দেশ ও মানুষ– অরণ্যপ্রহরীরা-উমা ভট্টাচার্য

সরেজমিন তদন্ত সেরে রিপোর্ট করছেন সহসম্পাদক উমা ভট্টাচার্য

desh5606 (Medium)জলপাইগুড়ি জেলার আলিপুরদুয়ার ২নং ব্লকের  একটি গ্রাম মাঝেরডাবরি। তিনটি ভাগে বিভক্ত মাঝেরডাবরি গ্রাম-পূর্ব মাঝেরডাবরি,উত্তর মাঝেরডাবরি,আর দক্ষিণ মাঝেরডাবরি।অন্য দুটি খানিকটা শহুরে হলেও দক্ষিণ মাঝেরডাবরি একটি প্রত্যন্ত গ্রাম।সেই গ্রামের একদিকে বনাঞ্চল বক্সা ব্যাঘ্র প্রকল্পের অন্তর্গত।তারই পাশ দিয়ে বয়ে চলেছে ছোট নদী শিখিয়াঝোরা-একটি  বর্ষণপ্লাবিনী নদী।

সারা বছর জল থাকে কম,স্রোতের বহমানতা থাকে কম,জায়গায় জায়গায় দামবদ্ধ জল আগাছায় ভর্তি থাকে। বিরাট আদিগন্ত সবুজ মাঠের মাঝে ইতস্তত ছড়িয়ে থাকা কিছু কাঁচা বাড়িঘর,নারকেল,সুপারি গাছ,ঝোপঝাড় নিয়ে এই গ্রাম প্রতি বছরেই বর্ষাকালে নদীর জল উপচে ঝিলের আকার নিত। জলে প্লাবিত হত বাড়িঘর,চাষের ক্ষেত। গ্রীষ্মে দামবদ্ধ হয়ে আসা নদীতে জল খেতে আসত  বনের হরিণ,হাতি। কখনো কখনো গ্রামেও ঢুকে পড়ত । আয়ের বিকল্প রাস্তা না থাকাতে এলাকার পুরুষেরা নির্দ্বিধায় বন ধ্বংস করত,সেই কাঠ বিক্রি করে আয় করত,তাও পর্যাপ্ত ছিল না। এলাকাবাসীদের আবেদনে বন্যা থেকে বাঁচাতে বনদপ্তর গ্রামের কাছে বাঁধ দিয়ে একটি স্লুইস গেট করে দিয়েছিল আর গ্রামের দিকের নদীর ধার বাঁধিয়ে দিয়েছিল, কিন্তু সেও বেশিদিন টেকেনি।বর্ষার শিখিয়াঝোরার  ভয়ঙ্কর জলস্ফীতিতে প্লাবিত হয় গ্রাম,ভেঙে যায় বাঁধ।

গ্রামের মেয়েদের সবদিক দিয়ে অসুবিধা,ঘরে খাবার না থাকলে, বন্যায় সব ভেসে গেলে,বাচ্চাকাচ্চাদের নিয়ে ভোগান্তির একশেষ। পুরুষদেরও আয় সামান্যই।এই সময় ২০০১ সাল থেকে এলাকার দুই  মাঝবয়সী মানুষ নলিন বর্মন আর সুশীল বর্মণ কাঠের নৌকো নিয়ে ঝিলের পথ বেয়ে চলে যেতেন গভীর বনের দিকে,কিছু সংগ্রহের আশায়।মিলত চালতা,কিছু বুনো কন্দ,ঝিলের মাছ,আর মধুর চাক।মাঝে মাঝে কিছু অ্যাডভেঞ্চারপ্রিয় যুবক  ঘুরতে ঘুরতে সে এলাকায় এলে মাঝিদের সঙ্গে যেত বনের দিকে। বনদপ্তরের নজরে এল ব্যাপারটা। বনদপ্তরের আরও নজরে এল এলাকার মহিলারা নিঃস্বার্থে বনটহল দিচ্ছেন,শুকনো কাঠকুটো সংগ্রহ করে্ন ঠিকই,কিন্তু বনের গাছ কেটে বন ধ্বংস করতে দেন না। ফলে বনের পশুরাও লোকালয়ে ঢুকে আসেনা। কাঠ চুরিও  কম।প্লাবন থেকে গ্রামকে রক্ষা করার জন্য ও নদীর জলে দৈনন্দিনের কাজকর্ম সারবার  জন্য এই মহিলারাই নিজেরা মাটি কেটে ভেঙে যাওয়া বাঁধ তৈরি করতেন প্রতিবছর। 

