গল্প-অঙ্কুর-আশুতোষ ভট্টাচার্য-বর্ষা ২০১৬

galpoangkur01 (Medium)গরমের ছুটিতেও স্বস্তি নেই বিহুর। হাজার হোম ওয়ার্ক। অঙ্ক, বিজ্ঞান, বাংলা, ইংলিশ আরও কত কী। তার সাথে জুড়েছে প্রজেক্ট, একটা সত্যিকারের ছোলাগাছ নিয়ে যেতে হবে। সেটাও অবশ্য ম্যাম বলে দিয়েছেন মোটামুটি কী করতে হবে। ছোলা একদিন জলে ভিজিয়ে রাখলে অঙ্কুর বেরোবে, তারপর সেটা মাটিতে পুঁতে দিলেই দু-চারদিনে গাছ বেরোবে।

বিহুর মায়ের আবার সবেতেই টেনশন আর ভীষণ সিরিয়াস, তা সে ক্লাস টেস্ট হোক কি ড্রয়িং ক্লাস কি গানের কম্পিটিশন কিংবা সাঁতার। স্কুল খুলবার সাতদিন আগে থেকে শুরু হয়ে গেল অপারেশন ছোলাগাছ। বিহুর মা কিছু ছোলা একটা বাটিতে রেখে দিলেন রাতে। আশা এই যে পরদিন অঙ্কুর বেরোবে আর তারপর মাটিতে পুঁতলেই গাছ। পরদিন সকালে ঘুম থেকে উঠে দেখা গেল ডাইনিং টেবিল থেকে সেই ছোলা ভেজানো বাটিটা উধাও। খোঁজ খোঁজ, ছোলার কি হাত পা গজালো যে সোজা বাটিসুদ্ধ বাগানে গিয়ে পায়চারি করছে! এই সময় বিহুর দাদু মর্নিং ওয়াক সেরে ঘরে ফিরে সমস্ত ঘটনাটা শুনে মেয়েকে বললেন, “এই যা, এসব তো আগে বলতে হয়। আমি তো ভেবেছি আমার খাবার জন্য ছোলা ভিজিয়েছিস। সকাল সকাল উঠে তাই খেয়েই তো হাঁটতে বেরলাম। তা যা বলিস, রোজ সকালে ছোলা খাওয়াটা কিন্তু দারুণ স্বাস্থ্যকর, শরীরটা বেশ চনমনে থাকে।”

একচোট চ্যাঁচামেচি করল বিহুর মা। কিন্তু তাতে তো আর ছোলা ফিরে আসবে না। কী আর করা, রাতে ফের পরেরদিনের জন্য কিছু ছোলা ভিজিয়ে রাখলেন। আর বাটির গায়ে কাগজ সেঁটে দিলেন – খাবার জন্য নয়, তিনটে ভাষায়, বাংলা, ইংলিশ আর হিন্দিতে।

পরদিন সকালে উঠে বিহু দেখে ছোলাগুলোর মাথায় কী সুন্দর অঙ্কুর হয়েছে, যেন সাদা ঝুঁটি। মায়েরও খুব আনন্দ। একটা ছোট টবে কিছু ছোলা পুঁতে বারান্দায় রেখে দিলেন। বিহুর বাবা যেই বলতে গেছে, “এই চল্লিশ ডিগ্রি গরমে টবটা বাইরে না রাখাই ভালো, ঘরের মধ্যেই রাখলে তো হয়,” শুনে বিহুর মা বলল, “বাইরে না রাখলে ওরা কী করে ফটোসিন্থেসিস করবে, বড় হবে কী করে?”

বিহুর বাবা আর বেশী কথা বাড়ালেন না।

এদিকে ঘণ্টায় ঘণ্টায় দেখা হচ্ছে ছোলাগুলো থেকে পাতা-টাতা কিছু বেরোচ্ছে কি না। বিকেলের দিকে দেখা গেল, ছোলাগুলো অঙ্কুরসমেত কেমন বিচ্ছিরিরকম কালো হয়ে গেছে। মা বলল, “কী করে বুঝব, ভাবলাম গাছগুলো এত ছোট, তাই একটু দুধ গরম করে দিয়েছিলাম টবে।”

শুনে বিহুর কী হাসি, বলল, “মা, সাথে বিস্কুটও দিলে পারতে।”

মা একপ্রস্থ বকে দিলেন বিহুকে, কোনও সিরিয়াসনেস নেই, সব কিছুতেই ফাজলামো, তোর কিছু হবে না ইত্যাদি, ইত্যাদি।

যাই হোক বাবাও এরমধ্যে কিছু ছোলা আর একটা টবে পুঁতে কেয়ার টেকারের ঘরের পাশে যে কামিনীগাছ আছে তার নীচে রেখে এসেছিলেন। দু’দিন বাদে দেখা গেল সেই টব ভর্তি ছোট ছোট গাছ সবুজ হয়ে আছে। কিন্তু এক একজনকে এক একরকম দেখতে। কোনটা যে ছোলা তা নিয়ে বিস্তর ধন্দে পড়ে গেল সবাই। বাবা বলল, “কুছ পরোয়া নেই, শৌভিক বীণা এক মিনিটেই বলে দেবে। শুধু টবটা নিয়ে যেতে হবে।”

শৌভিক আঙ্কেল আর বীণা আন্টি বাবার বন্ধু আর ওদের ছেলে পপাই আবার বিহুর খুব বন্ধু। বিহুও চলল বাবার সাথে, সাথে সেই টব।

ওদের বাড়ি পৌছতেই শুরু হয়ে গেল হইচই। আঙ্কেল বলল, “আগে বস, চা জলখাবার খা, দুপুরের খাবার খেয়ে দেখে দেব না হয়।”

বীণা আন্টি কিছু পরে কোত্থেকে এক মাইক্রোস্কোপ নিয়ে হাজির। এক একটা গাছের কিছু অংশ একটা ব্লেড দিয়ে পাতলা করে কাটছে, মাইক্রোস্কোপের নীচে রাখছে, কিছুক্ষণ গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করবার পর মাথা নাড়ছেন। অর্থাৎ, এটাও নয়। আস্তে আস্তে সব পরীক্ষা নিরীক্ষার শেষে দেখা গেল লাউ, কুমড়ো, তুলসী, ধান, বট, পেঁপে, অশ্বত্থ সব আছে কেবল ছোলাগাছ ছাড়া। টবটা বাইরে রাখা ছিল আর পাখি তাতে নানান বীজ ফেলে দিয়ে গেছে।

ওইদিকে সময়ও আর বেশি নেই। মা সুদামদাকে বলে রেখেছিল একটা ছোলাগাছের জন্য। সুদামদা ওদের বারান্দার গাছগুলোর যত্নআত্তি করে সপ্তাহে একদিন। রাজারহাটের দিকে একটা নার্সারিও আছে শুনেছে। তা সুদামদা বলেছিল, “দিদি নার্সারিতে তো ফুলের গাছ বড়ো হয়, তবুও দেখব।”

শেষ চেষ্টা হিসেবে মা ফোন করল সুদামদাকে। মা ফোনে বলছে, “সুদাম আছে? ছোলাগাছ পাঠাতে বলেছিলাম। হ্যাঁ হ্যাঁ, জলদি পাঠিয়ে দিন।”

ফোন রেখে মা বলল, “শান্তি। তোমরা তো কিছুই করো না, সব দায়-দায়িত্ব আমার।”

কিছুক্ষণ পরে বেল বাজল। দরজায় দাঁড়িয়ে আছে ‘সুস্বাদু’র ডেলিভারি বয়। হাতে ছোলে কুলচা আর মাছের কালিয়ার পার্সেল। বাবা বলল, “বাহ্, সুদামকে ফোন করতে গিয়ে তোর মা ‘সুস্বাদু’তে ফোন করে দিয়েছে। ছোলে আর মাছ অর্ডার দিয়েছে, রোববারের লাঞ্চটা দারুণ জমবে।”

মায়ের মুখটা তখন কাঁদোকাঁদো। কাল স্কুলে টবে কী নিয়ে যাবে বিহু? ওর কি কোনও চিন্তা আছে? টিভি দেখছে, ফুটবল পেটাচ্ছে, ছবি আঁকছে, দাদুর সাথে গল্প করছে। মায়ের চ্যাঁচামেচি শুনে বিহু হাজির। বলল, “একটু চুপ করে বসো তো! আমি এক্ষুনি আসছি।”

কিছুক্ষণ পরে বিহু হাজির। হাতে একটা টবে অনেক ছোলাগাছ, সদ্য পাতা মেলেছে, কী সুন্দর ছোট্ট ছোট্ট পাতা আর কী সবুজ, ঝলমল করছে, খুশিখুশি লাগছে গাছগুলোকে। এবার মায়ের অবাক হবার পালা। বিহু

বলল, “আমিও কিছু ছোলা এক ছোটো টবে পুঁতে ওয়াশরুমের কোণায় ঠাণ্ডায় রেখে দিয়েছিলাম। তারপর থেকে মাঝে মাঝে জল দিতাম আর দেখতাম আস্তে আস্তে কাণ্ড, পাতা বেরোচ্ছে, ব্যস।”

বিহু বলল, “মা, ক্রিসমাস ট্রির মতো এই গাছগুলোতে কাল স্কুলে যাবার আগে সুতো দিয়ে ছোলা ঝুলিয়ে দেব ভাবছি, যাতে গাছগুলো সত্যিকারের ছোলাগাছ বলে মনে হয়।”

galpoangkur02 (Medium)ছবিঃ মৌসুমী