যশোধরা রায়চৌধুরী
আধো অন্ধকার একটা ঘর। কোথাও কেউ নেই। সমস্ত ঘরটাই জানালার বাইরের স্ট্রিটলাইটের চুঁইয়ে আসা আলোয় ভারি ছায়া ছায়া, মায়াময়। খানিক বিভ্রান্তিকরও বটে। অনেকক্ষণ একটানা চেয়ে থাকলে বোঝা যায় টেবিলের ওপর একটা ছোটো পর্দায় আলো কাঁপছে। আরো মন দিয়ে দেখলে বোঝা যায় আলোর সামনে বসে আছে কেউ। একটা মানুষের অবয়ব।
জানালার বাইরে থেকে দেখছিলেন সূর্যশেখর। প্রবল গরমের দাপটে দরদর করে ঘাম হচ্ছে। বন্ধ জানালার বাইরে একটা ছোটো ইট বাঁধানো ধাপ। ওখানে গা সাঁটিয়ে দাঁড়ানো অনেকক্ষণ। কেন না সাহস নেই প্রথমেই দরজা খটখটানোর। বাড়িটার গতিপ্রকৃতি বুঝে নিতে হবে তো আগে! কারা থাকে এখন এ বাড়িতে?
একটু আগেই নিজের ভুল বুঝতে পেরেছেন সূর্য। যে যন্ত্রের কাঁটা ত্রিশ বছর এদিক ওদিক হবার কথা, তা পঞ্চাশ বছর এগিয়ে দিয়েছেন। ১৯৬৫ সালে বসে, সময়যানের কাঁটাকে ঠেলে দিয়েছেন একেবারে ২০১৫ র দিকে! ভাবা যায়। ভাবতেই গায়ে কাঁটা।
চেয়েছিলেন অতীতে যেতে। সাহস পাননি। স্যারও বলেছেন, প্রথমেই এমন কোন বিষয় নিয়ে নাড়াঘাঁটা না করতে, যেটা সম্পূর্ণ অজানা। তবে ভবিষ্যত আর কত অজানা হবে! বড়োজোর কিছুদিন আগেই যেখানে পাঠ সাঙ্গ করে এসেছেন সেই আমেরিকার মত উন্নত হবে ভারত, ত্রিশ বছর পরে।
ক্যালিব্রেশনে ভুল ছিল মনে হয়। কাঁটার দাগ একেবারে ধরে ধরে এগোলেও , ত্রিশ বছর কীভাবে পঞ্চাশ বছর হয়ে গেল কে জানে! ১৯৯৫ এর বদলে এসে গেলেন ২০১৫য়।
প্রথমে বুঝতে পারেননি। যন্ত্রটা ঘটরমটর করে নড়ে উঠে নাগাড়ে পঞ্চাশ মিনিট থরথর করে কেঁপেছে। ঝাপসা কাচের জানালা দিয়ে বাইরে দেখতে পাননি। উনি তখন দক্ষিণ কলকাতায় স্যার শিবাজী রায়ের বাড়ির পেছনদিকে একটা টিন ঢাকা চালাঘরের মধ্যে যন্ত্রের ভেতর ঢুকে বসেছিলেন।
যন্ত্র থেকে বেরিয়ে দেখলেন, খোলা মাঠ একখানা। শিবাজী রায়ের বাড়িটাই নেই। কিছু ভাঙা দরজা জানালা পড়ে আছে।
কী সর্বনাশ।
এদিক ওদিক তাকিয়ে প্রথমেই রাস্তায় পা ফেলে আঁতকে উঠলেন। সাঁ সাঁ করে কয়েকটা গাড়ি বেরিয়ে গেল। একটু আগেই দেখেছেন এক বুড়ো রিকশাওয়ালা বসে বসে ঝিমচ্ছে ঠিক এইখেনেতেই।
তা না হয় হল। সহ্য করে নিলেন। ১৯৯৫তে কলকাতা এতটা পাল্টাতেই পারে। কিন্তু তারপর একটু হাঁটতে হাঁটতেই ধাক্কা খেলেন প্রচন্ড। না সত্যিকার ধাক্কা নয়। মনে ধাক্কা খেলেন।
একটা বিশাল সাইনবোর্ড দেখলেন। যেটা আদৌ বোর্ড নয়। টিনের ওপর রঙ করে করে সাইন লেখার কাজ করছে লোকজন, এটাই সারাজীবন দেখেছেন, মই বেয়ে বা বাঁশ বেঁধে উঠে সে কাজ যারা করে, ছোটো একটা চৌখুপি কাটা কাগজ থেকে দেখে দেখে বিশাল বোর্ডে ঠিক মাপে মাপে স্কেলমাফিক বড়ো করে বসিয়ে দেয় আস্ত একটা মেয়ে বা ঘোড়া বা সিগারেটের প্যাকেটের ছবি, দেখে সাবাশ দিতে হয়।
সেরকম আঁকা নয়, সেরকম বোর্ড নয়। কোন ফ্রেমও নেই সে অর্থে। লোহার বড়ো ফ্রেম । নাঃ এ তো নড়বড়ে একটা বাঁশের ফ্রেম মনে হচ্ছে। অথচ ফোটোগ্রাফের মত সুন্দর ছবি বিশালকায় একটা ক্যানভাস বা কাপড়ের ওপর আঁকা। নাঃ আঁকাও নয়, ছাপা ।
আর তার বিষয়বস্তুই জ্বলজ্বল করছে চোখের সামনে। এটি একটি গানের অনুষ্ঠান।
কিন্তু এ কী বানান লিখেছে এরা? বাংলা ভাষার এত বিবর্তন হয়ে গিয়েছে আগামী ত্রিশ বছরে?
