ধারাবাহিক উপন্যাস-সিন্ধু নদীর তীরে -পর্ব ৮- পিটার বিশ্বাস-শীত ২০২২

সিন্ধুনদীর তীরে –প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্বচতুর্থ পর্বপঞ্চম পর্বষষ্ঠ পর্ব , সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব

IMG-20210913-WA0004

অষ্টম পর্ব

একটি মৃত্যুদণ্ড

আমাদের লক্ষ্য শয়তান জাদুকরদের দেশ ম্হিরি তার প্রস্তুতি উপলক্ষ্যেই আপনাদের এইখানে আহ্বান করা

মহাপুরোহিত আহীন শব্দগুলো উচ্চারণ করতে গোটা সভাঘরেই একটা হালকা গুঞ্জন উঠল

মঞ্জাদাহির নগরের মন্দিরদুর্গের তৃতীয় তলের এই সভাঘরটি দৈর্ঘ্যে প্রস্থে শতহস্ত পরিমিত দক্ষিণের সুদূর অরণ্য এলাকা থেকে সংগ্রহ করে আনা দুর্মূল্য কৃষ্ণকাষ্ঠের ধূসর মসৃণ পাটাতনে মোড়া মেঝেটির একদিক খোলা সেইদিকে বহু নীচে নির্মীয়মাণ মঞ্জাদাহিরের বিস্তার ছাড়িয়ে ইন্দা নদীর ধারা চোখে পড়েতার অন্য তিনদিকে পোড়া ইটের পুরু দেয়ালের গায়ে পাশাপাশি ছোটো ছোটো দরজাগুলি মন্দিরদুর্গের পুরোহিতদের বাসকক্ষের দিকে এগিয়ে গেছে

সভাঘরের কেন্দ্রীয় অংশে আহীনের নেতৃত্বে দ্বাদশজন পুরোহিত দুটি মুখোমুখি অর্ধবৃত্তে বসেছেন ইন্দাতীরের নগরমণ্ডলীর মধ্যেকার প্রধান শক্তিকেন্দ্রগুলির মহাপুরোহিতরা আজ সকলেই এই সভায় উপস্থিত হয়েছেন উপস্থিত হয়েছেন মঞ্জাদাহিরে অধিষ্ঠিত মহান দোরাদাবুর নির্দেশে সে নির্দেশ তাঁদের কাছে সরাসরি আসেনি বলা বাহুল্য এসে পৌঁছেছে দোরাদাবুর আদেশে মহাপুরোহিত আহীনের পাঠানো নির্দেশ হয়ে দুটি অর্ধবৃত্তের একটিতে তাঁদের অবস্থান সেখানে রয়েছেন প্রতিবেশী জুদির্জাদাহির, কট্টাদিজা, দূরস্থ আমহিরি, সুদূর দক্ষিণের লুথিলা, উত্তরে রাইবি নদীতীরের আরাপা পূর্বে যামিন নদীতীরে অবস্থিত রক্ষাগাড়িন এই প্রতিটি মন্দিরের প্রধান পুরোহিত তাঁদের মুখোমুখি দ্বিতীয় অর্ধবৃত্তে বসেছেন মঞ্জাদাহিরের মহাপুরোহিত আহীন সহ আরও পাঁচজন মুখ্য পুরোহিত

বাইরে থেকে আসা পুরোহিতরা স্বভাবতই এহেন আহ্বান পেয়ে একটু শঙ্কিত চিত্তেই মঞ্জাদাহির এসে পৌঁছেছিলেন কারণ মঞ্জাদাহিরের অধিষ্ঠাতা ঈশ্বর দোরাদাবুর এহেন আহ্বান সাধারণত ডাক পাওয়া মানুষটির পক্ষে শুভ হয় না, বিশেষত এইবারের আহ্বানে চূড়ান্ত গোপনীয়তা বজায় রেখে এইখানে উপস্থিত হবার নির্দেশ ছিল তাঁদের উপরে এইবার আহীনের মুখে তাঁদের ডেকে আনবার কারণটি শুনে একটু স্বস্তিবোধ করছিলেন তাঁরা

আপনারা প্রত্যেকেই ইন্দাতীরে মহান দোরাদাবু প্রতিষ্ঠিত এই নগরমণ্ডলীর সূচনার ইতিহাস জানেন দেবতার আবির্ভাবের আগে আদিপীঠ আমহিরির ওপরে দানবনগরী ম্হিরি জাদুকর দানবদের নিয়ত আক্রমণের ইতিহাসও আপনাদের অজানা নয় পরবর্তীকালে দেবতার ভয়ে তারা সে আক্রমণ শানানো বন্ধ করলেও, তাদের গুপ্তচরবাহিনী সমগ্র ইন্দাতীরেই সক্রিয় আছে নিজেদের দুর্ভেদ্য নগরীর অন্তরালে বসে তারা সর্বদাই ইন্দাতীরে আক্রমণ চালাবার চক্রান্তে রত থাকে তাই মহান দোরাদাবুর আদেশ, এবারে একটা প্রবল ঝটিকা আক্রমণে নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে ওই ম্হিরি নগরীকে একজন দানবও যেন বেঁচে না থাকে সেই হবে আমাদের…”

যদি অনুমতি হয় তো বিষয়ে আমি কিছু…”

আহীনের পাশে বসা মুখ্যপুরোহিত মার্জক হঠাৎ কথা বলে উঠলেন আহীন খানিক বিরক্তিভরে তাঁর দিকে ঘুরে তাকালেন নিঃসন্দেহে এইবার তাঁর প্রস্তাবের বিরুদ্ধে কিছু বক্তব্য রাখবে

মার্জক এই পুরোহিতমণ্ডলীতে স্বাগত নন পুরোহিতসম্প্রদায়ের পদগুলি মূলত বংশানুক্রমিক তবে দ্রুত নগরায়ণের ফলে বিভিন্ন নতুন নতুন জনবসতিতে এবং মঞ্জাদাহিরের কেন্দ্রিয় প্রশাসণেও পুরোহিতের চাহিদা বেড়েছে সে চাহিদা মেটাবার জন্য বেশ কিছুকাল হল মন্দিরসেনাদের মধ্যে শ্রেষ্টতম যোদ্ধাদের পরিবার থেকেও কিছু কিছু পুরোহিত নিয়োগ করা শুরু হয়েছে কিন্তু মার্জক এই দুই সম্প্রদায়ের একটিরও সদস্য নন তিনি পেশায় বণিক

বিরক্ত মুখে কিছু একটা বিরূপ মন্তব্য করতে গিয়েছিলেন আহীন কিন্তু তখনই সামনে খোলা জায়গাটা দিয়ে নীচে নগরীর দক্ষিণ সীমার দিকে চোখ পড়ল তাঁর সেখানে সুবিশাল একটি প্রাসাদের নির্মাণকর্ম চলছে খর রৌদ্রে অসংখ্য শ্রমিক স্তূপ স্তূপ ইট দিয়ে গড়ে চলেছে তার কাঠামো সেদিকে চোখ ফেলে নিজের বিরক্তিটাকে হজম করে গেলেন আহীন যে কারণে, একরকম বাধ্য হয়েই এঁকে পুরোহিতমণ্ডলীতে গ্রহণ করতে হয়েছে, তার একটি উদাহরণ ওই নির্মীয়মাণ বাজার ইন্দাতীরের এই নগরগুলিতে বণিকরা ইদানিং ক্রমশই আরো শক্তিশালী হয়ে উঠছে সহস্রমুন্ড সর্পের মতই এদের অস্তিত্ব আগেকার দিনে সামান্যতম বিরুদ্ধাচরণের ক্ষেত্রে অপরাধীর মৃত্যুদণ্ডই শৃঙ্খলা বজায় রাখতে যথেষ্ট ছিল অথচ এই বণিকেরা

কেবলমাত্র এই বাজারটিই নয়, ম্হিরি নগরীর একেবারে সন্নিকটে পৈরাক মঞ্জাদাহিরের খানিক উত্তরে রণগন্দাই শহরদুটির মন্দিরদুর্গ নির্মাণের সম্পূর্ণ দায়িত্বও এই মার্জকই বহন করছে কাজগুলির জন্য বিপুল ধন ব্যয় করবার প্রস্তাব সে দিয়েছিল একটিমাত্র শর্তেমহান দোরাদাবুর মন্দিরের একজন মুখ্য পুরোহিত হবার অধিকার সে চায় এবং সে সম্মান পাবার বিনিময়ে ভবিষ্যতেও আরো বহু ধন খরচ করতেও সে প্রস্তুত এই মর্মে একটি লিখিত প্রতিজ্ঞাপট্টও সে দান তুলে দিয়েছে আহীনের হাতে

