কুহু দুপুরবেলা বিছানায় শুয়ে শুয়ে ঠাকুরমার ঝুলি পড়ছিল। এবারের গরমের ছুটিতে কোথাও যাওয়া হয়নি। একা একা বাড়িতে থেকে কুহু যখন আর পারছে না, ঠিক তখনই দেশের বাড়ি থেকে কাকাই এসে চুপি চুপি এই বইটা দিয়ে গেছে। কুহুর মা তো গল্পের বইয়ের উপর হাড় চটা। তাই চুপি চুপি দিতে হয়েছে আর কি! এরকম বই তো কুহু আগে পড়েনি। ইরাবতী, লীলাবতী আর লালকমল নীলকমলের সাথে বাকি ছুটিটা ভালোই কাটছিল কুহুর। প্রতিদিন দুপুরবেলা মা যখন পাশের বাড়ীর জেঠিমার সাথে গল্প করতে যায়, ঠিক তখনই কুহু লুকিয়ে লুকিয়ে ড্রয়ার থেকে বইটা বার করে তাতে মশগুল হয়ে পড়ে।
তা সেদিন দুপুরবেলাও কুহু খুব মনোযোগ দিয়ে ঠাকুরমার ঝুলি পড়ছিল। হঠাৎ একটা ঠক করে আওয়াজ হল ঘরের মধ্যে। কুহু প্রথমে শুনতে পায়নি। তারপর বেশ কয়েকবার ঠক-ঠক করে আওয়াজ হতে কুহু ভালো করে ঘরের মধ্যেটা দেখল। না, ঘরে তো কিছু নেই। অনেক সময় ইঁদুর আওয়াজ করে বটে, আর তাদেরকে দেখাও যায় না। কিন্তু সে তো খুট-খুট আওয়াজ। আবার কে যেন ঠক করে ঠোকা দিল একখানা। এবার কুহু বুঝতে পারল শব্দ ঘরের লাগোয়া ছোট বাথরুমটা থেকে আসছে। কুহু তড়িঘড়ি করে উঠে বাথরুমের দরজা খুলতেই একটা চড়াই পাখি ফুড়ুৎ করে কুহুর মাথার উপর দিয়ে উড়ে ঘরে ঢুকে ঘুরপাক খেতে লাগল। কুহু পড়ি কি মরি করে ছুটে গিয়ে পাখার সুইচ বন্ধ করে আর কি!
পাখা বন্ধ, জানালা খোলা – তাও চড়ুইটা ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ করে ঘরের মধ্যে ওড়াউড়ি করছিল। আর বার বার বাথরুমের মধ্যে ঢুকে পড়ছিল। সেই দেখে কুহুও চড়ুইটার সাথে সাথে বাথরুমের মধ্যে গেল। প্রথমে কুহু বাথরুমে কিছুই দেখতে পেল না। চড়ুইটা উড়ে গিয়ে জলভরা বালতির কানায় বসল। তখনই কুহু দেখতে পেল বালতির জলে মগটা উলটে পড়ে আছে আর তার তলায় চাপা পড়ে কে যেন ছটফট করছে। আলতো করে মগটা তুলতেই কুহু আরেকটা চড়ুইকে দেখতে পেল। ইস্! জলে ভিজে পুরো চুপসে গেছে। তায় একটা ডানা কেমন যেন ছড়িয়ে গেছে। আহা রে! ভেঙেই গেছে কি না কে জানে? কুহু আলতো করে চড়ুইটাকে জল থেকে তুলে নিল। ঘরে গিয়ে টেবিলে একটা রুমাল পেতে চড়ুইটাকে শোয়াল। অন্য চড়ুইটাও টেবিলে এসে বসেছে। কুহু বাবার ব্লটিং পেপার থেকে একটা পাতা ছিঁড়ে এনে চড়ুইয়ের গায়ে লেগে থাকা জলের কণাগুলোকে শুষে নেওয়ার চেষ্টা করতে লাগল।