“চিল চিল চিল। সামার চিল। গানের ভেলায় অনুশঠানে সকলের সাদোর আমোন্ত্রন।“
হায় চিল , সোনালি ডানার চিল।
সূর্যশেখরের কলেজ জীবনে পড়া জীবনানন্দের কবিতা মনে পড়ল। আমন্ত্রণের এক্সট্রা ওকার আর মূর্ধণ্য ণ এর অভাব বুকে বাজল। তারপরই মাথাটা ঝঝন করে উঠল। লেখা রয়েছে,
আগামি ৩০ অক্টোবর ২০১৫
শীশুবিকাস মঞ্চে
শপোরিবারে আশুন।
তাহলে ক্যালিব্রেশনে এতটা ভুল ছিল? হায়। কী করবেন ভাবছেন। আবার ফিরে যাবেন নিজ কালে? কিন্তু প্রচন্ড এক লোভের খপ্পরে পড়ে গেলেন সূর্যশেখর।
২
শিবাজী রায়ের বাড়ি থেকে ঢিল ফেলার দূরত্বেই তো তাঁর নিজের বাড়ি। ২০১৫ তে শিবাজী রায়ের বাড়ি মাঠ হয়ে গেছে। তাঁর নিজের বাড়িটাও যদি–
বুকের ভেতরটা অকারণে প্রচন্ড ঢিপ ঢিপ করে উঠল। উফফফ। কী হবে। বাড়িতে দুটো ছোট্ট শিশু , একজনের বয়স ছয় একজনের দুই। ২০১৫ তে নিয়মমত তাদের বয়স হবে ছাপ্পান্ন আর বাহান্ন। উফ্ফ্! ভাবা যায় না।
সাহস করে যাবেন? যদি বাড়িটাই খুঁজে না পান?
কিন্তু সংশয়ের থেকে কৌতূহলেরই জয় হল। এসে প্রথমেই বাড়ির চারপাশ দিয়ে একবার ঘুরে গেলেন। আষ্টেপৃষ্ঠে সবকিছু বন্ধ! এই গরমে … ১৪ টা জানালা বন্ধ! বাড়িটার প্রকৃতিই যেন পালটে গেছে। সবদিক আঁটোসাঁটো। ১৯৬৫ সালের মত খোলামেলা নয়।
শুধু সদর দরজাটা কাঠের, সেই রকম বিবর্ণ। আর সিঁড়িটুকু একই আছে। বড়ো বড়ো কয়েকটা জানালা , জানালায় সবুজ কাচ।
এই বাড়ির সামনে একটা বড়ো ঝাপড়া বুগেনভিলিয়া গাছ আছে। সেই গাছে একইসঙ্গে হলুদ আর গোলাপি দু রকম বুগেনভিলিয়া হয়। ২০১৫ তেও সেই গাছটা থাকবে এ আশা করাই ভুল। তবু চোখ তারেই খুঁজে বেড়ায়। নাঃ, তার বদলে অন্য গাছ চোখে পড়ল বাড়ির সামনেই । দরজার ধারে ছোট্ট মাটির টব থেকে উঠে গেছে। রক্তকরবী।
এই বাড়ির আশপাশের ছোটো ছোটো ঝুপড়ি বস্তিগুলো কোথায় গেল? পাশের ফাঁকা প্লটে গোয়ালারা থাকে। খাটাল একটা।
তাকিয়ে দেখলেন, বড়ো গেট, গেটের ওপারে একটা বিশাল চারতলা বাড়ি। আর বস্তির জায়গায় এখন দুতিনটে দোতলা, একতলা ব্যাঁকাচোরা বাড়ি।
সন্ধে হয়ে আসছে। এই এক বাঁচোয়া। ঢোলা প্লিট দেওয়া প্যান্ট পরা , মাথার চুল ব্যাকব্রাশ করে ব্রাইল ক্রিম লাগানো সূর্যশেখরকে রাস্তার লোক সেভাবে দেখতে পেল না। পেলে পাগলই ভাবত। যেভাবে হাঁ করে তিনি বাড়ির দিকে প্রথমটা তাকালেন!