প্রস্তাবটি আহীন দোরাদাবুর কাছে জানিয়েছিলেন এতে তিনি তৎক্ষণাৎ একে মৃত্যুদণ্ড দেবার আদেশও দিয়েছিলেন কিন্তু তা কার্যকর করবার আগেই, তাঁকে অবাক করে গোলকদেবতা সে আদেশ কেবল প্রত্যাহারই করে নেননি, পুরোহিতবৃত্তে বণিকদের প্রবেশে নিজের সম্মতি জানিয়ে নির্দেশও দিয়েছিলেন আহীনকে

সে সময় বিস্মিত খানিক বিরক্ত হলেও দেবতার এহেন মতপরিবর্তনের কারণটি এর কিছুকাল পর থেকে অনুভব করতে শুরু করেন আহীন এরপর থেকে ইন্দাতীরের অন্যান্য কিছু কিছু নগরেও পুরোহিতবৃত্তে বণিকদের আগমন ঘটা শুরু হয়

ইদানিং, পুরোহিত পদের বিনিময়ে এদের স্বেচ্ছাদত্ত ধনসম্পদের কল্যাণে একটা বিপুল বদল আসতে শুরু করেছে ইন্দাতীরের নগরীগুলোতে আগে নগরপরিচালন মন্দিরদুর্গের রক্ষণাবেক্ষণের খরচ মেটাবার জন্য মন্দিরসেনার বলপূর্বক কর সংগ্রহ অভিযান বহু রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের জন্ম দিত এতে লোকক্ষয় খরচও হত প্রভূত বণিকদের স্বেচ্ছাদত্ত বিপুল ধনবল এখন সে শ্রমের অনেকাংশেই লাঘব করেছে

এতে বণিকদের লাভও কম হয়নি নগরপরিচালনায় বণিকদের সরাসরি অংশগ্রহণের ফলে দেশের আইনকানুনে বহু বাণিজ্যসহায়ক পরিবর্তন সাধিত হয়েছে সমস্ত নগরীগুলিতে এখন পরিমাপের জন্য বাধ্যতামূলকভাবে একই ওজন ব্যবহার করা হয় সোনা মূল্যবান রত্নাদি মাপবার জন্য অতিসুক্ষ্ম ওজনের বাটখারা থেকে শুরু করে উচ্চতর ওজন পরিমাপের জন্য দুই দশের গুণিতক হারে ক্রমবর্ধমান ওজনের বাটখারার প্রচলন করা হয়েছে সর্বত্র চালু হয়েছে ব্রোঞ্জদণ্ডের সহায়তায় দাঁড়াতে সক্ষম উন্নত দাঁড়িপাল্লার ব্যবহারও

এর সম্পূর্ণ পরিকল্পনা, এবং বিভিন্ন নির্দিষ্ট ওজনের ঘনকাকার প্রস্তরখণ্ড ব্যবহার করে তার সফল প্রয়োগ ঘটাবার সম্পূর্ণ কৃতিত্বই মার্জকের চালু হয়েছে ক্রেতাসুরক্ষার আইনকানুন, দৈব প্রাকৃতিক দুর্যোগে পণ্য বা ফসল ক্ষতিগ্রস্ত হলে বণিকের সুরক্ষার জন্যও মন্দির তহবিল থেকে ঋণের বন্দোবস্ত করা হয়েছে পাশাপাশি তঞ্চকতা, নিম্নমানের সামগ্রী বিক্রয়, পণ্যক্রয়ের পর উপযুক্ত মূল্যদানে অস্বীকৃতি ইত্যাদি অপরাধে কঠোর সুনির্দিষ্ট শাস্তির প্রচলন ইন্দাতীরের শহরগুলিতে নতুন সমৃদ্ধিরও সূচনা ঘটাচ্ছে

বাণিজ্যসংক্রান্ত এই নীতিগুলি যে অর্থনীতির প্রভূত উন্নতি করেছে তা বলাই বাহুল্য কিন্তু তার বিনিময়ে মন্দির পরিচালনায় এই প্রতিবাদী স্বরগুলোর যন্ত্রণাও গড়ে ওঠা শুরু হয়েছে এই বণিকপুরোহিতরা যুদ্ধের গৌরব বোঝে না বোঝে ব্যাবসায় লাভ অন্যায়কারীকে মৃত্যুদণ্ডদানের পরিবর্তে তার সমস্ত সম্পদ মন্দিরের করায়ত্ত করে তাকে দাস হিসাবে কাজে লাগাবার দিকেই এদের ঝোঁক এই বদলের ক্ষীণ স্রোতটাই ইদানিং আহীনকে সন্ত্রস্ত করে রাখে পুরোহিত মন্দিরসেনার কঠোর সামরিক নিয়ন্ত্রণে যে সরলসিধে শাসণ, বণিকদের এই কর্মপদ্ধতি তাকে অনাবশ্যক জটিল করে তুলছে ক্রমাগত আগেকার দিন হলে অতি সহজেই এদের দুএকজনকে দৃষ্টান্তমূলক মৃত্যুদণ্ড দিয়ে এই সমস্যাকে নিয়ন্ত্রণ করা যেত তবে এখন তেমন কিছু ঘটলে তাতে এদের থেকে আসতে থাকা বিপুল ধনের স্রোত বন্ধ হয়ে যাবার সম্ভাবনা এই বণিকরা এক জায়গায় স্থির থাকে না সুদূর উর, লাগাশ, এরিদু হেন বহু জায়গাতেই ছড়িয়ে গেছে তারা ফলে কেবল বাহুবলে আর তাদের নিয়ন্ত্রণ করার উপায় নেই

তবে, মার্জককে তাঁর বক্তব্য বলতে না দিয়ে আহীনের উপায় নেই কোনো মন্ত্রণাসভায় সকলের সামনে মঞ্জদাহিরের একজন প্রধান পুরোহিতকে দাবিয়ে রাখা, অন্যান্য নগরী থেকে আসা পুরোহিতদের কাছে ভালো কোনো সন্দেশ পৌঁছাবে না

বলুন মার্জক বিষয়ে আপনার বক্তব্য…”

***

প্রচলিত পথে দৃশ্য বা শব্দকে সে সরাসরি অনুভব করে না তার চেতনায় কেবল ভেসে ওঠে এই পরজীবি পোষ্যদের চিন্তাতরঙ্গের ছাপ মন্দিরগর্ভের সিংহাসন থেকে চেতনার আকর্ষী বাড়িয়ে ধরে সেই চিন্তাগুলিকে নিবিষ্টমনে পাঠ করছিলেন দোরাদাবু নামের গ্রহগোলক

দানবনগরী ম্হিরির বিষয়ে এতকাল তিনি নীরব ছিলেন দূর অতীতে তাদের আক্রমণ একবার প্রতিহত করবার পর, তদের কথা বিস্মৃত হয়ে এই নগরগুলি গড়ে তোলবার কাজেই মনোনিবেশ করেছিলেন তিনি অনুগত পরজীবিদের কাজে লাগিয়ে বিপুল বেগে এগিয়ে নিয়ে চলেছিলেন ইন্দাতীরে তাঁর সাম্রাজ্যকে

