সিন্ধুনদীর তীরে –প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব , সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব
দ্বিতীয় পর্ব
পর্ব-২
দোপেয়ে পরজীবীটার মস্তিষ্কে নিজের অনুভূতির আকর্ষীগুলো দিয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল সে। দেখছিল, এবং মুগ্ধ হচ্ছিল। তার নিজের শরীরের কেন্দ্রে গলিত ম্যাগমার ছোটো একটা পিণ্ড তার শক্তিশালী চেতনার জন্ম দিয়েছে। এই পরজীবীর শরীরের চূড়ায় শক্ত ঢাকনার আড়ালে থাকা ওই তুলতুলে নরম অঙ্গটার সম্ভাব্য ক্ষমতা তার চেয়ে বেশি। সম্ভাব্য এইজন্যই যে, তার বেশির ভাগটাই এখনও ঘুমন্ত।
খুব সাবধানে অঙ্গটাকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখে তার আকর্ষিরা। শুষে নেয় তার মধ্যে জমে থাকা অজস্র স্মৃতিদের। সরল ও কুৎসিত কিছু স্মৃতি। হাওয়া, জল ও কিছু রাসায়নিকের মিশেলে তৈরি একটা অদক্ষ দেহযন্ত্র। দুর্বল। প্রকৃতির শক্তিকে সরাসরি গ্রহণে অক্ষম। তাকে টিকিয়ে রাখাকে ঘিরেই এর সমস্ত স্মৃতি। তার জন্য পুষ্টি সংগ্রহ, তাকে ধ্বংসের হাত থেকে রক্ষা করা…তার ধ্বংস হবার আতঙ্ক…
অঙ্গটা সুতোর মত কিছু কোষ জুড়ে তৈরি। প্রকৃতির বিচিত্র প্রযুক্তি। তার কাজ করবার পদ্ধতি করে নিতে বিশেষ অসুবিধে হচ্ছিল না দোরাদাবুর। এদের একের সঙ্গে অন্যের বৈদ্যুতিক সঙ্কেত আদানপ্রদানে এই পরজীবীর চেতনার সৃষ্টি হয়। তবে এখনও এর খুব কম অংশেই সেই বৈদ্যুতিক সঙ্কেতের আদানপ্রদান চলেছে। অধিকাংশ যোগাযোগই নিষ্ক্রিয়। আর একটু সক্রিয় করে তুলতে হবে একে। তা না হলে তার নির্দেশকে বোঝা ও সেইমত হুকুমগুলোকে তামিল করার সাধ্য হবে না এই চিন্তাযন্ত্রের।
তবে খুব সাবধানে কাজটা করতে হবে তাকে। প্রয়োজনের অতিরিক্ত সক্রিয়তা এই মুহূর্তে দেয়া উচিত হবে না একে। অঙ্গটার সমস্ত কোষের মধ্যেকার যোগাযোগ সক্রিয় হলে যে বিপুল চিন্তাশক্তি জেগে উঠতে পারে সেখানে, তাকে নিয়ন্ত্রণ করা হয়তো তার সাধ্য হবে না।
এদের বসতিতে আরো অনেক এই শ্রেণীর জীব আছে। পরজীবীটার স্মৃতিকোষে তাদের আবছা ছবিগুলো ভেসে আছে। এদের প্রত্যেককে তার জানা প্রয়োজন। প্রাণীগুলো তার তুলনায় দৈত্যাকার। তাদের ঘুমন্ত মস্তিষ্কের সম্ভাব্য শক্তি তার চাইতে বহুগুণ বেশি। মনের গভীরে একটা হালকা ভয়ের ছোঁয়া লাগছিল তার।
সাবধানে, খুব সাবধানে মানুষটার মস্তিষ্কের কিছু কিছু নিষ্ক্রিয় এলাকাকে জাগিয়ে তোলবার কাজে হাত দিল সে এবার। সামান্য চিন্তাশক্তি, কিছু প্রাথমিক বিশ্লেষণী ক্ষমতা, ভাব বিনিময়ের সামান্য দক্ষতা…এবং তার প্রতি তীব্র ভয়ের একটি স্থায়ী অনুভূতি…
একসময় থেমে গেল সে। এর চেয়ে বেশি ঝুঁকি নেয়া উচিত হবে না এখনো। অন্তত যতদিন না তার নিজস্ব বংশবৃদ্ধি শুরু হয়। যতদিন না তার নিজের প্রজাতির আরো কিছু খুদে গ্রহ জন্ম নিয়ে তার হাতকে শক্ত করে। ততদিন…
রাত শেষ হয়ে আসছিল। নিঃশব্দে বসে থাকা মানুষটার চেতনা থেকে অবশেষে সে তার আকর্ষিদের সরিয়ে নিল। তারপর একটা সংক্ষিপ্ত আদেশ…
টলতে টলতে উঠে দাঁড়াচ্ছে মানুষটা। অসীম ভয় নিয়ে একবার সে তাকিয়ে দেখল, কিছুদূরে পড়ে থাকা মাটি-পাথরের গোলকটার দিকে। হঠাৎ করেই কিছু প্রশ্ন জেগে উঠেছে তার মনে। কী ওটা? আকাশ থেকে নেমে এসেছে ও। আকাশ! হাজারো রহস্যের নীল চাঁদোয়া। সেখান থেকে আগুন নামে, জল নামে… ঈশ্বর নামেন। ঈশ্বর… একটা অচেনা নতুন শব্দ। এইমাত্র সেই শব্দটাকে তৈরি করেছে তার খানিক শক্তিমান হয়ে ওঠা মন। ঈশ্বর! বাঘের চাইতে ভয়ঙ্কর তিনি… ইচ্ছা করলে অসীম যন্ত্রণার কোনো অন্ধকার দেশে নিয়ে যেতে পারেন তিনি তাদের… তাঁর আদেশ মানতে হয়। তিনি আদেশ দিয়েছেন…
