সাতটা সমুদ্র আর তেরোটা নদী পেরোলে পড়বে একটা পাহাড়ের দেশ। সেই পাহাড়ের কোলে অনেক রাজ্য আছে। সে যে কতগুলো রাজ্য, ছোটো ছেলেমেয়েরা হাতে গুনে শেষ করতে পারবে না। তারই মধ্যে একটা ছোট্ট রাজ্য আছে, সে রাজ্যের নাম নিসর্গগড়।
যেমনই তার নামের বাহার, তেমনই তার প্রাকৃতিক শোভা। সে রাজ্যের গাছে গাছে সারাবছরই নানা রঙের ফুল ফুটে থাকে। সব ঋতুতে সমান ফুল ফোটে। বসন্তেও যা বর্ষায়ও তাই। একটু কমও না, একটু বেশিও না। সারাবছর ধরে মন দিয়ে বসে বসে এসব ফুল ফুটতে দেখে সে রাজ্যের আনমনা রাজপুত্র। কত আর তার বয়স? ন’ বছর হবে! সে রাজপুত্রের নাম সহায়কেতু।
সেই রাজ্যের সব নদীতে সারা বছরই সমান জল থাকে। বর্ষায়ও যা, গ্রীষ্মেও তাই। জোয়ার-ভাটায় কখনওসখনও জল কমে-বাড়ে বটে, তার পর আবার যে-কে সেই! তখন তুমি তাকে জোয়ারও বলতে পার, আবার ভাটা বলে বসলেও কোনও ক্ষতি নেই। কেমন করে যেন জল সমান হয়ে যায়। আর নৌকো? সে কথা যদি বল, আকাশ আঁধার করে আসা কালবৈশাখীর ঝড়ের দিনেও যত নৌকো বয়ে যেতে দেখবে সে নদীর জলে, কনকনে মাঘের শীতের দিনেও সমান নৌকোকেই ভেসে যেতে দেখবে। একটু কমও না, একটু বেশিও। এসব গুনে গুনে দেখেছে সে রাজ্যের আর-এক আপনভোলা রাজপুত্র। কত আর তার বয়স হবে? বছর সাতেক। সে রাজপুত্রের নাম সম্বলকেতু।
সেই রাজ্যের গোটা আকাশের গায়ে সারা বছরই নীল আর সাদা মেঘের ভেলা যেতে দেখা যায়। সে শরতের দিনেও যা, ঘনঘোর নাছোড় বাদলের দিনেও তাই। কখনও বাদল মাথায় করে সেসব মেঘের ভেলা সাজগোজ করে দু’-দশটা কমও আসে না, আবার শরতের দিনে কাশ ফুলের মুকুট মাথায় আর শিউলি ফুলের মালা গলায় পরে সেজেগুজে দশ-বিশটা বেশিও বেরোয় না। এসব দেখে দেখে তার খাতার পাতায় সব লিখে রাখে সহায়কেতু।
সেই রাজ্যের পাহাড়টা রোজ দু’ বেলা মেঘের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে এই ভাব করে তো, এই আড়ি করে। কখনও দিনেরবেলা শুধুই আড়ি আর শুধুই আড়ি। আবার সন্ধে হয়েছে কি হয়নি, আকাশে তারা ফুটেছে কি ফোটেনি, চাঁদ উঠেছে কি ওঠেনি, তখন শুধুই ভাব আর ভাব। দিনেরবেলার আড়ির সংখ্যা কখনও এক-আধটা কমেও না। ফের রাতেরবেলার ভাব, সেও গোনাগুনতি। এক-আধটা বেশিও হয় না। রাজপুত্র সম্বলকেতু এসব গুনেগেঁথে রাখে আকাশের তারার গায়ে দাগ কেটে কেটে।
ওই দুই রাজপুত্রের কাণ্ড দেখে ছোটোদের কিন্তু বেশ লাগে! তারাও পড়ালেখা ফেলে সারাদিন ওই দুই রাজপুত্রের সঙ্গে টইটই করে কাটিয়ে দিতে পারলে দারুণ খুশি হয়। কিন্তু তার আর জো নেই। লেখাপড়া না করলে বাড়িতে বড়োদের বকুনি বাঁধা। কিন্তু ওরা, ওই রাজপুত্ররা যে পড়ালেখা করে না?