কিন্তু ম্হিরি সন্নিকটে পৈরাক নামের নতুন নগরী নির্মাণের জন্য যে সন্তানগোলককে তিনি সেখানে পাঠিয়েছিলেন, কিছুকাল আগে তার কাছ থেকে পাওয়া একটি গোপন, বিপজ্জনক সংবাদ তাঁর দৃষ্টি সেদিকে ঘুরিয়ে দিয়েছে নাকি চূড়ান্ত এক যুদ্ধের প্রস্তুতি নিচ্ছে ম্হিরি নিচ্ছে সরাসরি মঞ্জাদাহির নগরীর বিরুদ্ধেই সংবাদ সন্তানগোলককে সংগ্রহ করে এনে দিয়েছে পৈরাক নগরীর এক বণিক এই বণিকরা সর্বত্রগামী লাভের সম্ভাবনা থাকলে স্বয়ং মৃত্যুর মুখেও এগিয়ে যেতে দ্বিধা করে না এমনকি ওই দানবনগরীতেও যাতায়াত রয়েছে তাদের তবে সেখানে প্রবেশ করলে তাদের কঠোর নিরাপত্তায় ঘিরে রাখে দানবরা তাদের রাজপুরুষ বা পরীক্ষাগারের কাছাকাছি এগোবার অনুমতি দেয় না কঠোর প্রহরায় নগরপ্রান্তের বাজার অঞ্চলে  লেনদেনের কাজ সমাধা করে ফিরে আসতে হয় তাদের সেখান থেকে ফিরে আসা এক বণিকই পৈরাকের মন্দিরের এক পূজারির কাছে তার শুনে আসা এহেন জনশ্রুতিটি বলেছিল

খবরটা নিতান্ত অমূলক নয় কিছুকাল ধরেই মঞ্জাদাহিরের মন্দিরঘনিষ্ট কর্মচারী, কিংবা প্রশাসণের কিছু গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তির পরিজনদের অপহরণের বেশ কিছু সংবাদ আসছিল দোরাদাবুর কাছে আহীনের গুপ্তচরদের আনা সংবাদ সত্য হলে এদের সকলকেই ম্হিরি নগরীর দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছেএবং সেখানে তাদের পরিণতি বিষয়ে কিছু ভয়াবহ গুজব ছড়িয়ে পড়ছে মঞ্জাদাহিরে চাপা একটা আতঙ্কের আবহ গড়ে উঠছে এতে

তবে প্রথম প্রথম তাতে বিশেষ উদ্বিগ্ন হননি তিনি জাতিধর্মনির্বিশেষে চরবৃত্তি, অপহরণ তস্করবৃত্তি এই পরজীবিদের স্বাভাবিক চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য তুচ্ছ কারণে কিংবা একেবারে অকারণেও তারা নিয়মিত এগুলির চর্চা করে থাকে এক্ষেত্রেও বিষয়টিকে তাই বিশেষ গুরুত্ব দেননি তিনি কিন্তু এইবার পৈরাক থেকে আসা সংবাদটির সঙ্গে এই অপহরণের বিষয়টিকে একত্র করে দেখবার পর দোরাদাবু একরকম বাধ্য হয়েই ওই দানবনগরীর দিকে মনোনিবেশ করেন দানবনগরীর অভ্যন্তরের বিষয়ে অনুসন্ধান পরবর্তী পদক্ষেপের বিষয়ে পরামর্শদানের জন্য পৈরাকে অবস্থিত সন্তানগোলকের কাছে তাঁর নির্দেশ যায়

এই নির্দেশের ফলাফল এই গ্রহের বুকে অবতরণের পর প্রথম তাঁর অন্তরে একটু ভয়ের সঞ্চার করেছিল কারণ, এই প্রথম, তাঁর অসীম শক্তিধর সন্তানগোলক কোনো মনুষ্যবসতির আকাশসীমা লঙ্ঘন করতে অসমর্থ হয় ম্হিরির নগরসীমার বাইরে থেকেই ফিরে এসে সে জানিয়েছিল, তার চেতনা, নগরসীমা থেকে বেশ কিছুটা দূরেই থেমে যেতে বাধ্য হয়েছিল কোনো নিষ্প্রাণ চেতনার শক্তিশালী প্রবাহ নগরটিকে ঘিরে স্পন্দমান তাকে ভেদ করবার চেষ্টা করতে ব্যর্থ হয়েছে সন্তানগোলক গোটা নগরটি তার চোখে তাই অদৃশ্য থেকে গিয়েছে

অপ্রত্যাশিত এই খবরটা ভাবিয়ে তুলেছিল দোরাদাবুকে মৃত গ্রহের বুকে জন্মানো এই দ্বিপদ পরজীবিদের চেতনাকে বশ রাখাই তাঁর মত গ্রহজীবের একমাত্র অস্ত্র আর, সন্তানগোলকের বক্তব্য সঠিক হলে, সেই অস্ত্রটিকেই নখদন্তহীন করে দেবার পথে অগ্রসর হচ্ছে ম্হিরির দানবেরা! তাদের নগরী এর মধ্যেই তাঁর প্রধান অস্ত্রকে প্রতিরোধ করবার শক্তি ধরে!

বিষয়টা নিয়ে দীর্ঘ চিন্তাভাবনার পর দোরাদাবুর সিদ্ধান্ত নেন, কোনো বড়োসড়ো বিপদের সম্ভাবনা দেখা দেবার আগে, তার সম্পূর্ণ জনসম্পদ সহ নিশ্চিহ্ন করে দিতে হবে ম্হিরিকে এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শুরু করবার নির্দেশ যায় ইন্দাতীরের উল্লেখযোগ্য নগরীদের শাসক সন্তানগোলকদের কাছে

প্রস্তুতির আর একটি পন্থা ছিল বণিকদের তাঁর ঘনিষ্ট বৃত্তে স্থান দেয়া ম্হিরির বিষয়ে যা সামান্য তথ্য মেলে তা ওই বণিকদের করায়ত্ত এরা কাছে থাকলে সেগুলো প্রস্তুতিতে কাজে আসবে তাছাড়া, তাদের বিপুল ধনবলও একটি গুরুত্বপূর্ণ শক্তি গত কয়েক পুরুষ ধরে তাঁর সামনে বেড়ে উঠতে থাকা এই সভ্যতা নিজে থেকেই আগের সারল্য ছেড়ে ক্রমশ ধননির্ভর হয়ে উঠছে বিষয়টা দোরাদাবুর খুব একটা বোধগম্য হয় না যে গ্যালাক্সিব্যাপী গ্রহসভ্যতার শেষ জীবিত সদস্য তিনি তার বিস্তারেধনবিষয়টির অস্তিত্ব ছিল না কিন্তু এদের তৈরি সমাজেধনযে উপস্থিত শক্তির প্রধান উৎস হয়ে উঠছে তার বহু প্রমাণ পেয়েই তিনি অবশেষে বণিকদের তাঁর নিজস্ব বৃত্তে নিয়ে আসবার বিষয়ে সম্মত হন

এবারে, অবশেষে সেই প্রস্তুতি সমাপ্তির মুখে সাতটি প্রধান নগরীতে গড়ে তোলা বিপুল সেনাদল এবার ম্হিরির ওপরে অন্তিম আঘাত হানবার জন্য প্রস্তুত তাঁর নির্দেশেই তাই অবশেষে আজ আহীনের ডাকে এই মন্ত্রণাসভার আয়োজন 

ক্রমাগত ঝলক দিয়ে চলা চিন্তাতরঙ্গগুলো সুষ্ঠুভাবেই তাঁর নির্ধারিত পথে চূড়ান্ত সিদ্ধান্তের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল কিন্তু হঠাৎ তার মধ্যে একটি চিন্তাসূত্র ছন্দ ভেঙে সরে আসতে হঠাৎ সতর্ক হয়ে উঠলেন দোরাদাবু তাঁর চেতনা সংহত হয়েছে ওই বিদ্রোহী চিন্তাসূত্রের দিকে

নিজের চিন্তাগুলোকে সামান্য সাজিয়ে নিলেন মার্জক তারপর বললেন, “আমার পরামর্শ অন্য ম্হিরি নগরীতে আমি একাধিকবার যাতায়াত করেছি যতটুকু বুঝেছি, তাতে এরা যথেষ্ট রণনিপুণ হলেও, ইন্দাতীরের মহান দোরাদাবুর সৈন্যদলের সামনে তা এক ফুৎকারেই উড়ে যাবে হয়তো কিন্তু দুর্বলতর সেনাবলের পাশাপাশি এদের যে অন্য সম্পদের খোঁজ আমি পেয়েছি, তা অতুলনীয় ম্‌‌হিরির দানব বাসিন্দারাই সেখানকার প্রকৃত সম্পদ ইন্দাতীরে নগর গড়ে ওঠবার বহু আগেই তারা সেখানে আধুনিক নগর গড়েছিল শিল্পে, কৃষিপ্রযুক্তিতে, ধাতুবিদ্যায় এই দানবরা অকল্পনীয় উন্নতি করেছে আমরা বণিক বিশ্বব্যাপী বাণিজ্য করে বেড়াই উর, তেলমুন্দ, কিশ, মুন্দিগ্র এহেন বহু নগরীতেই তাদের পণ্যসামগ্রীর খ্যাতি আমাদের নজর এড়ায় না তাই আমার বক্তব্য একটাই, একটা রক্তাক্ত জনশূন্য নগরীর পরিবর্তে যদি এদের সঙ্গে ইন্দাতীরের নগরমণ্ডল একটি লাভজনক বাণিজ্যচুক্তি করে…”

সাবধান মার্জক! আপনি মহান দোরাদাবুর সুনির্দিষ্ট আদেশের বিরুদ্ধে…”

আমি আমার কর্তব্য পালন করছি মহাপুরোহিত,” আহীনকে থামিয়ে দিয়ে ফের বলে উঠলেন মার্জক, “আমার প্রথম কর্তব্য ইন্দাতীরের নগরগুলির উন্নতির প্রতি কোনো ঈশ্বরের প্রতি…”

উত্তপ্ত বিদ্রোহী চিন্তার বিপজ্জনক ছোবলটা সরাসরি দোরাদাবুর চেতনায় ঘা দিল এসে এই বণিক ঠিক বলছে না ভুল বলছে তা বড়ো কথা নয় কথা হল, বণিকসমাজের এই প্রতিভূ জনসমক্ষে স্বয়ং দোরাদাবুর প্রতি আনুগত্যকে অস্বীকার করবার কথা ঘোষণা করবার দুঃসাহস দেখাচ্ছে এরা তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বী হয়ে উঠতে চায়?

কর্তব্য স্থির করে নিলেন গোলকদেবতা না তাঁর হাতে নয় আহীনের হাতে, উন্মুক্ত সভায় এর শাস্তি হওয়া প্রয়োজন সামনেই যুদ্ধ আসন্ন সে যুদ্ধে ম্হিরি নগরীতে উপস্থিত থেকে তাদের সহায়তা করবার ক্ষমতা থাকবে না দোরাদাবুর বা তাঁর সন্তানগোলকদের যুদ্ধ ওই পরজীবিদের নিজেদের লড়তে হবে সে যুদ্ধের আগে তাদের নেতাকে নিছক দোরাদাবুর ক্রীড়নক নয়, একজন স্বাধীন কঠোর শাসক হিসবে তার সৈন্যদের সামনে তুলে ধরা প্রয়োজন সেজন্য, এযাত্রা অবাধ্য বণিককে শাস্তিদানে ভার নিতে হবে একজন পরজীবিকেই

এবারে, চিন্তার একটা আকর্ষী বাড়িয়ে ধরলেন আহীনের মস্তিষ্কের উদ্দেশ্যেআহীনের মস্তিষ্কের স্নায়বিক তরঙ্গের গতির সঙ্গে এক লয়ে বাঁধা, তীব্র শক্তিশালী সে আকর্ষীতরঙ্গ পরমুহূর্তেই তীব্র অনুরণন তুলল আহীনের মস্তিষ্কে

***

হঠাৎ মাথার মধ্যে যেন একটা বিস্ফোরণ ঘটে গেল আহীনের তীব্র ছুরিকাঘাতের মত একটা যন্ত্রণা যেন ফালা ফালা করে দিচ্ছে তার মস্তিষ্ককে সুতীব্র সেই ব্যথার ঢেউ যেন লক্ষস্বরে একসঙ্গে একটি কথাই বলে চলেছিল তাকেমৃত্যুমৃত্যুদণ্ড দিতে হবে এই অবাধ্য নিম্নজাতীয় বণিককে সে ঈশ্বরবিরোধীএকজন ঈশ্বরবিরোধীর কী শাস্তি দেন মহাপুরোহিত আহীন তা এই নগরের জেনে রাখা প্রয়োজন

একটা অবোধ্য গর্জন করে হঠাৎ তাঁকে উঠে দাঁড়াতে দেখে বাকি পুরোহিতরাও উঠে দাঁড়িয়েছিল একযোগে অশান্ত হয়ে উঠে নিজের নিজের অস্ত্র উঁচিয়ে ধরেছিল, পুরোহিতদের ঘিরে থাকা মন্দিরসেনাদের দলটিও উঁচিয়ে ধরেছিল আহীনের আদেশের অপেক্ষায় কিন্তু সে অস্ত্র তাদের কাজে লাগাবার কোনো প্রয়োজন হল না একেবারে হঠাৎ করেই এগিয়ে এসে এক সৈনিকের হাত থেকে তার সুদীর্ঘ ভল্লটি কেড়ে নিলেন আহীন তারপর সামনে দাঁড়ানো মার্জকের বুকে সজোরে সেটি বিঁধিয়ে দিয়ে আসুরিক শক্তিতে ভল্লে গেঁথে ছটফট করতে থাকা শরীরটাকে শূন্যে তুলে ধরলেন

ভয় পেয়েছে সভায় উপস্থিতি অন্যান্য পুরোহিতরা কৃশকায় এই প্রৌঢ়ের শরীরে হঠাৎ করেই এহেন মত্তহস্তির শক্তির স্ফুরণ, প্রৌঢ় পুরোহিতের শান্ত মুখচ্ছবি বদলে গিয়ে সেখানে এক দানবিক মুখভঙ্গীর আত্মপ্রকাশ তাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছিল সেই মুহূর্তে ভল্লে গাঁথা অবস্থায় ছটফট করতে থাকা শরীরটা থেকে ঝরে পড়া অবিশ্রাম রক্তধারায় স্নান করতে করতেই আহীনের গম্ভীর গলাটা ছড়িয়ে পড়ছিল গোটা ঘর জুড়ে, “নীচজাতীয় বণিকদের এই প্রতিভু ঈশ্বরের অবমাননা করবার শাস্তি পেয়েছে ভল্লে গাঁথা অবস্থায় এর শরীর মন্দিরদুর্গের প্রাচীরে আজ থেকে এক পক্ষকাল গাঁথা থাকবে গাঁথা থাকবে সমগ্র বণিকজাতির উদ্দেশ্যে সতর্কবার্তা হিসাবে আজ থেকে মঞ্জাদাহিরের নেতৃত্বে ইন্দাতীরের সমস্ত নগরীর একমাত্র লক্ষ্য হবে ম্হিরির পতন তার বাসিন্দাদের নির্মূল করা মহাপুরোহিত আহীনের এই আদেশ অমান্য করবার একমাত্র শাস্তি হবে ভল্লাগ্রে মৃত্যুদণ্ড

।২।

একটি মহৎ আত্মত্যাগ

“মাণ্ডুপ…”

চাপা গলার ডাকটা পেয়ে মাণ্ডুপ চমকে উঠে চোখ খুলে তাকাল। না। ঘুম নয় ঠিক। আধো ঘুম আধো জাগরণে হাজারো চিন্তা ও দুঃস্বপ্নের উত্তেজনা এতক্ষণ ঘিরে ছিল তাকে। না, আগামীকাল ভোরে অজানা ম্‌হিরি নগরীর দিকে যাত্রা শুরুর উত্তেজনা নয়, চিন্তা ও দুঃস্বপ্নগুলির উৎস ছিল সদ্য আগত ম্‌হিরির সৈন্যদলটির কিছু কাজকর্ম ও তাদের কথাবার্তা থেকে সংগ্রহ করা কিছু তথ্য।

