ধারাবাহিক উপন্যাস-সিন্ধু নদীর তীরে পর্ব ৩-পিটার বিশ্বাস-শরৎ ২০২১

সিন্ধুনদীর তীরে –প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্বচতুর্থ পর্বপঞ্চম পর্বষষ্ঠ পর্বসপ্তম পর্বঅষ্টম পর্বনবম পর্ব

IMG-20210913-WA0004

দ্বিতীয় অধ্যায়

কট্টাদিজ ও মঞ্জাদাহিরি (৩১০০ খৃপূ)

 

সময় হয়েছে। নিজের শরীরের গভীরে তার ইঙ্গিত পাচ্ছিল দোরাদাবু। দেহের কেন্দ্রে গলিত ম্যাগমার কুণ্ডে ঢেউ উঠেছে। গ্রহজীবের প্রাণরস। এইবার তার সামান্য একটা অংশ বাইরে বের হয়ে আসবে…

নিজের জন্মের সেই মুহূর্তটার কথা দোরাদাবুর স্মৃতিতে অক্ষয় হয়ে আছে। ভূমিকম্পে থরোথরো মায়ের শরীরের ফাটল বেয়ে সেই প্রথম তার বাইরে আসা। মাটিপাথরের এই শরীর তখন তার গড়ে ওঠেনি। সচেতন  ম্যাগমার একটা স্রোত। মাতৃগ্রহের সমস্ত স্মৃতি ও অভিজ্ঞতায় তা সমৃদ্ধ। তারপর, ভূমিকম্পের প্রচণ্ড ধাক্কায় ভর করে, আগুনের একটা ছোট্ট গোলকের রূপ নিয়ে মুক্তির উল্লাসে দূর আকাশের দিকে সেই উড়ান…

মনে আছে একসময় মায়ের আকর্ষণ ক্ষীণ হয়ে এসেছিল। অনেক পেছনে ধীরে ধীরে ছোট হয়ে আসছিল তাঁর নীল শরীর…

নিজের সদ্য পাওয়া আগুনে শরীর নিয়ে সেদিকে নিজের চেতনাকে মেলে ধরেছিল দোরাদাবু। টের পেয়েছিল, মায়ের স্মৃতি আর দীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার ভাগ জমা হয়ে আছে তার জ্বলন্ত শরীরে। কিন্তু তবু, আর সে মায়ের চেতনার অংশ নয়। সে স্বতন্ত্র। একজন স্বাধীন গ্রহজীব।

তারপর, উল্লাসের সেই ছুটও শেষ হয়েছিল একসময়। ঝলমলে নীল একটা তারার সংসারে নিজের কক্ষপথ খুঁজে নিয়েছিল সে। সেইখানে, দীর্ঘদিনের সাধনায় নিজের শরীর ঘিরে জমিয়ে তুলেছিল, মহাজাগতিক ধুলো আর তারাদের ছাইয়ের তৈরি এই শরীর…

তবে, এই বিরাট মরা গ্রহের বুকে সেই পথে সন্তানকে জন্ম দেবার কোনো পথ নেই। তার দেহ থেকে বের হয়ে আসা প্রাণরসের জ্বলন্ত ধারা কখনই এর করাল আকর্ষণকে হারিয়ে মহাশূন্যের আঁতুরঘরে পৌঁছোতে পারবে না। আর তাই…

সামনের দিকে একবার তাকিয়ে দেখল দোরাদাবু। সেখানে একটা তামার পাত্রে মাটি পাথর ও বিভিন্ন ধাতুর  একটা স্তূপ রেখে মন্দিরের দরজার সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছে আহিন। দরজার বাইরে আমহিরি নগরের এক হাজার তরুণ-তরুণী সুশৃঙ্খলভাবে দাঁড়িয়ে। তাদের হাতে বর্শার তামার ফলকে সূর্যের আলোর ঝলক। আজ তাদের উৎসবের দিন। আহিন সেদিকে মুখ করে গান গাইছিল। সুরেলা গলায় দ্রুতলয়ে বলে যাওয়া কথার স্রোত ভেসে চলেছিল যোদ্ধার বেশে সাজা মানুষগুলোর উদ্দেশে।  উৎসবের এই দিনে দোরাদাবুর গাথা শোনাচ্ছে সে তাদের।

গাথার কথাগুলোর দিকে মনোযোগ দিল দোরাদাবু। এই পরজীবীদের ভাবের আদান-প্রদানের এই পদ্ধতিটা তাকে এখনও অবাক করে। গলা কাঁপিয়ে বাতাস শব্দ তুলে…

 ***

“শোনো হে আমহিরির নগরবাসী। আজ এই পূণ্য তিথিতে, ঈশ্বর দোরাদাবুর সন্তান আসবার মুহূর্তকে দেখবার আগে তাঁর গাথা শুনে তোমরা নিজেদের পবিত্র করো। আমি, দোরাদাবুর প্রধান পুরোহিত আহিন, ঈশ্বরের প্রথম পুরোহিত মহান মুহিরার বংশধর, আজ তোমাদের সেই কাহিনি শোনাব।

“আদি পুরোহিত মুহিরার মুখে সুপ্রাচীন কালে এই গাথার সূচনা। মুহিরার সপ্তম পুরুষে পুরোহিতশ্রেষ্ঠ রিহাম প্রথম পোড়ামাটির পাটায় তাকে লিপিবদ্ধ করেন। তার পর থেকে পুরুষানুক্রমে আমরা, দোরাদাবুর প্রধান পুরোহিতের বংশধররা সেই মহান কাজকে এগিয়ে নিয়ে চলেছি…”

আহিনের উচ্চারণ করা শব্দগুলো ছবির পর ছবি তৈরি করছিল দোরাদাবুর মনে। মাত্রই পাঁচটা শতাব্দি। গ্রহজীবের জীবনে তা আর কতটুকুই বা! চল্লিশ থেকে পঞ্চাশ বছর গড় আয়ুর এই তুচ্ছ পরজীবীদের কাছে যেটা দূর অতীত, দোরাদাবুর কাছে তা নিতান্তই গতকালের ঘটনা যেন…

তার দক্ষ পরিচালনায় এরা আগুনকে নিয়ন্ত্রণ করতে শিখেছিল মুহিরার আমলেই। তারপর ধীরে ধীরে ধাতুর ব্যবহারেও তাদের অভ্যস্ত করে তুলেছে সে। উদ্ভাবনী ক্ষমতায় কোনো জুড়ি নেই এই পরজীবীদের। মস্তিষ্কের স্নায়ুসংযোগে সামান্য বদল ও তুচ্ছ দুটো বিদ্যা… এইটুকুই তার অবদান। অথচ সেইটুকুকেই কাজে লাগিয়ে, মুহিরার মৃত্যুর এক শতাব্দির মধ্যেই এরা বিস্ময়কর অগ্রগতি ঘটিয়েছে নিজেদের। আগুন দিয়ে শক্ত করে তোলা মাটির টুকরো জুড়ে জুড়ে গড়ে তুলেছে মাথা গোঁজবার ঠাঁই। ধাতুর ফলক দিয়ে মাটির বুক চিরে গড়ে তুলেছে ইচ্ছামত খাদ্যশস্য জন্মাবার প্রযুক্তি।

