সিন্ধুনদীর তীরে –প্রথম পর্ব, দ্বিতীয় পর্ব, তৃতীয় পর্ব, চতুর্থ পর্ব, পঞ্চম পর্ব, ষষ্ঠ পর্ব , সপ্তম পর্ব, অষ্টম পর্ব, নবম পর্ব
নক্ষত্রের ভিড় ক্রমশ পাতলা হয়ে আসছে। চারপাশে ছেয়ে থাকা গভীর শূন্যতার মধ্যে আরো একবার চেতনার আকর্ষীদের বুলিয়ে নিল সে। কয়েক আলোকবর্ষের ভেতরে মাত্রই গুটিচারেক নক্ষত্র এখানে। নক্ষত্র! তার মানেই গ্রহজীব। প্রাণের সম্ভাবনা।
ভাবনাটা আসতে দোরাদাবু-র কঠিন ভূত্বকের তলায় জীবন্ত মাটি ও নুড়িপাথরের শরীর জুড়ে একটা হতাশার কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল। কেন্দ্রিয় কৃষ্ণগহ্বরের গভীর থেকে উঠে আসা, ঈশ্বরের রোষাগ্নির মতই সেই প্রাণঘাতী বিকীরণের ঢেউ নক্ষত্রমণ্ডল জুড়ে ছড়িয়ে থাকা অজস্র প্রাণের একজনকেও ছাড়েনি।
জীবন! চেতনা! একদিন ওই কেন্দ্রিয় কৃষ্ণগহ্বরই তার সৃষ্টি করেছিল এই শ্বেতধারা নক্ষত্রপূঞ্জের বুকে। অতিদূর অতীতে সেখান থেকে উঠে আসা ‘জানুস’ বিকীরণ, শ্বেতধারার অজস্র গ্রহের মাটি ও পাথরে গড়া শরীরকে প্রাণময় করেছিল। তাদের উত্তপ্ত ও তরল কেন্দ্রীয় ম্যাগমার চৌম্বকক্ষেত্রে জাগিয়েছিল চেতনার প্রথম ইশারা। এই নক্ষত্রমণ্ডলে এখনও সর্বত্র সেই জানুস বিকীরণের মৃদু অবশিষ্ট টের পাওয়া যায়। তার দুর্বল ছোঁয়ায় কখনো কখনো মহাজাগতিক ধূলোর কণাদের শরীরে প্রাণের অস্ফূট আভাস জেগে ওঠবার প্রমাণ মেলে।
ব্যতিক্রমী শ্বেতধারা। ব্রহ্মাণ্ড জুড়ে অগুন্তি নক্ষত্রপুঞ্জে পাক খেয়ে চলা কোটি কোটি গ্রহের মধ্যে একমাত্র তার গ্রহরাই চেতনার আশীর্বাদ পেয়েছে। ব্রহ্মাণ্ডে তারা একা। অথচ নিজের সেই দুর্লভ সৃষ্টিকে কত সহজেই না মুছে নিল ওই উন্মাদ কৃষ্ণগহ্বর! একদিন যেমন তার রহস্যময় গভীরতা থেকে উঠে এসে ওই জানুস বিকীরণ অসংখ্য গ্রহকে চেতনাময় করে তুলেছিল, ঠিক তেমনই আর এক দিন আর এক মারণ বিকীরণ সেখান থেকে উঠে এসে মুছে দিয়ে গেল সেই প্রাণের স্পন্দনকে।
বিজ্ঞানীরা এ-বিকীরণের কোনো নাম রাখেননি। রাখবার সময় দেয়নি তা। কৃষ্ণগহ্বর থেকে বের হয়ে এসে অবমহাকাশের সময়হীন পথে প্রায় একই মুহূর্তে তা ছড়িয়ে পড়েছিল গোটা নক্ষত্রপুঞ্জ জুড়ে। কোনো হিংস্রতা ছিল না তাতে। শুধু তার অদৃশ্য মরণকাঠির ছোঁয়া এসে নিভিয়ে দিয়ে গিয়েছিল গ্রহদের উত্তপ্ত কেন্দ্রীয় এলাকায় বহে চলা চেতনার তড়িচ্চুম্বকীয় স্বাক্ষর। অসীম ব্রহ্মাণ্ডের বুকে, ছোট্ট এক নক্ষত্রপূঞ্জে, আকস্মিক ব্যাখ্যাহীন পথে একদিন চেতনার আলোয় জেগে উঠেছিল একদল গ্রহ। নিঃসীম অন্ধকারের বুকে চেতনার সেই তুচ্ছ একটুকরো আলো আবার তেমনই আকস্মিকভাবে নিভে গিয়েছিল।