সন্ধ্যার মুখমুখ প্রহরীদলটি এসে এইখানে পৌঁছায়। এরা সকলেই মহিষারূঢ় দক্ষ সৈনিক। সঙ্গে করে বৃষচালিত একটি যান নিয়ে এসেছে তারা। কিছুকাল আগে ম্‌হিরির দুই রাজপুরুষ যে যুদ্ধরথ নিয়ে এসেছিলেন, এ যানটি তার তুলনায় অনেকটাই বড়ো ও মজবুত গড়ণের। তবে এর যাত্রীবাহী অংশটি একটি প্রশস্ত কাঠের পাটাতন। দুটি অতিকায় গাছের গুঁড়ির ভারী চাকতির ওপরে তা দৃঢ়ভাবে বসানো। এখানে এসে পৌঁছোবার পর তারা যানটিকে মাণ্ডুপের খাঁচার কাছে নিয়ে এসে দীর্ঘক্ষণ ধরে খাঁচার মাপজোক নিয়ে যানের পাটাতনের গায়ে ধাতুনির্মিত কিছু কীলক স্থাপন করে। তারপর সকলের মিলিত শক্তিতে মান্ডুপসহ খাঁচাটি তুলে নিয়ে পাটাতনের ওপর বসিয়ে সেই কীলকগুলির সঙ্গে তাম্রনির্মিত সুক্ষ্ম রজ্জু দিয়ে তাকে সংযুক্ত করেছে। আশ্চর্য এই রজ্জুগুলো মাণ্ডুপের মনে বিস্ময়ের উদ্রেক করছিল।দেখতে অবিকল সুতোর মত জিনিসগুলি অমিত শক্তি ধরে। যানের ওপর খাঁচাটিকে আটকে দেবার পর মনে হচ্ছিল যেন মাটির গভীরে প্রোথিত স্তম্ভের মতই অনড় হয়ে উঠেছে তা পাটাতনটির ওপরে।

অপ্রত্যাশিত ব্যাপারটা একটা গভীর হতাশা ছড়িয়ে দিয়েছিল মাণ্ডুপের মনে। তার মুক্তির জন্য যে পরিকল্পনা করেছিলেন দৈমিত্রি, খাঁচাটিকে এইভাবে বেঁধে দেয়ায় সে পরিকল্পনা কাজ করবার আর কোনো উপায় রইল না।

এই হতাশাটাই তাকে সহসা ক্ষিপ্ত করে তুলেছিল। অবরুদ্ধ ক্রোধ আর হতাশায় বারংবার খাঁচার গায়ে সর্বশক্তি দিয়ে আঘাত করছিল সে। খানিক দূরে বন্ধনরজ্জুতে জড়ানো দৈমিত্রির সহানুভূতি মাখানো চোখদুটি তার সেই অসহায় ক্রোধকে নীরবে দেখছিল কেবল। একটি শব্দও উচ্চারণ করেননি তিনি।

একটা ক্ষিপ্ত জন্তুর মতই তাকে খাঁচার গায়ে ক্রমাগত ধাক্কা দিতে দেখে সৈনিকদের একজন তার দিকে একটি ভল্ল তুলে ধরেছিল। কিন্তু তাদের দলনেতা প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই এগিয়ে এসে সৈনিকের সে চেষ্টাকে প্রতিহত করে ও নীচুস্বরে তাকে বলে, “এর শরীরে আঘাত করা নিষিদ্ধ। মহাপুরোহিত তাঁর শল্য-অনুসন্ধানের জন্য সুস্থ ও অক্ষত অবস্থায় এই দেহটি চান।”

সৈনিকটি নতুন। মঞ্জদাহির থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে যাওয়া মানুষগুলিকে নিয়ে ঠিক কী করা হয় তা তার জানা ছিল না। খাঁচায় আটক এই বন্য কিশোর যে তাঁদের ভাষা বুঝবে না এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন ম্‌হিরি দলপতি। তাই অক্লেশে মাণ্ডুপের সামনেই তার দেহ ও মন নিয়ে ঠিক কোন অনুসন্ধান চালানো হবে ম্‌হিরির পরীক্ষাগারে তার একটি বিস্তারিত বিবরণ তিনি দিয়েছিলেন অধীনস্থ সৈনিককে। সুললিত ও অলঙ্কারবহুল ম্‌হিরির ভাষায় বলে যাওয়া সেই বিবরণ মাণ্ডুপের মেরুদণ্ডে একটি হিমস্রোত বইয়ে দিচ্ছিল। এবং সর্বশেষে দলপতি একটি রহস্যময় কথা বলেন। নদী উপত্যকা থেকে অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া বন্দিদের ক্ষতবিক্ষত অথচ পূর্ণ সচেতন শরীরগুলিকে একটি শেষ পরীক্ষার জন্য নগরকেন্দ্রে ‘জ্যোতিগৃহ’ নামের একটি কাষ্ঠনির্মিত পঞ্চভূজাকৃতি প্রাসাদে নিয়ে যাওয়া হয়। এইখানেই ম্‌হিরির শ্রেষ্ঠ প্রযুক্তিবিদরা গড়ে তুলছেন, ইন্দাতীরের মনরাক্ষসের বিরুদ্ধে তাঁদের অমোঘ অস্ত্র। সে অস্ত্রের মূল উপাদান সুদূর উর রাজ্যের পার্শ্ববর্তী ইফ্রাত নদীর কূলের কোনো পাহাড় থেকে আসা একখণ্ড পাথর। তার বিষয়ে বিশেষ কিছু জানা নেই দলপতির। কারণ সেই জ্যোতিগৃহের কাছে কোনো মানুষের যাওয়া নিষিদ্ধ। কেবলমাত্র বিশেষ অনুমতিপ্রাপ্ত কিছু প্রযুক্তিবিদ পুরোহিত আপাদমস্তক সীসানির্মিত বর্মে সজ্জিত হয়ে সেই পাথরের কাছাকাছি যেতে সক্ষম। বন্দিদের নগ্নমস্তকে সেই গৃহে প্রবেশ করিয়ে প্রযুক্তিবিদরা তার বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া নথীভূক্ত করেন। সে সময় বন্দির মৃত্যুযন্ত্রণার ভয়াবহ আর্তনাদ শুনলে নাকি অতিবড়ো সাহসীরও হৃৎকম্প হয়।

রাত্রি প্রথম প্রহর অতিক্রান্ত হবার পর প্রহরীরা তাকে সেইভাবে রেখেই দস্যুদের শিবিরে ফিরে গেছে। তারা ফিরে যাবার পর, গভীর অন্ধকারের ভেতরে দৈমিত্রির শান্ত গলাটা ভেসে এসেছিল, “ভয় একজন যোদ্ধার সবচেয়ে বড়ো বন্ধু মাণ্ডুপ। ভয় তার শক্তি ও বুদ্ধির শেষ বিন্দুটিকেও নিংড়ে বের করে এনে তাকে জয়ী হতে সাহায্য করে। কিন্তু ভয় পেয়ে বুদ্ধিনাশ হলে তা যোদ্ধার পরাজয়ের কারণ হয় জানবে। অতএব, স্থির হও। মনে রেখো মৃত্যুর আগের মুহূর্ত অবধি জীবনের আশা থাকে। ভাবো মাণ্ডুপ। বিগত দুটি দিন ধরে ম্‌হিরি বিষয়ক যে তথ্যগুলি আমার কাছে জেনেছ সেগুলিকে নিয়ে মনে মনে চর্চা করো। ম্‌হিরি নগরের গঠন, বিভিন্ন প্রবেশ ও নিষ্ক্রমণ পথ, নাগরিক ও সামরিক স্তরের বেশ কিছু সঙ্কেতবাক্য, মূল প্রাসাদ, সৈন্যাবাস ইত্যাদির অবস্থান, শস্ত্র সম্ভার…এদের একটি তথ্যও যেন ভবিষ্যতে বিস্মৃত না হও তার প্রযত্ন করো…”

“কিন্তু কী লাভ তাতে দৈমিত্রি?” মাণ্ডুপের অসহায় গলাটা অন্ধকারেই জবাব দিয়ে উঠেছিল, “সে ভবিষ্যত আসবার সম্ভাবনা তো নির্মূল হয়ে গেছে। এরা যে কৌশল করেছে তাতে নির্দিষ্ট স্থানে পৌঁছে নিজের শক্তিতে এই খাঁচাকে নিয়ে গড়িয়ে পড়া তো আমার পক্ষে আর সম্ভব হবে না…”

জবাবে মৃদু হেসেছিলেন দৈমিত্রি। তারপর বলেছিলেন, “উপায় হবে মাণ্ডুপ। মনে রেখ দৈমিত্রি এখনও জীবিত আছে। তার কৌশলের ভান্ডার এখনও ফুরিয়ে যায়নি।”

এরপর আর কথাবার্তা বেশিদূর এগোয়নি। দৈমিত্রি ফের নীরব হয়ে কোনো চিন্তায় ডুবে গিয়েছিলেন। আর মাণ্ডুপ একরাশ দুশ্চিন্তা নিয়ে ডুবে গিয়েছিল আধো ঘুম ও আধো জাগরণের মধ্যবর্তী এলাকায় ভয়াল দুঃস্বপ্নের মিছিলে। 

“মাণ্ডুপ…” ফের একবার নীচুগলার ডাকটা ভেসে এল কানের কাছে। অন্ধকারের মধ্যে দৈমিত্রির ফ্যাকাশে চামড়ার একটা আভাস দেখা যাচ্ছিল।

“তুমি… মুক্ত!!”