হঠাৎ কুহুর কী মনে হল, সোজা গিয়ে ঠাকুরঘর থেকে ছোট থালাবাটি নিয়ে এল। তারপর তাতে জলটল ঢেলে টেবিলের উপরে চড়ুইদু’টোর সামনে রাখল। চড়ুইদু’টোও টুকটুক করে বাটি থেকে জল খেতে লাগল। আহা, কী তেষ্টাই না ওদের পেয়েছিল। তা আর পাবে না! যা গরম পড়েছে। কুহুর খুব কষ্ট লাগল ছোট্ট ছোট্ট পাখিদু’টোর জন্য। ও ছুটে গিয়ে রান্নাঘর থেকে একটা বিস্কুটও নিয়ে এল। সেটাকে ছোটো ছোটো টুকরো করে ছড়িয়ে দিল টেবিলে। জলে ভেজা চড়ুইটা তখন অনেকটা শুকিয়ে গেছে। এমন কি ডানাও ঝাপটাল দু’বার। চড়ুইদু’টো সারা টেবিল ঘুরে ঘুরে বিস্কুটের টুকরোগুলো খেতে লাগল। কুহুও একটা চেয়ার টেনে টেবিলের পাশে বসল। খেতে খেতে চড়ুইদু’টো কিচির মিচির করে কত কথাই বলছিল নিজেদের মধ্যে। বোধহয় ওরা কুহুকে খুব করে ভালো বলছিল।
চড়ুইদের খাওয়া দেখতে দেখতে কুহু একেবারে বিভোর হয়ে গেছিল। এমন সময় ও একটা রিনরিন গলা শুনতে পেল। “এই কুহু, এই কুহু।” কুহু চমকে উঠে ঘরের চারিদিকে দেখল। ওমা, কই কোথাও তো কিচ্ছু নেই। তাহলে কে ডাকল কুহুকে? আবার সেই রিনরিন গলা ডেকে উঠল, “টেবিলের উপরে দেখ গো মেয়ে।”
ওমা, চড়ুইদু’টো কথা বলছে নাকি? চড়ুইরা আবার মানুষের মতো কথা বলে? কুহু তো অবাক হয়ে এটা জিজ্ঞেসই করে ফেলল। একটু বড়ো চড়ুইটা বিজ্ঞের মতো মাথা দুলিয়ে বলল, “সবাই পারে না। আমরা পারি।”
কুহু আরও অবাক হল, “তোমরা বুঝি বিশেষ কেউ?”
বড়ো চড়ুইটা বিজ্ঞের মতো মাথা নাড়িয়ে বলল, “সে তো ঠিকই। আমরা হলাম চড়ুই রাজ্যের কুলপতি। সবার থেকে উঁচু। আমরা হলাম ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী।” বলতে বলতে গর্বে চড়ুইটার পালক-টালক ফুলে ফেঁপে একাকার।
কুহু তো এতই অবাক হল যে চেয়ার থেকেই পড়ে যায় আর কি।
“ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী? যারা লালকমল আর নীলকমলকে সাহায্য করেছিল?”
“হ্যাঁ গো, হ্যাঁ। সেই তারাই। তবে তারা আমাদের ঠাকুরদার ঠাকুরদা। আমরা হলাম এখনকার ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী। এখনও তো আমরা ও দেশের রাজকুমারদের সাহায্য করি,” ছোট চড়ুই বলল।
কুহু বলল, “কিন্তু তোমরা তো চড়ুই। তোমরা এত ছোটো। রাজকুমারদের নিয়ে উড়ে যাও কী করে?”
ছোটো চড়ুই তো হেসে কুটোপাটি, “আরে কুহু, তুমি কিচ্ছু জানো না। রাজকুমাররাও তো ছোট্ট হয়। ওরা আমাদের পিঠে দিব্যি বসতে পারে।”
কুহু গালে হাত দিল, “তোমরা এখনও রাজকুমারদের সাহায্য করো? লালকমল আর নীলকমল? তারা আছে?”