আর এইভাবেই ইন্দা নদীর তীরে এই আমহিরি জনপদকে একটা আদিম গ্রাম থেকে উন্নত শহরে বদলে দিতে এদের সময় লেগেছিল মাত্রই এক শতাব্দিকাল। কিন্তু মুখের ভাষাকে লিখিত অক্ষরে বদলে দিয়ে স্মৃতিকে চিরস্থায়ী রাখবার কৌশল আবিষ্কার করতে এদের আরো দুই শতাব্দি লেগে গিয়েছিল।

সেদিন চমকে উঠেছিল দোরাদাবু। পুরোহিত রিহাম সেদিন তার ছেলে সিনাক্ষকে নিয়ে এসেছিল তার মন্দিরে। নিতান্তই শিশু সে। এবং নিতান্তই অজ্ঞ। তার চেতনায় ইতিহাসের কোনো স্মৃতি খুঁজে পায়নি দোরাদাবু। সেটাই স্বাভাবিক অবশ্য। কারণ পনের বছর বয়স হবার আগে দোরাদাবুর গাথার পাঠ দেয়া হয় না আমহিরির মানুষকে।

প্রাথমিক প্রণাম ও পুজো সারবার পর রিহাম একটা পোড়ামাটির পাত তুলে দিয়েছিল সিনাক্ষর হাতে।সেইটি হাতে নিয়ে তার সামনে হাঁটু গেড়ে বসেছিল সিনাক্ষ।

ব্যাপারটায় শুরুতে কোনো অস্বাভাবিকতা খুঁজে পায়নি দোরাদাবু। এই পরজীবীরা তার কাছাকাছি এলে একেবারেই শিশুর মত আচরণ করে। জানে কোনো লাভ নেই, তবু নিজেদের রোজকার কাজে লাগা জিনিসপত্র উপহার নিয়ে এসে তার সুরক্ষাবলয়ের বাইরে বসে এমনি করেই হাঁটু গেড়ে তাকে উৎসর্গ করে। খাবার, পোশাক, গয়না, এমনকি জীবন্ত পশু অবধি নিয়ে আসে কেউ কেউ।

এই অর্থহীন কাজটার নামে এরা দিয়েছে পূজা। উপহার সামগ্রীগুলো অবশ্য তার পুরুতের দল মহানন্দে নিজেদের মধ্যে ভাগ করে নেয়। অতএব সে ধরে নিয়েছিল, নিজের ছেলের হাতে তেমনই আরো একটা অর্থহীন উপহার নিয়ে এসে তাকে দিয়ে ঈশ্বরের পূজা করাবার ইচ্ছা হয়েছে রিহামের।

আপাতদৃষ্টিতে উপহারটায় কোনো বিশেষত্ব অবশ্য দেখেনি দোরাদাবু। জিনিসটা এদের খাবার, পোশাক বা গয়না হতে পারে না। ঘরবাড়ি তৈরির জন্য এরা যে ধরণের মাটির পাটা আগুনে পুড়িয়ে শক্ত করে নেয় তেমনই পাট একখানা। কেবল একটু পাতলা এই যা।

তবে একটু বাদেই তার ঔদাসিন্য বদলে গিয়েছিল বিস্ময়ভরা কৌতূহলে। পাটাটার গায়ে কতগুলো এলোমেলো, অসংলগ্ন চিহ্ন খোদাই করা ছিল। আর সেদিকে চোখ রেখেই তরুণ গলায় সিনাক্ষ বলতে শুরু করেছিল দোরাদাবুর ইতিহাসের গাথা! চমকে উঠেছিল দোরাদাবু। এরা নিজের মস্তিষ্কের বাইরে, জড়বস্তুর মধ্যে নিজেদের স্মৃতিকে জমিয়ে রাখবার  কৌশল আবিষ্কার করেছে! 

গ্রহজীবরা প্রযুক্তি কাকে বলে জানে না। প্রকৃতি তাদের যে শক্তি দিয়ে সৃষ্টি করেছেন সেই বিপুল শক্তিই তাদের একমাত্র সম্বল। এইভাবে মাটি, আগুন ও কিছু চিহ্নকে ব্যবহার করে স্মৃতিকে চেতনার বাইরে জড়বস্তুর মধ্যে ধরে রাখবার যে কৌশল এরা গড়ে তুলেছে তা দেখে বিস্ময়ে স্তম্ভিত হয়ে গিয়েছিল দোরাদাবু।

বিস্ময়… এবং কিছুটা দুশ্চিন্তাও। একটা পুরোনো ভয়। একেবারে শুরুতে, এদের মস্তিষ্কের বিরাট ঘুমন্ত এলাকার একটা সামান্য অংশকে জাগিয়ে তুলেছিল সে। তবে সে কেবল, এদের তার হুকুম তামিল করবার উপযুক্ত করে তোলবার জন্য। সম্পূর্ণ মস্তিষ্কটার সম্ভাব্য বিপুল ক্ষমতার একটা আন্দাজ তার ছিল। তাই সে-পথে খুব বেশি এগোয়নি সে। তাহলে কি…

সন্দেহটা মনে আসতে দোরাদাবু রিহাম ও সিনাক্ষর চিন্তাতরঙ্গকে পাশাপাশি রেখে একটা বিশ্লেষণ করেছিল। এর ফলাফল তার  সন্দেহটাকে আরো দৃঢ় করে তোলে। ভুল করেছিল সে। এদের মস্তিষ্কের শক্তিকে সামান্য বাড়িয়ে তোলবার জন্য যে চেতনার আঘাতটা সে করেছিল গোটা বসতির মানুষজনের মাথায়, তাতে একটা শৃঙ্খলবিক্রিয়া চালু হয়ে গেছে এদের স্নায়ুতন্ত্রে। তার অজান্তে, তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে, প্রত্যেক প্রজন্মে খুব ধীরে ধীরে জাগ্রত অংশটার আয়তন ক্রমশ বেড়ে চলেছে এদের। প্রতি প্রজন্মেই সেটা বাড়ছে একটু একটু করে।