বিস্মিত গলায় শব্দগুলো উচ্চারণ করেই হঠাৎ বিষয়টা পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল মাণ্ডুপের কাছে। নিজের গলার মধ্যে লুকিয়ে রাখা স্ফটিকের টুকরোটির কথা দৈমিত্রি কথায় কথায় তাকে আগেই জানিয়েছিলেন। তাহলে তারই সাহায্যে এবারে নিজের বন্ধনরজ্জুর গ্রন্থি খুলে ফেলেছেন দৈমিত্রি! অথচ তিনি তো বলেছিলেন, তাকে রক্ষা না করে তিনি একা এখান থেকে…

একটা করুণ হাসি খেলে গেল মাণ্ডুপের মুখে। অন্যায় কিছু করেননি দৈমিত্রি। অনেক ভেবে যখন বুঝেছেন মাণ্ডুপকে বাঁচাবার কোনো উপায় নেই আর, তখন, হয়তো বাধ্য হয়েই নিজের জীবনরক্ষার কথা ভেবেছেন তিনি। তবে এতে সে তাঁর দোষ দেখে না। সে নিজে হলেও তো তাই-ই করত। একজন প্রকৃত যোদ্ধা কখন পিছু হঠতে হয় তা জানে।

“বিদায় দৈমিত্রি। ফিরে যাও তুমি তোমার দেশে, তোমার ছেলের কাছে। তোমাদের মঙ্গল হোক।”

“এত তাড়াতাড়ি বিদায় সম্ভাষণ কোরো না মাণ্ডুপ,” অন্ধকারেই মৃদু হাসলেন দৈমিত্রি, “তার চেয়ে, সাবধানে নিজের খাঁচাটিকে একবার নেড়ে দেখো তো!”

একটু বিস্মিত হয়েই খাঁচার শলাকা দৃঢ়মুষ্টিতে ধরে সামান্য ঝাঁকুনি দিল মাণ্ডুপ। তারপর পাটাতনের বুকে ভগ্নগৃহের মত দুলে ওঠা খাঁচাটিকে ফের স্থির করে ধরে বিস্মিত স্বরে নীচুগলায় বলল, “এর বন্ধন দুর্বল হয়েছে! কিন্তু কীভাবে… কোন কৌশলে তুমি এদের নজর এড়িয়ে …”

“নজর আড়াতে কোনো কৌশল প্রয়োজন হয়নি মাণ্ডুপ। কারণ এই মুহূর্তে কোনো নজরদার এখানে উপস্থিতি নেই,” বলতে বলতে মাথা নাড়লেন দৈমিত্রি, “ভেবে দেখো মাণ্ডুপ। জায়গাটা শ্বাপদসঙ্কুল। রাত্রে উন্মুক্ত জায়গায় কেউ থাকলে তার প্রাণ সংশয় হবার সম্ভাবনা আছে। তাদের মূল্যবান শিকারটি ধাতব খাঁচায় শ্বাপদের আক্রমণ থেকে সম্পূর্ণ নিরাপদ। এই শ্বেতাঙ্গ দস্যুটি শ্বাপদের খাদ্য হলে তাতে তাদের ক্ষতিবৃদ্ধি নেই বিশেষ। অতএব রাত্রি প্রথম প্রহর শেষ হবার পর এরা সকলেই যার যার শিবিরের নিরাপত্তায় ফিরে গেছে।  সেই সুযোগে আমার তীক্ষ্ণধার স্ফটিকটিকে বের করে এনে তার সহায়তায় নিজের বন্ধনরজ্জুর গ্রন্থি কাটতে আমার বিশেষ সমস্যা হয়নি। আর বের হয়ে এসে নির্জনতার সুযোগে এতক্ষণ ধরে ধীরে ধীরে গো-যানের সঙ্গে আটকানো খাঁচার ধাতব বন্ধনরজ্জুগুলির পাক আলগা করে দিয়েছি আমি। সঠিক মুহূর্তে প্রবল একটা ধাক্কায় এইবার তা উলটে যেতে সমস্যা হবে না।

“তবে মনে রেখো। পরের দিন যখন গাড়িটি রওয়ানা হবে তখন তার স্বাভাবিক চলনে খাঁচার কোনো দুলুনি যেন না ওঠে তা খেয়াল রাখতে হবে তোমাকে। যাত্রাপথে তার শলাকাগুলিকে দৃঢ়হাতে ধরে থাকতে হবে তোমাকে তাই। একমাত্র সঠিক মুহূর্ত আসবার পর…”

ফের একবার খাঁচাটিকে নেড়ে দেখল মাণ্ডুপ। হয়তো খানিক দুর্বল হয়েছে তা, কিন্তু তবু, একার শক্তিতে তাকে ভূপাতিত করা হয়তো কঠিন হবে। কিন্তু তবু, চেষ্টা তো করা যাবে একটা! দৈমিত্রির দিকে তাকিয়ে কৃতজ্ঞ স্বরে সে বলল, “হয়তো কাল আমার জীবন রক্ষা হবে। হয়তো হবে না। কিন্তু তবু তুমি আমার জন্য যা করলে তার জন্য অসীম কৃতজ্ঞতা রইল বন্ধু। এইবার তুমি রওনা হও। সকাল হতে বিলম্ব নেই আর। শিবির একবার জেগে উঠলে…”

নীরবে মাথা নাড়লেন দৈমিত্রি, “ভুল বুঝেছ তুমি মাণ্ডুপ। খাঁচার বাঁধন অতিরিক্ত দুর্বল করলে তা ধরা পড়বার সম্ভাবনা থাকবে। একে যেটুকু দুর্বল করেছি আমি তাতে তোমার একক শক্তিতে এর বাঁধন ছেঁড়া সম্ভব হবে না। দুজনের মিলিত শক্তির প্রয়োজন হবে এতে। আমাকে শেষ মুহূর্ত অবধি থাকতে হবে তোমার সঙ্গে।”

“তুমি… কীভাবে…”

“সহজ। এবারে আমি ফের বন্দিত্বে ফিরে যাব মাণ্ডুপ। কেবল এবারের রজ্জুবন্ধন কিছুটা দুর্বল হবে। সঠিক সময়ে তাকে ছুঁড়ে ফেলে…”

“কিন্তু তোমার নিজের জীবন…”

“শ্‌স্‌স্‌…কালকের পরিকল্পনাটা শেষবারের মত ঝালিয়ে নাও মাণ্ডুপ। জায়গাটায় আমরা রাত্রির প্রথম বা দ্বিতীয় যামে এসে পৌঁছাব। খাড়াই পর্বতগাত্রের গা বেয়ে উঠে যাওয়া পথের পাশে একটি ত্রিভূজাকৃতি প্রস্তরখণ্ড। সেখানে পৌঁছাবার ঠিক আগে আমি তোমাকে সঙ্কেত দেব। তারপর? বলো…”

“প্রস্তরখণ্ডের প্রান্ত থেকে দুটি সুবিশাল অর্জগবৃক্ষ খাদের বুকে বেঁকে গিয়েছে। তাদের ফাঁক দিয়ে এগিয়ে গেলে খাদের মাথা থেকে দশ হস্ত নীচে একটি ছোট্ট প্রস্তর অলিন্দ। ওপর থেকে চোখে পড়বে না। আপনার সঙ্কেত পাবার পর বৃক্ষদুটির কাছে পৌঁছানোমাত্র এক প্রবল আঘাতে খাঁচাটিকে উলটে দিয়ে তার চূড়ার খোলা এলাকা দিয়ে বের হয়ে এসে ওপর থেকে লাফ দিয়ে সেই অলিন্দে নেমে যেতে হবে। সেখানে কণ্টকময় লতাকুঞ্জের আড়ালে একটি প্রাকৃতিক সুড়ঙ্গমুখ পাব। সেই পথে অর্ধপ্রহর এগিয়ে গেলে সুড়ঙ্গের অন্যমুখ দিয়ে বের হয়ে মঞ্জাদাহিরের পথ! কিন্তু দৈমিত্রি… দৈমিত্রি… তুমি…”

