ধারাবাহিক উপন্যাস-সিন্ধু নদীর তীরে পর্ব ৪-পিটার বিশ্বাস-শীত ২০২১

সিন্ধুনদীর তীরে –প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্বচতুর্থ পর্বপঞ্চম পর্বষষ্ঠ পর্বসপ্তম পর্বঅষ্টম পর্ব, নবম পর্ব

IMG-20210913-WA0004

প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব– তারপর…

“এর বেশি আমার আর কিছু বলবার নেই মহামান্য,” বলতে বলতে অন্যমনস্কভাবে সামনে নিভু নিভু অগ্নিকুণ্ডের দিকে তাকিয়ে রইলেন সৌগম। এতক্ষণ ধরে বারংবার আহিনের প্রশ্নের জবাবে তিনি কট্টাদিজি গ্রামটির যথাসাধ্য পরিচয় দিয়েছেন তাঁকে। প্রায় তিন শতাধিক বাসগৃহ রয়েছে সেখানে। সৌষ্ঠবহীন কিছু কুঁড়েঘর, লতাপাতায় ছাওয়া, একে অন্যের গা ঘেঁষাঘেঁষি করে একটা ছোটো এলাকায় মধ্যে দাঁড়ানো। জায়গাটা সামান্য নীচু। তার চারপাশে উঁচু পাহাড়চূড়াগুলো বসতি এলাকাকে ঘিরে থাকে। একপাশে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে ইন্দা নদীর দিকে ছড়ানো একফালি সমতলভূমির দিকে। মানুষগুলো আদিম, প্রায় বন্যই বলা যায়। অরণ্য ও নদী তাদের খাদ্যের উৎস। হস্তশিল্প বলতে একমাত্র পাথরের অস্ত্রশস্ত্রের কিছু কর্মশালা।

তবে আদিম হলেও, তারা সতর্ক মানুষ। বসতিকে চারপাশে ঘিরে থাকা পাহাড়চুড়াগুলো ছোটো ছোটো পাহারা চৌকি দিয়ে সুরক্ষিত। তার প্রতিটিতে দশজন করে যোদ্ধা ও প্রচুর অস্ত্রসম্ভার নিয়ে দিনরাত  জেগে থাকে। বারংবারই তিনি বলতে চেয়েছেন, এদের সঙ্গে যুদ্ধে বিপুল রক্তক্ষয় নিশ্চিত। আর দৈবক্রমে যদি জয় আসেও, তা হলেও তাতে আমহিরির কোনো ঐহিক লাভ হবে না। সভ্য দুনিয়ায় মূল্যবান বলতে যা বোঝায় তেমন কোনো সম্পদই নেই এই বুনো, অসভ্য অপমনুষ্যদের ডেরায়।

নীরবে তাঁর কথাগুলো  বিশ্লেষণ করছিলেন আহিন। সৌগম ব্যবসায়ী। লাভ-লোকসানের হিসেবটা তিনি শুধুমাত্র ব্যাবসার দৃষ্টিকোণ থেকেই বিচার করে থাকেন। সেটাই স্বাভাবিক। কিন্তু আহিনের চোখ অন্য কিছু দেখে। তিনি একজন দক্ষ শাসক। তাঁর অভিজ্ঞ মন বারংবার একটা বিষয়ের দিকেই ঘুরে যাচ্ছিল কথাগুলো শুনতে শুনতে। অজেয় কট্টাদিজিতার বুনো বাসিন্দাদের হাতের পাথরের দুর্বল  অস্ত্রশস্ত্র কেবল নিজের জোরে তাকে অজেয় বানাতে পারত নাকিন্তু সে অস্ত্রের সঙ্গে যোগ দিয়েছেন স্বয়ং প্রকৃতি। এর অবস্থানের গুণে ঐ সামান্য অস্ত্রশস্ত্রও বহুগুণে শক্তিশালী প্রতিপক্ষকে রুখে দিতে পারে।  তিনদিকে পাহাড় ও একদিকে নদীর দুর্লঙ্ঘ্য বাধা তাকে সুরক্ষা দেয়। পাহাড়গুলোর মাথায় চৌকিদের সৈনিকরা, বসতি আক্রমণে আসা বিশাল সৈন্যদলকেও চারদিক থেকে পাথর ফেলে কিংবা তিরের ঝাঁক পাঠিয়ে নিকেশ করে দিতে সক্ষম।

আদর্শ দুর্গ ও সেনানিবাস হিসেবে অতুলনীয় এই কট্টাদিজি। কিন্তু…

এই কিন্তুটাই বারবার তাঁকে ভাবিয়ে তুলছিল। কট্টাদিজি নগর স্থাপনের যোগ্য স্থান নয়। তার জন্য প্রশস্ত সমতলভূমি দরকার। অথচ তবু মহান দোরাদাবু…

কথাটা মনে আসতেই সব সংশয় ঝেরে ফেললেন তিনি। ঈশ্বরের আদেশ। তাকে সুষ্ঠুভাবে পালন করাটাই তাঁর কর্তব্য। তাঁর উদ্দেশ্যকে প্রশ্ন করার  ফল শুভ হয় না কখনো। অন্তর্যামী দোরাদাবুর কিছুই অজানা থাকে না। ভেতরে ভেতরে একটু শিউরে উঠে মনে মনেই একবার ক্ষমা চেয়ে নিলেন তিনি তাঁর ঈশ্বরের কাছে। আসল কাজে মনঃসংযোগ করতে হবে এবারে। অজেয় কট্টাদিজি! গত কয়েক ঘণ্টা ধরে বারংবার প্রশ্ন করে সৌগমের কাছ থেকে যা তথ্য পাবার তিনি পেয়েছেন অথচ তাতে কোনো লাভ…

হঠাৎ কী মনে করে ফের একবার সৌগমের দিকে ঘুরে বসলেন তিনিএকটু অন্যপথে চেষ্টা করা যাক। দুর্যোগের মুহূর্তে যেকোনো বসতির দুর্বলতাগুলি প্রকট হয়। এখানেও তা নিশ্চয় হয়ে থাকবে। বন্যা, দাবানল, ঝড়, শত্রুর আক্রমণ—এহেন বিবিধ দুর্যোগ তো যেকোনো বসতির নিত্যসঙ্গীই বটে।

আগুন নিভে এসেছে। ধিকিধিকি অঙ্গারের স্তূপের অন্যপাশে বসে ঢুলছিলেন প্রৌঢ় মানুষটা। সৈনিকদের সঙ্গে লম্বা পথ পাড়ি দিয়ে, তারপর প্রায় সারারাত আহিনের সঙ্গে আলাপচারির শেষে বড়ো ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন তিনি। পাহড়ি অঞ্চলের শেষরাত্রি ঠান্ডার আমেজ আনে। হাওয়ায় সেই শৈত্যের হালকা ছোঁয়ায় একটু কুঁকড়ে উঠছিল সৌগমের শরীর। 

পাশ থেকে কয়েকটা কাঠ তুলে নিয়ে আগুনের মধ্যে ফেলে দিলেন আহিন। তারপর অগ্নিকর্দমে(১) ভিজিয়ে শুকিয়ে রাখা গাছের ছালের কয়েকটা পুঁটুলি তাতে ছুঁড়ে দিতেই লকলক করে উঠল আগুনের শিখা।

হঠাৎ আগুনের হলকার উত্তাপে চোখ মেলে সোজা হয়ে বসলেন সৌগম। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আহিনের তীক্ষ্ণ দৃষ্টির সঙ্গে চোখাচোখি হতে সামান্য লজ্জিত গলায় বললেন, “ক্ষমা মহামান্য। ঘুমিয়ে পড়েছিলাম। আসলে বয়স হয়েছে…”

আহিন মাথা নাড়লেন। তারপর বললেন, “আর সামান্যই কষ্ট দেব আপনাকে সৌগম।”

“আদেশ প্রভু।”

“গল্প বলুন সৌগম। এই বসতিতে যাতায়াত কালে কখনও কি এদের কোনো প্রাকৃতিক বা দৈবী বা অন্য কোনো দুর্যোগের মুখোমুখি হতে দেখেছেন?”

কিছুক্ষণ চিন্তা করলেন সৌগম, তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “দেখেছি মহামান্যএকবার ঘন বর্ষণে পাহাড় থেকে নেমে আসা কর্দম ও নুড়িপাথরের ঢল এই বসতিকে প্রায় নিশ্চিহ্ন করে দিয়েছিল। আমার পণ্যসামগ্রীসহ বেশ কিছু পশুও তাতে মারা পড়ে। বড় ক্ষতি হয়ে গিয়েছিল সেযাত্রা…” বলতে বলতেই সেই হারানো পণ্যের শোকে মুখটা করুণ হয়ে উঠছিল সৌগমের। আরো বিস্তারিতভাবে ঘটনাটা বলবার উপক্রম করছিলেন তিনি, কিন্তু আহিন বাধা দিলেন, “এছাড়া, আর অন্যকিছু?”