ফলে, এদের এত দ্রুত উন্নতির কারণটা তার সামনে পরিষ্কার হয়ে যায়।

এরপর, বিভিন্ন পথে চেষ্টা করেও এরপর এই শৃঙ্খলবিক্রিয়াটাকে আটকাতে পারেনি দোরাদাবু। স্নায়ুভিত্তিক চেতনা, তার মত গ্রহজীবের কাছে একেবারেই অপরিচিত একটা প্রাকৃতিক প্রযুক্তি। না জেনে, একেবারে গোড়াতেই সেই ঘুমন্ত দৈত্যকে জাগাবার যে মন্ত্র সে দিয়েছিল, তাকে ফিরিয়ে নেবার কৌশল তার জানা নেই।

সে বুঝতে পারছিল, ধীরে ধীরে তার নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাওয়া শুরু করেছে এই পরজীবীরা। একটা ভয় মাথা তুলছিল তার ভেতরে। অগুণতি পরজীবী! অগুণতি মহাশক্তিধর মস্তিষ্ক। লিখিত ভাষা উদ্ভাবন করে এরা এবার এই অগুণতি মস্তিষ্কের উদ্ভাবনী ক্ষমতাকে পুরুষানুক্রমে একত্র করবার কৌশল গড়েছে! এবারে একদিন…

একদিকে লক্ষ লক্ষ মহাশক্তিধর পরজীবী মস্তিষ্কের মিলিত শক্তি, আর একদিকে সে! একা!

পরজীবীরা গ্রহ খায়। পুরোনোকালের পর্যটক গ্রহেরা শ্বেতধারা নক্ষত্রপুঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় তার প্রমাণ পেয়েছিলেন…

বিষয়টাকে অতএব অঙ্কুরেই শেষ করে দেবার দরকার ছিল। দোরাদাবু অতএব সিদ্ধান্ত নিতে দেরি করেনি।

কাজটায় রিহামই তার সহায়ক হয় অবশ্য। একটা ছোটো কৌশল। রিহামের মস্তিষ্কে একটা নির্দেশ- জ্ঞান ঈশ্বরের দান। কেবল দোরাদাবুর উপাসক পুরোহিতরাই তার মালিক। তার বাইরে, তাকে তুচ্ছ মাটিপাথরের বুকে সঞ্চয় করে অযোগ্য মানুষের হাতে তুলে দেয়া মহাপাপ।

অক্ষরে অক্ষরে সে-নির্দেশ পালন করেছিল রিহাম। আমহিরির সাধারণ মানুষের বিদ্যার্জনের জন্য লিপির ব্যবহার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল এরপর। ততদিনে আমহিরির বহু মানুষের হাতে পৌঁছে যাওয়া লিপিবদ্ধ জ্ঞানচর্চার ক্ষমতাকে মুছে দেবার কাজটাও সুচারুভাবে সমাধা করেছিল সে। তার নিয়ন্ত্রিত সেপাইদের অস্ত্রে বহু বিদ্যার্থীর রক্ত ঝরেছে সেই সময়টা। ইন্দা-র নীল জল লাল হয়ে গিয়েছে তাতে। পুরোহিত পরিবারের বাইরে লিপিচর্চা এখন মৃত্যুদণ্ডযোগ্য অপরাধ এই নগরীতে।

তবে লিপির সীমাবদ্ধ ব্যবহার রিহাম করেছিল বইকি। দোরাদাবুকে সে অনুরোধ করেছিল, অন্তত দূরদূরান্তের জনপদদের সঙ্গে তাদের যে বাণিজ্য শুরু হয়েছে তার হিসাব রাখবার জন্য, কিংবা শহরের ঘরবাড়ি, মন্দির এদের মাপজোক ধরে রাখবার জন্য কিছু তুচ্ছ লিখিত সঙ্কেত ব্যবহারের অধিকার যাতে সাধারণ মানুষকে দেয়া হয়।

প্রস্তাবটার ব্যবহারিক গুরুত্ব ধরতে ভুল করেনি দোরাদাবু। উত্তরের বিস্তীর্ণ অঞ্চল জুড়ে অজস্র পরজীবী গোষ্ঠীর বসতি। তাদের কেউ কেউ ম্‌হিরা-র মত উন্নত, আবার অধিকাংশই প্রাচীন আমহিরির মতই আদিম। কিন্তু একটা বিষয়ে তাদের মধ্যে মিল আছে। লিখিত লিপির শক্তি তাদের কারো কাছে নেই। সেদিক দিয়ে দেখলে এই ব্যবহারগুলো আমহিরিকে তাদের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্ব দেবে। তার শক্তি বাড়িয়ে তুলবে। সেটা দোরাদাবুর প্রয়োজন। কারণ উত্তরে ম্‌হিরি(১) ও কিল্লিগুল(২) নামের দুটো প্রাচীন শহর এখনও শক্তিমান। আমহিরিকে কেন্দ্র করে যে সাম্রাজ্য গড়ে তোলবার স্বপ্ন সে দেখে, তার পথে ঐ দুটি প্রধান কাঁটা। তাদের উপড়ে ফেলবার জন্য আমহিরির আরো শক্তিশালী হওয়া দরকার।

dharabahik78

বাইরে দাঁড়ানো সশস্ত্র যুবকের দলটার দিকে চেতনাকে ছড়িয়ে দিয়ে একটুক্ষণ থেমে রইল দোরাদাবু। রিহামের যুগ কেটে গেছে সে অনেকদিন হল। মুহিরা থেকে শুরু করে গত পাঁচটা শতাব্দি তাঁর গিয়েছে উপযুক্ত প্রস্তুতি নিতে। এই পরজীবীরা স্বভাবতই যুদ্ধপ্রিয়। রিহামের আমলে শিক্ষা ও জ্ঞানার্জনের পথ বন্ধ করবার পর এদের সমস্ত উদ্ভাবনী শক্তিকে সে ঘুরিয়ে দিয়েছিল যুদ্ধ্যোদ্যম আর বাণিজ্যের দিকে। এতদিনে তার ফল পাবার সময় হয়েছে। শক্তি আর সম্পদ দুদিক দিয়েই এরা এইবারে প্রস্তুত। সাম্রাজ্যকে ছড়িয়ে দেবার জন্য পরবর্তী পদক্ষেপ নিতে হবে এবারে।

তবে, যে সাম্রাজ্যের স্বপ্ন সে দেখে, তার কেন্দ্রীয় শহর হবার যোগ্যতা এই শহরের নেই। সামান্যতম প্রাকৃতিক সুরক্ষাও নেই ইন্দা নদীর তীরের এই আমহিরি(৩) নগরীতে। তার জন্য উপযুক্ত জায়গার সন্ধান সে নিয়েছে দু’একটা নৈশ উড়ানে। এইবার সেদিকে এগোবার পালা।