হঠাৎ তাঁর আদেশটা ভাষাহীন পথে তার সমস্ত চেতনায় ছড়িয়ে গেল। ঈশ্বর তার বসতির সমস্ত মানুষকে ডাক দিয়েছন। তাদের নিয়ে আসতে হবে তাঁর কাছে…
***
নদীর বুকে রোদ ঝিলমিল। সকালের নরম রোদ সবেমাত্র এসে ছুঁয়েছে তার ছুটন্ত জলকে। বর্ষা গিয়েছে সবে। দুকুল ছাপানো মহান সেই জলের ধারা কোথা থেকে আসে তা তারা জানে না। কোথায় সে যায় তা-ও নয়। তারা কেবল এইটুকুই জানে, ওই জলের গভীরে সুস্বাদু মাছদের বাস। গাছের লম্বা ডালের মাথায় ধারালো পাথরের টুকরো বেঁধে নিয়ে তাই এই সময় এই বসতির কমবয়েসিরা সেই জলে ঝাঁপাই জোড়ে।
বসতির বয়স্করাও কেউ বসে থাকে না এই সময়। আকাশে আলো যতক্ষণ ততক্ষণ তারা সকলেই মৌমাছির মত ব্যস্ত থাকে। কেউ নদী থেকে জল তুলে আনছে, কেউ বা জলের ধারের জঙ্গলে ঢুকছে ফলফুলুরি আনতে। আর গায়ে যাদের সবচাইতে বেশি জোর, তারা যায় জঙ্গলের আরেকটু গভীরে। সেখানে অনেক, পাখি, হরিণ, বুনো ছাগল, বরা।
নদীতীরের খোলা এলাকা ছাড়িয়ে কিছুদূর গেলেই সেই ঘন অরণ্য শুরু হয়ে গেছে। তার ভেতর অল্প কিছু দূর অবধিই সাহসী জোয়ানদের গতায়াত। বেশিদূর যাবার দরকারই বা কী? ফলপাকুর বা শিকার, সে-সব কাছাকাছি জঙ্গলেই যা মেলে তাতে দিব্যি কুলিয়ে যায় তাদের।
ফলে, সেই অরণ্য যে কতদূরে কোথা অবধি ছড়িয়ে গেছে খুব কম মানুষই তার খবর রাখে। কখনো কখনো কিছু দুঃসাহসী সেই অরণ্যের ওপারে কী আছে তা খুঁজতে গিয়েছে বইকি। এর মধ্যে যারা নদীর ধারাকে অনুসরণ করে এগিয়েছে, তারা বলে সেদিকে সেই মহারণ্যের কোনো শেষ নেই। নদীর ধারার আড়াআড়ি, তাকে পেছনে ফেলে যারা সূর্য ডোবার দিকে এগিয়েছে তাদের মধ্যে খুব কম মানুষই ফিরে আসতে পেরেছে। তারা বলে, এক হাতের যতগুলো আঙুল ততবার আলো আর অন্ধকারের সময় ধরে হাঁটলে সেই অরণ্য শেষ হয়ে একটা ভয়ঙ্কর জায়গা শুরু হয়। সেখানে যতদূর চোখ যায়, জলহীন, অরণ্যহীন বালির রাজত্ব। তার বুকে বিরাট বিরাট বালির ঢেউ নাকি জমে স্থির হয়ে থাকে। তার বুকে কখনো কখনো বড়ো বড়ো জলাশয় চোখে পড়ে। কিন্তু সেদিকে এগোতে গেলেই সেই জল মিলিয়ে যায়।
তবে নদীর ধারার উলটোদিকে পাহাড়ের দেশের দিকে যে খোঁজারুরা এগিয়েছে, আজ পর্যন্ত তারা কেউ ফিরে আসেনি।
এই ফিরে না আসবার কারণ তারা জানে। সেদিকে অনেক, অনেক দূরে শয়তান জাদুকরদের দেশ ম্হির*। একবার সেখানে পা দিলে কারো ফেরা হয় না আর।
প্রতিবার বর্ষা শেষ হয়ে যেই মেঘের দল উধাও হয়, ঠিক সেই সময় এই জাদুকরদের দল তাদের বসতিতে হানা দেয়। এদের শক্তিশালী জাদু বনের জন্তুকে বশ করতে পারে। আক্রমণকারীদের সঙ্গে আসে সেই বশ মানা হিংস্র নেকড়ের দল। এদের আদেশে তারা বসতির মানুষকে আক্রমণ করে। বড়ো বড়ো শক্তিমান ষাঁড় এদের পিঠে নিয়ে ছুটে আসে। এদের হাতে যে অস্ত্র থাকে তা যেমন ধারালো, তেমনই শক্ত। এমনকি আকাশের আগুনও এদের বশ। বশ মানা নেকড়েদের সঙ্গে নিয়ে, ছুটন্ত ষাঁড়ের পিঠে সওয়ার হয়ে, হাতে আগুন আর শক্তিশালী অস্ত্র নিয়ে তারা এসে ঝাঁপিয়ে পড়ে তাদের বসতিতে।
সেই সময়গুলোতে এরা নদীর ধারের অরণ্যের মধ্যে পালায়। সেখানে লুকিয়ে অসহায় চোখে দেখে, যারা পালাতে পারেনি সেই অভাগাদের মধ্যে বৃদ্ধ, অশক্তদের মেরে ফেলে, কমবয়েসি সুস্থ-সবলদের বনের লতায় বেঁধে জাদুকরদের দল ফিরে চলেছে নদীর উজানের ক্রমশ উঁচু হয়ে যাওয়া অরণ্যভূমি বেয়ে।
