বনের ডায়েরি-পাখি দেখা -ডাহুক কেন ডাকে-অলোক গাঙ্গুলী-বর্ষা-২০২২

আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি, বাঁশপাতি, মোহনচূড়া , হাট্টিমাটিমটিম থেকে হটিটি, রামগাংড়া

ডাহুক (White-Breasted Waterhen)

ডাহুক পাখিকে আমি হামেশাই দেখতে পাই আমার বাড়ির আনাচ-কানাচে। গৃহপালিত মুরগির মতো ঘুরে বেড়ায়। যদিও-বা ভীষণ ভীরু প্রকৃতির পাখি, তাও খাবারের সন্ধানে চলে আসে। মাটি থেকে খুঁটে খেতে খেতে সমানে এদিক ওদিক তাকায়। পিঠের রঙ ধূসর থেকে খয়েরি-কালো, মাথা ও বুক সাদা। লেজের নীচের অংশে লালচে আভা। ঠোঁট হলুদ রঙের, ঠোঁটের উপরে লাল রঙের একটি ছোট্ট দাগ আছে।

bonerdiary02

ডাহুক খুব সুন্দর একটি পাখি। রাতে ডাহুকের ‘কোয়াক’ ‘কোয়াক’ ডাক শুনে সহজেই একে চিনতে পারা যায়। এই ডাক পুরুষ পাখির, যা বর্ষাকালে বেশি শোনা যায়। একটানা অনেকক্ষণ ডেকে শ্বাস নেয়। ডাহুকের স্ত্রী প্রতিশব্দ ডাহুকী। জল এদের প্রধান আশ্রয়। পুকুর, খাল, জলাভূমি, বিল, নদীর গোপন লুকানো জায়গা এদের খুব প্রিয়। মাটিতে, ঝোপের তলায় এরা বাসা তৈরি করে। ৬-৭টি ডিম পাড়ে। ডিমের রঙ ফিকে হলুদ বা গোলাপি মেশানো সাদা। ফোটে ২০-২৪ দিনে। বাবা ডাহুক আর মা ডাহুক মিলে পালা করে ডিমে তা দেয়।  সাদা-কালো রঙের এই পাখিটির ছানারা হয় কুচকুচে কালো। সবচেয়ে মজার ঘটনাটা ঘটে যখন বাচ্চা ডাহুকগুলোকে খাবার খাওয়ানো হয়। অন্য পাখিদের মতো ডাহুকের বাচ্চাদের মা বা বাবা মুখে খাবার নিয়ে খাইয়ে দেয় না। তাহলে ওরা খায় কীভাবে? ডিম থেকে বাচ্চা বের হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রাকৃতিক নিয়মেই বাচ্চাগুলো ১৫-২০ ফুট উঁচু থেকে লাফ দিয়ে নামে মাটিতে। শরীরটা পাতলা বলে লাফ দিয়ে মাটিতে পড়লেও তাদের কিছুই হয় না। মাটিতে নেমেই বাচ্চাগুলো মা-বাবার পিছনে পিছনে হেঁটে হেঁটে খুঁটে খুঁটে খাবার খায়। প্রাপ্তবয়স্ক ডাহুকের মূল খাদ্য জলজ কচি ঘাসের ডগা-পাতা, পাকা ধান ইত্যাদি। ডাহুক-ছানার প্রিয় খাবার পোকামাকড়, শামুক, উদ্ভিদের ডগা আর শস্যদানা।

মাঝে মাঝে পোষ-মানা ডাহুকের স্ত্রী পাখিকে বলা ডাহুকী। ডাহুকীকে নিয়ে প্রকৃতি, লুকানো জীবনের প্রাণবন্ত কবি জীবনানন্দ দাশ বলেছেন,

মালঞ্চে পুষ্পিতা লতা অবনতমুখী,-
নিদাঘের রৌদ্রতাপে একা সে ডাহুকী
বিজন-তরুর শাখে ডাকে ধীরে ধীরে
বনচ্ছায়া-অন্তরালে তরল তিমিরে।’

