সিন্ধুনদীর তীরে –প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব , সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব
৬
“এবং তুমি সেই সম্মুখযুদ্ধে জয়লাভ করেছ!”
সামনে স্তূপ করে রাখা সোনা রূপা ও তামার মুদ্রাগুলোর দিকে চোখ রেখে বৈক্লন্য খুশিভরা গলায় বলে উঠলেন। ইন্দার দিক থেকে বয়ে আসা হালকা ঠান্ডা হাওয়ায় তাঁর চাঁদের আলোমাখা সাদা চুলদাড়ি উড়ছিল। কেমন যেন দূরচারী কোনো পরিব্রাজকের মত দেখাচ্ছে তাঁকে এই মুহূর্তে।
আমহিরির বাণিজ্যের সময় এখন। দেশ-দেশান্তর থেকে পণ্য কেনাবেচার জন্য বহু ব্যাপারীরই আসে এখানে এই সময়। দ্বন্দ্বযুদ্ধের বাজি ধরবার সময় তারা যার যার দেশের মুদ্রাদের জমা করে মন্দিরসেনার অধিনায়কের কাছে। যুদ্ধশেষে সে অর্থের অর্ধেক যায়, বাজি ধরে যারা জিতেছে তাদের হাতে। বাকি অর্ধেকের দুই তৃতীয়াংশ বিজয়ীর প্রাপ্য হয়। অবশিষ্ট মুদ্রার যথাক্রমে এক ও দুই তৃতীয়াংশ যায় বিজিত যোদ্ধার হাতে ও শহরের অধিষ্ঠাতা দোরাদাবুর ঈশ্বরকোষে।
মাণ্ডুপের অংশের অর্থ দেখে বোঝা যাচ্ছিল, আজ বাজির পরিমাণ নিতান্ত কম হয়নি।
মাণ্ডুপ বৈক্লন্যের দিকে তাকিয়ে দেখল একবার। যতটা অর্থ সে আজ জিতেছে তার পুরোটা দেখলে বোধ হয় স্তম্ভিত হয়ে যেতেন বাবা। যা সে বাড়িতে এনেছে তা তার পাওয়া অর্থের অর্ধাংশই কেবল। বাকি অর্ধেক সে আজ ইস্কার হাতে তুলে দিয়ে এসেছে। তবে অর্ধেক অংশ বাড়িতে নিয়ে এলেও তাতেও যা পরিমাণ হয়েছে তাতেই পিতা সন্তুষ্ট বোঝা যাচ্ছে।
অবশ্য ইস্কাকে ভাগ দিয়ে আসবার বিষয়ে মাণ্ডুপের খেদ নেই কোনো। সে চাইলে এর পুরোটাও তার হাতে দিয়ে আসতেও কোনো আপত্তি হত না তার। সত্যি বলতে কি যুদ্ধটা আজ সামনা সামনি সে করলেও আসলে তো ইস্কাই করেছে। মুখোমুখি সেটা স্বীকার না করলেও মনের ভেতর সে নিয়ে একটা গভীর কৃতজ্ঞতা কাজ করছিল তার। আজ ইস্কার বুদ্ধি নইলে ওই শ্বেতদানব দৈমিত্রের কুঠারের ভক্ষ্য হয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে পড়ে থাকতে হত তাকে।
এই দ্বন্দ্বযুদ্ধগুলোয় কারো মৃত্যু হয় না বটে, মন্দিরসেনার অধিনায়ক সেদিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখেন। কিন্তু গুরুতর আহত অনেকেই হয়। আর গুরুতর না হোক, সামান্যতম আঘাত নিয়েও সে ফিরলে আজ মায়ের হাতে তার অশেষ লাঞ্ছনা ছিল।
মাকে জানিয়ে যুদ্ধে যায়নি মাণ্ডুপ আজ। কারণটা সরল। জানালে আর এ যুদ্ধে যাওয়া হত না তার। পিত্তা শান্তিপ্রিয় মানুষ। যোদ্ধার ঘরনী হয়ে সারাটা জীবনই তাঁকে ভয়ে ভয়ে, স্বামীর জন্য দুশ্চিন্তা করেই কাটাতে হয়েছে। কিছুকাল আগে কর্মজীবন শেষ করে বৈক্লন্য মঞ্জাদাহির ছেড়ে পাকাপাকি ফিরে আসছেন এই খবরটা আমহিরিতে এসে পৌঁছোবার পর সে দুশ্চিন্তা শেষ হয়েছিল তাঁর। এইবার তিনি স্বামীপুত্র নিয়ে নিরুদ্বেগ জীবন কাটাতে চান। জীবনের বাকি দিনগুলো ফের ছেলেটাকে নিয়ে একই দুশ্চিন্তায় কাটাবার ইচ্ছা তাঁর নেই।
তবে সৌগমপুত্র বিসারার দেহরক্ষীর কাজটা যখন মাণ্ডুপ নিল, তখন তিনি আগ্রহভরেই তাতে সম্মতি দিয়ে বলেছিলেন, “সেই ভালো। বিসারা বেণের ছেলে। যুদ্ধবিগ্রহে তো আর যাবে না! ওর কাছে তুই থাকলে আমি নিশ্চিন্ত। পারলে ওকে সন্তুষ্ট করে বাণিজ্যের কাজ শিখে নেবার চেষ্টা কর। ওতে প্রচুর রোজগার। নিশ্চিন্ত জীবন!”
তবে খবর না দিয়ে যুদ্ধে গেলেও, এতবড়ো একটা ঘটনার খবর, শহরের পথে পথে মুন্দিগ্রজয়ী মাণ্ডুপের নামে জয়ধ্বনি, এসব পিত্তাদেবীর অজানা থাকবার কথা নয়। প্রতিবেশী গৃহিনীরাই উদ্যোগী হয়ে সবিস্তারে সে খবর তাঁকে দিয়ে যাবেন। অতএব ইস্কাকে বিদায় দিয়ে বাড়ি ফেরবার পথে মাণ্ডুপ মনেমনে তৈরিই ছিল, আজ সন্ধ্যায় তার ভাগ্যে খানিক দুর্গতি আছে। রুষ্ট পিত্তাদেবীর সামনে বৈক্লন্য তো কোন ছাড়, স্বয়ং ওই শ্বেতদানব দৈমিত্রও নখদন্তহীন হয়ে পড়বে, এ বিশ্বাস মাণ্ডুপের মনে অত্যন্ত দৃঢ়। ছোটোবেলা থেকেই আদর ভালোবাসার পাশাপাশি তাঁর কঠোর শাসনের স্মৃতিও কম নেই মাণ্ডুপের।
বাড়িতে ঢুকে তাড়াতাড়ি কুয়ো থেকে একপাত্র জল তুলে নিয়ে মাথায় ঢেলে নিয়েছিল মাণ্ডুপ প্রথমে। তারপর কুয়োতলার পাশেই তার নিজস্ব ছোটো ঘরটায় ঢুকে, সঙ্গের জিনিসপত্র সেখানে রেখে, নীল রঙ করা একটা পরিষ্কার ধুতি কোমরে জড়িয়ে নিয়ে বের হয়ে এসেছিল। হাতে নিয়েছিল কেবল হরিণের চামড়ার তৈরি ছোটো একটা থলে।
বুদ্ধিটা অবশ্য ইস্কার। চলে আসবার আগে মুচকি হেসে বলে, “আজ পিত্তাদেবীর হাতে তোর কপালে দুঃখ আছে। না বলে লড়াইতে নেমেছিস, এবার সাজা পাবি তার। ওসব পুরস্কার-টুরস্কার দেখিয়ে কাজ হবে না। ঠিক হবে। যেমন কাউকে না বলে লড়তে যাস…”
তারপর তার ঘাবড়ে যাওয়া মুখটা দেখে নিজেই বুদ্ধিটা দিয়েছিল, “পিত্তাদেবী গয়না পছন্দ করেন। সাজতে ভালোবাসেন। কিছু একটা নিয়ে যা হাতে করে। যদি তাতে রাগ খানিক কমে।”
কশেরুকার হাড় দিয়ে তৈরি এই কানফুলদুটো সে নিজেই বেছে নিয়ে থলেটায় ভরে তার হাতে দিয়ে দিয়েছে। তারপর ফের মুচকি হেসে বলে, “বলিস না আবার আমি দিয়েছি। বেণের মেয়ের উপহার…”
কুয়োতলার পাশেই রান্নাঘর। সেখানে দেম্ভা আর নাশাইলি দেখা গেল ভারী ব্যস্ত। দেম্ভা বসে বসে স্তূপাকার মাংস টুকরো টুকরো করে তাতে মশলা মাখিয়ে তিসির তেল দিয়ে জারাচ্ছে। আর নাশাইলি পড়েছে বড়ো বড়ো তরমুজ নিয়ে। খোসা ছাড়িয়ে বিরাট কাঠের পাত্রে ফেলে মোটকা ডাণ্ডা দিয়ে পিষে পিষে রস বের করে কানাতোলা পাত্রে জমা করছে। রান্নাঘর সুগন্ধে ম ম।
দেখে মাণ্ডুপ একটু থমকে গেল। অন্তত জনাদশেক মানুষের মত মাংস! বাড়িতে আজ ভোজ আছে এ কথা তো সকালেও মা কিছু বলেনি!