এভাবে যাদের তারা ধরে নিয়ে যায় তাদের মধ্যে এখন অবধি একজনই ফিরে আসতে পেরেছিল। সে এই বসতির দলপতি মুহিরা। দুহাতের যতগুলো আঙুল, ততগুলো বর্ষা যখন তার বয়েস, সেই সময় একবার ম্হিরের জাদুকরদের একটা হানাদার দলের হাতে ধরা পড়ে গিয়েছিল সে। সাত দিন সাত রাত্রির পথ পেরিয়ে তারা তাকে নিয়ে গিয়েছিল অরণ্য ছাড়িয়ে হিংস্র লাল পাহাড়দের রাজত্বে। সেখানে ছোটো এক নদীর ধারে তাদের আশ্চর্য বসতি। সে বসতিতে, এক হাতের যতগুলো আঙুল ততগুলো বর্ষা থাকবার পর মুহিরা পালাতে পেরেছিল। পলাতক দাসের পেছনে জাদুকরদের পাঠানো পোষা নেকড়ের দলকে হার মানিয়ে সে বহু কষ্টে নিজের বসতিতে ফিরে আসে- আশ্চর্য সব রূপকথার ঝুলি নিয়ে।
এখনও এই এত বয়সে এসেও মুহিরা যখন রাতের অন্ধকারে বসে তার সেই দিনগুলোর গল্প শোনায়, তখন সকলে অবাক হয়ে অবিশ্বাস্য সেইসব গল্প শোনে।
আশ্চর্য সেই মানুষদের আদেশ মেনে মাটির বুকে প্রতি বর্ষার পর শস্যদানা গজিয়ে ওঠে। সেখানে প্রত্যেক পরিবারের জন্য আলাদা আলাদা বাড়ি। চৌকো মাটির টুকরো সাজিয়ে সাজিয়ে সেইসব বাড়ি তৈরি হয়। প্রতিটি বাড়ির কাছে তাদের ইচ্ছেয় ছোটো ছোটো অরণ্য জন্মায়। সেই অরণ্যের প্রত্যেক গাছে সুস্বাদু ফল ফলে। আকাশের আগুন তাদের ঘরে পোষ মেনে বাস করে। প্রতিটি খাদ্য সেই আগুন ঠাকুরকে আগে খাইয়ে তারপর তারা তার প্রসাদ খায়।
গ্রামের অনেকেই অবশ্য তার এইসব আজগুবি গল্পে বিশেষ বিশ্বাস করে না। কারণ মুখে গল্প বললেও, আগুন, নেকড়ে বা গাছপালাকে সে কখনো পোষ মানিয়ে দেখাতে পারেনি কাউকে।
তবে মুহিরাকে যে জাদুকররা ধরে নিয়ে গিয়েছিল তার অনেক সাক্ষি আছে। তাদের খপ্পর থেকে যে বেঁচে ফিরতে পেরেছে তাকে সামনা-সামনি মিথ্যেবাদি বলবার মত সাহসও তাদের নেই। তাছাড়া, জাদুকরদের দেশ থেকে শিখে আসা একখানা কায়দা অন্তত সে হাতে-কলমে করেও দেখিয়েছে। তাতে ফলও হয়েছে ভালো।
ব্যাপারটা সংক্ষেপে এইরকম-
জাদুকরদের বসতির পাশে পাহাড়ের ভেতর দিয়ে মস্ত এক পথ নেমেছে তাদের উপত্যকায়। সেই গিরিপথ বেয়ে তাদের মানুষজন নানান সওদা নিয়ে দূরদেশে বাণিজ্যে যায়। দূরদেশ থেকে সওদাগররাও সেই পথ বেয়ে আশ্চর্য সব জিনিস নিয়ে জাদুকরদের দেশে বাণিজ্যে আসে। আবার সেই পথেই কখনো কখনো ভিনদেশি হানাদাররা জাদুকরদের দেশে হানা দিতে আসে। জাদুকররা তাই সেই রাস্তার আশপাশের পাহাড়ে সবসময় কয়েকটা লোককে লুকিয়ে রাখে। তাদের সঙ্গে থাকে অনেক পাথর। হানাদারদের দেখলেই ওপর থেকে পাথর ছোঁড়ে আর চিৎকার করে সবাইকে সাবধান করে দেয়।
কায়দাটা মুহিরা এখানেও কাজে লাগিয়েছে। ফি-বছর বর্ষার শেষে বসতির উত্তর দিকে জঙ্গলের ভেতর নানান গাছের মাথায় ছোটো ছোটো মাচা বেঁধে বিশটা লোককে তুলে দেয়া হয় এখন। বসতির যে বুড়োবুড়িরা আর কিছু কাজে লাগে না তারা দিনরাত ওই মাচায় বসে থাকে। মাচা বাঁধবার জন্য ঘাস পাকিয়ে দড়ি বানাবার কৌশলটাও মুহিরার ওই জাদুকরদের থেকেই শেখা। এ-দেশে পাথর তো মেলে না আর। তাই পাথর ছোঁড়া না গেলেও, জাদুকরদের দলটাকে দূর থেকে আসতে দেখলেই তারা নানান জন্তুর গলা করে ডাক দিয়ে ওঠে। ওইতে বসতির লোকজন আগেভাগেই টের পেয়ে গিয়ে জঙ্গলে পালাতে পারে। বুড়োবুড়িগুলো মরে অবশ্য। তবে তাতে বরং ভালোই হয়। অকেজো খাওয়ার মুখ কমে কয়েকটা।