বড়োরা বলেন, ‘‘ওরা যে রাজপুত্র, ওদের সঙ্গে নিজেদের তুলনা করতে নেই!’’
রাজপ্রাসাদের বাইরের কেউ এ নিয়ে কথা বলাবলি না করলে কী হবে, এ নিয়ে নিসর্গগড়ের রাজার কিন্তু চোখে একটুও ঘুম নেই, মনে একটুও শান্তি নেই। নিসর্গগড়ের রাজার নাম তরঙ্গকান্তি। ইদানিং কী যে হয়েছে, তাঁর একটুও মন ভালো নেই।
রাজামশাইয়ের মন খারাপ দেখে রানি হিল্লোলকুমারীর মনেও চিন্তার মেঘ ভেসে বেড়ায়। সূর্য গাছপালার মাথায় ওঠার আগেই তিনি যখন গোলাপ জলের দিঘিতে স্নান করতে যান, একটুও জলে নামতে তাঁর ইচ্ছে করে না। শ্বেতপাথরের ঘাটে চুপ করে বসে থাকেন। দাসীরা তখন বায়না করে, অনুনয় বিনয় করে, ‘‘রানিমা, বেশি না হোক, মাত্র একহাঁটু জলে নামুন!’’
হেড দাসী অনুরোধ করে বলে, ‘‘একহাঁটু নয় রানিমা, একগলা জলে নামতেই হবে। না হলে এসব কথা রাজামশাইয়ের কানে হুশ করে এক্ষুনি পৌঁছে যাবে। পৌঁছে গেলে যে তিনি বেজায় চটে যাবেন, সে কথা কি আর বলতে? হয়তো আমাদের মাথা কাটা যাবে মশানে! নয়তো কমের কম শাস্তি হলে চাকরিটাও চলে যেতে পারে!’’
তখন রানিমা মুখ ভার করে, নোলক দুলিয়ে বলেন, ‘‘যাক! তোদের চাকরি চলে যাক! তোরা তখন অন্য রাজ্যে চলে যাবি! এই পাহাড়ের দেশে কি রাজ্যের অভাব আছে নাকি? সেসব রাজ্যে কত কত রানি আছে। তাদের সব সময় কত কত দাসদাসীর দরকার পড়ে। তোরা এখন আমার সামনে থেকে যা তো! আজ আমার মন ভালো নেই! মন ভালো না থাকলে কি কেউ গোলাপ জলের সরোবরে স্নান করে?’’
সাত দিনের সপ্তাহে শুধু একদিন বিকেলে রানিমার সাজগোজের দিন। রাজজ্যোতিষীর কাছ থেকে খোঁজখবর নিয়ে সে দিনটা ঠিক করে দিয়েছেন রাজামশাই নিজে। সে দিনটা মঙ্গলবার। সেদিন রাজা তরঙ্গকান্তির মায়ের বিশাল ছাদ সমান উঁচু গাছসিন্দুক খোলা হয়। সিন্দুকের পাশে থির হয়ে বসে থাকেন রানিমা।
সেই সিন্দুক খোলাও কি চাট্টিখানি কথা! সতেরোখানা বাহির-তালা, তেত্রিশখানা ভিতর-তালা খুলতে হয় নানা কসরত করে। সিন্দুকের পাহারায় থাকা পাঁচজন প্রহরী সেসব তালা ঘোরাতে ঘোরাতে ঘেমেনেয়ে একশা হয়ে যায়। কারও কারও মাথাও ঘোরে তালপাতার চরকির মতো বনবন করে। তারপর সেই তালাগুলো খুলে গেলে, খবর যায় রাজামশাইয়ের কাছে, রাজদরবারে। তারপর সোজা রাজামশাইয়ের কাছ থেকে সে খবর গিয়ে পৌঁছয় হেড প্রহরীর কাছে। তখন হেড প্রহরী গভীর ঘুম ভেঙে উঠে সোজা হয়ে দাঁড়ান। তারপর তিনি কাঁধে তুলে নেন মস্ত বড়ো একটা সোনার চাবি। তাঁর কাঁধে তখন ঝকমক করতে থাকে আধ মন ওজনের সেই সোনার চাবিটা। সকলে হাঁ করে তাকিয়ে থাকে সেই চাবিটার দিকে।
