তাপস মৌলিক
ভালো নাম বাবলি। দাদু ডাকেন ভেবলি। ভ্যাবলাকান্ত থেকে ভেবলি।
আর একটা কারণ আছে। ভেবলির যখন কথা ফুটল, সে মা, বাবা, গাগা এসব কিছুই বলল না। তার মুখে শুধু লি লি। খুশিতে লি লি, খিদে পেলেও লি লি, এমনকি কাঁদলও লি লি করে। দাদু বললেন, “আমার নাতনি বাংলার বিলুপ্তপ্রায় স্বরবর্ণ ৯ কে ফিরিয়ে এনেছে।” নাম দিলেন ভেব৯।
ছেলেকে ডেকে বললেন, “বাসু দেখিস, ওর ভালো নামেও যেন ৯ থাকে।”
বাবা তাই মেয়ের নাম রাখলেন বাব৯। লেখার সময় অবশ্য বাবলি-ই লেখেন। আর মা তো আরও ছোট করে নিয়েছেন, স্রেফ লিলি ডাকেন।
পাঁচ বছর বয়সে মেয়ে একটু একটু কথা বলতে শিখল। টানা একটা বাক্য নয়, কিছু কিছু শব্দ। তবে খুশি হলে, রেগে গেলে বা দুঃখ পেলে তখনও তার মুখে কেবল লি লি।
ছ’বছর বয়সে ভেবলিকে একটা স্পেশাল স্কুলে ভর্তি করা হল।
আসলে ভেবলি একটু অন্যরকম, আর পাঁচটা স্বাভাবিক বাচ্চার মতো নয়। জন্ম থেকেই ওর একটা অসুখ আছে। অসুখটার ইংরিজি নাম ডাউন সিনড্রোম। জিনগত এ অসুখে বাচ্চার শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি সাধারণ বাচ্চাদের থেকে দেরিতে হয়, বড় হয়েও তারা অধিকাংশ সময় মনের দিক থেকে ছেলেমানুষই থেকে যায়। জিনের ভেতর ‘ক্রোমোজোম ২১’ নামের একটা ক্রোমোজোম দুটোর বদলে তিনটে থাকলেই এই বিপত্তি। ব্রিটিশ ডাক্তার জন ল্যাংডন ডাউন-এর নামে অসুখটার নাম হয়েছে ডাউন সিনড্রোম।
অন্যরকম হলেও ভেবলিকে দেখতে খুব মিষ্টি। মোটাসোটা গোলগাল ফরসা চেহারা, নাকটা বোঁচা, কানদুটো ছোট ছোট, হাত-পাগুলোও ছোট ছোট, আর জিভটা বেশ লম্বা। প্রায় সময়েই সে মুখ হাঁ করে থাকে, জিভটা অল্প বার করে রাখে। সর্বদা হাসিখুশি ভেবলি জন্ম থেকেই দাদুর আদরের নাতনি, বাবা-মায়ের চোখের মণি।
ভেবলি অবশ্য ঠাকুর্দা, মানে দাদুর কাছে থাকত না। দাদু-ঠাম্মা থাকতেন গ্রামের বাড়িতে, হুগলীর গুপ্তিপাড়ার কাছে, আর বাবা-মায়ের সঙ্গে ভেবলি ছিল দিল্লির পাশে গাজিয়াবাদে। তার বাবা দিল্লিতে চাকরি করতেন; সিভিল ইঞ্জিনিয়ারিং-এ ডিপ্লোমা পাশ করে একটা নির্মাণ সংস্থায় কাজ পেয়েছিলেন তিনি।
ভেবলি দেরিতে হামাগুড়ি দিতে শিখল, হাঁটতেও শিখল দেরিতে, অনেক দেরিতে আধো আধো কথা বলতে শিখল, তবে তাইতে ওর বাবা-মায়ের কোনও সমস্যা ছিল না। আপনমনে খোশমেজাজে থাকা ভেবলিকে নিয়ে সুখেই ছিলেন তাঁরা।
