বাঁশিওয়ালা
তরুণকুমার সরখেল
খুব বড়ো একটা মাঠ। মাঠের এখানে ওখানে ছোটো ছোটো ঝোপ। আর ঝোপের পাশ দিয়ে আঁকাবাঁকা পায়ে চলা রাস্তা। সেই রাস্তা ধরে অলস পায়ে হেঁটে চলেছে লোকটি। কাঁধে তার লম্বা ঝোলা। হাতে একটা বাঁশি। অভ্যাসমতো বাঁশিতে ফুঁ দিচ্ছে সে। বেশ কিছুদূর গিয়ে লোকটি একটা শিরিষ গাছ দেখতে পেল। গাছের ছায়ায় বসে খানিকক্ষণ জিরিয়ে নিতে কাঁধের ঝোলাটা মাটিতে নামিয়ে রাখল। আর তখনই সে দেখতে পেল ছোট্ট ছেলেটিকে।
গাছের নীচে একটা পলিথিন বিছিয়ে লোকটি বসে পড়ল। তারপর বাঁশিটা পকেটে রেখে ছেলেটিকে কাছে ডাকল।
“এই যে খোকাবাবু, কী নাম তোমার ? একা একা কী করছো এখানে ?”
ছেলেটি কাছে এসে বলল, “আমার নাম ঋক। আমাদের গ্রামেই তো তুমি এইমাত্র খেলা দেখিয়ে এলে। খুব ভালো খেলা দেখাও তুমি। তুমি কি জাদুকর?”
লোকটি এবার ঋককে ডেকে পাশে বসাল। তারপর কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত চালাতে চালাতে বলল, “না খোকাবাবু। আমি জাদুকর নই। জাদুকর হতে গেলে বিদ্যেবুদ্ধি লাগে যে। আমার তো তা নেই। তবে বাঁশি বাজাতে আমার খুব ভালো লাগে। বাঁশি বাজানোর সময় আর কোনদিকে খেয়াল থাকে না। এই যে তুমি এতটা পথ আমার পিছন পিছন চলে এলে, বুঝতেই পারিনি।”
ঋক বলল, “আমার কিন্তু জাদুর খেলা খুব ভালো লাগে। ঐ যে তুমি টাকার খেলাটা দেখালে ওটা আমাকে শিখিয়ে দেবে ? আমিও তাহলে বন্ধুদের খেলাটা দেখিয়ে অবাক করে দিতে পারব।”
“কোন খেলাটা?”
“ঐ যে টুপির মধ্যে এক টাকার একটি কয়েন ফেলে এক মুঠো টাকা তুলে আনলে, ওইটা।
জাদুকর বলল, “সব খেলাগুলোর মধ্যেই হাতের কায়দা থাকে। ওগুলো শিখিয়ে দিলে আর মজা থাকবে না খোকাবাবু।”
ঋক বলল, “একটা খেলা অন্তত শিখিয়ে দাও। তাহলে আমি বন্ধুদের দেখাতে পারব।”
“আচ্ছা আচ্ছা, শিখিয়ে দেব। তার আগে আমি একটু বাঁশি বাজিয়ে নিই। দেখো আমার বাঁশি তোমার খুব ভালো লাগবে। শিরিষ গাছের ছায়ায় বসলে মন ভালো হয়ে যায়। আর মন ভালো হলেই আমার বাঁশি বাজাতে ইচ্ছে করে।”
জাদুকর একমনে বাঁশি বাজাতে লাগল। ঋক চুপটি করে বসে রইল পাশে। এমন সময় দূরে একটা হইচই শোনা গেল। ঋক তাকিয়ে দেখল তাদের গ্রামের লোকজন লাঠি হাতে এদিকেই ছুটে আসছে। জাদুকরের অবশ্য সেদিকে খেয়াল নেই। সে চোখ বন্ধ করে একমনে বাঁশিতে ফুঁ দিয়ে চলেছে।
গ্রামের লোকজন মারমুখী হয়ে অনেকটা কাছে চলে এসেছে। কিছু একটা ঘটতে চলেছে বুঝতে পেরে ঋক জাদুকরকে ডাকল। অবশ্য লোকজনের চিৎকার ততক্ষণে তারও কানে পৌঁছেছে। সে বাঁশি থামিয়ে ঋককে বলল, “খোকাবাবু এবার আমি যাই। এই বলে তড়িঘড়ি ঝোলাটা কাঁধে ফেলে কাঁকুরে মাঠ ধরে ছুটতে শুরু করল।”
(২)
