আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি, বাঁশপাতি
পাখি দেখা – ১৪
সাত রাজ্যের ও-পারে আমার স্বপ্নে দেখা পক্ষিটি থাকে। পাখিটিকে একবার দেখলেই চোখ জুড়িয়ে যায়। মনটা অন্যরকম এক ভালো লাগার আবেশে ভরে যায়। অনন্যসুন্দর সেই পাখিটির নাম হুদহুদ। মূলত আফ্রো-ইউরেশিয়া অঞ্চলের হুপো নামে একটি পাখির নামানুসারে এই পাখিটির নামকরণ করা হয়েছে। পাখিটির শরীর বাদামি এবং ডানা ও লেজে সাদা-কালো দাগ রয়েছে। মাথায় সুন্দর একটি ঝুঁটি। সেই ঝুঁটির হলদে-বাদামি পালকের মাথাটা কালো রঙের।
সাধারণত এই উপমহাদেশে পাখিটি বেশি দেখা যায়। আমাদের দেশে পাখিটি ‘মোহনচূড়া’ বা ‘হুপো’ নামে পরিচিত। ডাকে উপ.. উপ… উপ আওয়াজ করে।
উপুপিড়ি গোষ্ঠীর একমাত্র প্রতিনিধি এই হুদহুদ মধ্যপ্রাচ্যের দেশ ওমানে বেশ পরিচিত। পাখিটি শুধু ওমান নয়, মধ্যপ্রাচ্যের প্রতিটি দেশ এবং আফ্রিকার মিশর, চাদ, মাদাগাস্কার, এমনকি ইউরোপের কয়েকটি দেশ, এশিয়ার ভারত এবং দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার একাধিক দেশেও অতিপরিচিত। দেশভেদে কেবল নামকরণেই কিছুটা পার্থক্য। ইংরেজিতে একে হুপো বা হুপি বলে ডাকা হয়। আরবির মতো উর্দুতেও একে হুদহুদ নামে ডাকা হয়।
বলা হয়ে থাকে, হুদহুদ পাখির পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অসাধারণ। কিন্তু তা সত্ত্বেও পাখিটি কিন্তু তাকে শিকারের জন্য পেতে রাখা ফাঁদ দেখতে পায় না। অর্থাৎ দূরের কোনও বস্তু তার কাছে স্পষ্ট হলেও তার প্রাণঘাতী ফাঁদটি সে স্পষ্টভাবে দেখতে বা বুঝতে পারে না। ভারতের উড়িষ্যা ও অন্ধ্রপ্রদেশে ২০১৪ সালে যে ঘূর্ণিঝড় আছড়ে পড়েছিল, তাকে হুদহুদ নাম দেওয়া হয়েছিল। ঘূর্ণিঝড়ের নাম রেখেছিল ওমান দেশ থেকে ইসরায়েলের জাতীয় পাখি হুদহুদের নামকরণে। সেই সুবাদে নামটি এখন লোকজনের মুখে মুখে। আমরা বাংলায় বলে থাকি মোহনচূড়া।
এই পাখিদের মাথায় কাকাতুয়ার মতো ঝুঁটি থাকে। উত্তেজিত হলে এই ঝুঁটি প্রসারিত করে থাকে। সেই সময় দেখতে পেলে ভারি চমৎকার লাগে। ছবিতে তো অনেক দেখেছি, কিন্তু স্বচক্ষে দেখতে পাওয়ার আনন্দ অন্যরকম। এই পক্ষি নাকি এত সুলভে দেখা যায় অথচ আমার একে দেখতে সময় লাগল প্রায় পাঁচ বছরের একটু কম। পাঁচ বছর এই জন্যই যে পাখি দেখার শখ যবে থেকে হয়েছে তখন থেকে পাঁচ বছর। আর প্রথম দর্শন বোলপুরে। আর আমার সঙ্গে ঠিক এইরকমই হয়ে থাকে। যখনই আমার হাতে ক্যামেরা থাকে না, ঠিক