গোধুলিয়ার রাস্তায় আনমনে হাঁটছিলেন অনুতোষবাবু। কতদিন পর আবার কাশীতে। কতদিন, না বছর? ঊনিশশো বাষট্টি কি তেষট্টির পর দু’হাজার চোদ্দ সালের মে – হ্যাঁ, একান্ন-বাহান্ন বছর কেটে গেছে মাঝখানে। পঞ্চাশ বছর অনেকটা সময়। পালটে যাওয়া কাকে বলে হাড়েহাড়ে টের পাওয়া যাচ্ছে। এই কাশী যেন অনেকটাই অচেনা তাঁর কাছে। এ যেন তাঁর পূর্বজন্মের ব্যাপার। হাঁটতে হাঁটতে সেকথাই মনে আসছিল অনুতোষবাবুর। আগে পথ ছিল যতদূর মনে পড়ে কালো পাথর বাঁধানো, পাশে বেশিরভাগ জায়গাতেই খোলা নর্দমা। এখন কোথাও কংক্রিট, কোথাও পিচ। নর্দমা গা-ঢাকা দিয়েছে মাটির তলায়। বাঙালি ধর্মশালাটা অবশ্য একই আছে। মাথার ওপর ইলেকট্রিক আর টেলিফোনের তারের জাল অতটা ঘন ছিল না আগে। পাশেই একটা পোস্ট বাক্স ছিল না? যার লাল গা আর খোলা হাঁ করা মুখ দেখে ভয় পেতেন ছোটোবেলায়? ওখানে এখন ব্যাঙ্কের এটিএম। বড়ো বড়ো গাছগুলোর কথা মনে পড়ছে। মস্ত নিমগাছ, অজস্র পাখপাখালির বাসা, পাশে একটা গলি ছিল। এখন গাছপালা বা গলির চিহ্ন নেই! দোকানে দোকানে সব ঢাকা পড়ে গিয়েছে। মনে আছে তাঁর ছোটোবেলাতেও ছোটো ছোটো দোকান ছিল গোটাকয়েক। পুজোর ডালা বিক্রি হত। টিমটিম করে কার্বাইডের বাতি আর প্রদীপ জ্বলত। আলোর চাইতে ছায়া হত বেশি। এখন নিয়ন আর মার্কারিতে ঝকঝক করছে সব। লোকজনের হল্লাও বেড়েছে সেই অনুপাতে। নাহ্, সেই কাশী আর এই ঘিঞ্জি শহরটাতে আকাশপাতাল তফাৎ।
অবশ্য পাঁচ-ছ’বছরের একটা বাচ্চা ছেলের নজর আর সাতান্ন বছরের বুড়োমানুষের নজরেরও তফাৎ হয়ে যায় অনেকটাই। অনুতোষবাবু মনকে বোঝাবার চেষ্টা করলেন। হয়তো আগের চেয়ে এটাই ভালো, বেশ উন্নতি হয়েছে জায়গাটার বলাই যায়। মেনে নেওয়াই উচিত তাঁর। পুরোনো কাশীতে রঙ লাগিয়েছে তাঁর শিশুমনের কল্পনা।
জ্ঞানবাপির পাশ দিয়ে অন্নপূর্ণামন্দির হয়ে পা চালিয়ে দশাশ্বমেধ ঘাটে পৌঁছে সিঁড়ির চেনা চাতালটাতে বসে হাঁফ ছাড়লেন অনুতোষবাবু। পাল্টায়নি ঘাটের শ্যাওলা ধরা সিঁড়ি, গঙ্গার স্রোত, তালপাতার বড়ো ছাতাগুলো আর সাঁঝবেলাকার জোলো বাতাস।
আহ্! একবুক শ্বাস নিয়ে বাঁচলেন যেন। আরতির সময় হয়েছে, দূর থেকে অনেকগুলো মন্দিরের ঘণ্টা শোনা যাচ্ছে একসঙ্গে। গোলমাল ভালো না বাসলেও এই শব্দ একটুও খারাপ লাগছে না তাঁর।