ঝামেলা শুরু হল ভেবলিকে স্কুলে ভর্তি করার সময়। সাধারণ কোনও স্কুল ভেবলিকে কিছুতেই ভর্তি করতে চাইল না। এই ধরনের বাচ্চাকে ভর্তি করার মত বন্দোবস্ত নাকি তাদের নেই। ভেবলির তো একজন সহকারী লাগবে! তাকে বাথরুমে নিয়ে যেতে হবে, টিফিন খাইয়ে দিতে হবে, ব্যাগ গুছিয়ে দিতে হবে – এরকম স্পেশাল অ্যাটেন্ড্যান্ট সেসব স্কুলে নেই। তাছাড়া, আলাদা করে, মানে ভেবলি যাতে বুঝতে পারে সেরকম করে পড়াশুনো বুঝিয়ে দেওয়ার সময়ও তাদের দিদিমণিদের নেই। কোনও কোনও স্কুল বলল, ভেবলিকে ভর্তি করলে অন্য স্বাভাবিক ছেলেমেয়েদের মা-বাবারা আপত্তি করবেন। ভেবলির বাবা অনেক তর্ক করলেন, সরকারি আইন অনুযায়ী সব স্কুলে প্রতিবন্ধীদের জন্য নির্দিষ্ট কোটা রয়েছে। কিছুতেই কিছু হল না।
শেষমেশ বাড়ি থেকে বেশ কিছুটা দূরে দিল্লির একটা স্পেশাল স্কুলে ভেবলিকে ভর্তি করা হল। মানসিক প্রতিবন্ধী বাচ্চাদের সেখানে বিশেষভাবে পড়ানো হয়, সবসময় দেখাশুনো করার জন্য প্রত্যেক ক্লাসে তিন-চারজন আয়া রয়েছে, পড়ানোর পদ্ধতিও ভেবলির মতো ছেলেমেয়েদের কথা ভেবেই তৈরি। দূরে হলেও স্কুলটার নিজেদের বাস আছে, ভেবলিকে তারা বাড়ি থেকে নিয়ে যাবে, ফের বাড়ি পৌঁছে দেবে। তবে খরচা অনেক, স্কুলের মাইনে প্রচুর। ভেবলির বাবা বিরাট কিছু রোজগার করেন না। তাও আদরের মেয়ের মুখ চেয়ে কষ্টেসৃষ্টে ম্যানেজ করে নিলেন।
প্রথম প্রথম স্কুলে যাবার সময় ভেবলি খুব কাঁদত, মা’কে ছেড়ে যেতে চাইত না। কিছুদিন মা সঙ্গে গেলেন, সারাক্ষণ স্কুলে বসে রইলেন। একটু একটু করে অভ্যেস হয়ে গেল ভেবলির। সে অক্ষর চিনল, পড়তে শিখল, তারপর দু’বছরের মাথায় একদিন ট্যারাব্যাকা করে স্লেটের ওপর নিজের নাম লিখে ফেলল। বাবা-মায়ের আনন্দ আর ধরে না। হবে না? মেয়েকে লেখাপড়া শেখানোর জন্য তাঁরাও তো স্কুলের দেওয়া নির্দেশ মেনে বাড়িতে যতটা সম্ভব করেছেন।
এরপরই হল আসল মুশকিল। ভেবলির বাবার হঠাৎ বদলির নির্দেশ এল, অবিলম্বে যেতে হবে মধ্যপ্রদেশের সাতপুরায়। তাঁর কোম্পানি সাতপুরা তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র সম্প্রসারণের কিছু নির্মাণকাজ পেয়েছে। সেখানে সাইটে থাকতে হবে, তাই ফ্যামিলি নিয়ে যাওয়ার কোনও প্রশ্ন নেই।
ভেবলির মা রুমার মাথায় যেন আকাশ ভেঙে পড়ল। তিনি বাংলার মফস্বল শহরের মেয়ে, সাদামাটা নিরীহ ভালোমানুষ। দিল্লির মতো জায়গায় মেয়েকে নিয়ে একা একা থাকা, ভেবলিকে সামলানো আর রান্নাবান্নার সঙ্গে সঙ্গে বাজারহাট দোকানপাট করা তাঁর পক্ষে সম্ভব নয়। ভেবলি যে স্পেশাল স্কুলে পড়ে সেরকম স্কুল তো সবজায়গায় নেই! কলকাতায় কিছু আছে। সেখানকার কিছু বড়ো বড়ো নামকরা স্কুলে স্বাভাবিক বাচ্চাদের সঙ্গে ভেবলির মতো ছেলেমেয়েদেরও ভর্তি করা যায়, যদিও সে সব স্কুলে খরচা অনেক। কিন্তু কলকাতাতেও রুমার একই সমস্যা। একা একা কোথায় থাকবেন? কী করে থাকবেন? রুমার বাপের বাড়িতেও কেউ নেই। তাঁর বাবা, মানে ভেবলির দাদামশাই মারা গেছেন, বৃদ্ধা মা দিদির কাছে আসানসোলে থাকেন। ভেবলিকে নিয়ে দিদির সংসারে তো আর ওঠা যায় না!