তখনই আমার সামনে যতসব ভালো, সুন্দর প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এসে উপস্থিত হয়। এই যেমন একদিন লকডাউনের মধ্যেই আমি বিকেলে ছাদে রয়েছি, হঠাৎ কিছু দূরে এক গাছের ডগায় ভারি সুন্দর দেখতে একটি পাখি উড়ে এসে বসল। একটা ঘুঘু পাখির চেয়ে বেশি বড়ো নয়, গায়ের রঙ তামাটে আর মাথাটা ছাই রঙের। কিছু বুঝে ওঠার আগেই আবার উড়ে গেল। হাতে ক্যামেরা থাকলে সু্যোগ ছিল একটা ছবি চট করে তুলে নেওয়ার। মোহনচূড়ার ক্ষেত্রেও তাই হয়েছিল। দুপুরবেলা আমি ঘর থেকে আহার সেরে অফিস যাব বলে বেরিয়েছি মাত্র, আমাদের সামনের রাস্তার ওপরে উনি স্বচ্ছন্দে একা একা ঘুরে বেড়াচ্ছেন আর পোকামাকড় খুঁটে খেয়ে চলেছেন। আমি তখনই দূরত্ব বজায় রেখে দাঁড়িয়ে পড়লাম। পাঁচ মিনিটের বেশি সময় ধরে কেবল তার আচার-আচরণ লক্ষ করে গেলাম। আমার পকেটে আমার মোবাইল ফোন, তাতে প্রায় ৮ মেগাপিক্সেল ক্যামেরা রয়েছে, কিন্তু পাখির ছবি তোলার জন্য যথেষ্ট নয়। কিন্তু এছাড়া আমার আর কোনও উপায় ছিল না। একটা ছবি এল ঠিকই, একমাত্র আমি দেখেই বলতে পারব যে ওটা একটা পাখি, নাম মোহনচূড়া বা হুদহুদ অথবা কমন হুপো। একদিকে খুব ভালো লাগল যে আমার হুপো না দেখতে পাওয়ার বাধাটা কেটে গেল। আবার দুঃখও রয়ে গেল যে আমি ওকে ধরে রাখতে পারলাম না। মনে মনে ভাবলাম যে ঈশ্বর আবার নিশ্চয় সু্যোগ করে দেবেন ওকে ফ্রেমবন্দি করার।
ঈশ্বরের কৃপায় আবার সু্যোগ এল ২০১৭ সালের ডিসেম্বর মাসে। আমরা বেড়াতে গিয়েছিলাম জিম করবেট টাইগার রিজার্ভ সহ দিল্লি, আগ্রা ও ফতেপুর সিক্রিতে। জিম করবেটে আমাদের গাইড ও গাড়ির চালক ছিল এক যুবক, রশীদ, এই জঙ্গল ওর নখদর্পণে। এমন কোনও পাখির নাম নেই ও জানে না আর এই জঙ্গলে ক’টা বাঘ আছে, তার মধ্যে ক’টা পুরুষ আর ক’টা স্ত্রী, তাদের আবার ক’টা ক’টা করে ছানাপোনা আছে, ও সব জানে। রশীদই আমাকে ধনেশ পাখি দেখাতে সাহায্য করেছিল, একবারে এক ঝাঁক রাজ ধনেশ। আমাদের প্রথম সাফারির দিন সকালবেলাতেই বাঘ-দর্শন হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু সেই বাঘ আবার বোধ হয় একটু লাজুক প্রকৃতির, তাই একবার দেখা দিয়েই সে গিয়ে এক ঝোপের মধ্যে গা ঢাকা দিল। রশীদ জানাল যে এখানে অপেক্ষা করে আর লাভ নেই, ও আর সারাদিনেও বাইরে বেরোবে না। ও গাড়ি ঘুরিয়ে নিয়ে চলল, আর আমরাও চলেছি গাড়িতে বসে মুখটি তুলে। একটু দূরে গিয়েই দেখি একটা গাছের ডাল রয়েছে ঝুলে আর তারই মগডালে