মনে মনে ইচ্ছে থাকলেও এতদিন সুযোগ হয়নি। বাবা, মা আর ছোটো বোনটা একদিনে মারা যাবার পর এতগুলো বছর একার জীবনে দম ফেলবার সুযোগ হয়নি। দশ-বারো বছর টানা অনাথ আশ্রম, তিন বছর মেস থেকে কলেজ। লেখাপড়া শেষ হবার পর বেসরকারি কোম্পানিতে হিসেব রাখার দমচাপা কাজ। বেড়াতে যাবার প্রশ্নও ওঠেনি। ইচ্ছেটাও চাপা পড়ে ছিল। কলকাতার অফিস থেকে বেনারসে ইন্সপেক্শনে আসার কথা ওঠা মাত্র লুফে নিয়েছেন এবার। তাও তো মাত্র দিন দশেকের জন্য, যার মধ্যে চারদিন কেটে গেছে। অবশ্য কাশী ঘুরে দেখার ইচ্ছেয় কাজের ব্যাপারটা অনেকটাই সামলান গেছে এর মধ্যেই।
বাঁয়ে মণিকর্ণিকার শ্মশানের আলোয় ডানদিকে রাজঘাট হয়ে আরও কত ঘাটের বিন্দু বিন্দু আলো জোনাকির মতো জ্বলজ্বল করছে। গঙ্গার কালো জলে তাদের ছায়া পড়ছে। ওপারেও টিমটিমে আলো। কুলকুল স্রোতের শব্দ। সারাদিনের শুকনো গরমের পর বেশ জোরালো ঠান্ডা বাতাস বইছে। ব্রিজের ওপর দিয়ে রেলগাড়ি পার হয়ে গেল। সারি সারি জানালায় আলো, শব্দ কানে আসে না এতদূরে। ঝিমুনি আসছে তাঁর।
মানুষের মগজ একটা আশ্চর্য যন্তর। অনুতোষবাবুর মনে হল মাথার কোনও অন্ধকার কোণায় পড়েছিল পুরোনো দিনের কাশী। বাবা মা ছোটোবোনটা। ছোট্টবেলার সেই ফুল বেলপাতা পচা গন্ধ, কয়লার উনুন ধরানোর জমাট ধোঁয়া, পাথুরে রাস্তার টাঙ্গায় চালার ঘরঘর, ঘোড়ার খুরের খটখট, ষাঁড়, গোবর, বাঁদর, পানদোকানের জর্দার মনমাতানো গন্ধ। সব যেন ঝাঁপিয়ে পার হয়ে এল এতগুলো বছর। প্রায় বুজে যাওয়া চোখের সামনে সিনেমার ছবির মতো সারি সারি মুখ। বহুদূর থেকে খুব চেনা গলায় কে ডাকছে, “অনু, মেঘ করেছে, বাড়ি আয়!” ছোট্ট একটা ছেলে ছুটছে অন্নপূর্ণামন্দিরের দেউড়ির পাশ দিয়ে গলির ভেতর। দিনের আলো কমতে কমতে রাতের আঁধার ঘনিয়ে এল। মাথার ওপর মেঘের রঙ মোষের গায়ের মতো কালো। ঝড় উঠছে, পায়রার দল পাগলের মতো ওলটপালট খেয়ে উড়ছে। ছেলেটা ভয় পেয়ে প্রাণপণে ছুটছে কিন্তু এক পাও এগোতে পারছে না। হঠাৎ যেন কান বন্ধ হয়ে গেছে ওর, কোথাও কোনও শব্দ নেই। সিনেমায় শব্দ চলে গেলে যেমন হয়। প্রাণপণে চিৎকার করছে ছেলেটা, তারও কোনও আওয়াজ নেই। বিদ্যুতের আলোয় মুখ দেখা গেল তার। মুখটা যেন খুব চেনা! কে?
“ও মশাই, শুনছেন?”
চমকে তাকালেন অনুতোষবাবু। জোলো হাওয়ায় ঝিমুনিটা বেশ পেয়ে বসেছিল। চোখটোখ কচলে সোজা হয়ে বসলেন। ধুতি আর ফতুয়া পরা একজন লোক ওঁর দিকে চিন্তিতমুখে চেয়ে আছেন, “শরীর খারাপ নাকি আপনার?”
উত্তর দিতে আমতা আমতা করলেন অনুতোষবাবু, “কই, না তো!”
“দেখলাম চোখ বুজে বিড়বিড় করে কথা বলছেন। গলগল করে ঘামছেন। ডাকলাম বলে কিছু মনে করলেন না তো?”
“না না, আপনি তো ভালোর জন্যই…”
কথা শেষ করতে না দিয়ে লোকটি কাকে যেন চেঁচিয়ে দু’গ্লাস সরবত পাঠিয়ে দিতে বলে পাশে এসে বসলেন। তাঁর কোলবসা চোখে সন্ধানী দৃষ্টি!
“বাঙালি তো বুঝতেই পারছি, কাশীতে নতুন বুঝি?”