“কী ব্যাপার গো! এতো খাবার?” মাণ্ডুপ জিজ্ঞাসা করল।
জবাবে দেম্ভা মুচকি হেসে বলে, “সে ভালো ভালো খাবার তো পরে খাবে। আগে মায়ের কাছে চড়চাপড়টা খেয়ে নাও!”
“শুনে নাশাইলি কাজ করতে করতেই মুখ মটকে দু-হাতের কনুই অবধি চুড়ি ঝাঁকিয়ে বলে, “ঠিক হয়েছে। যেমন অকাজ করেছ…”
এ-বাড়ির বহু পুরোনো লোক ওরা। দেম্ভাকে বৈক্লন্য মঞ্জাদাহির থেকে খানিক উত্তরে জুদির্জাদাহির নামে একটা জায়গা দখল করবার সময় সেখান থেকে এনেছিলেন। আর নাশাইলি এসেছে দূর দক্ষিণের অজানা কলহারু এলাকা থেকে। সেখানে সোনার খোঁজে যাওয়া এক অভিযান থেকে বৈক্লন্যের প্রিয় বন্ধু বিদারা তাকে এনে উপহার দিয়েছিলেন বৈক্লন্যকে। একজনের চামড়া দিনের আলোর মত সাদা আর অন্যজন রাত্রির মত কালো। তাই তাদের অমন নাম রেখেছেন পিত্তা। মাণ্ডুপকে তারা সেই ছোটোবেলা থেকেই দেখেছে। মনিব টনিব বলে কোনো খাতির করে না তাই। মাণ্ডুপও তাদের কখনো কাজের লোক বলে মনে করে না। যেন তার দুটি বড়ো দাদা-দিদি।
দেম্ভার দিকে মুখ ফিরিয়ে মাণ্ডুপ নীচুগলায় বলে, “কোথায়?”
দেম্ভা মাথার ওপরদিকে ইশারা করে দেখিয়ে দিল। সেখান থেকে জাঁতার ঘরঘর শব্দ আসছিল।
“ওপরে। ভাঁড়ার ঘরে। যব গুঁড়ো করছে বসে বসে। যাও। গিয়ে বকুনি খেয়ে রাগ ভাঙাও দেখি! বাড়িতে আজ এমন আনন্দের দিন! লোকজন খাবে…”
কীসের আনন্দের দিন সে নিয়ে তখন আর কোনো প্রশ্ন করেনি মাণ্ডুপ। মা জাঁতায় বসেছে এটা ভালো খবর নয়। খুব বেশি রেগে গেলে মা ওই করে। জাঁতাটার ওপর রাগটা বের করে বসে বসে।
রান্নাঘরের ভেতর দিয়ে কাঠের একটা সিঁড়ি ওপরের ভাঁড়ার ঘরে উঠে গেছে। সিঁড়িতে সাবধানে পা দিয়ে ওপরে উঠে গেল মাণ্ডুপ।
মেঝেতে বসানো জাঁতাটায় যব পিষে ছাতু তৈরি করছিলেন পিত্তাদেবী। আস্তে আস্তে তাঁর কাছে গিয়ে হঠাৎ পেছন থেকে দুহাতে তাকে জড়িয়ে ধরেছিল সে। পিত্তা কোনো সাড়া দেননি। কেবল জাঁতার দণ্ডটা আরো জোরে জোরে ঘোরাতে আরম্ভ করেছিলেন। এবারে মাণ্ডুপ কিছু না বলে তাঁর পাশে কানফুলের ছোট্ট থলেটা রেখে দিল। তারপর সামনে ঘুরে এসে দন্ডটা তাঁর হাত থেকে টেনে নিয়ে সেটকে বনবন করে ঘোরাতে শুরু করে দিল।
ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন পিত্তা। শরীর ঘেমে উঠেছে। মাণ্ডুপ এসে দণ্ডটা কেড়ে নিতে একটুক্ষণ বসে হাঁফ ছেড়ে নিয়েছিলেন প্রথমে। চোখদুটো অবশ্য একইরকম শক্ত। তারপর চুপ করে থেকেই ঘুরন্ত জাঁতার গর্তে যব ঢেলে দিতে দিতে কানফুলের থলেটার দিকে চোখ যেতে মুখটা আরো গম্ভীর হয়ে উঠেছিল তাঁর। গম্ভীর গলায় বলেছিলেন, “শাসণ করা তো বারণ হয়েছে। অতএব তোমাকে আজ শত অন্যায় করলেও কিছু বলবার উপায় নেই। কিন্তু প্রশ্ন করি, এই গয়না তুমি পেলে কোথায়?”
“ফেরবার পথে…ওই আরকি… বাজারে… ইস্কার কর্মশালা থেকে…”
“তার মানে তুমি ফের ওই বেণের মেয়ের কর্মশালায় গিয়েছিলে! সৌগমপুত্র বিসারার কাছে কাজ নিয়েছ সে অন্য কথা। সে পেশার ব্যাপার। ওতে ভবিষ্যৎ আছে। কিন্তু তোমাকে কতবার মানা করেছি, ভিন্নজাতীয় মেয়েদের সঙ্গে এভাবে ওঠাবসা করা বৈক্লন্যের পরিবারের উপযুক্ত কাজ নয়? তাছাড়া, ইস্কার শরীরে এক মহাপাপীর রক্ত বইছে তা কি তুমি জানো না? আর কত অন্যায় তোমার সহ্য করব আমি মাণ্ডুপ?” বলতে বলতে গলাটা ভেঙে আসছিল পিত্তার, “আমায় না জানিয়ে তুমি ঐ দৈত্যের সঙ্গে যুদ্ধে নেমেছ, তার পর আবার ওই বেণের মেয়ের কর্মশালাতে গিয়ে আমার জন্য গয়না এনেছ। আমার প্রত্যেকটা কথা আজ অমান্য করেছ তুমি। আজ তোমার পিতা এখানে উপস্থিত না থাকলে এর উপযুক্ত শাস্তি তোমাকে আমি দিতাম। তুমি…
মাণ্ডুপের তখন আর মায়ের রুষ্ট কথাগুলি কানে যাচ্ছে না। এইবার সে এত খাওয়াদাওয়ার আয়োজনের অর্থটা বুঝতে পারছিল। এদিক-ওদিক তাকিয়ে সে বলে, “বাবা? তিনি এসেছেন? কোথায়?”
“হ্যাঁ। কিছুক্ষণ আগে এসে পৌঁছেছেন। ছাদে তোমার জন্য অপেক্ষা করছেন। যাও। গিয়ে পিতার উপযুক্ত পুত্র হয়ে তাঁর আনন্দ বাড়াও তুমি। আসবার আগে মন্দিরাধ্যক্ষের সঙ্গে সাক্ষাত করতে গিয়ে তোমার গুণপনার খবর পেয়ে তো আনন্দে উদ্বাহু হয়ে বাড়িতে ফিরেছেন। মহিষ ও হরিণের মাংস সংগ্রহ করে এনেছেন মন্দিরের খাদ্যশালা থেকে। তোমার যুদ্ধজয়ের আনন্দে আজ এ-বাড়িতে ভোজ হবে। হে মাতৃকা, আমার কেন মৃত্যু হয় না! আমার পুত্র কুপুত্র হল। মায়ের অজান্তে মায়ের আদেশ অমান্য করে রাক্ষসের সঙ্গে প্রাণঘাতী যুদ্ধ করল, আর তার পিতা সেই সংবাদ শুনে কোথায় তাকে শাসন করবেন, তা নয়, আনন্দে অস্থির হয়ে, প্রতিবেশীদের নিমন্ত্রণ করে ভোজের আয়োজন করলেন। আমি আর এই সংসারে…”
কিন্তু তাঁর বাক্যটা পুরো হবার আগেই ঘর থেকে বের হয়ে গিয়ে দৌড়ে নীচে নেমে গিয়েছিল মাণ্ডুপ। তারপর কুয়োতলার পাশে তার ঘর থেকে যুদ্ধের প্রাপ্তির পুঁটুলিটা সঙ্গে করে ছাদের দিকে সটান উঠে গিয়েছিল কাঠের সিঁড়ি বেয়ে।
এই ছাদ থেকে দূরে ইন্দার ধারা চোখে পড়ে। প্রশস্ত নদীর বুকে সদ্য আকাশে জেগে ওঠা পুর্ণিমার চাঁদের ছায়া তরল রুপোর মত ছড়িয়ে পড়ে ঝিলমিল করছিল।
সেখানে, রুপোলি চাঁদের আলো গায়ে মেখে বসে থাকা যে মানুষটা তাকে উঠে আসতে দেখেই উঠে দাঁড়িয়ে দু হাত ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তার দিকে, তাঁকে দেখে আনন্দের পাশাপাশি একটা আশ্চর্য দুঃখও ছড়িয়ে পড়েছিল মাণ্ডুপের বুকে।
প্রায় দু’বছর বাদে বাড়িতে ফিরলেন তিনি। কিন্তু এ কী চেহারা হয়ছে তাঁর! ছোটোবেলায় যাঁর বীরোচিত পেশল শরীরের দিকে তাকিয়ে সে স্বপ্ন দেখত একদিন সেইরকম পুরুষ হয়ে উঠবে, সেই তিনি… একজন ন্যুব্জ বৃদ্ধ হয়ে ফিরে এসেছেন!