তারপর হেড প্রহরী সিন্দুকের সামনে গিয়ে একশো এগারোটা প্যাঁচ ঘোরালে তবে ঘটাং করে একটা জোর শব্দ হয়। দেউড়িতে রাত-প্রহরের ঘণ্টা পড়ার মতো জোর সে শব্দ। সব সময় যে একশো এগারোটা প্যাঁচ ঘোরাতে হয়, তা কিন্তু নয়। কোন মঙ্গলবার ক’টা প্যাঁচ ঘোরাতে হবে সে নির্দেশ আসে হেড প্রহরীর কাছে রাজামশাইয়ের কাছ থেকে।
তারপর পাঁচজন প্রহরী মিলে গায়ের সমস্ত জোর দিয়ে সিন্দুকের ডালা খোলে। তখন থরে থরে সাজানো গয়না দেখে ন’জন দাসীরই চোখ বড়ো বড়ো হয়ে যায়। নয়নতারা বলে যে দাসীটার চোখ দুটো একটুখানি ছোটো, তখন কেমন করে যেন তার ছোটো চোখ দুটোও বড়ো বড়ো হয়ে যায়।
সিন্দুকটা হিরের আর সোনার গয়নায় ভরতি। কোনওটায় আবার মরুভূমির বালির মতো অসংখ্য মণি বসানো আছে, আবার কোনওটায় আকাশের তারার মতো অগুনতি মুক্তো!
এবার মঙ্গলবার এল। বিকেলবেলা পাঁচজন প্রহরী আর একজন হেড প্রহরী মিলে খুলে দিল সিন্দুকের ডালা। ন’জন দাসী রানিমাকে গয়না পরাতে এগিয়ে এল। রানিমা ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘‘আজ তোরা সব সরে যা! আমার আজ সাজগোজে মন নেই।’’
এ কী কথা? ন’জন দাসী মাথায় হাত দিয়ে বসে পড়ল মখমল পাতা মেঝেতে। রাজা তরঙ্গকান্তির বিয়ে হয়েছে আজ বারো বছর হল। রানিমার মুখ থেকে এমন কথা কেউ কখনও শোনেনি। রানিমার অমন ইচ্ছের কথা যদি রাজামশাইয়ের কানে যায়, তা হলে কী হবে?
বিকেল গড়াতে না গড়াতেই এ কথা সত্যি সত্যি পৌঁছে গেল সটান রাজামশাইয়ের কানে। রাজারাজড়াদের ব্যাপার তো, কথা পৌঁছতে সময় লাগে না। রাজামশাইয়ের কানে এসব কূটকচালি খবর পৌঁছে দেওয়ার জন্যেও নাকি মাইনে করা লোক আছে। তাদের নাকি এটাই চাকরি! কারা যে সেসব মাইনে করা লোক, রাজপ্রাসাদের কেউ তাদের চেনে না। কেউ কেউ বলে দাসদাসীর সঙ্গেই নাকি মিশে থাকে সেসব লোক।
এ খবর শোনার পর অন্য সময় হলে রাজা কারও মাথা কাটার আদেশ দিতেন মশানে নিয়ে গিয়ে। কাউকে অন্ধকার কারাগারে বন্দি করে রাখার আদেশ দিতেন সারা জীবনের জন্যে। কাউকে বা দূর করে তাড়িয়ে দিতেন সাতটা রাজ্যের ওপাশের একটা বাঘ-ডাকা গভীর জঙ্গলের মধ্যে। কিন্তু আজ রাজামশাই এ খবর পাওয়ার পর কাউকে রাজদরবারে ডেকেও পাঠালেন না। রেগেও গেলেন না একটুও! সকলে রাজা তরঙ্গকান্তির এমন কাণ্ড দেখে অবাক-তাজ্জব হয়ে গেল। মনে মনে ভাবল, যাক, এ যাত্রায় মনে হয় চাকরিটা বেঁচে গেল দাসীদের!
রাজপ্রাসাদের সকলেই বলাবলি করতে লাগল, ‘‘কেন এমন হল? এ কি রাজ্যের পক্ষে ভালো, নাকি খারাপ?’’