পেছন ফিরে নিজের বন্ধনদণ্ডের দিকে এগিয়ে যেতে যেতেই ডাকটা শুনে ফের একবার ঘুরে দাঁড়ালেন মুন্দিগ্রের শ্বেতযোদ্ধা। এ ডাকে অভিজ্ঞ যোদ্ধার দার্ঢ্য নেই। আছে এক অসহায় কিশোরের আকুলতা। কঠিন মনটা হঠাৎ অকারণেই দ্রব হয়ে উঠল তাঁর। এগিয়ে গিয়ে নিজের শ্রমকর্কশ কঠোর আঙুলগুলি খাঁচার ফাঁকে ঢুকিয়ে দিয়ে কিশোরটির অশ্রুসিক্ত গাল স্পর্শ করলেন তিনি একবার। হয়তো এই শেষ। কারণ তাঁর দীর্ঘ অভিজ্ঞতায় তিনি জানেন, কাল যে পথে একে রক্ষা করবার কথা ভেবেছেন, তারপর তাঁর বেঁচে থাকবার কোনো সম্ভাবনা নেই আর। কিন্তু সে কথা বলে এই কিশোরকে ভারাক্রান্ত করা উচিৎ হবে না। নিজের মনের ভাবটা লুকিয়ে রেখে মৃদু হাসলেন দৈমিত্রি, “আমিও প্রচেষ্টা করব তোমার সঙ্গেই লাফ দেবার। তাতে সফল হলে ভালো, নইলে, যুদ্ধে মৃত্যুবরণের গৌরবের চেয়ে একজন যোদ্ধার আর কীই বা চাওয়ার থাকে?”

ধীরে ধীরে নিজের জায়গায় ফিরে যাচ্ছিলেন দৈত্যাকার মানুষটি। অন্ধকারে মৃদু খস খস শব্দ থেকে অনুমান করা যাচ্ছিল, ফের একবার নিজের শরীরে তিনি জড়িয়ে নিচ্ছেন তাঁর বন্ধনরজ্জুগুলিকে। নির্বাক চোখে সেদিকে তাকিয়ে দেখছিল মাণ্ডুপ। অন্যের জন্য এত অক্লেশে নিজের জীবন নিয়ে বাজি খেলতে পারে এমন কোনো মানুষের খবর সে তার ইন্দাতীরের সংক্ষীপ্ত জীবনে কখনো পায়নি।

নিজেকে ফের একবার বাঁধনে জড়িয়ে নিতে নিতে নিজের মনেই বিড়বিড় করছিলেন মুন্দিগ্রের সেই শ্বেতযোদ্ধা, “সুখী হও বালক। দীর্ঘজীবি হও তুমি। ইন্দাতীরের ওই মনরাক্ষস তোমার উপাস্য দেবতা। সে দেবতা না দানব আমি নিশ্চিত জানি না। বিদায়ের মুহূর্তে তাই একটিই প্রার্থনা আমার, সত্য প্রকাশিত হোক তোমার কাছে। তোমার মধ্যে সততা, সাহস ও দৃঢ়তা আছে। তারই বলে একজন ন্যয়াপরায়ণ মহাযোদ্ধা হয়ে ওঠো তুমি, সেই হবে তোমার ঋণশোধ। ঘুমাও তুমি বালক। কালকের পরীক্ষার জন্য যতটুকু সম্ভব শক্তি সঞ্চয় করে নাও এবারে…”

***

সন্ধ্যা নেমে এসেছে। তাদের মূল্যবান বন্দিকে নিয়ে সমস্ত দিন ধরে দীর্ঘ অর্ধমরু হেন পথ অতিক্রম করে এসেছে সৈন্যদলটি। এইবার মরুপ্রায় নিম্নভূমি ছেড়ে ম্‌হিরিগামী পার্বত্য পথ ধরেছে তারা। সামনে আকাশের দিকে মুখ করে খাড়া হয়ে ওঠা পাহাড়টির গায়ের গভীর অরণ্য সন্ধ্যার বাতাসে দোল খায়। তার গভীরে ইতিউতি জ্বলন্ত চোখ, বন্যজন্তুর কন্ঠস্বর শুনে টের পাওয়া যায় অরণ্য তার নৈশজীবনে জেগে উঠতে শুরু করেছে এইবার। অরণ্য চিরে এগিয়ে যাওয়া খাড়াই, আঁকাবাঁকা পথটি বিপজ্জনক। সামনে ও পিছনে মশালের আলো জ্বেলে তার লোহিতাভ দপদপে আলোয় পথ খুঁজে উঁচু থেকে আরও উঁচুতে উঠে চলে দলটি।

খাঁচা বহনকারী যানটির ঠিক পেছনে দৃঢ় রজ্জুবন্ধনে আবদ্ধ দৈমিত্রি মাথা নীচু করে হেঁটে চলেছেন। তাঁর দিকে তাকিয়ে চোখদুটো একবার মুছে নিল মাণ্ডুপ। সকালে রওয়ানা হবার আগে তাঁর বন্ধনরজ্জু ধরে টান দিতে সেটিকে ঢিলে দেখে প্রহরীরা খানিক বিস্মিত হয়েছিল। তারা সন্দেহ করেছিল রাত্রের অন্ধকারে পালাবার ব্যর্থ চেষ্টা করেছেন দৈমিত্রি। সেই অপরাধে এরপর ভয়াবহ শারীরিক নিগ্রহ চালানো হয়েছে তাঁর ওপরে। তারপর দৈমিত্রির গলায় ও পায়ে বহুগুণে দৃঢ় বন্ধনরজ্জুর ফাঁস পরিয়ে তার অন্যপ্রান্ত নিজের মহিষের সঙ্গে বেঁধে নিয়েছে একজন সৈনিক। সেই অবস্থাতেই বারংবার মাটিতে আছড়ে পড়তে পড়তে, রক্তাক্ত শরীরে হেঁটে চলেছেন সেই শ্বেতাঙ্গ বীর।

চলতে চলতেই সহসা দৈমিত্রির তীক্ষ্ণ নীলাভ চোখদুটো এসে স্থির হল খাঁচার দেয়াল ধরে দাঁড়ানো মাণ্ডুপের চোখে। সে দৃষ্টি থেকে হঠাৎ করেই যন্ত্রণার সব চিহ্ন উধাও। চোখাচোখি হতেই মৃদু হেসে হঠাৎ মাথাটি দুবার ওপর নীচে নাড়লেন তিনি। তাঁর রজ্জু ধরে মহিষে বসে থাকা সৈনিকটির কোনো সন্দেহ হল না তাতে। কেবল, মাণ্ডুপ ভেতরে ভেতরে সতর্ক হয়ে উঠল। দৈমিত্রি দৃঢ় বন্ধনে বন্দি। তিনি ক্লান্ত, রক্তাক্ত। অথচ তবু তিনি তাকে সঙ্কেত দিচ্ছেন, সময় প্রায় উপস্থিত! কিন্তু কী করে? কোন পথে…

তীক্ষ্ণ চোখে সামনে উঠে যেতে যেতে পাহাড় বের দিয়ে বেঁকে যাওয়া পথটার ওপরের অংশটার দিকে তাকাল মাণ্ডুপ। সঙ্গে সঙ্গেই ভেতরে ভেতরে তার হালকা একটা কাঁপুনি জেগে উঠেই স্থির হয়ে গেল ফের। সামনে, খানিক উঁচুতে, পথের মাথায়, হাতের ডাইনে দেখা দিয়েছে দুটি ঝুঁকে পড়া অতিকায় অর্জগবৃক্ষের মাথা…মশালের দপদপে আলো তার ঝাঁকড়া পত্রমুকুটের মসৃণ পাতাগুলিতে লেগে মৃদু ঝিলিক তুলছিল।

ঠিক কী করবেন দৈমিত্রি সে নিয়ে তখন আর ভাববার অবকাশ ছিল না মাণ্ডুপের। একজন শিক্ষিত যোদ্ধার মতই তখন সে নির্দেশের কারণ বা উপযোগিতার কথা ভুলে গিয়ে তাকে পালনের জন্য নিজেকে তৈরি করে তুলছিল। আর তারপর…