desh5603 (Medium)মহিলাদের  নিঃস্বার্থে বনরক্ষায় তৎপরতা দেখে তাঁদের সাহায্যে এগিয়ে আসে বনদপ্তর। সেই সময়ে  উত্তরবঙ্গ ট্যুরিজম দপ্তর থেকে একটি ইকো ট্যুরিজম কমিটি গঠিত  হয়,কাছাকাছি কিছু গ্রাম নিয়ে।সেই সময়েই ২০০৩ সালে ‘শিখিয়াঝোরা ইকো ট্যুরিজম  প্রকল্প’ ও মহিলা স্বনির্ভর দল তৈরি হয়। গ্রামের মহিলাদের নিয়ে গঠিত আটটি স্বনির্ভর দল এই সংস্থা পরিচালনা করেন। প্রতি দলের মহিলা সদস্য সংখ্যা দশ জন । প্রকল্পের  মহিলা প্রধান  জানালেন যে,তাঁদের এই দলগুলি হল,দাস স্বনির্ভর দল,অযাচক স্বনির্ভর দল,বীনাপাণি স্বনির্ভর দল, ভগবতী স্বনির্ভর দল,জ্যোতি স্বনির্ভর দল, বনরক্ষা স্বনির্ভর দল, কামারপাড়া  স্বনির্ভর দল প্রভৃতি। এঁরাই এলাকার বনের দেখাশুনা করেন, পিকনিক পার্টিদের পিকনিক করার জন্য বনের নির্দিষ্ট এলাকায় পিকনিক করতে দেন, তারা যাতে বনের বা পশুপাখীদের ক্ষতি না করতে পারে,সেদিকে কড়া নজর রাখেন। পিকনিক করতে বনে প্রবেশমূল্য জনপ্রতি দশ টাকা করে নেন। নদীর জলধারা পেরিয়ে বনে প্রবেশের জন্য  বনদপ্তরের সহযোগিতায় ও তাঁদের আয় থেকে অর্থ  দিয়ে একটি কংক্রিটের চওড়া  বাঁধ  দিয়েছেন তাঁরা।সেই নাতিউচ্চ বাঁধের ওপর বসেই তাঁরা বাসন ধোয়া,কাপড় ধোয়া,স্নান প্রভৃতি নিত্যকর্ম সারেন।

desh5605 (Medium)

এছাড়া তাঁরা ট্যুরিজম দপ্তরের অনুমতিসাপেক্ষে নদীটিকে ব্যবহার করেন। স্বনির্ভর দলের মহিলারা যেহেতু নিঃস্বার্থে,বিনা পারিশ্রমিকে বনটহলের কাজটি একনিষ্ঠভাবে  শুরু করেছিলেন তা দেখে  বনদপ্তর এই মহিলা স্বনির্ভর দলকে বিনা পয়সায় নদীপথটি ব্যবহার করতে দিয়েছে।মহিলা স্বনির্ভর দল আরণ্যক পরিবেশের মধ্যে দিয়ে ট্যুরিস্টদের জলভ্রমণের রোমাঞ্চকর আনন্দের স্বাদ্গ্রহনের সুযোগ করে দেবার জন্য জলধারাটি ব্যবহার করেন। দলের দুই সদস্যা রজবালা বর্মন আর যশোবালা বর্মন ও তাঁদের স্বামী যথাক্রমে সুশীল বর্মন আর নলিন বর্মনই নদীপথে ট্যুরিস্টদের নৌকো চালান। নৌকোটি নৌকো বাইচের একটি পুরনো মোটরচালিত নৌকো।এখন অবশ্য চলে বৈঠা আর লগির সাহায্যে। নৌভ্রমণে যেতে লাগে মাথাপিছু পঞ্চাশ টাকা। গা ছমছমে পরিবেশে দামবদ্ধ জলের মাঝখান দিয়ে নৌকো চলে,হাত দিয়ে ধরা যায় জলের ফুল, জলজ লতা,কচুরি পানার ফুল। ভাসমান জলহাঁস,অসংখ্য জলপিপি আর মাথার ওপর ভনভন শব্দে উড়ে বেড়ানো মৌমাছির ঝাঁক সারাপথের সঙ্গী।কোথাও নদীপথ এত সঙ্কীর্ণ যে নৌকা বাঁক নিতে একজন  মাঝিকে জলে নেমে ঠেলে নৌকো ঘোরাতে হয়।খানিক বাদে বাদে দেখা যায় হাতী,হরিণ প্রভৃতি বন্যপ্রাণীর জল খেতে আসার ঢালু রাস্তা।পাশের জঙ্গলে কখনও কখনও বক্সার জঙ্গলের রিগেল পাইথনেরও দেখা মেলে। এলাকার উন্নয়নে,জায়গাটিকে আকর্ষণীয় ইকো ট্যুরিষ্ট স্পট হিসাবে গড়ে তুলতে এই মহিলা স্বনির্ভর দল সরকারী সহযোগিতার সবটুকুকে প্রাণপাত করে কাজে লাগিয়েছেন।  

desh5602 (Medium)নদীভ্রমণে লেখক নিজে

 