সব শুনে ভেবলির দাদু ছেলেকে ফোনে বললেন, “এতে এত চিন্তার কী আছে? ভেবলি আমার কাছে থাকবে। রুমা আর ভেবলিকে এখানে রেখে যা।”
“কিন্তু বাবা, ভেবলি তো এখানে একটা স্পেশাল স্কুলে পড়ে। সেরকম স্কুল তো ওখানে নেই।”
“ও আমাদের গ্রামের স্কুলেই পড়বে, তুই যেখানে পড়েছিস। এখানকার সবাই আমাদের চেনা। কোনও অসুবিধে হবে না।”
ভেবলির বাবা-মায়ের হাতে বিকল্প কিছু ছিল না। তাই একদিন দুপুরবেলা, ভেবলি আর তার বাবা-মাকে নিয়ে একটা ভ্যান-রিক্সা গ্রামের ছায়াঘন পথ দিয়ে এসে থামল জয়চন্ডীতলায়, তাদের গ্রামের বাড়ির উঠোনের সামনে। মেয়ে আর তার মাকে রেখে বাবা পরদিনই ফিরে গেলেন কাজে।
ভেবলিকে পেয়ে দাদু-ঠাম্মা দারুণ খুশি। ফাঁকা বাড়িতে বুড়ো-বুড়ির নিরালা সংসারে সময় কাটত না তাঁদের। নাতনির সঙ্গে সারাদিন খেলার ফাঁকে ফাঁকে দাদু তো নতুন উদ্যমে তাকে বাংলা শেখাতে শুরু করলেন। তিনি গুপ্তিপাড়া টাউনের এক স্কুলে বাংলার শিক্ষক ছিলেন, অবসরের অনেকদিন পর ফের পড়ানোর সুযোগ পেলেন। দিল্লির স্পেশাল স্কুলে ভেবলি ইংরিজিতে পড়ছিল, গ্রামের স্কুলে ভর্তি হলে তো বাংলায় পড়তে হবে তাকে।
গ্রামের বাড়ির খোলামেলা জায়গা, কৃষ্ণচূড়া ফুলের ঝরা পাপড়িতে রঙিন হয়ে থাকা উঠোন, সবুজ গাছপালার ঠাণ্ডা ছায়া, মাটির দাওয়া, পুকুরের হাঁস এসব দেখে ভেবলিরও আনন্দ আর ধরে না যেন! গাজিয়াবাদে ছোট্ট দু’কামরার ভাড়া ফ্ল্যাটে সে ছিল বন্দী, সামনেই বড়ো রাস্তা, বাইরে বেরোনো মানা। এখানে সে টলমল পায়ে একা একাই উঠোনে দাওয়ায় খেলে বেড়ায়।
হাসি নেই শুধু ভেবলির মায়ের মুখে। মেয়ের পড়াশুনো নিয়ে তার দুশ্চিন্তা। দিল্লির স্কুলে ব্যাপারটা সুন্দর এগোচ্ছিল। হঠাৎ এভাবে সেটা বন্ধ হয়ে যাওয়ায় রুমা মুষড়ে পড়েছেন। দাদু ব্যাপারটা বুঝলেন। একদিন বললেন, “অত চিন্তা কোর না বৌমা। সামনের সপ্তাহেই ভেবলিকে স্কুলে ভর্তি করে দেব, সবে দেড় মাস সেশন শুরু হয়েছে। এখানে তো ওসব স্পেশাল স্কুল-টুল নেই, সবাই সাধারণ স্কুলেই পড়ে। এ পাড়ারই একটি ছেলে আছে, বাসুর চেয়ে বছর দশেকের বড়ো, জন্ম থেকেই বোবা-কালা। সেও গ্রামের প্রাইমারি স্কুলেই পড়েছে, তারপর টাউনে আমার হাই স্কুলে ভর্তি হল। অন্য স্বাভাবিক ছেলেদের সঙ্গেই পড়ত, দিব্যি মাধ্যমিক পাস করে গেল, দু-তিন বছর হয়ত বেশি লেগেছে। এখন সে কালনার বাজারে কাপড়ের দোকান দিয়েছে, বিয়ে-থা করেছে, দিব্যি আছে।”