“আজ্ঞে হ্যাঁ। ওই অফিসের কাজে দিন কতকের জন্য আসা।”
“আসবেন বইকি! এত যুগের শহর মশাই! এর রন্ধ্রে রন্ধ্রে ইতিহাস, অলিতে-গলিতে রহস্য। তা দর্শন-টর্শন হল?”
“নাহ্। ইচ্ছে আছে বটে, সময় হয়নি এখনও। আপনার পরিচয়টা?”
কথাটা মাথায় ঘুরঘুর করলেও পাড়তে পারছিলেন না – কে লোকটা? পাণ্ডা, দালাল, দোকানদার না নিছক ঘাটে হাওয়া খেতে আসা পাড়ার লোক? আর একটা কথাও মনে আসছে, বদ মতলববাজ লোক এ শহরে কম নেই! গুন্ডাটুন্ডা নয় তো? অজান্তেই পকেটের মানিব্যাগে হাত চলে গেল তাঁর। মোবাইল ফোন বা আংটির ব্যাপার নেই, চিন্তা নেই। হোটেলের নাম লেখা চাবি। এ আর কোন কাজে লাগবে এর!
“আমার চোদ্দপুরুষের বাস মশাই কাশীতে। গামছার ব্যবসা। ওই তো দেখুন না – ‘সনাতন পোদ্দার এন্ড সন্স’, মাদুলির কার আর গামছা বিক্রয় হয়। আমার নাম রূপচাঁদ। দোকানে যাঁর নাম লেখা তিনি আমার ঠাকুরদার বাবা। তিনি স্বনামধন্য গনৎকার ছিলেন মশাই। এখনও তাঁর মাদুলির বেশ নামডাক।”
“আমি অনুতোষ, অনুতোষ দাস।”
“পিতা? সাকিন?”
“ওইটি মুশকিলে ফেললেন মশাই। ছেলেবেলা থেকেই আমি একা। বাবা মায়ের পরিচয়ও জানা নেই। অনাথ আশ্রমে মানুষ। নামটিও আশ্রমের মহারাজের দেওয়া। তবে খুব আবছা মনে পড়ে তিনজনের কথা। বোধহয় তারাই আমার বাবা, মা আর ছোট্ট একটি বোন। একদিনেই বোধহয় তারা কোনওভাবে মারা যান। আমাকে দেওয়া হয় বহরমপুরের কাছে এক অনাথ আশ্রমে।”
“তাই?”
“তারপর লেখাপড়া শেষ করে কলকাতা শহরে একার জীবন।” বড়ো করে শ্বাস পড়ল অনুতোষবাবুর।
“ছোটো বয়সের কথা কিছুই তেমন মনে পড়ে না। পাঁচ বছর বয়সের কথা কারই বা মনে থাকে। তবে…”
“তবে?”
“জন্ম শুনেছি কাশীতেই। এই আশপাশের পাড়াতে কোথাও ঘর ছিল।”
“সেই খোঁজেই বুঝি কাশীতে আসা আপনার?”
“এসেছি তো অফিসের কাজে। হ্যাঁ, এই ফাঁকে যদি কোনও হদিশ পাই পুরোনো পাড়া, বাড়ি এসবের। সেরকম একটা ইচ্ছে তো আছেই। খোঁজখবর করব বইকি।”
আনমনাভাবে কথাগুলো বলে পোদ্দারের মুখের দিকে তাকালেন অনুতোষবাবু।
“বিশেষ করে কী করে তারা মারা গেল আর আমি বেঁচে রইলাম!”
সরবত এল দু’গ্লাস। একটি তাঁর হাতে ধরিয়ে নিজের গেলাসে চুমুক দিলেন রূপচাঁদ। কী মেশায় এরা সরবতে? সিদ্ধি থাকে কি ? বেশ তৃপ্তি করে খাবার পর মনটা খুশিখুশি হল অনুতোষবাবুর। শরীরে বেশ একটা চনমনে ভাব। জোরালো হাওয়া দিচ্ছে, রাত হল অনেক। গঙ্গার হাওয়ায় নানা রঙের নিশানাগুলো ওলটপালট খাচ্ছে। কালো জলে ছোট ছোট ঢেউ। মনে পড়ল গঙ্গা এখানে উত্তরবাহিনী। জোয়ারভাটা খেলে না। তবে বহুদূরে বোধহয় কোথাও কোথাও ঝড়বৃষ্টি হওয়ায় বড়ো বড়ো ঢেউ দিচ্ছে মাঝগঙ্গায়। ঘাটের কাছে এতক্ষণ জ্বলে থাকা প্রদীপগুলো তেল ফুরিয়ে নিভু নিভু। রতচরা কী একটা পাখি প্রায় জল ছুঁয়ে উড়ে গেল রাজঘাট পেরিয়ে। কোথায় যেন ঢং করে একটা ঘন্টা পড়ল।
“ছেলেবেলার কথা জানতে চান?”
“অবশ্যই।”
“হাতটা দেখি আপনার।”
অনুতোষবাবু ডান হাত বাড়ালেন, “আপনি হাত দেখেন বুঝি?”
এই কথাটার সরাসরি উত্তর এল না। খুব মনো্যোগ দিয়ে তাঁর বাড়ানো হাতের দিকে চেয়ে আছেন রূপচাঁদ। চোখ তুলে তাকালেন।
“জন্মতারিখ আর সময়টা জানা থাকলে আরও ভালো হত।”
অনুতোষবাবু স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন। কী যেন শুনেছিলেন মহারাজের কাছে? বুদ্ধপূর্ণিমা, গ্রহণ – না, মনে থাকে নাকি অত! হাত নাড়লেন অনুতোষবাবু।
“তা আর পাব কোথায়? আমার মতো কপালপোড়া মানুষের কেই বা অত দিনক্ষণ লিখে রেখেছে। তবে বছর তারিখ পরীক্ষার সার্টিফিকেটে যা লেখা ছিল বলতে পারি। সকাল না বিকেল জানা নেই।”
“সেটাই লিখে দিন আমাকে।”
পকেটে কাগজ কলম ছিল, অনুতোষবাবু লিখে দিলেন। রাত্তিরে হোটেলের ঘরে শুয়ে আকাশপাতাল ভাবনা আসছিল মাথায়। অনাথ বলে একেবারেই অজ্ঞাতকুলশীল নন তিনি। পাঁচ বছর বয়স অবধি কাশীতে থাকার কথা। বাবা মা বোনের কথাও আবছা মনে আছে। সবচাইতে আশ্চর্য হল এখনকার পথঘাট, মন্দির, গঙ্গার ঘাটও একটু একটু চেনা চেনা ঠেকছে। যদিও ওই বয়সের কথা মনে না থাকাটাই স্বাভাবিক। তবে ওই তিনজনের একসঙ্গে মারা যাওয়ার ব্যাপারটা একেবারেই অজানা। ওর জন্মদিন ধরে বিচার করে কি জানা যেতে পারে সবকিছু? নাকি আর পাঁচটা জ্যোতিষীর মতো এই লোকটাও বুজরুক? প্রথম আলাপেই অত হালহকিকত জানতে চাইবার কারণটাই বা কী?
পরপর দু’দিন সন্ধ্যেবেলা যথারীতি ঘাটে হাজিরা দিয়েও রূপচাঁদের সঙ্গে দেখা হল না তাঁর। দেখা হলে একটা খবর দেওয়ার ছিল। অনুতোষবাবুর জন্ম বুদ্ধপূর্ণিমার দিন চন্দ্রগ্রহণের সময়। অনাথ আশ্রমের মহারাজ একবার বলেছিলেন সেই কোন ছোটবেলায়। হঠাৎই মনে পড়ে গেছে তাঁর। এই মহারাজই তাঁকে কাশী থেকে আশ্রমে নিয়ে যান। আর একটা ভয়ংকর কালবৈশাখীর ঝড়ের ঘটনা আছে তাঁর জীবনে। যে বিষয়ে মহারাজ তেমন কিছু কোনদিনও বলতে চাননি। মনে পড়ার পর গত দু’রাত্রি ঘুম হয়নি তাঁর। স্বপ্ন দেখে বারবার ঘুম ভেঙে গেছে। ছোট্ট একটা ছেলে গঙ্গার ঘাটে দাঁড়িয়ে আছে একা। মুখটা খুব চেনা চেনা। তাঁর নিজের মুখ কি? বড়ো দুঃখী মুখ, বড়ো অসহায়!
আশ্চর্য! তিনদিন আগে রূপচাঁদকে বলার সময় এত কথা মনেই পড়েনি। পুরনো জায়গায় ফিরে আসার কারণেই বোধহয় মন আর স্মৃতি জেগে উঠেছে তাঁর। নিজের ওপর করুণা হচ্ছে। সত্যি, কী জীবনটাই না কাটিয়েছেন এতদিন! একদম একা, অন্ধকার খুপরি ঘরের কোণ, বাজে হোটেলে খাওয়া আর সারাটা দিন কোম্পানির জাবদাখাতায় অঙ্কের দাগ বুলোনো।
তিনদিন পর হোটেলের ম্যানেজার একটা হাতচিঠি দিয়ে বললেন, “কাশীতে আপনার বন্ধু আছে বলেননি তো?”
চিঠিতে লেখা – অনুতোষবাবু, রাত ন’টায় জ্ঞানবাপির পাশের গলিতে আসুন,সব জানতে পারবেন। সোজা দশ মিনিট হেঁটে ডানদিকের গলির ঢাল বেয়ে মণিকর্ণিকার দিকে যাবেন। তিন নম্বর বাড়ি, নাম রামপ্রসাদ হাভেলি। ভাঙা বাড়ি দেখে ভয় পাবেন না। অবশ্যই আসবেন, সব জানতে পারবেন। দেখা হবে। – ইতি রূপচাঁদ।
সারাদিন দমচাপা গরমের পর বিকেল থেকে আকাশে মেঘ জমেছে। আকাশে কোনও তারার চিহ্ন নেই। থমথম করছে চরাচর। খাওয়াদাওয়া সেরে আটটা নাগাদ ঘাটে এসে বসলেন অনুতোষবাবু। অল্প অল্প বাতাস বইতে শুরু করেছে ঝড় আসতে পারে, তাই ঘাটে আজ হাতেগোনা লোক। প্রথমে একটু দোটানা থাকলেও মন শক্ত করলেন তিনি। যেতেই হবে, ঝড়জল যাই হোক। রূপচাঁদের চিঠি টানছে তাঁকে। পৌনে ন’টা নাগাদ উঠে পড়লেন অনুতোষবাবু।
জ্ঞানবাপির পাশের গলিতে দশ মিনিট হাঁটতে হাঁটতে পাড়াটা নিঝুম হয়ে এল। আকাশ যতটুকু নজরে পড়ছে থমথমে কালো। জমাট মেঘে মণিকর্ণিকার চিতার আলো পড়ে ভয়ংকর দেখাচ্ছে। ডাইনে ঢালু পথ। নেশাগ্রস্ত লোকের মতো তিন নম্বর বাড়িটার কাছে আসতেই ঝড় শুরু হল। পশ্চিমা কালবৈশাখীর ধাক্কায় দরজা জানলা পড়ছে দুমদাম করে। হুড়মুড় করে বোধহয় কোথাও পুরনো দেওয়াল ধসে পড়ল। ধুলোয় দম নেওয়া যাচ্ছে না। কোনওমতে দেউড়ি ঠেলে ভেতরে ঢুকতেই উঁচু ভিতের ঘরটা নজরে পড়ল। খোলা দোর দিয়ে লম্ফ হাতে ও কারা বেরিয়ে আসছে? একজন পুরুষ, ঘোমটা মাথায় বাচ্চা কোলে এক মহিলা, পাশেই একটা ছোট্ট ছেলে! কারা এরা? ঘরটা হাওয়ার তোড়ে দুলছে। হঠাৎ চরাচর নীল আলোর চাবুকে ধাঁধিয়ে কানফাটা শব্দে বাজ পড়ল উঠোনে মানুষগুলোর ওপর আর বাড়িটা ভেঙে পড়ল একই সঙ্গে। অনুতোষবাবুর যেন হুঁশ নেই, শরীরটা যেন ওঁর ফাঁপা! বিদ্যুতের আলোয় ওদের দেখেছেন মরে যেতে। ছেলেটা চাপা পড়েছে ভাঙা দেয়ালের তলায়।
সব মনে পড়ছে তাঁর! তিনজন নয়, মারা পড়েছে চারজন। ছেলেটার কোনও গতি হয়নি, খুঁজে না পাওয়ায়। তার মানে তাঁর শরীরটাও আসলে শরীর নয়! পঞ্চাশ বছর লাগল তাঁর নিজেকে চিনতে। রূপচাঁদ এসে দাঁড়িয়েছে পাশে, আসলে বেঁচে নেই সেও! এ শহরে এরকম কতো আছে!
আর দুঃখ নেই, দশাশ্বমেধ ঘাটেই থাকবেন তিনি। ঝোড়ো বাতাসে দু’বন্ধু গা ভাসিয়ে উড়ে গিয়ে বসলেন গঙ্গার ওপারের ভাঙা ঘাটে। দরকার না হলে আর কাউকে দেবেন না ওঁরা।
ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য
শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের সব গল্প একত্রে