তবু, চেষ্টা তাকে করতে হবে। ঘরছাড়া হবার পর লম্বা সময় ধরে বিশ হাজার আলোকবর্ষ জুড়ে ছড়িয়ে থাকা প্রাণহীন গ্রহদের সমাধিক্ষেত্র সে পেরিয়ে এসেছে। কেন সে বেঁচে গেল এই সর্বব্যাপী মৃত্যুর ঢেউ থেকে তা সে জানে না। এক এক সময় তার মনে হয়, এ এক অভিশাপ। নিষ্প্রাণ শ্বেতধারার বুকে এক জীবন্ত প্রেত হয়ে অনন্তকাল বেঁচে থাকা। কোন অজানা পাপের শাস্তি সে এভাবে বয়ে চলেছে তা তার জানা নেই।
নাঃ। মৃত্যু কোনো কঠিন ব্যাপার নয়। অজস্র জ্বলন্ত নক্ষত্র তাদের দীপ্তিময় রূপ নিয়ে তাকে ডাকে। একবার, শুধু একবার তাদের আকর্ষণে ধরা দেয়া। তারপর পাক খেতে খেতে তাদের সুবিশাল অগ্নিকুণ্ডে ঝাঁপ দিয়ে পড়া। চেতন অণুপরমাণুগুলো তীব্র উত্তাপের নিঃশাসে গুঁড়ো গুঁড়ো হয়ে ছড়িয়ে যাবে নক্ষত্রের আগুনে! তারপর আর একাকিত্ব নেই। আর অনিঃশেষ ব্যর্থ অনুসন্ধান নেই…
কিন্তু তবু, আত্মহত্যা সে করতে পারেনি। আশা। যন্ত্রণাদায়ী, অসহ্য আশা। যদি কোথাও, শ্বেতধারার কোনো কোণে তার মত আরো একটি গ্রহ… দৈত্যগ্রহ হোক, অথবা তার মত অণুগ্রহ হোক… শুধু আর একটিবার কোনো দ্বিতীয় গ্রহের চেতনার চৌম্বকক্ষেত্র যদি প্রতিধ্বনি তোলে তার তরুণ চেতনায়…
এই একটামাত্র আশা তাকে তাড়িয়ে নিয়ে চলেছে শ্বেতধারার কেন্দ্রীয় অংশ থেকে তার প্রান্তদেশের দিকে। অলস পেঁচানো বৃত্তাকার পথে কেন্দ্রিয় অঞ্চল থেকে শুরু করে একে একে শ্বেতধারার প্রতিটি নক্ষত্রকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে,তাদের কক্ষপথে ঘুরে চলা প্রতিটি গ্রহের শরীর ঘিরে চেতনার চৌম্বকীয় ক্ষেত্রের ব্যর্থ সন্ধান করতে করতে সে পথ চলে।
আর এখন, এই চলাটাই তার অভ্যাস হয়ে দাঁড়িয়েছে একরকম। কেন চলছে তা নিজেই সে ভুলে গেছে বহুকাল। সে শুধু জানে, তার ক্লান্ত, দুঃখী গোলকাকার শরীরটিকে বাঁচিয়ে রাখতে হবে। শুধু জানে, প্রতিটি গ্রহমণ্ডলের সদস্যদের কাছে এগিয়ে গিয়ে ছড়িয়ে দিতে হবে তার চেতনার চুম্বকীয় আকর্ষী। তারপর কোনো প্রত্যুত্তর না পেয়ে ফের ভেসে যেতে হবে পরের মৃতদেহের খোঁজে।
চারটি নক্ষত্র এখানে। তাদের তীব্র আলোকধারার দিকে সন্তর্পণে সে তার আকর্ষীদের বাড়িয়ে ধরছিল একে একে। নক্ষত্রের কাছাকাছি এলাকায় কোনো গ্রহের উপস্থিতি থাকলে তার অভিকর্ষের সামান্য ধাক্কার রেশ ধরা পড়বে সেই আকর্ষীতে…