কিন্তু পোষ মানার পর আমাদের দেশের এক শ্রেণির অসাধু মানুষ এদের টোপ হিসেবে ব্যবহার করে অন্য ডাহুক পাখি শিকার করে। কারণ, একটির ডাকে কাছাকাছি থাকা অন্য পাখিটি চলে আসে। এমন সুন্দর একটি পাখিকে মানুষের কী করে মেরে ভক্ষণ করতে ইচ্ছে করে আমি বুঝে পাই না। কবিরা পর্যন্ত সুন্দর পাখিটিকে নিয়ে নিজেদের মতো রচনা করেছেন।

চণ্ডীদাস তার কবিতায় বলছেন:

‘ভাদর মাঁসে অহোনিশি অন্ধকারে
শিখি ভেক ডাহুক করে কোলাহল।
তাত না দেখিবোঁ যবেঁ কাহ্নাঞিঁর মুখ
চিনি-তে মোর ফুট জায়িবে বুক।’

অর্থাৎ কবি বলছেন, শিখি, মানে ময়ূর, ভেক ও ডাহুক পাখির কোলাহল এ সময় শোনা যায়। আসলেই এ সময় নতুনভাবে সজীব হয়ে ওঠে প্রকৃতি। কলকাকলি মুখর পরিবেশে নতুন কিছু খুঁজে থাকে সে। নতুন কিছু পাবার আর নতুন কিছু দেবার ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় ভাদ্র তার দান ভাণ্ডার খুলে বসে। প্রকৃতির কাছ থেকে তার অপার সৌন্দর্যকে নিয়ে ভাদ্র বিলিয়ে দিতে চায় সবার কাছে। আর এই সময় সবাই মিলে সুখ-দুঃখ ভাগাভাগি করে নেয়। ডাহুকের ক্ষেত্রে কথাটা একবারেই ঠিক। জলচর এই পাখিটি মায়ার ডালি। যখন সঙ্গীর খোঁজ না পায়, সারা দিনরাত ডাকতে ডাকতে গলা চিরে রক্ত উঠে একসময় ঘুমিয়ে পড়ে মৃত্যুর কোলে। সত্যি কী মর্মান্তিক! তবু তাতেই সার্থক তাদের জীবন। ভালোবাসা অসীম, চিরন্তন।

আমার বাড়ির পেছনে দুটি বড়ো বড়ো জলাশয় আছে, তার মধ্যে একটি আবার কাঁটাতারের বেড়া দিয়ে ঘেরা রয়েছে সংরক্ষিত অঞ্চলের আওতায় পড়ে বলে। একদিক দিয়ে ভীষণ ভালো, কেউ ওই বেড়াজাল টপকে ভিতরে প্রবেশ করতে পারবে না, অর্থাৎ পাখিদের জন্য নিরাপদের আশ্রয়। তাছাড়া কেউ সাহস করবে না, এক ওটা পুলিশের এলাকা আর দ্বিতীয় ওখানে জলাশয়ে ঘিরে এত উঁচু ঘাস যে ওখানে বিষাক্ত সরীসৃপ লুকিয়ে থাকার যথেষ্ট সম্ভাবনা আছে। এসব আমি আমার বাড়ির ছাদ থেকেই দেখতে পাই। মাঝেমধ্যেই ডাহুকেরা, কখনও একা আবার কখন জোড়ায় আসে বাড়ির পেছনে, ওদের ডেরা ওই জলাশয়ের ধারেই। যখনই আসে আর আমার চোখে পড়লে আমি এক দৃষ্টিতে তাকিয়ে দেখি। একবারে আমাদের গৃহপালিত মোরগ-মুরগির মতো চালচলনে আর হাবেভাবে। এও অন্য পাখিদের চেয়ে কোনও অংশে কম সুন্দরী নয়। আগে একটা তথ্য এদের ব্যাপারে জানা ছিল না, পরে বই পড়ে জানতে পারলাম, ওপরে উল্লেখিত, যে ওরা নিজেদের সাথীকে দেখতে না পেলে ক্রমাগত ডাকতে থাকে আর তার থেকে তাদের মৃত্যু পর্যন্ত ঘটে, কী মর্মান্তিক! তারপর বুঝলাম এই ডাহুক পাখি সারারাত ধরে জলাশয়ের পাশে ডাকতে থাকে আর আমি তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থাতেও ওই ডাক শুনতে পাই। ও তখন চিৎকার করে ওর সাথীকে ডেকে বেড়াচ্ছে। ভোরবেলা আর ওই ডাক শুনতে পেতাম না। ঈশ্বর জানেন যে ওর সাথী ফিরে এসেছিল, নাকি ও চেঁচাতে চেঁচাতে মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ল। ভাবলে গায়ে শিহরন দিয়ে ওঠে।