তাড়াতাড়ি তার বাবার দিকে এগিয়ে গিয়েছিল সে।
শৈশবের কিছু ঝাপসা স্মৃতি তার মনে আসে মাঝেমাঝে। যেন অন্য কোথাও, অন্য কোনো মায়ের কোলে… তবে সেই স্মৃতিদের, কোনো অপদেবতার পাঠানো স্বপ্ন বলেই মেনে নিয়েছে সে বহুকাল। বাবা তার বড় প্রিয়জন। তার জীবনের একমাত্র উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক।
বীর বৈক্লন্য। স্নেহময় পিতা বৈক্লন্য। যখনই পিতাপুত্রে দেখা হয়েছে হাজারো উপহারে তাকে ভরিয়ে দিয়েছেন তিনি। শৈশবে যখন দেখা হত, তাঁর সঙ্গে আসত মঞ্জাদাহিরে তৈরি মহান দোরাদাবুর সিংহাসনে বসা মূর্তি। মাটি পুড়িয়ে তৈরি সেই মূর্তিদের শরীরে আশ্চর্য দক্ষতায় রঙ ফোটাত সেখানকার শিল্পীরা। কখনো সুদূর ম্হিরি প্রদেশের থেকে আসা আশ্চর্য সব মাটির তৈরি খেলনাও নিয়ে আসতেন বৈক্লন্য। অপরূপ সব পুতুল, চাকা লাগানো নানান চেহারার রথ। রথ টানবার ভারবাহী পশুদের ছোটো ছোটো নিখুঁত প্রতিরূপ। সে-রথদের মাটিতে রেখে টানলে তার চাকাগুলি সত্যকার রথের মতই ঘোরে। তারপর একটু বড়ো হতে একবার তিনি তাকে এনে দিয়েছিলেন মঞ্জাদাহিরের মন্দিরদুর্গের কারিগরদের গড়া ছোটো একটা চামড়ার বর্ম ও একটি ছোটো ঢাল-তরবারি। সে বর্ম দেখিয়ে বন্ধুদের মধ্যে সম্মান অনেকগুণ বেড়ে গিয়েছিল মাণ্ডুপের। সেই তরবারি নিয়েই তার যুদ্ধশিক্ষার সূচনা।
আজ তার প্রতিদান দেবে সে। নিজের প্রথম উপার্জনের উপহার দিয়ে তাঁকে বাড়িতে স্বাগত জানাবে মাণ্ডুপ। তাঁর কাছে এসে পায়ের সামনে নীচু হয়ে বসে পড়েছিল সে। তারপর হাতের পুঁটুলিটা খুলে সেখানে রাখতে চাঁদের আলো পড়ে ঝলমল করে উঠেছিল তার ভেতরের সোনা, রুপো আর তামার গোল, চৌকো কিংবা নিছকই আকারবিহীন ছোটো ছোটো পিণ্ডগুলো। তাদের গায়ে কতনা বিভিন্ন এলাকার মুদ্রাচিহ্ন খোদাই করা! তারপর বলেছিল, “সম্মুখযুদ্ধে আমার প্রথম উপার্জন বাবা। আপনার জন্য স্বাগত উপহার।”
***
“কী হল? আমার প্রশ্নের জবাব দিলে না মাণ্ডুপ? না না, উত্তরটা আমি জানি। কিন্তু তোমার মুখে তা ফের একবার শুনতে ভালো লাগবে আমার। আহা, বৈক্লন্যের পুত্র… বলো মাণ্ডুপ, তুমি সেই সম্মুখযুদ্ধে জয়লাভ করেছ?”
মাণ্ডুপ হাসিমুখে মাথা নেড়ে সম্মতি জানাল। তারপর বলল, “কিন্তু মা…”
দুহাতে তাকে বুকের সঙ্গে জড়িয়ে ধরে একটুক্ষণ তার চোখের দিকে তাকিয়ে রইলেন বৈক্লন্য। তারপর মৃদু হেসে বললেন, “মায়ের কথায় দুঃখ পেয়ো না। তিনি স্নেহ করে তোমায় বুকে আগলে রাখতে চান। হয়তো চান প্রাণঘাতি যুদ্ধ ব্যবসায়ের বদলে তুমি বেণেদের মত নিঃশঙ্ক জীবন যাপন করো। কিন্তু বৈক্লন্যের পুত্র যে একদিন মৃগচর্মের আবরণ সরিয়ে নিজের সিংহরূপ প্রকাশ করবেই সে বিষয়ে আমি নিঃসন্দেহ ছিলাম। তবে সে দিনটা যে এমন অসামান্য একটা ঘটনার মধ্যে দিয়ে আসবে, সে আশা আমি করিনি। সবই মহান দোরাদাবু ও মাতৃকার কৃপা। আজ ঐ দ্বন্দ্বযুদ্ধের পর মন্দিরসেনার অধ্যক্ষ স্বয়ং কী প্রস্তাব দিয়েছেন আমার কাছে জানো? বলেছেন তোমাকে তিনি মন্দিরসেনায় অন্তর্ভূক্ত করতে চান। কেবল তাই নয়, এখনই তিনি সরাসরি দ্বাদশজন সেনার অধিকারী হিসেবে তোমাকে কাজে নিযুক্ত করতে প্রস্তুত। মাত্র সতের বছর বয়স তোমার। এত কম বয়সে ইন্দাতীরের কোনো শহরে কোনো তরুণ এমন সম্মানজনক প্রস্তাব পায়নি সে আমি জোর দিয়ে বলতে পারি।”
“এবং আপনি সে প্রস্তাবে সম্মতি দিয়ে এসেছেন নিশ্চয়? আপনি…”
পিত্তাদেবী কখন যেন নিঃশব্দে ছাদে উঠে এসেছেন। হঠাৎ বাবা ও ছেলের মাঝখানে এসে দাঁড়িয়ে বৈক্লন্যের মুখোমুখি হলেন তিনি। একটি হাত বাড়িয়ে সজোরে জড়িয়ে ধরেছেন তিনি মাণ্ডুপের মাথাটিকে। তাঁর হাত থেকে ফুলের পরাগের মত যবের গুঁড়ো ঝরে পড়ে মাখামাখি হয়ে যচ্ছিল মাণ্ডুপের মাথায়।
সেদিকে একনজর দেখে বৈক্লন্য সামান্য হেসে মাথা নাড়লেন, “না না। আমি সম্মতি দিইনি। তোমার ছেলে এত সামান্য সেপাইগিরির জন্য জন্মায়নি জেনে রেখো। অনেক বড়ো ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে তার জন্য।”
একটা লম্বা স্বস্তির শ্বাস ফেললেন পিত্তাদেবী। কিন্তু তার পরেই একটা নতুন আশঙ্কা জেগে উঠল তাঁর মনে। অধ্যক্ষ মাণ্ডুপকে মন্দিরসেনায় ভর্তি করতে চাইবার অর্থ, তা স্বয়ং দেবতার ইচ্ছা। মন্দিরসেনার অধ্যক্ষ তাঁর প্রধান পুরোহিত। তাঁর মুখ দিয়ে নিজের ইচ্ছাই ব্যক্ত করেন অধিষ্ঠাতা দেবতা। সে ইচ্ছা আমহিরিবাসীর কাছে অমোঘ আদেশ। প্রাচীনকালে আদি পুরোহিত মুহিরাদেবের সামনে প্রথম আবির্ভূত হয়ে, জ্বলন্ত গোলকের রূপ নিয়ে তাঁকে যে দশটি ধর্মোপদেশ তিনি দিয়েছিলেন, সেই উপদেশমালার পালন আজও ইন্দাতীরের সমস্ত বাসিন্দার কর্তব্য। অন্যথায় মৃত্যুদন্ড ও অনন্ত নরকবাস। দেবতার প্রতিটি আদেশের প্রশ্নহীন পালন সেই দশ ধর্মোপদেশের অন্যতম।
একটু ইতস্তত করে তিনি বললেন, “কিন্তু দেবতার ইচ্ছার বিরুদ্ধে কোনো পুরোহিতও যেখানে প্রতিবাদ করবার ক্ষমতা ধরেন না, সেখানে তোমার মত সাধারণ একজন মানুষ…”
বৈক্লন্য একটু হাসলেন। এতকাল যে জীবিকায় তিনি ছিলেন, তাতে এ রীতি তাঁর অজানা নয়। অতএব, পুরোহিতের কথার সরাসরি বিরুদ্ধাচরণ তিনি আজ করেননি। কেবল মৃদু হেসে বলেছিলেন, “আপনার আদেশই ঈশ্বরের আদেশ। কিন্তু মহান, সৃষ্টিকর্তা দোরাদাবুর প্রধান পুরোহিত আহীনদেব যে আমার পুত্রকে মঞ্জাদাহিরে আহ্বান করেছেন! সে আদেশ তবে…”
পুরোহিত বুদ্ধিমান। সামান্য অসন্তুষ্ট হলেও আহিনের বন্ধু ও প্রাক্তন সেনাপতি বৈক্লন্যদেবের এই কথার বিরুদ্ধে আর তাই কোনো প্রতিবাদ করেননি তিনি।