জাদুকরের কী অপরাধ ঋক তা কিছুই বুঝে উঠতে পারল না। লোকজন সব লাঠি উঁচিয়ে জাদুকরের পিছন পিছন গিয়ে ঠিক তাকে ধরে ফেলল। তারপর কিল-চড়-ঘুঁষি মারতে মারতে বলল, “আমাদের গ্রাম থেকে ছেলে ধরে নিয়ে যাস্, এত সাহস। ছেলেধরাদের কী শাস্তি দিই সেটাই এবার দেখাচ্ছি।”
ঋক বুঝল জাদুকরকে এরা ছেলেধরা ভেবেছে। অবশ্য এ জন্য ও নিজেই দায়ী। ঋক যদি একা জাদুকরের পিছনে পিছনে এতদূর না আসত তাহলে কেউ তো জাদুকরকে সন্দেহ করত না। এই ভরদুপুরে একা একা তার চলে আসা মোটেই ঠিক হয়নি। তার জন্যই লোকটা এমনভাবে মার খাচ্ছে।
ঋক ছুটে গেল জাদুকরের কাছে। তবে তার কাছে যেতে পারল না। লোকজন সব ভিড় করে আছে আর সমানে লাথি-ঘুষি চালিয়ে যাচ্ছে। তার কথা কারো কানেই পৌঁছাল না। চোখে জল এল ঋকের। একটু আগেই যে লোকটা গাছের ছায়ায় বসে মিষ্টি সুরে বাঁশি বাজাচ্ছিল সেই এখন মরতে বসেছে।
অনেক চেষ্টায় ভিড়ের মধ্যে ঢুকে লোকটির অনেক কাছাকাছি চলে এল ঋক। দু-একটা কিল থাপ্পড় তাকেও খেতে হল। মাথা ফেটে রক্ত বের হচ্ছে জাদুকরের। সেই রক্ত কাঁচা-পাকা দাড়ি বেয়ে এসে ময়লা আলখাল্লা ভিজিয়ে দিচ্ছে। ঋক সে দৃশ্য আর দেখতে পারল না। ঝাঁপিয়ে পড়ল তার গায়ে। উত্তেজিত গ্রামবাসী তখনো রাগে ফুঁসছে। এরকম ছেলেধরাদের কীভাবে শায়েস্তা করতে হয় তা তাদের জানা আছে।
শিরিষ গাছের নীচে শুইয়ে দেওয়া হয়েছে লোকটিকে। মাথা থেকে এখনো একটু একটু করে রক্ত গড়াচ্ছে। পোশাক ভিজে যাচ্ছে। কাঁধের ঝোলাটা ছিটকে পড়েছে কোনদিকে। ম্যাজিক দেখানোর হাবিজাবি জিনিসপত্র ছড়িয়ে আছে মাঠময়। গ্রাম থেকে আরো লোকজন আসছে। পাশের গ্রাম থেকেও দু-একজন আসতে শুরু করেছে। এরকম একজন ছেলেধরাকে চাক্ষুস দেখতে চায় সকলে।
গ্রামবাসীদের বহু কষ্টে আটকেছে ঋক। লোকটা যে তাকে সঙ্গে নিয়ে আসেনি সে কথা মানতে রাজি নয় কেউ। ভরদুপুরে লোকটা ছোটো ছোটো ছেলেদের উপর জাদুবিদ্যা প্রয়োগ করে। তারপর বাঁশি বাজিয়ে পেছনে পেছনে নিয়ে আসে। একসময় ফাঁকা মাঠে এসে ঝোলায় ভরে ফেলে, এ তাদের জানা কথা। তাছাড়া লোকটাকে বাঁশি বাজাতে বাজাতে আসতেও দেখেছে দু-একজন। তারাই গ্রামে গিয়ে ছেলেধরার খবরটা দেয়।
মাঠ জুড়ে জটলা পাকিয়ে ছেলেধরা বিষয়ে বিস্তর গল্প চলতে লাগল। তারপর একসময় শিরিষ গাছের পাতায় বিকেলের আলো ঝরে পড়ল। ক্লান্ত পাখির দল এসে বসল গাছের ডালে। তাদের কিচির মিচির ডাক শোনা যেতে লাগল। লোকজন সব গ্রামে ফিরে গেল। তারা ঝুড়ি ঝুড়ি উপদেশ দিতে দিতে ঋককেও সঙ্গে নিয়ে গেল। শুধু ফাঁকা মাঠে পড়ে রইল জাদুকর আর ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে যাওয়া তার সাধের বাঁশি।
সূর্য একসময় সব আলো মুছে, শিরিষ গাছের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে নিজের দেশে পাড়ি দিল।
ছবিঃ অংশুমান
তরুণকুমার সরখেল এর সমস্ত লেখা