আঙুল উঁচিয়ে একদিকে দেখাল। সে নিজেই বলল, “মনে হচ্ছে ল্যাপউইং – হাটিটি।”

হ্যাঁ, সে ঠিকই সনাক্ত করেছে। এটা হাটিটি তো নিশ্চয়ই, তবে হলুদ হাটিটি। মুখের ওপর একটা হলুদ রঙের মুখোশ পরানো রয়েছে। না-হলে একবারে লাল লতিকার মতোই হাবেভাবে। এই পক্ষীকে আমি দেখতেই পেতাম না যদি না আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করা হত।

পুরী থেকে ফিরে গিয়ে রাজুকে ছবি দেখিয়েছিলাম এই হাটিটির। ওকে বললাম, “এই হল আরও এক প্রকারের হাট্টিমাটিম টিম, পরে আরও অন্য প্রকারের পেলে দেখাব।”

রাজু ভালো করে ছবি দেখে বলল, “দাদা, এ তো একই পাখি, কেবল আগেরটা নাকের কাছে লাল দাগ ছিল আর এটার হলুদ।”

আমি মাথা নাড়ালাম যে দুটোই একই পাখি কেবল প্রজাতি আলাদা।

নভেম্বর, ২০১৭ সালে আমরা জিম করবেট অভয়ারণ্য বেড়াতে যাই। সেখানে বাঘ দেখার অভিজ্ঞতা তো হয়েছেই, তাছাড়া বহু প্রকারের পক্ষী পেয়েছি, হিমালয়ের সুন্দর পাখি। এই অভয়ারণ্যের ভিতর দিয়ে বয়ে গেছে রামগঙ্গা নদী। সেই নদীর ধারে বহু পশুপাখি জল খেতে, স্নান করতে আসে। এর চরে অনেকরকমের পাখি দেখা যায়। জিম করবেট জাতীয় উদ্যানের অনেকগুলো বলয় আছে যার মধ্যে আমরা ঘুরেছিলাম প্রথমে বিজরানি, গৈরাল, আরও কিছু ছোটো বলয় আর সবশেষে প্রধান বলয় আর সবথেকে বড়ো ও জনপ্রিয় এলাকা ঢিকালা। ঢিকালা ফরেস্ট রেস্ট হাউসের পাশ দিয়ে বয়ে গেছে রামগঙ্গা। সামনেটায় একটা বড়ো ওয়াচ টাওয়ার বানানো পর্যটকদের দেখার জন্য। আমরা ওখানে গিয়ে যখন দাঁড়ালাম তখন ওখানে আর কেউ ছিল না। সবার চোখে পড়ল দুটো হাতি, একটা কোর্চে বক, একটা সাদা কাক আর নদীর ধারে দূরে খালি চোখে মনে হল একটা কুমির পড়ে আছে। ক্যামেরার লেন্স চোখে দিতেই স্পষ্ট হল যে ওটা একটা ঘড়িয়াল। কিন্তু আরও কিছু চোখে পড়ল ক্যামেরার লেন্সের সাহায্যে। সাদা কাকের পাশে আরও একটা ছোটো পাখি, এও হাটিটি। নদীর কাছেই দেখা যায়। নদীটি River Lapwing। হাটিটিরা শান্ত ধরনের পাখি, খুব একটা নড়াচড়া করে না তাই অনেক সময় নিয়ে ভালো করে এই পাখিদের ছবি তোলা যায়। আমার সঙ্গীদেরও দেখালাম দূরের ওই ছোটো পাখিটাকে। ওরাও অবাক যে হাট্টিমাটিম টিম থেকে হাটিটিতে পরিবর্তিত এই পাখির এক প্রজাতিকে দেখে।