কেউ কোনও উত্তর দিতে পারল না। আগের মতোই পাখি উড়তে লাগল গাছে গাছে, গান গেয়ে চলল নিজের মনে। ডালে ডালে রংবেরঙের ফুল ফুটতে লাগল আগের মতোই। নদী বয়ে চলল ঘড়ির সময় ধরে। পাহাড় মাথা উঁচু করে মনের কথা বলতে লাগল মেঘের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। আকাশের নীল আর সাদা মেঘের ভেলাগুলো হাসিমুখে নেমে এল নিসর্গগড়ের মাথার উপর।
।। ২।।
এর কয়েক দিন পরে একদিন রানি হিল্লোলকুমারী আনমনা হয়ে বসে ছিলেন শয়নকক্ষের পালঙ্কের বাজুতে ঠেস দিয়ে। ঘরের আলো নেভানো। বাইরে থেকে খড়খড়ির ফাঁক দিয়ে যেটুকু চাঁদের আলো যা গড়াগড়ি খাচ্ছে শ্বেতপাথরের মেঝের উপর। এমন সময় ধীরপায়ে রাজামশাই ঘরে ঢুকলন।
রানি রাজামশাইকে বললেন, ‘‘আপনি রাজপুত্রদের কথা কিছু ভেবে দেখেছেন? একজন বেজায় আনমনা, আর-একজন ভীষণ আপনভোলা। বড় হলে এদের মধ্যে কার উপর রাজ্যের ভার তুলে দেবেন মহারাজ?’’
রাজা তরঙ্গকান্তি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘‘সেসব ভেবেই তো আমারও চোখের পাতা রাতে এক হয় না! আমার আর রাজ্যশাসনে মন নেই!’’
রানি বললেন, ‘‘আপনি দুই রাজপুত্রকে বরং দূরের তপোবনে গুরুগৃহে রেখে আসুন! ওরা সেখানে শাস্ত্রপাঠ করুক, নিয়মের মধ্যে বড়ো হোক!’’
রাজা মুখ তুলে বললেন, ‘‘তপোবন তো রাজপুত্রের জায়গা নয় রানি! তপোবনে গুরুগৃহের অত কষ্ট কি ওরা সইতে পারবে? অমন আনমনা আর আপনভোলা রাজপুত্রদের যদি তপোবনে জায়গা না হয়?’’
রানি হিল্লোলকুমারী বললেন, ‘‘আমি দুই রাজপুত্রের সঙ্গে যাব মহারাজ। গিয়ে অনুনয় করব গুরুজিকে।’’
রাজা ঘাড় নাড়লেন, ‘‘কিন্তু রাজপুত্ররা ঘোড়ায় চড়া শিখবে না, অস্ত্রবিদ্যা জানবে না, তরবারি ধরতে শিখবে না, কুস্তির প্যাঁচ লড়বে না, তা কি হয়? তারা তপোবনে গিয়ে সরোবরে পদ্মফুল তুলবে, রাজহাঁসের পিঠে চড়ে সাঁতার কাটবে, ফুল পেড়ে মালা গাঁথবে, হরিণের পিছনে ছুটে ছুটে দুপুরটাকে বিকেল করে দেবে, পাখির মাঝখানে পাখি হয়ে বসে থাকবে, সে কি ভালো হবে?’’
রানি ঘাড় নেড়ে বললেন, ‘‘শুনেছি, সেখানে মানুষ তৈরি করা হয়। আমাদের দুই রাজপুত্র যদি মানুষ হয়ে ওঠে, তাই বা কম কী মহারাজ? ওদের অন্তত শাস্ত্রবিদ্যায় তো জ্ঞান হোক!’’
অমত হয়ে রাজা তরঙ্গকান্তি ঘাড় নাড়লেন। আর তখন নাছোড় হলেন রানি হিল্লোলকুমারী।
এমনি করেই দিন গড়িয়ে যেতে লাগল নিসর্গগড়ের রাজপ্রাসাদে। আপন মনে বড়ো হতে লাগল দুই রাজপুত্র সহায়কেতু আর সম্বলকেতু। বিষণ্ণ মনে রাজা তরঙ্গকান্তিও বয়সের ভারে ক্লান্ত।
।। ৩।।
একদিন রাজদরবার একেবারেই ফাঁকা। রাজা তরঙ্গকান্তি চুপ করে বসেছিলেন সিংহাসনে। আজ তিনি একটু একা থাকতে চান। তাই কাউকেই রাজদরবারে আসার অনুমতি দেননি।
এমন সময় বড়ো রাজপুত্র সহায়কেতু হন্তদন্ত হয়ে ঢুকল দরবারে। রাজামশাইকে বলল, ‘‘বাবা, আমি জঙ্গলের ওদিকে গিয়েছিলাম, আজ ফুল ফুটতে কেন এত দেরি হচ্ছে তার খবর নিতে। গিয়ে দেখি কী, একটা লোক লুকিয়ে লুকিয়ে বড়ো একটা গাছ কাটছে। আমি তাকে নিষেধ করলাম। তবু সে শুনবে কি? গাছ কেটেই চলছিল। তারপর একটু থেমে সে বলল, ‘‘আমি কাঠুরে। কাঠ কেটেই আমার দিন চলে রাজকুমার। গাছ না কাটলে খাব কী করে?’’
রাজামশাই ঘাড় নাড়লেন, ‘‘তারপর? সেই কাঠুরে কোথায়? তাকে ধরে আনলে না কেন? তার কঠোর সাজার ব্যবস্থা করতাম।’’
দু’ হাত নেড়ে রাজপুত্র সহায়কেতু বলল, ‘‘তাকে বেঁধে এনেছি আমি। দরবারের বাইরে প্রহরীর কাছে রেখে এসেছি। আপনি বললে, তাকে এখন দরবারে নিয়ে আসি।’’
সঙ্গে সঙ্গে রাজা তরঙ্গকান্তি প্রহরীকে হুকুম করলেন, ‘‘যাও, এক্ষুনি মন্ত্রীকে ডেকে আনো।’’
প্রহরী রাজদরবার থেকে বেরিয়ে যাচ্ছিল। রাজামশাই পিছন থেকে তাকে ডেকে বললেন, ‘‘শোনো, আসার সময় হেড ঘাতককেও দরবারে নিয়ে এসো, এক্ষুনি।’’
প্রহরীর কাছ থেকে রাজামশাইয়ের তলব পেয়ে সঙ্গে সঙ্গে হাজির হলেন মন্ত্রীমশাই। তাঁর পিছন পিছন এসে দাঁড়াল নিসর্গগড় রাজ্যের হেড ঘাতক। মুখে লম্বা গোঁফ। রামায়ণের রাবণের মতো দেখতে লোকটাকে। তার কাঁধে বিরাট খড়্গ। দরবারের আলো পড়ে চিকচিক করছে সেই খড়্গের তীক্ষ্ণ ধার। তার পিছনে প্রহরী।
রাজা প্রহরীকে আদেশ করলেন, ‘‘যাও। কাঠুরেকে হাজির করো।’’
নিয়ে আসা হল কাঠুরেকে। ভয়ে ঠকঠক করে আমলকী পাতার মতো কাঁপছে সে। কেননা, সে এ রাজ্যের হেড ঘাতক আর তার ওই খড়্গটা ভালো করেই চেনে। আগে একবার একটা চোরকে মশানে নিয়ে গিয়েছিল এই লোকটা। কাঠুরে পরে শুনেছে, সেবার চোরটার মাথাটা কেটে শাস্তির ব্যবস্থা করেছিল এই ঘাতকই।
রাজা সিংহাসন থেকে উঠে দাঁড়ালেন। কাঠুরেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘তুমি জঙ্গলে গাছ কাটছিলে? জানো, গাছ কাটার নিয়ম নেই এ রাজ্যে?’’
কাঠুরে কাঁপতে কাঁপতে বলল, ‘‘মহারাজ, আমি গাছ না কাটলে যে না খেয়ে মারা যাব। এই করেই তো আমার সংসার চলে!’’
রাজা হুঙ্কার দিয়ে উঠলেন, ‘‘রাজার মুখের উপর কথা! ঘাতক, একে মশানে নিয়ে যাও। তারপর সকলের যা পরিণতি হয়, তাই করো।’’
ঘাতক উদ্যত খড়্গ তুলে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে যেতে লাগল কাঠুরেকে। এমন সময় রাজপুত্র সহায়কেতু দু’ হাত তুলে পথ আগলে দাঁড়াল ঘাতকের। বলল, ‘‘দাঁড়াও ঘাতক!’’ তারপর রাজা তরঙ্গকান্তির দিকে অনুনয় করে বলল, ‘‘বাবা, কাঠুরেকে শাস্তি দিয়ে কী হবে? আর একজন কাঠুরে অমন করে পেটের দায়ে ফের জঙ্গলে যাবে গাছ কাটতে। ফের আপনি তাকেও মশানে নিয়ে গিয়ে হত্যার আদেশ দেবেন? এটা তো রাজার মতো কাজ হল না। বরং আপনি কাঠুরেদের রোজগারের ব্যবস্থা করে দিন। যাতে ওদের বেঁচে থাকতে গেলে যেন আর গাছ না কাটতে হয়।’’
থমকে গেল ঘাতকের উদ্যত খড়্গ। মন্ত্রী হাঁ করে তাকিয়ে রইলেন কী আদেশ আসে রাজামশাইয়ের মুখ থেকে শোনার জন্যে।
রাজামশাই একটুক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর ঘাতককে আদেশ করলেন, ‘‘তুমি ফিরে যাও তোমার ঘাতকনিবাসে।’’ তারপর মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘শুনুন মন্ত্রীমশাই, সহায়কেতুর কথাই ঠিক! আপনি এ রাজ্যের কাঠুরেদের অন্য কোনও কাজের ব্যবস্থা করার কথা ভাবুন। যাতে তাদের আর গাছ না কেটে সংসার চলে!’’ একটু থেমে বললেন, ‘‘আর হ্যাঁ, স্বর্ণশিল্পীকে খবর দিন, কালকের মধ্যে আমার সিংহাসনের পাশে যেন একটা ছোটো সোনার সিংহাসন বানিয়ে দেয়।’’
রাজা তরঙ্গকান্তি রাজপুত্র সহায়কেতুর পিঠ চাপড়ে দিয়ে বললেন, ‘‘তুমি আনমনা হলে কী হবে, তোমার মধ্যে কবে কবে রাজ্যচালনার ক্ষমতা তৈরি হয়েছে, আমি বুঝতে পারিনি! তুমি কাল থেকে নতুন সিংহাসনে আমার পাশে বসবে। রাজকার্যে তোমার সুন্দর পরামর্শ আমার দরকার হবে!’’
এই খবর সেদিনই বাতাস হয়ে ছড়িয়ে পড়ল নিসর্গগড় ছাড়াও আশেপাশের দশ-বিশটা রাজ্যে। সকলে সহায়কেতুকে ধন্য ধন্য করতে লাগল।
সেদিন সন্ধেবেলা যখন চাঁদের আলোয় ভেসে যাচ্ছে নিসর্গগড়, রাজা শয়নকক্ষে এসে রানি হিল্লোলকুমারীকে বললেন, ‘‘আজ আমি নিশ্চিন্ত মনে ঘুমোব! আজ থেকে আমার রাজ্যচালনার আর চিন্তা নেই!’’
তারপর রানিকে সব ঘটনা খুলে বললেন রাজা তরঙ্গকান্তি। সহায়কেতুর গুণপনার কথা শুনে আশ্বস্ত হলেন রানিও।
সেদিন কাউকে কিছু না জানিয়ে অনেকক্ষণ ধরে আকাশকে জ্যোৎস্না দান করল সোনার থালার মতো গোল চাঁদ।
।। ৪।।
এখন রাজদরবারে রাজামশাইয়ের পাশে বসে রাজপুত্র সহায়কেতুও। নানা রাজকার্যে তার সুচিন্তিত পরামর্শ কাজে লাগে। আর রাজ্য-বিরাজ্যের মানুষ সহায়কেতুর প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়।
অমন একদিন রাজদরবার গমগম করছে। কত লোক এসেছে রাজার কাছে সুবিচার চাইতে। কত অসহায় মানুষ এসেছে একটুখানি রাজার ভালোবাসা পেতে। নিরাশ্রয় মানুষ এসেছে রাজার কাছে এক চিলতে আশ্রয়ের আশায়।
দেখতে দেখতে ছোটো রাজপুত্র আপনভোলা সম্বলকেতুও বড়ো হয়ে উঠল। এমন সময় একদিন সম্বলকেতু একটা লোককে টানতে টানতে নিয়ে এসে ঢুকল রাজদরবারে। ছেঁড়া লুঙ্গি পরা লোকটার মাথায় গামছার ফেট্টি বাঁধা। লোকটার হাতে একটা বড়ো খাঁচা। খাঁচার ভিতর কিচিরমিচির করছে রংবেরঙের কত পাখি। লোকটা পাখি ভরতি খাঁচাটা দরবারের মখমলের মেঝেতে নামিয়ে রেখে তাকাল রাজামশাইয়ের দিকে।
সকলে অবাক হয়ে দেখছিল সম্বলকেতুকে। অত পাখির কিচিরমিচিরে ক্ষণেকের জন্যে থেমে গেল রাজকার্য।
রাজপুত্র সম্বলকেতু রাজাকে বলল, ‘‘দেখুন বাবা, এই লোকটা কাঠির গায়ে আঠা লাগিয়ে ফাঁদ পেতে পাখি ধরছিল বনে। গাছের মগ ডালে উঠে একটা মা-পাখিকে ধরে খাঁচায় ভরল। আমি বললাম, ‘ছেড়ে দাও পাখিটাকে। দেখছ না গাছের ডালের বাসায় ওর তিনটে বাচ্চা কেমন চিঁচিঁ করে কাঁদছে?’ ও আমার কথা শুনল না। বলল, এই পাখিটার নাকি অর্ডার আছে। চড়া দামে ও পাখিটা বিক্রি করতে আজই শহরে যাবে। আমি ওকে ধরে এনেছি।’’
রাজা তরঙ্গকান্তি পাখিধরা লোকটাকে বললেন, ‘‘তুমি জানো না, পাখি ধরার নিয়ম নেই পৃথিবীর কোথাও?’’ তারপর প্রহরীকে বললেন, ‘‘একে নিয়ে যাও প্রহরী। কারাগারে নিয়ে যাও। আর হ্যাঁ, শোনো, ওকে রাখবে অন্ধকার কক্ষে, যেখানে দিন-রাতের একটুও তফাত না বোঝা যায়। কোনও দিন যেন ও পৃথিবীর আলো আর না দেখতে পায়!’’
প্রহরী এগিয়ে গিয়ে পাখিওলার হাতটা জব্দ করে ধরল। অমনি তক্ষুনি সম্বলকেতু খাঁচার কাছে গিয়ে খুলে দিল খাঁচার তারের ছোট্ট দরজাটা। বন্দি পাখিগুলো শাঁ শাঁ করে উড়ে রাজদরবারের ঘুলঘুলির ফাঁক দিয়ে উড়াল দিল নীল আকাশের দিকে।
অমনি পাখিওলা লোকটা জোরে কেঁদে উঠল, ‘‘আমার অত কষ্টে ধরা পাখিগুলো উড়িয়ে দিল? এখন কী হবে?’’
আর সেই মা-পাখিটা? সে তখন উড়ে গিয়ে বসল রাজদরবারের জানলার পাশের একটা রাজঅশোক গাছের ডালে। গোটা গাছটায় তামাটে রঙের পাতা ঝুলে আছে ঝালরের মতো। তারই ফাঁকে বসে কুক্কু কুক্কু করে খুঁজতে লাগল তার ছানা তিনটেকে।
এমন সময় রাজপুত্র সম্বলকেতু বলল, ‘‘বাবা, ওকে শাস্তি দিলে কি বন্ধ করা যাবে বনের পাখি ধরা? ও তো পাখি ধরে বিক্রি করে ওর সংসার চালানোর জন্যে! বরং ও যাতে আর পাখি না ধরে, তার জন্যে ওকে অন্য কোনও একটা কাজের উপায় বাতলে দিন। আর ওর সুদিন ফিরে এসেছে দেখলে অন্য সব পাখিওলাও ওর দেখাদেখি পাখি ধরা ছেড়ে নতুন কাজের খোঁজে আপনার কাছে আসবে। আপনি তাদের নতুন আলোর পথ দেখাবেন! এটাই তো রাজার প্রকৃত কাজ!’’
রাজদরবার নিশ্চুপ! সম্বলকেতু রাজদরবারের চারদিকে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে বলল, ‘‘যাই! আমি ততক্ষণে মা-পাখিটাকে ওর বাসার দিকে তাড়িয়ে নিয়ে যাই। ওর বাচ্চারা মাকে না পেয়ে এখন কত না কাঁদছে!’’
সম্বলকেতু রাজদরবার থেকে বেরিয়ে গেল ‘হুই, হুট হুট, হুট, হুট, হুই’ বলতে বলতে।
রাজা তরঙ্গকান্তি তৃপ্তির নিশ্বাস ফেলে সহায়কেতুর দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘‘আমার আপনভোলা রাজপুত্র সম্বলকেতুর হৃদয়ে গরিব-দুঃখীর জন্যে সমবেদনার কোনও তুলনা নেই! ও আজ আমাকে রাজকার্যের নতুন এক কৌশল শেখাল।’’
তখন রাজপুত্র সহায়কেতু হেসে বলল, ‘‘মহারাজ, আপনার ডান দিকটা তো ফাঁকাই পড়ে আছে। ওখানে একটা ছোট সোনার সিংহাসন না থাকলে কি মানায়? আপনি আজই স্বর্ণশিল্পীকে ডেকে আর-একটা সোনার সিংহাসন তৈরি করার আদেশ দিন। আর কাল থেকে ওই সিংহাসনে বসুক ভাই সম্বলকেতু!’’
রাজা ঘাড় নেড়ে হাসি মুখে সায় দিলেন রাজপুত্রের কথায়।
সম্বলকেতুর এই খবরও ছড়িয়ে পড়ল রাজ্যে-রাজ্যান্তরে। সকলে বাহবা দিতে লাগল সম্বলকেতুর।
রাজা তরঙ্গকান্তি সেদিন রাতে তাড়াতাড়ি ফিরে গেলেন শয়নকক্ষে। রানি হিল্লোলকুমারী তাকিয়ে ছিলেন বাইরের দিকে। বসন্ত আসতে বুঝি আর দেরি নেই। আকাশে-বাতাসে যেন বসন্তের আগমনের গন্ধ ছড়িয়ে পড়ছে। এমন সময় রাজা রানিকে বললেন, ‘‘রানি, কাল সকালে আমার রাজ্যে নতুন রাজার অভিষেক অনুষ্ঠান। কাল থেকে এই নিসর্গগড় রাজ্যের নতুন রাজা হবে। আমার তো বয়স হল!’’
রানি অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করলেন, ‘‘আমাদের রাজ্যের নতুন রাজা? নাম কী সেই নতুন রাজার,
মহারাজ?’’
রাজা হেসে বললেন, ‘‘নতুন রাজা একজন নয় রানি। দু’জন। একজনের নাম রাজা সহায়কেতু। আর-একজনের নাম রাজা সম্বলকেতু!’’
রানি আবেগে থরথর করে কেঁপে উঠলেন। বললেন, ‘‘এ কি সত্যি মহারাজ?’’
রাজামশাই রাজমুকুটটা খুলে পাশে সরিয়ে রাখতে রাখতে বললেন, ‘‘সত্যি!’’
রানি গদগদ গলায় বললেন, ‘‘রাজামশাই, আপনি কাল আপনার হেড প্রহরীকে আদেশ পাঠান, আমি কাল অভিষেক অনুষ্ঠানে যাব আপনার মায়ের সব গয়না পরে।’’
রাজা তরঙ্গকান্তি মিটিমিটি হাসলেন।
পরদিন সকাল হতে না হতেই রানি হিল্লোলকুমারী হেড দাসীকে আদেশ করলেন, ‘‘আজ আমি অভিষেক অনুষ্ঠানের আগে শ্বেতপাথরের ঘাট-বাঁধা গোলাপ জলের সরোবরে স্নান করতে যাব। তুমি এক্ষুনি সব আয়োজন করো!’’
গ্রাফিক্স্- ইন্দ্রশেখর
রতনতনু ঘাটীর সব লেখা একত্রে