কিছুক্ষণ চুপ করে ভাবলেন সৌগম। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “আর একবার অন্য সমস্যায় পড়তে হয়েছিল কট্টাদিজিতে আশ্রয় নিতে এসে। সেবারও বর্ষাকাল ছিল। বসতিতে পৌঁছে দেখি তা একরকম শ্মশান হয়ে গেছে। বাড়িগুলো দগ্ধ। বেশ কিছু পোড়া মৃতদেহ ঘিরে শকুনের উৎপাত। বাকি গ্রামবাসীদের কোনো চিহ্ন নেই। চারপাশের পাহাড়ে অরণ্যে প্রাণ নিয়ে পালিয়েছিল সেবার এখানকার জীবিত বাসিন্দারা।”

“ঘোর বর্ষায় দাবাগ্নি?” একটু বিস্মিত গলায় প্রশ্ন করলেন আহিন।

সৌগম মাথা নাড়লেন, “অগ্নিকর্দম, মহামান্য। আপনার তীক্ষ্ণ ধীশক্তির কল্যাণে যার দাহিকাশক্তিকে আমরা চিহ্নিত করে বশ করতে পেরেছি, সেই অগ্নিকর্দমের নির্বোধ প্রয়োগই এদের সেই সর্বনাশের মূল।”

“অগ্নিকর্দম? এখানে…”

সৌগম মাথা নাড়লেন, “এই পর্বতশ্রেণী জুড়ে উচ্চমানের অগ্নিকর্দমের বহু উৎস আছে। এই হতভাগ্য বর্বরেরা  সেই বিপজ্জনক কর্দম এনে প্রতিটি ঘরে বড়ো বড়ো কূপে তাকে সঞ্চয় করে রাখে। সেই এদের অগ্নির উৎস। এদের কুটিরগুলো গা ঘেঁষাঘেঁষি করে তৈরি। আর আপনার তো অজানা নেই যে অগ্নিকর্দমের পাত্রেকূপে একবার আগুন লাগলে বর্ষার ধারাও  তাকে সহজে…”

মাথা নাড়লেন আহিনঅগ্নিকর্দম! অন্যান্য আগুনকে জলসিঞ্চনে বশ করা গেলেও এ আগুন তাতেও সহজে বশ মানে না। নামটার সঙ্গে তাঁর নাম জড়িয়ে থাকবে চিরকাল। পাহাড়ের দেহ থেকে চুঁইয়ে আসা জলনিরোধক এই বস্তুটি দিয়ে ঘাসপাতার পাত্রে প্রলেপ দিয়ে তাকে জল রাখবার উপযুক্ত করা হত। মানুষের কাছে ওর বেশি মূল্য ছিল না এর। আহিনই প্রথম লক্ষ করেন, কৃষ্ণবর্ণ, আঠালো ও দুর্গন্ধযুক্ত এই প্রায় মূল্যহীন বস্তুটি অগ্নিদেবেরও প্রিয় খাদ্য।  এই আবিষ্কারের পর থেকে গত কয়েক বছরে আমহিরি নগরীসহ সভ্যজগতের অন্যান্য বসতিতেও এর নতুন প্রয়োগের জনপ্রিয়তা এতটাই বেড়েছে যে তাকে ‘আহিনের অগ্নিকর্দম’ নামেই চেনে এখন মানুষজন। তবে এর ভয়াবহ দাহিকাশক্তির বিষয়ে আহিন ওয়াকিবহাল থাকবার ফলে একমাত্র ধাতুকর্মীদের কর্মশালা ভিন্ন এর অন্যত্র প্রয়োগ আমহিরিতে নিষিদ্ধ। আর এখানে এই বর্বররা সেই ভয়ঙ্কর বস্তুকে…

এই অসভ্যেরা তবে তাঁর আগেই অগ্নিকর্দমের এই গুণ আবিষ্কার করেছিল! ভেতরে ভেতরে সামান্য ঈর্ষা হচ্ছিল আহিনের। কিন্তু পরমুহূর্তেই অনুভূতিটাকে ঝেরে ফেললেন তিনি। বন্য, বর্বর অর্ধমানুষের দল। দৈবক্রমে অগ্নিকর্দমের গুণ নির্ধারণ করে ফেললেও তাতে তাদের অমঙ্গলই হয়েছে। এর সঠিক ব্যবহারের কৃতিত্ব…

কথাটা ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ মুখে হালকা একটুকরো হাসি ফুটে উঠল আহিনের। পথ পাওয়া গেছে। এদের এই আবিষ্কারই এদের মৃত্যুবাণ হয়ে উঠবে এবারে।

উঠে দাঁড়িয়ে নরম গলায় তিনি বললেন, “আপনার সাহায্যের জন্য অশেষ ধন্যবাদ সৌগম। রাত শেষ হবার পথে। এবার আপনি যেতে পারেন। কাল আপনার ওপরে একটি গুরুদায়িত্ব দেব।  এখন তাই যতটুকু পারেন বিশ্রাম নিন।”

সৌগম সরে যেতে পেছনের অন্ধকারের দিকে ঘুরে একবার ইশারা করলেন আহিন। প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই সেখান থেকে বের হয়ে দীর্ঘকায় মানুষটা তাঁর সামনে এসে দাঁড়াল।

“প্রণাম মহামান্য।”

“এসো বৈক্লন্য। আমাদের আলোচনা আশা করি সম্পূর্ণই শুনেছ?”

“হ্যাঁ। মহামান্য। কিন্তু এতে কাজের কোনো কথা…”

বিরক্ত ভঙ্গীতে একবার ভ্রূ কোঁচকালেন আহিন। তারপর মাথা নেড়ে বললেন, “চিন্তা করা তোমার কাজ নয় মূর্খ। সে দায়িত্ব পুরোহিতের। তুমি ও তোমার সৈন্যরা কেবল আমার আদেশ পালন করবে, এই হল মহান দোরাদাবুর নির্দেশ, তা কি ভুলে গেলে?”

বৈক্লন্য সামান্য ভীতভাবে মাথা নাড়লেন। দোরাদাবুর আশীর্বাদে সর্বশক্তিমান পুরোহিত শাসকদের অপরিমিত ক্ষমতা ও জাদুকরি শক্তির মাহাত্ম্য তাঁর অজানা নয়।

“বেশ। এখন আদেশ শোনো। কট্টাদিজি এখান থেকে ছয় ঘটিকার পথ। কাল সকালে একটি ছোটো সার্থবাহ একত্র করবে। আমাদের আনা রসদ থেকে কিছু সাধারণ খাদ্যসামগ্রী, কিছু অস্ত্র তাদের পণ্য হবে। সার্থবাহের নেতৃত্বে থাকবেন সৌগম। তিনি কট্টাদিজিতে পরিচিত মুখ। ফলে বাণিজ্যে সমস্যা হবে না। তোমার বিশ্বস্ত সৈনিকদের থেকে বাছাই করা দশজন যোদ্ধা বণিকের ছদ্মবেশে তাঁর সঙ্গী হবে।  সার্থবাহের কাজ হবে সেইসব পণ্যের বিনিময়ে কট্টাদিজি থেকে বেশ কিছু পরিমাণ অগ্নিকর্দম সংগ্রহ করে আনা।”

“অগ্নিকর্দম! কিন্তু… আমহিরি নগরীতে তো সে বস্তুর কোনো অভাব নেই মহামান্য। সেক্ষেত্রে ওই বিপজ্জনক বস্তু এখান থেকে সংগ্রহ করে…”

“আবার তোমায় সাবধান করছি বৈক্লন্য। প্রশ্ন করা তোমার কাজ নয়। এবার শোনো। কট্টাদিজিতে থাকাকালিন তোমার দ্বিতীয় কাজ হবে একে ঘিরে পাহাড়ের গায়ে গায়ে লুকোনো এদের প্রহরীশিবিরগুলোর সন্ধান নেয়া। বসতির পূর্ব, পশ্চিম, উত্তর ও দক্ষিণে নিকটতম চারটি এমন শিবিরের অবস্থান চিহ্নিত করবে ও সেখানে পৌঁছোবার পথগুলোর সন্ধান নেবে। চিহ্নিত শিবিরগুলো থেকে বসতির দূরত্ব যেন তিরন্দাজদের পাল্লার মধ্যে থাকে সেটা মনে রাখবে।

“তোমরা অগ্নিকর্দম সংগ্রহ করে শিবিরে ফিরে আসবার পর আমরা যুদ্ধযাত্রা করব। শিবিরে ফিরে এসে তুমি প্রথমে দোরাদাবুর উদ্দেশ্যে যুদ্ধপূর্ববর্তী উপাসনার আয়োজন করবে।”

“আজ্ঞা পালিত হবে মহামান্য। উপাসনার বলি কি কট্টাদিজি হতে…”

“মূর্খ। ঈশ্বর দোরাদাবু মানুষ বলি চান। কট্টাদিজির অর্ধপশুরা আমহিরির তরবারির খাদ্য হতে পারে, কিন্তু দোরাদাবুর বলি হবার যোগ্যতা বা পূণ্যবল তাদের নেই।”

“সেক্ষেত্রে সৈন্যদের থেকে কোনো একজনকে…”

“এ যুদ্ধে প্রতিটি সৈনিক মূল্যবান বৈক্লন্য। তারা নয়। তাই সর্বাংশে উপযুক্ত বলি আমি সঙ্গে করে নিয়ে এসেছি। আমরা সৌগমকে এই উপাসনায় উৎসর্গ করব। তিনি বৃদ্ধ। অশক্ত। এই অভিযানে তাঁর ভূমিকা শেষ হয়েছে। যুদ্ধজয়ের অব্যর্থ পথনির্দেশ দিয়ে তিনি দোরাদাবুর প্রিয়পাত্র হয়েছেন। অতএব উপাসনান্তে তাঁর বলিদানে দোরাদাবুকে তৃপ্ত করবে তুমি। তারপর প্রয়োজনীয় নির্দেশ নেবার জন্য আমার কাছে আসবে।”

