বনের ডায়েরি-পাখি দেখা -বাঁশপাতি-অলোক গাঙ্গুলী-বর্ষা ২০২১

আগের পর্ব ধনেশ, মাছরাঙা, মুনিয়া, কাজল পাখি , দোয়েল-কোকিল-ময়না বুলবুল, বকপাখি, মোনাল দেখার গল্প, পাঁচ বউয়ের কাহিনি, ঘুঘুর বাসা, টুনটুনি

পাখি দেখা – ১৩

bonerdiaryalok (3)

আকাশে উড়ন্ত পাখিদের নৃত্য কেউ কখনো লক্ষ করেছে কি? আমি করেছি, আর তাই সেই নৃত্যের বর্ণনা দিতেই আবার হাজির হয়েছি জয়ঢাকের পাতায়। আমরা আকাশে উড়ন্ত চিল অথবা বাজ দেখেছি কেমন করে তারা ঘুরতে ঘুরতে ওপর থেকে শিকারের দিকে লক্ষ্য রেখে হঠাৎ ছোঁ মেরে মাটি থেকে তাদের পায়ের থাবায় শিকার তুলে নিয়ে যায়। ডিসকভারি চ্যানেলে প্রায়ই এরকম দৃশ্য দেখা যায়। আমরা দেখেছি আকাশে বুনো হাঁসের বলাকা, এক ছন্দে ডানা মেলে, তালে তাল মিলিয়ে তারা উড়তে উড়তে তাদের ঠিকানায় পৌঁছে যায়। মাটির ওপরে নৃত্য করতে দেখেছি আমরা অনেকেই ময়ূরকে পাখনা মেলে। বর্ষাকাল ওদের প্রজননের সময়। তাই ঠিক তখনই ময়ূরকে দেখা যায় পাখনা তুলে নৃত্য করতে তার স্ত্রী সাথীকে আকর্ষণ করার জন্য। ঠিক এরকমই আরো এক পাখির নাম চাক দোয়েল (White Browed Fantail), আমাদের এখানকার সাধারণ দোয়েলের আকারের, ঠিক ময়ূরের মতো পাখনা তুলে তার স্ত্রী সঙ্গীকে আকর্ষণ করার জন্য নৃত্য করে। কিন্তু কখনো কেউ বাঁশপাতিকে নৃত্য করতে দেখেছি কি উড়ন্ত অবস্থায়? সেইভাবে বোধ হয় নয়। শিকার ধরার জন্যে আকাশে উড়ে একসঙ্গে ব্যালে করা এক বিরল দৃশ্য। তবে এই নৃত্য কীরকমের তা বলার আগে একটু জেনে নিই এই বাঁশপাতি পাখিটা ঠিক কী ধরনের।

আমাদের গাঙ্গেয় পশ্চিমবঙ্গে বাঁশপাতি অনেক দেখা যায়। ইংরেজিতে বলা হয় ‘গ্রিন বি ইটার’ (Green Bee Eater)। বি অর্থাৎ মৌমাছি, ভিমরুল, বোলতা খেয়ে নেয় এরা। এছাড়া অন্যসব কীটপতঙ্গ এদের খাদ্যের মধ্যেও পড়ে। শহর, গ্রাম সর্বত্রই এদের দেখা যায়। ভারি অদ্ভুতরকম দেখতে এই পাখি। এমনিতে সবুজ রঙের পাখি, গাছের ডালে বসে থাকলে সহজে চোখে পড়ে না। মাথা ও ঘাড়ের কাছে একটু মরচে রঙের ছোপ, ঠোঁট কালো ও সামান্য বাঁকা; চোখ ও গলায় কালো টানা দাগ রয়েছে। গলার নীচে সবজে নীল ছোপ। যেটা অদ্ভুত লাগে এই পাখির ক্ষেত্রে তা হল লেজের মধ্যেখান দিয়ে সরু কাঠির মতো পালক বেরিয়ে থাকে যা অন্য কোনো পাখির বেলায় নজরে পড়ে না। উড়তে উড়তে খুব নীচু স্বরে ট্রি-ট্রি করে ডাকে। ঢালু জমিতে এরা সুড়ঙ্গের মতো গর্ত করে বাসা বানায় আর গরমে সেই বাসায় পাঁচ-ছ’টি করে ডিম পাড়ে।

bonerdiaryalok (4)