তবে এ কথা এখনই পিত্তাদেবীকে জানাবার কোনো অর্থ নেই। স্বামীপুত্র নিয়ে অন্তত একটি রাত্রির আনন্দ অভাগিনীর প্রাপ্য। সুখবরটাকে চেপে রেখে, মাথা নেড়ে বৈক্লন্য বললেন, “মঞ্জাদাহিরের প্রধান পুরোহিত আহীনের বন্ধু, প্রধান সেনাপতি বৈক্লন্য কোনো সাধারণ মানুষ নয় পিত্তা। আমি যা করেছি তা আহীনের সম্মতিক্রমেই করেছি। ও নিয়ে তুমি ভেবো না।”
***
চাঁদ মাঝ আকাশে উঠেছে। আশপাশের বাড়িগুলো ঘুমিয়ে পড়েছে এবারে। প্রধান রাস্তার পাশে এই বাড়িগুলোর বাইরের চত্বরে অনেক বিপণী। তাদের আলোও নিভে গেছে এবারে। ঘুমন্ত শহরের মধ্যে কেবল এই বাড়িটি জেগে আছে এখন। তার প্রশস্ত ছাদের একপাশে সদ্য শেষ হওয়া ভোজের বাসনপত্র তুলে নীচে নিয়ে যাচ্ছিল দেম্ভা আর নাশাইলি।
অন্যপাশে কার্পাসের তুলো থেকে পাকানো সুতোয় তৈরি একখণ্ড সফেদ কাপড় বিছিয়ে অতিথিরা বসেছিলেন। এ শহরের মান্যগণ্য মানুষ তাঁরা। কিন্তু অধিকাংশই আমহিরির চৌহদ্দি ছাড়িয়ে কখনো তার বাইরে পা দেননি। বৈক্লন্য তাঁদের কাছে সেই ঘটমান বহির্জগতের একটি জানালার মতই। তাদের হাজারো প্রশ্নের জবাব শান্তভাবেই দিয়ে চলেছিলেন তিনি। বড়ো আরাম হচ্ছিল তাঁর। এইবার তাঁর যোদ্ধাজীবনের সমাপ্তি হয়েছে। ছেলেটি বড়ো হয়েছে। ঘরে অর্থের অভাব নেই। এইবার বাকি জীবনটা এইভাবেই বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে খানিক গল্পে, ভোজে, আনন্দে কাটিয়ে দেবার পালা।
“তা মাণ্ডুপকে তো মন্দিরসেনায় পদ দেবার কথা হয়েছে শুনলাম,” প্রতিবেশী রল্ল-র গৃহিনী উমানি বলে উঠলেন হঠাৎ, “এইবার তবে আমাদের মাণ্ডুপ…”
তাঁর দিকে চাপা বিরক্তির চোখে একবার চেয়ে দেখলেন পিত্তা। এই প্রৌঢ়া যেন এ শহরের যাবতীয় সংবাদের চলমান সংগ্রহশালা। এঁর কান এড়িয়ে এ শহরের একটা পাতা অবধি নড়তে পায় না।
তারপর বিরক্তিটা চেপে তিনি জবাব দিলেন, “না না। ওই সামান্য কাজে আমার মাণ্ডুপ…”
পিত্তার গলায় বেজে ওঠা সামান্য অহঙ্কারের শব্দটা প্রৌঢ়ার কান এড়ায়নি। তাঁর স্বামীও মন্দিরসেনা ছিলেন। সামান্য সেপাই হয়ে যোগ দেবার পর দীর্ঘ কর্মজীবনের শেষে সদ্যই মন্দিরসেনার চব্বিশ সৈন্যের অধিকারী পদ থেকে অবসর নিয়েছেন। অতএব পিত্তার কথাটা তাঁর গায়ে লেগেছে। মুখে ছুরির মত একটুকরো হাসি মেখে তিনি বললেন, “অ। তাহলে ওই বেণের ছেলে বিসারার দেহরক্ষী হয়েই থাকা স্থির হল? তা অবশ্য মন্দ নয়। চেহারাতেও তো বেণেটার সঙ্গে বেশ মিল আছে মাণ্ডুপের। পিছু পিছু যখন ভল্ল হাতে হেঁটে যায়, যেন মনে হয় দুটি ভাই। শুনছি নাকি নিজেও আজকাল একটু আধটু পুঁজি লাগাচ্ছে ব্যবসায়। ভালো ভালো।”
পিত্তার বুকের ভেতরে একটা হালকা কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল। মুখের মিলের কথাটা উমানি খুব একটা ভুল বলেননি। পিত্তার নজরেও ব্যাপারটা পড়েছে। কিন্তু সেটা নিতান্তই দৈবিক ব্যাপার। কারণ মাণ্ডুপের জন্ম কট্টাদিজি শহরের বন্য এলাকায়। যদিও সে যে বৈক্লন্যের পালিত পুত্র, একথা কখনো এই শহরে কারো মুখে উচ্চারিত হয়নি। বৈক্লন্যর তেমন আদেশই ছিল। স্বয়ং আহিনের মুখ্য সেনাপতির সে আদেশ অমান্য করবে এতবড়ো সাহস এ-শহরে কারো থাকবার কথাও নয়।
খোঁচা খাওয়া প্রৌঢ়ার মুখের এহেন কথা শুনে বৈক্লন্যও দেখা গেল উত্তেজিত হয়ে উঠেছেন। বিসারার সঙ্গে মাণ্ডুপের মুখের মিলের কারণটা এখানে একমাত্র তিনি জানেন। তিনি সন্তানহীন। সে নিয়ে তাঁর মনে গভীর দুঃখও আছে। সে কথা এঁদের অজানা নয়। অথচ তা সত্ত্বেও তাঁর বাড়িতে বসে প্রসঙ্গটা যে এভাবে তাঁর সামনে কেউ তুলতে পারে এ তাঁর কল্পনারও বাইরে ছিল।
তাঁর দিকে সামান্য শঙ্কিত চোখ ফেলে রল্ল নীরবে তার স্ত্রীর কাঁধে নিষেধসূচক হাত ঠেকাল একবার। একটু থতমত খেয়ে থেমে গেলেন প্রৌঢ়া। তারপর যেন সাফাই গাইছেন এমনভাবে বলে উঠলেন, “একটু রহস্য করছিলাম আরকি। এমন দৈবিক মিল তো কতই দেখা যায় ঈশ্বর দোরাদাবুর দুনিয়ায়। আর তাছাড়া বেণের পেশাও আর খারাপ কী এমন! আজকাল তো নগর পরিচালনায় মন্দিরসেনার পাশাপাশি বণিকসঙ্ঘের সদস্যেরাও অংশ নিচ্ছেন।”
কঠোর ও অপ্রিয় এই সত্যটা আরো গভীরভাবে ধাক্কা দিল বৈক্লন্যকে। মহান দোরাদাবুর ইশারায় কিছুকাল হল ইন্দাতীরের শাসণে যুদ্ধব্যবসায়ীদের পাশাপাশি বণিকদের অংশগ্রহণ ক্রমশ বেড়ে চলেছে। এরা শঠ ও কুটিল। পবিত্র তরবারি এদের কাছে অস্পৃশ্য। বাণিজ্যের জটিল দুনিয়া এদের যুদ্ধক্ষেত্র। সোনারূপার খণ্ড এদের অস্ত্র। সম্প্রতি এমনকি মঞ্জাদাহিরের পুরোহিতমণ্ডলীতেও কয়েকজন যোগ্য যুদ্ধব্যবসায়ী পরিবারের সন্তানকে উপেক্ষা করে তাদের জায়গায় বণিকপুত্রদের স্থান দেয়া হয়েছে। তাঁর মত একজন প্রাচীন যুদ্ধব্যবসায়ীর কাছে এ বড়োই অপমানকর।
যে কথাটা রাত্রে ধীরে ধীরে পিত্তার কাছে ভাঙবেন বলে স্থির করে রেখেছিলেন, এইবার খোঁচাগুলো খেয়ে তারা এইবার তাঁর মুখে উঠে এল। একটুকরো ধারালো হাসি ছড়িয়ে তিনি রল্লর দিকে তাকিয়ে বললেন, “না। সামান্য বেণের ছেলের দাসত্ব করবার জন্য মাণ্ডুপের জন্ম হয়নি রল্ল। বৈক্লন্যের সন্তান কখনো অর্থলোভি বণিক হবে না। জেনে রাখো, আমার পুত্রকে স্বয়ং আহীন মঞ্জাদাহিরে আহ্বান করেছেন। আমি সেই সংবাদ নিয়েই ফিরে এসেছি আমহিরিতে। আগামীকাল বিকেলে সে মঞ্জাদাহিরের পথে রওয়ানা হয়ে যাবে। সেখানে তার জন্য উজ্জ্বল ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করছে। একবার সেখানে পৌঁছোবার পর আমার মাণ্ডুপ…”
কিন্তু কথাটা শেষ হল না তাঁর। হঠাৎ সেই আনন্দময় আসর থেকে মূর্তিমান বিষাদের মত হাতে চোখ চাপা দিয়ে উঠে দাঁড়িয়েছেন পিত্তা। তারপর এগিয়ে গিয়ে মাণ্ডুপকে জড়িয়ে ধরে কান্নাভেজা গলায় হাহাকার করে উঠলেন তিনি, “মাণ্ডুপ… পুত্র আমার…”