তৃতীয় নক্ষত্রটিতে এসে প্রথম সাফল্য এলো তার। চারটে গ্রহের উপস্থিতি ধরা পড়েছে এই যুগ্ম নক্ষত্রের কক্ষপথে। সতর্ক হয়ে উঠল দোরাদাবু। তারপর, বিভিন্ন দিক থেকে ধেয়ে আসা নক্ষত্রবাতাসের স্রোতকে সংহত করে তার ধাক্কায় তীব্র গতিতে ধেয়ে গেল সেই জোড়া নক্ষত্রের দিকে…
ব্যর্থতা। সেটাই স্বাভাবিক অবশ্য। গ্রহগুলো নিষ্প্রাণ। তাদের চুম্বকিয় ক্ষেত্র নিতান্তই জড়বস্তুর বিকীরণ। তাতে চেতনার ছোঁয়া নেই কোনো। হতাশ হয়ে এইবার প্রায় চার আলোকবর্ষ দূরের হলদেটে নক্ষত্রটার দিকে মনোযোগ দিল সে। এই শেষ। দুগ্ধধারার একেবারে সীমান্তে এসে পৌঁছেছে সে। এর পরে পরবর্তী নক্ষত্রপুঞ্জ অবধি কেবলই নিঃসীম শূন্যতা।
ন’টি গ্রহ রয়েছে হলদে তারাকে ঘিরে। গ্রহমণ্ডলকে ঘিরে থাকা মহাজাগতিক মেঘমালার ভেতরে এসে তার ছোট্ট দেহটি স্থির হয়ে রইল কিছুক্ষণ। এইবার…
এতকাল পরে, অবশেষে মনস্থির করে নিয়েছে সে। শেষ আশাটুকু মিলিয়ে যাবার আগে নিজেকে ধ্বংস করবে না বলে নিজের কাছেই প্রতিজ্ঞা করেছিল সে একদিন। আজ সেই প্রতিজ্ঞার শেষ ধাপ। গোটা নক্ষত্রপূঞ্জে মৃত্যুর ভয়াল উৎসব শেষ হবার পরে আশায় বুক বেঁধে প্রাণের সন্ধানে যখন সে রওনা হয়েছিল, তখন কোটি কোটি গ্রহ তার অপেক্ষায় ছিল। এইবার সে-সংখ্যা কমে এসে মাত্রই ন’টি অবশিষ্ট রয়েছে আর। সামান্যই কাজ বাকি আছে এবারে। তারপর, নিজের বাসভূমি থেকে বহু দূরে, দুগ্ধধারার এই অজানা নির্জন কোণে জেগে থাকা ওই হলদে তারার দিকে নিঃশব্দে এগিয়ে যাওয়া… আস্তে আস্তে তাকে ঘিরে কঠিন হয়ে উঠবে অভিকর্ষের ফাঁস। তীব্র উত্তাপ এসে তার শরীরকে…
শান্তি। আর কোনো দুঃখ নয়, সব হারাবার যন্ত্রণা নয়। মৃত্যুর উত্তপ্ত নিঃশ্বাসে এইবার…
মেঘমালার আবছায়া এলাকা পেরিয়ে এসে একে একে গ্রহগুলিকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল সে। মৃত। মৃত্যুর নিবিড় শান্তি ছড়িয়ে আছে এই গ্যাস দানবদের দেহ জুড়ে।
আর তারপর… গ্রহমণ্ডলটার মাঝামাঝি এলাকায় এসে হঠাৎ বুকের ভেতর একটা অজানা ভয়ের কাঁপুনি ছড়িয়ে গেল তার। একটা গ্রহের চূর্ণবিচূর্ণ মৃতদেহ! তার শরীরের খণ্ড খণ্ড অঙ্গপ্রত্যঙ্গের দল একটা বলয়ের মত ছেয়ে রয়েছে বিস্তীর্ণ এলাকা জুড়ে!
গ্রহটা দৈত্যশ্রেণীর ছিল। ভেসে চলা পাথরের বড়ো বড়ো টুকরোগুলোর মাঝখানে এসে সেগুলোকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল সে। না। মারণ বিকীরণ আসবার বহু আগেই এ ধ্বংস হয়েছে। এত নৃশংসভাবে কোনো গ্রহের মৃত্যু হতে পারে তা তার কল্পনাতেও ছিল না কখনো। অজ্ঞাত কোনো প্রাকৃতিক ঘটনা? অথবা, অজানা কোনো শক্তিমান শত্রু… অথবা… পরজীবী!?