এছাড়াও আরো বেশ কয়েকরকমের বাঁশপাতি দেখা যায় আমাদের দেশে। সবগুলোর অবশ্য বাংলা নাম আমার জানা নেই। এর মধ্যে উত্তরাখণ্ডের রুদ্রপ্রয়াগে আমি দেখতে পেয়েছিলাম লাল মাথা বাঁশপাতি (Chestnut Headed Bee Eater), ‘চেস্টনাট হেডেড বি ইটার’। মিশ্র পর্ণমোচী জঙ্গলে আর জলের ধারেই এই পাখিদের বেশি দেখা যায়। তাই বোধ হয় রুদ্রপ্রয়াগের ভাগীরথী ও অলকানন্দের সঙ্গমস্থলে ওপরেই এক গাছের ডালে একে বসে থাকতে দেখেছিলাম। মাথা থেকে পিঠের মাঝামাঝি পর্য্যন্ত গাঢ় বাদামি রঙ আর তার নীচে থেকে সবুজ। কালো বাঁকানো ঠোঁট ও চোখের কাছে কালো টানা দাগ। গলার দিকে ফিকে হলুদ রঙ ও গলার ওপর একটা কালো রিঙমতো দেখা যায়। সাধারণ বাঁশপাতির মতো এদের লেজের মাঝখান দিয়ে সরু পালক নেই। এরাও কীটপতঙ্গ খায়। এরা সাধারণত গাছের ডালে দল বেঁধে বসে থাকে, কিন্তু আশ্চর্যের ব্যাপার হল আমি গাছের ডালে একটাকেই দেখতে পেয়েছিলাম আর আমি বেশ অনেকক্ষণ ওখানে দাঁড়িয়েও ছিলাম কিন্তু আর কোনো লাল মাথা বাঁশপাতি দেখা যায়নি। এরাও সাধারণ বাঁশপাতির মতো ডাকে, তবে একটু জোরালো। নদীর ধারে বালির মধ্যে লম্বা সুড়ঙ্গের মতো করে বাসা বানায়। লাল মাথা বাঁশপাতিদের হিমালয় অঞ্চলেই বেশি দেখতে পাওয়া যায়।

এছাড়াও যেসব ধরনের বাঁশপাতি আমাদের দেশে দেখা যায় তার ইংরেজি নামগুলো জানিয়ে রাখি – ব্লু বিয়ারডেড বি ইটার (Blue Bearded Bee Eater), মূলত হিমালয়ের পাদদেশে দেখা মেলে; ব্লু চিকড বি ইটার (Blue Cheeked Bee Eater), উত্তর-পশ্চিম ভারতে বেশি দেখা যায়; ব্লু টেইলড বি ইটার (Blue Taile Bee Eater), উপমহাদেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমে প্রজনন স্থান, গ্রীষ্মকালে উত্তর ও মধ্য ভারতে দেখা যায় এবং শীতকালে দক্ষিণ ভারত ও শ্রীলঙ্কায় দেখা মেলে। সাধারণ বাঁশপাতির মতো ব্লু চিকড বি ইটার ও ব্লু টেইলড বি ইটারদেরও লেজের দিকে সূচের মতো পাখনা দেখা যায়।

অনেক হল বাঁশপাতির ব্যাখ্যা, এবার মূল কথায় ফিরে আসি। আমার বাড়ির ঠিক পেছনেই রয়েছে একটা বড়ো বেলগাছ আর আমাদের জানালার ঠিক সামনেই একটা কদম ফুলের গাছ। এই দুই গাছেই অনেক প্রকারের পাখির দেখা মেলে। কদমগাছের পেছনে রয়েছে একটি সরকারি ভবন। সেই ভবন থেকে কদমগাছ ঘেঁষে আমাদের বাড়ির প্রাঙ্গণ হয়ে বেরিয়ে গেছে মোটা একটি ক্যাবলের তার। এই তারের ওপরেও আমি দেখিছি ময়না, মুনিয়া ও বাঁশপাতিদের বসে থাকতে। এক বিকেলে আমি ছাদে রয়েছি আর দেখি ওই তারে বসে রয়েছে অন্তত ছয়টি বাঁশপাতি। সবক’টির লেজের ডগার দিকে সূচের মতো পাখনা বেরিয়ে আছে। তাই অনেকেই এই পাখিকে সুঁইচোরা পাখিও বলে থাকে। বিকেলে দিক থেকে বাতাসে পোকা উড়তে দেখা যায়। আর বাঁশপাতিরা ওত পেতে বসে থাকে পোকা শিকার করার জন্য। এরা যে জায়গায় বসে থাকে, সেখান থেকে উড়ে, একটু ঘুরপাক খেয়ে আবার সেই জায়গায় গিয়ে বসে। আমি দেখলাম, একবার সবক’টা পাখি মিলে একসঙ্গে উড়ল আর বাতাসে নানারকম ডিগবাজি খেয়ে আবার ফিরে এসে তারে বসে পড়ল। এরকম বেশ কয়েকবার হল। ভারি অদ্ভুত ঠেকল ব্যাপারটা। ঠিক যেন সঙ্গীতের তালে তালে এক ছন্দে ওরা উড়ে চলেছে। আর আশ্চর্যের ব্যাপার হল প্রত্যেকবার ওদের সবার ঠোঁটে একটা করে পোকা ধরা রয়েছে। আমি আজ পর্যন্ত এরকম সুন্দর পাখিদের উড়ন্ত অবস্থায় নৃত্য করতে দেখিনি। আমার মনে হচ্ছিল ওরা হাওয়ায় তাল মিলিয়ে ‘ব্যালে’ (Ballet) প্রদর্শন করে চলেছে। পাখিদের এরকম কলাকৌশল আমি সত্যিই আগে কখনোই দেখিনি। আমার মতো আর কেউ এই নৃত্য প্রদর্শনী লক্ষ করেছে কি না আমার জানা নেই বা কেউ এই নিয়ে কখনো কিছু লিখেছে কি না তাও জানা নেই। কিন্তু এই নৃত্যকলা দেখার পর আমার মনে হয়েছে এটা অবশ্যই সবাইকে জানানোর মতোই।