সামান্য একটু হাসি ফুটল এবার বৈক্লন্যের মুখে। বলিপ্রদত্ত যেকোনো পূণ্যবানের ক্ষেত্রেই তার গৃহবাসী আত্মীয়পরিজনসহ যাবতীয় সম্পত্তি পুরোহিতের অধীনে আসে। তার থেকে সামান্য অংশ পারিতোষিক হিসেবে বলিকারের ভাগেও পড়ে। সৌগমের বিষয়সম্পত্তির সম্বন্ধে তিনি যতদূর শুনেছেন  তাতে সেই সামান্য অংশও নিতান্ত কম হবে না। তার পরিবারটিও বৃহৎ। তার থেকে দাস হিসেবে দু’একজন নিঃসন্দেহে তাঁরও প্রাপ্য হবে। পুরোহিতের কৃপা হলে এদের থেকে একটি উপযুক্ত শিশুর অধিকার যদি তিনি পান…

বৈক্লন্য নিঃসন্তান। যুদ্ধব্যবসায়ের উপার্জিত প্রচুর ধনসম্পত্তির রক্ষার জন্য একটি উপযুক্ত উত্তরাধিকারীর সন্ধান তিনি বেশ কিছুকাল ধরেই করে চলেছেন।    

আভূমি নত হয়ে আহিনকে প্রণাম করলেন তিনি। তারপর অক্ষরে অক্ষরে আদেশ প্রতিপালনের প্রতিশ্রুতি দিয়ে ফের মিলিয়ে গেলেন রাত্রিশেষের কুয়াশায় ঢাকা চত্বরটি পেরিয়ে।

ভোর হয়ে আসছিল। হালকা কুয়াশায় মোড়া প্রান্তর জুড়ে কর্মব্যস্ততা শুরু হয়েছে। যুদ্ধের বাহন এবং খাদ্য হিসেবে সঙ্গে করে আনা বৃষগুলোর থেকে বাছাই করা কয়েকটিকে তাড়িয়ে এনে একত্র করছিল কয়েকজন সৈনিক। সকাল হবার আগেই ঘুম ভাঙিয়ে বের করে আনা অনিচ্ছুক জন্তুগুলোর প্রতিবাদের হাঁকডাক শুনতে শুনতেই  নিজের অলঙ্কৃত সিংহচর্মটি বের করে এনে ভূমিশয্যা নিলেন আহিন। বৈক্লন্য তার কর্তব্য সুষ্ঠুভাবেই পালন করবে। সৌগমের বলিদানের আদেশ পেয়ে তার লোভাতুর দৃষ্টি আহিনের নজর এড়ায়নি। তুচ্ছ সাধারণ মানুষ। সামান্যেই সন্তুষ্ট হয় এরা। সেই ভালো। ভয় ও লোভ, যতক্ষণ এই দুটি শক্তিশালী অস্ত্র হাতে আছে, ততক্ষণ তাঁর মত সুদক্ষ শাসকের কাছে কিছুই অজেয় নয়।

ঘুমের অতলে তলিয়ে যেতে যেতেই অস্ফুট গলায় ঈশ্বর দোরাদাবুর উদ্দেশ্যে একটি প্রশস্তিমন্ত্র উচ্চারণ করছিলেন পুরোহিত আহিন। পুবের আকাশে তখন প্রথম সূর্যের লাল আভা জেগে উঠেছে।

“বলো বৈক্লন্য।”

দুপাশে সার বেঁধে অপেক্ষায় থাকা তরুণ সৈনিকদের মধ্যে দিয়ে ধীরপায়ে পুজাবেদির দিকে এগিয়ে আসতে আসতে সৈন্যাধক্ষের দিকে মুখ ঘুরিয়ে প্রশ্নটা ছুঁড়ে দিলেন আহিন। গত সন্ধ্যায় তারা রওনা হবার পর একটি রাত ও দিন বড়ো উৎকন্ঠায় কেটেছে তাঁর। অবশেষে এখন, রাত্রির এই চতুর্থ প্রহরে তাঁর ঘুম ভাঙিয়েছিল বৈক্লন্য। তার মুখে সাফল্যের হাসি ছিল।

বেদীটা অর্ধচন্দ্রাকার। তার অবতল দিক পূর্বমুখ করা। পরিমাপশাস্ত্রে অভিজ্ঞ বাস্তুকার পুরোহিত অজিনের সৃষ্ট দ্বাদশ শ্রেণীর পূজাবেদীর মধ্যে এটি অন্যতম। সাধারণত বলির উৎসর্গকর্মে এর ব্যবহার। উপস্থিত তার ওপরে ছড়িয়ে থাকা রক্তের কালচে হয়ে ওঠা আবরণ প্রমাণ দিচ্ছিল, সৌগমের বলিদানের প্রক্রিয়াটি সুষ্ঠুভাবেই সম্পন্ন হয়েছে।

বৈক্লন্য তৃপ্তমুখে বেদির দিকে ইশারা করে, খানিক দূরে গাছের ছালের চাদর দিয়ে মোড়া শরীরটার দিকে দেখালেন। “বলি নির্বিঘ্নে সম্পন্ন হয়েছে মহামান্য। মূর্খ সৌগম অবশ্য স্বেচ্ছায় ইশ্বরের এই আশীর্বাদকে গ্রহণ করতে চায়নি। খানিক শক্তিপ্রয়োগ করতে হয়েছিল শেষ অবস্থায়। তবে তাতে কোনো বিঘ্ন হয়নি বিশেষ। এইবার আপনার আদেশ হলে দ্রুতগামী বৃষ দিয়ে কয়েকজন সৈনিককে আমহিরি নগরীতে পাঠিয়ে এর বিষয়-সম্পত্তির…”

“কট্টাদিজির জয় সম্পূর্ণ হবার পর সেসব কথা ভাবা যাবে।” রূঢ় গলার একটা ধমকে তাকে থামিয়ে দিলেন আহিন। তারপর প্রশ্ন করলেন, “অগ্নিকর্দম সংগ্রহ করা গেছে?”

খানিক অপ্রসন্ন মুখে বৈক্লন্য একপাশে রাখা বড় বড়ো চামড়ার মশকগুলোর দিকে ইঙ্গিত করে বললেন, “যথেষ্টের বেশিই সংগ্রহ করা গেছে  মহামান্য।”

“এদের প্রহরী শিবিরগুলো…”

“চিহ্নিত হয়েছে। বসতির চারদিকে চারটি। আপনার আদেশমত, বসতি অবধি তিরের নিক্ষেপসীমার মধ্যে রয়েছে এমন চারটি শিবিরকে নির্দিষ্ট করা গেছে। সেখানে পৌঁছোবার পথও দেখে আসা হয়েছে।”

রাত্রির চতুর্থ প্রহর শেষ হয়ে আসছিল। অন্ধকার দিগন্তের কাছে কৃষ্ণাচতুর্দশীর একফালি চাঁদ অস্তগামী। তার ম্লান আলোর দিকে চোখ রেখে আহিন নীচুগলায় বললেন, “বেশ। একশত সৈনিকের একটি দলকে অরণ্যে পাঠাও। দিনের প্রথম দণ্ড পার হবার আগে তারা যতটা সম্ভব শুকনো বাকল সংগ্রহ করে আনবে। এরপর তাতে অগ্নিকর্দম মাখিয়ে পাঁচ সহস্র তিরের ফলায় তার টুকরো পুরু করে জড়াবার কাজ শেষ করবে তারা।

“সন্ধ্যার মুখমুখ এক এক দলে পঁচিশজন সৈনিকের চারটি দল প্রথমে রওনা দেবে। অন্যান্য যুদ্ধাস্ত্রের সঙ্গে প্রতিটি দল এই তির প্রচুর পরিমাণে সঙ্গে করে নেবে। অন্ধকারের আড়াল নিয়ে প্রথমে ওই চারটি প্রহরা শিবিরে পৌঁছে তাদের দখল নেবে তারা। এদের নেতৃত্বে থাকবে তুমি ও তোমার নির্বাচিত আরও তিনজন শ্রেষ্ঠ যোদ্ধা। প্রহরীদের কেউ যেন জীবিত না থাকে। একজনও যদি পালাতে সক্ষম হয় তবে আক্রমণকারী দলের প্রতিটি সদস্য এবং সেনানায়ককে মৃত্যুদণ্ড দেবেন স্বয়ং দোরাদাবু।

“শিবির দখলের পর তারা নিঃশব্দে অপেক্ষায় থাকবে ও মধ্যযামে আমার অগ্নিসঙ্কেত চোখে পড়লে একসঙ্গে তিরগুলির মাথায় অগ্নিসংযোগ করে বসতির দিকে নিক্ষেপ করবে।

“আমার নেতৃত্বে বাকি সৈন্যদল এদের বসতি ছেড়ে বের হবার প্রতিটি পথের বাইরে প্রতীক্ষায় থাকবে ও বহ্ন্যুৎসব শুরু হবার পর বসতি ছেড়ে কেউ পালাতে চাইলে তাদের নিরস্ত করবে।