মহাবিশ্বে পরজীবীদের অস্তিত্বের বিষয়ে পর্যটকদের বহু অনুমিতিই সে শুনেছে এককালে। দুগ্ধধারার কোনো কোনো নির্জন বুনো অঞ্চলে এদের উপস্থিতির চিহ্ন পেয়েছেন বলে কোনো কোনো পর্যটক গ্রহ দাবী করেছেন। তবে নির্দিষ্ট প্রমাণের অভাবে তত্ত্বটা চিরকাল অনুমান হিসেবেই থেকে গিয়েছিল।
তাঁদের মতে, জীবিত বা মৃত গ্রহদের শরীরে অসুখের মতই এদের সংক্রমণ হয়। একবার তা ঘটলে কয়েক কোটি সময়-এককের মধ্যেই সে-গ্রহের ধ্বংস অবধারিত। শুরুতে অজ্ঞান, নিরীহ কিছু জীবকণা হিসেবে তারা জন্মাবে আক্রান্ত গ্রহের জলমণ্ডলে। তারপর দ্রুত বিবর্তিত হয়ে চেতন বুদ্ধিধর পরজীবী হয়ে উঠবে। আক্রান্ত গ্রহের মেদ-মাংস-মজ্জা ছিঁড়ে খেয়ে তাকে কঙ্কালসার করে মৃত্যুর দিকে ঠেলে দেয় এই পরজীবীরা। অনেক সময় জন্মগ্রহকে খাওয়া শেষ করে মহাকাশ পেরিয়ে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে দ্বিতীয় কোনো জীবন্ত গ্রহের শরীরে…
একটা ভয়ের ঢেউ তার কেন্দ্রীয় অঞ্চল থেকে মাথা তুলেই হঠাৎ ফের শান্ত হয়ে গেল। কী লাভ? তেমন কোনো কিছু এখানে থেকে থাকলেও সে তো তাকে তার প্রিয় জিনিসটাই উপহার দেবে। মৃত্যু। তাহলে ভয় কী?
ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা দেহখণ্ডগুলোর এলোমেলো চৌম্বক বিকীরণ একটা জালের মতই গ্রহমণ্ডলটার কেন্দ্রীয় এলাকাকে ঘিরে ছিল। তার ওপারে যে তিনটে অবশিষ্ট গ্রহ রয়ে গেছে তাদের থেকে কোনো চৌম্বক সঙ্কেত আলাদাভাবে টের পাওয়া যায় না এখান থেকে।
সাবধানে তাদের পাশ কাটিয়ে আস্তে আস্তে সে বের হয়ে এল তাদের ভেতরের আকাশে। আর তারপরেই, হঠাৎ একটি গভীর কাঁপুনিতে শিউরে উঠল তার মাটিপাথরে গড়া কঠিন গোলাকার শরীর। চেতনার ছোঁয়া। ক্ষীণ। প্রায় অদৃশ্য, কিন্তু নিশ্চিত।
সম্মুখগতি একেবারে থামিয়ে দিল সে। প্রাণময় চেতনার ছোঁয়া নিঃসন্দেহে। কিন্তু একটু অন্যরকম স্বাদ তার। একে একে সেই মিশ্রিত চেতনা তরঙ্গের প্রত্যেকটা সুতোকে আলাদা ভাবে বিশ্লেষণ করে চলে তার আকর্ষীরা। এবং ততই একইসঙ্গে আনন্দ, হতাশা, ভয় আর উত্তেজনার একটা পাঁচমেশালি আবেগ এসে ছেয়ে ফেলছিল তাকে। সামনে ভাসমান লালরঙের মৃত গ্রহটার ওধারে, আরও ভেতরে ভেসে থাকা নীলরঙা গ্রহটার বুক থেকে ভেসে আসছে সঙ্কেতগুলো।
একটা চকিত ঝাঁপে লাল গ্রহকে পেছনে ফেলে সে নীল জলগ্রহটার কক্ষপথে এসে স্থির হল।
সাবধানে গ্রহটাকে ভালোভাবে পরীক্ষা করল দোরাদাবু। না। গ্রহটা মৃত তাতে সন্দেহ নেই। তার নিজস্ব চৌম্বকক্ষেত্র একেবারেই চেতনাহীন, জড়পদার্থের বিকীরণ। অথচ তার সঙ্গে মিশে থাকা প্রায় অদৃশ্য অন্য কিছু চেতনার তরঙ্গ..
পরজীবী চেতনা! গ্রহটার বুকে আশ্রয় করে… তাই হবে! সে ছাড়া এর আর কোনো ব্যাখ্যা হতে পারে না!