কিন্তু যেতে দিতেই হয়। এই শহরে পিত্তার পিতৃপুরুষ বহুযুগ হতে বাস করছেন। এই ভূমিতেই একদিন আবির্ভাব হয়েছিল ঈশ্বর দোরাদাবুর। এইখানেই তাঁর দেয়া দশটি নীতির শিক্ষা নিয়ে মুহিরাদেব যখন এই শহরের গোড়াপত্তন করছিলেন তখন পিত্তার পূর্বপুরুষও সেই কর্মযজ্ঞে শামিল হয়েছিলেন। বংশানুক্রমে দোরাদাবু ও তাঁর সন্তানদেবতার সেনাবাহিনীতে কাজ করেছেন তাঁর পিতা পিতামহ প্রপিতামহেরা। তাঁদের জন্য প্রাণ দিয়েছেন। তাঁদের প্রসাদে উন্নতির চূড়ায় উঠেছেন। ঈশ্বরের বা তাঁর মুখপাত্র পুরোহিতদের আদেশের প্রতি আনুগত্য তাঁর রক্তে মিশে আছে। শত দুঃখেও সে আদেশের বিরোধিতা করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়।
বড়ো দুঃখের রাত ছিল সেদিন পিত্তার। চোখের জল তাঁর বাধা মানে না। মাণ্ডুপের পরদিন রওনা দেবার প্রস্তুতি চলেছে সারা রাত জুড়ে। দুঃখ পেয়েছে দেম্ভা আর নাশাইলিও। সারা রাত ধরে তারা তিনজন মিলে মাণ্ডুপের বিদায়ের প্রস্তুতি চালায়। গো যানে যাবে মাণ্ডুপ। অন্তত সাতটি দিনের যাত্রা। সেজন্য উপযুক্ত আহার্য, মঞ্জাদাহির নগরীতে যাবার পর সেই বিশাল শহরের উপযুক্ত পোশাক-আশাক এই সবকিছুই গুছিয়ে ফেলতে হবে তাদের। মাণ্ডুপের যেন পথে কোনো কষ্ট না হয়। সে যেন আরামে, আনন্দে পৌঁছে যেতে পারে মহান ঈশ্বর দোরাদাবুর পীঠস্থানে। রাত বহে যায়। মাঝে মাঝেই কাজে বিরতি দিয়ে পিত্তা উঠে যান মাণ্ডুপের ছোট্ট ঘরটিতে। সেখানে একফালি সরু বিছানায় গভীর ঘুমে ডুবে থাকা মাণ্ডুপ টের পায় না, তার গালে, কপালে ঝরে পড়ে মায়ের আশির্বাদি চুমু, ঝরে পড়ে তাঁর ভালোবাসার নোনতা জলের বিন্দুরা…
***
“তাহলে… চলেই যাবি তুই?”
তাদের পায়ের তলা দিয়ে ইন্দা বয়ে যায়। সুদূর উত্তরে কোন অজানা পাহাড়ের কোলে তার জন্ম কে জানে! সেখান থেকে বয়ে আসা এই নদীর তীরে তীরে একে একে ছোটোবড়ো কত না বসতি গড়ে উঠছে। সিন্ধু বেয়ে আমহিরিতে আসা বণিকেরা তাদের খবর বয়ে আনে। সুদূর দক্ষিণে কোনো অজানা জায়গায়, অদেখা সমুদ্রের বুকে গিয়ে মেশে সিন্ধু। সেখানে সমুদ্রের ধারে নাকি গড়ে উঠছে লৌতল নামে এক আশ্চর্য বন্দরশহর।
“আজ সন্ধ্যায় তবে ইন্দার বুকে তোর নৌকা…”
মাণ্ডুপ মাথা নাড়ল, “ইন্দা বেয়ে নয় রে। আজ সন্ধ্যায় বণিক সুম্ভের পণ্য চলেছে মঞ্জাদাহির হয়ে নবসার নগরীর পথে। তাঁর সঙ্গেই যাব ঠিক করেছি।”
“স্থলপথে? কিন্তু সেখানে যে দস্যুদের উপদ্রব!”
বলতে বলতে খানিক আশঙ্কার সঙ্গে নদীর ধার দিয়ে এঁকেবেঁকে গিয়ে শহরকে বের দিয়ে উত্তরপশ্চিমের দিকে এগিয়ে যাওয়া পথটার দিকে একবার তাকিয়ে দেখল ইস্কা। ইন্দার তীরে তীরে গড়ে উঠতে থাকা দোরাদাবুর এই বিরাট সাম্রাজ্যের বিভিন্ন জায়গার মধ্যে নিরাপদ যোগাযোগের প্রধান পথ এখনও ওই জলধারা। স্থলপথে দস্যুর উপদ্রব আছে। বিসারার বাণিজ্যবহরও ওই জলপথেই চলাচল করে। স্থলপথ প্রধানত সৈনিকদের ব্যবহারেই লাগে বেশি।
তবে হ্যাঁ। স্থলপথেও কোনো কোনো বণিক আজকাল পণ্য নিয়ে আসা শুরু করেছেন বটে। পথের দুধারে গড়ে উঠতে থাকা ছোটোবড়ো শহরগুলির পাশাপাশি কিছু কিছু রক্ষাদুর্গও গড়ে ওঠায় সে পথরা এখন আগের তুলনায় নিরাপদ হলেও সম্পূর্ণ নিরাপদ এখনও নয়। এখনও পশ্চিমের মরু অঞ্চলের অর্ধ যাযাবর বন্য মানুষদের দলবদ্ধ আক্রমণ ঘটে তার নির্জন এলাকাগুলোতে। এরা বুদ্ধিমান। দলবদ্ধ সৈনিক, কিংবা সাধারণ পথিকদের এরা স্পর্শ করে না। সাধারণত বণিকদের পণ্য নিয়ে চলাচল করা যানগুলোই তাদের আক্রমণের প্রধান লক্ষ হয়।
তার উদ্বেগ দেখে মাণ্ডুপ হাসল, “ওইজন্যেই তো সুবিধে হয়ে গেল। আমার মঞ্জাদাহির যাবার খবরটা সকালের মধ্যে গোটা আমহিরি জেনে গিয়েছে। তা সকালে বণিক সুম্ভ এসে বাবার সঙ্গে দেখা করেছিলেন। আমার কালকের যুদ্ধের সংবাদ তিনি শুনেছেন। আজ বিকেলে পণ্যসামগ্রী ভরা ছত্রিশটি গো যান নিয়ে তিনি মঞ্জাদাহির হয়ে নবসারের পথে রওনা হবেন। এখান থেকে মঞ্জাদাহির অবধি পথটা খানিক জনবিরল। তার ওধারে নবসারের আগে পথের দুপাশে বসতি তুলনায় ঘন। তা বাবাকে তিনি অনুরোধ করলেন, তাঁর রক্ষিবাহিনীর নেতৃত্ব দিয়ে আমি যদি তাঁদের মঞ্জাদাহির অবধি যাই। মুন্দিগ্রজয়ী মাণ্ডুপের সুরক্ষায় তবে তিনি নিশ্চিন্ত বোধ করবেন। বাবা একটু ইতস্তত করছিলেন, তখন আমি গিয়ে বললাম, আমি এক শর্তে সম্মত। যাত্রার সমস্ত ব্যয়ভার সুম্ভকে নিতে হবে এবং নিরাপদে মঞ্জাদাহির পৌঁছোবার পর তিনি আমাকে উপযুক্ত পারিশ্রমিক দেবেন। শুনে সুম্ভ এক কথায় রাজি। ”
মাণ্ডুপের দিকে খানিক উদ্বিগ্ন ও বিরক্ত মুখে তাকিয়ে দেখল ইস্কা। তারপর হঠাৎ ফিক করে হেসে ফেলে বলে, “তুই কিন্তু যোদ্ধা কম বেণে বেশি। সাধারণ একটা যাত্রাকেও লাভজনক একটা লেনদেনে বদলে নিলি। কিন্তু…”
তার রুখু চুলে হাত রাখল মাণ্ডুপ, “ভাবিস না। চব্বিশজন দক্ষ সৈনিকের একটা দল চলেছে প্রহরী হয়ে। তাদের নেতৃত্বে মহিষে সওয়ার হয়ে আমি চলব। কোনো দস্যুর দল আমার কোনো ক্ষতি করতে পারবে না। স্বয়ং দোরাদাবু আমায় ডাক দিয়েছেন। প্রয়োজনে তিনিই রক্ষা করবেন আমায়। তাঁর কৃপায়, দস্যু তো ছাড়, যদি মুন্দিগ্র নগরীর কোনো শ্বেত রাক্ষস কিংবা দানবনগরী ম্হিরির যন্ত্রবিৎ দানবের দলও আমার সামনে আসে, আমি তাদের বন্দি করে নিয়ে যাব মহান দোরাদাবুর মন্দিরে এই জেনে রাখবি।”
কথাটা শুনে উত্তরপশ্চিমে মুখ করে হাত জোড় করে প্রণাম জানাল ইস্কা একবার। ওইদিকেই বহু পথ পার হয়ে দোরাদাবুর অধিষ্ঠান। তিনি অন্তর্যামী। তাঁর ইচ্ছা বিনা ইন্দাতীরের একটি গাছের পাতাও নড়ে না। ডেকেছেন যখন, তখন তার মাণ্ডুপকে রক্ষা করবার ভারও তাঁরই।
কিন্তু তার পরেই একটা দ্বিতীয় শঙ্কা দেখা দিল তার মনে। হঠাৎ তার মাথায় রাখা মাণ্ডুপের হাতটা দুহাতে ধরে টেনে নিয়ে সে বলল, “আর কি তুই আমহিরিতে ফিরবি না?”