বর্তমানে আমার বাড়ির পেছনে একটা সরকারি ভবন গড়ে উঠেছে। দিনের বেলায় কর্মচারীরা কাজে আসে আর রাতে কিছু মানুষ পাহারায় থাকে। তারা এই ভবনেই নিজেদের খাবার তৈরি করে রান্না করে। জানালা দিয়ে অথবা নর্দমা দিয়ে জলের সঙ্গে কিছু খাবারও বোধহয় বেরিয়ে আসে, তাই প্রতিদিন সকালে-দুপুরে বেশ কিছু শালিক, ঘুঘু, পায়রা, দোয়েল ইত্যাদি একত্রিত হয় খাবারের আশায়। একদিন দেখি এক ডাহুকও এসেছে, তখন আর কোনও পাখি ছিল না। আমি জানালা দিয়ে দেখছি পাখিটা বেশ খাবার উপভোগ করছে আর মাঝেমধ্যে মাথা তুলে, ঘাড় ঘুরিয়ে এদিক ওদিক সতর্ক হয়ে দেখছে কোনও শত্রু এল কি না। এর মধ্যে দেখি হঠাৎ ভবন থেকে এক ব্যক্তি বেরিয়ে চুপিচুপি পাখিটার দিকে এগোচ্ছে, ধরার তাগিদে। আমিও যথারীতি উৎসুক হয়ে বসেছি কী হয় দেখার জন্য। আমি নিশ্চিত, ওই পাখিকে কিছুতেই ধরা যাবে না। তবুও যদি একান্ত ধরেই ফেলে তখন ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। এই ভেবে আমি পরিস্থিতি ওপর নজর রাখছি। ডাহুক অসম্ভব সতর্ক প্রাণী, পায়ের শব্দ শোনামাত্র পাখা মেলে উড়ে সীমানার বাইরে, জলাশয়ের কাছে চলে গেল। মানুষটি ব্যর্থ হয়ে কোমরে হাত দিয়ে দাঁড়িয়ে দেখছে, এমন সময় আমার সঙ্গে চোখাচোখি হতেই বোধহয় একটু বিব্রত বোধ করছিল। আমি মুখে হাসি নিয়েই বললাম,  “পাখিটি বন্য জগতের প্রাণী, ওর শিকার করলে আর ওরা এদিকে আসবে না। যদি ওদের যত্ন নেন, তাহলে ওরা আরও বেশি সংখ্যায় আসবে, দেখতেও ভালো লাগবে।” এই কথা শোনার পর ও চলে গেল। তারপর বেশ কিছুদিন ডাহুককেও দেখতে পেলাম না, আর না ওই ব্যক্তিকে। প্রায় ২০-২২ দিন পর আবার ডাহুকের দেখা পেলাম। একই জায়গায় খেতে এসেছে। তারপর থেকে এখন পর্যন্ত কাউকেই আর ওদের বিরক্ত করতে দেখিনি।

bonerdiry8101

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s