২০১৯ সালে জয়ঢাকের সঙ্গে চন্দ্রশিলা ট্রেকে যাই। ফেরার পথে হরিদ্বার থেকে দিল্লির ট্রেন। তাই ফেরার দু-দিন আগেই আমরা কালীকমলি ধর্মশালাতে উপস্থিত। মাঝে পুরো একটা দিনের সময়। তাই সকলকে ছাড় দেওয়া হল হরিদ্বারে যে যা করতে চায় সেদিন করে নিতে পারে। আমাদের ঠাসা কর্মসূচি পরের দিনের জন্য। প্রথমে চণ্ডীমাতা মন্দির ট্রেক করে ওঠা ও নামা, পরে গঙ্গায় স্নান করে পবিত্র হয়ে নেওয়া আর বিকেলে মা মনসা মন্দিরে পুজো দিতে যাওয়া আর শেষে কিছু কেনাকাটা। পাখি দেখার এই পর্বে আমাদের প্রাতঃকালের চণ্ডীমাতা মন্দির ট্রেক কেবল প্রযোজ্য, কারণ এখানেই পাখির কিছু সাক্ষাৎ পেয়েছিলাম, হিমালয়ের পাখির। কিন্তু এই গল্পের নায়ক এই পাহাড়ের ওপরে থাকে না। আমরা নেমে আসার পর ঠিক করলাম, যেহেতু আমাদের কাছে সময় রয়েছে তাই প্রথমে একটু পানীয় সেবন করে গঙ্গার ধার ধরে হাঁটা শুরু করলাম। লোকালয়ের থেকে কিছুটা দূরে আসার পর আমার সঙ্গীরা বিশ্রাম নেওয়ার জন্য এক বাঁধানো জায়গায় বসে পড়ল। আর ঠিক ওখান থেকেই নদীর ও-পাড়ে আমার নজরে পড়ল পাখিদের নড়াচড়া। আমার সঙ্গীসাথীরা সেই সময় গল্পে ব্যস্ত, আমি আস্তে করে উঠে চলে এলাম। আমার নজরে পড়ল দুটি খঞ্জনা ও একটি হাটিটি – নদী হাটিটি (River Lapwing)। আমি আমার কাজ চুপচাপ সেরে নিলাম। দেবভূমিতে ট্রেক করতে এসে অনেক পাখিই সংগ্রহ করে নিয়েছি আর হাট্টিমাটিম টিম, থুড়ি হাটিটির তালিকায় আবার যোগ হল নদী হাটিটি।

bonerdiary (3)