***
তবে আজকে এই বসতির কেউ কোনো কাজে যায়নি। আজ তারা গোটা গ্রাম জুড়ে নদীর ধারে এসে একত্র হয়েছে। একত্র হয়েছে মুহিরার নির্দেশে। আগের দিন রাত্রে মুহিরা ঘরে ফেরেনি। ভোরবেলা, নদীর দিক থেকে ফিরে এসে মাটি ও লতাপাতায় ঘেরা বসতির চৌহদ্দির ভেতরে ঢুকে সে যখন প্রথম কথা বলল, সবাই বুঝেছিল আগের রাত্রে কোনো গভীর জাদু তাকে স্পর্শ করেছে। মাত্রই এক রাত্রের মধ্যে তার আচরণে গভীর বদল এসেছে একটা।
তখন গোটা বসতির সমস্ত মানুষ সকালের খাবারের জন্য জড়ো হয়েছিল আগের সন্ধ্যায় জুটিয়ে আনা খাদ্যবস্তুর চারপাশে। ফিরে এসে মুহিরা প্রতিদিনের মত এগিয়ে যায়নি সেই খাবারের আসরে। তার চার সন্তানের মা যে বৃদ্ধা, তিনি তার মুখ দেখে অনুভব করেছিলেন সে ক্ষুধার্ত। বড়োসড়ো একখণ্ড মাংস তার সামনে ধরে দিয়েছিলেন তিনি। হাতের ইশারায় বাড়িয়ে ধরা সেই খাবার সরিয়ে দিয়ে সে বড়ো বড়ো পায়ে হেঁটে গিয়ে দাঁড়িয়েছিল খাওয়া দাওয়ার সেই আসরে। তারপর গম্ভীর গলায় ডাক দিয়েছিল, “ঈশ্বরের ডাক এসেছে। আমার সঙ্গে চলো।”
একটা শান্ত, আত্মবিশ্বাসী ছাপ ছিল তার শরীরের ভাষায়। তার গলার শব্দে সেই আশ্চর্য জাদুর ছোঁয়া ছিল, যার কোনো প্রতবাদ হয় না। সে-আদেশ শুনে বিনা প্রতিবাদে নীরবে খাওয়া ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়েছিল তার গোষ্ঠীর প্রতিটি মানুষ। এমনকি ছোটো ছোটো শিশুরাও কোনো প্রতিবাদ করেনি কোনো।
নিঃশব্দে, আশ্চর্য শৃঙ্খলা মেনে বুনো সেই মানুষদের দল এরপর তার পেছন পেছন সার বেঁধে এগিয়ে গিয়েছিল নদীর ঢালের দিকে। সেখানে মাটির বুকে পড়ে থাকা সেই গোলকটার দেখা পেয়ে তদের কেউ কেউ ভারী বিস্মিত হয়ে তার দিকে এগিয়ে যাবার চেষ্টা করে যেন ধাক্কা খেয়ে ছিটকে পড়েছিল দূরে। ব্যাখ্যাহীন তীব্র আতঙ্কের ঢেউ তাদের শরীরকে অবশ করে দিয়েছিল। গোটা দলটা গোলকদেবতার কাছাকাছি গিয়ে পৌঁছোবার পর অবশ্য আর কোনো আদেশ দিতে হয়নি মুহিরাকে। কোনো অদৃশ্য ইশারায় মানুষগুলো জিনিসটাকে ঘিরে পঞ্চাশ হাতের ব্যবধান বজায় রেখে গোল হয়ে বসেছিল। আর তারপর তাদের অজান্তেই গভীর ঘুম ছেয়ে এসেছিল তাদের চোখে…
সূর্য ধীরে ধীরে মাঝ আকাশের দিকে এগিয়ে চলেছিল। ঝলমলে নীল আকাশের তলায়, নদীতীরের নরম মাটিতে একটা ছোটো গোলককে ঘিরে মানুষের দলটা যেন গভীর ধ্যানে ডুবে রয়েছে। অসীম কৌতূহল নিয়ে দোরাদাবু তাদের সমস্ত স্মৃতিকে আহরণ করে নেয় নিজের শরীরে। আশ্চর্য এই পরজীবীদের সম্পূর্ণ ইতিহাস, এই গ্রহের দূর দূরান্তরে, তাদের উত্থান, দীর্ঘ পথ পেরিয়ে তাদের এই নদীর ধারের দেহে আসা, এখানে বসবাস, তাদের ওপরে জাদুকরদের বার্ষিক হানা…
এই জাদুকরদের বিষয়ে এদের স্মৃতিগুলো তাকে কৌতূহলী করে তুলছিল। দোপেয়ে এই পরিজীবীদের মতই আর একটি গোষ্ঠী। আগের দিন রাতে মুহিরার স্মৃতি থেকে তাদের কিছু কিছু ছবি সে উদ্ধার করেছিল। কিন্তু আজ এদের মিলিত স্মৃতি থেকে সেই ছবিগুলো পূর্ণতা পাচ্ছে।
বিস্মিত হচ্ছিল দোরাদাবু। প্রকৃতির লীলা বড়ো বিচিত্র। শ্বেতধারা নক্ষত্রমণ্ডল জুড়ে যে অসংখ্য গ্রহের সুবিপুল সমাজ, একটি গ্রহের মৃতিদেহের গায়ে গজিয়ে ওঠা এই পরজীবীদের মধ্যেও সেই সমাজেরই অবিকল একটা ছবি গড়ে উঠেছে যেন। দূরে দূরে একেকটি গোষ্ঠী। কেউ খানিক উন্নত, কেউ খানিক পিছিয়ে পড়া। উন্নতরা পিছিয়ে পড়াদের সভ্যতাকে আক্রমণ করে ধ্বংস করে দেয়। লুটেপুটে নিয়ে যায় তাদের সম্পদকে। শ্বেতধারা বুকেও তো সেই একই যুদ্ধ চলত ক্রমাগত। উন্নততর গ্রহমণ্ডলের গোষ্ঠীদের নিষ্ঠুর আক্রমণে হার মানত দুর্বলতর গ্রহগোষ্ঠীরা। পরাজিত গ্রহদের কাউকে অভিকর্ষের শেকলে বন্দি করে নিয়ে যাওয়া হত বিজয়ী গ্রহদের সৌরমণ্ডলে। কাউকে বা আহুতি দেয়া হত তার নক্ষত্রের জ্বলন্ত বুকে। বিজিতদের সমস্ত সম্পদ- তাদের অজস্র উপগ্রহ, ধূমকেতু ও গ্রহাণুরা লুঠ হয়ে যেত আক্রমণে আসা গ্রহমণ্ডলের অভিকর্ষের মর্মান্তিক টানে।