একটা ক্ষীণ কৌতুকের অনুভূতি ছড়িয়ে পড়ল দোরাদাবুর শরীরে। আজ যখন সে সত্যিই এই গল্পকথার পরজীবী চেতনার অস্তিত্ব খুঁজে পেল, তখন সে আবিষ্কারকে ভাগ করে নেবার মত কোনো দ্বিতীয় গ্রহ বেঁচে নেই দুগ্ধধারার বুকে।
কী করবে সে? মৃত্যুকে সে কামনা করেছে বহুকাল। কিন্তু এই মৃত্যু কখনো নয়। নক্ষত্রের পবিত্র উত্তাপে ছাই হয়ে যাওয়ায় তৃপ্তি আছে। কিন্তু পরজীবীর আক্রমণে তিলে তিলে মরা…
কিন্তু তবু, কোথাও একটা গভীর আকর্ষণ কাজ করে তার গভীরে। জীবন। হোক না সে হিংস্র পরজীবী! তবু, চেতনা তো! দীর্ঘকাল ধরে একাকি পথচলায় বড়ো ক্লান্ত সে। গ্রহটার শরীর থেকে উঠে আসা ওই চেতনার সুতোগুলো, সব আতঙ্ককে ছাপিয়ে যেন বন্ধুর মতই ডাক দিচ্ছিল তাকে…
সাবধানে, খুব সাবধানে গ্রহটার আবহমণ্ডলে ঢুকে এল সে। এই দৈত্যাকার গ্রহজীবের মৃতদেহের তুলনায় একটা ধুলোর কণার মতই তুচ্ছ তার শরীর। তার চেতনাহীন মৃতদেহের ওপর দিয়ে ভাসতে ভাসতে তার ভুপৃষ্ঠের দিকে নেমে চলেছিল সে।
বড়ো সুন্দর এই গ্রহজীবের শরীর। দূর থেকে কেবল ঘন নীল দেখালেও, এইবার তার শরীরে হাজারো রঙের চিত্রবিচিত্র নকশা নজরে পড়ে। কোথাও বিস্তীর্ণ জল, কোথাও আকাশছোঁয়া পর্বতের সার, সোনারঙের মরুভূমি…আর তারই মধ্যে…
একটু খুঁটিয়ে দেখে শরীরের ভেতরটা শিউরে উঠল তার। পর্যটকরা সামান্যই জেনেছিলেন। বাস্তবে, পরজীবীর লক্ষ লক্ষ প্রজাতি হয়। ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র আণবিক শরীর থেকে শুরু করে বিশালদেহী… তাদের কেউ নড়াচড়া করে বেড়াচ্ছিল মৃত ভুপৃষ্ঠের জলে স্থলে আকাশে। তবে অধিকাংশই স্থির। এই স্থির প্রজাতির সংখ্যাই বেশি এখানে। তাদের ঘিনঘিনে, অসুস্থ সবুজ রঙের ছোপ মৃতদেহটার অধিকাংশ স্থলভাগ জুড়ে ছেয়ে গেছে। একযোগে তারা সবাই মিলে শুষে নিচ্ছে তাদের মৃত আশ্রয়দাতার প্রাণরস।
তবে এরা বিবর্তনের একেবারেই প্রাথমিক স্তরের রয়েছে এখনও। সাবধানে নিজের চেতনার আকর্ষী বাড়িয়ে তাদের অস্ফূট মনদের ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেখছিল সে। নাঃ। সাড়া নেই কোনো। এরা মূক। শুধুমাত্র বেঁচে থাকবার অন্ধ প্রেরণায় শুষে খায় আশ্রয়দাতা গ্রহের মৃত শরীরকে। তাদের নাগালের বাইরে নীচু, অন্ধকার মেঘস্তরের ঠিক নীচে ভাসতে ভাসতে একটা হতাশা ছড়িয়ে যাচ্ছিল তার মধ্যে। কতকাল পরে, অন্য কোনো চেতনার সঙ্গে কেবল একটু কথাই তো বলতে চেয়েছিল সে। চেতনার পথে একটু ভাবের লেনদেন। হয়তো তারা শত্রু। হয়তো সম্পর্কটা একেবারেই খাদ্যখাদকের। কিন্তু তবু, একটু কথাও যদি তাদের সঙ্গে বলা যেত…কতকাল সে দ্বিতীয় কোনো জীবন্ত অস্তিত্ত্বের সঙ্গে ভাবের লেনদেন করেনি!