বড়ো চড়ুই দুঃখের সাথে মাথা নেড়ে বলল, “না গো কুহু। তারা আর নেই। তবে তাদের নাতিপুতিরা আছে।”
ছোটো চড়ুই বলল, “হ্যাঁ, সূর্যকমল আর চাঁদকমল। সূর্যকমল বড়ো আর চাঁদকমল ছোটো। এবার রাক্ষসী রানির সাথে তাদের যুদ্ধ।”
কুহু বলল, “সূর্যকমল আর চাঁদকমল বুঝি যুদ্ধ করবে?”
বড়ো চড়ুই ডানা ছড়িয়ে বলল, “হ্যাঁ, করবে বইকি। তাই তো ওরা খবর পাঠাল। ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী চাই। সেই জন্যই তো আমরা ছুটে ছুটে, থুড়ি উড়ে উড়ে যাচ্ছিলাম। কিন্তু কী গরম পড়েছে বলো? তাই তো খুব জল তেষ্টা পেয়েছিল। আর জল খেতে গিয়ে ব্যাঙ্গমী তো মরেই যেত, যদি তুমি না থাকতে কুহু। বলো কুহু, তুমি কী চাও?”
কুহুর চোখ গোল গোল হয়ে উঠল, “আমি কী চাই? আমি চাইলেই পাবো?”
ছোটো চড়ুই ছটফটিয়ে বলল, “নিশ্চই পাবে। তুমি আমাকে বাঁচালে। শুধু তাই নয়, আমরা মরে গেলে আমাদের ছানাদের কে দেখত? তারাও তো মরে যেত। তাহলে আর ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীই থাকত না এই পৃথিবীতে। আর ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী না থাকলে রাজপুত্রদের নিয়ে কে যেত রাক্ষস রানি মারতে? তাহলে তো রাক্ষস রানিই জিতে যেত। তাই কি হয়?”
বড়ো চড়ুই উদাস গলায় বলল, “তুমি এত্ত ভালো মেয়ে। একটা ছোটো পাখির জন্যও তোমার মনে কত ভালবাসা। তুমি যা চাইবে তাই দেব কুহু।”
কুহু আনন্দে ছটফটিয়ে উঠে বলল, “তাহলে আমি একবার সূর্যকমল আর চাঁদকমলকে দেখতে চাই।”
ছোটো চড়ুই অবাক হয়ে কী যেন বলতে যাচ্ছিল। কিন্তু বড়ো চড়ুই তাকে থামিয়ে গম্ভীর গলায় বলল, “তাই হবে কুহু। রাক্ষস রানির সাথে যুদ্ধ শেষ হয়ে যাক। আমি নিজে সূর্যকমল আর চাঁদকমলকে তোমার কাছে নিয়ে আসব। ততোদিন কিন্তু তুমিও আমাদের একটু সাহায্য করো।”
কুহু বলল, “নিশ্চয়ই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী! বলো কী সাহায্য করতে হবে?”
বড়ো চড়ুই গম্ভীরভাবে টেবিলের উপর লাফিয়ে লাফিয়ে পায়চারি করল খানিকক্ষণ। তারপর বলল, “যা বুঝছি। যুদ্ধ তো একটা হবেই। আর যুদ্ধ হলে আমাদের সবাইকে সেই যুদ্ধে যোগ দিতে হবে।”
কুহু উৎসুকভাবে বলল, “সবাইকে মানে? সব চড়ুইদের?”
ছোট্ট চড়ুই ডানা ঝাপটে বলল, “হ্যাঁ গো। কিন্তু যা গরম পড়েছে। কোথাও একফোঁটা জল নেই। সব শুকিয়ে গেল। আগের মতো খাবার পাই না আমরা। যুদ্ধ না করেই কত চড়ুই মারা যাচ্ছে শুধু জল না পেয়ে। আর যুদ্ধ হলে কী যে হবে!”
কুহু বলল, “তোমাদের কোনও চিন্তা নেই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী। আমি জল দেব। খাবার দেব। ছাদে রেখে আসব। জানালার কাছে রেখে দেব। পাড়ার বাকি কাকু কাকিমাদেরও বলব ছাদে আর জানালায় জল আর খাবার রাখতে, যাতে করে তোমরা খেতে পার।”
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আনন্দে নাচতে নাচতে বলল, “থ্যাংকু কুহু। থ্যাংকু। তুমি খুব ভালো। তবে কাউকে বলো না কিন্তু যে আমরা ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী। বলো যে চড়ুইরা খাবার আর জল না পেয়ে মারা যাচ্ছে। চলি এখন তাহলে। যুদ্ধু শেষ হলেই সূর্যকমল আর চাঁদকমলকে নিয়ে তোমার কাছে আসব।”
এই না বলে চড়ুইদু’টো থুড়ি ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী আবার ফুড়ুৎ ফাড়ুৎ করে উড়তে উড়তে জানলার গ্রিলে গিয়ে বসল।
কুহু জানালার কাছে ছুটে গিয়ে জিজ্ঞেস করল, “একটা কথা যে বুঝলাম না ব্যাঙ্গমা। তোমরা আমার নামটা কী করে জানলে?”
ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী উড়ে যেতে যেতে ফিকফিকিয়ে হেসে বলল, “তা আর জানবো না! আমরা যে তোমার বাড়ির বারন্দাতেই থাকি।”
এই না বলে নীল আকাশে ঘুরপাক খেয়ে খেয়ে ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমী অদৃশ্য হয়ে গেল।
কুহু অবাক হয়ে চেয়ারে এসে বসল। তারপর ভাবতে থাকল এমনটাও হয়? ভাবতে ভাবতে কখন ঘুমিয়ে পড়েছে কে জানে। আচমকা মায়ের ডাকে কুহুর ঘুম ভাঙল। মা চেঁচামেচি করছে, “ইস্, মেয়ের কান্ড দেখ। এই গরমে ঘামে ভিজে ফ্যান বন্ধ করে ঘুমাচ্ছে। তুই কী রে? চেয়ারে বসেই বা ঘুমাচ্ছিস কেন? পড়ে যাবি যে! আর টেবিলের উপর এত জল এল কী করে? এমা, এ তো ঠাকুরের থালা! কি রে কুহু, কী করেছিস তুই?”
কুহু চোখটোখ রগড়ে একেবারে ছুট দিল বারান্দায়। হ্যাঁ, বারান্দায় খড়কুটো দিয়ে তৈরি একটা পাখির বাসা দিব্বি দেখতে পাচ্ছে কুহু। তারমধ্যে থেকে কিচকিচে আওয়াজও ভেসে আসছে। নিশ্চয়ই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীর ছানারা আছে ওখানে। কুহু মনের আনন্দে মায়ের কাছে ছুটে এল। তারপর মায়ের গলা জড়িয়ে ধরে পুরো গল্পটা বলল, অবশ্যই ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীদের অংশটা বাদ দিয়ে। সব শুনেটুনে মাও খুব খুশি। এখন কুহু আর মা দু’জনে মিলে রোজ ছাদে আর বারান্দায় বাটি করে পাখিদের জন্য জল রেখে দেয়। বেঁচে যাওয়া ভাত, চাল এইসব ছড়িয়ে দেয়। কুহুদের কথা শুনে শুনে পাড়ার আরও কয়েকজনও নাকি পাখিদের নিয়মিত জল দিচ্ছে আজকাল। তা হবে না কেন? ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীদের সাহায্য করতে হবে তো! শুধু কুহু মাঝে মাঝে ভাবে তাদের পাড়ার মতো যদি অন্য পাড়াগুলোও চড়ুইদের খাবার দিত, জল দিত। শুধু পাড়া কেন? অন্য গ্রাম, অন্য শহর, দেশের সব্বাই দিত। তাহলে আর ব্যাঙ্গমা ব্যাঙ্গমীদের জন্য কোনও চিন্তাই থাকত না।
ছবিঃ মৈনাক মিত্র