“আজ রাত্রি চতুর্থ প্রহরের সূচনায় একজন কট্টাদিজিবাসীও জীবন্ত থাকলে অথবা বসতিতে একটিও গৃহ অক্ষত থাকলে সম্পূর্ণ সৈন্যদলটিই দোরাদাবুর উদ্দেশ্যে বলিপ্রদত্ত হবে।”

নিঃশব্দে, যন্ত্রের মতই কর্মব্যস্ততা শুরু হয়ে গেল গোটা শিবিরে। বৈক্লন্য একজন দক্ষ আদেশপালক। তাঁর নেতৃত্বে মৌমাছির ঝাঁকের মত সুশৃঙ্খলভাবে কাজে নেমে পড়েছে গোটা দলটাই। সেদিকে তৃপ্ত চোখে একনজর দেখে নিলেন আহিন। মহান দোরাদাবুর আদেশ সম্ভবত নিখুঁতভাবেই পালিত হবে এবারে। সেটা হওয়াই মঙ্গল। কারণ, সাধারণের কাছে সর্বশক্তিমান পুরোহিত নিজে দোরাদাবুর সামনে একই রকম অসহায়। নির্দেশ পুঙ্খানুপূঙ্খভাবে  পালিত না হবার শাস্তি, পুরোহিতদের ক্ষেত্রে দোরাদাবু স্বয়ং দান করেন। সে শাস্তির ভয়াবহতা আহিন একাধিকবার দেখেছেনহঠাৎ একটা তিক্ত হাসি খেলে গেল তাঁর ঠোঁটে। ভয়! ইন্দাপাড়ের আমহিরি নগরীর সুশৃঙ্খল জীবনের পেছনে প্রধান চালিকাশক্তি  এই ভয়। সেই গভীর ভয়ই এই শহরের সমৃদ্ধি ও শৃঙ্খলার উৎস। এ শহরে তাই কোনো অপরাধ নেই। কোনো বিশৃঙ্খলা নেই। আর যাদের ভয়ে এ-শহর এভাবে কুঁকড়ে থাকে, সেই পুরোহিতসমাজকেও সেই একই অস্ত্রে নিয়ন্ত্রণে রাখেন স্বয়ং দোরদাবুনগরবাসীদের ভয়ের কারণরা নিজেরাও একইভাবে সেই ভীতিরই দাস।

মাঝে মাঝে অবশ্য একটা অন্য আশঙ্কা তাঁর মনে উঁকি দিয়ে যায়। কখনো, কোনো কারণে যদি এমন কেউ আসে, যে এই ভয়ের বৃত্তটাকে ভেঙে দেবে! যদি সে নিজেও অমিত শক্তিশালী হয়? দোরাদাবুর মতই! তবে পরক্ষণেই সে ভাবনাটাকে ঝেড়ে ফেলে দেন আহিন। দোরাদাবু স্বয়ং ঈশ্বর। তাঁর চেয়ে বেশি শক্তিমান হওয়া সম্ভব নয় কারো পক্ষেই। প্রকৃতির নিয়মের বিরুদ্ধে যাবে তা…

***

“মা।”

ছোট্ট ছেলেটা তার পিঠে এসে হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল কোনোমতে টাল সামলে, একটা হাতে তাকে জড়িয়ে ধরে কোলের কাছে টেনে নিল মুঢ়াল। অধিক বয়সের সন্তান। তাই মুঢ়াল তাকে একটু বেশিই ভালোবাসে। হয়তো সেইজন্যই, জন্মের পর বেশ কয়েকটা শীতঋতু কেটে গেলেও মাণ্ডুপ তাকে ছেড়ে যায়নি এখনও।

“এত দুষ্টু হয়েছ তুমি। আমি আগুন নিয়ে কাজ করছি। যদি তার ওপর মুখ থুবড়ে পড়ে যেতাম? কাজের সময় এভাবে কখনো আর আমার গায়ে ঝাঁপ দেবে না।”

বলতে বলতেই ফের একবার সামনের গর্তে কাঠকয়লার গনগনে আভার দিকে মনোযোগ ঘুরিয়ে ধরল মুঢ়াল। সেখানে নরম চকপাথরের পুঁতিদের গায়ে রঙবেরঙের খনিজগুঁড়োর প্রলেপ পাকাপোক্ত হয়ে বসছিল আগুনের ছোঁয়ায়। সেদিকে তাকিয়ে মনটা একবার হু হু করে উঠল মুঢ়ালের। সৌগম! অদেখা কোনো এক আমহিরি শহর থেকে আসা সেই বণিকের কাছেই তার এই বিদ্যায় হাতেখড়ি। বাণিজ্যযাত্রার পথে এই কট্টাদিজিতে দু’একদিনের যাত্রাবিরতিতে, ভিনদেশি এই বিদ্যা শিখিয়েই তরুণী মুঢ়ালকে জয় করেছিল সে একদিন!   

কথাটা মনে হতে নিজের জরাজীর্ণ শরীরের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার মুঢ়াল। কতকাল আগে সে এই পৃথিবীতে এসেছিল তা এখন মনে পড়ে না তার। তবে উপস্থিত সে এই বসতির সবচেয়ে বয়স্কদের একজন। এই আদিম বসতি থেকে বহুদূরে যে নগরদের থেকে বণিকরা মাঝে মাঝেই এখানে আসে, তাদের হিসেবে তার বয়স এখন চল্লিশ ছুঁয়েছে। তবে মূঢ়ালের সে হিসেব জানবার কথা নয়। সংখ্যা দিয়ে জগতকে মাপবার কৌশল এখনও এই আদিম বসতিতে এসে পৌঁছোয়নি।

মাণ্ডুপ তার কোলের কাছে হাঁটু গেড়ে বসে সামনের গর্তে জ্বলন্ত আগুনের দিকে দেখছিল। তবে বেশিক্ষণ  চুপ করে বসে থাকা তার ধর্ম নয়। খানিক বাদে মুঢ়াল নিজের কাজে ফের ব্যস্ত হয়ে উঠতেই সুযোগটা মিলে গেল তার।  উনুনের একপাশে বড়োসড়ো গর্তটার মুখের পাতার ঢাকনা ফাঁক দিয়ে তার মধ্যে হাত ঢুকিয়ে দিল মাণ্ডুপ। তারপর আঠালো অগ্নিকর্দম মাখা হাতটা আগুনের কাছে নিয়ে যেতে মুঢ়াল চমকে উঠে হাতটা চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠল, “আঃ মাণ্ডুপ। কী করছ তুমি?”

“আগুন নিভে আসছে যে। তাতে খানিক অগ্নিকর্দম…”

“হাতটা পুড়ে যাবে সেই খেয়াল আছে কি?” মুঢ়াল ধমকে উঠল, “যাও বাইরে গিয়ে খেলো। কতবার বলেছি, কাজের সময় বিরক্ত করবে না।”

“আমি কাজ করবই। আমি খেলব না।” মাণ্ডুপ মুখ গোঁজ করে দাঁড়িয়ে ঘোষণা করলসেদিকে তাকিয়ে মুঢ়ালের বুকটা ভরে উঠছিল। এইটুকু ছেলেটা তার! তবু এরই মধ্যে মায়ের পরিশ্রমের ভাগ নিতে চাইছে সে…

“বেশ তো। তাহলে তুমি উঠোনে যাও। রোদে দেয়া ইটগুলোর একপিঠ শুকিয়ে গিয়েছে। তাদের উলটে দাও।”

উঠোনের একপাশে গুটিকয়েক মাটির ইট রোদে শুকোচ্ছিল। সেদিকে তাকিয়ে দেখে নিল একবার মাণ্ডুপ। দেয়ালের একটা অংশ গত বর্ষায় ধ্বসে গিয়েছে। তার মেরামতের জন্য ইটগুলো গড়েছে মা।

“কী হল, যাও!”