*** dharabahik02

“ঈশ্বর দোরাদাবু আমাদের শক্তি দিয়েছেন। আমাদের মাথার ওপরে ছাদ, খেতের শস্য, রাত্রির অন্ধকারে অগ্নিদেবের নিরাপত্তা, শত্রুর আক্রমণ থেকে এই জনপদকে রক্ষা করে তাকে উন্নতির শিখরে নিয়ে পোঁছে দেয়া, এই সমস্তই সেই ঈশ্বরের দান…”

গাথার একেবারে শেষপর্যায়ে এসে পৌঁছেছেন এবার আহিন। দীর্ঘ কাহিনির একেবারে শেষ পর্যায়ে পৌঁছে এইবার ঈশ্বরের স্তুতিপাঠের পর্ব চলেছে তার, “আমরা সেই মহান ঈশ্বর দোরাদাবুর ভৃত্য। আজ ঈশ্বর তাঁর প্রথম সন্তানকে পৃথিবীতে আনবেন। তাঁর অসীম কৃপা, আর তাই তিনি সেই পূণ্যমুহূর্তের সাক্ষি হবার ডাক দিয়েছেন তোমাদের।

“তবে মনে রেখো, এ-সৌভাগ্য সকলের হয়নি। নগরীর শ্রেষ্ঠতম যোদ্ধারাই কেবল তার অংশীদার হতে পেরেছেন। কারণ যোদ্ধারাই পূণ্যবান। নিজের রক্তের বিনিময়ে তারা নগরীকে রক্ষা করে, রাজ্যের বিস্তার ঘটায়।”

জবাবে একটা মিলিত জয়ধ্বনির শব্দ জেগে উঠল অস্ত্র হাতে জড়ো হওয়া তরুণ-তরুণীদের দলটার মধ্যে।  তাদের চোখে জলের ধারা নেমেছে। এহেন সৌভাগ্যের বিনিময়ে ঈশ্বরের জন্য প্রয়োজনে প্রাণ উৎসর্গ করতে প্রস্তুত থাকবার প্রতিজ্ঞা ঘোষণা করছিল তারা।

সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন আহিন। তারপর বললেন, “ঈশ্বর দোরাদাবু মহান। তিনি পিতার মতই আমাদের অন্নবস্ত্র দেন, আবার প্রয়োজনে পিতার মতই স্নেহময় শাসনে অসৎ পথ থেকে সত্য ও ধর্মের পথে ফিরিয়ে আনেন তাঁর সন্তানদের। যে যতবড়ো পাপকর্মই করে থাকুক না কেন, অপার স্নেহে তাকে বুকে টেনে নিয়ে সেই পাপের নাশ করেন তিনি। আজও তেমনই এক পাপী তাঁর স্নেহের  আশীর্বাদ পাবে…”

বলতে-বলতেই তাঁর ইশারায় ঘাসে বোনা শক্ত দড়িতে বাঁধা এক তরুণকে দোরাদাবুর সুরক্ষাবলয়ের একেবারে সামনে এনে দাঁড় করানো হচ্ছিল। তার দিকে ইশারায় দেখিয়ে আহিন বললেন, “এই যুবককে দেখো। পশ্চিমের পর্বতমালার কোলে অবস্থিত দানবনগরী ম্‌হির। তারও পশ্চিমে পর্বতমালার অন্যপাড়ের মুন্দিগ্র(৪) প্রদেশ থেকে আসা এই গুপ্তচর গোপনে দোরাদাবুর মন্দিরের পুথিশালায় পবিত্র লিপিতে ধরে রাখা আমহিরির ইতিহাসের একটি পাটাতন চুরি করবার চেষ্টা করেছিল। যে লিপিতে কেবল ঈশ্বরের দাসানুদাস পুরোহিতদের অধিকার, যে লিপি সাধারণ মানুষের চোখে দেখাও মহাপাপ, এই গুপ্তচর তাকে চুরি করে আমহিরির সীমার বাইরে নিয়ে যাবার ষড়যন্ত্রে লিপ্ত হয়…”

জবাবে রাগী ভোমরাদের ডাকের মত একটা গুঞ্জন উঠে এল মন্দিরের চত্বরে। এক হাজার তরুণ-তরুণীর হাতের বল্লমের তামার ফলা ঝিলিক দিয়ে উঠেছে রোদের প্রখর আলোয়। এতবড়ো একটা পাপ যে কোনো মানুষ করতে পারে তা তাদের কল্পনার বাইরে ছিল। ক্রুদ্ধ গলায় তারা তাকে শাস্তি দেবার অধিকার দাবি করছিল।

গুপ্তচর তরুণটি এইবার কুঁকড়ে গেছে। তার নীল চোখে গভীর ভয়ের ছাপ। সেদিকে তাকিয়ে একটু হাসলেন আহিন। তারপর হাত তুলে যোদ্ধাদের শান্ত হতে বলে কোমল গলায় তরুণটিকে বললেন, “ভয় পেও না। তুমি সৌভাগ্যবান। আজ, সন্তান-জন্মের পূণ্যলগ্নে তৃপ্ত ঈশ্বর তাঁর শ্রেষ্ঠ পুরস্কারটি দেবার জন্য তোমাকে নির্বাচন করেছেন। আজ তিনি তোমাকে তাঁর বুকে স্থান দেবেন।”

ছেলেটি বয়সে তরুণ। কোনো অজানা আশঙ্কায় তার চোখদুটো ভয় পাওয়া হরিণের মত হয়ে উঠেছে। সেদিকে তাকিয়ে একটু হতাশা লাগছিল দোরাদাবুর। শক্তিশালী এই তরুণ হয়তো আমহিরির একজন উজ্জ্বল সৈনিক হতে পারত। কিন্তু তা আর সম্ভব নয়। রিহামের পর থেকে গত দুই শতাব্দি ধরে পুরোহিতদের সতর্ক নজরদারিতে গোপনে জ্ঞানচর্চার প্রতিটি অঙ্কুরকে ধ্বংস করা হয়েছে এই নগরীতে। আমহিরির পুরোহিতদের আশ্চর্য লিপিবিদ্যার খবর এখন দূরদূরান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। যেকোনো কৌশলে তার নাগাল পাবার জন্য ম্‌হির, কিল্লিগুল, এমনকি সুদূর মুন্দিগ্র থেকে এই নগরীতে অসংখ্য গুপ্তচরের আনাগোণা। কিন্তু এতকাল ধরে তাদের প্রত্যেককেই ধ্বংস করা হয়েছে সাফল্যের সঙ্গে। এ-নিয়মের ব্যত্যয় করা উচিত হবে না।

দোরাদাবু তৈরি হল। শারীরিকভাবে সে এদের সামনে দুর্বল। তুচ্ছ মাটিপাথরের একটা গোলক। আর তাই, নিজেকে ঘিরে সাইকিক শক্তির সুরক্ষাবর্মকে সে সবসময়  জাগিয়ে রাখে। এর ভেতরে পা দেবার সামর্থ্য নেই ওই পরজীবীদের। এই শক্তিতরঙ্গ তাদের উন্নত মস্তিষ্কে, অকল্পনীয় ভয়ের অনুভূতির জন্ম দেয়। কয়েক মুহূর্তের বেশি এর প্রভাবে থাকলে অকেজো হয়ে যায় গোটা মস্তিষ্কটাই।

তবে শাস্তি দেবার সময় অপরাধীকে এই কয়েক মুহূর্তের অবসরও দেয় না সে। সাইকিক বিচ্ছুরণের কম্পাঙ্ক কিছুটা বাড়িয়ে নেয়া কেবল। অদৃশ্য ছুরির মতই তা ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করে দেয় এদের সচেতন স্নায়ুমণ্ডলকে। মৃত্যু আসে চোখের পলকে।

হাত-পায়ের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছে অপরাধীর এবারে। সুরক্ষাবর্মকে সরিয়ে নিল দোরাদাবু। আহিন হাসিমুখে যুবকটিকে ইশারা করছেন দোরাদাবুর সিংহাসনের দিকে এগিয়ে যেতে।

সেদিকে একনজর তাকিয়ে মুখে একটু হাসি ফুটে উঠল অপরাধী যুবকের। মাটিপাথরের একটা গোলক। অথচ আমহিরির বাইরে, ম্‌হির, কিল্লিগুল, এমনকি তার মহান শহর মুন্দিগ্র অবধি কতই না ভয়াল কাহিনি প্রচলিত আছে একে নিয়ে। আজ সে সেই সমস্ত প্রবাদের সমাপ্তি ঘটাবে। 

হঠাৎ পাশে দাঁড়ানো দেহরক্ষীর দিকে তার একটা হাত ক্ষিপ্র সাপের মত ছুটে গেল। মুহূর্তে তার হাত থেকে বল্লমটা কেড়ে নিয়ে সে বিরাট এক লাফে এগিয়ে গেল দোরাদাবুর দিকে।

প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই দ্বিগুণ শক্তিতে সাইকিক শক্তির একটা অদৃশ্য ঝলক ছুটে এসে ঘিরে ধরল তাকে। শূন্যে লাফানো অবস্থায় স্থির হয়ে গেছে তার শরীরটা। হাতের উদ্যত বল্লম দোরাদাবুর দিকে লক্ষ্য করে স্থির। মাথার ভেতরে সুতীব্র যন্ত্রণায় তার সমস্ত শরীরটা তিরতির করে কাঁপছিল।

শেষ আঘাতটা করবার আগেই কী ভেবে নিজেকে সংযত করল দোরাদাবু। একটা অন্য পরিকল্পনা এসেছে তার মনে। তার হাতে নয়। তার উত্তরাধিকারী আসছে। এই শহরের মানুষের সামনে সে-ই নিজের শক্তির প্রথম পরিচয় রাখুক একে দিয়ে।

অবশ শরীরটা ফের ছিটকে এসে পড়েছে ঈশ্বরের সুরক্ষাগণ্ডির লালরঙের বৃত্তটার বাইরে। সঙ্গে সঙ্গেই তাকে লক্ষ করে ঝিকিয়ে উঠেছিল এক রক্ষীর তলোয়ার। কিন্তু সেটা তার শরীরে নেমে আসবার আগেই আহিন তাকে নিরস্ত করলেন। ঈশ্বরের অন্য উদ্দেশ্য আছে। তাঁর মনের ভিতর সেই আদেশ জানিয়েছেন তিনি…

তবে সেই মুহূর্তে সুরক্ষাবৃত্তের বাইরে ঘটে চলা দৃশ্যটার দিকে আর কারো নজর ছিল না। সবার চোখ তখন হঠাৎ করেই ঘুরে গিয়েছে স্বয়ং দোরাদাবুর দিকে। কারণ, সেখানে সিংহাসনে বসা দোরাদাবুর গোলকাকার শরীরে হঠাৎ করেই একটা বদল আসতে শুরু করছিল। থেকে থেকে থর থর করে কেঁপে উঠছিল গোলকটা। তার মাটিপাথরের শরীরে নানারঙের আলোর হালকা দ্যুতি জেগে উঠছিল একটু একটু করে…

…সাড়া জেগেছে গ্রহজীবের শরীরের গভীরে ফুটন্ত ম্যাগমার পিণ্ডে। তার প্রবল ধাক্কায় নিজের বুকের মধ্যে বেড়ে ওঠা একটা ফাটলের তীক্ষ্ণ যন্ত্রণা অনুভব করছিল সে…

ধীরে ধীরে নিজের আসন ছেড়ে এইবার সে বাতাসে ভেসে উঠল। মন্দিরের বাইরে অপেক্ষায় থাকা এক হাজার যোদ্ধা বিস্ময়ে মূক হয়ে গেছে। শহরের একপাশে সুরক্ষিত মন্দিরক্ষেত্র। তার মাঝখানে আকাশছোঁয়া মন্দিরের গভীরে অধিষ্ঠান করেন গোলকদেবতা। দরজার বাইরে বহুদূর থেকেই তাঁর দর্শন পেয়ে তৃপ্ত থাকতে হয় পূণ্যার্থীদের। স্থির, নিশ্চল একটা মাটিপাথরের ড্যালা। অকল্পনীয় শক্তির যে প্রবাদ রয়েছে তাঁর বিষয়ে তার কোনো লক্ষণই দেখা যায় না তাঁর মধ্যে। এই অলৌকিক দৃশ্য তাই তাদের স্তম্ভিত করে দিয়েছে এই মুহূর্তে।

তবে বিস্ময়ের আরো একটু বাকি ছিল। হঠাৎ বাতাসে ভেসে ওঠা সেই গোলকের শরীর থেকে হালকা গুণগুণ শব্দ উঠল। একটা সুক্ষ্ম দাগ দেখা দিয়েছে গোলকের গায়ে। প্রায় অদৃশ্য কালো তিলের মত দাগটা দেখতে দেখতে চোখ ঝলসানো কমলা একটা আলোর বিন্দুতে বদলে যাচ্ছিল। আর তারপর, তীক্ষ্ণ শিসের শব্দ করে সেই পথে বের হয়ে এল ঘন কমলা রঙের উত্তপ্ত ম্যাগমার একটা  সরু স্রোত। ছুটে গিয়ে তা সরাসরি ঘা মারল তামার পাত্রের ওপরে রাখা মাটি, পাথর আর ধাতুখণ্ডের স্তূপে।