তারপর গুঁড়ি মেরে এগিয়ে গিয়ে একটা জানালার পাশ ঘেঁষে দাঁড়ালেন।
চোর ভেবে কেউ যে পিটিয়ে দিল না ওঁকে, এ-ও এক বিশাল বাঁচোয়া।
এতবড়ো একজন বিজ্ঞানী এখন নিজের বাড়ির জানালার বাইরে থেকে ভেতরে দেখার চেষ্টায় মগ্ন।
ভেতরে অন্ধকার। বাইরে আধো আলো। সন্ধে নামছে।
গরমে ঘামছেন। অথচ ভেতরে মৃদু গুণগুণ গান গাইছে যেন কোন যন্ত্র।
৩
হায় বিজ্ঞান।
ছোটোবেলা থেকে সূর্যশেখর হতে চেয়েছিলেন একজন বিজ্ঞানী। তাঁর পড়াশুনো তাঁকে দূরদূরান্তে ছুটিয়ে নিয়ে গিয়েছিল। পঞ্চাশ-ষাট দশকে একটা কথা লোকের মুখে মুখে ফেরে। ব্রিলিয়ান্ট স্কলার। সূর্যশেখর হচ্ছেন তাই। বাবামায়ের মুখ উজ্জ্বল করেননি শুধু। বন্ধুবান্ধব, আত্মীয় স্বজন সকলের অগাধ বিস্ময় আর ভালবাসা পেয়েছেন কেবল লেখাপড়া করার সুযোগ পেয়েই।
কোন একভাবে, বোধ করি, তাঁর আদর্শ হল , রনেসাঁসের সময়ে, অর্থাৎ, মধ্যযুগ থেকে আধুনিক যুগে উত্তরণের মাঝামাঝি অবস্থানরত বৈজ্ঞানিক লিওনার্দো দা ভিঞ্চির কমপ্লিট ম্যান। তাঁর এক হাতে পদার্থ বিদ্যা রসায়নের যাদুমন্ত্র। অ্যাস্ট্রোফিজিক্স অন্য পছন্দের বিষয়। অন্য হাতে আছে সাহিত্য। গান । কবিতা পড়তে ভালবাসেন। কবিতা আর বিজ্ঞানের মেলবন্ধন ঘটিয়েছেন সময়যানের চর্চায়।
পড়াশুনো করেছেন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে, ৫০ এর দশকের মাঝামাঝি। ১৯৫০ দশকটা অন্যরকম একটা দশক। চাচা নেহরু পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার মাধ্যমে সদ্য স্বাধীন ভারতের মুক্তি আর স্থায়ী উন্নতির কথা বলছেন, নন অ্যালাইনমেন্ট মুভমেন্টের মাধ্যমে তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলিকে ইস্ট ব্লক ওয়েস্ট ব্লকের বাইরে একটা অন্য মর্যাদায় স্থাপন করছেন। এদিকে একের পর এক নতুন নতুন শিল্প স্থাপন হচ্ছে। নেহরু বলেছিলেন, ইস্পাত শিল্পের বিশাল টাওয়ার, ডোম, এগুলোই ভবিষ্যতের মন্দির।
সেইসব মন্দিরে অনেক সেবাদাস লাগবে, আর অনেক পুরোহিত। ভারতীয় তখন এই দুটোর কোন একটা হবে বলে নিজেকে তৈরি করছে।
সূর্যশেখর নিজেকে পুরোহিতই ভাবেন।
৪
কে যেন নড়ে উঠল। জানালার ভেতর দিয়ে চোখকে খুব স্ট্রেন করে দেখতে হচ্ছে। ওঁরই নাতিপুতি কেউ হবে । সালটা দু হাজার পনেরো। মনে রাখতে হবে। দরজার বাইরে দেখেছেন ছেলে ও মেয়ে দুজনেরই নাম লেখা। অর্থাৎ এ বাড়ি হাত বদল হয়নি। এমনকি পার্টিশনও হয়নি। দেবু আর ফুচি অত নীচে নামেনি। ওঁর ছেলেমেয়ে হয়ে কী করে নামবে? ভারতীয় মহাকাব্য ঘেঁটে বড়ো বড়ো নাম রেখেছেন ওদের। দেবব্রত আর অনসূয়া।
কিন্তু ভেতরে যে বসে আছে সে পঞ্চাশোর্ধ হতেই পারে না। অত্যন্ত ক্ষীণকায়। হাত পায়ের গড়ণ শিশুর মত। অংক করে দেখতে হবে, এ সূর্যশেখরের ছেলের দিকের না মেয়ের দিকের।
১৯৬৫তে সূর্যশেখর ছোট্ট বাচ্চা দুটোকে ফেলে এসেছেন। ইস্কুলে যায় বড়োটা। ছোটোটা গিন্নির নজরদারিতে। আচ্ছা, সময়যানে চাপলে নিজের সঙ্গে দেখা তো হয় না। গিন্নি বেঁচে থাকলে তাঁর সঙ্গে তো দেখা হতেই পারে, তাই না?
দেবেন নাকি বুক ঠুকে কলিং বেল টিপে?
যেই করে থাকুক, সূর্য দেখলেন, প্রাচীণ, পৈত্রিক তাঁর ভাঙাচোরা বাড়ি কেউ একটা সারিয়েছে। ওই জানালায় সাদা কাচের জানালা লাগিয়েছে। যে সরু সরু ধাতব পাতের ওপরে লাগিয়েছে সেটা কি অ্যালুমিনিয়াম? হাঁড়িকুড়ি ছাড়া এমন ব্যবহার কখনো দেখেননি।
আর ওই গুণগুণ গান গাওয়া যন্ত্রটাই কি এয়ারকন্ডিশনার? তাহলে তা ইভলিউশন অর্থাৎ বিবর্তন হয়ে, এক নতুন আজব রূপ ধরেছে। ঘরে না থেকেও ঘর ঠান্ডা করছে। ঐ তো, দেখতেই পাচ্ছেন, বাইরে বসানো আছে। বারান্দায়। কিন্তু ভেতরটা ঠান্ডা হচ্ছে কীভাবে? মেশিনটা গোঁ গোঁ করে চলছে। পাখা ঘুরছে বনবন। কিন্তু ঘরের ভেতরে তো কাচের গায়ে বিন্দু বিন্দু শিশিরজল জমেছে। ফুলহাতা গায়ের সঙ্গে সেঁটে বসা অলিভ রঙ এর জামা পরে আছে মনে হচ্ছে ওই ছায়ামূর্তি। বয়স বড়োজোর আঠারো উনিশ হবে। খুব রোগা, আর অন্ধকারে বসে আছে বলেই, ভাল দেখা যাচ্ছে না।
কিন্তু এটা বোঝা যাচ্ছে যে ও নাগাড়ে, স্থির হয়ে তাকিয়ে আছে ঐ জিনিসটার দিকে। একটা বইয়ের মত ছোট্ট। সাধারণ বইয়ের তুলনায় পাতলা হবে। লাল রঙ এর গীতা বা চন্ডীর মতই আকার আকৃতি। তার মধ্যে হালকা আলো ফুটেছে। অর্থাৎ, বৈজ্ঞানিক সূর্যশেখরের মস্তিষ্ক বুঝল, ওটা কোন স্ক্রিন।
কিন্তু এই স্ক্রিন টিভির মত উত্তল নয়। তাঁর বিদেশ থেকে আমদানি করা কাচের খোলস পরানো গণকযন্ত্রের স্ক্রিনের মতও নয়। চ্যাপ্টা। কেমন যেন প্রাচীন যুগের হায়রোগ্লিফিক লিপিতে লেখা ট্যাবলেটের মত দেখতে। ওভাবেই হাতে নিয়ে আছে। যেমনটা মিশরীয় আঁকাজোঁকায় দেখা যায়!