তাঁদের কথা হল গাছ ,বন আর প্রকৃতি আমাদের বাঁচার অবলম্বন, গাছই দেবে জল,বাতাস,অক্সিজেন,রুখবে মাটির ক্ষয়।তাই প্রকৃতি মায়ের এই দানকে সংরক্ষণ করতে হবে।আর সেগুলিকেই করতে হবে জীবিকার অবলম্বন। তাঁদের আয়ের উৎস নৌকার ভাড়া,পিকনিক পার্টির মাথাপিছু টিকিটের দাম।এছাড়া যেসব গাড়ি এখানে আসে সেগুলির পার্কিং ফি। টাটাসুমোর মত মাঝারি গাড়ি,বাস,অটো,বাইকের পার্কিং ফি যথাক্রমে ত্রিশ টাকা,ষাট টাকা,দশ টাকা ও পাঁচ টাকা। এইসব আয়ের সবই টিকিটের মাধ্যমে সংগ্রহ করা  হয়।দলপ্রধানের হাতেই থাকে টিকিট দেবার ও ক্যাশের ভার।মাঝিরা কেউ একটি পয়সাও সরাতে পারেন না।তাঁদের ফাণ্ডের হিসাবরক্ষক আছেন,রীতিমত অডিট হয়। সব ব্যাপারটা এত স্বচ্ছভাবে চলে বলে তাঁরা সরকারী সহযোগিতাও পাচ্ছেন।

বনদপ্তর মাইনে করা বনকর্মী দিয়ে বনসম্পদ রক্ষার যে কাজ এতদিনেও করাতে পারেনি,সে কাজ করছেন মহিলা স্বনির্ভর দল।তাই সরকারের কাছে আবেদন করে তাঁরা মাইক্রোপ্ল্যানের টাকা থেকে পাঁচ লক্ষ টাকা পেয়েছিলেন ২০০৩ সালে,যা দিয়ে তাঁরা কিনেছেন নদীর ধারের পাঁচ বিঘা জলাজমি।desh5604 (Medium)এখন সেটি ভরাট করা হয়েছে।সেখানে গড়ে উঠছে রিসর্ট,রেস্তোরাঁ।জলভ্রমণের জন্য ট্যুরিস্টের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে।তাই মহিলারা এই উদ্যোগ নিয়েছেন।ট্যুরিজম দপ্তরের সহযোগিতায়  এক কোটি পাঁচ লক্ষ টাকা অনুদান মিলেছে এই উদ্যোগ বাস্তবায়নের জন্য।স্থানীয় বি ডি ও অফিস মারফৎ টেণ্ডার ডেকে এই প্রকল্পের নির্মাণ শুরু করেছেন এই স্বনির্ভর গোষ্ঠী। ডি এফ ডির কাছ থেকে প্রতিবছর তাঁরা নতুন অনুমতিপত্র এনে তারপর বন ব্যবহার করেন ও জলপথটি ব্যবহার করেন। কোনও কারচুপি নেই। তাই এতদিনে তাঁরা একটু লাভের মুখ দেখতে শুরু করেছেন। ট্যুরিস্টদের থাকা খাওয়ার জায়গা নির্মাণ হয়ে গেলে তাঁদের আশা তাঁদের এই ইকো ভিলেজ এক সেরা ট্যুরিস্ট স্পট হয়ে উঠবে। প্রকৃতিও বাঁচবে, তাঁরাও মানুষের মত বাঁচবেন।

গ্রামের পুরুষদের তাঁরা এই প্রকল্পের কোনো কাজে বিশ্বাস করে লাগান না। পুরুষদের মধ্যে যাঁদের সামান্য জমি আছে তাঁরা ঋতু অনুযায়ী  ফসলের চাষ করেন, কেউ বা ব্যবসা করেন শহরে। যুবক ছেলেরা প্রায় সবাই বোম্বে, কেরালা, ব্যাঙ্গালুরুতে চলে গেছে বেশি পয়সায় কাজ করার জন্য।

চারদিকে প্রকৃতি ধ্বংসের প্রতিযোগিতার সমাজে মাঝেরডাবরির শিখিয়াঝোরার এই মহিলা স্বনির্ভর দল এক উজ্জ্বল আশার দিগন্ত দেখাচ্ছেন। সেখানে না গেলে জানাই যেত না যে ডুয়ার্সের আশেপাশেই লুকিয়ে আছে এমন এক বেড়ানোর যায়গা আর সেখানে চলছে এক উল্লেখযোগ্য কর্মকাণ্ড। 

আলোকচিত্রঃ লেখক

দেশ ও মানুষ-সমস্ত এপিসোড এই লিংকে একত্রে