একটা আলোয় গড়া সরীসৃপের মতই তিরবেগে এইবার স্তূপের ভেতরে অদৃশ্য হল ম্যাগমার স্রোত।  আর সঙ্গে সঙ্গেই মাটিপাথরের স্তূপটায় একটা বদল আসতে শুরু করল। থালা ছেড়ে বাতাসে ভেসে উঠে দ্রুত পাক খেতে শুরু করল তা…আর পাক খেতে খেতেই নিজেকে সে বদলে নিচ্ছিল, অপেক্ষাকৃত ছোট একটা গোলকের চেহারায়…

কয়েকটা মুহূর্ত কেবল। তার পরেই সদ্যোজাত গোলকটা বাতাসে ভর করে ধেয়ে এল সুরক্ষাবলয়ের বাইরে। সেখানে, তখনও স্তম্ভিত হয়ে বসে থাকা গুপ্তচর তরুণের মাথার ওপর স্থির হয়ে অলসভাবে ভাসতে থাকল।

সেদিকে চোখ রেখে ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়াল তরুণটি। নীচু হয়ে মাটি থেকে কুড়িয়ে নিল তার খসে পড়া বল্লম। তার মাথার ভেতরে তখন গুণগুণ করে উঠছিল একটা ভাষাহীন আদেশ। অমোঘ, নিষ্ঠুর সেই হুকুমকে অস্বীকার করবার ক্ষমতা ছিল না তার মস্তিষ্কের। দোরাদাবুর সন্তানগ্রহটি তার মায়ের স্মৃতি ও শক্তি নিয়েই জন্মেছে। মায়ের চেতনারই একটা শাখা সে। মায়ের ইচ্ছাটি সেখানে তার আগে থেকেই গেঁথে দেয়া রয়েছে। সাইকিক শক্তির একটা সামান্য ধাক্কায় সে এইবার তরুণটির স্নায়ুতন্ত্রের দখল নিল। এর মস্তিষ্ক এখন তার সম্পূর্ণ বশীভূত হয়েছে।

তারপর, চারপাশে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর বিস্মিত চোখের সামনে সযত্নে বল্লমটার ফলা নিজের গলায় ঠেকিয়ে চাপ দিল সেই তরুণ…

গলায় আমূল ঢুকে যাওয়া ফলার ধাক্কায় শিরাছেঁড়া রক্তের স্রোত বাতাসে ছিটকে উঠে ধুইয়ে দিচ্ছিল সদ্যোজাত গ্রহদেবতার শরীর। সেদিকে চোখ রেখে  জয়ধ্বনি করে উঠলেন আহিন। পাপীর আত্মবলিদানের রক্তে অভিষেক সম্পূর্ণ হয়েছে নতুন দেবতার।

জয়ধ্বনি করে উঠেছিল অপেক্ষায় থাকা সৈনিকরাও। কিন্তু, তার পরক্ষণেই হঠাৎ নৈঃশব্দ্য নেমে এল গোটা মন্দিরচত্বরে। তাদের মাথায় একসঙ্গে বেজে উঠেছে মহান দোরাদাবুর কন্ঠস্বর, “আমহিরির বাসিন্দারা।  আমার এইখানকার শাসনকাল শেষ। তোমাদের নতুন ঈশ্বরকে স্বাগত জানাও।”

কথাগুলো মাথায় আঘাত করতে চমকে উঠে সেদিকে ঘুরে তাকিয়েছিল আহিন। কিন্তু কোনো প্রশ্ন করবার আগেই দ্বিতীয় একটা আদেশ ভেসে উঠল তার চেতনায়, “এই নগরীতে তোমার কাজও শেষ পুরোহিত আহিন। আমার সন্তান নিজে তার প্রধান পুরোহিত নির্বাচন করে নেবে।”

“প্রভু আমি… কোন অপরাধে…”

“অপরাধ নয় প্রিয় আহিন। আমার সেবক তুমি। আমারই সেবক থাকবে। তবে এইখানে নয়। তোমার কর্তব্য অন্যত্র।”

“ধন্য প্রভু,” বলতে বলতে মাটিতে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল আহিন, “আদেশ করুন।”

এই সৈন্যদল নিয়ে পঞ্চাশ ক্রোশ উত্তরে কট্টাদিজা(৫) বসতিতে যাও। তাকে ধ্বংস করো।”

বলতে বলতেই মন্দিরের গর্ভগৃহ ছেড়ে বাইরে এসে শরতের চোখ ধাঁধানো নীল আকাশের গায়ে ভেসে উঠছিল দোরাদাবুর শরীর। যে আসনটিতে তিনি সাধারণত অধিষ্ঠান করেন, সদ্যোজাত গোলকটা এখন সেই জায়গাটা নিয়েছে।

ভাসমান গোলকটির দিকে চোখ রেখে আহিন বিনীত গলায় জিজ্ঞাসা করল, “প্রভু, আপনি আমাদের ছেড়ে…”

“কট্টাদিজাকে ধ্বংস করো প্রথমে আহিন। সেইখানেই আমাকে পাবে। পাবে পরবর্তী কাজের নির্দেশ। এখন যাও…”

বলতে বলতেই মন্দিরের দরজা ছেড়ে বের হয়ে এসে বাতাসে বহু উঁচুতে ভেসে গেল দোরাদাবু। সেখানে একমুহূর্ত স্থির হয়ে থেকে এইবার সবেগে উত্তরের দিকে ধেয়ে গিয়ে দিগন্তে মিলিয়ে গেল তার গোলকশরীর।

সেদিকে চোখ ধরে রেখে, হাতে ধরা হাড়ের বাঁশিটায় ফুঁ দিল আহিন। তারপর হাঁক দিয়ে উঠল, “অস্ত্র ধরো। ঈশ্বরের আদেশ। কট্টাদিজার একটি প্রাণীও যেন জীবন্ত না থাকে…”

***

এর দুদিন পরে অরণ্য পেরিয়ে এক হাজার সুশিক্ষিত যোদ্ধা ধেয়ে চলল উত্তরের দিকে। এই পথে পঞ্চাশ ক্রোশ এগোলে, ইন্দা-র অন্যপাড়ে কট্টাদিজা গ্রাম। নিতান্তই সাধারণ অনুন্নত কিছু মানুষ তারা। নদীর মাছ আর বনের জীবজন্তু, কন্দ, ফলমূল খেয়ে জীবন কাটায়। এখনও কৃষিবিদ্যাও জানে না।

কেন যে তাদের ধ্বংস হতে হবে সে প্রশ্ন একবারও করছিল না ধেয়ে চলা সৈনিকের দল। তারা দোরাদাবুর সেপাই। যুদ্ধ তাদের রক্তে। আদেশ পালন তাদের কাজ। তাদের নেতা আহিন তাদের যে পথে নিয়ে যাবেন সে পথে চলাই একমাত্র ধর্ম তাদের কাছে।

 