“কেন ফিরব না রে?”
তার হাতে নিজের মুখটা লুকিয়ে ফেলল ইস্কা। ভেতরে ভেতরে একটা হালকা কাঁপুনি উঠছিল তার। মাণ্ডুপ তার বড়ো সহায় ছিল এই আমহিরিতে। বলা যায় একমাত্র সহায়।
তার বাপকে ঈশ্বর নিয়েছেন। তাতে অবশ্য ঈশ্বরকে সে দোষ দেয় না। মহাপাপ করেছিলেন তিনি। বণিক হিসাবে সামান্য লিপিজ্ঞান তাঁর আইনত প্রাপ্য ছিল। মুদ্রার চিহ্নদের পড়তে শেখা, তার সরল হিসাবনিকাশ- মন্দির থেকে সেই শিক্ষাটুকু তাঁকে দেয়াও হয়েছিল। অথচ তাতে সন্তুষ্ট না হয়ে তিনি সে জ্ঞানকে আরও প্রসারিত করতে গেলেন।
কোন অন্ধকার, পাপের পথে যে লেখবার নিষিদ্ধ কৌশল আয়ত্ত করেছিলেন তিনি কে জানে। তবে, ঈশ্বরের তা অজানা থাকেনি। একদিন মন্দিরসেনার একটা ছোটো বাহিনী এসে তাঁর ঘরের এক কোণে মাটিতে পুঁতে রাখা সাতটি মাটির পট্ট উদ্ধার করে। তার গায়ে লেখা লিপিগুলো যে তাঁরই রচনা তা বাবা অস্বীকার করেননি। সেদিন গভীর লজ্জায় মুখ লুকিয়েছিল ইস্কা ও তার মা।
তাঁকে বন্দি করে নিয়ে যাবার পর, বাড়িটিকে শোধন করেছিল সৈন্যরা। করেছিল পবিত্র আগুনের শিখায়। নগরের একপ্রান্তে ভিখারি ও দরিদ্র মানুষের আশ্রয়স্থল গণগৃহের এক কোণে পড়ে থাকা ইস্কা ও তার মা পরে লোকমুখে শুনেছিল, দোরাদাবুর সন্তানদেবতার কক্ষে নিয়ে যাওয়া হয়েছিল তাঁকে। ঈশ্বরের অদৃশ্য করুণাবহ্নি তাঁর মনকে পুড়িয়ে তার পাপ ধুয়ে দিয়েছিল। নশ্বর শরীরটি তাদের ফেরৎ দেয়া হয়নি অবশ্য। দিলেও লাভ হত না। একজন পাপীর দেহকে তার মাটিতে সমাধিস্থ করবার স্থান দিতে অস্বীকার করত এ নগরের ধর্মভীরু মানুষজন।
মাঝে মাঝে একটা হাহুতাশ জাগে ইস্কার মনে। কোথায়, ইন্দার কোন চড়ায় তার বাপের দেহাবশেষ পড়ে আছে কে জানে? বন্যপশুর খাদ্য হয়েছে হয়তো। কখনো কখনো মনের অনেক গভীরে একটা দ্বিতীয় প্রশ্নও জাগে তার। লিপির পাঠ নেয়া, তার চর্চা করা… কেন তা পাপ হবে? কেন মহান দোরাদাবুর দশ নির্দেশের তৃতীয়টিতে এ পাপের একমাত্র শাস্তি হিসেবে মৃত্যুদণ্ড ধার্য করা হল?
তবে সে চিন্তা সে বেশিক্ষণ মনে ঠাঁই দেয় না। দোরাদাবুর অন্য নাম মনরাক্ষস। এই কুচিন্তা মনে দীর্ঘক্ষণ ঠাঁই দিলে হয়তো তা তাঁর অজানা থাকবে না। না না! মরতে বড়ো ভয় পায় ইস্কা।
সে ঘটনার পর দীর্ঘ দশটা বছর তাদের মা-মেয়ের কেটেছে ওই গণগৃহে। সামান্য কিছু পুঁতি গড়ে কোনোমতে দিন গুজরাণ হয়েছে একদা ধনী এই পরিবারের দুই অভাগা সদস্যের। মহাপাপীর সন্তানকে সাহায্য করতে কেউ এগিয়ে আসেনি। শুধু, এসেছিল ওই মাণ্ডুপ! শৈশবের খেলার সাথীটি তার, একদিন তার পাশে এসে দাঁড়িয়ে, তাকে সাহায্য করে ফের তাদের মা-মেয়ের জীবনে সামান্য হলেও কিছুটা সুখের আলো এনে দিয়েছে। আর আজ সে এমন হঠাৎ করেই সব ছেড়েছুড়ে…
কিন্তু না। মাণ্ডুপকে সে তার চোখের জল দেখতে দিতে চায় না। প্রাণপণে তার হাতটা মুখের ওপর চেপে ধরে তাই সে বসে থাকে নির্বাক হয়ে। তার কেঁপেকেঁপে ওঠা পিঠে মাণ্ডুপের অন্য হাতটা স্নেহের স্পর্শ দিয়ে যায়।
খানিক বাদে নিজেকে সংযত করে উঠে বসল সে। মাণ্ডুপের দিকে চোখ রেখে বলল, “কী করে ফিরবি তুই? মহান ইন্দাকে ঘিরে কত নগর, বন্দর, কত দুর্গ। মঞ্জাদাহিরের মন্দিরসেনার একজন মুখ্য হয়ে তার কোথায় কোথায় তোকে ঘুরে বেড়াতে হবে কে বলতে পারে। সেসব নগরে কত আনন্দ, কত আকর্ষণ! সেইসব ছেড়ে এই সামান্য আমহিরি নগরে…”
মাণ্ডুপ হাসল। বেশি কথা সে বলতে জানে না। গুছিয়ে বলতেও পারে না অতশত। তাই মাথা নেড়ে খুব সংক্ষেপে সে তার জবাবটা দিয়ে দিল ইস্কাকে, “আমি ফিরে আসবই। দেখে নিস। আর শোন, যখন আসব, তোর জন্য কোনো অমূল্য উপহার সঙ্গে করে নিয়ে আসব দেখিস।”
একটুক্ষণ চুপ করে বসে রইল ইস্কা। মাণ্ডুপের গলায় একটা অজানা ভরসার ছোঁয়া ছিল। একটা অচেনা সুর। এ সুর ইস্কা তার গলায় আগে শোনেনি কখনো। তার কেবল মনে হচ্ছিল, এ সুরকে বিশ্বাস করা যায়। খানিক বাদে সে মাথা নেড়ে বলল, “বেশ। আমি অপেক্ষা করে থাকব।”
৭
পথ চলে গেছে নদীর পাড় ধরে ধরে, উঁচুনীচু জমির বুক চিরে সটান উত্তর পশ্চিম মুখে। বণিকের পণ্যবাহিনী। বড়োই ধীরলয়ে চলে। পণ্যবোঝাই ভারী ভারী শকটগুলোকে টেনে নিয়ে নিয়ে যেতে কিছুক্ষণ বাদে বাদে স্বাস্থ্যবান গরুগুলোও হাঁফিয়ে পরে। তখন যাত্রা থামিয়ে তাদের একদলকে বিশ্রাম দিয়ে নতুন একদলকে গাড়িতে জোতার পালা। আর এইভাবেই থামতে থামতে ধীরে ধীরে এগিয়ে চলেছিল সুম্ভের পণ্যবাহী বাহিনী।