দূরে সমুদ্রের বুক থেকে হাওয়ার স্রোত উঠে আসছিল একটা। সে হাওয়ার ধাক্কায় তাকে ঘিরে থাকা মেঘের ঘন আবরণ ছিঁড়েখুঁড়ে উড়ে যাচ্ছে উত্তরদিকে…
মেঘের আড়ালে লুকিয়ে থাকা উপগ্রহটার আলো ছড়িয়ে পড়ছিল তার পায়ের নীচের মাটিতে। একটা নদী। প্রশস্ত, শান্ত জলের ধারা। উপগ্রহের আলো তার ছুটন্ত বুকে চিকচিক করে। দৃশ্যটা বড়ো আগেবমথিত করে তুলছিল তাকে। বিশ হাজার আলোকবর্ষ দূরে যে মাতৃগ্রহের শরীর থেকে তার জন্ম, যাঁর উপগ্রহ হয়ে তাঁকে ঘিরে পরিক্রমাকেই সে প্রলয়ের আগে অবধি জীবন বলে জেনেছে, তিনিও এমনই সুন্দরী ছিলেন। তাঁর বুকেও বয়ে যেত এমনই সুন্দর জলের ধারা…
রূঢ় ধাক্কাটা ঠিক তখনই তাকে সতর্ক করে তুলল। কেউ তাকে দেখেছে! দ্রুত স্পষ্ট হয়ে উঠতে থাকা একটা চেতনার শিখা বিধ্বংসী আগুনের মতই ওই নদীর ধার থেকে উঠে আসছিল তাকে লক্ষ করে। দুর্বল আঘাত, কিন্তু তার মধ্যেই কী তীব্র হিংস্রতার স্পর্শ! গ্রহটার মৃতদেহ থেকে একটা পাথরের টুকরো ছিঁড়ে এনেছে সে। দুহাতে সেটা তুলে ধরে সে ছুঁড়ে মারছে তার দিকে…
চেতন পরজীবী! অবশেষে…
মাটি থেকে তাকে লক্ষ করে আকাশের দিকে ছিটকে আসা পাথরের টুকরোগুলো তাকে ঘিরে এদিক-ওদিক ভেসে যাছিল। টুকরোগুলো তার শরীরের মতই বড়ো একেকটা। সাবধান হল দোরাদাবু। জীবটার চেতনা অনেকটাই উঁচুস্তরের। মানসিক তরঙ্গগুলো তার আকর্ষীদের ছোঁয়া পেয়ে প্রতিক্রিয়া দেখাচ্ছে। অর্থাৎ এর সঙ্গে ভাবের আদান-প্রদান হয়তো সম্ভব হবে। হয়তো…
না। একে ধ্বংস সে করবে না। একটা বিচিত্র ইচ্ছে জেগে উঠছিল তার মনে। নিম্নস্তরের চেতনাযুক্ত অজস্র মহাজাগতিক জীব ছিল দুগ্ধধারার বুকে। অজস্র গ্রহাণু, ধূমকেতু, গ্যাসপিণ্ড। তাদের বশ মানিয়ে নিজেদের কক্ষপথে পালন করা গ্রহজীবদের প্রিয় কাজ ছিল একসময়। তাদের বিনিময় অর্থনীতির মাধ্যম হিসেবেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করত এই পোষ্যেরা।
জীবন বড়ো সুন্দর। বড়ো দুর্লভ। দুগ্ধধারার অস্তমিত সভ্যতার একমাত্র উত্তরসূরী সে, দোরাদাবু। না। নিজের জীবনকে বিসর্জন সে দেবে না। তার মায়ের মত রূপবতী এই গ্রহের মৃত শরীরে, এই চেতন পরজীবীদের পোষ মানিয়ে…
দৃশ্যটার কথা ভাবতে সামান্য কৌতুকের অনুভূতি হচ্ছিল তার। পরিচিত জগতের একেবারে শেষপ্রান্তে, এক হলুদ তারার কক্ষে ঘুরন্ত মৃত গ্রহজীবের বুকে এক পশুপালক… একদল হিংস্র পরজীবীর ঈশ্বর…
তবে, প্রথমে একে আক্রমণ করা থেকে নিরস্ত করতে হবে… আর তারপর…
নিজেকে আর একটু ওপরে তুলে নিয়ে গেল সে। আক্রমণগুলোর নাগালের বাইরে। তুলনায় অনুন্নত এই চেতনাদের চরিত্র সে জানে। তার মাতৃগ্রহের কক্ষে অনেক পোষ্যকেই সে দেখেছে। একটা নির্দিষ্ট দৈর্ঘ্যের চিন্তার আঘাত এদের প্রভুর বাধ্য রাখে। হয়তো এই পরজীবীর ক্ষেত্রেও তা কার্যকরী হবে…