টিভির উত্তল স্ক্রিনের ভেতর সিনেমা দেখা যায়, যা তিনি আমেরিকায় দেখেছিলেন। সাদা কালো ছবি। তারপর এতগুলো বছরে টিভি নিশ্চয় অনেক পরিবর্তিত হয়েছে। আজ কি ওইটুকু স্ক্রিনে ওই যুবক বা যুবতী টিভিই দেখছে? নাকি অন্যকিছু করছে।
খানিক লক্ষ করে বুঝলেন, শুধু দেখছেই না, ওর হাত নড়ছে। একটা আঙুলের নড়াচড়া দেখা যাচ্ছে । ও কি স্ক্রিনের ওপর হাত বোলাচ্ছে মাঝে মাঝে।
দূর থেকে দেখে সূর্যশেখরের মনে হচ্ছে এক ভৌতিক ব্যক্তি বসে আছে। পবিত্র কোন পাথরের টুকরোয় মারণ উচাটনের মন্ত্রোচ্চারণ করছে।
ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে, সূর্যশেখর কি ভেবেছেন কখনো, যিনি নাকি জীবন থেকে সবরকমের কুসংস্কারকে দূরে সরাতে সচেষ্ট ছিলেন, তাঁরই কপালে এই আছে। তাঁর বংশধরই একদিন নিজের ঘরে বসে তুকতাক করবে!
৫
পাশেই বারান্দার গ্রিল। সূর্য যে খাঁজে পা রেখে দাঁড়িয়ে আছেন, বেশিক্ষণ পারবেন না আর। বোঝাই যাচ্ছে। সরে যেতেই হবে। বারান্দার দিকে যেতে চাইলেন। পা টনটন করছে। পিঠ কনকন করছে।
বারান্দার দিকে আগে পুরোটাই ফাঁকা ছিল। এখন গ্রিল দিয়ে ঘিরে দেওয়া হয়েছে দেখলেন। যেখানে ওই গোঁ গোঁ করা যন্ত্র বসে।
তা ভাল করেছে ওরা। বাড়ির পেছনে একটু মনোযোগ যে দিয়েছে এই অনেক। কিন্তু গ্রিল থাকায় উনি তো বারান্দা দিয়ে বাড়িতে ঢুকতে পারবেন না।
সবার চক্ষুর অন্তরালে বাড়িতে ঢোকার শেষ চেষ্টাও ব্যর্থ তবে! অন্ধকারের আড়াল নিয়ে এভাবে ঘরে যাওয়ার চেষ্টা বোধ হয় সফল হবে না।
ঘুরে দরজায় গিয়ে, ঘন্টি বাজাতেই হবে। ওদের প্রশ্নের মুখোমুখি হতে হবে।
নাঃ সূর্যর কপাল ভালই। বারান্দার গ্রিলে একটা একটা জানালার মত পাল্লা করা আছে। সেই পাল্লা দিয়ে ঢুকে যেতে পারবেন মনে হয়। ঠিক পারবেন।
টুক করে ঢুকে পড়লেন সূর্য। আরে, নিজের বাড়ি তো। আজ সকালেও, ১৯৬৫ সালের ২৮ এপ্রিল, ওই বাড়ির বারান্দায় দাঁড়িয়েই চা খেতে খেতে খবরকাগজ পড়ছিলেন।
এত্তো ইয়ার্কি! নাঃ।
বারান্দার দিকের দরজাটা ঠেলতেই খুলে গেল। আঃ। বাড়ির ভেতরটা!
আজ সকালেও গরমে প্রাণ ওষ্ঠাগত হয়েছিল। এখন একেবারে ঠান্ডা। চিলড ।
ওহহহহ। এতক্ষণে বোধগম্য হল, একটু আগে দেখা ওই সাইনবোর্ড টার অর্থ । ওটা পাখি চিল নয় । ঈগলের ভায়রাভাই। নাঃ ওটা গরমের থেকে মুক্তির চিল। সি এইচ আই এল এল!