এই জাদুকরদের স্মৃতিকে অনুসন্ধান করতে গিয়েই সে টের পাচ্ছিল, এদের বুকের গভীরে একটা ভয় কাজ করে চলেছে। তার তৈরি করে দেয়া কৃত্রিম আতঙ্কের সম্মোহন নয়। দ্বিতীয় এই ভয়টার শেকড় আরো গভীরে। তারা জানে জাদুকরদের ফিরে আসবার সময় হয়েছে। জঙ্গলের গভীরে তাদের পাঠানো চররা অপেক্ষায় আছে বনস্পতিদের পাতার আড়ালে। প্রতি মুহূর্তে তাদের কাছ থেকে আক্রমণের সঙ্কেত আসবার আশঙ্কা নিষ্ঠুর একট ফাঁসের মত চেপে বসে আছে এদের চেতনায়।
কোথাও একটা গভীর সহানুভূতিরও ছোঁয়া লাগছিল তার মনে। শ্বেতধারার দৈত্যাকার গ্রহসমাজে তার মত তুচ্ছ আকারের গ্রহরা বড়ই দুর্বল, বড়োই অরক্ষিত ছিল। তাদের তুচ্ছাতিতুচ্ছ সৌরমণ্ডলরা তো এইভাবেই কতবার বিধ্বস্ত হয়েছে তুলনায় বড়ো ও শক্তিশালী হানাদার গ্রহমণ্ডলের হানাদারিতে। তফাতের মধ্যে, এরা আক্রমণ হলে পালাতে পারে, আর তারা ছিল তাদের নিজের নিজের নক্ষত্রের অভিকর্ষের টানে বন্দি। আক্রমণের সময় ভয়ার্ত যে গ্রহেরা সেই অভিকর্ষকে ছিঁড়ে মহাশূন্যের গভীরতায় একবার পালিয়ে যেত, আর কোনোদিন কেউ তাদের কোনো সন্ধান পেত না। সেই পলাতক, দুর্বল গ্রহজীবদের কেউ কেউ হয়তো কোনো নতুন সৌরমণ্ডলে আশ্রয় পেত। ইতিহাসে সে উদাহরণ কিছু কিছু আছে। কিন্তু তাদের অধিকাংশেরই শেষ আশ্রয় হত মহাকাশের অসীম শূন্যতয় চিরনির্বাসিতের ভবঘুরে জীবন। সে জীবনের যন্ত্রণাকে সে নিজেও তো সদ্যই অনুভব করে এসেছে। সে-স্মৃতি তার চেতনায় এখনো তাজা।
***
তন্দ্রাচ্ছন্ন মানুষগুলো কোনোকিছু অনুভব করবার আগেই দোরাদাবু তাদের উপস্থিতি টের পেয়েছিল। প্রথমে অবশ্য শুধুই দূর থেকে ভেসে সা কিছু জীবজন্তুর ভয়ার্ত ডাক। শব্দগুলো পেয়েই সেদিকে নিজের মনোযোগকে ঘুরিয়ে ধরেছিল সে। আর তার পরেই সে অনুভব করেছিল, সেদিকে অরণ্যের গভীরে বহুদূরে একরাশ চেতনার উপস্থিতি। তুলনায় উন্নততর, হিংস্র, আসন্ন যুদ্ধের উত্তেজনায় টগবগ করে ফুটতে থাকা কিছু মন…
তাকে ঘিরে বসে থাকা অসহায়, অনুন্নত পরজীবীগুলোর দিকে ঘুরে দেখল সে একবার। একটা অজানা অবুভূতি পাক খেয়ে উঠছিল তার মনে। এরা আর আশ্রিত। এদের রক্ষা করবে সে। রক্ষা করবে ওই ধেয়ে আসা আক্রমণকারীদের হাত থেকে। আর, কেবল রক্ষাই নয়, আর কোনোদিন যাতে ওই আক্রমণকারীরা ফিরে না আসে তার বন্দোবস্তও করতে হবে তাকে। এই পরজীবীদের নদীতীরের আবাসে তার নতুন সাম্রাজ্যের সূচনা হবে। তার রূপ কেমন হবে তা সে এখনও জানে না। কোন পথে এর নিজেদের সভ্যতাকে গড়ে তুলবে, কী রূপ নেবে তা আগামী দিনগুলোতে তা জানবার বা এদের বলে দেবার কোনো উপায় তার কাছে নেই। সে-পথ এদের নিজেদেরই খুঁজে নিতে হবে। উপস্থিত তার কাজ হবে এদের সেই পথে চলবার জন্য প্রয়োজনীয় শান্তি ও নিরাপত্তা দেয়া।
তার মনোযোগ অন্যদিকে সরে যেতে মানুষগুলো ফের একবার সচেতন হয়ে উঠছিল। ধীর ধীর তাকে ঘিরে উঠে দাঁড়াচ্ছে তারা। আকাশ থেকে নেমে আসা মাটিপাথরের সেই গোলকের দিক থেকে এইবার তাদের মনোযোগ সরে গেছে দূরে উত্তরের অরণ্য থেকে ভেসে আসা কিছু মানুষের আর্তনাদ আর বহু মানুষের যুদ্ধের হাঁকের দিকে। হানাদাররা এসে গেছে। গাছের আড়াল থেকে বসতিকে সঙ্কেত দিয়ে সতর্ক করে দেয়া বৃদ্ধবৃদ্ধাদের খুঁজে বের করে তাদের এ-বছরের নরমেধের সূচনা করেছে তারা। ভীত মানুষগুলো একে একে তাদের নেতা মুহিরাকে ঘিরে দাঁড়াচ্ছিল এসে।