“কিন্তু বাবা, ভেবলি তো সব কাজ নিজে নিজে পারে না। ওকে খাইয়ে দিতে হয়, বাথরুমে নিয়ে যেতে হয়, চেয়ারে তুলে বসিয়ে দিতে হয়, বইপত্র এদিকওদিক ছড়িয়ে ফেলে। দিল্লির স্কুলে এর জন্য স্পেশাল অ্যাটেন্ড্যান্ট ছিল, তারাই সব করে দিত।”
“ওতে কোনও অসুবিধে হবে না। প্রাইমারি স্কুলের দিদিমণিরা সবাই আমার চেনা, দু’জন এই গ্রামেরই মেয়ে, ওদের বলে দেব। তাছাড়া, দিল্লির স্কুলে ভেবলির সঙ্গে যারা পড়ত তারা সবাই ওরই মতো, সবারই কিছু না কিছু মানসিক প্রতিবন্ধকতা আছে। এখানে ভেবলি স্বাভাবিক বাচ্চাদের সঙ্গে পড়বে, তাদের সঙ্গে খেলবে, এতে ওর মানসিক বিকাশ তাড়াতাড়ি হবে। কালনা শহরের ডাক্তার সুধীরবাবু আমার পরিচিত, তাঁর সঙ্গে আমার কথা হয়েছে, তিনিও তাই বললেন। মাঝে মাঝে এসে তিনি ভেবলিকে দেখেও যাবেন বলেছেন।”
অতএব, ভেবলির যখন প্রায় ন’বছর বয়স, তখন গ্রামের শৈলবালা প্রাথমিক বিদ্যালয়ে তাকে ক্লাস ওয়ানে ভর্তি করে দেওয়া হল। সকালে স্কুল, দাদু সঙ্গে করে নিয়ে গেলেন। ক্লাসটিচার পাড়ার মেয়ে বাণী দিদিমণিকে বলে দিলেন, “বাণী, তুই তো জানিস আমার নাতনিটা একটু ন্যালাক্যাবলা, একটু দেখিস।”
বাণী দিদিমণি ভেবলিকে সঙ্গে নিয়ে ক্লাসে গিয়ে বললেন, “শোনো সবাই, এই দিদিটা আজ থেকে তোমাদের সঙ্গে পড়বে। একে সবাই দেখে দেখে রাখবে তোমরা।”
টিফিনের সময় দাদু আবার এসে নাতনিকে দেখে গেলেন, স্কুল ছুটি হলে সঙ্গে নিয়ে বাড়ি ফিরলেন। উৎকণ্ঠিত রুমা অধীর অপেক্ষায় বাড়ির সামনে রাস্তার ধারে দাঁড়িয়ে ছিলেন, মেয়েকে পেয়েই জড়িয়ে ধরলেন।
প্রতিদিনই দাদু ভেবলিকে স্কুলে পৌঁছে দিয়ে আসেন, টিফিন টাইমে ফের একবার দেখে যান, ছুটির পরে বাড়ি নিয়ে যান।
পাঁচ-ছ’দিন এরকম চলার পর একদিন রুমা দেখলেন, স্কুলের টিফিনের সময় হয়ে গেছে, ওদিকে শ্বশুরমশাই তখনও একমনে খবরের কাগজ পড়ে চলেছেন। তাঁর যেন স্কুলে যাবার কোনও গরজই নেই। এ গাঁয়ের রাস্তাঘাটের সঙ্গে রুমা তেমন সড়গড় নন। নইলে বুড়ো মানুষটাকে রোজ তিনবার স্কুলে না পাঠিয়ে তিনি নিজেও দু’একবার যেতে পারেন। তাছাড়া শ্বশুরমশাই নিজে থেকেই ভেবলিকে দিয়ে আসা নিয়ে আসার দায়িত্ব নিয়েছেন, তাই নিজে যাবার কথা রুমা ভাবেনওনি। একটু ইতস্তত করে বললেন, “বাবা, স্কুলে যাবেন না? টিফিন টাইম হয়ে গেছে কিন্তু।”
দাদু কাগজ থেকে চোখ না সরিয়েই বললেন, “একেবারে ছুটির সময় গিয়ে নিয়ে আসব। তুমি চিন্তা কোর না বৌমা, ভেবলি ঠিক আছে।”
শ্বশুরবাড়িতে রুমা বেশিদিন থাকেননি; তাঁর জড়তা তখনও পুরো কাটেনি। দরজার ফ্রেমে হেলান দিয়ে রাস্তার দিকে চেয়ে আমতা আমতা করে বললেন, “না মানে… মেয়েটা খেলো কিনা ঠিকঠাক…”