বাংলা নাম না জানা আরেক হাটিটি পেয়ছিলাম গৌরনিতাইর বাসস্থানে, অর্থাৎ নদীয়া জেলার মায়াপুরে ইসকন মন্দিরের খুব কাছেই এক জলাভূমিতে। এই হাটিটির ইংরেজি নাম গ্রে হেডেড ল্যাপউইং (Grey Headed Lapwing)]। আমি বিশেষজ্ঞদের মতামত জানতে চেয়েছিলাম, কিন্তু তাঁরা কেউই সঠিক বাংলা নাম জানাতে পারেননি। তাই আমি ধূসর মাথা হাটিটি বলে এর এখানে একটা বাংলা নামের পরিচয় রাখলাম। একদিন সকালে বেরিয়ে পড়েছিলাম গাড়ি নিয়ে নদীয়া জেলার সদর কৃষ্ণনগরে। অবশ্যই একটা ব্যক্তিগত কাজের জন্যেই, কিন্তু আমি জানি রাস্তায় আমার ভালো লাগার অনেক কিছুই পড়বে। নভেম্বর মাসের মাঝামাঝি, তখন ভোরের দিকে একটা ঠান্ডার আমেজ পাওয়া যায় যেটা বেলা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে আর থাকে না। তাই পথে গরম ছিলই, কিন্তু জলঙ্গি নদীর কাছে এসে গরম অনুভব করলাম না। এই জায়গাটির পরিবেশ অত্যন্ত মনোরম। তখন কিছু বক জাতীয় পাখি ছাড়া আর কিছুই চোখে পড়ল না। ৩৪ নং জাতীয় সড়কের পাশ দিয়ে চলে গেছে রেল লাইন মুর্শিদাবাদের দিকে। আমি সড়কপথের সেতুর ওপর দাঁড়িয়ে, আর ঠিক সেই সময় একটা লালগোলা ফাস্ট প্যাসেঞ্জার দ্রুত গতিতে বেরিয়ে গেল। নদীর পাড়ের বকগুলো পাখনা মেলে আর কিছুটা দূরে গিয়ে উড়ে বসল। কৃষ্ণনগরে যেখানে গিয়েছিলাম সেখানে আবার বিকেল ৪টায় যেতে হবে। আমার কাছে তখন অফুরন্ত সময়। ঠিক করলাম, এগিয়ে যাই মায়াপুরে ইসকন মন্দিরের দিকে। রাধা-কৃষ্ণের মন্দির দর্শনও হবে আর আমার সময়ও কাটবে। এখানে বলে রাখি, এখানেও আমার সঙ্গী আমার অর্ধাঙ্গিনী। মায়াপুর পৌঁছে যথারীতি সমস্ত দর্শনীয় স্থান ঘুরে ঘুরে দেখে নিলাম। ওখানেই খাওয়াদাওয়ার কুপন নিয়ে ভোজনও সেরে ফেললাম দুজনে। সময় যখন বেলা ৩টার কাছাকাছি, তখন ঠিক করলাম যে এবার রওনা হওয়া যাক। বেশ খানিকটা পথ আসার পর একটা জলাভূমির মতো দেখা পেলাম। আমার স্ত্রী গাড়ি থামাতে বলল। ও নিশ্চয়ই কিছু একটা লক্ষ করেছে। আমিও তাড়াতাড়ি গাড়ি থেকে নেমে আমার স্ত্রীর পিছু নিলাম। ও অঙ্গুলিনির্দেশ করে যা দেখাল সেটা অবশ্যই এক পক্ষী এবং হাটিটি। আগে ছবি দেখেছি তাই চিনতে ভুল হয়নি। গ্রে ল্যাপউইং অথবা আমার ভাষায় ধূসর মাথা হাটিটি। কী সুন্দর দেখাচ্ছিল যখন জলের মধ্যে পা ফেলে আস্তে আস্তে ঘুরে বেড়াচ্ছে আরে জলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে জল থেকে পোকামাকড় বেছে খাচ্ছে। এমনিতেই এই স্থানটি মূল লোকালয় থেকে কিছুটা নিরিবিলি। মাঝেমধ্যে দু-একটা সাইকেল বা ভ্যান-রিকশা যাওয়া আসা করে আর মোটর গাড়ি দ্রুত গতিতে বেরিয়ে যায়। আমার মতো পক্ষী দেখার বাতিক এদিকে কজনেরই-বা আছে। তবে আমার সঙ্গে আমার স্ত্রীরও এই বাতিকের উপসর্গ দেখা দিয়েছে, এটা কিন্তু ভালো লক্ষণ। ও সঙ্গে থাকলে আমি কিছুটা হালকা অনুভব করি। যেমন এই ক্ষেত্রে, হাটিটিটা তার নজরেই পড়ল, আমার মনোযোগ অবশ্য গাড়ির স্টিয়ারিংয়ে বসে সামনে রাস্তার ওপরেই ছিল এবং এই জন্যেই এই পক্ষী দর্শন লাভ হল।

bonerdiary (4)

উত্তরে টিটি অথবা ইংরেজি নামে পরিচিত, নর্দার্ন ল্যাপউইং (Northern Lapwing), [৫- নীচের ছবি অনুযায়ী]। আমার ভাগ্যে দেখা পায়নি যদিও বা যেখানে এদের পাওয়া যায় সে-সব স্থানে আমি বহুবার গিয়েছি। মূলত হিমালয়ের পাদদেশে নদীর ধারে, চরে এদের অনেক পরিমাণে দেখা যায়, কিন্তু আমার চোখকে এই পক্ষী ফাঁকি দিয়ে গেল। অপূর্ব দেখতে, অনেকটা হিমালয়ের মোনালের সঙ্গে কোথায় যেন একটা মিল খুঁজে পাওয়া যায়। বোধ হয় মাথার ঝুঁটি ও খানিকটা গায়ের রঙের সঙ্গে মিল আছে, তবে আকারে এই পাখি অনেক ছোটো। আমাদের পশ্চিমবঙ্গের গাজোলডোবায়, মহানন্দার চরে এদের প্রচুর মাত্রায় দেখা যায়। পরের বারের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া উপায় – লাকি ড্রয়ের সময় প্রায়েই ইংরেজিতে লেখা দেখা যায় – বেটার লাক নেক্সট টাইম।       

bonerdiary (5) 

বি: দ্র: উত্তরে টিটি – ছবি সৌজন্য গুগল

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s