এক ঈগল পাখি, পাছে ধরে, তাই আগেই ওকে আমি বন্দি করে ফেললাম, অবশ্যই আমার লেন্সে। দারুণ ছবি এল এই পাখির। বাংলায় নাম তিলাজ বা সাপমার চিল – ইংরেজিতে ক্রেস্টেড সারপেন্ট ঈগল। ইতিমধ্যেই রশীদ আমার দৃষ্টি আকর্ষণ করল অন্যদিকে। একটা সরু মেঠো পথ বেঁকে চলে গেছে বনের একধারে। বেশ কিছু চিতল হরিণ সেখানে দাঁড়িয়ে অবাক দৃষ্টিতে আমাদের দিকে চেয়ে রয়েছে। আমি ক্যামেরার লেন্স ওদিকই তাক করেছিলাম, কিন্তু রশীদ নিজের হাতে আমার ক্যামেরার ফোকাস নামিয়ে দিল সামনের সবুজ ঘাসের ওপর। চোখের সামনে এক মোহনচূড়া বা হুদহুদ ঘুরে বেড়াচ্ছে। ওর লম্বা সূচের মতো ঠোঁটকে মাটির মধ্যে ঢুকিয়ে কিছু খাদ্য টেনে বার করে আনছে। ঈশ্বরের আর রশীদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ যে অবশেষে ওরা আমাকে এই পাখির দর্শন করাতে সাহায্য করেছে। প্রাণভরে ওকে আমি আমার লেন্সবন্দি করেছি। [১ – পাশের ছবি অনুযায়ী] বোলপুর থেকে সেই আক্ষেপ নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছি কবে এর দেখা পাব, অবশেষে পেলাম এই হিমালয়ের পাদদেশে এসে, গভীর অরণ্যের মধ্যে। এর পুরো কৃতিত্ব প্রাপ্য অবশ্যই রশীদের। ও না দেখালে আমার হয়তো দৃষ্টিই পড়ত না হুদহুদের প্রতি। আমার পাখির অ্যালবামে যোগ হল মোহনচূড়া, আমার কাছে অন্তত এক আলংকারিক পাখি আর আমি মনে করি অনেকেই আমার সঙ্গে একমত হবেন।
করবেট ভ্রমণ করে দিল্লি ফিরে এসেছিলাম। রাজধানীতে কিছুদিন থেকে আবার একদিন সারাদিনের ভ্রমণ-সূচি তৈরি করে বেরিয়ে পড়লাম আগ্রা ও ফতেপুর সিক্রির উদ্দেশ্যে, দুটোরই ভারতের ঐতিহাসিক স্থান হিসাবে বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। সেই ইতিহাসের দিকে আর গেলাম না, সকলেরই জানা সেই বিষয়। আমি বরং আমার সাবজেক্ট নিয়েই থাকি। আগ্রার তাজমহল আমি এর আগেও কয়েকবার ঘুরে এসেছি। এবার আসা আমার পরিবার, বিশেষ করে আমার মেয়ের জন্য। ওর আগে ভারতবর্ষের তথা বিশ্বের এই সপ্তম আশ্চর্য দেখা হয়নি বলে। ওরা যখন এই স্মৃতিস্তম্ভ ঘুরে দেখছে, আমার দৃষ্টি তখন তাজের পেছনে যমুনা নদীর ওপর। সেখানে পাখির মেলা বসেছে, কী নেই সেখানে। রাঙা মানিকজোড় (Painted Stork), পানকৌড়ি (Little Cormorant), সাদা কাঁক (Grey Heron) ও চখাচখি (Rudy Shellduck) আর মাথার ওপর উড়ে বেড়াচ্ছে এক চিল (Black Kite)। [২ – পাশের ছবি অনুযায়ী] সম্রাট শাহজাহানের স্মৃতিস্তম্ভ থেকে কিছু কম আনন্দ পাইনি এই প্রাকৃতিক দৃশ্য দেখে। এই ছবি আজও আমার মস্তিষ্কে এক স্মৃতিস্তম্ভ হয়েই রয়েছে। মাঝেমধ্যে স্মৃতির অ্যালবাম ঘেঁটে একবার করে পাতা উলটিয়ে দেখে নিই মাত্র।