ইংরিজি শব্দ বাংলা অক্ষরে, এ আবার কেমনধারা ব্যাপার? হ্যাঁ তিনিও লেখেন বটে। ওই যে, চেয়ার টেবিল এইসব। একটু খটমটো হলেও তো রোমান অক্ষরের শরণ নেন। বাংলা কথার সঙ্গে মিলিয়ে মিশিয়ে এইভাবে ইংরিজি কথা, নাঃ মনে হয় এটা ত্রিশ বছরে , থুড়ি, পঞ্চাশ বছরে ঘটেছে।
করিডোর ধরে ধরে বছর পঞ্চাশ আগেকার বাড়ির হিরের টুকরো ছেলেটি, পা টিপে টিপে হাঁটছেন। সাদা ধবধবে মাখনের মত রঙ করা করিডোরে, অনেক ছোটোবড়ো জিনিস রাখা। কোনটাই কাজের কিছু না। বইয়ের র্যাকে বইয়ের চেয়ে সাজানোর জিনিশ বেশি। ফুলের টবে নকল গাছ। এসব দেখলে হোটেল হোটেল লাগে। ছাতের থেকে ম্লান আলোর গোল গোল ল্যাম্প ঝুলছে। এগুলোও অদ্ভুত , অচেনা। গোল কাচের ডুমের মত আলোগুলো হাপিশ!
ঘরগুলোর দরজা আঁটা, কিন্তু হয়ত বা ভেতর থেকে খিল দেওয়া নয়। উফফফ। কী উত্তেজনা হচ্ছে! যে ঘরটার জানালা দিয়ে আড়ি পাতছিলেন সেই ঘরেই ঢুকে পড়বেন নাকি, বুক ঠুকে?
হঠাৎ পাশের দিকের একটা দরজা খুলে বেরিয়ে এল একটি যুবক। বয়স পঁয়ত্রিশের বেশি হবে কি? গায়ে রঙিন গেঞ্জি আর হাফপ্যান্ট। তাঁর কৈশোর কালে খাকি প্যান্ট পরতেন, সেরকমই দৈর্ঘ্য বটে, কিন্তু রঙিন, চক্রাবক্রা প্রিন্ট দেওয়া।
কিন্তু এ কে? এ যে ভীষণ চেনা! বুকের মধ্যে ধড়াশ করে উঠল। তারপরেই বুঝতে পারলেন সূর্যশেখর। এই চেহারা তো তিনি রোজ দুবেলা আয়নায় দেখেন!
পুরুষটিকে গটগট করে হেঁটে যেতে দেখে, একটা পর্দার পাশে সিঁটিয়ে দাঁড়িয়ে পড়লেন নিজেই। এই কি তবে দেবব্রত? উফফফ। কিন্তু হিসেবমত তার বয়স তো এখন পঞ্চাশোর্ধ! সব হিসেব গুলিয়ে যাচ্ছে কেন? যদি এটা ২০১৫ হয়…
তবে কি ভারতের মানুষ আয়ুবৃদ্ধিকে জয় করার কোন ওষুধ শেষমেশ আবিষ্কার করে ফেলেছে?
একটা দরজা ঠেলে যেটা তাঁদের খাবার ঘর সেঘরেই ঢুকে গেছিল যুবকটি। থুড়ি, দেবব্রত। বেরিয়ে এল হাতে একটা টিনের ক্যান নিয়ে। এরকম টিনের ক্যানে স্যুপ থাকে। এটা কী?
টিনের ক্যানের মাথাটা হ্যাঁচকা মেরে খুলে ফেলে ঢকঢক গলায় ঢালল সে।
আর তখনই, অসম্ভবটা সম্ভব হল।
ছাপ্পান্ন বছরের দেবব্রতর সামনে সশরীরে হাজির হলেন তার পঁয়তাল্লিশ বছর বয়সী পিতৃদেব!
৬
আঁতকে উঠল দেবব্রত।
এক ক্যান চিলড বিয়ার আগেই পেটস্থ হয়েছে। এখন নতুন এক ক্যান খুলেছে! এরই ভেতরে এত নেশা হয়ে গেল?
নিজেকে দেখছে কেন সামনে? হ্যাঁ, গিন্নি বসুন্ধরা করিডোরে জুতোর র্যাকের ওপরে একটা কেতার আয়না রেখেছিল বটে, কিন্তু দেবব্রত তো সেটাকে সরিয়ে দিতে বলেছিল। আবার এসে হাজির হল নাকি?
কিন্তু এক শতাংশ অফ এক মুহূর্তের মধ্যে চটকা ভাঙল। এটা তার রিফ্লেকশন হবে কী করে?
এই মূর্তি যতই তার মত দেখতে হোক না কেন, এ তো প্যান্টুলুন পরা এক কিম্ভূত মূর্তি। বেশ কমসবয়সি কিন্তু চেহারায় একটা বুড়োটে ভারিক্কে ভাব। যেন পুরনো বাংলা সিনেমা থেকে উঠে আসা লোক। কেমন যেন চেনা চেনা!
চোখ কচলে তাকাল দেবব্রত। ও ঘরে বসুন্ধরা সান্ধ্য বৈঠক করছে, ওর কিটিপার্টি না স্কুল ফ্রেন্ডসদের ওয়াটস্যাপ গ্রুপের জিটি আছে বোধ হয়। এদিকে রিম্পাই নিজের ঘরে থুড়ি নিজের বুদবুদে আছে। কে কখন এই বিচিত্র ভদ্রলোকটিকে দরজা খুলে দিল জানা নেই।
“আ-আপনি????” কিছুটা ফ্রেন্ডলি অনেকটা থতমত গলায় বলল দেবব্রত।
“আমি, আমি হলাম… গলা ঝেড়ে নিয়ে , বললেন সূর্যশেখর। আমি তোমার পিতৃদেব , দেবব্রত! তুমিই দেবব্রত , আশা করি?”