আমহিরি নগরের সীমানা ছাড়িয়ে আসতে গ্রামাঞ্চল শুরু হয়েছিল। এখন খেতে খেতে শস্যে পাক ধরবার সময়। গম ও যবের খেতগুলোয় শস্যের ভারে মাথা নুইয়ে থাকা গাছেরা সোনার মত আলো ঠিকরায় যেন। খেতগুলির পাশ দিয়ে ইন্দা বয়ে যায়। তার জলেই এই শস্যখেতদের পুষ্টি। বর্ষায় তার উন্মাদরূপ যতই ভয় দেখাক, আসলে সে তখন উর্বর পলির উপহারে এই খেতদেরই পরিচর্যা করে।
পণ্যবাহিনীর পেছন পেছন সুম্ভ চলেছেন তাঁর বিলাসবহুল গো যানে। গোটা দলটার আগেপিছে চব্বিশজন সেনাকে কুশলী ব্যুহে সাজিয়ে নিয়ে মাণ্ডুপ তার মহিষে সওয়ার হয়ে সুম্ভের পাশে পাশে চলে। তাদের দলটিকে দেখে চারপাশের শস্যক্ষেত থেকে চাষীরা মাথা তুলে দেখে। মাথা নত করে সম্মান জানায় ধীরচালে এগিয়ে চলা সুম্ভর রাজসিক শকট ও তার পাশে চামড়ার বর্মে সাজা মহিষবাহন বীরপুরুষকে।
এই শস্যক্ষেত্রদের ছেড়ে আসবার পর শুরু হয়েছিল সুবিস্তীর্ণ পশুচারণক্ষেত্র। এর পরিধি বহুদূর পর্যন্ত বিস্তৃত। জনবসতি এখানে প্রায় নেই বললেই চলে। এখানে কোথাও নরম ঘাসের সবুজ আবরণ, তার বুক দিয়ে অদূরবর্তী ইন্দার দিকে বয়ে যায় ছোটো ছোটো জলধারা। কোথাও বা দিগন্ত জুড়ে ছড়িয়ে থাকে বন্য ধানের প্রাকৃতিক খেত।
তবে জনবসতি না থাকলেও এই ধূ ধূ প্রান্তরগুলোয় মানুষ আছে। তারা পশুচারক। গবাদিপশুর বড়ো বড়ো দল নিয়ে তারা এই বিজন ভূমিতে মাসের পর মাস কাটিয়ে দেয়। এক এলাকায় পশুদের খাদ্য শেষ হয়ে গেলে তাদের সঙ্গে নিয়ে অন্য এলাকায় চলে যায়।
ঘাসের পাশাপাশি এখানকার বন্যধানের খেতগুলো পশুচারকদের প্রিয়। নাকি সে খাদ্যে পশুদের মাংস সুমিষ্ট হয়। দুধের পরিমাণও বাড়ে। মাঝে মাঝে তারাও পশুদের সঙ্গে ভাগ করে সেই বন্য ধান সিদ্ধ করে খায়। ফলে সাধারণত তারা এই ধানের খেতগুলোর পাশেই রাত্রিবসের আয়োজন করে থাকে।
বাইরে থেকে নিস্তব্ধ ও জনহীন দেখালেও এই এলাকাগুলো বিপজ্জনক। চিতা নেকড়ে ও হায়েনার দল এখানে পশুমাংসের লোভে ঘুরে বেড়ায়। অসাবধান পশুচারকের পালে হানাও দেয় সুযোগ পেলে। এছাড়া পশ্চিমা মরুদস্যুরাও মাঝে মাঝে অরণ্য থেকে বের হয়ে এসে এই চারণভূমিগুলোয় পশুপালকদের ওপরে হামলা করে তাদের পশুপাল লুঠে নিয়ে যায়।
এই এলাকায় ঢুকে এসে তাই রক্ষিদলের নেতা হিসাবে মাণ্ডুপ সিদ্ধান্ত নিয়েছিল, প্রতি রাতে পশুচারকদের কোনো না কোনো দলের কাছাকাছি শিবির পড়বে তাদের। এই পশুচারকরা বন্যপশু ও দস্যুদের সঙ্গে নিয়ত যুদ্ধ করে তাদের সম্পদ রক্ষা করে। অতএব কোনো বিপদ এলে এরা তার সহায় হবে এই আশা ছিল তার।
বাস্তবে দেখা গেল এই পশুপালকরা মানুষ হিসেবে বড়ো ভালো। সরল ও সিধেসাদা মানুষগুলো মাসের পুর মাস নির্জনে থাকবার ফলে মানুষের সঙ্গ পছন্দ করে। সন্ধ্যার মুখমুখ কোনো বন্য ধানের খেতের পাশে তাদের শিবিরে মাণ্ডুপরা সদলবলে উপস্থিত হলে তারা হাসিমুখে স্বাগত জানাত তাদের। সদ্য দোয়ানো দুধ, পোড়ানো গোমাংস আর সুসিদ্ধ বন্যধান্যের মণ্ডের ভোজসভা বসত খোলা আকাশের নীচে। আমহিরির কুশলী রাঁধুনীরা সেই সরল খাবারের স্বাদ কখনো গড়তে পারবে না তাদের পাকশালে।
খাওয়ার শেষে খোলা আকাশের নীচে শুকনো ঘাসের পুরু সুগন্ধী শয্যায় বিশ্রামের পালা। মাথার ওপর ঝুঁকে থাকে তারাভরা আকাশ। চারপাশে আগুনের নিরাপত্তাবলয়। সেই আগুনের ধার ঘেঁষে বসে পশুচারকরা অচেনা সুরে অচেনা ভাষায় গান গায়। সেই সুর শুনতে শুনতে ঘুম নেমে আসত মাণ্ডুপের চোখে। সে ঘুম ভাঙত সকালের শিশির আর প্রথম সূর্যের আলোর ছোঁয়ায়।
বিসারার সঙ্গে বহু দূর দূর দেশে সে গিয়েছে দেহরক্ষী হয়ে। কিন্তু জলপথের সেইসব যাত্রায় দেশ ভ্রমণের এই সুখ সে কখনো পায়নি। জলের বুকেই জাগরণ, যাত্রা, বিশ্রাম। মাটির সঙ্গে সে ভ্রমণের বিশেষ কোনো যোগ থাকত না প্রায়।
প্রায় চারটি দিন ও রাত লেগেছিল তাদের এই বিস্তীর্ণ চারণভূমি পার হতে। এই চারটি দিন এই অঞ্চলের বুকে পশুদের নিয়ে ঘরবসত করা যাযাবর মানুষগুলোর নিবিড় পরিচয় পেয়েছিল মাণ্ডুপ। আলাপ হয়েছিল ঘেরাউন, মাস্তাল বা দিবিয়ার মত যাযাবর-যাযাবরী মানুষদের সঙ্গে। সে জানত না, তার অজান্তে তার নিয়তি তাকে অন্য এক ভবিষ্যতের জন্য গড়ে তুলছেন। এই বিস্তীর্ণ তৃণভূমিতে এই সরল, দুর্ধর্ষ ও স্বাধীনচেতা মানুষগুলোর সঙ্গ, সেই ভবিষ্যতের প্রথম ভিত্তি স্থাপন করছিল।
স্বাধীনচেতা!
কথাটা তাকে প্রথম বলেছিল ঘেরাউন নামের সেই পশুপালক নেতা। দ্বিতীয় রাতে তার শিবিরের আগুনের পাশে বসে একটা তৃপ্তিদায়ক ভোজ খেয়ে মাণ্ডুপ নিজের মনেই অভ্যাসবশত বলে উঠেছিল, “সবই ঈশ্বর দোরাদাবুর কৃপা। তাঁর কৃপাতেই আমাদের এই নিরাপদ খাদ্য ও আশ্রয় মিলেছে। তাঁকে ধন্যবাদ জানাও ঘেরাউন।”
জবাবে ঘেরাউন তার দিকে একটুক্ষণ তাকিয়ে থেকে তারপর নীচু অথচ দৃঢ় গলায় বলেছিল, “তোমরা, নগরবাসীরা ঐ মনরাক্ষসের দাস হতে পারো। কিন্তু আমরা স্বাধীনচেতা পশুপালকরা তাঁর কৃপায় বাঁচি না সেনানী মাণ্ডুপ। আমাদের মাথায় ছাদ দেয় ওই তারাভরা আকাশ, আমাদের খাদ্য দেয় এই মাটি, আমাদের তৃষ্ণার জল দেয় মহান ইন্দা।”
কথাগুলো একটা প্রবল ধাক্কা দিয়েছিল তাকে। ইন্দাতীরের যেকোনো নগরে এহেন ঈশ্বরবিরোধী ভাবনাকে ক্ষমার অযোগ্য পাপ বলে ধরা হয়। দোরাদাবু মঙ্গলময়, তাঁর কৃপায় ইন্দাতীরে মানুষের নগর গড়ে উঠেছে, তাঁরই কৃপায় আজ ইন্দাতীরের বসতিদের শৌর্য, সম্পদ বিশ্বের আর সমস্ত বসতির ঈর্ষার কারণ… তাঁরই কৃপায়…
কিন্তু ভাবতে ভাবতেই হঠাৎ তার খেয়াল হয়েছিল, এই মানুষগুলোর তো সে ঐশ্বর্যের কোনোটাই নেই! ঈশ্বর দোরাদাবুর কোনো দানই তারা নেয়নি। অথচ তা সত্ত্বেও তারা… কী আশ্চর্য সুখে…কেমন করে হয়?
ঘেরাউনের সম্পূর্ণ কথাটার মধ্যে একটাই শব্দের অর্থ সে বোঝেনি। এইবার তাকে সে জিজ্ঞাসা করেছিল, “স্বাধীনচেতা” শব্দটার অর্থ কী?”
জবাবে ঘেরাউন মৃদু হেসে বলেছিল, “অর্থটা বললেও তা তোমার হৃসয়ঙ্গম হবে না নগরবাসী সৈনিক। তবুও বলছি। এর অর্থ হল, আমরা কেবলমাত্র নিজের ইচ্ছার দাস। নিজের ইচ্ছায় আমরা জীবনধারণ করি, মৃত্যুবরণ করি।”
কথাটা নিয়ে মনের ভেতর খানিক নাড়াচাড়া করে মাণ্ডুপ টের পেয়েছিল, ঘেরাউন মিথ্যা বলেনি। জ্ঞান হবার পর থেকে আমহিরি নগরীতে নিজস্ব ইচ্ছার কোনো ভূমিকা সে দেখতে পায়নি কখনো। তার অর্থ সে জানে না। সেখানে, কিংবা মঞ্জাদাহির, কট্টাদিজি, জুর্জাদাহির, নবসার- যত জায়গায় সভ্য মানুষের বাস তার সর্বত্রই মানুষের জীবনের প্রতিটা ধাপ মহান দোরাদাবু বা তাঁর সন্তানগোলকদের ইচ্ছায় চলে। জন্ম, মৃত্যু, বিবাহ, পেশা, এর প্রতিটিই নিয়ন্ত্রিত হয়ে তাঁর ইচ্ছাধীন পুরোহিতদের আদেশে। সেটাই প্রকৃতির নিয়ম। সেটাই স্বাভাবিক। সেটাই ধর্ম।
চারদিনের দিন সকাল হতে উত্তর-পশ্চিমে ঘন সবুজ একটা রেখা চোখে পড়ল। সেদিকে তাকিয়ে সুম্ভ একটু চিন্তিত হয়ে মাথা নেড়ে ইশারায় ডাকলেন মাণ্ডুপকে। সে কাছে আসতে সামান্য শঙ্কিত গলায় বললেন, “আজ সন্ধ্যায় ওই অরণ্যের ছায়ায় আমাদের শিবির পড়বে। যথাসাধ্য দ্রুত চললেও এই অরণ্য পাড় হতে অন্তত পাঁচটি দিন প্রয়োজন হবে আমাদের। এইবার তোমার আসল পরীক্ষা হবে মাণ্ডুপ। এই পাঁচটি দিন নিরাপদে পার করতে পারলে আর ভয় নেই।”
মাণ্ডুপ মাথা নেড়ে আশ্বাস দিল তাঁকে। গত কয়েকদিন ধরেই পশুচারকদের মুখ থেকে এই অরণ্যের কিছু কিছু পরিচয় সে পেয়েছে। দস্যুদের কোনো আক্রমণ হলে ওইখানেই তা হবার সম্ভাবনা। কিন্তু তাতে তার বুকে কোনো ভয় জাগছিল না। নিজের শক্তিতে তার গভীর আস্থা। মাথা নেড়ে সে বলল, “নিশ্চিন্ত থাকুন সুম্ভ। মুন্দিগ্রজয়ী মাণ্ডুপ আপনাকে হতাশ করবে না।”
সারাটা দিন পথ চলবার পর সন্ধ্যার মুখমুখ তাদের দলটা সেই দিগন্তবিস্তৃত অরণ্যের ছায়ায় এসে পৌঁছুল। দুজন সৈনিককে মাণ্ডুপ দ্রুতগামী মহিষের পিঠে আগেই সেদিকে পাঠিয়ে রেখেছিল। গোটা দলটা সেখানে এসে পৌঁছোতে সেই দু’জন এইবার অরণ্যের ছায়া থেকে বের হয়ে এল। রাত্রিবাসের জন্য উপযুক্ত একটা জায়গা তারা খুঁজে পেয়েছে। জায়গাটা নিরাপদ। কাছেই একটা জলধারাও আছে। আশপাশে তাদের সতর্ক অনুসন্ধান কোনো মানুষের উপস্থিতি টের পায়নি।
তাদের অনুসরণ করে পণ্যবাহী গোটা দলটা এইবার সেই আশ্চর্য নিস্তব্ধ বনের গভীরে ঢুকে এল।
শুধু একটাই ভুল করেছিল নগরবাসী দুই সৈনিক। তাদের অভ্যস্ত ও দক্ষ অনুসন্ধানকে তারা সীমাবদ্ধ রেখেছিল আশপাশের পশু চলবার পথে, ঝোপঝাড়ে ও জলধারার উজানভাটিতে। মাথার ওপরে ছেয়ে থাকা বনস্পতিদের উঁচু, পাতাঘেরা এলাকাগুলোকে খুঁজে দেখবার কথা তাদের মাথায় আসেনি। মাটি থেকে এত ওপরে বনস্পতিদের মাথায় যে কোনো মানুষ লুকিয়ে থাকতে পারে এ-কথা তাদের শহরে পালিত মন কল্পনাতেও আনতে পারেনি।
সেখানে, তাদের নজরের আড়ালে, নিঃশব্দে বড়ো বড়ো ডালগুলোকে জড়িয়ে ধরে অতিকায় গিরগিটির মতই অপেক্ষায় থাকা কিছু মানুষ তাই তাদের নজরে আসেনি।
এই নজরদাররা গত দিনগুলো দূর থেকে তাদের এগিয়ে আসাকে চোখে চোখে রেখেছে। রাত্রির গভীরে, চারণভূমির বুকে মাণ্ডুপদের শিবিরগুলো থেকে নিরাপদ দূরত্বে দাঁড়িয়ে, কখনো বা বন্য ধানের খেতের আড়াল নিয়ে শিবিরের কাছে এগিয়ে এসে তারা যাবতীয় সন্ধান নিয়েছে পণ্যবাহী দলটার।
তারা জানত, এই দলটায় বহুমূল্য সম্পদ অনেক আছে। কিন্তু তার মিলিত মূল্যের চেয়েও মূল্যবান একটি সম্পদ চলেছে এদের সঙ্গে। মঞ্জাদাহিরের সেনাপতি বৈক্লন্যর পুত্র! এমন একজন বন্দির জন্য, ইন্দাতীরের এই মনরাক্ষসের নগরদের নাগালের বাইরে থাকা ম্হিরি, মুন্দিগ্র অথবা অন্য যেকোনো নগরীর অধিপতিরা বিপুল মূল্য দিতে তৈরি থাকবেন।
মরুচারী এই অর্ধসভ্য দস্যুরা বুদ্ধিমান। সভ্য নগরীদের পারস্পরিক শত্রুতার সুযোগ তারা নিতে জানে। ম্হিরি নগরীর দানবসেনার হাতে তাদের বহু সহচর বন্দি হয়ে দাসের জীবন কাটাচ্ছে। এর বিনিময়ে তারা তাদের মুক্তি দাবি করতে সক্ষম হবে।
অরণ্যে রাত নামছিল…
ক্রমশ
শীর্ষচিত্র- অতনু দেব। ভেতরের চিত্র- ওঙ্কারনাথ ভট্টাচার্য