পায়ের বহু নীচে দাঁড়িয়ে আস্ফালন করতে থাকা জন্তুটার দিকে লক্ষ্যস্থির করে নিল সে। তারপর আঘাত হানল…
***
হঠাৎ তীব্র, বিশুদ্ধ ভয়ের একটা স্রোত খেলে গেল মুহিরা-র মেরুদণ্ড বেয়ে। ধারালো একটা যন্ত্রণা হঠাৎ জেগে উঠে যেন ছুরির মতই চিরে ফেলছিল তার মাথাটাকে। আতঙ্কের ধাক্কাটা এতটাই প্রচণ্ড ছিল যে সে, গোষ্ঠীপতি মুহিরা, যে ছুটন্ত বাঘের সামনে পাথরের অস্ত্র হাতে অবিচল দাঁড়িয়ে লড়বার সাহস রাখে, সে-ও কুঁকড়ে গিয়েছিল একেবারে।
শরীরটা গুটিয়ে দু’হাতের মধ্যে মাথাটা চেপে ধরে সে লুটিয়ে পড়ল নদীর ধারের নরম মাটিতে। যে হরিণটাকে অনুসরণ করে সে এইখানে এসে পৌঁছেছিল খানিকক্ষণ আগে, সে এইবার তার উপস্থিতি টের পেয়েছে। কাজলকালো চোখদুটো মেলে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে এসে দাঁড়িয়েছে তার ঠিক পাশে। যেন বুঝতে পেরেছে তার শিকারী এই মুহূর্তে একেবারেই অসহায়।
সেই অবস্থাতেই আকাশের দিকে একবার ঘুরে তাকাল মুহিরা। সেখানে চাঁদের আলোর পটুভূমিতে একটা অন্ধকার বিন্দুর মতই ভাসতে ভাসতে নেমে আসছিল অজানা গোলকটা…
তাদের জীবন বড়ো কঠিন। এই নদী, পাহাড় ও সমতলভূমি যেমন তাদের খাবার জোগায়, তাদের কুঁড়ের মাটি, তার চালের খড় জোগায় অকৃপণ হাতে, ঠিক তেমনই অকৃপণ হাতে মৃত্যু উপহার দেয় সে। সে মৃত্যু আসে নানা চেনা বা অচেনা চেহারা ধরে। কখনো আকাশের আগুন, কখনো ক্ষ্যাপা নদীর স্রোত, কখনো চেনা বা অচেনা কোনো পশু কিংবা অজানা অসুখের চেহারা ধরে হয়ে আসে তা। আর তাই, বেঁচে থাকবার জন্য একটা সরল নীতি নিয়েছে তারা। যা কিছু অচেনা, তা-ই তোমার শত্রু। যদি তা আকারে বড়ো হয় তবে পালাও ও বড়ো দল নিয়ে ফিরে এসে তার মোকাবিলা করো। যদি তা তোমার চাইতে আয়তনে ছোটো হয় তবে তাকে আক্রমণ করে ধ্বংস করো। অনেক সময় তার ফলে ভালো খাদ্যও মিলে যায় শত্রুর শরীর থেকে।
সেই একই নীতি থেকেই সে, হঠাৎ মেঘভাঙা চাঁদের আলোয় মাথার ওপর এসে হাজির হওয়া খুদে গোলকটার দিকে পাথরের চাঁইগুলো ছুঁড়ে দিয়েছিল। জিনিসটা বুদ্ধিমান তাতে সন্দেহ নেই। প্রতিটা আঘাতকে সে এড়িয়ে গেছে অবহেলায়। তারপর তার নাগালের বাইরে উঠে গেছে মৃদুমন্দ গতিতে। আর তারপর, হঠাৎ জিনিসটার প্রতি এই অন্ধ, তীব্র ভয়ের স্রোতটা এসে একেবারে অকেজো করে দিল তার শরীর আর মনকে…
বেশ কিছুটা সময় ওইভাবেই কেটে গেল তার। আস্তে আস্তে ভয়ের ধাক্কাটা কমে এসেছে। একসময় সাবধানে উঠে বসল মুহিরা। খুদে গোলকটা তার থেকে কিছুটা দূরে মাটির ওপর এসে নেমেছে। স্থির হয়ে পড়ে আছে নির্জীবের মত। এইবার…
আস্তে আস্তে মাটিতে পড়ে থাকা তার পাথরের কুঠারটা উঠিয়ে নিয়ে বস্তুটার দিকে এগিয়ে গেল সে। মাটির গোল ড্যালা একটা। কুঠারের একটা আঘাত…হয়তো ওর মাটির আবরণের ভেতরে উষ্ণ রক্তমাংস আছে। সুস্বাদু খাবার…