আর ঠিক তখনই তাদের মাথার মধ্যে বাজের মত ঝলসে উঠল একটা আদেশ। শব্দহীন সেই আদেশ সরাসরি সঙ্কেত পাঠাচ্ছিল তাদের পেশিচালক স্নায়ুদের কেন্দ্রে। যন্ত্রপুতুলের মতই হঠাৎ সার বেঁধে দাঁড়িয়ে পড়ল তারা। তারপর সুশৃঙ্খলভাবে দ্রুতপায়ে হাঁটতে হাঁটতে গোলকের অদৃশ্য নিরাপত্তাবেষ্টনীকে পাক দিয়ে তারপেছনে নদীর জলের ধার ঘেঁষে দল বেঁধে বসে পড়ল।
***
“মাতৃকাদেবীর কৃপা।” হাতের কুঠারের পাথুরে ফলা থেকে রক্তের দাগ মুছতে মুছতে ইমস্রা বলে উঠলেন।
তাঁর বাহন অতিকায় ষাঁড়টি তাঁদের এইভাবে দাঁড়িয়ে পড়াটাকে পছন্দ করছে না ঠিক। সামনে বেশ কিছুটা দূরে নদীর ধারে জড়ো হওয়া মানুষগুলোর দিকে নজর পড়েছে তারও। যুদ্ধবাজ জীবটা এখন সেইদিকে ছুটে যেতে চায়। হাতের হালকা চাপড়ে তাকে শান্ত করে পেছনে বসা সদ্যনিযুক্ত পুরোহিত অনিগ-এর দিকে ঘুরে তিনি আবার বললেন, “এবং আপনার মন্ত্রশক্তির সুফল।”
অরণ্যের এই শেষপ্রান্ত থেকে এখানকার বুনোদের বসতিটা পরিষ্কার নজরে আসে। জায়গাটায় প্রাণের কোনো স্পর্শ নেই। কিন্তু সেখান থেকে খানিক দূরে নদীর একেবারে ধার ঘেঁষে অবিশ্বাস্য দৃশ্যটা ফুটে আছে। গোটা গ্রামের মানুষ অরণ্যে আশ্রয় না নিয়ে সম্পূর্ণ অরক্ষিত হয়ে মাটিতে মুখ গুঁজে, যেন তাঁদেরই অপেক্ষায় রয়েছে।
সেদিকে একনজর দেখে ইমস্রা-র পাশে দাঁড়ানো অনিগ-এর মুখটা গর্বে ঝলমল করে উঠল। পূজার এতটা সাফল্য তিনিও আশা করেননি। বিশেষ করে এইবারেও এদের বসতির কাছাকাছি আসতেই ওই নজরদারদের হাঁকডাক ওঠবার পর নিজের জীবনের আশা তিনি ছেড়েই দিয়েছিলেন প্রায়। অতএব তার ঠিক পরেই এই আশাতীত সৌভাগ্যের দৃশ্যটা তাঁকে স্তম্ভিত করে দিয়েছে।
খানিক বাদে একটু সামলে নিয়ে নীচু গলায় তিনি বললেন, “আশা করি এইবার আমার স্বপ্নদর্শনে তোমার বিশ্বাস অটুট হবে ইমস্রা।”
আসলে পরপর কয়েকটি বছর হল এই ইন্দা নদীর অববাহিকার বুনোদের চত্বর থেকে ইমস্রা-র দাস সংগ্রহের অভিযান প্রায় ব্যর্থই হয়েছে বলা যায়। বুনোগুলো বুদ্ধিমান হয়ে উঠছে দিন কে দিন। জঙ্গলের মধ্যে নজরদারের ব্যবহার শুরু করেছে। এবং সেখানেও ঘৃণ্য একটা কৌশল করে এরা। নজরদারের দলটা সাধারণত অশক্ত বৃদ্ধ বৃদ্ধাদের নিয়ে তৈরি করা হয়। দাস হিসেবে তারা ম্হিরের সমাজে কোনো কাজেই আসে না। তাছাড়া, উত্তর ও পশ্চিমের পার্বত্য অঞ্চল থেকে শুরু করে, দক্ষিণের অদেখা জলজগতের তীরের বসিন্দাদের বহু জনপদের সঙ্গেই তাদের বাণিজ্য চলে। সমুদ্রতীরের বসতি ইলিহার শঙ্খ, পাহাড় পেরিয়ে ন্যগ্রোধদের দেশ থেকে মহামূল্যবান ধাতু সীসা কিংবা বদকাশা** দেশের রত্নরাজি নিয়ে ব্যাপারীরা ম্হিরের বাজারে আসে। বৃদ্ধ, অশক্ত দাসের বিনিময়ে সে-সব মহার্ঘ্য বস্তু তারা হাতবদল করতে রজি হয় না।
এ-বছরের অভিযানের শুরুতে তাই গোষ্ঠীপতি একটা আলোচনাসভা ডেকেছিলেন। সেখানে ব্যর্থতার কারণ নিয়ে আলোচনার শুরুতে মাতৃকামন্দিরের এই তরুণ পুরোহিত অনিগ ঘোষণা করে, মূল পুরোহিত সৌহকের পূজায় মাতৃকা অসন্তুষ্ট এবং সে স্বপ্নাদেশ পেয়েছে যে একমাত্র সৌহকের সপরিবার বলি পেলে তিনি সন্তুষ্ট হবেন। অনিগ উচ্চাকাঙ্খী তরুণ। নিজের ভাগ্যকে নিয়ে জুয়া খেলতে তার কোনো সংশয় নেই। তবে এযাত্রা, সৌহকের ওপরে চুড়ান্ত অসন্তুষ্ট গোষ্ঠীপতি তার কথা মেনে নেবার পর থেকে একটু দুশ্চিন্তায় সে ছিল বইকি। কারণ সৌহকের সপরিবার বলির পর গোষ্ঠীপতি ইঙ্গিত দিয়েছিলেন, যদি তার কথা মিথ্যা প্রতিপন্ন হয় তবে তার নিয়তিও ওই সৌহকের মতই হবে।