bonerdiaryalok (2)

এটা ঠিক যে জীবনে বিরল ঘটনা খুব কম, একবারের বেশি দেখা যায় না। যেমন এমন একটা প্রাকৃতিক ঘটনার কথা বলি যা আমি পরপর দু-বছর ধরে সাক্ষী হয়েছিলাম। সেটা ছিল দুটি দাঁড়াশ সাপের শঙ্খ লাগার দৃশ্য। সেই দৃশ্য আর কোনোদিনও দেখিনি। ঠিক একইরকম, বাঁশপাতির ব্যালে দেখেছিলাম পাঁচ বছর হয়ে গেল। তারপরেও বাঁশপাতি এসেছে, হয় একা অথবা দুটো, কিন্তু তাদের শিকার ধরার খেলা আর দেখা যায়নি। হয়তো তারা অন্য কোনো স্থান বেছে নিয়েছে আর যদি কেউ সেটা লক্ষ করে থাকে, সেই ব্যক্তি ভাগ্যবান। আমি যখন বাঁশপাতির ব্যালে দেখেছিলাম সেটা ছিল বর্ষাকাল। আমার মনে হয়েছে বাঁশপাতিরা শীতকালে বাসা বানায়, গ্রীষ্মে তারা ডিম পাড়ে আর বর্ষা ঋতুর মধ্যে সেই বাচ্চারাও উড়তে শিখে যায়। আর বর্ষার সন্ধ্যায় পোকা ওড়ে বেশি তাই তাদেরও সমাগম হয়। এবার বর্ষায় আবার অপেক্ষায় থাকব বাঁশপাতিদের পরিবারের আগমনের জন্য।

bonerdiaryalok (1)

এই গল্প লেখার সময় আমরা সকলেই গৃহবন্দি করোনা ভাইরাসের প্রকোপে। পৃথিবী জুড়ে এই মারণরোগ, সবদেশের মানুষেরাই প্রার্থনায় মগ্ন ঈশ্বরের দরবারে। তার মধ্যে একটা আশার আলো যে সংক্রমণ জীবজন্তুদের প্রভাবিত করবে না। আমি নিশ্চিত যে এই লেখা যখন পাঠকদের কাছে পৌঁছাবে তখন আমরা এই ভাইরাসকে হারিয়ে আবার প্রগতির পথে চলতে শুরু করে দিয়েছি। কিন্তু এর সঙ্গে এটাও ঠিক যে এই মারণরোগ আমাদের অনেক কিছু শিক্ষা দিয়ে গেল। আমাদের পরিবেশের প্রতি জাগ্রত হওয়া, পশুপাখিদের প্রতি আমাদের আরো বেশি করে মনোযোগী হওয়া, অযথা তাদেরকে শখের জন্য শিকার না করা ইত্যাদি।

বাঁশপাতি দেখার সুযোগ অনেক আসবে, কিন্তু এক ঝাঁক বাঁশপাতি এসে নৃত্য দেখাবে আকাশে এই সু্যোগ প্রতিদিন বা প্রতিবছরেও না আসতে পারে। তাই বর্ষার সন্ধ্যায় একটু সজাগ থেকে ওদের আগমনের অপেক্ষায় থাকলে সারাজীবনের এক অপূর্ব স্মৃতি থেকে যাবে। আর যদি ক্যামেরাটা হাতের নাগালে থাকে, তাহলে তো কেল্লাফতে!

ছবি- লেখক

হেডপিসের উড়ন্ত বাঁশপাতি ছবি সৌজন্য গুগল

বনের ডায়েরি সব লেখা একত্রে

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s