পৌঁছলাম আরেক স্মৃতিস্তম্ভ দেখতে এবার, ১৫৬৯ সালে আকবরপুত্র জাহাঙ্গীরের জন্ম হয় এইখানে। যে সন্ত শেখ সেলিম চিস্তি জাহাঙ্গীরের জন্মের সফল ভবিষ্যদ্বাণী করেন, তাঁর সম্মানার্থে এই ধর্মীয় প্রাঙ্গণ নির্মাণ করেন সম্রাট আকবর। জাহাঙ্গীরের দ্বিতীয় জন্মদিনের পরে আকবর এখানে একটি প্রাচীর-ঘেরা শহর এবং এক রাজশাহী প্রাসাদ নির্মাণ করেন। ১৫৭৩ সালে আকবরের গুজরাত বিজয়ের পরে শহরটির নাম হয়ে যায় ফতেপুর সিক্রি, ‘বিজয়ের শহর’। মূল প্রবেশদ্বারটি বুলন্দ দরওয়াজা নামে পরিচিত। এখন অবশ্য প্রবেশদ্বার অন্য দরওয়াজা বরং প্রস্থানদ্বার হয়েছে বুলন্দ দরওয়াজা। আর আমার সবথেকে আনন্দের ব্যাপার হল, এখানে প্রবেশের পর কিছুটা গিয়েই দেখতে পেলাম সম্রাজ্ঞী জোধাবাই-এর রান্নাঘর। তার সামনেই খোলা সবুজ প্রাঙ্গণ আর ওখানেও রয়েছে এক হুপো বা হুদহুদ। ছবি তুলে পরে দেখলাম করবেটে যে ছবি তুলেছিলাম সেটাও সবুজ ঘাসের ওপর আর এখানেও তাই, যার জন্য দুটো ছবি প্রায় একই কায়দার হয়ে গেছে। অথচ যদি আমি কোনও ইমারত নিয়ে ছবি তুলতাম তাহলে হয়তো পাখিটি কারুর চোখেও পড়ত না। সকলে ইমারতটাই দেখত।
হুদহুদ খুব কাছ থেকেই দেখা গেল ঠিকই, কিন্তু এমন নয় যে এক বিরল পাখি যা দেখার জন্য আমাকে সাত রাজ্য পাড়ি দিতে হবে। দুঃখের কথা হল যে এত বছর ধরে অপেক্ষা করেও একে আমার বাড়ির ১০ কিমি ব্যাসরেখার মধ্যে দেখতে পেলাম না কোনোদিন। লকডাউনের পরেও অনেক নতুন পাখি দেখা গিয়েছে, কিন্তু হুদহুদ কেন আসে না সে আজও আমার কাছে এক রহস্য। আমার বাড়ির লোকেরা বলে, আসলে এখানকার হুদহুদ নাকি আমার ক্যামেরাকে ভয় পায়, তাই এ-মুখো হয় না। কিন্তু ক্যামেরা তো আমার প্রদর্শিত থাকে না সর্বক্ষণ! আমার মনে হয় বাঙালি হুদহুদেরা বোধ হয় একটু লাজুক প্রকৃতির, তাই আমার সমুখপানে হয় না। ভিন রাজ্যের হুদহুদ দেখার জন্য আমাকে পাড়ি দিতে হয়েছে উত্তরপ্রদেশ ও পাশের রাজ্য উত্তরাখণ্ডে। তবে গিয়ে সেই ছবি সংগ্রহ করতে পারলাম।
তাই বলে রাখলাম, এই পাখিকে কেউ যদি ঝুঁটি খোলা অবস্থায় দেখতে পায় তার থেকে ভাগ্যবান আর কেউ হবে না। ওই অবস্থায় লেন্সবন্দি করতে পারলে তো কেল্লা ফতে! সেই দুঃখ এখনও রয়েছে আমার।
বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে