তনুময় বলল, “ধুস অমন আবার হয় নাকি?”
অনুরাগ বিরক্ত হয়ে বলল, “তোর সবতাতেই বড্ড নেগেটিভ অ্যাপ্রোচ তনু। সবকিছু শোনার আগেই দুম করে বলে দিলি অমন হতে পারে না।”
“পারে নাই তো”, আবার জোর দিয়ে বলে তনুময়, “তুই চাইলি আর অমনি সুগতর ধুম জ্বর এসে গ্যালো সামনের সপ্তা থেকে। এমন জ্বর যে উঠে দাঁড়াতেই পারবে না, খেলা তো দূরের কথা…”
“হতেই তো পারে। এ পৃথিবীতে কতসময় কতকিছুই তো ঘটে। তার সবকিছুর কার্য কারন কি আমরা জানি না বুঝি না বিচার করতে চাই…”
“তবু এ ব্যাপারটা বড্ড অবাস্তব কল্পনা হয়ে যাচ্ছে রে অনুরাগ। তুই বরং অন্য কিছু ভাব”, দু দিকে মাথা নাড়ে তনুময়।
“কত অবাস্তব ঘটনাই তো ঘটছে চারদিকে বল, ঘটছে না? এই আজকেই তো লাইফ সায়েন্স ক্লাশে পড়া করে যাইনি। চুপি চুপি রাতুলকে বলেছিলাম। এমন পাজি রাতুলটা যে স্যার ক্লাশে আসতেই চোখ বুজিয়ে বিড়বিড় করতে শুরু করে দিল হে ভগবান আজ স্যার যেন অনুরাগকে পড়া ধরেন… আর ব্যাস। ক্লাশে ঢুকে চেয়ারে বসে প্রথম পড়া ধরলেন উনি আমাকেই। বল কী করে হল?”
“ওটা কো ইন্সিডেন্স অনু। বার বার অমন হয় না।”
“কিন্তু হয় তো।”
“হয়”, মাথা নাড়ে তনুময়, “খুব ইচ্ছেশক্তি থাকলে হতে পারে।”
“পথে আয়। এই কথাটাই তো তখন থেকে বোঝাতে চাইছি তোকে। ইচ্ছেশক্তি। মন থেকে চাওয়া। যেমন রাতুল সেদিন চেয়েছিল। দিয়েছি পাজিটার সঙ্গে তারপর থেকে আড়ি করে। কথা বলি না আর। যেমন পা বাড়িয়ে শত্রুতা করা আমার সঙ্গে।”
“কী করবি ভাবছিস তাহলে?”
“সত্যি কথা বলতে কি সামনের ম্যাচে সুগত যদি আমাদের এগেইনস্টে মাঠে নামে তাহলে কিছুতেই জিততে পারব না আমরা। ও একাই আমাদের হারিয়ে ভূত করে দেবে। তাই আমি আমার ইচ্ছেশক্তি কাজে লাগাতে চাই। মন দিয়ে একাগ্রভাবে শুধু চেয়ে যেতে হবে যাতে সুগত নেক্সট ম্যাচে মাঠে না নামতে পারে… তুইও এই প্রার্থনাটা চালিয়ে যাস কিন্তু মন দিয়ে।”
“কাজ হবে বলছিস?”
“আমার মা তো বলেন মন দিয়ে কিছু চাইলে নিশ্চিত তা করা যায়। আর মা কি মিথ্যে বলবে মনে হয় তোর?”
“না না তা আবার হয়? তবে এর আগে ট্রাই করে দেখেচিস কখনও?”
“উঁহু। মা তো সাধারনত পড়াশোনার ব্যাপারেই কথাটা বলে। কিন্তু পড়াশোনা জিনিসটাই এমন যে মন দিয়ে তা করতে চাওয়াটাই বিপদ। খেলা টেলা, গুলতির টিপ প্র্যাকটিশ, মন্ডল পুকুরে সাঁতার কাটতে যাওয়া সব বরবাদ হয়ে যাবে তখন। জিষ্ণুকে দেখিস না, আমাদের ক্লাশের ফার্স্ট বয়, সারাদিন শুধু পড়ে। কিছুই পারে না আর। ঢিল ছুঁড়ে আম পাড়তে পারে না, ফুটবলে পা ছোঁয়ায়নি কোনোদিন, ব্যাট কীভাবে ধরতে হয় তাই জানে না…”
“হুঁ।”
“ওই দ্যাখ, হুঁ মানে? আমার প্ল্যানটায় খুব একটা আস্থা পাচ্ছিস না না রে?”
“সত্যি বলতে কি পাচ্ছি না। সন্দেহ হচ্ছে। তোর ইচ্ছে শক্তির ওপরে ভরসা তৈরি হচ্ছে না।”
“তাহলে অবশ্য প্ল্যান বি আর প্ল্যান সি আছে…”
“কী রকম?”
“আমার ঠাকুরমায়ের কাছে জোলাপের শিশি আছে। ওটা লুকিয়ে হাতিয়ে নিতে পারলে কেল্লা ফতে।”
“কী ভাবে?”
“ম্যাচের আগের দিন কোনো ভাবে ওকে ডেকে নিয়ে আলুকাবলি খাওয়ানোর তালে ওটা যদি খাবারের সাথে মিশিয়ে দেওয়া যায় পরেরদিন আর মাঠ পর্যন্ত আসতেই পারবে না ও।”
“আর যদি না খায়?”
“সেটাই ভাবছি। ওদের স্কুলের গেম টিচার কৃষ্ণবাবু খুব কড়া লোক। ম্যাচের দু দিন আগে থেকেই এমন চোখে চোখে রাখেন সব্বাইকে… এসব খাবার খাওয়ায় বিধি নিষেধ তো থাকবেই। তবে সুগতটা পেটুক। এড়াতে পারবে না বোধহয়। তাছাড়া আমি অপোনেন্ট স্কুলের ক্যাপ্টেন হলে কী হবে আমায় ভালোবাসে। একসময় একবাড়িতেই তো আমরা দুই পরিবার ভাড়া থাকতাম বাদামতলার কাছাকাছি।”
“এই প্ল্যানটাও জোলো লাগছে। তোর প্ল্যান সি বল।”
“এই প্ল্যানটা একটু কড়া ধাঁচের। নিতান্ত অনোন্যপায় হলে এটা করব ভেবে রেখেচি।”
“কীরকম, কীরকম?”
“আমাদের ঘরের বাইরে জবা ফুল গাছের পাতার আড়ালে একটা বোলতার বাসা আছে। বাসাটা খুব বড় নয়। তবে ওতেই কাজ হয়ে যাবে।”
“মানে?”
“রাতে পোকাগুলো কিছু দেখতে পায় না। হাতে প্লাস্টিক বেঁধে ওটা ভেঙে নিয়ে যদি থলেতে ভরে ওর ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে দেওয়া যায়…”
“দিবি কী করে?”
“সিম্পল”, অনুরাগ হাসে, “বোকাটা রাতে জানালা খুলে শোয়। আমি দেখে রেখেছি। খোলা জানালা দিয়ে হাত গলিয়ে ভেতরে ছুঁড়ে দিলেই হল ব্যাস। কেল্লা ফতে। দু তিনটেও যদি কামড়ায় বাছাধনকে আর মাঠে নামতে হবে না পরের দিন।”
“কিন্তু কেউ জেনে ফেললে?”
“ধুস আবার ভীতুর মতন কথা তোর। কে দেখতে যাচ্ছে…”
“হুঁ”, বলে একটুক্ষণ চুপ করে থাকে তনুময়। তারপর গম্ভীরভাবে বলে, “প্ল্যানটা গোলমেলে। তবু অন্যগুলোর চেয়ে এটাই বেশী রিয়ালিস্টিক। তোর উইল ফোর্সের চেয়ে এটা অন্তত বেশি কার্যকরী এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।”
“দেখা যাক”, দার্শনিকের মতন মুখ করে বলে অনুরাগ, “হাতে আরো কিছুদিন তো সময় আছে। প্ল্যান এ দিয়ে শুরু করি। তারপর অন্য প্ল্যানগুলোর কথা ভাবা যাবেখন।”
“দেখ কী করলে হয়। আমাদের ট্রফি পাওয়া নিয়ে কথা। বছরের পর বছর ওদের কাছে হারতে হারতে বেদম হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত।” বলে বড় করে নিঃশ্বাস ছেড়ে বাড়ির পথ ধরে তনুময়। অনুরাগ সেদিকে তাকিয়ে থাকে কিছুক্ষণ। তারপর হাঁটতে থাকে সে-ও।
২
একটা অদ্ভুত ও একটানা থ্রপ থ্রপ শব্দে অনুরাগের ঘুম ভেঙে গেল। মা আর বাবা পাশের ঘরে শুয়ে ঘুমোচ্ছেন। অন্যদিন পাশাপাশি দুটো বিছানায় সে আর তার দিদি শোয়। দিন দুই হল দিদি পিসির বাড়ি গেছে ভদ্রেশ্বরে। আসবে সেই সামনের বিষ্যুদবারে। এই কদিন একাই এই ঘরে শুতে হচ্ছে অনুরাগকে। মা একবার অবশ্য বলেছিলেন একা শোবার দরকার নেই। একসাথে সবাই মিলেই শুয়ে পড়া যাবে। ও রাজি হয়নি। মা কী ভাবেন ওকে? ও কি ভীতু নাকি? দেওয়ালে টাঙানো বড়ো ঘড়িটা থেকে একনাগাড়ে টিক টিক আওয়াজ হচ্ছে। দিনের বেলা এই আওয়াজটা শোনাই যায় না বলতে গেলে, অথচ রাতে এই আওয়াজটাকেই কী জোরালো মনে হয়। চোখ বুজিয়ে বিছানায় শুয়ে শুয়েই মনের মধ্যে কেমন একটা যেন অস্বস্তি টের পেল অনুরাগ। চোখদুটো খুলে ফেলল সে। ঘরের মধ্যে একটা হাল্কা আলো। বেগুনী বেগুনী রঙের। বাইরে কি ভোর হয়ে আসছে? নাহলে আলোটা কেমন করে এল? কাল রাতেই নাইট ল্যাম্পটা কেটে গেছে। ওটা জ্বলার কথা নয়। এইসব ভাবতে ভাবতেই টং টং করে চাপা মৃদু গলায় চুপি চুপি দুটো বাজল। দিনের বেলা এই আওয়াজটা কিন্তু জোরেই হয়। ঢং ঢং করে। রাতে ঘন্টাটা কেমন লাজুক হয়ে যায়। ঘুমের অসুবিধে হবে বলে গলা উঁচু করে বাজতেই চায় না।
কিন্তু ওই আলো… রাত দুটোয় ঘরের মধ্যে এই আলোটা আসছে কী করে। সামনের ঘরে রাতে-ভিতে তবু রাস্তার আলো ঢুকে পড়ে কারো আপত্তির তোয়াক্কা না করেই। কিন্তু এই ঘরটা বাড়ির পিছন দিকে। এখানে তো স্ট্রিটলাইটের আলো ঢোকার সম্ভাবনা নেই কোনো!
অনুরাগ সত্যিই ভীতু নয়, তবু গায়ে কাঁটা দিয়ে উঠল তার। মনে বেশ দ্বিধা আর আশঙ্কা নিয়েই বিছানার ওপরে উঠে বসল সে। আর তখনই জিনিসটাকে দেখতে পেল অনুরাগ। জেলির মতন খানিকটা থকথকে স্বচ্ছ নির্দিষ্ট আয়তনবিহীন জিনিসটা মেঝের ওপর লাফিয়ে লাফিয়ে চলাফেরা করছিল অস্থির ভঙ্গীতে। তার শরীর অমসৃণ, থেকে থেকেই পরিবর্তন হচ্ছিল তার আকার। কখনও লম্বাটে তো কখনও বলের মতন গোল। আবার পরক্ষণেই হয়ত দু পাশ থেকে হাতের মতন দুটো অংশ বেরিয়ে বেখাপ্পা লম্বা হয়ে দুলতে লাগল দু’দিকে। তার শরীরে সবসময় চাঞ্চল্য। যেন স্থির হয়ে বসতে জানে না সে। আর তার শরীর থেকেই ঠিকরে বেরিয়ে আসছে সেই আশ্চর্য নরম নরম আলো। অনুরাগ বিছানার ওপরে বসে হাঁ করে তাকিয়ে ছিল সেই অদ্ভুত বস্তুটার দিকে। ওর চোখের সামনেই ধীরে ধীরে সেই স্বচ্ছ জেলির মতন বস্তুটি একটি আবছা ধোঁয়া ধোঁয়া মানুষের আকৃতি ধারণ করে যেন অনুরাগের পড়ার টেবিলের পাশে রাখা হাতল দেওয়া চেয়ারে বসে পড়ল পা ঝুলিয়ে। তারপর সামনে পিছনে দুলতে লাগল অস্থির ভঙ্গীতে। পুরো ব্যাপারটা চোখের সামনে ঘটতে দেখে ভয়ে হাত পা ঠান্ডা হয়ে গিয়েছিল অনুরাগের। মা বা বাবাকে যে পাশের ঘর থেকে ডেকে নেবে সে শক্তিটুকুও যেন হারিয়ে গিয়েছিল তার। গলা দিয়ে আওয়াজ বের হচ্ছিল না কোনো।
ভয় পেতে পেতে ক্রমে ভয় পাওয়াটা সয়ে গেল তার। হাত পায়ের শিরশিরানি কমে এল। শুকিয়ে কাঠ হয়ে যাওয়া গলা স্বাভাবিক হয়ে হয়ে এল ধীরে ধীরে। সাহসটা ফিরে আসতেই সোজা হয়ে বসল অনুরাগ। আবছা আর স্বচ্ছ শরীরটার দিকে তাকিয়ে সে চাপা গলায় জিজ্ঞেস করল, “কে তুমি?”
প্রায় প্রতিধ্বনির মতন একই রকম কন্ঠে সে উত্তর দিল, “আমায় চিনতে পারছ না তুমি অনুরাগ?”
“তুমি কি ভূত?” অনুরাগ আবার জিজ্ঞেস করে তাকে।
“না না। আমি বর্তমান, আমি বর্তমান…” দু দিকে মাথা নাড়াতে নাড়াতে বলতে থাকে সেই ছায়ামূর্তি।
“আমি তোমার কথা ঠিক বুঝতে পারছি না।”
“আমি আসলে তুমিই।”
“কী হেঁয়ালি করছ তুমি?” বলতে বলতে বিছানা থেকে উঠে নীচে নামে অনুরাগ।
“হেঁয়ালি না”, ছায়ামূর্তি বলে, “আমি আসলে তোমার মানসমূর্তি।”
“বুঝলাম না।”
“আমি ইচ্ছা, তোমার ইচ্ছামূর্তি।”
“যাহ, তা আবার হয় নাকি”, বলে সেই মূর্তিকে দু হাত দিয়ে ছুঁতে গেল অনুরাগ। কিন্তু কী আশ্চর্য, অনুরাগের হাত সেই ছায়া শরীরের কাছে পৌঁছনোমাত্র সে যেন হাওয়ায় ভেসে সরে গেল তার হাতের নাগাল এড়িয়ে। তারপর চাপা গলায় বলে উঠল, “কেন পাগলামি করছ অনুরাগ। ইচ্ছেকে কেউ কি কখনও হাত দিয়ে ছুঁতে পারে?”
অনুরাগ স্তব্ধ হয়ে দাঁড়িয়ে রইল কিছুক্ষণ। একটা মলিন বিষণ্ণ আলো ইচ্ছে শরীর ঘিরে রয়েছে এখন। ওটা তার নিজেরই শরীর। তার কন্ঠস্বর হুবহু অনুরাগেরই মতন। অনুরাগ বুঝতে পারল এখন। কিন্তু শরীরটা এমন অস্থির কেন? তার শরীর জোড়া কম্পন যেন স্পষ্ট বার্তা দিচ্ছে সে ভালো নেই। তার শরীর বেয়ে চুঁইয়ে নামা আলো কেমন রুগ্ন লাগছে। হঠাতই খুব মন খারাপ হয়ে গেল অনুরাগের। কান্না পেতে লাগল তার। একরাশ মন খারাপ নিয়ে সে তার নিজেরই ছায়াশরীরকে জিজ্ঞেস করল, “তুমি কী ভালো নেই?”
“উঁহু।” ক্ষীণ কন্ঠে উত্তর দিল সে, “আমি একটুও ভালো নেই।”
“কিন্তু কেন?”
“তুমি যে আমায় আর ভালো থাকতে দিচ্ছ না?”
“সে কী? আমি?” অবাক হয়ে বলে অনুরাগ।
“হ্যাঁ তুমিই।”
“কী করেছি আমি?”
“ফোঁস করে দীর্ঘশ্বাস ছাড়ে সেই অনুজ্জ্বল আলোয় মোড়া ছায়া ছায়া শরীরটা, “তোমার শরীরের মধ্যেই তোমার সুখ দুঃখের অনুভূতি ভাগ করে আমি বাস করেছি অনুরাগ। তোমার ভালো, তোমার মন্দ, সব সমস্ত কিছুর অংশীদার হতে হয়েছে আমায়। তোমার ভালো আমায় পরিপুষ্টি দিয়েছে, তোমার মন্দ ক্ষীণ দুর্বল করেছে আমায়। আসলে সমস্ত মানুষের মধ্যেই এই ভালোমন্দের খেলাটা চলে। আমি জানি। কিন্তু…” বলে থামে সে। দম নেয়। কথাগুলো একটু কঠিন শোনাচ্ছিল। তবু শুনতে ইচ্ছে করছিল অনুরাগের। সে উদগ্রীব হয়ে বলল, “কিন্তু…?”
“মানুষের মনের মতন এই বিশ্ব প্রকৃতির মধ্যেও একটা ভালো মন্দের খেলা চলেছে সর্বক্ষণ। প্রকৃতির ধর্মই হল সে সবকিছু টেনে নীচে নামাতে চায়। একেবারে আছড়ে ফেলতে চায় মাটির ওপর। আর মানুষ চিরকাল সেই নিম্নমুখি আকর্ষণ উপেক্ষা করে ওপরে উঠতে চেয়েছে। এইটেই তার সাধনা। আর সেই সাধনায় আমরা তার ইচ্ছা হয়ে সাহায্য করেছি, খেলায় অংশ নিয়েছি আবহমানকাল ধরে। কিন্তু যারা এই গতির উল্টোদিকে গিয়ে প্রকৃতির ইচ্ছেতে সায় দিয়ে নীচে নামতে চেয়েছে তারা আমার ওপরে নিয়ন্ত্রণ রাখতে পারেনি আর। আমিও সেই মারাত্মক নিম্নমুখী টানে আছড়ে পড়েছি এ মহাজগতের তাবৎ মন্দশক্তির সাথে মিশে গিয়ে। আমি এখন সেই টান অনুভব করছি অনুরাগ। তোমার মধ্যে থেকে টেনে হিঁচড়ে আমায় যেন বাইরে বের করে নিতে চাইছে বিশ্বজোড়া সেই মন্দশক্তি। জানো তো অনুরাগ, সেই শক্তি যতই টান দিচ্ছে আমায় ততই আমি আমার স্বাভাবিক রঙ, স্বাভাবিক উজ্জ্বলতা হারিয়ে ফেলে রুগ্ন আর ম্লান হয়ে যাচ্ছি ক্রমাগত। আমি ভেবেছিলাম তুমি আমায় এই পতন থেকে রক্ষা করবে। কিন্তু তুমিও শেষে…” ছায়া শরীরের গলা অবরুদ্ধ হয়ে এল।
অনুরাগেরও কষ্ট হচ্ছিল। তারই যে ছায়া শরীর। সে শরীর কষ্ট পেলে সে কি আনন্দে থাকতে পারে? গলার কাছটা টনটন করে উঠল তার। কান্নাভেজা গলায় সে বলে উঠল, “আমি যে কিছুতেই বুঝতে পারছি না কী অন্যায় করেছি আমি। আর কী করেই বা এই টান থেকে তোমায় রক্ষা করে আমার মধ্যেই নিরাপদে রেখে দেওয়া যায় তোমায় চিরকাল। আনন্দে। সুখে। উজ্জ্বল আলোয় আলোকিত করে।”
“তুমি সামান্য একটা লড়াই লড়তে অন্যায় সমাধানের পথ খুঁজলে কেনো অনুরাগ?”
“কী লড়াই ?”
“ভাবো।”
একটু ভাবে অনুরাগ। চকিতে মনে পড়ে যায় সুগতকে আটকানোর জন্যে তার করা পরিকল্পনার কথাগুলো। খুব লজ্জা পেয়ে যায় সে মনে মনে। মুখ নামিয়ে মৃদু গলাতেই সে বলে, “কিন্তু সুগত সত্যি ভালো খেলে। ওকে না আটকাতে পারলে…”
“তুমিও যথেষ্ট ভালো খেলো।”
“ওর মতন না।”
“ওর মতন হয়ে ওঠার চেষ্টা করো। আর ওর মতনই বা কেনো, ওর চেয়েও ভালো। খাটো। পরিশ্রম করো।”
“ধুস।”
“সারা জীবনটাই তো খেলা। অমন কত সুগত তোমার সামনে যোগ্যতর হয়ে আকাশ আড়াল করে দাঁড়াবে। এইভাবে অন্যায় দিয়ে কতজনকে আটকাবে তুমি অনুরাগ?” ছায়া শরীরের গলা ব্যথায় বুজে আসে। তার গায়ের নীলচে বেগুনী আলো আরো মলিন হতে থাকে। একটা হাল্কা গোঙানির মতন শব্দ উঠে আসে তার গলার মধ্যে থেকে। অনুরাগ দেখে। বুকের মধ্যে মোচড় মেরে ওঠে তার। ছায়া ছায়া শরীরটা দুমড়ে মুচড়ে ছোট হয়ে আসে। ক্রমশ মিলিয়ে যাচ্ছে সে এবার। বিছানায় ফিরে আসে অনুরাগ। একবার তাকায় সেই অমসৃণ আকারবিহীন স্বচ্ছ পিন্ডটার দিকে। তারপর বলে ওঠে, “যেও না। আমার মধ্যেই থাকো। আমি সহজ পথের বাইরে যাব না আর। আমি অন্যায়ের পথে যাব না আর। আমি চেষ্টা করব। আমি আমার সাফল্য অর্জন করব দক্ষতায় আর অনুশীলনে। মুহূর্তে একটা উজ্জ্বল আলো ঝিলিক মেরে ওঠে সেই থকথকে স্বচ্ছপিন্ডের শরীর থেকে। সেই আলোয় ভরা আনন্দের অজস্র রঙ ঝিলমিল তরঙ্গ। সেই আনন্দ তরঙ্গের ঢেউ এসে লাগে অনুরাগের শরীরে। আনন্দে কান্না পেয়ে যায় তার। এই প্রথম বিছানায় উপুড় হয়ে শুয়ে আনন্দে কেঁদে ওঠে সে। ফুলে ফুলে। ডুকরে ডুকরে।
মা এসে পিঠে হাত রাখেন, “কী রে, ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে এমন করে কাঁদছিস কেনো অনু, খারাপ স্বপ্ন দেখেছিস নাকি কোন?”
বিছানার ওপর ধড়মড় করে উঠে বসে অনুরাগ। ফ্যালফ্যাল করে একটুক্ষণ চেয়ে থাকে মায়ের দিকে। মাকে কি সব বলবে? বলা যায় সব? বিছানা থেকে নেমে পড়ে সে। মা জিজ্ঞেস করেন, “উঠে পড়লি যে! সবে তো সাড়ে চারটে। সকাল সাতটার আগে তো উঠিস না কোনোদিন হাজার ডাকলেও। মায়ের দিকে চেয়ে মিষ্টি করে হাসে অনুরাগ, “আজ থেকে এটাই রুটিন। সাড়ে চারটেয় উঠে মুখ ধুয়ে মাঠে প্র্যাকটিশে যাওয়া। ফিরে এসে ডট সাতটায় পড়তে বসে যাওয়া।”
মা হাঁ করে চেয়ে থাকেন ওর দিকে। অনুটা যেন কেমন পালটে গেছে আজ। মায়ের সেই ভ্যাবাচ্যাকা মুখটার দিকে তাকিয়ে আবার হাসে অনুরাগ। মাকে জড়িয়ে ধরে বলে, “দেখে নিও। আমি পারবই। একজনের কাছে প্রমিস করেছি আমি। আর আমার প্রমিস আমি রাখবই।”
ছবিঃ শিমূল