৭
ঠাশ্ ধপাস্ একটা আওয়াজ পেয়েছিল বসুন্ধরা। ডাইনিং রুমে বারো ঘন্টার আয়া মালতী কিছু ফেলেছে ভেবে আর ওদিকে যায়নি। এদিকে পরনিন্দা পরচর্চা চলছিল কিনা। সঙ্গে ক্রিস্পি চিলি বেবিকর্ন। বাড়িতে এরকম রেস্তোরাঁর মত কী করে বানাল বসু, তা নিয়ে সব্বাই চুলচেরা বিশ্লেষণে ব্যস্ত ছিল।
কেউ খেয়াল করল না।
সূর্যশেখর বিশালবপু পুত্রটিকে টানতে টানতে কোনমতে তাঁর ১৯৬৫ র শোবার ঘরে এনে তুললেন। পুব-দক্ষিণের এই ঘরটিই যে এখনো দেবব্রতদের ঘর, অর্থাৎ মাস্টার বেডরুম তা নিঃসন্দেহে তাঁর কাছে প্রতিভাত হয়েছিল। ঠিক যেমন, সবচেয়ে নিঃশব্দ ও নিরিবিলিও মনে হয়েছিল গৃহের ওই কোণটিকে।
সে ঘরে দেবব্রতকে এনে, মেঝেতেই ফেলে রেখে, তিনি জল খুঁজলেন। পেলেনও। রঙিন প্লাস্টিকের বোতলে বিছানার ধারেই গড়াচ্ছে একটি। কাচের বোতল আর নেই। ভ্যানিশ! জল বার করে চোখে মুখে ছিটোলেন নিজের পয়ঁত্রিশ বছরের মত টানটান দেখতে ছাপ্পান্ন বছরের পুত্রের। ঘরে ঠান্ডামৃদু হাওয়া আছে। যথেষ্ট সুখকর। আশপাশে তাকিয়ে বাহারি পর্দা দেখলেন। দ্রুত হাতে আবার জল ছিটোতে যেতেই, একাদিক্রমে কয়েকটি ব্যাপার ঘটল।
ছেলে জেগে উঠে বলল, “বাবা!” মুখ চোখ ভেবলু। একেবারে হতভম্ব।
ইতিমধ্যে ঘরে দরজা ঠেলে সন্তর্পণে প্রবেশ করল অন্য ঘরের ওই ফুল হাতা জামা পরা বাসিন্দাটি , হাতে সেই যন্ত্র। যা উত্তল অবতল নয় একেবারে ফ্ল্যাট। ছোট্ট। বড়োজোর ন ইঞ্চি বাই এগারো ইঞ্চি।
বাসিন্দাটি একটি কন্যাসন্তান। চকচকে চোখে চশমা। মুখে কৈশোরের সারল্য মুছে খানিকটা সর্বজ্ঞ আত্মপ্রত্যয়ী ভাব এসেছে। (এ’সব ভাষা সাহিত্যপ্রেমী সূর্যশেখরের মাথায় স্বয়ংক্রিয়ভাবেই আসে) সে নিজের বাবার দিকে, এবং হুবহু বাবার মত দেখতে এই অচেনা ভদ্দরলোকের দিকে তাকাল, মেপে নিল তার বাবার মতই দেখতে এবং বাবার মতই তরুণ, ঝলমলে, টানটান এই মধ্যবয়সী যুবককে এবং বাবার কুম্ভমেলায় হারিয়ে যাওয়া যমজ ভাই ভেবে ফেলে, সঙ্গে সঙ্গেই প্রায় বলল, “হাই!!!”
আত্মপ্রত্যয়ের জায়গায় এখন এসে হাজির হয়েছে একটি আনন্দ , মজা আর অবাক হবার অভিব্যক্তি। তার পেছনে পেছনেই ঢুকলেন এক স্থূলাকৃতি সুন্দরী। কিশোরী মেয়েটির মত করে দরজা সন্তর্পণে না খুলে ঘটাং করেই ঢুকলেন, এবং “কী গো, বেবিকর্ন চাইছিলে না? এ কীঈঈঈঈঈঈঈ, এটা কে এ এ এ ?”
একটানে অনেকটা কথা বলে , চক্ষু বর্তুল করে তিনি তাকিয়ে রইলেন সূর্যশেখরের দিকে। সূর্যশেখর মেঝে ছেড়ে ততক্ষণে উঠে পড়েছেন , টান টান হয়ে দাঁড়িয়েছেন পিঠ ঝাড়া দিয়ে। এবং অবশ্যই মহিলার চোখ চড়কগাছে উঠে গেল এই সুদর্শন সৌম্যকান্তি চশমাপরা প্যান্ট শার্ট শোভিত যুবকটিকে দেখে, যে নাকি তার বার্মুডা টি শার্ট পরা স্বামীর একজ্যাক্ট প্রোটোটাইপ বললেও কম বলা হয়।
ম্যাট ফিনিশের আইভরি রঙ এর টাইলসের মেঝেতে শায়িত স্বামীর মুখের ফ্যালফেলে ভাবটি দেখে নিজেই কোনমতে তাকে হাত ধরে উঠিয়ে বসালেন স্থূলাঙ্গিনী। নিজেই নিচু হতে কষ্ট হয় তার, স্বামীরও মেঝে থেকে উঠতে বেশ কষ্ট হল। মাথায় একটা আলুও হয়ে গিয়েছে করিডোরে পড়ে গিয়ে। নিজের অজ্ঞাতেই প্রায় রিফ্লেক্স বশত ঠান্ডা বিয়ার ক্যানটা মাথায় ঠেকিয়ে সেটার ব্যবস্থা করতে শুরু করল দেবব্রত। মেয়ে এবং বউয়ের সামনে কেমন ক্যাবলার মত বাবার দিকে তাকিয়ে বলল, “না না , এটা তো বাবা!”
“বাবা?????” সমস্বরে মেয়ে ও বউ চীৎকার করে উঠল।
তারপরেই বর্তুল চক্ষু বিঘুর্ণিত করে বৌমা শ্বশুরের আইডেন্টিটি সম্পর্কে সংশয় প্রকাশ করলেন। “কী বলছটা কী তুমি? এটা কি সায়েন্স ফিকশনের গল্পো নাকি! যা তা বললেই হল? কে না কে এসে গেছে বাড়ির মধ্যে, হ্যাঁ, তা মশাই, আপনি কখন কীভাবে বাড়িতে ঢুকলেন বলুন ত?”
প্র্যাক্টিকাল গৃহিণী হিসেবে খুব কনফিডেন্স আছে বসুন্ধরার। গলা খাটো করে, তখনো বিস্ময়াহত, নড়বড়ে কর্তার কানের কাছে বললেন, “বাবা, বাবা , কী বলছটা কী তুমি! তোমার বাবা কি সুভাষচন্দ্র, যে একশো বছর পরে নিখোঁজ বাবা হঠাৎ ফিরে আসবেন। মামদোবাজি?”
“না না না, একশো বছরের বাবা কেন হবে। ১৯৬৫ র বাবা… উফফ , আমি জানি না কী করে সম্ভব।”
“এই রিম্পাই, পুলিশকে একটা ফোন কর তো ! ইমপার্সোনেশনের কেস।”
ভয় খেয়েছেন ইতিমধ্যেই সূর্যশেখর। ছ্যাঁক করে উঠল মনের মধ্যেটা পুলিশের কথায়। এসব সম্ভাবনার কথা আগে ভাবেন নি কেন? ঘরের চারিদিকে চোখ মেলে দেখলেন। নাঃ কোণের দিকে যে কালো কোলাব্যাঙ এর মত দেখতে টেলিফোন যন্ত্রটা ছিল সেটাকে দেখতেই পেলেন না। পুলিশকে ফোন করা বোধ হয় এ যাত্রায় এদের হল না। নাকি, ফোনটা অন্য কোন ঘরে আছে?
অনেক কিছুরই কোন উত্তর পাচ্ছেন না, যেমন এখুনি ছেলে বলল উত্তরাঞ্চলের গন্ডগ্রামে উনি হারিয়ে গেসলেন। উত্তরাঞ্চলটা আবার কী? উত্তরপ্রদেশের কুমায়ুনে, হ্যাঁ। শিবাজীদা ওটা টপ সিক্রেট রাখতেই চান তো ।
আপাতত ত কলকাতা থেকে সময়যানে চড়া হয়েছে। কিন্তু এখন যে ওই কচি মেয়েটি সেই চ্যাপ্টা ছোটো বইজাতীয় বস্তুটিকে হাতে নিয়ে কী সব খুটখাট করছে চিন্তিত মুখে, তার কী ?
মেয়েটা কিন্তু শুরুতে ওঁর দিকে তাকিয়ে বেশ খুশি হয়ে হেসেছিল।
এখন মায়ের কথা শুনে ঘাবড়ে গেছে।
ঐ তো,ছোটো যন্ত্রটা এখন ওর কানে উঠেছে। হ্যালো হ্যালো বলছে।
নাঃ পুলিশ আসার আগেই যা হয় কিছু একটা করতে হবে।
ঝাঁপিয়ে পড়লেন সূর্যশেখর, “শোনো শোনো শোনো। দেবব্রত ঠিকই বলছে। আসলে আমি সত্যিই সূর্যশেখর। সত্যিই টাইম ট্র্যাভেল করে এসেছি এখানে। বিশ্বাস কর।”
কান থেকে যন্ত্র নামিয়েছে নাতনি। বৌমাও তাকিয়ে আছে হাঁ করে। তারপর বলেছে, “আপনি, আপনি সত্যি আমাদের বাবা? কী করে বুঝব? মায়ের নামটা বলুন তো!”
“সর্বাণী।”
“আপনাদের আদি দেশ কোথায় বলুন তো?”
“ময়মনসিংহ।”
“এই বাড়ি কবে কিনেছিলেন?”
“আমি কিনিনি, আমার বাবা কিনেছিলেন, জনৈক কস্তূরচাঁদ নাগরমলের কাছে।”
“যাকগে যাক। আপনি যদি সত্যিই বাবা হন, হ্যাঁ, বাবার মতই তো দেখতেও আপনাকে, তাহলে ছেলের নামটা খামখা দেবব্রত রাখলেন কেন বলুন তো? আর কোন আধুনিক নাম পেলেন না?”
এতক্ষণে দেবব্রতর চোখ চকচক করে উঠেছে। বাবা যে বাবা-ই, সে প্রমাণ গিন্নিকে দিতে পেরে। বাবা, “তুমি কোথায় আছ আজকাল বাবা? উত্তরাঞ্চলেই?”
“আরে, উত্তরাঞ্চল কেন হতে যাবে বোকা, উত্তরপ্রদেশ তো। না না আমি গাড়োয়াল হিমালয়ে এক দু’বার গেছি মাত্র। ওখানে সেটল করার তো কোন প্ল্যান নেই। আর, আপাতত তো আমি কলকাতাতেই আছি। আজ সকালেই এই তো, মোড়ের শ্রীকৃষ্ণর দোকানের কচুরি তরকারি আর জিলিপি খেয়েছি। যতই বলা হোক ডালডা চর্বিতে ভাজা, খেতে বড্ড ভাল্লাগে রে। তোরা খাস?”
“ না না, শ্রীকৃষ্ণের খাবার বড্ড আনহেলদি। ডিপফ্রাইড কিচ্ছু খাইনা। বলে, বোকা বোকা মুখে মাথা দুপাশে নেড়ে নেড়ে, ধপাস করে খাটে বসে পড়েছে ছেলে, ছেলের বউ।”
নাতনিও খাটের পাশে দাঁড়িয়ে দাদুর পরিচয় কনফার্মড হতেই, মিটিমিটি হাসতে হাসতেই দ্রুত খ্যাচাক খিচিক আওয়াজ করছে। দাদুর দিকে তাক করে। তার ওই ছোট্ট হস্তধৃত মুকুরের মত জিনিসটি দিয়ে। ও জিনিস দিয়ে ফোনও করা যায়, টিভিও দেখা যায়, লেখাও পড়া যায়, ছবিও তোলা যায়? আগফা ক্যামেরাটার চামড়ার বেল্ট, মোটা গোল ভিউফাইন্ডার এর কথাটা ভেবে বিজ্ঞানের অগ্রগতিটা আরেকবার মাপতে চেষ্টা করলেন সূর্যশেখর।
৮
একটাই প্রশ্ন সূর্য শেখরের মাথায় এখন ঘুরছে।
ভবিষ্যতে এলে কি নিজের সঙ্গে নিজের দেখা হবে?
কেউ কেউ বলেছে, হয়। সময় পেরিয়ে এলে যেমনকার তেমন সব দেখা গেলে, বয়স্ক নিজেকেও দেখা যাবে তো!
কেউ কেউ বলেছে, হয় না। যে শরীর নিয়ে তুমি আছ, সে শরীরের ভবিষ্যত তুমি দেখ কীভাবে। এর ভেতরে একটা লজিকাল ফ্যালাসি আছে !
এদিক ওদিক তাকাচ্ছিলেন সূর্যশেখর। কোন ঘরে নিজেকে পাবেন , বা চেঁচামেচি শুনে উঠে আসবেন তাঁর একটি বৃদ্ধ ভার্শান।
এল না কেউ। আবার কোথাও তাঁর কোন ছবিও নেই, যা বলে দেবে , তিনি ইতিমধ্যেই মৃত। ছবিতে ফুলের মালা টাঙানো থাকবে, ঝুল লাগা কাগজের মালা।
ইশ।
উদ্বেগে ছাতি ফেটে যাচ্ছিল সূর্য শেখরের।
শেষমেশ বলেই ফেললেন, কথাটা।
“আমি, আমি কোথায় রে?”
“তুমি … তুমি … জানি তুমি টাইম ট্র্যাভেল নিয়ে কাজ করছিলে, কিন্তু সে তো নাকি উত্তরাঞ্চলের কোন গন্ডগ্রামে… তারপর তো তোমার আর কোন খোঁজই পাওয়া যায়নি, বাবা!”
একটা জোর টাল খেলেন সূর্য। তারপর আস্তে আস্তে উঠে দাঁড়ালেন।
নাঃ এখানে আর এক দন্ড নয়।
এ বাড়ি থেকে বেরিয়ে যেতে হবে। ফিরে যেতে হবে টাইম মেশিনের কাছে।
আর, হ্যাঁ, খুঁজে বের করতেই হবে নিজেকে।
ছেলে আর নাতনির এই ভরাভর্তি সংসারে নিজে যদি না থাকতে পারেন, তাহলে আবার পঞ্চাশ বছর পর লাইফটা কীরকম বোরিং হয়ে যাবে না?
আজ থেকে নিজের সময়ে ফিরে, নানা সময়ে গিয়ে গিয়ে নিজেকে ট্র্যাক ডাউন করাই হবে তাঁর একমাত্র লক্ষ্য। আর সেটা করতে গেলে…
“চলি রে, আমার আবার বেশিক্ষণ থাকার উপায় নেই এ সময়ে। এতটুকু এদিক ওদিক হলেই গোল বাধবে…” বলে , হাঁ মুখ ছেলে ছেলের বউকে ফেলে গুটিগুটি পায়ে তিনি রাস্তার দিকে এগোন।
“বাবা, যাও বাবা,” ফোঁপাতে ফোঁপাতে দেবব্রত বলল, “তোমার টাইমমেশিন একলা পড়ে থাকলে সেটা আবার কেউ না ও এল এক্সে বেচে দেয়। তখন তো তুমি ফিরতেও পারবে না…”
নাতনিকে একবার শুধু , বাড়ি থেকে যাবার সময়, চোখের দেখা দেখে যাবেন সূর্যশেখর। ওর হাতের ওই ছোট্ট জিনিসটা …বড়ো লোভ ওটায়। পারলে, স্পেসিমেন হিসেবে নিয়ে যাবেন।
অলংকরণঃ ইন্দ্রশেখর