দাদু রুমার উদ্বেগটা বুঝলেন। কাগজ রেখে উঠে তাড়াতাড়ি পাজামার ওপর একটা পাঞ্জাবি গলিয়ে নিয়ে বললেন, “চলো যাই দেখেই আসি, তুমিও চলো আমার সঙ্গে, স্কুলটা দেখে আসবে।”
নিচু পাঁচিলঘেরা কম্পাউন্ডের ছোট্ট গেট দিয়ে ঢুকে বাঁদিকে স্কুলের একতলা বিল্ডিং, টানা বারান্দার পেছনে সারি দিয়ে ক্লাসঘর, টিচার্স রুম; ডানদিকে ঘাসে ঢাকা ছোট একটা খেলার মাঠ। মাঠের তিনদিকে পাঁচিলের ধার ঘেঁষে কয়েকটা গাছ, দুটো সুপুরি, একটা কাঠমালতী, একটা বকুল।
দূর থেকেই বাচ্চাদের হৈ-হুল্লোড়, চীৎকার-চ্যাঁচামেচির আওয়াজ কানে আসছিল, বোঝা যাচ্ছিল টিফিন টাইম চলছে। ভেতরে ঢুকে বারান্দায় উঠে ভেবলির দাদু আর মা দেখলেন, মাঠে তুমুল খেলাধুলো চলছে। সব ক্লাসের ছেলেমেয়েরাই মাঠে নেমে পড়েছে, একদিকে এক্কাদোক্কার ঘর কাটা, একদিকে ছোঁয়াছুঁয়ি চলছে, আরেকপাশে লেমম্যান খেলা। কারও কোনওদিকে তাকাবার ফুরসৎ নেই।
কিন্তু ভেবলি কোথায়? আছে, সেও আছে। বারান্দার সামনেই মাঠের একপাশে একটু ছায়ার নিচে দুটো চেয়ার মুখোমুখি রাখা হয়েছে। তার একটায় বারান্দার দিকে পিঠ, মাঠের দিকে মুখ করে বসে আছে ভেবলি। দুটো মেয়ে, ভেবলির থেকে বয়েসে ছোট, হয়ত ওর ক্লাসেই পড়ে, ওর পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। একজন টানটান করে ভেবলির চুল আঁচড়ে দিচ্ছে, আরেকজন বিনুনি বেঁধে দিচ্ছে। ভেবলির সামনের চেয়ারটাতে রাখা আছে ওর টিফিন বাক্সটা, খোলা; আছে জলের বোতলটাও। ঠাম্মা আজ টিফিনে একটু সুজি করে পাঠিয়েছিলেন। ছোঁয়াছুঁয়ি খেলতে খেলতে একেকবার একেকটা মেয়ে ছুট্টে এসে ভেবলিকে এক চামচ করে সুজি খাইয়ে দিচ্ছে, তারপর চেয়ারের পেছনে ঝোলানো একটা কাপড় দিয়ে মুখটা মুছিয়ে দিয়েই একদৌড়ে ফের খেলায় ফিরে যাচ্ছে। মাঝেমধ্যে একসঙ্গে দু’জনও চলে আসছে, একজন সুজি খাইয়ে দেওয়ার পর আরেকজন ওয়াটার বটল থেকে একটু জল খাইয়ে দিচ্ছে। ভেবলির ফ্রকের একজায়গায় অল্প একটু ধুলো লেগে ছিল, হঠাৎ একটা ছোট্ট ছেলে ছুট্টে এল, সামনে দাঁড়িয়ে একটু দেখল ভেবলিকে, তারপর ধুলোটা ঝেড়ে দিয়ে একছুটে ফের খেলতে চলে গেল। ভেবলি মাঠের দিক থেকে চোখ ফেরাচ্ছে না, সারা মুখ হাসিতে খুশিতে ঝলমল করছে তার। চেয়ারে বসে বসে জোরে জোরে পা দোলাচ্ছে সে আর ক্রমাগত হাততালি দিতে দিতে বলে চলেছে, “লি লি লি লি…।”
দাদু ভেবলির মায়ের দিকে ফিরলেন, “কী বৌমা, ঠিক আছে তো?”
মায়ের চোখে তখন আনন্দাশ্রুর বান ডেকেছে, দুই গাল ভেসে যাচ্ছে জলে, উত্তর দেওয়ার অবস্থা নেই।
ছবিঃ সুতপা নাথ