***
শরীরের একেবারে ওপরে একটা গোলকাকার এলাকায় পরজীবীটার চেতনাকেন্দ্র। তুলতুলে নরম খানিকটা বস্তুর দলা। তার নিজের শরীরের কেন্দ্রে গলিত ম্যাগমার যে ছোটো পিণ্ডটা চেতনার চৌম্বকক্ষেত্রের জন্ম দেয়, এর ক্ষেত্রে এই ঠান্ডা, নরম বস্তুটাও সেই একই কাজ করছে। দোরাদাবু অসীম কৌতূহল নিয়ে সেটার মধ্যে খেলে চলা তড়িৎস্ফুলিঙ্গগুলোকে বিশ্লেষণ করে চলেছিল।
আস্তে আস্তে একটা নির্দিষ্ট নকশায় নিজেকে সাজিয়ে নিচ্ছিল তড়িৎসঙ্কেতগুলো। আদিম, প্রাথমিক তাড়িতিক ভাষা। কোনো অসুবিধা হচ্ছিল না দোরাদাবুর, তাকে বুঝে নিতে… আঘাত করো, ধ্বংস করো, খাও…
বেচারা ঘৃণ্য পরজীবী! দুটো মাত্র প্রেরণা আছে তার জীবনে। মারো, খাও। তবে এর সঙ্গে ভাববিনিময় করা সম্ভব। তড়িৎস্ফুলিঙ্গের নকশাগুলো যে চৌম্বকক্ষেত্র তৈরি করছে তাকে অনুকরণ করে একে পরিচালনা করবার জন্য বিভিন্ন আদেশ তৈরি করা কঠিন হবে না দোরাদাবুর পক্ষে।
বশকারক তরঙ্গের একটা আবরণ নিজের চারধারে ছড়িয়ে দিল সে প্রথমে। জীবটা তাকে আঘাত করবার জন্য পাথর ছুঁড়ছিল কিছুক্ষণ আগে। সে কতটা দূর অবধি তা ছুঁড়তে সক্ষম তার হিসেব করে নিতে তার অসুবিধা হয়নি। তার থেকে খানিক বেশি ব্যাসার্ধ নিয়ে রক্ষাবর্মটাকে ছড়িয়ে দিয়েছে সে। এইবার…
***
সাবধানে, হাতের পাথরের খণ্ডটাকে মাথার ওপরে উঁচিয়ে ধরে পায়ে পায়ে এগিয়ে চলেছিল মুহিরা। স্থির হয়ে আছে তার শিকার। ঝলমলে চাঁদের আলোয় সাক্ষাত মৃত্যুকে এগিয়ে আসতে দেখেও তার বিকার নেই কোনো। সম্ভবত আগে কখনো মানুষ দেখেনি সে। আর সামান্য দূরত্ব। তারপরেই তার পাথরের নাগালে এসে যাবে ওটা। এইবার…
এগিয়ে যাবার জন্য পা তুলে সামনে বাড়িয়ে দিয়েই হঠাৎ স্থির হয়ে গেল মুহিরার শরীর। তার মাথার মধ্যে ফের একবার ঝলসে উঠেছে তীব্র যন্ত্রণাটা। গভীর, অবুঝ আতঙ্কের একটা ঢেউ বন্যার মত ধেয়ে এসে ডুবিয়ে দিতে চাইছিল তাকে।
কিন্তু তবু, হত্যার অন্ধ প্রেরণায় সেই আতঙ্কের বর্মকে ঠেলে সরিয়ে সে পায়ে পায়ে এগিয়ে যেতে চায়। প্রতিটা পদক্ষেপের সঙ্গে সঙ্গেই লাফিয়ে লাফয়ে বেড়ে উঠছিল কষ্টদায়ক অনুভূতিগুলো। তারপর একসময় তার জ্ঞানহীন শরীরটা আছড়ে পড়ল গোলকটা থেকে প্রায় চল্লিশ পা দূরে।
“আর এগিও না মূর্খ। তাহলে মরবে। ওই দূরত্ব থেকে আমার উপাসনা করো…”
মাথার ভেতর ঝনঝন করে বেজে ওঠা কথাগুলোয় কোনো শব্দ ছিল না। হঠাৎ করেই শিকারের ইচ্ছেটা একেবারে মিলিয়ে গেল মুহিরার। ইনি তার শিকার নন। ইনি কোনো আকাশচারী দেবতা। পাপ। মহাপাপ করেছে সে তাঁকে এভাবে আক্রমণ করতে এসে। সসম্ভ্রমে তাঁর থেকে প্রায় পঞ্চাশ পা দূরে হাঁটু গেড়ে বসে পড়ল সে। দেবতার পরের আদেশের অপেক্ষায়।
ক্রমশ
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর