গল্প-অপহারী হরেন-কিশোর ঘোষাল

এ তল্লাটে হরেন পোল্লেকে সকলেই চেনে, কিন্তু আবার কেউই সঠিক চেনে না। আশেপাশে পাড়া পল্লীতে তার অবাধ যাতায়াত। বিশেষ করে যারা একটু মুরুব্বিগোছের জমি-জায়গার মালিক কিংবা ব্যাবসা-ট্যাবসা করে মা লক্ষ্মীকে ঘরে আদর যত্নে রেখেছে, তাদের বাড়িতেই তার যাতায়াত। তবে ঘন ঘন যায় না হরেন, সে জানে ঘন ঘন কুটুমবাড়ি গেলে সেখানে কদর কমে যায়, বাড়ির লোক জন সতর্ক হয়ে যায়।

আসলে হরেন পোল্লে একজন তস্কর। চোর বললে বড্ড খারাপ শোনায়, তাই তস্কর। অনেকে আবার নিশিকুটুম্বও বলে। রাতের কুটুম বলা নেই কওয়া নেই পাঁচিল টপকে ঘরের দেয়ালে সিঁদ দিয়ে ঢুকে পড়ে বাড়ির অন্দরে। কাজ-টাজ সেরে সুযোগ পেলে অনেক সময় ফ্রিজ খুলে ভালোমন্দ খেয়েও আসে। কুটুমবাড়ি গিয়ে কিছু না খেয়ে আসতে নেই কিনা, তাতে গেরস্তের অমঙ্গল হয়, মা লক্ষ্মী অস্থির হন, চঞ্চল হয়ে ওঠেন।

পুলিনগড়ের হাটে হরেন পোল্লের একটা ইলেকট্রিকের দোকান আছে। এমনিতে সেখানে নানান ধরনের বাল্ব, ইলেক্ট্রিকের তার-টার, সুইচের বাক্সটাক্স আরো নানান তামঝাম সরঞ্জাম বিক্রি করে। আবার দরকার পড়লে সারাইয়ের কাজ টাজ করতে লোকের বাড়িতেও যায়। কথাবার্তা তার খুব ভালো আর আপনি, আজ্ঞে ছাড়া কথা কয় না, এমনই বিনয়ী। সেই কারণেই কারো মনে সন্দেহও হয় না, যে মাঝরাতের নিষুতিতে হরেন পোল্লে মিশমিশে অন্ধকারে মিশে কোথায় যায়, কী করে। সে যে কোনদিন ধরা পড়েনি তা নয়, বারপাঁচেক পড়েছে। কিন্তু পরনে কালো হাফপ্যাণ্ট, সারাগায়ে বিটকেল গন্ধওলা তেল মাখা, ঝুল-কালি মাখা মুখ দেখে তাকে চেনবার জো থাকে না। খুব মারধোর করলে সে নানান নাম বলে, বিশু মণ্ডল, হারু বাগ, ছোঁচা মল্লিক, মটর সর্দার…এক এক জায়গায় এক এক নাম, আর সেই জায়গার নামটা সে ভোলেও না। এক জায়গায় দুবার ধরা পড়লে একই নাম বলতে তার ভুল হয় না।

এই যেমন সেদিন দুটো ছাগল নিয়ে বদরু শেখ হাটে যাচ্ছিল, বাসে দেখা গুলে মিদ্দের সঙ্গে। অনেক দিনের সুখদুখের বন্ধু তারা। বাসের ছাদে বসে দুটো বিড়ি ধরিয়ে দুজনে নানান কথাবার্তা চালাচ্ছিল। কথায় কথায় উঠল চুরির কথা। বদ্রুমিঞাঁর পাড়ায় গত পরশু রাতে চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েছিল হরেন পোল্লে। বেদম উত্তম মধ্যম দিয়ে তার নাম জিগ্যেস করাতে বলেছিল, ‘আজ্ঞে অধমের নাম হারু বাগ’। তাই শুনে গুলে মিদ্দে বললে, ‘আরে, আমাদের পাড়াতে বছর খানেক আগে একটা চোর ধরা পড়েছিল, সে ব্যাটাও খুব পেটানি খেয়ে নাম বলেছিল ছোঁচা মল্লিক। তাহলে সে ব্যাটা অন্য। আজকাল পাড়ায় পাড়ায় কত চোর যে আমদানি হয়েছে, সামলে ওঠা মুস্কিল হয়ে উঠছে। থানাটাও বড্ড দূর। এর সুরাহা কী করা যায় বল দিকি, বদ্রুভাই?’

হরেন পোল্লের হাটের ইলেকট্রিকের দোকান, আহামরি তেমন চলে না। আগে মাসে এক দুদিন চুরিচামারি করলেই তার সংসারের সংকুলান হয়ে যেত। বুড়ি মা, বউ আর একটা মেয়ে নিয়ে তার সংসারও তেমন কিছু বড়ো নয়। সমস্যা হয়েছে তার এই সোনামুখী মেয়েটি। তার মেয়েটি এই দিগরের সেরা মেয়ে, লেখাপড়ায় খুব ভালো। ভালোই তো, এটা আবার সমস্যা নাকি? সমস্যাই তো, মাধ্যমিকে জেলার মধ্যে সেকেন্ড হওয়ার পর, তার মেয়েকে নিয়ে দিনদশেক খুব নাচানাচি হল। গুচ্ছের আবর্জনা বই, পাঁচহাজার টাকা আর একটা প্রশংসাপত্র। টিভির ক্যামেরার সামনে সদরের বাবুরা খুব বলাবলি করল, এই মেয়ে আমাদের গৌরব। আমাদের জেলার মুখ উজ্জ্বল করেছে, সব রকম সাহায্যের জন্যে আমরা প্রস্তুত। কিন্তু সদরের হাইস্কুলে বিজ্ঞান পড়াতে গিয়ে হরেন পোল্লের উজ্জ্বল মুখ অন্ধকার হয়ে গেল।

সদরের হাইস্কুলে এত খরচ? বাপরে! তার রোজগার কম বলে, আর মেয়ের দারুণ রেজাল্টের জন্যে টুইশন ফি আদ্দেক হয়েছে ঠিকই, কিন্তু তাও তো নেহাত কম নয়! তাছাড়াও এতদূরে রোজ যাওয়া আসা, স্কুলের টিফিন, টুকটাক হাতখরচা, বই খাতা, সেই বা কম কী? হরেন পোল্লের কপালে আরো একটা ভাঁজ বাড়ল।

কিন্তু তার এমন মেয়েকে সে পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানিয়ে সারাজীবন কাটাতে দিতে পারবে না। হরেন পোল্লে স্বপ্ন দেখে, তার মেয়ে ডাক্তার হয়ে তার চোখের কোল পরীক্ষা করছে। বুকে পিঠে স্টেথো ঠেকিয়ে ঠেকিয়ে বলছে, “বাবা বড়ো বড়ো শ্বাস নাও।” থুতনি ধরে বলছে, “হাঁ করো তো বাবা, বলো অ্যাঅ্যাঅ্যাঅ্যা…”

স্বপ্নে মেয়ের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতে থাকতে তার চোখটা ঝাপসা হয়ে গেল। হরেন পোল্লে ঠিক করে ফেলল, দিনের ব্যাবসাটা কমিয়ে, রাতের ব্যাবসাতেই জোর দিতে হবে। বিপদ আছে, ঝুঁকি আছে, কিন্তু দুটো পয়সাও আছে।

আশেপাশের গ্রামগঞ্জে যাই হোক আর তাই হোক, প্রফুল্লনগরে চুরিচামারি রাহাজানির তেমন কোন ইতিহাস নেই। এই ছোট্ট শহর সরকারি শিল্পনগরী, লোকজন সকলেই চাকরিসূত্রে এখানে বাস করে। অবসর নেওয়ার পর, সরকারি কোয়ার্টার ছেড়ে দিয়ে, যে যার নিজের জায়গায় ফিরে যায়। যারা এ শহরে নতুন আসে, তাদের স্মৃতিতে থাকে ছেড়ে আসা অঞ্চলের চুরিচামারি, ফেরেব্বাজির বিস্তর ঘটনা। অতএব তারা প্রথম প্রথম এসে খুব অসহায় বোধ করে। কোন বাড়িতে পাঁচিল নেই। চারপাশে প্রচুর গাছপালা, বিস্তর ফাঁকা জমি। সন্ধে হতে না হতে আনকোরা লোকেরা ভয়ে দরজায় খিল এঁটে বসে থাকে। তারপর পাড়া-প্রতিবেশীদের থেকে ভরসা পেয়ে, নিজেরাও কিছুদিন থাকার পর সব কিছু বুঝে সুঝে নিলে, ভয়টা কমে। তখন শান্ত নিরিবিলি অথচ নিরাপদ এই জায়গাটাকে সকলেই ভালোবেসে ফেলে। বুঝে যায়, এমন জায়গা এ রাজ্যে আর দ্বিতীয় নেই।

যে জায়গায় ময়লা থাকে, লোকের স্বভাব হল সেই জায়াগাটাকে আরো নোংরা করা। কিন্তু পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন জায়গাকে নোংরা করার আগে লোকে তিনবার ভাবে। ঠিক একই কারণে প্রফুল্লনগরে চুরি করা খুব সহজ জেনেও, চোরেরা এই জায়গাটাকে সমীহ করে এড়িয়ে চলত। কারণ ওই একটাই, এখানে চুরিচামারির কোন ইতিহাস নেই।

প্রফুল্লনগর থেকে পুলিনগড় এমন কিছু দূরে নয় ঠিকই আবার খুব কাছেও নয়, যে জোরে হাঁক পাড়লে শোনা যাবে। সাইকেলে গেলে আধঘন্টা চল্লিশমিনিট লেগেই যায়। পুলিনগড়ে মঙ্গল আর শনিবার এই দু’দিন হাট বসে। সেই হাটে বাঘা বাঘা সব ফড়েরা সবজি নিয়ে আসে। তাদের মধ্যে অনেকেরই প্রফুল্লনগরেও সবজির দোকান আছে। তাদেরই একজন মিঠু শেখ। মিঠু শেখের সঙ্গে একদিন ঘনিষ্ঠ আলাপে হরেন পোল্লে প্রফুল্লনগরের হদিশ পেল।

কদিন আগে পুলিনগড়ের উত্তরদিকের গ্রাম জোতলখিমপুরে বেশ বড়ো সড়ো একটা চুরির ঘটনায় চারদিকে হইচই পড়ে গিয়েছে। সে গাঁয়ের সম্পন্ন ধানচাষী নিতু হাজরার পেল্লায় বাড়িতে সিঁদ দিয়ে চুরি হয়ে গেছে বিস্তর জিনিসপত্র। নিতু হাজরার ছোটোছেলের সামনে বিয়ে। বিয়ের আগে ঘরদোর সাফসাফাই, রংচং করার কাজ চলছিল। সেই রংমিস্ত্রির তুলির খোঁচায় ছিঁড়েখুঁড়ে গিয়েছিল পুরোনো দিনের ইলেকট্রিক তারের জটিল সংযোগ। আর সেই ইলেকট্রিকের তারের কাজ করতে হরেন পোল্লের ডাক পড়েছিল নিতু হাজরার বাড়িতে। চারদিন যাওয়া আসা করে বাড়ির প্রায় সব ঘরের সুলুকসন্ধান, বাড়ির সামনে, পিছন, আঁদাড়-পাঁদাড় সব বুঝে নিয়েছিল হরেন পোল্লে। ইলেকট্রিকের কাজকম্মো ঠিকঠাক সেরে, পাওনাগণ্ডা পেয়ে যাওয়ার পাঁচদিনের মাথায়, একদিন নিশুত রাতে হরেন পোল্লে হানা দিয়েছিল নিতু হাজরার বাড়ি।

galpoApahari Haren 2 (Medium)নিজের হাতের তালুর মতো চেনা বাড়ির পিছনের পাঁচিল টপকে সিঁড়ির দালানের জানালায় মোক্ষম ছ্যাঁদা করেছিল। বাড়ির বাইরে উঁচু পাঁচিল, তার গেট বন্ধ। রাত্রে বাড়ির সামনের সদর দরজা আর পিছনের খিড়কি দরজা, সবই বন্ধ থাকে রোজ। সেই কারণে বাড়ির ভিতর ছেলেপুলেরা অনেক ঘরেই দরজা বন্ধ না করেই ঘুমোয়। জানালার ছ্যাঁদা দিয়ে হরেন পোল্লে নিঃশব্দে উঠে গিয়েছিল দোতলায়। নিতু হাজরার ছোটোছেলে আর ভাইপোদের চারটে ঘর খোলা পেয়েছিল হরেন, আর সেই ঘরগুলো থেকে সে সরিয়ে ফেলেছিল, ছটা হাতঘড়ি, পাঁচটা মোবাইল ফোন, একটা ক্যামেরা, নোট আর কয়েন মিলিয়ে নগদ আট হাজার সাতশ তেত্রিশ টাকা। একটা ঘর থেকে টিভি সরানোর জন্যে হাত নিশপিশ করলেও নিজেকে সামলেছিল, কারণ তার জানালার গর্ত দিয়ে ও জিনিস বের করা মুশকিল হতো।

ঘটনাটা হয়েছিল মঙ্গলবার রাতে, আজ শনিবারের হাটে সেই গল্প নিয়ে হাট সরগরম। গোপলাবেনের চায়ের দোকানে চা খেতে গিয়ে মিঠু শেখের কাছে পুরো ঘটনাটা অবাক হয়ে শুনল হরেন পোল্লে। সে যা যা করেছিল তার চেয়ে অনেক বেশিই শুনল।

“কী দিন কাল পড়ল রে, হরু। এতবড়ো চুরি এ দিগরে আগে কোনদিন শুনিনি। বাপরে! কী সাহস চোর ব্যাটার! জিনিসপত্র যা গেছে, সে তো গিয়েছে। কিন্তু নিতু হাজরার চোদ্দ পুরুষের ভাগ্য যে, ওর অমন তাজা তাজা ছেলেপুলে, ভাইভাইপোরা প্রাণে বেঁচে গেল।”

হরেন পোল্লে চমকে উঠল নিজের অজানা কীর্তিতে। জিগ্যেস করল, “সেকী? চোরটা কাউকে মারধোর বা খুনখারাপি করতে গিয়েছিল এমন তো শুনিনি।”

“তা করেনি ঠিকই, কিন্তু বাকিটাই বা কী রেখেছিল বল? ব্যাটা এমন নিদ-বন্ধন মন্ত্র চালিয়েছিল, কেউ সাড়া পর্যন্ত করতে পারে নি।”

“নিদ-বন্ধন মন্ত্র? সে আবার কী?”  তার চোদ্দ বছর চোর জীবনের অভিজ্ঞতায় এমন মন্ত্রের কথা হরেন প্রথম শুনল।

“চোরেরা ঢোকার আগে বাড়ির চারদিক ঘুরে মন্ত্র পড়ে দেয়। তাতে বাড়ির ভিতরে থাকা লোকজন অঘোরে ঘুমিয়ে পড়ে। সে এমন ঘুম, সে সময় তাদের গায়ের পাশ দিয়ে রাজধানী ট্রেন চলে গেলেও ঘুম ভাঙে না। ঘুমের বাঁধনে আষ্টেপৃষ্ঠে বেঁধে ফেলে বলেই এ মন্ত্রের নাম নিদ-বন্ধন।”

চায়ে একটা চুমুক দিয়ে, চোখ বড়ো বড়ো করে হরেন বলল, “বাপরে, বলিস কী?” 

“তবে? তা নাহলে তুই ভাব, চোরটা জানালা ভেঙেছে, একতলার সব ঘরে ঢুকেছে, ওপরে গিয়ে দোতলার সব ঘরে ঢুকেছে, সমস্ত ঘর থেকে গুচ্ছের জিনিস হাতসাফাই করে নিশ্চিন্তে সটকে পড়েছে। এ কি কম সময়ের ব্যাপার? এতক্ষণের মধ্যে বাড়িতে অতগুলো লোক, কারো ঘুম ভাঙল না, এ হতে পারে? শুনেছি এই মন্ত্রের এতটুকু এদিক সেদিক হলে, মানুষের মৃত্যু হয়ে যাওয়াও বিচিত্র নয়।”

“হুম। একদম হক কথা। তবে কী কী  হাতিয়েছে, কিছু খবর পেলি?”

মিঠু শেখ লম্বা চুমুকে চায়ের গেলাস শেষ করে বলল,“সে অনেকে অনেক কথা বলছে। শুনলাম দশ বারো ভরি সোনার গয়না, প্রায় হাজার চল্লিশেক নগদ টাকা। চার পাঁচ গন্ডা হাতঘড়ি, মোবাইল ফোন, ক্যামেরা। এক কথায় বাড়ির লোকগুলোকে ছাড়া সব নিয়ে গেছে। নিতু হাজরাকে একেবারে পথে বসিয়ে দিয়ে গেছে রে হরু।”

হরেনও দীর্ঘশ্বাস ফেলে চায়ের গেলাস খালি করল, তারপর বলল, “ইস, ছি ছি। হাজরামশাইয়ের মতো অমায়িক মানুষের এতবড়ো ক্ষতি কেউ করতে পারল? ভাবা যায় না, মিঠু ভাই।”

“সেই জন্যেই তো বলছি রে, এই তল্লাটে চোর ছ্যাঁচড়ের বড্ডো বাড়বাড়ন্ত হয়ে উঠছে দিন কে দিন। আর চিন্তা কর, এই তো এখান থেকে মাইলদশেক হবে কি হবে না, প্রফুল্লনগর। চুরি নেই, জোচ্চুরি নেই। সারা রাত লোকে দরজা জানালা খুলে নিশ্চিন্তে ঘুমোয়। একটা সেফটিপিন অব্দি চুরি যায় না। যেন সত্যযুগ, রামরাজত্ব।”

“যাঃ, এমন জায়গা আবার হয় নাকি? হতে পারে, এদিকের থেকে কমসম হয়, কিন্তু একেবারেই হয় না?”

“আমার কথায় তোর বিশ্বাস হলো না তো? আমি তো হপ্তায় পাঁচদিন প্রফুল্লনগরেই যাই। ওখানকার বাজারে আমার সব্জির দোকান আছে, ওখানকার বড়ো বড়ো অফিসাররা আমার কাছে আসে টাটকা সব্জির জন্যে। তাদের মুখেই শুনেছি, প্রফুল্লনগর নামেও প্রফুল্ল কাজেও প্রফুল্ল, হাসি খুশি। কোন ভয় নেই, আতংক নেই, শান্তির জায়গা।”

 “তাই নাকি, প্রফুল্লনগর এমন জায়গা? মিঠুভাই, এ নিয়ে পরে আবার কথা বলব। এখন উঠছি, দোকানে কেউ নেই, অনেকক্ষণ খোলা রেখে এসেছি।”

ছোট্ট শহর হিসেবে প্রফুল্লনগরে থানা একটা আছে, কিন্তু সে না থাকারই মতো। থানার বড়ো, মেজ কোন বাবুই নেই, আছেন এক ছোটোবাবু আর সঙ্গে গোটা তিনেক হাবিলদার। যে খাতায় ডাইরি লেখা হয়, সে খাতাটায় ছোটোবাবুর বড়োছেলে, কাটাকুটি খেলে শেষ করে দিয়েছে। শহরে রোজ ক’টা কু’কাজ হল, তার বর্ণনা লিখে রাখার নিয়ম থানার ক্রাইম রেজিস্টারে। সেই রেজিস্টার শেষ লেখা হয়েছিল, ২০১০ সালের সরস্বতীপুজোর ভোরবেলা। দুটো বাচ্চা মেয়েকে একদম বমাল সমেত ধরে এনেছিল এক কটকটে বুড়ি। কটকটে বুড়ির পাল্লায় পড়ে ছোটোবাবুকে ডাইরি আর ক্রাইম রেজিস্টার দুটোই লিখতে হয়েছিল। বাচ্চা মেয়েদুটোর হাত থেকে বাজেয়াপ্ত করতে হয়েছিল পুজোর ফুলসমেত ফুলের সাজি। থানার জিম্মায় দিয়ে কটকটে বুড়ি ফিরে যাওয়ার পর, বাচ্চা মেয়েদুটিকে রিকশায় নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দিয়ে এসেছিলেন ছোটোবাবু নিজেই। সঙ্গে ফিরিয়ে দিয়েছিলেন ফুলের সাজিদুটোও। বেচারা মেয়েদুটি ফুলচোর, সরস্বতী পুজোর জন্যে ফুল চুরি করতে গিয়েছিল ঐ বুড়ির বাগানে। যাই হোক, সেই রেজিস্টারে ছোটোবাবুর স্ত্রী এখন বাজারের হিসেব লেখেন।

সেই ঘটনার প্রায় চার বছর পরে সেদিন শিবেনবাবু থানায় গিয়েছিলেন চুরির অভিযোগ নিয়ে। খোলা জানালার ধারে টেবিলের উপর রাখা ছিল তিনটে হাতঘড়ি, দুটো মোবাইল ফোন, ক্যালকুলেটর, জ্যামিতির বাক্স। সব চুরি হয়ে গেছে। ছোটোবাবু শিবেনবাবুকে অনেক বোঝালেন, প্রফুল্লনগরে এমন হতেই পারে না। জিনিষগুলো তাঁর বাড়ির বাচ্চারাই দুষ্টুমি করে লুকিয়ে রেখেছে। টিভিতে “ছোটা ভীম” দেখতে দিলেই সব বের করে দেবে। কিংবা দুপুরের দিকে মাঝে মাঝে হনুমানের দল আসে, তাদের বাঁদরামিও হতে পারে। কিন্তু চুরি? অসম্ভব।

এই ঘটনার দিন কুড়ি পরে, সন্টুবাবু প্রায় একই অভিযোগ নিয়ে থানায় গেলেন। এবারে ছোটোবাবুকে একটু নড়েচড়ে বসতেই হল। পরপর দুটো একইরকম ঘটনায় তিনিও চিন্তিত হয়ে পড়লেন। হাবিলদারকে বলে পাড়ার দোকান থেকে দুটো বড়ো বড়ো রুলটানা খাতা আনিয়ে তিনি ডাইরি লিখলেন, লিখলেন ক্রাইম রিপোর্ট। কিন্তু এতেই থেমে থাকল না, এই ঘটনার মাসখানেকের মধ্যে চুরির অভিযোগ নিয়ে আবার এলেন স্বপন সাঁতরা। তাঁরও প্রায় একই অভিযোগ, বাড়তির মধ্যে তাঁর কোয়ার্টারের সীমানার মধ্যে দুটো নারকেল গাছ থেকে চোরটা সমস্ত নারকেল সাফ করে দিয়েছে। ডাইরি আর ক্রাইম রিপোর্ট লিখিয়ে স্বপনবাবু চলে যাবার পর, তিনি হাবিলদার সুখন রাম আর রামপ্রকাশকে বললেন, তাঁর সাইকেল বের করতে। তিনি তদন্তে যাবেন। কিন্তু সুখন রাম জানাল, সাইকেলের যা হাল, তাকে সারিয়ে সুরিয়ে খাড়া করতে দিন দুয়েক লাগবেই।

দুমাসের মধ্যে লাগাতার তিনটে চুরির ঘটনায়, প্রফুল্লনগরের শান্ত পরিবেশ উত্তাল হয়ে উঠল। অফিসে, বাজারে, স্কুলে কলেজে, চায়ের দোকানে, মহিলাদের বিউটি পার্লারে সর্বত্র এই আলোচনা। প্রফুল্লনগর যে অপরাধীদের হাতে চলে গেছে, এতে সকল বাসিন্দারাই একমত। সন্ধের পর লোকজন জরুরি কাজ না পড়লে বের হচ্ছে না। বাজারের দোকানপাট সাড়ে সাতটায় বন্ধ হয়ে, শুনসান হয়ে যাচ্ছে। অসহায় নেড়ি কুকুরগুলোও ভয়ে ফুটপাথের ধারে কুণ্ডলী পাকিয়ে শুয়ে পড়ে।

********

বাবা তখনো অফিস থেকে ফেরেন নি। সন্ধেবেলা মায়ের সঙ্গে ঘরের বাইরের বারান্দায় বসে গল্প করছিল টুম্পি আর তার দুই যমজ বোন রুনুঝু্নু। কথায় কথায় চলেই এল প্রফুল্লনগরের চুরির ব্যাপারটা। টুম্পি রুনুঝুনুকে বলল, –             

“এই চুরির ব্যাপার নিয়ে, তোদের ভূতবন্ধু রুকুসুকু কিছু জানে না?” রুকুসুকু দুই যমজ ভাই, কিন্তু ভূত, রুনুঝুনুর সঙ্গে খুব ভাব। রুনুঝুনু বলল, “তুইই জিগ্যেস কর না, দিদি। ওই তো ওরা, সেই থেকে বসে বসে আমাদের কথা শুনছে।”

“হ্যারে রুকুসুকু, আমাদের এ শহরে কি হচ্ছে বল দেখি, বাবা? তোরা কিছু জানিস?”

মা আগে রুকুসুকুকে ভয় পেতেন, কিন্তু আজকাল আর পান না। উল্টে বাড়িতে মিষ্টিটিষ্টি আনলে কিংবা ভালোটামন্দটা রান্না হলে ডেকে খেতে দেন, বলেন, “আহা, ওরা দুই বেচারা ভুত হলে কী হবে, আমি জানি মা মরা ভুতদের খুব দুঃখ।”

মায়ের কথায় রুকু একটু কেশে গলাটা সাফ করে নিয়ে বলল, “আজ্ঞে মা, জানি বইকি। ওই চোরের বিস্তর খবর জানি। ওর ভালো নাম হরেন পোল্লে। ধরা পড়লে আরো চারটে নাম ও বলে থাকে বিশু মণ্ডল, হারু বাগ, ছোঁচা মল্লিক, মটর সর্দার।”

টুম্পি নাক বেঁকিয়ে বলল, “ছোঁচা? ছোঁচা আবার কারো নাম হয় নাকি? নাম শুনলেই তো সাবান মেখে ভালো করে চান করতে ইচ্ছে হয়।”

“আজ্ঞে, যা বলেছো, মেজদিদি। ও ওইরকমই। এক এক জায়গার জন্যে এক এক নাম। পুলিনগড়ের হাটে একটা ইলেক্ট্রিকের দোকান আছে, ভালো চলে না। অভাবে স্বভাব নষ্ট। এক একদিন একেক গাঁয়ে চুরি করে বেড়ায়। চোদ্দ বছরের চুরির অভিজ্ঞতা, মাত্র পাঁচবার ধরা পড়েছে। ছোঁচা মল্লিককে গোটা চোরসমাজে সকলেই সমীহ করে চলে।”   

“বাবা, চোরেদের আবার সমাজ?” মা অবাক হয়ে গালে হাত দিলেন।

“চোরেরা কি মানুষ নয়, মা? ওদেরও সমাজ আছে, বিধিনিষেধ আছে, সভাসমিতি, ব্রত, পালাপার্বণ, উৎসব সবই আছে।”

“ব্রত? কীসের ব্রত পালন করে চোরেরা?” হেসে ফেলে টুম্পি জিগ্যেস করল।

“সে এক-আধটা নয়, অনেক, মেজদিদি। একটার কথা বলি। পোষ মাসের অমাবস্যায় পোষালি ব্রত খুব ধুম জাঁক করে চোরেরা পালন করে। ওই দিন ওরা গৃহস্থের বাড়ি চুরি করবেই। চোরেদের ওটাই নাকি বছরের প্রথম দিন। ওদের ধারণা, ওইদিন ভালোয় ভালোয় চুরি হলে, সারা বছর ভালোই যাবে।” 

“সে না হয় পরে একদিন শুনবো, তার আগে আমাদের এই ছোঁচা, না কী বললি, তার খবর কী বল।” মা বললেন।

“হ্যাঁ মা, এই বলি। চোর হিসেবে খুব সুনাম থাকলেও হরেন পোল্লে, আগে রয়েসয়ে কমসম চুরি করতো। কিন্তু ইদানীং সে চুরির মাত্রা খুব বাড়িয়ে দিতে বাধ্য হয়েছে।”

“বাধ্য হয়েছে? কেন?” মা জিগ্যেস করলেন।

“আজ্ঞে মা, সে যেমন আনন্দের কথা, তেমনই দুঃখের কথাও বটে। হরেন পোল্লের একমাত্র মেয়ে শুক্লা পোল্লে, নামেও শুক্লা, গুণেও শুক্লা সরস্বতী। এবারের মাধ্যমিকে আমাদের এই জেলায় শুক্লা দ্বিতীয় হয়েছিল। হরেনের স্বপ্ন মেয়েকে ডাক্তারি পড়াবে, তাই সদরের স্কুলে বিজ্ঞান নিয়ে পড়তে পাঠিয়েছে, কিন্তু খরচ? সেই খরচের যোগাড়েই হরেনকে এখন ফি হপ্তায় দুবার করে চুরিতে বেরোতে হচ্ছে।”

“বলিস কী রে রুকুসুকু? অমন হীরের টুকরো মেয়েকে মানুষ করার জন্যে বাবাকে শেষ অব্দি চুরি করে বেড়াতে হচ্ছে? ছি, ছি, এতো আমাদেরই লজ্জা রে। এর একটা বিহিত তো না করলেই নয়,” মা খুব উত্তেজিত হয়ে বললেন।

সুকু এতক্ষণ কিছু বলে নি, চুপ করে সব কথা শুনছিল, সে বলল, “হ্যাঁ মা, এমন কিছু করুন যাতে ছোঁচা মল্লিককে আর চুরি করতে না হয়, অথচ শুক্লাদিদি ডাক্তার হয়ে শহরে ফিরে আসে।”

সুকুর এই কথায় কেউ কোন উত্তর দিল না। কিছুক্ষণ পর মা বললেন, “ঠিক আছে। আমি কালই আমাদের মহিলা সমিতির সভায় এই কথাটা পাড়বো, দেখি কী করা যায়।”  

আলু চচ্চড়ি দিয়ে গরম গরম চার খানা রুটি আর ভেলিগুড় দেওয়া ঘন চা। এই জলখাবার খেয়ে, রবিবার সকাল সাড়ে সাতটা নাগাদ হরেন পোল্লে তার দোকান খুলতে হাটের দিকে রওনা হল। গত দু হপ্তা জ্বরজ্বারিতে জেরবার হয়ে রাত্রে কোথাও বেরোতে পারে নি হরেন। বাজারও মন্দা, দোকানে বেচাকেনা নেই বললেই হয়। ঘরে টাকা পয়সার বাড়ন্ত, এমন চললে দিন পনের পর উনুনে হাঁড়ি চড়বে কিনা সন্দেহ। লেখাপড়া শিকেয় তুলে, শুক্লামাকেও দোকানঘরে এসে বসতে হবে, পুরোনো খবরের কাগজ দিয়ে ঠোঙা বানাতে হবে, নয়ত লোকের বাড়ি বাড়ি কাজে লাগতে হবে।

হরেনের মাথার মধ্যে এই চিন্তাগুলো সর্বদাই ঘুরপাক খাচ্ছে, আর এই চিন্তা করলেই তার দুচোখ ঝামড়ে জল চলে আসছে। ঝাপসা দুই চোখে তখন কিচ্ছু দেখতে পায় না। এখনো সে নিজের দুরবস্থার কথা ভাবতে ভাবতেই ঝাপসা চোখে সাইকেল চালাচ্ছিল।

চোখ ঝাপসাই হোক আর যাই হোক, হাটে যাবার এই রাস্তা তার এত চেনা, যে চোখ বন্ধ করেও হাটে পৌঁছে যেতে পারত। কিন্তু পারল না, সামনে আরেকটা সাইকেলের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে, পড়ে যেতে যেতেও ডান পায়ের ঠেকনো দিয়ে দাঁড়িয়ে গেল। সাইকেলের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা লোকটার দিকে তাকিয়ে তার মুখটাও ঝাপসা দেখল হরেন। সেই লোকটা খেঁকিয়ে উঠে বলল, “চোখে দেখতে পান না, কানা নাকি? একটা জলজ্যান্ত লোক সাইকেল খাড়া করে দাঁড়িয়ে, হাত নেড়ে দাঁড়াতে বলছি সেই থেকে, দৃকপাত না করে, ধাক্কা মেরে দিলেন?”

হরেন হাতের তালুতে চোখ মোছার পর স্পষ্ট দেখতে পেল লোকটাকে। লোকটা একলা নয়, তার পিছনে আরেকজন দাঁড়িয়ে আছে সাইকেল নিয়ে, আর তার দিকেই তাকিয়ে আছে। হরেন ধরা ধরা গলায় বলল, “আজ্ঞে, শোকেতাপে পোড়া মানুষ। দুঃখের কথা ভাবতে ভাবতে চোখে জল চলে এসেছিল, তাই অঘটনটা ঘটিয়ে ফেলেছি। কিছু মনে করবেন না। চোট টোট লাগে নি তো, দাদাভাই?”

“চোখে জল নিয়ে সাইকেল চালাচ্ছেন, এতো, ভাল কথা নয়, হরেনবাবু।”                   

পিছনের লোকটি এতক্ষণ কিছু বলে নি, এখন বলল, “হরেনবাবু, না ছোঁচা মল্লিকবাবু?”  তার এই কথায় ধাক্কা খাওয়া প্রথম লোকটি বলল, “নাকি বিশু মণ্ডলবাবু, না মটর সর্দারবাবু? কি নামে আপনাকে ডাকব বলুনতো, ভাই?”

লোকদুটোর এই সব কথায় হরেন পোল্লের পায়ের এবং সাইকেলের চাকার তলা থেকে মাটি সরে গেল। এ লোকদুটো যে সাধারণ লোক নয়, সেটা বুঝতে তার আর বাকি রইল না। কারণ তার এতদিনের তস্করজীবনে এই লোক দুটোই প্রথম, যারা তার নামরহস্য জানে! আতঙ্কে আর বিস্ময়ে হরেন ফ্যালফ্যাল করে তাকিয়ে রইল দুজনের দিকে। বলল, “আপনাদের তো আজ্ঞে, চিনতে পারলাম না, দাদাভাই। আমার মতো সামান্য লোকের এত তত্ত্বতালাশ জানলেনই বা কী করে?”

“কী করে জানলাম সেটা বড়ো ব্যাপার নয়, ছোঁচা মল্লিকবাবু। আমরা দুজনেই আসছি প্রফুল্লনগর থেকে, আমার নাম নেপাল ঘোষ, আর উনি দেবু নস্কর। আমরা সাতসকালে আপনার অপেক্ষাতেই এই পথে দাঁড়িয়েছিলাম, আপনাকে প্রফুল্লনগর নিয়ে যাব বলে।”

“আপনারা কি পুলিশ?”

“পুলিশ হলে কি খুব ভালো হত, মটরবাবু? কোমরে দড়ি বেঁধে, হাতকড়া পরিয়ে সকলের সামনে দিয়ে টেনে নিয়ে গেলে তবেই না পুলিশ? হাটের লোকজন কী মনে করত, তাতে কি আপনার সম্মান বাড়ত? না মটরবাবু, আমরা পুলিশ নই।” দেবু নস্কর মিচকে হেসে উত্তর দিল।

“সাইকেলে চেপে পড়ুন, হরেনবাবু। কতটুকুই বা পথ, তিনজনে সুখদুঃখের গল্প করতে করতে দিব্যি চলে যাব। সেখানে গেলে আপনার ভালোই হবে, চাই কি আপনার জীবনের আর আপনার মেয়েকে নিয়ে সব স্বপ্নও হয়তো পূরণ হয়ে যাবে।”

“আমার মেয়েকেও চেনেন, আপনারা? আমার মেয়েটা যদি জানতে পারে, আসলে আমি একটি চোর, ও বোধহয় আর বাঁচবে না। ওর কানে যেন এই সব কথা না যায়, দাদাভাই, সেটা একটু দেখবেন।” বলতে বলতে হরেন পোল্লের গলা ভারি হয়ে এল, আবার তার চোখ ঝাপসা হয়ে উঠল। নেপাল ঘোষ হরেনের হাত ধরল, দেবু নস্কর হাত রাখল তার কাঁধে, তারপর নেপাল ঘোষ  বলল, “আপনার মেয়ে, আমাদের জেলার গর্ব, তাকে আমরা হেরে যেতে দেব না, হরেনবাবু। এখন তাড়াতাড়ি চলুন, দেরি হয়ে যাচ্ছে।”   

ওদের পৌঁছে যাবার খবর পেয়ে সমিতির হলঘরে শহরের গণ্যমান্য লোকজন এবং সমিতির মহিলারা এসে জড়ো হলেন। তখন সাড়ে এগারোটা বাজে। স্টেজের নীচেয় সকলের সামনে হরেন পোল্লেকে দাঁড় করিয়ে দিল নেপাল ঘোষ ও দেবু নস্কর। তারপর সকলের দিকে তাকিয়ে নেপাল ঘোষ পরিচয় করিয়ে দিয়ে বলল,

“আমাদের এই নিরিবিলি প্রফুল্লনগরে, দুমাসে তিন তিনটি চুরি করে অশান্তি এনে দিয়েছে যে লোকটি, তার নাম হরেন পোল্লে। এই হচ্ছে সেই লোক। উপস্থিত দিদিভাই ও দাদারা, এখন আপনারাই ঠিক করুন এর কী শাস্তি হওয়া উচিৎ।”

এত গণ্যমান্য লোক এবং মহিলাদের দেখে হরেন পোল্লের হাঁটু কাঁপতে লাগল। রাতের অন্ধকারে নিখুঁত দক্ষতায় লোকের বাড়ি বাড়ি চুরি করতে যার বুক কাঁপে না, আজ এই উজ্জ্বল আলোর হলঘরে, ভয়ে তার বুক ধড়ফড় করতে লাগল। গলা শুকিয়ে কাঠ, জিভটাকে মনে হচ্ছে শুকনো কাঠের টুকরো। সামনের সারির বাঁদিক ঘেঁষে বসে আছেন থানার ছোটোবাবু, তাঁর পিছনে দাঁড়িয়ে আছে দুজন হাবিলদার।

পাশে দাঁড়ানো নেপাল ঘোষকে হরেন পোল্লে বলল, “দাঁড়াতে পারছি না, দাদাভাই, একটু বসব?” বলে স্টেজের দেওয়ালে হেলান দিয়ে হলের মেঝেতেই থেবড়ে বসে পড়ল।

“আরে দাঁড়ান, দাঁড়ান, ওখানে বসছেন কেন, চেয়ার দিচ্ছি।” দেবু নস্কর ব্যস্ত হয়ে বলে উঠল।

“না দাদাভাই, এই বেশ আছি। বড়ো দুব্বল লাগছিল, এখন একটু ভাল বোধ হচ্ছে।”

কেউ একজন এক গ্লাস জল এনে দিতে জলটা ঢক ঢক করে খেয়ে খুব শান্তি পেল হরেন পোল্লে। তারপর মাথা নীচু করে চুপ করে বসে রইল।

একটু পরে রুনু-ঝুনুর মা উঠে দাঁড়িয়ে সকলের উদ্দেশে বললেন, “শ্রদ্ধেয় নাগরিকবৃন্দ ও আমাদের সমিতির সদস্যাগণ, এই লোকটি একজন চোর। সামান্য পুঁজির ইলেকট্রিক দোকান থেকে এর ছোট্ট সংসার প্রতিপালন হত না। সেই অভাব ঘোচানোর জন্যে ছোটোখাটো চুরি করতে করতে আজ এই লোকটি একজন মহাচোর। এই চোরের আতংকে আমাদের রাতের ঘুম চলে গেছিল। আজ এই লোকটি ধরা পড়ে, অসহায় হয়ে আমাদের সামনে হাজির। গত রবিবারেও এই সমিতি ঘরেই, আমাদের একটি সভা হয়েছিল। সেই সভায় আমাদের সকলেই এক মত হয়ে এই লোকটির কী শাস্তি দেওয়া হবে, সে সিদ্ধান্ত আমরা নিয়েছিলাম। এখন আমি মহিলা সমতির প্রধান আলোকা দত্তকে অনুরোধ করব, তিনি সামনে এসে তাঁর দেওয়া সেই কঠোর শাস্তির কথা ঘোষণা করুন।”

আলোকা দত্ত সামনে এগিয়ে এলেন, প্রথমে হরেন পোল্লের দিকে তাকালেন তারপর সকলের মুখের দিকে তাকিয়ে বলতে শুরু করলেন, “এই লোকটি, যার নাম হরেন পোল্লে সে একজন চোর। ভদ্রলোক নয়, একজন লোক। আর এই হল-এ বাকি আমরা সবাই ভদ্রলোক।  আজ আমরা যারা এই কারখানায়, বিভিন্ন জায়গা থেকে কাজ করতে এসেছি, আমরা সবাই ভদ্রলোক। কিন্তু আজ আমাদের এই কারখানাটা যদি বন্ধ হয়ে যায়, কাল সকাল থেকে আমাদের কাজটা যদি আর না থাকে? আমরাও কি পারব এইরকম ভদ্রলোক থাকতে? নাকি কিছুদিন ভদ্রলোক থাকার চেষ্টা করতে করতে, আমরাও হেরে গিয়ে, ভদ্রতা হারিয়ে, ঐ লোকটির মতোই হরেন পোল্লে কিংবা মটর সর্দার অথবা ছোঁচা মল্লিক হয়ে উঠব? আপনারা উপস্থিত সকলে একবার চিন্তা করে দেখুন তো, ভদ্র অভদ্র ব্যাপারটা কি হাওয়ার মতো খুব হালকা নয়?”

আলোকা দত্ত কিছুক্ষণের জন্যে থামলেন, সে সময় হরেন পোল্লে মুখ তুলে তাকাল তাঁর দিকে। দু চোখ থেকে তার জলের ধারা নেমে আসছে। দুই হাত জড়ো করে সে আলোকা দত্তের দিকে নমস্কার করে, আবার মুখ নিচু করে মেঝের দিকে তাকিয়ে বসে রইল।

“হরেনবাবু, ওই জোড়হাত আর চোখের জল দেখে আপনার শাস্তি মকুব হবে না। আপনাকে কঠোর শাস্তি পেতেই হবে। তার আগে আপনাকে কথা দিতে হবে, আপনি আর চুরি করবেন না। বলুন, কথা দিন।”

“কথা দিলাম, দিদিভাই, কোনদিন আর চুরি করব না,” হরেন কাঁপা কাঁপা গলায় বলল।

“তাহলে আপনার সংসার চলবে কী করে? আপনার মেয়ে শুক্লা ডাক্তার হবে কী করে?”

“সে সব আর হবে না, দিদিভাই। মেয়েকে লেখাপড়া ছাড়িয়ে কোন কাজে ঢুকিয়ে দেব। মা, মেয়ে, আমি সবাই মিলে খাটলে সংসারটা টিকে যাবে, দিদিভাই, ভাববেন না। কিন্তু নাঃ, এই চোরের কাজ করে সত্যি খুব ছোটো হয়ে যাচ্ছিলাম দিন দিন, আর করব না। যে স্বপ্ন পূরণ হবার নয়, সে স্বপ্ন আর দেখবই না।”

“শুক্লার মতো মেধাবি ছাত্রীকে আমরা তো এমন সর্বনাশের দিকে ঠেলে দিতে পারি না, হরেনবাবু। চুরি করেছেন, তাও আমরা আপনাকে পুলিশে দিইনি। কিন্তু লেখাপড়া ছাড়িয়ে শুক্লাকে এখন কাজে লাগিয়ে দিলে আমরা সবাই মিলে আপনাকে পুলিশে দিয়ে দেব। দেখেছেন তো আমাদের সঙ্গে দারোগাসায়েবও আছেন?

হরেনবাবু, আপনার পুলিনগড় হাটের ঐ দোকান তুলে দিন। আমরা আমাদের এখানে দোকান করার জন্যে আপনাকে দোকানঘর দেব, বড়ো রাস্তার ধারে, ইলেকট্রিকের আলো ফ্রি। আমাদের এই সমিতির সকলে আপনার সঙ্গে সবরকমের সহযোগিতা করবো। আপনার দোকান থেকে আমরা সবাই জিনিস কিনব। আমাদের বাড়িতে ইলেক্ট্রিকের সমস্যা হলে আমরা আপনাকেই ডাকব। আমাদের এই শহর ছোট্ট হলেও, আপনার ঐ পুলিনগড়ের থেকে অনেক বেশি লোকজন থাকে। অতএব আপনার বিক্রিবাটা খারাপ হবে না। আর সবার শেষে বলি, আমাদের মহিলা সমিতি আর নাগরিক সমিতি থেকে আপনার মেয়েকে প্রত্যেক মাসে দেড় হাজার টাকা বৃত্তি দেওয়া হবে।

নেপালভাই, দেবুভাই তোমরা হরেনবাবুকে দোকানঘর দেখিয়ে দাও। কালকে সন্ধের মধ্যেই যেন ওঁনার এই দোকান চালু হয়ে যায়, আমরা সবাই যাবো সেই নতুন দোকান দেখতে। আর হরেনবাবু, আপনার বা আপনার মেয়ের ব্যংকে অ্যাকাউন্ট আছে? না থাকলে দু পাঁচদিনের মধ্যে খুলে নিন, আমরা শুক্লার বৃত্তির টাকাটা তার নামে ব্যাংকেই জমা দেব।” 

হরেন কাঁদতে কাঁদতে উঠে এসে আলোকা দত্তর পায়ে ধরতে নিচু হচ্ছিল। আলোকা দত্ত জোর ধমকে বলে উঠলেন,  “মাথা নিচু করে প্রণাম ট্রণাম করবেন না, হরেন বাবু। মাথা উঁচু করে বাঁচতে শিখুন। আপনাকে আমরা সবাই মিলে যে সুযোগ দিলাম, সেখান থেকে আবার যদি বিপথে যান, তাহলে কিন্তু আপনাকে আমরা ছেড়ে দেব না। মনে রাখবেন আপনার প্রত্যেকটি গতিবিধি, সর্বক্ষণ লক্ষ করবে দুইভাই, রুকুসুকু। আপনি তাদের দেখতে না পেলেও, জানবেন তারা আছে। তাদের থেকেই আপনার সব বৃত্তান্ত আমরা সবাই জেনেছি। আমাদের অনুরোধ, আপনার মেধাবি মেয়েটিকে মাথা তুলে বাঁচতে দিন, আপনিও মাথা তুলে বাঁচার লড়াই চালিয়ে যান। ব্যস, এই আপনার শাস্তি।”

galpoapahari haren01 (Medium)

এই ঘটনার মাস ছয়েক পরে, পুজোর ছুটির পর হরেন পোল্লে মেয়েকে সদর স্কুলের বোর্ডিংয়ে রাখতে যাচ্ছিল। বাসে দেখা নিত্য মণ্ডলের সঙ্গে। গাঁ ঘরের কথা আলোচনা হতে হতে, নিত্য হঠাৎ বলে উঠল, “আমাদের এদিকে চুরিচামারিটা একদম বন্ধ হয়ে গেছে, জানো? শুনেছি এদিকের ছোঁচা মল্লিক বলে চোরটাকে আর নাকি দেখাই যায় না। বাইরে কোথাও চলে গেছে, বোধ হয়।”

হরেন পোল্লে ঘাড় নেড়ে সায় দিল আর মনে মনে বলল, ‘হুঁ, বিশু মণ্ডল, হারু বাগ, ছোঁচা মল্লিক কিংবা মটর সর্দার, কোন চোরকেই আর কোনদিন খুঁজে পাওয়া যাবে না, কারণ তারা সব্বাই নতুন করে বাঁচার মন্ত্র পেয়ে গেছে’! 

ছবিঃ অংশুমান