সেই থেকে অনিগ বড়ো মনোযোগের সঙ্গে মাতৃকার আরাধনা করেছে। প্রতিটি আচার পালন করেছে নিখুঁতভাবে। এবং আজ তার সুফলকে চোখের সামনে দেখতে পেয়ে তার মনে গভীর একটা কৃতজ্ঞতার বোধ জেগে উঠছিল। দেবী তাকে সত্যিই কৃপা করেছেন। তা নইলে এতগুলি দাসকে এভাবে মন্ত্রমুগ্ধের মত নদীর তীরে তাদের জন্য স্থানু করে রাখতেন না।
“তবে আর অপেক্ষা কীসের ইমস্রা? চলো। দেবীর দান মাথা পেতে স্বীকার করে নেয়া যাক।”
পরমুহূর্তে ইমস্রার ইশারায় বাতাস কাঁপিয়ে রণধ্বনি করে উঠল গোটা দলটা। তারপর সেনাপতির ষাঁড়কে ছাড়িয়ে তারা ছুটে গেল সামনের দিকে।
অরণ্য থেকে নদীর তীর লক্ষ্য করে ছুটে আসতে থাকা সৈনিকদের দলটার হাতে অস্ত্রের বদলে এইবার উঠে এসেছে ঘাসে বোনা দড়ির লম্বা লম্বা ফাঁস। নদীর ধারে অপেক্ষায় থাকা লোকগুলো নিরস্ত্র। সামনে মাটিতে পড়ে থাকা একট গোলাকে রেখে তারা যেন তাদের অপেক্ষতেই বসে আছে দল বেঁধে মাথা নীচু করে।
সেদিকে একনজর তাকিয়ে দেখে নিয়ে সঙ্গের পুঁটুলি থেকে শুকনো মাংসের দুটি টুকরো বের করে এনে তার একটা পুরোহিতের দিকে বারিয়ে ধরে অন্যটিতে কামড় বসালেন ইমস্রা। সৈনিকরা তাদের কাজ শেষ করতে খানিক সময় নেবে। ততক্ষণ সামান্য বিশ্রাম…
কিন্তু সুস্বাদু, মশলাদার মাংসের টুকরোটা মুখে দিতে গিয়েও হঠাৎ করে থেমে যেতে হল ইমস্রাকে। কারণ হঠাৎ করেই তাঁর সামনের দৃশ্যটা আমূল বদলে যাচ্ছিল তখন…
***
আর কোনো দয়া নয়। সুরক্ষাবেষ্টনীর পরোক্ষ প্রতিরোধও নয়। ধেয়ে আসা সৈনিকদের দিকে লক্ষ্যস্থির করে মানসিক আঘাতটিকে ঘাতক স্তরে বেঁধে নিল দোরাদাবু। তারপর, অদৃশ্য, বিষাক্ত একটা জালের মতই তাকে ছুঁড়ে দিল সে সামনের দিকে সুরক্ষাবেষ্টনীর সীমা ছাড়িয়ে বেশ খানিক দূরে।
প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই থমকে গেছে সৈনিকের দলটা। অসহনীয়, ব্যাখ্যাহীন আতঙ্কের একটা অতিকায় ঢেউ যেন এসে আছড়ে পড়েছে তাদের ঘিরে।
দাঁড়িয়ে পড়ে থরথর করে কাঁপতে থাকা মানুষগুলো সামনে খানিক দূরে পড়ে থাকা নিরীহদর্শন গোলকর দিকে তাকিয়ে দেখে। প্রাণঘাতী ভয়ের স্রোতটা ওইখান থেকে উঠে আসছে তাদের লক্ষ্য করে। তাদের হাতে ধরা দড়ির ফাঁস খসে পড়েছে এইবার…
আঘাতের শক্তি বাড়াল দোরাদাবু। তার উত্তপ্ত শরীর ছেড়ে ধেয়ে যাওয়া অদৃশ্য সেই শক্তির স্রোত এইবার সরাসরি মরণ আঘাত হেনেছে আক্রমণ করতে আসা সেপাইদের কেন্দ্রীয় স্নায়ুতন্ত্রে। বিদ্যুৎবেগে তা নিষ্ক্রিয় করে দিচ্ছিল তাদের মস্তিষ্কের প্রতিটি স্নায়ুকোষকে…
কাঁপতে কাঁপতে মাটিতে বসে পড়া সৈনিকদের নাক ও কান দিয়ে গড়িয়ে আসা রক্তস্রোত ইমস্রার রক্তে আগুন ধরিয়ে দিল যেন হঠাৎ। ষাঁড়ের গায়ে পায়ের ধাক্কা দিয়ে অস্ত্র উঁচিয়ে ধরল সে। শত্রুদের লক্ষ্য করে ছুট শুরু করেছে তার বাহন। কোন শয়তানি জাদুতে তার গোটা সৈন্যদলটা এইভাবে এক মুহূর্তে মারা পড়ল তা সে জানে না। কিন্তু সে, বহু যুদ্ধের নায়ক দূর্ধর্ষ ইমস্রা, সেই জাদুর জালকে আজ ছিন্ন করবে। কারণ, স্বয়ং মাতৃকার আশীর্বাদপ্রাপ্ত অনিগ তার সহায়।
ছুটে আসতে থাকা অতিকায় জন্তুটার দিকে সর্বশক্তি দিয়ে আরেকটা আক্রমণ ছুঁড়ে দিতে গিয়েও নিজেকে সংযত করল দোরাদাবু। এর আরোহী দুজন মানুষ সম্ভবত এদের নেতা। বিশেষ একটা কারণ এদের বাঁচিয়ে রাখা প্রয়োজন। এদের রোখবার জন্য তার সুরক্ষাবেষ্টনীর পরোক্ষ প্রতিরোধই যথেষ্ট হবে।