 “এসো সৌগম। তুমি ক্ষুধার্ত নিশ্চয়! আমার খাবারের ভাগ নাও,” বলতে বলতেই আহীন পাথরের থালা থেকে বৃষমাংসের একটা রসালো টুকরো তুলে মুখে দিয়ে পাত্রটার দিকে ইশারা করে দেখালেন তাঁর সামনে এসে বসা প্রৌঢ় মানুষটাকে।

থালাটার দিকে পিটপিট করে একনজর তাকিয়ে দেখে নিলেন সৌগম। স্বয়ং পুরোহিত তাঁকে খাদ্য ভাগ করে দিচ্ছেন! এতটা সৌভাগ্য সম্ভবত কোনো আগামি দুর্ভাগ্যের সূচনা করতে চলেছে। তবে পুরোহিতের অনুরোধ। আসলে তা আদেশই। অতএব একটু ভয়ে ভয়েই তিনি উবু হয়ে বসে থালাটার দিকে হাত বাড়িয়ে ধরলেন।

সৌগম মধ্যবয়স্ক মানুষ। চালচলনে বয়সোচিত ধীরস্থির ভাব এসেছে তাঁর। শরীরে মেদও জমেছে খানিক। এককালে উত্তরের পথে পণ্যসামগ্রী নিয়ে বাণিজ্যে যেতেন তিনি। ইন্দার তীরের দুপাশে ছড়িয়ে থাকা অরণ্যভূমি, তার জায়গায় জায়গায় গড়ে ওঠা অজস্র আদিম বসতিতে পণ্যের সন্ধানে অনেক ঘুরেছেন যৌবনে। এমনকি, ম্‌হির, বা তার পাশ দিয়ে রহস্যময় অজানা পশ্চিমাঞ্চলের অঞ্চলের দিকে এগিয়ে যাওয়া বাণিজ্যপথ ধরেও বহুদূর অবধি গিয়েছেন।

ভাগ্য তাঁর এই পরিশ্রমের পুরস্কারও দিয়েছে দু’হাত ভরে। আমহিরি নগরীর শ্রেষ্ঠ বাড়িটা তাঁর। ছ’টি ঘরওয়ালা এই বাড়ির রান্নার উনুন, ব্যক্তিগত শস্যাগার থেকে শুরু করে তার পেছনে উঁচু জমিতে গড়ে তোলা স্নানকুণ্ড সবকিছুই একেবারে অন্য ধাঁচের।

সুদূর পশ্চিমের বদকাশা নগরী থেকে জুটিয়ে আনা নানারঙের দুর্লভ পাথরের গয়না তাঁর শরীরে শোভা পায়। বল্কল বা পশুচর্মের বদলে ম্‌হির-এর অসুরনগরী থেকে  নিয়ে আসা কার্পাস নামের মিহিন একধরণের তন্তুর পোশাকে নিজেকে সাজায় সে। তার আশ্চর্য তন্তু বা বুনোটের রহস্য আমহিরির পোশাক নির্মাতার শত চেষ্টাতেও অধিগত করতে পারেনি এখনও।

তা, প্রৌঢ় বয়সে, ধনসম্পত্তির মালিক হয়ে, ভালো পোশাক ও গয়নাগাঁটিতে সেজে, পরিবারের মহিলা আর তরুণদের তার অবিশ্বাস্য যাত্রাগুলোর গল্প বলে কিংবা গভীর রাতে ইলিহা থেকে জুটিয়ে আনা শঙ্খের গায়ে খোদাই করা নানান নকশার ছিদ্র দিয়ে আকাশের তারাদের চলাচল দেখে সুখেই দিন কাটছিল তার।

তারপর, হঠাৎ দিনতিনেক আগে বিনামেঘে বজ্রপাতের মত আহিনের ডাক এল। তাকে যুদ্ধযাত্রায় যেতে হবে তার সঙ্গে। দোরাদাবুর আদেশ।

প্রতিবাদ করবার কথা অবশ্য ঘূণাক্ষরেও ভাবেনি সৌগম। আমহিরি নগরী মহান দোরাদাবুর রাজত্ব। তাঁর সেবক পুরোহিতদের কথাই এখানে শেষ কথা। তাকে অমান্য করবার একটিই শাস্তি, কিংবা পুরোহিতদের ভাষায়, পুরস্কার। দেবতার গর্ভগৃহে, তাঁর সামনে পৌঁছে তাঁর কাছে করুণাঘন মৃত্যুর আশীর্বাদ নেয়া।

যদিও মহল্লায় কেউ কখনো সে-আশীর্বাদ পেলে তার সৌভাগ্যকে মহা উৎসাহে উদযাপন করা হয়, কিন্তু তবু, সৌগম কখনো এহেন সৌভাগ্যকে চান না। অতএব প্রকাশ্যে দেবতার নেকনজরে পড়বার এহেন সৌভাগ্যে উল্লাস দেখিয়ে মহল্লার লোকজনকে একটা ভোজ দিয়েছেন তিনি। নিজের পশুগৃহ থেকে দুটো পুষ্ট ভেড়া খরচও হয়ে গেছে তাতে। তবে মনে মনে তিনি নিজের ভাগ্যকে খানিক অভিসম্পাত দিয়েছেন বইকি। যুদ্ধ তরুণদের খেলা। এই প্রৌঢ় বয়সে, এত সুখভোগ ছেড়ে সে-খেলায় অংশ নিয়ে বেঘোরে প্রাণ দেয়াটা তাঁর কাছে মোটেই সুবিধের ঠেকেনি।

আহিনের কাছে এসে হাজিরা দেবার পর থেকেই একটা দ্বিতীয় রহস্য সৌগমকে উতলা করছিল। যুদ্ধযাত্রার উপযোগী অস্ত্রশস্ত্র সকলেই পেয়েছে। এমনকি আহিনও পুরোহিতের দণ্ডের পাশাপাশি কোমরে একটি ব্রোঞ্জের কুঠার ঝুলিয়ে নিয়েছেন। অথচ তাঁকে কোনো অস্ত্র দেয়া হল না। এমনকি শুকনো চামড়ার যে পোশাক সম্মুখযুদ্ধে শরীরকে শত্রুর অস্ত্রের হাত থেকে বাঁচায় সেই পোশাকও দেয়া হয়নি তাঁকে। কেন যে তিনি চলেছেন এদের সঙ্গে সে প্রশ্নের উত্তর নিয়ে রাতগুলো বিনিদ্রই কেটেছে তাঁর গত কয়েকটা দিন। আর তারই মধ্যে একটা অশুভ আশঙ্কা মাথা চাড়া দিচ্ছিল তাঁর মনে। ইন্দা-র দু’পাশে যে অজস্র আদিম মানুষজনের বাস, তাদের কারো কারো গোষ্ঠীতে যুদ্ধযাত্রার আগে গোষ্ঠীর কোনো সদস্যকে বলি দেয়া হয়। সাধারণত বয়স্ক ও অক্ষম কোনো মানুষকেই বেছে নেয়া হয় এই বলিদানের জন্য। বয়স তাঁরও হয়েছে। এরা যুদ্ধযাত্রাতেও চলেছে। তবে কি…

…আর আজ, কট্টাদিজা যখন আর মাত্রই এক দিনের পথ দূরে, সেই সময় এভাবে তাঁকে ডেকে পাঠিয়ে সুখাদ্য সাজিয়ে দেয়া… সৌগমের মনে পড়ছিল, এমন একটি বলির অনুষ্ঠানে তিনি সাক্ষি ছিলেন। জায়গাটা ইন্দা-র পুবপাড়ে প্রায় একুশ দিনের পথ। সেখানেও বলির ঠিক আগে এইভাবেই প্রৌঢ় মানুষটাকে…

মাংসের একটা টুকরো তুলে নিতে নিতে হাতটা সামান্য কাঁপছিল তাঁর। আহিন তা লক্ষ করে হাসলেন। ভয়! নিরঙ্কুশ শাসনের প্রধান অস্ত্র। এই ভয়ের অস্ত্র দোরাদাবুকে তাঁর সুরক্ষাবলয়ের মধ্যে নিরাপদে রাখে। তাঁর পঞ্চাশ হাতের মধ্যে পা দিলে কারণহীন, তীব্র ভয়ের আঘাত অপরাধীকে কঠোর সাজা দেয়। আমহিরি নগরকে দখলে রাখবার জন্য এই ভয়কেই তাই প্রধান অস্ত্র করেছে তার পুরোহিত শাসকরা। তাঁর সামনে বসা এই মানুষটাও সেই ভয়েরই দাস এই মুহূর্তে।

“আপনি আমাকে…” গলাটা একটু কেঁপে গিয়েছিল সৌগমের।

হাত তুলে অভয় দিলেন তাঁকে আহিন, “যে কারণে আপনাকে এই যুদ্ধযাত্রায় আনা তা এইবার বলবার সময় হয়েছে সৌগম। কট্টাদিজা একটা সাধারণ বন্য গ্রাম। আমহিরির মত উন্নত নগরীর সঙ্গে তার কোনো লেনদেন নেই। এমনকি এখানকার খুব কম মানুষই তার নাম জানে। অথচ তাকে ধ্বংস করবার জন্য স্বয়ং ঈশ্বর এক হাজার বাছাই সেনার দল পাঠালেন একজন প্রধান পুরোহিতের নেতৃত্বে। কেন? না সৌগম। এ-জায়গার নিশ্চয় কোনো গোপন শক্তি আছে। কোনো আলাদা গুরুত্ব আছে।

“সিন্ধুতীরের বিভিন্ন এলাকায় যাতায়াতের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা আপনার। তাই আপনাকে সঙ্গে আনা। এখন, এই কট্টাদিজা সম্পর্কে   যতটুকু জানেন…”

একটা স্বস্তির নিঃশ্বাস বের হয়ে এল সৌগমের বুক থেকে। আর ভয় নেই। এই কারণেই তবে তাঁকে সঙ্গে আনা হয়েছে। গত কয়েকদিনের নাহক আতঙ্কের কথা ভেবে একটু হাসিই পাচ্ছিল তাঁর। মাথা নেড়ে তিনি বললেন, “বিভিন্ন বাণিজ্যযাত্রায় আমি একাধিকবার সে-গ্রামে আতিথ্য নিয়েছি হে মহামান্য। সাধারণ বন্য গ্রাম। মানুষগুলি অতিথিপরায়ণ। এরা এখনও তামা বা সীসার ব্যবহার জানে না। পাথরের অস্ত্রই একমাত্র সম্বল। কিন্তু তা সত্ত্বেও, তাদের মুখেই শুনেছি, আজ অবধি কখনো তাদের বসতিতে  কোনো বহিঃশত্রুর আক্রমণ হয়নি।”

“কেন?”

“সঠিক জানি না। তবে অনুমান করতে পারি,” সৌগম হাসলেন একটু। তারপর উঠে গিয়ে গাছের গায়ে বাঁধা একটা জ্বলন্ত মশাল খুলে এনে আহিনের সামনে তা মাটিতে গেঁথে দিলেন। তারপর একটা ধারালো শলা নিয়ে এসে আলোকিত মাটির ওপর দ্রুত হাতে দাগ কাটতে কাটতে বলে চললেন, “এর কারণ সম্ভবত কট্টাদিজার বিচিত্র অবস্থান। সিন্ধুর পূর্বপাড়ে, জলধারা থেকে সামান্যই দূরে  দাঁড়িয়ে আছে এই গ্রাম। এর পেছনদিকে দুরারোহ রাহারি(৬) পাহাড়শ্রেণীর সারি। তার ঢালে গড়ে ওঠা এই গ্রামের পেছনদিক পাহাড়ের সার প্রাকৃতিক দেয়ালের কাজ করে।

“আর সামনের দিকে একফালি উর্বর জমি ছাড়িয়ে মহান ইন্দা-র ধারা। পাহাড় ও নদীর সতর্ক প্রহরায় নিরাপদ থাকে এই গ্রাম। পাহাড়ের মাথায় জায়গায় জায়গায় এদের নজরদাররা নদী ও পাহাড় দুদিকেই নজর রাখে। কাজেই বিপুল সৈন্যবল নিয়ে এদের অজান্তে এই বিশাল নদী পাড় হওয়া কিংবা ওই দুরারোহ পাহাড়শ্রেণীকে পেরোনো সম্ভব নয়। আর আক্রমণের সম্ভাবনার কথা টের পেয়ে গেলে, সুবিধাজনক অবস্থান থেকে সামান্য সংখ্যক সৈন্য দিয়েই এরা সহজেই গ্রামকে রক্ষা করতে পারবে।”

নিজের আসনটা এইবার মাটিতে আঁকা ছবিটার কাছে এগিয়ে আনলেন আহিন, “বেশ। অন্য কৌশল করতে হবে। আপনি মনঃসংযোগ করুন সৌগম। এই গ্রামের যা কিছু দেখেছেন তার যথাসম্ভব খুঁটিনাটি আমার জানা প্রয়োজন… তারপর…”

ক্রমশ

—————–

 ১) ম্‌হিরি- অধুনা মেহেরগড় ২) কিল্লিগুল- অধুনা কিলিগুল মহম্মদ

৩) আমহিরি-অধুনা আমরি ৪) মুন্দিগ্র- অধুনা মুন্ডিগাক ৫) কট্টাদিজা- অধুনা কোট দিজি  ৬) বর্তমান নাম রোহরি পর্বতশ্রেণী

শীর্ষচিত্র- অতনু দেব।  গ্রাফিক্‌স্‌- ইন্দ্রশেখর

 জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s