মাণ্ডুপের মাথায় একটা বুদ্ধি আসছিল। মাথা নেড়ে চোখদুটো সরু করে সে বলল, “দিতে পারি, কিন্তু তাহলে আজ তুমি জঙ্গলে যাবার সময় আমায় সঙ্গে নিতে হবে।”

মুঢ়ালের মুখে একটুকরো হাসি ছড়িয়ে পড়ল। মাণ্ডুপের উজ্জ্বল গমরঙা মুখটাকে দুহাতে জড়িয়ে ধরে তার মাথায় একটা চুমু খেয়ে সে বলল, “কিন্তু সে বড়ো কঠিন কাজ যে। সেখানে উঁচু গাছ থেকে ফল পেড়ে আনা, পাথুরে মাটি খুঁড়ে কন্দ তোলা… এ তোমার  মত ছোটো ছেলের সাধ্য নয় বাবা। তাছাড়া সেখানে হিংস্র বন্য জন্তুরা আছে। তারা…”

মাণ্ডুপ গম্ভীরভাবে মাথা নাড়ল। তারপর বলল, “আমি ভয় পাই না। আমি পিতার মতো বীর। তিনি বলেন, একদিন আমি তাঁরই মতো পণ্যসামগ্রী বোঝাই করা বৃষের বাহিনী নিয়ে তাঁর সঙ্গে বাণিজ্যে যাব। মুন্দিগ্র, ম্‌হিরি, পূর্বে ইষক নগরী… সর্বত্র যাব তাঁর সঙ্গে; গভীর অরণ্য, মরুদেশ এই সবকিছু পেরিয়ে…”

মুখের হাসিটা ধরে রেখেই নিঃশব্দে মাথা নাড়ল একবার মূঢ়াল বেচারা নির্বোধ শিশু। তার পিতা বণিক সৌগম বহুদূর আমহিরি নগরীর বাসিন্দা। বছরে-দু’বছরে বাণিজ্য করতে যাতায়াতের পথে একবার-দুবার এসে তিনি তাকে ও মাণ্ডুপকে দেখে যান।  রেখে যান কিছু ভিনদেশি খাদ্য, কখনও বা মাণ্ডুপের জন্য মাটির তৈরি কিছু বিচিত্র খেলনা।

গতকালও সেই উপলক্ষ্যেই মুঢ়ালের কুঁড়েতে উৎসবের স্পর্শ ছিল। কারণ, সৌগম এসেছিলেন। একেবারে হঠাৎ করেই। নিতান্তই ছোটো একটি বণিকদল নিয়ে।

তবে সৌগমের এহেন আসাযাওয়া একেবারেই সাময়িক। বছরের বাকি দিনগুলো মুঢ়ালকে নিজেকেই নিজের ও মাণ্ডুপের গ্রাসাচ্ছাদনের বন্দোবস্ত করতে হয়। পুঁতি গড়ে তার বিনিময়ে যেটুকু খাদ্য জোটে তাতে দুটো পেট বলা বাহুল্য ভরে না। তাকে তাই বাকি রসদের সন্ধানে অরণ্যে যেতেই হয়। শুরুতে ভয় ভয় লাগত। তারপর একসময় অভ্যাস হয়ে গেছে।  

এযাত্রা সৌগমের ফিরে যাবার আগে, তাঁকে বিনীতভাবে মাণ্ডুপের বিষয়ে প্রশ্ন করেছিল মুঢ়াল। মাণ্ডুপকে তিনি স্নেহ করেন। তার মাথায় হাত বুলিয়ে, তাকে বাণিজ্যে নিয়ে যাবার এই কথাগুলি সৌগমকে একাধিকবার বলতে শুনেছে মুঢ়াল। সেই কারণেই ছেলেকে এতদিন বসতির আর দশটা ছেলের মত সেপাইদের ডেরায় অস্ত্রশিক্ষায় পাঠায়নি সে।

কিন্তু এযাত্রা সে-আশায় শেষমেষ জল ঢেলে দিয়ে গিয়েছেন সৌগম। আশায় বুক বেঁধে সে তাঁকে জিজ্ঞাসা করেছিল, মাণ্ডুপ বড়ো হচ্ছে। এবারে যদি সৌগম নিজের ছেলেকে সঙ্গে করে নিয়ে যান। জবাবে দন্তহীন মুখে ব্যাঙ্গের হাসি ফুটেছিল সৌগমের। বলেছিলেন, “তোকে উন্মাদরোগ ধরেছে কি বানরী? মাণ্ডুপকে ছেলেভুলানো কথা কী বলেছি না বলেছি, তাকে তুই সত্যি বলে ভাবলি? এই অর্ধমনুষ্যকে সঙ্গে নিয়ে আমি লোকালয়ে যাব নিজের সন্তান পরিচয় দিয়ে? সে কি হয়?”

মুঢ়াল তবু ব্যর্থ চেষ্টা করেছিল একটা, “নাহয় তাকে ভৃত্য পরিচয় দিয়েই…”

জবাবে তার অবিন্যস্ত, রুক্ষ চুলে একটা কঠিন টান দিয়েছিলেন সৌগম। তারপর একটা ধাক্কা দিয়ে দূরে ছিটকে ফেলে বলেছিলেন, “দশ বছর বয়স হল তোর ছেলেরএখনও মায়ের কোল জুড়ে বসে অলীক স্বপ্ন দেখা ছাড়া আর কিছুই শিখল না। নিজের পরিবারের খাদ্য সংগ্রহের ক্ষমতাও হল না এখনও। কট্টাদিজির সেপাই হবার জন্য যার জন্ম তাকে সে কাজের জন্য তৈরি না করে তুই অন্যায় করেছিস বানরী…”

একটা লম্বা শ্বাস বের হয়ে এল মুঢ়ালের বুক চিরে। হ্যাঁ। বৃথা অলীক আশায় ভর করে সে সত্যিই অন্যায় করছে মাণ্ডুপের সঙ্গে। আর নয়। এবারে তাকে তৈরি করতে হবে সামনের কঠিন জীবনের জন্য।

ভাবতে ভাবতেই একটা অন্য কথাও তার মনে উঠে আসছিল। সত্যিই তো। এই অরণ্য, পাহাড়, পশ্চিমে বয়ে চলা ইন্দা নদীর ধারা, এই তো স্বর্গ তাদের। এখানে একজন সাধারণ সৈনিকের কঠোর জীবন তো দুঃখের নয়! যুগ যুগ ধরে প্রকৃতির বুক থেকে খাদ্য সংগ্রহ করে, তাদের বসতিকে রক্ষা করে ভালোই তো আছে কট্টাদিজির বাসিন্দারা। তবে কেন সে তার ছেলেটাকে তার থেকে এভাবে আলাদা করে রাখবে? তবে কেন…

“ও মা, বলো। নিয়ে যাবে তো!”

ছেলের মুখের দিকে হাসি হাসি মুখে ফিরে তাকাল মুঢ়াল। তারপর মাথা নেড়ে বলল, “হ্যাঁ বাবা। নিয়ে যাবআজ থেকে মায়ের কাছে তোর আসল শিক্ষার শুরু হবে। তারপর একদিন মস্তোবড়ো বীর হবে আমার মাণ্ডুপ। মস্ত শিকারী হবে। তার ভল্লের পাথরের ফলার সামনে পশু, মানুষ, রাক্ষস, ভূতপ্রেত কেউ দাঁড়াতে পারবে না…”

***

 “এই যে দ্যাখ। এইভাবে…” বলতে বলতে হাতে ধরা লম্বা দড়িটার একটা মাথা ঘুরিয়ে তাতে একটা ফাঁস দিল মুঢ়াল।

এখানে পাহাড়ের ঢালে অরণ্য গভীর। ডাইনে একটা পায়েচলা শূঁড়িপথ এগিয়ে গিয়েছে নীচের দিকে। মানুষ ও পশুদের পায়ে পায়ে গড়ে ওঠা বন্য পথ।

সন্ধ্যার মুখমুখ জায়গাটা নির্জন। মাণ্ডুপ ভয়ে ভয়ে চারদিকে দেখছিল। সেটা লক্ষ করে  হেসে মাথা নাড়ল মুঢ়াল, “ভয় লাগছে? ওপরদিকে দ্যাখ তাকিয়ে!”

তার দেখানো আঙুলের পথ বেয়ে ঢালের ওপরের দিকে তাকিয়ে দেখল মাণ্ডুপ।  সেখানে ঘন অরণ্যের আড়াল থেকে হালকা ধোঁয়া ও আগুনের আভাস চোখে পড়ে বহু উঁচুতে।

“ওইখানে প্রহরী শিবির আছে তো আমাদের। কোনো বিপদ হলে জোরে একটা হাঁকার দিলেই হল।”

“কিন্তু এইখানটা যে বড্ড নির্জন মা! তাছাড়া এতদূর থেকে ডাক দিলে ওরা কি আর…”

“উফ। কী ভিতুরে তুই!” মুঢ়াল হাসল, “কট্টাদিজির বীর সেপাই হবে যে তার কি এমন ভয় পাওয়া সাজে? নে। এখন এদিকে মন দে দেখি!” বলতে বলতেই কাঁচা ঘাস বুনে তৈরি দড়ি দিয়ে গড়া ফাঁসগুলো মাণ্ডুকের দিকে বাড়িয়ে ধরল মুঢ়াল, “শোন। জলের শব্দ পাচ্ছিস?”

মাণ্ডুপ কান খাড়া করল, “হুঁ।”

ডাইনের গলিটা বেয়ে সাবধানে নেমে যা। ওখান দিয়ে একটা ঝর্ণা নামছে দেখবি। মাঝখানে তার জল দাঁড়িয়ে একটা ছোটো কুণ্ডি হয়েছে। অন্ধকার নামলেই ওর পাশে অনেক জানোয়ার জল খেতে আসে। সেখানে সাবধানে এই ফাঁদগুলো বিছিয়ে দিতে হবে কেবল।”

ফাঁসটা হাতে নিয়ে দেখল একবার মাণ্ডুক। তারপর মাথা নেড়ে অবিশ্বাসের গলায় বলল, “এইটুকু ফাঁসে বরাহ বা হরিণ…”

মুঢ়াল হেসে ফেলল, “দূর। ছোট্ট কুণ্ডি। এইখানটায় বড়ো জন্তুরা জল খেতে আসে না। কুণ্ডি থেকে জল ফের উপচে যেখানটায় গিয়ে ইন্দায় মিশেছে তারা সেইখানে যায় সে আরো অনেকখানি নীচে। তাছাড়া বড়ো বড়ো প্রাণী শিকার করা আমাদের মা-ছেলের সাধ্যও নয়। এ-ফাঁদ শজারু বা খরগোশের জন্য।

“শোন। কুণ্ডির ধারে গিয়ে সাবধানে খেয়াল করে দেখবি। যেখানগুলোয় ওরা জলের ধারে আসে সেখানে পাথরের গায়ে ওদের কাদামাখা থাবার ছাপ দেখতে পাবি। যেখানে যেখানে ছাপ দেখবি, একটা করে ফাঁস সেখানে ফেলে অন্যপাশগুলো পাথর চাপা দিয়ে আটকে রাখতে হবে। তারপর চুপটি করে লুকিয়ে থেকে দেখবি মজা। গাসুই ঘাস দিয়ে ফাঁদের দড়ি বুনেছিখরগোশদের পছন্দের জিনিস। একটু বাদেই ওরা জল খেতে আসবে। ঘাসের গন্ধ পেলে ফাঁদের কাছে আসবেই। তারপর কোনোমতে একটা পা ওতে আটকে গেলে… ব্যস।”

ফাঁসগুলো হাতে নিয়ে নিজেকে বেশ বড়ো বড়ো বলে মনে হচ্ছিল মাণ্ডুপের। এরকম গুরুত্বপূর্ণ একটা দায়িত্ব মা তাকে এই প্রথম দিল। আহা, নিজের হাতে শিকার করা খরগোশের মাংস… সে আর মা… শূলে গেঁথে আগুনে সেঁকে…

“আর তুমি?”

মুঢ়াল হাসল, “আমি বুড়োমানুষ। তোর মত জোয়ানরা শিকার করতে যাবে যখন, আমি ততক্ষণে এই জঙ্গল থেকে খানিক ফল, মাংস সেঁকবার সুগন্ধ লতাপাতা, খানিক শেকড়বাকড় খুঁড়ে জড়ো করব।”

“তাহলে তুমি কিন্তু এইখানেই থেকো মা। আমি শিকার নিয়েই…”

ঢালের বাঁকের মুখে বাড়ন্ত শরীরটাকে মিলিয়ে যেতে দেখে মুখে একটুকরো তৃপ্তির হাসি ফুটছিল মুঢ়ালের। আসলে, মনের গভীরে কোথাও সে ঠিকই জানত, সৌগম তার ছেলেকে কখনই নিজের সঙ্গে নিয়ে যাবে না। কানাঘুষোয় সে শুনেছে, সৌগমের আমহিরি নগরী, দক্ষিণে ইন্দাপাড়ের এক ভয়াল জাদুর দেশতারা দুর্দম বীর। তারা বড়ো অহঙ্কারী। তাদের জাদুকর দেবতা দোরাদাবু বড়ো নিষ্ঠুর। তাদের ঝকমকে সুকঠিন অস্ত্রের ফলার সামনে কট্টাদিজির সেরা বীরের হাতের প্রস্তরশূলও তুচ্ছ হয়ে যায়। কট্টাদিজির মত জায়গা তাদের চোখে নিতান্তই বুনো। নিতান্তই অসভ্য। সেখানকার এক তুচ্ছ মেয়ের সন্তানকে দোরাদাবুর দেশের একজন অহঙ্কারী বেনে কখনই সঙ্গে করে নিয়ে যেতে পারে না।  

তবু, যদি তেমন অসম্ভবও কোনো জাদুতে সম্ভব হয়ে ওঠে, এই আশাটা তার বুকে জেগে থাকত এতদিন। গতকাল সৌগমের হাতের মার আর মুখের টিটকিরিতে সে আশা এইবার একেবারে নিভে গেছে। এইবার… নিশ্চিন্তে তার ছেলেটাকে সে বড়ো করে তুলতে পারবে। আর কোনো দোটানায় ভুগতে হবে না তাকে।

পাহাড়ের ওপরের এই জঙ্গলে কোনো হিংস্র পশু নেই। কুণ্ডির ধারে ও নিরাপদেই থাকবে। অতএব এইবার সে নিশ্চিন্তে একটা ধারালো পাথরের টুকরো নিয়ে বুনো আলুর একটা শুকনো লতার গোড়ায় মাটি খুঁড়তে শুরু করল। তাকে ঘিরে আস্তে আস্তে অন্ধকার নেমে আসছিল। বহু উঁচুতে পাহাড়ের মাথায় কট্টাদিজির প্রহরী শিবির থেকে পাহারাদারদের কথাবার্তা, হাসিঠাট্টার হালকা শব্দ তাকে সাহস দিচ্ছিল। কোনো ভয় নেই…

 ***

 মূঢ়ালের থেকে খানিক নীচে ছোট্ট কুণ্ডিটার ধারে একটা পাথরের আড়ালে অপেক্ষায় থাকা মাণ্ডুপও একইরকম নিশ্চিন্তে ছিল। জায়গাটা শান্ত। তাছাড়া কাছেই তার মা আছে।  কোনো দরকার হলে একটা ডাক দেবার অপেক্ষা কেবল। ভয় কী?

আস্তে আস্তে ঘন অন্ধকারে ঢেকে যাচ্ছিল চারদিক। তবে মাণ্ডুপের তাতে কোনো সমস্যা হচ্ছিল না। প্রকৃতির সন্তান সে। অন্ধকারেও তার তীক্ষ্ণ দৃষ্টি সম্পূর্ণ অকেজো থাকে না। পাশাপাশি শব্দ স্পর্শ ও ঘ্রাণও তাকে চারপাশের পরিবেশ নিয়ে অনেক খবর দেয়। কাজেই সেই অন্ধকারের মধ্যেও ঝোপঝাড়ের হালকা নড়াচড়া, বিভিন্ন মৃদু শব্দ ও গন্ধ তাকে বলে দিচ্ছিল, জায়গাটায় সে একা নয়। আর অবশেষে, হঠাৎ করেই সামনে খানিক দূরে ঢালু জমিটার নীচে শুকনো লতাপাতার ওপর জেগে ওঠা পায়ের হালকা মচমচ শব্দ ও অন্ধকারের মধ্যে ঝটাপটির আবছায়া আভাস তাকে বলে দিল, আশা পূর্ণ হয়েছে। জল খেতে এসে তার পাতা ফাঁদে ধরা দিয়েছে জীবন্ত খাদ্য। একটা বিরাট উল্লাস হঠাৎ তার গায়ে শিহরণ জাগিয়ে তুলল। শিকার ধরেছে মাণ্ডুপ। জীবনে প্রথম, তার হাতে পাতা ফাঁদে ধরা পড়েছে সত্যকার খাদ্য। মায়ের মুখটা চোখের সামনে ভেসে উঠল মাণ্ডুপের। মা কত খুশি হবে আজ!

আস্তে আস্তে নিজের লুকোবার জায়গা ছেড়ে উঠে দাঁড়িয়ে নীচের দিকে পা বাড়িয়েছিল সে। কিন্তু দু-তিনটে পদক্ষেপ নেবার পরেই হঠাৎ ফাঁদে আটকা জীবটার গলা থেকে তীক্ষ্ণ, কর্কশ একটা আহত শব্দ উঠে তাকে চমকে দিয়ে গেল। অসতর্ক অবস্থায় সামনের দিকে একটা লাফ দিতে পায়ের নীচের অবলম্বন হারিয়ে মাণ্ডুপ গড়িয়ে পড়ল নীচের দিকে।

ছটফট করছিল ফাঁদে পড়া ছোট্ট প্রাণীটা। তার পিঠে বিঁধে থাকা তিরটার ক্ষতস্থান থেকে উষ্ণ চটচটে রক্ত এসে মাখামাখি হয়ে যাচ্ছিল মাণ্ডুপের হাত।

পরক্ষণেই পেছন থেকে একটা মশালের দপদপে আগুন জ্বলে উঠে জায়গাটাকে হালকা আলোকিত করে তুলল। ত্রস্ত মাণ্ডুপ মুখ তুলে তার পেছনে দ্রুত নেমে আসতে থাকা সৈনিকের পোশাক পরা মানুষদুজনকে দেখেই চিৎকার করে উঠেছিল, “মা-আ-আ…”

কিন্তু তার হাঁকটা সম্পূর্ণ হতে পারল না। তার আগেই একটা কঠোর হাত এসে মুখটা চেপে ধরে তাকে শূন্যে তুলে নিয়েছে। অন্য হাতে ধরা একটা ছুরির ধারালো ফলা চেপে বসছিল তার গলায়।

কিন্তু একেবারে শেষমুহূর্তে ফলাটা থেমে গেল। পেছন থেকে মশালের একঝলক আলো এসে পড়েছে তার মুখে। তারপর একটা গম্ভীর গলা নীচুস্বরে বলে উঠল, “মেরো  না। এর গায়ের রঙ আমাদের মত। এই বুনোদের মত নয়।”

ভাষাটা মাণ্ডুপের পরিচিত। তাদের গ্রামে মাঝে মাঝে যে বেণেরা যাতায়াতের পথে এসে ঠাঁই নেয় তারা এই ভাষাতেই কথা বলে। সে মুখ তুলে গম্ভীর গলার মানুষটার দিকে চেয়ে দেখল একঝলক। মানুষটা সপ্রশংস দৃষ্টিতে তার পুষ্ট, স্বাস্থ্যবান শরীরের দিকে দেখতে দেখতেই এগিয়ে এসে অন্য সৈনিকটির হাত থেকে তাকে সরিয়ে নিল। তারপর নিজের সামনে তাকে দাঁড় করিয়ে দিয়ে কিছু একটা বলতে গিয়েছিল সেকিন্তু কথাটি বলবার আগেই হঠাৎ পেছন থেকে মাণ্ডুপের নাম ধরে তীক্ষ্ণ গলায় ডাক উঠল একটা।

চমকে উঠে সেদিকে ঘুরে দেখল মাণ্ডুপ। ওপর থেকে নেমে আসা গলিটার অন্ধকারের ভেতর থেকে ডাকটা দ্রুত নেমে আসছিল তাদের দিকে।  মায়ের গলা! মা…

চেঁচিয়ে উঠে তাকে সাবধান করতে গিয়েছিল সে। কিন্তু তার আগেই ফের তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে তার মুখটা চেপে ধরেছে প্রথম সৈনিক। তারপর ক্ষিপ্র শ্বাপদের মতই তাকে তুলে নিয়ে গিয়ে আশ্রয় নিয়েছে একটা বড়ো পাথরের টুকরোর আড়ালে। সেখান থেকে অসহায় চোখে মাণ্ডুপ দেখছিল, নেমে আসা পথটার পাশে আরেকটা বড়ো পাথরের পেছনে খোলা অস্ত্র হাতে ওঁত পেতে দাঁড়িয়েছে গম্ভীর গলার মালিক দ্বিতীয় সৈনিক। তার সতর্ক কান টের পাচ্ছিল অন্ধকার শূঁড়িপথ বেয়ে তার মায়ের পায়ের শব্দ, টের পাচ্ছিল তাদের ঘিরে চারপাশ থেকে গাছ ও পাথরের আড়ালে এগিয়ে আসা বহু ভারী পায়ের আওয়াজ।

এর পরের ঘটনাটা চোখের পলকে ঘটে গেল। শূঁড়িপথ বেয়ে মশালের আলোর বৃত্তে ছিটকে আসা মুঢ়ালকে লক্ষ করে লাফিয়ে ওঠা সৈনিক নিজের শরীরের ধাক্কায় তাকে ছিটকে ফেলে দিল মাণ্ডুপের একেবারে সামনে। পরক্ষণেই চারপাশের অন্ধকার থেকে বের হয়ে আসা একাধিক সৈনিকের একজন তার মুখটা চেপে ধরল এসে।

বাঘিনীর মতই লড়ছিল মুঢ়াল তার সঙ্গে। কিন্তু সে লড়াই কয়েকটি মুহূর্তের বেশি স্থায়ী হল না। আরো চারজন সৈনিক এসে তার ছটফট করতে থাকা হাত পাগুলোকে মাটির সঙ্গে চেপে ধরে স্থির করে দিল তাকে। আরেকজন  সৈনিক ততক্ষণে একটুকরো কাপড় গুঁজে দিয়ে তার মুখটা বেঁধে ফেলেছে

এইবার একজন  সৈন্য এসে তার তলোয়ারের তীক্ষ্ণ নখ মুঢ়ালের গলায় ঠেকিয়ে গম্ভীর গলার মালিকের দিকে ঘুরে বলল, “আদেশ দিন সেনানায়ক বৈক্লন্য।”

বৈক্লন্য কিছু একটা ভাবছিলেন। মাটিতে শুয়ে থাকা মুঢ়ালের গভীর কালো শরীর ও কোঁচকানো চুলের দিকে একনজর দেখে তিনি বললেন, “ওই গোধুমবর্ণ বালক এই কৃষ্ণকায় অর্ধমনুষ্যকে মা বলে ডেকেছিল। কী করে তা সম্ভব? একে মারবার আগে সেটা আমার জানা প্রয়োজন।”

“কিন্তু মহামান্য,” তরবারিধারী সৈনিকটি সামান্য প্রতিবাদ করে উঠল, “বুনোদের প্রহরাশিবির বেশি দূরে নয়। এরা তাদের চর হওয়াটা অস্বাভাবিক নয়। এদের বাঁচিয়ে রাখলে…”

“মস্তিষ্ককে ব্যবহার করতে শেখ সৈনিক,” বৈক্লন্য বিরক্ত গলায় বললেন, “নারী বা শিশুকে চরবৃত্তির কাজে ব্যবহার এই অসভ্য অর্ধপশুরাও কখনো করেছে বলে শোনা যায়নি। এছাড়া, এ-ও সত্য যে বনের পশুর মতই এদের জীবনধারা। বনই এদের খাদ্যের জোগান দেয়। এরা দুজনেও সম্ভবত সেই উদ্দেশ্যেই অরণ্যে এসে ফাঁদ পেতেছিল বলে আমার বিশ্বাস। সেই ফাঁদে আটক প্রাণীটিকে তুমিই তো তিরবিদ্ধ করেছ খানিক আগে। তার পায়ে আটকানো ফাঁসটা তোমার নজরে পড়েনি?

“তবে নির্দিষ্ট সময়ের আগে আমাদের উপস্থিতি জেনে ফেলেছে এ। অতএব মৃত্যুদণ্ড এ পাবে। কেবল তার আগে আমার কৌতূহলটুকু মিটিয়ে নিতে চাই। ছেলেটাকে এর সামনে আনো।”

নীরবে বৈক্লন্যের আদেশ পালিত হল। মাটিতে শুয়ে থাকা অবস্থায় বিস্ফারিত দুটো চোখ মেলে ছেলের দিকে দেখছিল মুঢ়াল। মাণ্ডুপকে একহাতে জড়িয়ে রেখে, অন্যহাতে তার মুখ ও গলাটাকে জড়িয়ে রয়েছে একজন বিশালদেহী সৈনিক। সেদিকে ইশারা করে বৈক্লন্য মুঢ়ালকে বললেন, “তোমার মুখের বাঁধন খুলে দেয়া হবে। আমার প্রশ্নের যথাযথ উত্তর দেবে তুমি। যদি চিৎকার করে কাউকে সঙ্কেত দেবার চেষ্টা করো তাহলে তোমার চোখের সামনে এর গলাটা মুচড়ে দেয়া হবে।”

কথাগুলো বলতে বলতেই তাঁর ইশারায় মুঢ়ালের মুখের বাঁধন খুলে দেয়া হয়েছিল। মাণ্ডুপের দিকে ইশারা করে বৈক্লন্য এবার প্রশ্ন করলেন, “এ তোমার কে হয়?”

“আমার ছেলে।”

তোমার গর্ভজাত?”

“হ্যাঁ।”

“এর পিতা, তোমার স্বামীর পরিচয় তুমি জান?”

“জানি। তাঁর নাম সৌগম। তিনি একজন ভ্রাম্যমাণ শ্রেষ্ঠী।”

হঠাৎ চমকে উঠলেন বৈক্লন্য। সৈনিকের হাতে আটক শিশুটির কাছে এগিয়ে গিয়ে মশালের আলো তুলে ধরলেন তার মুখের সামনে। কয়েক মুহূর্ত মুখটির দিকে তাকিয়ে থাকবার পর আর কোনো সন্দেহ  রইল না তাঁর মনে। আগে খেয়াল হয়নি, কিন্তু এইবার এর মুখে, এর চোখের দৃষ্টিতে সৌগমের আদলটি একেবারে সুস্পষ্টভাবে ধরা পড়ছিল তাঁর চোখে।

মনের গভীরে একটা অদ্ভুত আনন্দ খেলা করে যাচ্ছিল তাঁর। ঈশ্বর দোরাদাবু! অন্তর্যামী দোরাদাবু তাঁর মনের একান্ত ইচ্ছাটি জানতে পেরেছেন। তাঁর সেবায় তৃপ্ত হয়েছেন তিনি। তা না হলে এই বিজন অরণ্যে এমন অলৌকিকভাবে তার কাম্য বস্তুটির এভাবে তাঁর হাতে আসা সম্ভব হত না।

কয়েক মুহূর্ত বাদে ছেলেটির দিক থেকে চোখ ফিরিয়ে হাতে তলোয়ার তুলে নিলেন তিনি। এই বন্য অর্ধমানবী তার কাজ সমাপ্ত করেছে। নির্দিষ্ট সময়ে সে এই অরণ্যে এসে হাজির হয়ে বৈক্লন্যর হাতে তার কাম্য বস্তুটি তুলে দিয়েছে। একে বাঁচিয়ে রাখবার কোনো প্রয়োজন নেই আর।

পরমুহূর্তে তলোয়ারের একটা নিখুঁত আঘাতে মুঢ়ালের মাথাটা ছিটকে পড়ল মাণ্ডুপের পায়ের কাছে। মাথাহীন ধড় থেকে ফিনকি দিয়ে উঠে আসা রক্ত ছড়িয়ে পড়ছিল থরথর করে কাঁপতে কাঁপতে জ্ঞান হারিয়ে ফেলতে থাকা শিশুটির গায়ে মুখে।