দৃশ্য সুরক্ষাবেষ্টনীকে ছুঁয়েই আঘাতটা পেয়ে ষাঁড়ের পিঠ থেকে ছিটকে পড়েছে তার দুই সওয়ার। স্নায়বিক শক্তির এই মর্মঘাতী হানাকে চিনতে পারে না তাদের মস্তিষ্ক। নিঃশ্বাস ও হৃৎস্পন্দন স্তব্ধ করে দেয়া একটা অবুঝ ভয়ের ঢেউ হিসেবেই তাকে চিহ্নিত করে সে কবল। সেই অ-শরীরী আক্রমণের ধাক্কায় মাটিতে পড়ে ছটফট করছিল তারা দুজন।
শুধু, তাদের বাহন সেই জন্তুটা একইরকম গতিতে ধেয়ে আসছিল বেষ্টনির কেন্দ্রে থাকা দোরাদাবুর গোলাকার শরীরকে লক্ষ্য করে। সেদিকে তাকিয়ে এক মুহূর্তের জন্য বিচলিত হয়ে পড়েল দোরাদাবু। তার শরীরের গড়ণ এই দানবের আক্রমণকে প্রতিরোধ করা উপযুক্ত নয় একেবারেই।
পরক্ষণেই নিজের ভুলটা বুঝতে পারল সে। মূর্খ জন্তুটার অনুন্নত মস্তিষ্ক তার চিন্তাতরঙ্গকে অনুভব করতে পারবে না। তার মানসিক প্রতিরোধ বা আক্রমণ তাই এর সামনে নিষ্ফল।
পরমুহূর্তেই এ-সমস্যার সমাধানটাও তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল। হঠাৎ, নিজেকে ঘিরে রাখা সুরক্ষাবেষ্টনীকে সরিয়ে নিয়ে পেছনে অপেক্ষায় থাকা মানুষগুলোর দিকে একটা ছোট্ট মানসিক নির্দেশ ছুঁড়ে দিল সে। সঙ্গে সঙ্গেই উঠে দাঁড়িয়েছে মানুষগুলো। পিলপিল করে ধেয়ে চলেছে তারা ছুটন্ত ষাঁড়কে লক্ষ্য করে। তাদের হাতে একে একে উঠে আসছিল পড়ে থাকা মৃত সৈনিকদের অস্ত্রগুলো।
এইবার ভয় পেয়েছে জন্তুটা। সামনে এতজন মানুষকে অস্ত্র হাতে ছুটে আসতে দেখে থমকে দাঁড়িয়েছে সে। তারপর মুখ ঘুরিয়ে সটান ছুট দিয়েছে দূরের অরণ্যকে লক্ষ করে। তাকে অনুসরণ করে মানুষগুলো খানিক দূর এগিয়ে যেতেই ফের নিজেকে ঘিরে আতঙ্কের সুরক্ষাবেষ্টনীকে ছড়িয়ে দিল দোরাদাবু।
***
দৃশ্যপটটা এমনভাবে এক মুহূর্তে বদলে যাবে সে-কথা ইমস্রা ভাবেনি। তবে অসামান্য যোদ্ধা সে। ফলে ছুটে আসা মানুষগুলোর হাতে যখন সে ও অনিগ ধরা পড়ল ততক্ষণে তাদের অন্তত সাত আটজন মানুষ মাটি নিয়েছে তার অস্ত্রের ঘায়ে।
মাটিতে পড়ে থাকা গোলকটা থেকে প্রায় ষাট হাত দূরে তাদের এনে দাঁড় করিয়েছে মানুষগুলো। মুখে কোনো কথা ছিল না তাদের। তারপর, কোনো অজ্ঞাত আদেশে হঠাৎ তাদের কয়েকজন এগিয়ে এসে ইমস্রা আর অনিগকে ধাক্কা দিয়ে গোলকটার দিকে ঠেলে দিয়েই ফের দূরে সরে গেল তারা।
মাথার মধ্যে তীব্র যন্ত্রণার ধাক্কাটা তখনই ফের একবার টের পেল ইমস্রা ও অনিগ। ঘন, উত্তপ্ত তরলের মত এক সর্বব্যাপী আতঙ্কের অনুভূতির মধ্যে তলিয়ে যেতেযেতেই তাদের মাথার মধ্যে একটা কর্কশ গলা কথা বলে উঠল হঠাৎ, “ফিরে যাও হানাদার ভিনদেশি। নিজেদের দেশে গিয়ে সেখানে দোরাদাবুর আদেশকে জানিয়ে দাও।
ইন্দা নদীর তীর, ঈশ্বর দোরাদাবুর দ্বারা রক্ষিত। কেবল ম্হির জাতিই নয়, আজ থেকে পাহাড় বা সমুদ্র যেকোনো এলাকার যেকোনো জাতির অধিকারের বাইরে থাকবে এই অঞ্চল। এ-আদেশের অন্যথা হলে অমান্যকারীর বসতিতে দোরাদাবুর অভিশাপ লাগবে। এক সূর্য সময়ের মধ্যে তাদের একজন বেঁচে থাকবে না আর। আমার সে-ক্ষমতার পরিচয় তোমরা পেয়েছ।”
“দোরাদাবু… তিনি…কোথায়…”
জবাবে আবার একটা রক্ত জল করা আতঙ্কের অনুভূতি সজোরে আছড়ে পড়ে অসহনীয় যন্ত্রণায় কুঁকড়ে দিল মানুষ দুজনকে।
ক্রমশ
*সে জায়গাকে এখন আমরা মেহেরগড় নামে জানি।
**অধুনা বাদাকশান
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর