ধারাবাহিক উপন্যাস-সিন্ধু নদীর তীরে -পর্ব ৯- পিটার বিশ্বাস-বসন্ত ২০২৩

সিন্ধুনদীর তীরে –প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্বচতুর্থ পর্বপঞ্চম পর্বষষ্ঠ পর্ব , সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব

IMG-20210913-WA0004

নবম পর্ব

।৩।

যুদ্ধোদ্যম

মন্দিরদুর্গের তৃতীয় তলের সভাগৃহটির রূপ এই মুহূর্তে খানিক পরিবর্তিত হয়েছে। তার কেন্দ্রস্থলে পোড়া ইটের একটি দশ হস্ত পরিমিত বেদিকা। বেদিকার ওপরে ইন্দাতীরের বালুকারাশি ছড়িয়ে দেয়া হয়েছে পুরু করে। তার বুকে একটি নগরীর চিত্র আঁকা হয়েছে। দীর্ঘ একটি কাষ্ঠনির্মিত শলাকা হাতে নিয়ে তার পাশে দাঁড়িয়ে নিবিষ্টচিত্তে সেদিকে দেখছিলেন ঐশিক। ঐশিক যেন তাঁর পিতা মার্জকেরই একটি তরুণতর প্রতিচ্ছবি।যোদ্ধাজনোচিত দৃঢ়তা কিংবা পুরোহিতজনোচিত গাম্ভীর্য- এর কোনোটিই তাঁর চেহারায় নেই। তবে তাঁর চোখদুটি দৃষ্টি আকর্ষণকারী। উজ্জ্বল ও গভীর দৃষ্টি মেলে ছবিটির দিকে তাকিয়ে রয়েছেন তিনি এই মুহূর্তে।

সেদিকে তাকিয়ে আহীনের মনে একটা তীব্র বিতৃষ্ণা উপস্থিত হচ্ছিল। মার্জককে হত্যা করেও তাঁর কাছে একরকম পরাজয়ই স্বীকার করতে হয়েছে তাঁকে। এই ঐশিক সেই পরাজয়েরই স্মারক যেন। আসলে, মার্জকের হত্যাকাণ্ডের পর বণিকসম্প্রদায়কে দমনের জন্য প্রতিটি নগরীতে প্রয়োজনীয় সন্দেশ পাঠাবার জন্য দোরাদাবুর অনুমতি প্রার্থনা করে ব্যর্থ হয়েছিলেন আহীন। সে অনুমতি দোরাদাবু তো দেনই নি, তার পরিবর্তে ঈশ্বরের আদেশে, আহীনের মৃত্যুর জন্য নিজের অনিয়ন্ত্রিত ক্রোধকে দায়ী করে একটি ঘোষণাপত্র দিতে হয়েছিল আহীনকে। সেখানে মার্জকের বিরুদ্ধে কেবলমাত্র একটি অভিযোগই রাখা হয়- তিনি ঈশ্বরের বিরুদ্ধে অসতর্ক মুহূর্তে একটি অধার্মিক উক্তি করেছিলেন। এবং তাতে নিজের ওপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে আহীন এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছেন, এই ছিল সেই ঘঢণাপত্রে আহীনের স্বীকারোক্তি।

ঘোষণাপত্রে তাঁকে আরও লিখতে হয়েছিল, দোরাদাবু তাঁর সন্তানদের প্রতি ক্ষমাশীল। মার্জকের ধর্মবিরোধী আচরণ নিন্দনীয় হলেও, এই হত্যাকাণ্ড দোরাদাবুর ইচ্ছায় ঘটেনি। এ একান্তই তাঁর নিজের দায়। এবং অনিচ্ছাকৃত এই অপরাধটির জন্য আহীন দোরাদাবুর দেয়া শাস্তি মাথা পেতে গ্রহণ করতে প্রস্তুত।

এরপর, পুরোহিত জীবনে এই প্রথম নতমস্তকে দোরাদাবুর সামনে গিয়ে দাঁড়নো, ও দূরে অপেক্ষমান বণিক ও মন্দিরসেনাদের সম্মুখে তাঁর মৃদু মানসিক কশাঘাতের শাস্তি সহ্য করতে হয়েছে তাঁকে। আর তারপর, মার্জকের পুরোহিত পদ তাঁর পুত্র ঐশিককে সসম্মানে সমর্পণ করতে হয়েছে আহীনকে।

অবশ্য ব্যক্তিগতভাবে অপমানিত হলেও, আহীনের শাণিত মস্তিষ্ক এই পদক্ষেপের প্রয়োজনীয়তাকে অস্বীকার করতে পারেনি। মার্জকের হত্যায় বণিকসমাজের মধ্যে উদ্ভুত ক্ষোভ এর ফলে যেমন প্রশমিত হয়েছে, তারই পাশাপাশি দোরাদাবুর- এবং ফলত ঈশ্বরের প্রতিভূ হিসাবে আহীনের- আদেশের সরাসরি বিরুদ্ধাচরণের সাহসও উপস্থিত অন্তর্হিত হয়েছে এদের।

তবে, ঐশিককে মার্জকের স্থানে গ্রহণ করা কেবলই একটি রাজনৈতিক পাশার চাল ছিল না। যোগ্যতার দিক দিয়েও তিনি এই পদের জন্য সর্বাধিক উপযুক্ত। কারণ, পিতার সঙ্গে বাণিজ্যযাত্রায় বহুবার তিনি ম্‌হিরি নগরীতে গিয়েছেন এবং সে- নগরীর অন্দর ও বাহির বিষয়ে তাঁর পুঙ্খাণুপুঙ্খ জ্ঞান ঈর্ষণীয়। অতএব ম্‌হিরি নগরীর বিষয়ে এই সভায় অনেকেই সবিশেষ অবহিত থাকলেও, এ-বিষয়ে ঐশিকের জ্ঞান বাকি সকলের চেয়ে অনেকটাই বেশি। অতএব মার্জকের শূন্যস্থানটির জন্য তিনি সর্বাধিক উপযুক্তও ছিলেন।

হাতের শলাকাটি এইবার ঐশিক ফের একবার বালুকারাশির বুকে আঁকা ছবিটির দিকে এগিয়ে ধরলেন, “আপনারা দেখতে পাচ্ছেন, এর বামে ও দক্ষিণে যথাক্রমে মার্জাগ ও বুলানির খরস্রোতা জলধারা, পেছনদিকে আকাশচুম্বী বুলানি গিরিসঙ্কট। এই তিনদিক দিয়ে ম্‌হিরির ওপরে আক্রমণ হানা অসম্ভব।”

আহীন বিরক্তভাবে মাথা নাড়লেন, “ওহে বণিকপুত্র, তুমি যা জানো, কেবল সেইটুকুই বলো। রণকৌশলের সম্ভাব্যতা-অসম্ভাব্যতা নিয়ে তোমার অপটু পাণ্ডিত্যে আমাদের কাজ নেই। চতুর্দিকে প্রকৃতির দ্বারা সুরক্ষিত কট্টাদিজা নগরীকেও তো আমরা…”

ঐশিক স্থির দৃষ্টিতে ঘুরে দেখলেন আহীনের দিকে। তারপর উদ্গত হাসিটিকে রোধ করে বিনম্র কণ্ঠে বললেন, “যতটুকু আমার জ্ঞান, তা থেকে বলতে পারি, সেই সময় দুটি অতিরিক্ত সুবিধা ছিল মহান দোরাদাবুর সেবকদের। প্রথমত, কট্টাদিজার চতুষ্পার্শে যে প্রাকৃতিক বাধাগুলি ছিল, সেই স্থানগুলি থেকে ওই গ্রাম যোদ্ধাদের ধনুঃশরের নাগালের মধ্যে ছিল। তাতেই সাফল্য এসেছিল আমাদের। অগ্নিমুখী শরক্ষেপণ করে গ্রামটিকে ভষ্মীভূত করতে কোনো সমস্যা হয়নি। এবং, তাতে যদি ব্যর্থও হতাম আমরা, সেক্ষেত্রে মহান ঈশ্বর দোরাদাবু ইচ্ছা করলে পলকেই সেই বন্য অর্ধমনুষ্যদের নাশ করে গ্রামটিকে পদানত করতে সক্ষম হতেন।

“এক্ষেত্রে কিন্তু সেই সুবিধাদুটির একটিও আমাদের কাছে নেই মহান আহীন। গিরিসঙ্কট এবং নদীগুলির প্রতিটির থেকেই এদের নগরী দুই থেকে তিনশত হস্ত দূরে। কোনো যোদ্ধার পক্ষেই সেই দূরত্বে শরক্ষেপণ সম্ভব নয়। দ্বিতীয়ত, পৈরাক নগরীর ঘটোনাটি হতে আমরা সকলেই অবহিত আছি যে এই দানবনগরীর অভ্যন্তরে কোনো নতুন গোপন অস্ত্র বা জাদুর উদ্ভবের ফলে মহান ঈশ্বরের এই নগরে প্রবেশের পথে কঠিন বাধা নির্মাণে সক্ষম হয়েছে এই দানবকুল। ফলত কট্টাদিজার মত এক্ষেত্রে সম্মুখযুদ্ধ ততটা ফলবতী হবে না বলেই আমার বিশ্বাস।”

“সেক্ষেত্রে…”

“নগরীর সম্মুখভাগে বিস্তীর্ণ অর্ধমরু অঞ্চল দিয়ে সেখানে পৌঁছোবার একমাত্র পথ।” বলতে বলতে হাতের শলাকাটি নিয়ে চিত্রের সামনের দিকে তাকে স্থাপন করলেন ঐশিক, “তবে আমি মহান দোরাদাবুর কৃপাধন্য সামান্য ব্যবসায়ীমাত্র। অতএব কীভাবে একে ব্যবহার করে সফল যুদ্ধোদ্যম সম্ভব তা আপনার বিচার্য বিষয় মহান আহীন। তবে এ-প্রসঙ্গে এ-ও জানাই, নগরীর প্রধান দ্বারের সামনের এই বিস্তীর্ণ অর্ধমরু অঞ্চলে ওই দানবরা তাদের অনুপম প্রযুক্তির সহায়তায় বালুকারাশির নীচে সুড়ঙ্গ খুঁড়ে বহুতর সৈন্যাবাস গড়েছে। এরা মুহূর্তে বালুকারাশি ভেদ করে উঠে এসে আক্রমণ শানিয়ে ফের অদৃশ্য হবার কৌশলে দক্ষ। আমাদের বাণিজ্যপথের দুপাশে ঐ বালুকারাশিতে ছড়িয়ে থাকা বহু মরুদস্যুর কঙ্কাল তার সত্যতা প্রমাণ করে।”

বলতে বলতে হাতের শলাকাটি নামিয়ে রেখে একপাশে সরে দাঁড়ালেন ঐশিক। মনের মধ্যে গভীর একটা ক্ষোভ কাজ করছিল তাঁর। মৃত্যুর আগের দিন রাতে বিষয়টা নিয়ে তাঁর সঙ্গে দীর্ঘ আলোচনা করেছিলেন মার্জক। সমস্ত দিক বিবেচনা করেই রণোদ্যমের ব্যর্থতার বিষয়ে নিশ্চিত হয়েছিলেন তিনি। সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন ম্‌হিরির সঙ্গে মঞ্জাদাহিরের শত্রুতা শেষ করবার জন্য বিকল্প একটি প্রস্তাব পেশ করবেন।

বড়ো আশা নিয়ে মহাপুরোহিতের সভায় গিয়েছিলেন তিনি পরদিন। ঐশিকও অনেক আশা নিয়ে সভার ফলাফলের অপেক্ষায় ছিলেন। কিন্তু, সেই সদুপদেশ দেবার পুরস্কার হিসেবে মার্জকের ভাগ্যে মৃত্যু জুটল। আহীন ক্ষমাপ্রার্থনা করেছেন। কিন্তু সেই ক্ষমাপ্রার্থনার পেছনের কূটনীতিটি ঐশিকের ক্ষুরধার বুদ্ধিকে এড়িয়ে যেতে পারেনি। এইবার, ওই পুরোহিতপ্রধানের সামনে রণোদ্যমের মূর্খতার দিকটি এভাবে তুলে ধরতে পেরে বড়ো তৃপ্তি অনুভব করছিলেন তিনি। না। মার্জকের মত ভুল তিনি করেননি।  দোরাদাবুর ইচ্ছার বিরুদ্ধে বাণিজ্য-রাজনীতির মাধ্যমে ম্‌হিরি জয়ের প্রস্তাব তিনি উহ্য রেখেছেন। কিন্তু তিনি জানেন, রণোদ্যত ম্‌হিরির বিরুদ্দে ইন্দাতীরের নিরাপত্তা বজায় রাখবার জন্য এবারে সে পথ নেয়া ছাড়া কোনো বাস্তব বিকল্প আহীনের সামনে নেই। এবারে তাকে নতমস্তকে মার্জকের প্রস্তাব মেনে নিতে হবেই।

সুকৌশলে, বিন্দুমাত্র ক্রোধ বা প্রতিশোধস্পৃহার অনুভূতি মনে জাগতে না দিয়েই শান্তভাবে চিন্তাগুলো করে চলেছিলেন ঐশিক। এজন্য গত কয়েকদিন রীতিমত মানসিক প্রস্তুতি নিয়েছেন তিনি। কারণ, তিনি জানেন, দোরাদাবুর দাস আহীন নয়, এ-বিষয়ে আসল সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষমতা কেবল ঈশ্বর দোরাদাবুর আছে। এবং তিনি তাঁর সেবকদের চিন্তাস্রোতকে পড়তে পারেন। অতএব তার সেই চিন্তাগুলোর আসল লক্ষ ছিল স্বয়ং ঈশ্বর দোরাদাবু।

উদ্দেশ্য ব্যর্থ হয়নি তাঁর। কারণ দোরাদাবুর একটি সুক্ষ্ম ইঙ্গিত ইতিমধ্যেই আহীনের মস্তিষ্কে ঐশিকের কথার যাথার্থ্যটির বিষয়ে একটি নতুন চিন্তাস্রোতের সূচনা করিয়েছিল। একটুখণ চুপ করে থেকে তিনি বললেন, “এক্ষেত্রে তবে রণকৌশল বিষয়ে তোমার কোনো প্রস্তাব…”

এই মুহূর্তটির জন্যই পিতার মৃত্যুর পর থেকে প্রস্তুতি নিয়েছেন ঐশিক। না। তিনি পিতার মত প্রাচীনপন্থী নন। বাণিজ্যকে কেবল শান্তি নয়, বরং প্রয়োজনে শাণিত যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে ব্যবহার করবার বিষয়ে তাঁর নিজস্ব চিন্তাভাবনা কিছু রয়েছে।

একটু ভেবে নিয়ে তিনি মুখ খুললেন, “আমার প্রস্তাব, প্রথমে যুদ্ধ নয়, শান্তির ছদ্মবেশে বণিকদের সেখানে অবাধ প্রবেশের জন্য কিছু পদক্ষেপ নেয়া হোক মহাপুরোহিত। এর প্রধান উদ্দেশ্য হবে দ্বিমুখী। ম্‌হিরির সমৃদ্ধির প্রধান উৎস তার বহির্বাণিজ্য।  ইন্দাতীরের অর্থবল এই পথে প্রথমে তার প্রধান বাণিজ্যগুলির নিয়ন্ত্রণ দখলে আনবার প্রচেষ্টা করবে। পাশাপাশি, তাদের যে নবতম অজ্ঞাত অস্ত্রটি নিয়ে আমরা আশঙ্কিত তার বিষয়েও প্রয়োজনীয় তথ্য সংগ্রহ…”

“কিন্তু সে অতি দীর্ঘ সময়ের ব্যাপার যুবক,” আহীন যেন দোরাদাবুর চিন্তারই প্রতিধ্বনি করলেন, “তাছাড়া এই পদ্ধতিতে সাফল্যের নিশ্চয়তাও নেই।”

জয় প্রায় হাতের মুঠোয় এনে এইবার ঐশিক বিনয়বনত হলেন। মাথা নীচু করে বললেন, আমরা সামান্য বণিক। কতটুকুই বা আমাদের জ্ঞান! নিজের সাধ্যমত যেটুকু কৌশল ভাবতে পেরেছি তাই নিবেদন করলাম মহান দোরাদাবুর চরণে। এবার সিদ্ধান্ত নেবার ভার আপনার সুযোগ্য হাতে হে মহাপুরোহিত আহীন।”

ধীশক্তির এই ধীরগামী অথচ শক্তিমান প্রতিদ্বন্দ্বিতা হয়তো আরো দীর্ঘক্ষণ চলত, কিন্তু হঠাৎ তাতে বাধা এল। সভাকক্ষের প্রবেশপথে দুজন সৈনিক এসে দাঁড়িয়েছে তখন। তাদের মাঝখানে এক ছিন্নবস্ত্র তরুণ একটি কাপড়ের পুঁটুলি হাতে এসে দাঁড়িয়েছে। তার দিকে থেকে গলিত মাংসের পূতিগন্ধ এসে ভরিয়ে তুলছিল সভাকক্ষকে।

কৌতূহলী দৃষ্টিতে সেদিকে ঘুরে তাকালেন আহীন। এবং সঙ্গে সঙ্গেই তরুণটি তার বস্ত্রের ভেতর থেকে আহীনের একটি স্মারকচিহ্ন বের করে এনে তুলে ধরল উঁচু করে। তারপর ক্লান্ত গলায় বলল, “বৈক্লন্যপুত্র মাণ্ডুপ মহাপুরোহিত আহীনের আদেশে মঞ্জাদাহিরের সেবায় প্রস্তুত।”

একনজর তার দিকে ঘুরে তাকালেন আহীন। বৈক্লন্যের এই পালিত পুত্রের জন্মের ইতিহাস এ নিজে না জানলেও তিনি জানেন। এর ধমনীতে যোদ্ধার নয়, এক বানিয়া ও এক অর্ধমনুষ্য বন্যনারীর রক্ত বইছে। বৈক্লনের প্রতি স্নেহবশত তিনি একে ডেকে পাঠিয়েছিলেন মঞ্জাদাহিরে। কোনো সাধারণ পেশায় একে নিযুক্ত করে দেবেন এই তাঁর মনোগত ইচ্ছা ছিল। এই গুরুত্বপূর্ণ সভার মাঝখানে তার দিকে মনোযোগ দেবার অবসর তাঁর নেই।

ঈষৎ বিরক্তমুখে সেদিকে তাকিয়ে তিনি তার সঙ্গী সৈনিকটিকে বললেন, “একে নিয়ে যাও। প্রথম তলের কোনো অতিথিগৃহে থাকবার বন্দোবস্ত করো। সময় হলে আমি একে ডেকে নেব।”

কথাটা বলে তিনি মুখ ঘুরিয়ে নিচ্ছিলেন, কিন্তু সেটা আর করা হল না তাঁর। তার আগেই সৈনিকের হাত ছাড়িয়ে ছেলেটা দৃঢ়পায়ে এগিয়ে এসে সভার মাঝখানে দাঁড়িয়েছে। তারপর কাপড়ের পুঁটুলিটা খুলে সেটাকে উপুড় করে দিয়েছে মেঝের ওপরে।

গলিত, দুর্গন্ধময় নরমুণ্ডটা দিকে চোখ ফেলে একটা গুঞ্জনধ্বনি উঠল গোটা সভাঘরেই। সেদিকে ইশারা করে মাণ্ডুপ তখন ক্রুদ্ধ গলায় বলে চলেছে, “মহান দোরাদাবুর সাম্রাজ্যের গভীরে ঢুকে এসে এহেন হত্যাকাণ্ড চালাবার দুঃসাহস অর্জন করেছে ম্‌হিরির দানব সেনারা। তাঁর ঐশ্বরিক শক্তিকে সরাসরি তাচ্ছিল্য করে অরাজকতার সূচনা করছে ইন্দাতীরে। আমি তার প্রমাণ নিয়ে এসেছি। আমি এর বিচার চাইতে এসেছি মহাপুরোহিত।”

স্তম্ভিত হয়ে কিশোরটির মুখের দিকে তাকিয়েছিলেন ঐশিক। নরমুণ্ডটার দিকে চোখ রেখে যে ক্রুদ্ধ গর্জন উঠেছে গোটা সভাঘর থেকে, তার রক্তলোলুপ সুরে ম্‌হিরিকে নিয়ে নিজের ও তাঁর স্বর্গত পিতার পরিকল্পনাটির এক অপ্রত্যাশিত মৃত্যু দেখতে পাচ্ছিলেন তিনি।

খানিক বাদে চিন্তাভাবনাগুলোকে গুছিয়ে নিয়ে ফের যখন কথা বললেন ঐশিক, তখন তাঁর গলায় পরিমিত ক্রোধ ও বিদ্বেষের স্পর্শ ছিল, “মহাপুরোহিত আহীন। এই ম্‌হিরির দানবদের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত প্রতিশোধ নেবার জন্য আমিও এই তরুণের মতই ব্যাকুল। কিন্তু, এই মুহূর্তে বণিকের ছদ্মবেশে এদের নগরীতে প্রবেশ করে তারপর ধীরে ধীরে সে প্রতিশোধের উপায় সন্ধানই একমাত্র পথ। কারণ, এদের অনতিবিলম্বে শাস্তি দেবার কামনা যতই উগ্র হোক আমাদের,  সরাসরি আমাদের যুদ্ধোদ্যমে এখানে ব্যর্থতার সম্ভাবনাই প্রবল। এদের নগরীতে সসৈন্যে প্রবেশ করা যে দুঃসাধ্য তা আপনি হৃদয়ঙ্গম করেছেন। আর মহান দোরাদাবুর অগণিত সেবকের রক্তের বিনিময়ে সেখানে প্রবেশ করতে পারলেও, অন্তত যতদিন না এদের ঐ অশুভ ঈশ্বরবিরোধী জাদু অস্ত্রের রহস্য ও তার প্রভাব বিকল করবার কৌশল আমরা উদ্ধার করতে পারছি ততদিন…”

“সসৈন্যে প্রবেশ করার একটি কৌশল আমি প্রস্তাব করতে পারি মহামান্য পুরোহিত,” ঐশিকের দিকে মুখ ঘুরিয়ে হঠাৎ করেই কিশোরটির ক্লান্ত কণ্ঠে উজ্জীবিত সুর লেগেছে। বিস্মিত হয়ে সেদিকে ফিরে তাকালেন আহীন। কিশোরটির আত্মবিশ্বাস তাঁকে একটু চমকিত করেছে। নরমুণ্ডটি এক স্বর্ণকেশ শ্বেতাঙ্গের। এরা পরিযায়ী যুদ্ধজীবি হয় সাধারণত। কিশোরের আচরণ থেকে বোঝা যায় এর সঙ্গে তার কোনো ঘনিষ্ট সম্পর্ক ছিল। যদি প্রতিশোধস্পৃহায় সে কোনো মিথ্যাচরণ করে  বা তাঁদের ভুল পথে পরিচালিত করবার কোনো পরামর্শ দেয়, সেটা অনুভব করে নিতে মহান দোরাদাবুর কোনো অসুবিধা হবে না। কিন্তু সত্যিই যদি এ কোনো গুরুত্বপূর্ণ তথ্য নিয়ে এসে থাকে সেক্ষেত্রে…

মাণ্ডুপের দিকে ঘুরে তাকালেন তিনি এবারে, “তোমার বক্তব্য তুমি বলতে পারো বালক। কিন্তু মনে রেখো কোনো মিথ্যাচরণ করলে…”

“আমি তার শাস্তি জানি মহাপুরোহিত!” মাণ্ডুপ তাঁর চোখে চোখ রেখে উত্তর দিল, “অবশ্য ম্‌হিরি নগরীত সসৈন্যে প্রবেশ করতে পুরোহিত ঐশিকের পদ্ধতিটিকেই কাজে লাগানো যাবে, কেবল সামান্য অন্যপথে। আমার প্রস্তাব…”

***

“কিন্তু ভেতরে প্রবেশ করা সম্ভব হলেও, এদের গোপন জাদু অস্ত্রটি…”

সূর্য অস্ত গিয়েছে অনেকক্ষণ। এই মুহূর্তে সভাগৃহে কেবল আহীন ও মাণ্ডুপ নামের সেই কিশোর মুখোমুখি বসে আছেন।

সামান্য ঈর্ষামিশ্রিত বিতৃষ্ণার দৃষ্টিতে বারংবার এই কিশোরটির দিকে দেখছিলেন আহীন। একেবারেই সাধারণ একটি কৌশল! অথচ তা শেষপর্যন্ত ওই বন্যনারীর গর্ভজাত বণিকপুত্রের কাছ থেকে গ্রহণ করতে হল তাঁর মত রণকুশলী পুরোহিতকে! নিয়তির এই পরিহাসকে কিছুতেই মেনে নিতে পারছিলেন না আহীন।

নগরীতে প্রবেশের কৌশলটি সে বলবার সঙ্গে সঙ্গে উপস্থিত প্রত্যেক পুরোহিতই সে পদ্ধতির কার্যকারিতা সম্পর্কে নিঃসন্দেহ হয়েছিলেন। এর জন্য কিছু কূটনৈতিক ও সামরিক প্রস্তুতি নিতে হবে। সেই দায়িত্ব নিয়ে অন্যান্য পুরোহিতদের অধিকাংশই সূর্যাস্তের পর রওয়ানা হয়ে গিয়েছেন। এ প্রস্তুতি নিতে হবে রাত্রির অন্ধকারের আড়ালে, যথাসম্ভব লোকচক্ষুর অন্তরালে, কারও কোনো সন্দেহ উদ্রেক না করে। কারণ ম্‌হিরির বহু চর যে এই মুহূর্তে মঞ্জাদাহিরে সক্রিয় আছে সে বিষয়ে আহীনের সন্দেহের কোনো অবকাশ নেই। যে বিপজ্জনক অথচ কার্যকর পথে আক্রমণ শানাবে মঞ্জাদাহির, তার সামান্যতম ইঙ্গিতও যদি ম্‌হিরিতে গিয়ে আগে থাকতে পৌঁছোয় তাহলে বিজয়ের স্বপ্ন মুহূর্তে ইন্দাতীরবাসীর হত্যাযজ্ঞে বদলে যাবে।

সভাগৃহের অন্যপ্রান্তে দুইজন পুরোহিত, সদ্য বানানো প্রশস্ত একটি মৃৎপট্টে সুতীক্ষ্ণ কীলকের সাহায্যে একটি লিপি রচনায় মগ্ন। সেটিও এই পরিকল্পনারই অঙ্গ, অতএব বাইরের কোনো লিপিশিল্পীকে সে কাজের জন্য আহ্বান করা হয়নি।

অন্যমনস্কভাবে সেই লিপি রচয়িতাদের দিকে তাকিয়ে কিছু ভাবছিল মাণ্ডুপ। আহীন এইবার অসহিষ্ণুভাবে তার কাঁধটি স্পর্শ করলেন, “আমার প্রশ্নের উত্তর দাও বালক।”

এইবার তাঁর দিকে ঘুরে তাকাল মাণ্ডুপ, “মৃত্যুর আগে দৈমিত্রি আমাকে যতটুকু জানিয়েছেন ওই অস্ত্রের বিষয়ে, তার থেকে আমি নিঃসন্দেহ যে, নগরীতে প্রবেশ করে এদের প্রধান শাসনকেন্দ্রে আপনার অধিকার প্রতিষ্ঠা হবার পরে আমি ঐ অস্ত্রকে নিষ্ক্রিয় করতে সমর্থ হব।”

“কী জানিয়েছিল সে তোমাকে, তা আমাকে খুলে বলো। কিছু গোপন কোরো না।”

“বলব মহাপুরোহিত। উর নগরীর কাছে ইফ্রাত নামে এক নদী আছে। তার উৎসের পর্বতমালা থেকে উরের বাসিন্দারা একধরণের ধাতু…”

এই অবধি বলেই হঠাৎ সচকিত হয়ে থমকে গেল মাণ্ডুপ। মহাপুরোহিত আহীন যেন বজ্রাহত হয়েছেন হঠাৎ। দুহাতে নিজের মাথাটি চেপে ধরে বারংবার স্খলিত গলায় তিনি বলে চলছেন, “আর একটি কথাও উচ্চারণ কোরো না তুমি… এ সংবাদ শোনবার অধিকার আমার নেই… তুমি ভিন্ন দ্বিতীয় কারো গোচরে এই সংবাদ পৌঁছোলে তার একমাত্র প্রাপ্য শাস্তি হল মৃত্যু… আ…আ…আহ…”

ভুলুণ্ঠিত হয়ে তীব্র যাতনায় ছটফট করতে থাকা মানুষটির দিকে নির্বাক হয়ে তাকিয়েছিল মাণ্ডুপ। সভাগৃহে উপস্থিত অন্য দুজন পুরোহিত এ দৃশ্য দেখে হঠাৎ ভূমিতে জানু পেতে বসে পড়েছেন। তারপর হাতগুলি ওপরে উঁচিয়ে অস্ফুট সুরে কোনো প্রার্থনা করে চলেছেন সভয়ে।

হঠাৎ কেন এমন হল তা বোঝবার কোনো উপায় ছিল না মাণ্ডুপের। সে ব্যাকুলভাবে কেবল বলে চলে, “আপনার আদেশ শিরোধার্য মহাপুরোহিত। এ সংবাদ আমি নিজের কাছে সঙ্গোপনে রাখব।”

…এই পরজীবিদের চিন্তাতরঙ্গ কঠিন বস্তুর বাধা মানে না। উজ্জ্বল আলোকশিখার মতই তা নিজের গর্ভগৃহে অবস্থানরত দোরাদাবুর ইন্দ্রিয়ে ধরা পড়ে। মানুষগুলির অনুভূতিগুলোকে পড়ে নিতে কোনো অসুবিধে হচ্ছিল না তাই তাঁর। আর তার ফলেই এই গ্রহে আসবার  পর এই প্রথম ভয়ের একটা সুক্ষ অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ছিল তাঁর চেতনায়। কথাটা ভাবতে গিয়ে দুশ্চিন্তার মধ্যেও একটু কৌতুকই অনুভব করলেন দোরাদাবু। ভয়! এই পরজীবিদের মস্তিষ্ককে প্রভাবিত করে এই ‘ভয়’ নামের অনুভূতিটার সুতীব্র প্রয়োগই তো তাঁর শক্তির চাবিকাঠি। আজ হঠাৎ করেই নিজের সেই অস্ত্রের কামড়ের স্বাদ নিজেই টের পাওয়া… নিয়তির পরিহাস?

ঐ কিশোরটির মনের মধ্যে থেকে ম্‌হিরির গোপন অস্ত্রটির আসল পরিচয় তিনি পেয়েছেন এইবারে। আর সেইটিই তাঁর আতঙ্কের উৎস। একটি প্রস্তরখণ্ড! তা থেকে হরিতাভ জ্যোতি বিচ্ছুরিত হয়! ম্‌হিরির জ্ঞানসাধক দানবরা সীসার পোশাক পরিধান করে তার কাছে যায়! এই মহাবিষের পরিচয় তাঁর অজ্ঞাত নয়।

আজ এই প্রথমবার তাঁর, এই গ্রহের বুকে আশ্রয়গ্রহণের সিদ্ধান্তকে সন্দেহ হচ্ছিল। হচ্ছিল কারণ, এখন তিনি বুঝতে পারছেন, কেন্দ্রীয় কৃষ্ণগহ্বর থেকে উঠে আসা প্রাণঘাতী বিকীরণে নক্ষত্রমণ্ডলের সমস্ত গ্রহজীবের যখন যৌথ মৃত্যু ঘটেছিল, এই গ্রহজীবটি তার বহু আগেই প্রাণ হারায়। প্রাণ হারায় গ্রহজীবের একমাত্র মারণ রোগের কবলে পড়ে। এক করাল কর্কটব্যাধি। এ ব্যাধিতে আক্রান্ত গ্রহজীবের শরীরে গড়ে ওঠে কিছু বিষাক্ত ধাতুর সঞ্চয়। ধাতব এই উপাদানগুলি থেকে তিনশ্রেণীর অদৃশ্য রশ্মি বিকীরিত হয়। বহুদূর থেকেও বিষাক্ত এই রশ্মির তেজষ্ক্রিয় জাল গ্রহজীবের কাছে এক অভেদ্য প্রাচীরের মতই কাজ করে। শুধু প্রাচীরই নয়। এর বিষাক্ত উপস্থিতির খুব কাছাকাছি এলে গ্রহজীবের মৃত্যু আসে ভয়াবহ যন্ত্রণা ও আত্মবিস্মৃতির মধ্যে দিয়ে।

একটিমাত্র ধাতু কেবল এর প্রভাবকে প্রতিরোধ করতে সক্ষম। ম্‌হিরির দানবরা সেই ধাতুর এই বৈশিষ্ট্যকে আবিষ্কার করেছে তবে! একে তারা ‘সীসা’ নামে ডাকে। অথবা… যেখান থেকে ঐ তেজষ্ক্রিয় প্রস্তরখণ্ড এসেছে সেই উর নগরীর বাসিন্দারাই কি এই জ্ঞান সরবরাহ করেছে তাদের?

এই জ্ঞান তাঁর পুরোহিতদের কাছে পৌঁছানো তাঁর পক্ষে বিপজ্জনক হয়ে উঠতে পারে। যুদ্ধবাজ ও রক্তলোলুপ এই পরজীবীরা তাঁকে যে সমীহ করে চলে তার প্রধান উৎস হল ভয়। অতএব স্বয়ং তিনি যাকে ভয় পান তার খবর এদের কাছে পৌঁছোনো শুভ হবে না।

ধীরে ধীরে একটা পরিকল্পনা গড়ে উঠছিল তাঁর মাথায়। ইফ্রাত নদীর অববাহিকা এবং উর নগরী। প্রথমে ম্‌হিরিকে পদানত করে এই কিশোরের মাধ্যমে ওই বিষাক্ত ধাতুখণ্ডটিকে নির্মূল করবার বন্দোবস্ত করা। তারপর এই কিশোরকে মৃত্যু আশীর্বাদ দিয়ে, তিনি নজর ফেলবেন ওই ইফ্রাত নদীকূলের দিকে। উর নগরীকে উৎখাত করে, তারপর সেই অঞ্চল থেকে মুছে দিতে হবে এই বিষাক্ত ধাতুর সমস্ত উৎসকে। মুছে দিতে হবে তাঁর বিশ্বস্ত ও অনুগত ইন্দাতীরের সেনাবাহিনীকে দিয়েই। ওরা জানবে না, দোরাদাবুর এ আদেশের উদ্দেশ্য কী? ওরা কেবল প্রাচীন অভ্যাসের বশে তাঁর নির্দেশ পালন করবে। সে কাজ সম্পূর্ণ করবার আগে স্বস্তি পাবেন না দোরাদাবু।

***

এবং প্রস্তুতি চলে পূর্ণোদ্যমে।

কিছুকাল আগে, ইন্দাতীরের নগরসমষ্টির প্রধান শাসক মহাপুরোহিত আহিনের বার্তাপট্ট নিয়ে ইন্দাতীরের বণিকদের একটি দল ম্‌হিরি নগরীতে গিয়েছিল। অত্যন্ত বিনীত ভাষায় লিখিত পত্রটিতে আহীন জানিয়েছেন, “ম্‌হিরির দানবনগরী যে ইন্দাতীরে অভিযানের পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে তা তিনি অবগত হয়েছেন। তবে, তাঁদের সঙ্গে অস্ত্রপরীক্ষায় অবতীর্ণ হবার কোনো ইচ্ছা তাঁর নেই। ইন্দাতীরের বণিকরা যে পথে উর, মুন্দিগ্র তেলমুন্দ ইত্যাদি নগররাষ্ট্রের সঙ্গে মঞ্জাদাহিরের সৌহার্দ্য স্থাপন করেছেন, এবারে সেই একই পথে মঞ্জাদাহির এইবার ম্‌হিরি নগরীর সঙ্গেও বন্ধুত্ব ও বাণিজ্যিক সম্পর্ক স্থাপনেই অধিক আগ্রহী। এবং সেই উপলক্ষ্যে ম্‌হিরি নগরীর সম্মতি থাকলে মঞ্জাদাহির তার বণিক সংগঠনের মাধ্যমে বিপুল ভোগ্যসামগ্রীর এক সার্থবাহ ম্‌হিরি নগরীতে পাঠাতে ইচ্ছুক। বিপরীতে, ম্‌হিরি নগরীও তার যাবতীয় পণ্য বিক্রয়ের জন্য ইন্দাতীরে স্বাগত। এখানকার প্রতিটি নগরীতে তাঁদের নিজস্ব ব্যবসায়কেন্দ্র গড়ে তোলবার অগ্রিম অনুমতি দেয়া হচ্ছে।”

বিষয়টি ম্‌হিরির শাসকদের কৌতূহলী করে তুলেছিল। হয়তো কিছুটা আত্মবিশ্বাসীও। কারণ, উর নগরী থেকে গোপনে এসে পৌঁছানো অপ্রত্যাশিত উপহার ওই তেজোময় প্রস্তরখণ্ডটিকে জ্যোতিগৃহে প্রতিষ্ঠিত করবার পর  ম্‌হিরি নগরীর উপকণ্ঠে দোরাদাবুর এক সন্তানগোলকের ব্যর্থ উড়ানের সংবাদ তাদের অজানা ছিল না। এর ফলে ওই প্রস্তরদেবতার বিপুল অলৌকিক শক্তির প্রতি তাদের ভরসা ও বিশ্বাসও বেড়ে ওঠে। স্বয়ং একজন গোলকদেবতার এহেন পরাজয়ের সংবাদটি যে মঞ্জাদাহির নগরীতে যথাসময়ে পৌঁছেছে, তাতেও তাদের কোনো সন্দেহ ছিল না। এহেন পরিস্থিতিতে সম্ভবত যোগ্য একজন প্রতিদ্বন্দ্বীর সংবাদ পেয়েই দোরাদাবু নিজেকে সংযত করেছেন ও মৈত্রির পথে এগোবার প্রচেষ্টায় রয়েছেন, এ-বিষয়ে তারা কিছুটা হলেও নিশ্চিত হয়।

তবে তাদের প্রাচীন শিকারভূমি ঐ ইন্দাতীরের অর্ধসভ্য মনুষ্যেতরদের সঙ্গে স্থায়ী মৈত্রী স্থাপনের কোনো ইচ্ছা ম্‌হিরির দানবজাতির ছিল না। তাদের বিরুদ্ধে যুদ্ধঘোষণার আগে ইন্দাতীরের নগরীগুলি ও তাদের অধিষ্ঠাতা গোলকদেবতাদের বিষয়ে তথ্যসংগ্রহের জন্য ইদানিং তারা, গুপ্তচরবৃত্তি ও সেখানকার কিছু কিছু গুরুত্বপূর্ণ বাসিন্দাকে অপহরণ করে এনে জিজ্ঞাসাবাদ ও পরীক্ষানিরীক্ষার ওপরেই নির্ভর করছিল। পদ্ধতিটি কষ্টসাধ্য ও সময়সাপেক্ষ। এই অবস্থায় ইন্দাতীর থেকে মুক্তবাণিজ্যের এহেন প্রস্তাব অতএব তাদের সে উদ্দেশ্য সাধন অরবার এক সহজতর পথের সন্ধান দেয়।

অতএব, আহিনের প্রস্তাবটি সানন্দে গ্রহণ করে তারা এরপর ব্যাপারীর ছদ্মবেশে বহু সুশিক্ষিত ও দক্ষ গূঢ়পুরুষকে ইন্দাতীরে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে। পাশাপাশি, মঞ্জাদাহির থেকে প্রস্তাবিত সার্থবাহটি এসে পৌঁছালে, তার বণিকদের প্রতি গোপনে তীক্ষ্ণ নজর রাখবার জন্যও প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি চলছিল ম্‌হিরি নগরীতে।

প্রস্তুতি চলেছিল ইন্দাতীরেও।

উত্তরে আরাপা হতে দক্ষিণ লুথিলার বন্দরশহর, পূর্বে রক্ষাগাড়িন হতে সুদূর পশ্চিমে সমুদ্রতীরে সুথাকাগন- প্রতিটি নগরিতেই এই মুহূর্তে সাজো সাজো রব উঠেছে। তাদের মন্দিরে মন্দিরে দোরাদাবুর সন্তানগোলকরা একযোগে ঈশ্বর দোরাদাবুর নবতম আদেশ শুনিয়েছেন তাঁদের পুরোহিতদের- ইন্দাতীরে সমস্ত নগরী হতে বণিকদের সার্থবাহদের আগামী তিন পক্ষকালের মধ্যে বিপুল পণ্যসামগ্রী নিয়ে মঞ্জাদাহির নগরীতে সমবেত হতে হবে। সর্বমোট এক সহস্র মহিষবাহিত যানে, গম, সুক্ষ্মবস্ত্র, পুঁতি ও রত্ননির্মিত গহনা, শঙ্খবলয়, গজদন্ত ও মৃৎনির্মিত ক্রীড়াসামগ্রীহেন পণ্যসামগ্রী নিয়ে এরপর শরতকালের শুরুতে বণিকদের দল ম্‌হিরি শহরের উদ্দেশে মৈত্রীযাত্রায় রওয়ানা হবে।

এহেন সৌহার্দ্যের একটি বাতাবরণে গোপনীয়তার কোনো অবকাশ ছিল না। প্রতিটি নগরীর মন্দিরদুর্গের দেয়ালে সে নগরী থেকে যে সার্থবাহটি যাবে তার বণিকদের নাম থেকে শুরু করে যাবতীয় পণ্যসামগ্রীর তালিকা সাধারণের জ্ঞাতার্থে চিত্রিত লিপিতে অঙ্কিত করা হয়েছে।

সেই শহরগুলিতে উপস্থিত ম্‌হিরির গূঢ়পুরুষরাও সতর্ক থাকত। প্রতিটি সার্থবাহে সামগ্রী বোঝাই হবার সময় তার মালবাহক শ্রমিকদের দলে মিশে থেকে তারা সতর্কভাবে নজর রেখে চলত সেদিকে। তারপর সার্থবাহটি মহিষচালিত যানের বাহিনী নিয়ে কিংবা জলপথে ইন্দার বুকে নৌবহর ভাসিয়ে রওয়ানা হবার পর  নগর ছাড়িয়ে গভীর বনপথে হারিয়ে গেলে তারা তার পুঙ্খানুপুঙ্খ বিবরণ ম্‌হিরিতে পাঠাবার বন্দোবস্ত করে নিশ্চিন্ত হত।

এই কাজে একবারের জন্যও তাদের একজন গূঢ়পুরুষও মন্দিরসেনার হাতে বন্দি হয়নি। এহেন অস্বাভাবিক মসৃণতা তাদের সন্দিহান করে তোলেনি। বরং নিজেদের কর্মদক্ষতার প্রতি আরও আত্মবিশ্বাসী করে তুলেছিল তাদের। ফলত আরও দুঃসাহসী হয়ে উঠছিল তাদের স্বভাব ও কর্মপদ্ধতি।

কেবল, সার্থবাহগুলি তাদের চোখের অন্তরালে গভীর বনাঞ্চলে প্রবেশ করবার পর তার অধিকাংশ পণ্যসামগ্রী অদৃশ্য হয়ে তার স্থানে, আগে থেকে বনের গভীরে এসে একত্র হওয়া সৈনিকদের যানে আরোহন করে অবশিষ্ট পণ্যসামগ্রীর আড়ালে আত্মগোপন করবার খবর সেই আত্মবিশ্বাসী গূঢ়পুরুষদের নজর এড়িয়ে গিয়েছিল। গিয়েছিল, কারণ স্বার্থবাহগুলিকে সেই দুর্গম ও জনহীন বনপথে অনুসরণ করবার কোনো প্রয়োজন তারা বোধ করেনি।

আর এইভাবেই একে একে মঞ্জাদাহির নগরীর মন্দিরদুর্গের নীচের প্রশস্ত ভূমিতে একে একে এসে জড়ো হচ্ছিল ম্‌হিরির উদ্দেশ্যে মঞ্জাদাহিরের পাঠানো উপহার- একশত বণিকের একটি বাহিনীর সঙ্গে এক সহস্র মহিষবাহিত যানে আরূঢ় ‘পণ্য’সামগ্রী।

***

মহামাতৃকা সুব্রান অপরাহ্নের স্নান সমাপ্ত করে অলিন্দে এসে দাঁড়ালেন। দ্বিতল এই বাড়িটির দুই তলে চারটি কক্ষ। দ্বিতলের কক্ষদুটির সামনে একটি প্রশস্ত অলিন্দে অস্তগামী সূর্যের স্বর্ণাভ আলো এসে পড়েছে। তার কবোষ্ণ উত্তাপ তাঁকে বড়ো তৃপ্তি দেয়।

মহামাতৃকার এই আবাসটির গড়ণ নগরীর আর পাঁচটা বাড়ির চেয়ে পৃথক কিছু নয়। তার কারণ মহামাতৃকা বহিরঙ্গের প্রাচুর্য ও গরিমায় আস্থা রাখেন না। তবে বাড়িটির প্রতিটি দেয়ালে ও অলিন্দে পোড়ামাটি, শঙ্খ ও গজদন্তের নিপুণ কারুকার্য একে একটি অনুপম শোভা দিয়েছে।

প্রত্যহ অপরাহ্নে এই অলিন্দটিতে দাঁড়িয়ে সুব্রান তাঁর প্রিয় ম্‌হিরির দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থাকেন। কেবল নিজের আবাসস্থলই নয়, সম্পূর্ণ নগরীটির নির্মাণ ও সজ্জাতেই এমন একটি সুক্ষ্ম রুচিবোধের ও শিল্পীসত্ত্বার স্বাক্ষর রয়েছে যা আর কোনো নগরীতে পাওয় যায় না। ম্‌হিরির এই শিল্পবোধ তাকে পশ্চিমে তুরানার বালুকাপ্রান্তর  হতে আরিয়ানাম পার হয়ে মগন উপসাগর পর্যন্ত ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ অঞ্চলের সর্বত্রই সুখ্যাতি এনে দিয়েছে। এবং এরই পাশাপাশি, সুশাসন ও ন্যায়বিচারের কেন্দ্র হিসাবেও তা এই অঞ্চলগুলিতে দৃষ্টান্তস্বরূপ।

কেবল, দক্ষিণে ইন্দাতীরের নগরীগুলি এর ব্যতিক্রম। অবশ্য সেখানেও ম্‌হিরির একটি বিষয়ে কিঞ্চিৎ খ্যাতি… বা বলা যায় কুখ্যাতি রয়েছে। হাতে শঙ্খবলয়গুলি ধারণ করে, সামনে দাঁড়ানো কিশোরীটির হাতে ধরা মসৃণ ধাতুপট্টে নিজের মুখচ্ছবিটির দিকে নজর রেখে কপালে সৌভাগ্যসূচক সিন্দুরবিন্দু অঙ্কন করতে করতে কথাটা মনে করে মুখে কৌতুকের একটুকরো হাসি ফুটে উঠল তাঁর। এই খ্যাতি বা কুখ্যাতির কারণটি হল ম্‌হিরির সুদক্ষ গুপ্তচরবাহিনী।

“মহামাতৃকা। আমাকে আহ্বান করেছিলেন?”

চমক ভেঙে সামনে এসে দাঁড়ানো পুরুষটির দিকে ঘুরে তাকিয়ে মৃদু মাথা নাড়লেন সুব্রান, “হ্যাঁ ঘুলান। তোমার আয়োজন সম্পূর্ণ হয়েছে কি?”

“আপনার আজ্ঞা পালিত হয়েছে মহামাতৃকা,” শ্রদ্ধাবনত কণ্ঠে উত্তর দিয়ে মানুষটি অলিন্দের ঠিক নীচে অবস্থিত সুবিশাল চত্বরটির দিকে ইঙ্গিত করলেন। তার বুকে একশত সুদৃশ্য তাঁবু মাথা তুলেছে। সেখানে অজস্র কর্মী শেষমুহূর্তে কাজে ব্যস্ত। ভারে ভারে সুখাদ্যের স্তূপ, স্নানের জন্য সুগন্ধিত জল ও অন্যান্য সামগ্রী এনে সাজিয়ে রাখা হচ্ছে তাঁবুগুলির ভিতরে।

সেদিকে নজর রেখে ঘুলান ফের বলে উঠলেন, “মঞ্জাদাহিরের বণিকদলকে কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে মহামাতৃকা। গিরিসঙ্কটের মুখে তাঁদের মহিষবাহিত এক সহস্র যান দেখা দিয়েছে। সম্ভবত সন্ধ্যার খানিক পরেই তাঁরা নগরবৃত্তে এসে পৌঁছোবেন। তাঁদের সাচ্ছন্দ্য ও আপ্যায়নের সমস্ত বন্দোবস্ত সম্পূর্ণ হয়েছে। যত্নের কোনো ত্রুটি থাকবে না দেবী।”

“আর দ্বিতীয় বন্দোবস্তটি?”

মৃদু হাসি খেলে গেল ঘুলানের দৃঢ়বদ্ধ ওষ্ঠাধরে, “তার আয়োজনও সম্পূর্ণ হয়েছে। একশত অতিথি বণিকের একশত পরিচর্যাকারীর প্রত্যেককে আমি নিজে নির্বাচন করেছি আমাদের শ্রেষ্ঠ চরদের মধ্যে থেকে। এদের উচ্চারিত প্রতিটি শব্দ আপনার গোচরে আনা হবে।”

“বেশ। এখন তুমি আসতে পারো। মঙ্গল হোক।”

মাথা নীচু করে মহামাতৃকার আশীর্বচন গ্রহণ করে পিছু হটে অলিন্দ থেকে বের হয়ে গেলেন প্রৌঢ় মানুষটি। সেদিকে স্মিতমুখে তাকিয়ে রইলেন সুব্রান। পিতৃতুল্য এই ঘুলান সুব্রানের গুপ্তচর বিভাগের প্রধান। তাঁর মায়ের শাসনকাল থেকেই এই পদটিতে এঁর অবস্থিতি। ম্‌হিরির নিরাপত্তা ব্যবস্থার এক প্রধান স্তম্ভ তিনি।

মাতৃমাতামহীদের কাছে কৈশোর থেকেই ম্‌হিরির এই গুপ্তচর বাহিনীর প্রতিষ্ঠার কাহিনি শুনে এসেছেন সুব্রান। মাত্রই কয়েক পুরুষ আগে পর্যন্ত এই গুপ্তচরবাহিনীর কোনো অস্তিত্বও ছিল না ম্‌হিরিতে। তার জন্ম হয় অজেয় ম্‌হিরির ইতিহাসে একমাত্র পরাজয়ের লজ্জাস্কর অভিজ্ঞতার পর। মহাত্মা আনজিনের গাথায় ধরা আছে সেই ইতিহাস:

দক্ষিণে ইন্দানদীর তীরস্থ বন্য অর্ধমনুষ্যদের দেশে একসময় নিয়মিত সামরিক অভিযান চালাত ম্‌হিরি। কিন্তু, এক কালে, মহামাতৃকা ঐমায়ার স্বামী, যোদ্ধাশ্রেষ্ঠ ইমস্রা সেই অভিযান চালাতে গিয়ে এক অজ্ঞাত শক্তির হাতে চূড়ান্ত পরাজয়ের লজ্জা স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন। ওই শক্তি, যা নিজেকে দোরাদাবু বলে ঘোষণা করেছে ইন্দাতীরে, সে এরপর তার অতিলৌকিক সুরক্ষাবলয়ে ইন্দাতীরকে ঘিরে ফেলে সেখানে এক প্রতিদ্বন্দ্বী সভ্যতার জন্ম দিয়েছে। সেখানে সামরিক অভিযান চালানো যায় না।

অবশ্য এদের সামরিক অভেদ্যতার বিষয়ে প্রথমে অবহিত ছিল না ম্‌হিরি। কারণ, সেই পরাজয়ের পর এদের সঙ্গে বৃথা যুদ্ধে শক্তিক্ষয় না করে উত্তর, পূর্ব ও পশ্চিমমুখে তাদের প্রভাববৃত্ত বাড়াবার কাজেই মনঃসংযোগ করেছিল সে। ওইদিকে মরু, পর্বত ও বিভিন্ন নদীর অববাহিকায় বহু জনপদ গড়ে উঠেছে দীর্ঘকাল ধরে। ম্‌হিরির প্রযুক্তিবিদ, বণিক ও সেনাবাহিনীর সহায়তায় সেই অঞ্চলগুলিতে তার প্রভাববৃত্ত মসৃণভাবেই বেড়ে চলেছিল ক্রমশ।

কিন্তু একসময় এই জনপদগুলিতেও ইন্দাতীরের বণিকদের আবির্ভাব হওয়া শুরু হয়। এই বণিকরা এক তীব্র প্রতিদ্বন্দ্বিতা গড়ে তুলছিল ম্‌হিরির বহির্বাণিজ্যের সঙ্গে। তবে এতেও বিচলিত হয়নি ম্‌হিরি।

তার বিচলিত হবার কারণ অবশেষে ঘটেছিল সুব্রানের বৃদ্ধ প্রমাতামহী, মহামাতৃকা মাহায়া-র শাসনকালে। এই সময় থেকে ম্‌হিরির নিকটবর্তী বিভিন্ন এলাকায় এদের কিছু কিছু নগর গড়ে ওঠা শুরু হয়। এইবার সতর্ক হয়ে ওঠে ম্‌হিরি। না। ইন্দাতীরের সেনারা বীর বটে, কিন্তু রণপ্রযুক্তি কিংবা রণকৌশলে তারা ম্‌হিরির সমকক্ষ নয়। সে বিষয়ে তারা নিজেরাও সচেতন। ফলত, ম্‌হিরির বিরুদ্ধে সরাসরি কোনো সামরিক অভিযান তারা কখনো চালায়নি। কিন্তু এইবার ম্‌হিরির মহামাতৃকা লক্ষ করেন, বিচিত্র এই সভ্যতা ইন্দার অববাহিকায় অজস্র নগরী স্থাপন করে  নিজেকে সুপ্রতিষ্ঠিত করবার পর এইবারে অর্ধচন্দ্রাকারে সাজানো একটি মালার মতই ছোটো ছোটো নগর দিয়ে ধীরে ধীরে ঘিরে ফেলতে শুরু করেছে ম্‌হিরিকে।

ফলত, এইবার এই নতুন নগরীদের বিরুদ্ধে কয়েকটি সামরিক অভিযান চালিয়েছিল ম্‌হিরি। কিন্তু সেই অভিযানগুলি চালাতে গিয়ে এক বিচিত্র পথে পরাজয় স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছে তার সেনাদল। এই আক্রমণগুলির সূচনায় প্রতিবারই ম্‌হিরির সেনাদল দ্রুত অগ্রসর হতে সমর্থ হয়েছে। কিন্তু তারপর, জয় যখন প্রায় হাতের মুঠোয়, তখন প্রতিবারই সহসা যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে উধাও হয়েছে ইন্দাতীরের সেনারা এবং তারপর আকাশে আবির্ভূত হয়েছেন এদের স্থানীয় গোলকদেবতা। এবং সেই আবির্ভাবের প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই ম্‌হিরির অজেয় সেনাদল কোনো অকারণ অতিলৌকিক আতঙ্কে অস্ত্রশস্ত্র ছেড়ে লুটিয়ে পড়েছে রণক্ষেত্রে।

এমনই একটি রণক্ষেত্রে, যুদ্ধ শেষ হয়ে যাবার পরে মহামাতৃকা গোপনে  সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। মুখে নারকীয় আতঙ্কের ছাপ নিয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ছড়িয়ে থাকা মৃতদেহগুলির বিকৃত দেহ ও মুখচ্ছবি তাঁকে বাকি জীবন দুঃস্বপ্নে ভুগিয়েছিল। এই গোলকরাক্ষসদের কোন অজ্ঞাত অস্ত্র এহেন মৃত্যু ডেকে আনতে পারে সে-রহস্য তিনি বা তাঁর প্রযুক্তিবিদ পুরোহিতরা শত চিন্তাতেও ভেদ করতে সক্ষম হননি।

এরপর থেকে সাবধান হয়ে গিয়েছিল ম্‌হিরি। অতিশীঘ্র এদের বিরুদ্ধে কোনো সামরিক অভিযান আর নয়। তার পরিবর্তে একটা দীর্ঘস্থায়ী পরিকল্পনার সূচনা হয়েছিল মহামাতৃকা মাহায়া-র হাতে। সূচনা হয়েছিল ম্‌হিরির সুদক্ষ ও আতঙ্ক উদ্রেককারী গুপ্তচরবাহিনীর প্রতিষ্ঠার মাধ্যমে। শুরু থেকেই এদের প্রাথমিক দায়িত্ব ছিল ইন্দাতীরের সভ্যতার যাবতীয় খুঁটিনাটি তথ্য সংগ্রহ। সে দায়িত্ব তারা অদ্যাবধি সুচারুভাবে পালন করে চলেছে।

ম্‌হিরির শাসনভার নেবার পর সুব্রান তাঁর গুপ্তচর বিভাগের কর্মপ্রণালীতে দুটি পরিবর্তন সাধন করেন। তার প্রথমটি ছিল চরবৃত্তির এলাকাটিকে কেবলমাত্র ইন্দাতীরের নগরীগুলিতে সীমাবদ্ধ না রেখে তাকে ম্‌হিরির প্রভাববৃত্তে থাকা অন্যান্য বন্ধুরাষ্টের বুকেও ছড়িয়ে দেয়া। কারণ, ম্‌হিরির পাশাপাশি মঞ্জাদাহিরের প্রভাবও ইতিমধ্যে তাদের বণিকশ্রেণীর হাত ধরে এই গোটা অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছে। উর, তেলমুন্দ, মগন ইত্যাদি বহু নগরেই এমনকি এদের নিজস্ব পল্লী অবধি গড়ে উঠেছে। রাজনীতিতে চিরস্থায়ী বন্ধুত্ব বলে কিছু হয় না। ফলত এই পরিস্থিতিতে এই বন্ধুরাষ্ট্রদের দিকেও গোপন নজরদারি রাখবার প্রয়োজন অনুভব করেচিলেন সুব্রান।

আর এই পদক্ষেপটির ফলেই সম্প্রতি একটি আশাতীত লাভ হয়েছে তাঁর। আশাতীত, এবং খানিকটা অপ্রত্যাশিতও বটে। ঘটনাটি ঘটেছিল উর নগরীতে। সেখানে সুব্রানের এক গুপ্তচর একদিন অপ্রত্যাশিতভাবে একটি কাজের দায়িত্ব পায়। উকালান নামে সেখানকার এক বৃদ্ধ পণ্ডিতকে প্রায়শ ম্‌হিরির বণিকপল্লীতে যাতায়াত করতে দেখে গুপ্তচর কিছু তথ্যসংগ্রহের আশায় কর্মপ্রার্থীর ছদ্মবেশে এই বৃদ্ধের বাসগৃহে একদিন উপস্থিত হয়েছিল। বৃদ্ধ তাকে কর্মে নিযুক্ত করেন এবং কয়েকদিন তাকে পর্যবেক্ষণের পর একদিন সরাসরি তাকে নিজের পাঠকক্ষে ডেকে নিয়ে বলেন, তিনি তার আসল পরিচয়টি জেনেছেন।

এতে চরটি সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ ততদিনে সে জেনেছে, উকালান উর নগরীর এক প্রমুখ পণ্ডিত, শাসকবৃত্তে তাঁর গভীর প্রভাব রয়েছে, এবং উর নগরীতে চরবৃত্তির শাস্তি অতি ভয়ঙ্কর। তার ভয় দেখে বৃদ্ধ তাকে আশ্বস্ত করে বলেন যে, তিনি তার কোনো ক্ষতি চান না, কেবল তাঁর একটি গোপন কার্যে চরের সহায়তা বাঞ্ছা করেন।

প্রাণভয়ে ভীত চরটি কৃতজ্ঞচিত্তে তাঁর শর্ত মেনে নেয় এবং গোপনীয়তা রক্ষার বিষয়ে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হয়। এরপর উকালান তাকে সংক্ষেপে জানান যে, ইন্দাতীরের গোলকরাক্ষসের বিষয়ে তিনি সবিশেষ অবগত। কেবল ইন্দাতীর নয়, সমস্ত মানবজাতির পক্ষেই তার উপস্থিতিকে বিপজ্জনক বলে মনে করেন তিনি। আর তাই দীর্ঘকাল ধরে দূর থেকে তার বিষয়ে যথাসম্ভব তথ্য আহরণ করে তিনি তার চরিত্র গভীরভাবে অধ্যয়ন করেছেন ও অবশেষে অতি সম্প্রতি এমন একটি অস্ত্রের সন্ধান তিনি পেয়েছেন যাকে হয়তো এই গোলকরাক্ষসের বিরুদ্ধে যুদ্ধাস্ত্র হিসাবে কাজে লাগানো যেতে পারে বলে তাঁর আশা। তবে ওই রাক্ষসের বিরুদ্ধে এর কার্যকারীতা আদৌ কিছু আছে কি না তা জানবার জন্য একে তার কাছাকাছি কোনো স্থানে নিয়ে যেতে হবে। ম্‌হিরি নগরী সে কাজের জন্য আদর্শ স্থান। কিন্তু, উর নগরীতে ইন্দাতীরের বণিকদের, ও বলাবাহুল্য তার গুপ্তচরদের উপস্থিতির কারণে প্রকাশ্যে তা ম্‌হিরিতে পাঠানো সম্ভব নয়।