সেদিকে একনজর দেখে নিয়ে নীচুগলায় একটা আদেশ দিলেন বৈক্লন্য। সঙ্গে সঙ্গেই সৈনিকদের একজন জ্ঞানহীন শিশুটিকে কাঁধে ফেলে অন্ধকার পাহাড়ি পথ বেয়ে ফিরে গেল মূল শিবিরের উদ্দেশে। সেখানে তার শুশ্রূষা করে সারিয়ে তোলা হবে এবারে। তারপর, যুদ্ধশেষে স্বয়ং বৈক্লন্য তাকে পালিত পুত্র হিসেবে সঙ্গে নিয়ে ফিরে যাবেন আমহিরি নগরীতে।

বন্যপশুর মতই জীবন এদের। তাছাড়া এখনও এ সামান্য শিশু। কাজেই উপযুক্ত আদরযত্ন পেলে, উন্নততর জীবনে এই শোক ভুলতে এ সময় নেবে না বেশি। আর, ভুলে না-ও যায় যদি, সেক্ষেত্রেও এর ধমনীতে তো সৌগমেরই রক্ত বইছে। বড়ো হয়ে নিজের জাতির সঠিক পরিচয় পাবার পর এই বন্যজাতির একটু তুচ্ছ মেয়ের মৃত্যু নিয়ে একজন গর্বিত আমহিরিবাসী হিসেবে  এর কোনো আক্ষেপ যে থাকবে না সে-বিষয়ে বৈক্লন্য নিশ্চিত ছিলেন।

মৃতদেহটা একটা গর্ত খুঁড়ে তাতে মাটিচাপা দিতে সামান্যই সময় লেগেছিল এরপর। সেকাজ নিখুঁতভাবে সমাধা করে একদল শ্বাপদের মত নিঃশব্দ পায়ে বৈক্লন্যের বাহিনী উঠে গিয়েছিল পাহাড়চূড়ায় কট্টাদিজির প্রহরী চৌকিকে লক্ষ করে। আকস্মিক সেই আক্রমণের মুখে বিশেষ কোনো প্রতিরোধ গড়তে পারেনি প্রহরীরা। সামান্য একটু লড়াইয়ের পর একে একে ভূমিশয্যা নিয়েছিল তারা। তারপর, অগ্নিকর্দম মাখানো একরাশ তিরে তুনির পূর্ণ করে তাদের প্রতীক্ষা শুরু হয়েছিল সেই পাহাড়চূড়ায়। তাদের পায়ের নীচে নিশ্চিন্তে ঘুমিয়ে থাকা বসতিটি এর সামান্য আভাসও পায়নি। দেখতে পায়নি তাদের বসতিকে ঘিরে থাকা চারটি পাহাড়চূড়ায় আপাত বিচ্ছিন্নভাবে জ্বলে ওঠা এক একটি মশালের আলো একে অন্যকে নিজেদের প্রস্তুতি সম্পূর্ণ হবার খবর জানিয়েছিল কখন।

তারপর, রাত্রি তৃতীয় প্রহরের শেষে ইন্দা নদীর দিকের পাহাড়ের ঢালে হঠাৎ একটি অগ্নিকুণ্ড জ্বলে উঠেছিল ধূ ধূ করে। সতর্ক হয়ে উঠেছিল, বসতিকে ঘিরে কাছেদূরে ছড়িয়ে থাকা প্রহরী চৌকিগুলো। তাদের সাবধানবাণী দেয়া দামামার সঙ্কেতে কট্টাদিজির মানুষজন জেগে উঠে প্রস্তুতিও নিয়েছিল, কিন্তু তাতে লাভ হয়নি কোনো। কারণ শেষরাত্রে ইন্দা নদী থেকে বসতির দিকে যখন ঠাণ্ডা হাওয়ার স্রোত ছড়িয়ে পড়তে শুরু করেছিল, তখন হঠাৎ করেই তাকে ঘিরে থাকা প্রহরী চৌকিদের মধ্যে চারটে চৌকি থেকে বাতাসে ভেসে উঠেছিল অজস্র আগুনের বিন্দু। মাধ্যাকর্ষণের টানে বাতাসে ভর করে নিখুঁত লক্ষ্যে তারা ধেয়ে এসেছিল কট্টাদিজির লতাপাতায় গড়া বাসস্থানগুলোর দিকে। ধূ ধূ আগুনে জ্বলে ওঠা শুকনো লতাপাতার আচ্ছাদন থেকে প্রতিটি বাড়িতে জমিয়ে রাখা অগ্নিকর্দম জ্বালানিকুণ্ডগুলোয় আগুন সঞ্চারিত হতে বিশেষ সময় নেয়নি।

খুব কম মানুষই ঘুম থেকে জেগে উঠে সেই আগুনের বেড়াজাল পেরিয়ে তার বাইরে আসতে পেরেছিল। সেখানে তাদের জন্য অপেক্ষায় ছিল আমহিরির অজস্র তীক্ষ্ণধার তলোয়ার

dharabahiksindhuepisode03

***

এর পরদিন সকালে সূর্য তার স্নিগ্ধ আলো ছড়িয়ে দিয়েছিল পুড়ে ছাই হওয়া কট্টাদিজি আর তার দগ্ধ কিংবা অস্ত্রের ঘায়ে মৃত বাসিন্দাদের শরীরে।

সেই মৃত শহরের বুকে আমহিরির সৈনিকদের এগিয়ে চলা সুশৃঙ্খল সারির উলটোমুখে, দক্ষিণগামী পথ ধরে একটা গরুর গাড়ি এগিয়ে চলেছিল তার ভেতরে, দুজন সৈনিকের কোমল কিন্তু দৃঢ় হাতের বাঁধনে আটক থাকা একটি শিশু তার জানালা দিয়ে পাথরের মত মুখচোখ নিয়ে মৃত সেই বসতির দৃশ্য দেখেছিল। গত একটা রাত তার সামান্য সময়ের মধ্যেই আমূল বদলে দিয়েছে তাকে। সে এখন জানে, অবোধ শিশুর মত বৃথা কান্না, আছাড়িপিছাড়ি কিংবা অভিসম্পাতে তার প্রিয়জনরা আর ফিরে আসবে না। সে জানে, যেকোনো মূল্যে বেঁচে থাকা সেই মুহূর্তে তার একমাত্র কাজ। বেঁচে থাকা। শত্রুকে জানা। তার দুর্বলতার সন্ধান করা। আর  তারপর… উপযুক্ত সময়ে…

তার অনভিজ্ঞ মন সে মুহূর্তে এর চেয়ে বেশি দূরের কথা ভাবতে পারে না। ঘুম… বড়ো ঘুম পায় তার। আর সেই ঘুমের মধ্যেই তার অগোচরে তাকে নিয়ে গরুর গাড়িটি কয়েকজন সেনার সতর্ক প্রহরায় এগিয়ে চলে আমহিরি নগরীর দিকে। তাদের সঙ্গে সেনাপতি বৈক্লন্যের শিলমোহর দেয়া একটি চিঠি রয়েছে তাঁর স্ত্রীকে উদ্দেশ্য করে। তাতে লেখা আছে, সৈনিকদের সঙ্গে পাঠানো শিশুটি বৈক্লন্যের যুদ্ধক্ষেত্রে অর্জিত সম্পত্তি। তাকে তিনি নিজের সন্তান হিসেবে গ্রহণ করেছেন। বৈক্লন্যের স্ত্রী যেন তাকে নিজের সন্তান হিসেবে দেখেন ও পালন করেন

কট্টাদিজির বিপরীতে ইন্দার অপর পাড়ে ছড়িয়ে থাকা বিস্তীর্ণ উর্বর সমতলভূমির কোনো একটি জায়গায় নিজেকে গোপন রেখে ঘটনাক্রমের ওপর নিঃশব্দে নজর রেখেছিলেন দোরাদাবু স্বয়ংতিনি  জানতেন, কট্টাদিজি বসতিকে আগুনে পুড়িয়ে ছাই করে দিয়ে ইন্দা নদীর তীরে এক সুমহান সভ্যতা গড়ে ওঠবার প্রথম বীজটি রোপিত হল সেইদিন। এবার শুরু হবে সেই বীজটিকে সুচারুভাবে একটি মহীরূহে বদলে দেবার পালা। কিন্তু গ্রহজীব দোরাদাবু কিংবা  মাণ্ডুপ বা বৈক্লন্য এদের কারো কাছেই ভবিষ্যতকে জানবার কোনো পথ ছিল না সেদিনথাকলে হয়তো তাঁরা দেখতে পেতেন,  সেই একই দিনে, তখনও  অজাত এই নগরসভ্যতার ধ্বংসের বীজটিও জন্ম নিল সেই কট্টাদিজির কাছেই। এইবার, সবার অলক্ষে সে তার ডালপালা ছড়াবে এই সভ্যতার রন্ধ্রে রন্ধ্রে। তারপর একদিন… তবে সে অনেক দূর ভবিষ্যতের কথা। সে কথা বলবার সময় এখনো আসেনি। এখন কেবল এই নবীন ও নিষ্ঠুর সভ্যতার উত্থানের পালা।

ক্রমশ

শীর্ষচিত্র- অতনু দেব।  গ্রাফিক্‌স্‌- ইন্দ্রশেখর

 জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিক

Leave a Reply

Fill in your details below or click an icon to log in:

WordPress.com Logo

You are commenting using your WordPress.com account. Log Out /  Change )

Facebook photo

You are commenting using your Facebook account. Log Out /  Change )

Connecting to %s