উঠতে উঠতেই হাতে বাঁয়ে বেঁকে গিয়েছে সরু পার্বত্য পথ। বাঁকটার মুখে এসে গতি কমিয়ে ফেলেছিল গোটা দলটাই। হাতের ডাইনে পাহাড়ের গা থেকে গভীর খাদের ওপর মুখ বাড়ানো একটুকরো পাথর জেগে আছে কেবল।তার ওপর যেন প্রায় একই গুঁড়ি থেকে মাথা উঁচিয়েছে দুটি অতিকায় অর্জগবৃক্ষ। সেটুকু বাদে, বেঁকে যাওয়া বিপজ্জনক শূঁড়িপথটার ডানদিকটা সম্পূর্ণই অরক্ষিত। সাবধান না হলে সামান্য পদস্খলনই এমন জায়গায় মৃত্যুর কারণ হতে পারে।

সৈন্যদলের ঠিক মাঝখানে থাকা বৃষচালিত যানটি খাঁচা নিয়ে এই গাছদুটির কাছাকাছি পৌঁছে খুব সাবধানে পায়ে পায়ে অন্যপাশের দিকে এগোচ্ছিল। ঠিক সেইমুহূর্তেই তাকে টেনে নিয়ে চলা বৃষদুটির ঠিক পেছনে একটা গভীর গর্জন উঠল…

এ গর্জন এই বৃষেরা চেনে। শিকার ধরবার পূর্বমুহূর্তে ঠিক এইভাবেই গর্জন তুলে শিকারকে হতচকিত করে দেয় অরণ্যসম্রাট বাঘ! শব্দটা তাদের বহুজন্মপালিত প্রবৃত্তিকে জাগিয়ে তুলল মুহূর্তে।হঠাৎ আর্তনাদ করে প্রবলবেগে লাফ দিল তারা সামনের দিকে। তাদের চালক অমানুষিক দক্ষতায় তাদের ছিটকে যাওয়াটা আটকেছিল বটে, কিন্তু ততক্ষণে লাফের ধাক্কায় তাদের দেহসংলগ্ন গাড়িটি প্রবল বেগে দুলে উঠেছে। সেই তীব্র ঝাঁকুনি ও তার সঙ্গে মাণ্ডুপের প্রবল ধাক্কার যৌথ শক্তিতে তার পাটাতনের ওপরে দুর্বলভাবে আটকানো খাঁচাটা তার বাঁধন ছিঁড়ে আছড়ে পড়েছে অর্জগবৃক্ষদুটির ফাঁকে…

dharabahiksindhu83

খাঁচার খোলা উপরিভাগ দিয়ে দ্রুতপায়ে বের হয়ে এসে নীচের অন্ধকার খাদের দিকে নিজের শরীরটা ছেড়ে দিতে দিতে এক মুহূর্তের জন্য মাণ্ডুপের চোখে পড়েছিল, গলা থেকে উপর্যুপরি দুবার শ্বাপদের শব্দটা বের করেই উন্মত্তের মত হেসে উঠেছেন দৈমিত্রি। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই তীক্ষ্ণধার অস্ত্রের কোপে ধড় থেকে ছিন্ন হয়ে তাঁর মাথাটা মাণ্ডুপের পাশ দিয়ে গড়িয়ে গেল নীচের দিকে। মাণ্ডুপের শরীর ততক্ষণে আছড়ে পড়েছে পাহাড়ের গায়ের সেই গোপন, সরু অলিন্দের ওপরে।

আছড়ে পড়েই একখণ্ড পাথরকে চেপে ধরে নিজের গড়িয়ে যাওয়া আটকেছিল মাণ্ডুপ। আর তখনই পায়ের কাছে উষ্ণ ও ভেজা একটা স্পর্শ পেয়ে হাত বাড়িয়ে দিল সে সেইদিকে। তারপর অন্ধকারেই, হাতে উঠে আসা ছিন্নমুণ্ডটাকে জড়িয়ে ধরে একমুহূর্তের জন্য বজ্রাহত হয়ে বসে রইল সে। দৈমিত্রি যে এই পথে তাকে রক্ষা করবেন তা সে স্বপ্নেও কল্পনা করেনি।

তবে শোক করবার মুহূর্ত সেটা নয়। পরমুহূর্তেই তাই মুণ্ডটা হাতে ধরে উঠে দাঁড়াল সেই কিশোর। তারপর সামনে পাহাড়ের দেয়ালের গায়ে গজিয়ে ওঠা ঘন ঝোপগুলোর তীক্ষ্ণ কাঁটার আঘাত অগ্রাহ্য করে সে ডুব দিল তার গভীরে। কয়েক মুহূর্তের মধ্যে তার কোনো চিহ্ন রইল না সেই সঙ্কীর্ণ অলিন্দের ওপরে।

যতক্ষণে ওপর থেকে সৈনিকদের মশালের আলো এসে সেই অলিন্দে পড়ল, সেই সময়টুকুর মধ্যেই তার শরীর কাঁটাঝোপের আড়ালে লুকানো সুড়ঙ্গ বেয়ে চিতাবাঘের ক্ষিপ্রতায় এগিয়ে চলেছে সুড়ঙ্গের গভীর থেকে গভীরতর এলাকার দিকে।

চলতে চলতে বুকের কাছে ধরে রাখা দৈমিত্রির ছিন্নমুণ্ডটার কাছে একটা প্রতিজ্ঞা করছিল মাণ্ডুপ। এই মৃত্যুর প্রতিশোধ সে নেবে। মৃত্যুর বদলে মৃত্যু দিয়ে দৈমিত্রির ঋণ চোকাতে ওই ম্‌হিরি নগরীকে…

দুর্গম, অজেয় ম্‌হিরি। দৈমিত্রি সে শহরের বিস্তারিত বিবরণ শুনিয়ে গিয়েছেন তাকে। আক্রমণকারী সেনাদল যতই শক্তিমান হোক না কেন, ম্‌হিরির পতন ঘটানো প্রায় অসম্ভব। তার দুপাশে মার্জাগ ও বুলানির খরস্রোতা জলধারা, পেছনদিকে আকাশচুম্বী বুলানি গিরিসঙ্কট। সম্মুখভাগে বিস্তীর্ণ অর্ধমরু অঞ্চল দিয়ে সেখানে পৌঁছোবার একমাত্র পথ। এই একটিমাত্র দিক থেকে আক্রমণ করে তাকে বশীভূত করা কঠিন, সে তার সৈন্যবল যতই দুর্বল বা সবল হোক। কিন্তু তবু, সেই দুষ্কর কর্তব্য পালনের জন্য কঠোর প্রতিজ্ঞা জ্বলে সেই কিশোরের চোখে। সেই প্রতিশোধ নেবার পথে প্রথম ধাপ হবে তার মঞ্জাদাহির নগরীতে পৌঁছানো। সেখানে, ঈশ্বর দোরাদাবুর সৈনিক হয়ে, তাঁর শক্তিতে শক্তিমান হয়ে সে একদিন এগিয়ে যাবে দানবনগরী ম্‌হিরির পথে। আর সেইদিন… 

একসময় সুড়ঙ্গ শেষ হয়ে এল। চলতে চলতেই তা নীচের দিকে দীর্ঘপথ নেমে এসে অবশেষে পর্বতের পাদদেশে একটি জায়গায় এসে অন্য একটা গুহামুখে শেষ হয়েছে। এখান থেকে খানিক দূরে দীর্ঘ পথ চলেছে দক্ষিণ পূর্বে মঞ্জাদাহিরের দিকে। সেদিকে তাকিয়ে একটা লম্বা শ্বাস ছাড়ল মাণ্ডুপ। তারপর দৈমিত্রির ছিন্নমুণ্ডটিকে পাথর ও নুড়ির একটি স্তূপের গভীরে সযত্নে সমাধি দিয়ে, তার ওপর পাথরের পর পাথর সাজিয়ে ছোটো একটি স্মৃতিস্তম্ভ গড়ল। সে কাজ শেষ হলে ক্লান্ত ও গভীর ক্রোধে উত্তপ্ত চোখ নিয়ে সেই তরুণ এসে দাঁড়াল মঞ্জাদাহিরগামী পথের বুকে।

ক্রমশ

শীর্ষচিত্র- অতনু দেব।

ভেতরের ছবি- মৌসুমী রায়  

 জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s