বিষয়টি শোনবার পর চর সানন্দে তাঁর সহায়তা করতে সম্মত হয়। এরপর বৃদ্ধ তাকে একটি সীসানির্মিত ছোটো পেটিকা ও কাপাসবস্ত্রে আবৃত একটি মৃৎকফলক দিয়ে বলেন এই পেটিকা সে যেন ভুলক্রমেও না খোলে, এবং পেটিকা পাবার পর মৃৎকফলকে তাঁর লিখিত নির্দেশাবলী পাঠ না করে মহামাতৃকা সুব্রানও যেন এটিকে খুলে দেখবার প্রচেষ্টা না করেন, কারণ তাঁর পরীক্ষায় ইতিমধ্যেই দেখা গিয়েছে, উন্মুক্ত অবস্থায় এটিকে স্পর্শ করা বা এর ঘনিষ্ট সান্নিধ্যে যাওয়া যেকোনো মানুষেরও মৃত্যুর কারণ হয়।

চরটি যথাসময়ে উকালানের সেই উপহার মহামাতৃকার কাছে এনে উপস্থিত করেছিল।

sindhu84

উর নগরীর মহাজ্ঞানী উকালানের খ্যাতি সুব্রানের কাছে অজ্ঞাত ছিল না। অতএব মৃৎফলকের গায়ে তাঁর নিজস্ব সঙ্কেতচিহ্ন দেখবার পর সেটিকে পাঠ করে মহামাতৃকা সেখানে লিখিত নির্দেশ অনুযায়ী শহরের একপ্রান্তে একটি সুরক্ষিত জ্যোতিগৃহ নির্মাণ করে তার মধ্যে পেটিকার ভেতরে বহন করে আনা অস্ত্রটিকে প্রতিষ্ঠা করেন। উকালানের নির্দেশ ছিল, ইফ্রাত নদীকূল থেকে সংগৃহীত এই দৈব অস্ত্রের চতুঃসীমায় শতহস্ত পরিমিত অঞ্চলে যেন কোনো সাধারণ মানুষ পদার্পণ না করে। তার দেখভাল করবার জন্য যে সৈনিকদের নিয়োগ করা হবে তারাও যেন এর কাছে যাবার সময় সীসানির্মিত বর্মে আপাদমস্তক আবৃত করে তবে তার সন্নিকটে যায়।

সুব্রান বিষয়টি নিয়ে নিজেও কৌতূহলী হয়ে উঠেছিলেন। তবে অস্ত্রটি প্রতিষ্ঠা করবার পর এক সন্ধ্যায় নিজেকে সীসানির্মিত বর্মে আচ্ছাদিত করে তিনি নিজেই সেই জ্যোতিগৃহে উপস্থিত হন।

অস্ত্রটি দেখবার পর অবশ্য সামান্য আশাহত হয়েছিলেন সুব্রান। সেটি আপাতদৃষ্টিতে সাধারণ একটি প্রস্তরখণ্ড বলে বোধ হয়ে। তবে সন্ধ্যার অন্ধকারে তা থেকে হরিতাভ একটি আভা বের হচ্ছিল এইমাত্র। তুচ্ছ একটি প্রস্তরখণ্ড কেমন করে দোরাদাবুহেন গোলক রাক্ষসকে প্রতিহত করতে পারে তা তাঁর বোধগম্য হচ্ছিল না। বিশেষত উকালান স্বয়ং তাঁর পত্রে এর কার্যকারিতা নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে জানিয়েছিলেন, এটি একটি সামান্য পরীক্ষামাত্র।

তবে এর কয়েক দিনের মধ্যেই তাঁর এহেন সন্দেহের নিরসন ঘটে। চরেরা সংবাদ বহন করে আনে, ম্‌হিরির একেবারে কাছে নির্মীয়মান ইন্দানগরী পৈরাকে কিছু বিচিত্র ঘটনা ঘটতে শুরু করেছে। সেখানকার পুরোহিতরা সভয়ে বলাবলি করছিল, তাদের গোলকদেবতা ম্‌হিরি নগরীর প্রান্তে বায়ুপথে একটি অভিযান চালাবার সময় সহসা এক আশ্চর্য বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। নাকি নগরীর ভেতর থেকে উঠে আসা কোনো মৃদু শক্তিবিচ্ছুরণ তাঁর চেতনাস্রোতকে প্রতিহত করে ঐ নগরীকে তাঁর কাছে অদৃশ্য করে দিয়েছে এবং তিনি সেই নগরীর আকাসসীমা লঙ্ঘন করতে অসমর্থ হয়ে ফিরে এসেছেন।

এই ঘটনাটি গোচরে আসবার পরই সুব্রানের ইন্দাতীরবিষয়ক নীতিতে কিছু পরিবর্তন আসে। পরীক্ষার ফলাফল জানিয়ে কিছুকাল হল তিনি উকালানের কাছে একজন বিশ্বস্ত বণিকের হাতে একটি পত্র পাঠিয়েছেন। পত্রে আরও অনুরোধ করেছেন, উকালান যেন বণিকের সার্থবাহের অন্যান্য সামগ্রীর মধ্যে সঙ্গোপনে দৈবশক্তিযুক্ত এই প্রস্তরের বেশ কিছু খণ্ড তাঁকে পাঠাবার বন্দোবস্ত করেন। একই সঙ্গে উত্তর পশ্চিমে গোর-ইগুরের দুর্গম পার্বত্য অঞ্চলে ম্‌হিরির শ্রেষ্ঠ খননকারীর একটি দল গোপনে এক অভিযানে রওয়ানা হয়েছে। পুরাকাল থেকেই এই পর্বতাঞ্চল  সীসা নামের ধাতুটির এক প্রধান উৎস।

এরই পাশাপাশি, তাঁর গুপ্তচরবাহিনীকে ইন্দাতীরে বহুগুণে সক্রিয় করে তুলেছেন এইবার সুব্রান। ছলেবলেকৌশলে ওই গোলকদেবতার ঘনিষ্ট বৃত্তের কিছু মানুষকে অপহরণ করে ম্‌হিরিতে নিয়ে আসাই তাদের একমাত্র লক্ষ। এই মানুষগুলিকে আশু প্রয়োজন সুব্রানের। দুটি কারণে কাজে আসবে তারা। প্রথমে আক্রমণে যাবার আগে গোলকদেবতা সম্পর্কে যাবতীয় গুরুত্বপূর্ণ তথ্যের উৎস হিসাবে, আর সে কাজ সমাধা হবার পরে, দৈব প্রস্তরখণ্ডের মারণক্ষমতার পরীক্ষার উপাদান হিসাবেও তাদের ব্যবহার করা যাবে। পরীক্ষাটি গুরুত্বপূর্ণ হলেও, নিজের নগরীর বাসিন্দাদের নিয়ে তা করতে সুব্রান সম্মত নন।   

আর কিছুকালের অপেক্ষা। তার পরেই প্রস্তুতির অন্তে ফের বহুকাল বাদে ফের একবার ইন্দাতীরে পা রাখবে ম্‌হিরির অজেয় সেনাদল। সুব্রান স্বপ্ন দেখেন, তাঁর সেনাবাহিনীর সম্মুখে ঐ দৈব প্রস্তরের খণ্ড ধারণ করে এগিয়ে চলেছে সীসার বর্মে আবৃত অগ্রবর্তী বাহিনী। তার প্রভাবে প্রতিটি নগরীর গোলকদেবতাকে অচল করে দিতে পারলে, তারপর ম্‌হিরির অজেয় দানব বাহিনীকে রোধ করবার সাধ্য হবে না ইন্দাতীরের ওই অর্ধমনুষ্যদের।

কাজটি সময়সাপেক্ষ অবশ্য। এক থেকে দুটি বৎসর অতিক্রান্ত হবে সমস্ত উপাদান সংগ্রহ করে এনে তা থেকে গোপনে রণসজ্জা সম্পূর্ণ করতে। ততদিন ইন্দাতীরের নগরমণ্ডলীর সঙ্গে সুসম্পর্কের একটি ছদ্মবেশ বজায় রাখা অত্যন্ত জরুরি ছিল।  আর ঠিক এই সময়ে মঞ্জাদাহির থেকে আসা এই বাণিজ্য প্রস্তাবটি যেন দৈবপ্রেরিত হয়েই সুব্রানের কাছে তাঁর উদ্দেশ্যসাধনের সহায়ক হয়ে এসে পৌঁছায়।

প্রস্তাবটি সঙ্গে সঙ্গেই সানন্দে গ্রহণ করেছিলেন তিনি, যদিও গ্রহণ করবার পরেই গুপ্তচরের একটি ক্ষুদ্র কিন্তু কর্মদক্ষ দল ইন্দাতীরের বিভিন্ন নগরীতে এই বণিকদলের সার্থবাহগুলির প্রস্তুতির ওপরে নজর রাখবার জন্য ছড়িয়ে পড়ে। অদ্যাবধি তারা মঞ্জাদাহিরের এই বাণিজ্য অভিযানের মধ্যে কোনো কু-উদ্দেশ্যের সন্ধান পায়নি।

অতএব, নিশ্চিন্ত হয়েই এইবার শয়নকক্ষের দিকে এগিয়ে গেলন সুব্রান। বণিকরা এসে পৌঁছোবার আগে সামান্য বিশ্রাম নিয়ে নেবার মত সময় হাতে আছে তাঁর।

ক্রমশ

শীর্ষচিত্র- অতনু দেব।

 জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Twitter picture

You are commenting using your Twitter account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s