বাঁকুড়া থেকে আউসারা, যাবো ছুটির দিনের রেলগাড়ি চড়তে। রাত কেটেছে ডাকবাংলোয়। কেটেছে কোথায়। এখনও আছে শেষ রাত্তির। রিকশা চলেছে এঁকে বেঁকে শিউলি ফুলের বাস জড়ানো হিমেল বাতাস গায়ে মেখে। রাস্তায় টিমটিমে চা মিষ্টির দোকান দুটো একটা। মাঝে মাঝে হঠাৎ অন্ধকারের মাঝ থেকে ঝাঁপিয়ে আসা আলোয় আলো পুজোমন্ডপ। দূর্গা অসুর সিংহ সবাই কাপড়ে ঢাকা, পুজো এখনও শুরুই হয়নি! কাল গেছে পঞ্চমী আজ মোটে ষষ্ঠী! এখনও আনন্দের ঝুলিতে সম্বল বাকি দিন কটা। চলতে চলতে গাল্লু ধরলো গান, আপ্পু ধরলো তান। তুফান মেল যায় তুফান মেল।
খুশি হয়ে ওদের সাথে গলা মেলাল পথের কটা কুকুর। অন্তু ডাকলো- যাবি আমাদের সাথে রেলগাড়ি চড়তে? সাহেবমামার ক্যামেরা চম্কে চম্কে উঠছে থেকে থেকেই।
পুরোন ষ্টেশনটা খুঁজে বার করে টিকিটের জানালায় দাঁড়াল ক’জন, বাকিরা গেল জায়গা রাখতে। গাড়ির কাছে গিয়ে বাঁশবনে ডোম কানা। বসব কোথায়? সবটাইতো খালি! ক্ষুদে লাইনে সারাদিনে এই একটাই ক্ষুদে গাড়ি, তাও খালিই পড়ে থাকে। সবাই তো কাজের মানুষ! এ গাড়িতে চড়বার সময় আছে কার? টিকিটদাদা বললেন দশদিন বাদে একসাথে বারোটা টিকিট বিক্রি হল।
ছোটো হলে কী হয়, ক্ষুদে ইঞ্জিনটা ফোঁস্ ফোঁস্ করছে ‘আগুন কয়লা’ খেয়ে, উগরে দিচ্ছে কালো রঙের খোঁয়া। চিমনীর ধোঁয়া কালো, নিচের ধোঁয়া সাদা। বুড়ো ড্রাইভার পিস্টন চাপতেই ফি-স্-স্ করে শব্দ হচ্ছে আর ধোঁয়ায় ধোঁয়া চাদ্দিক! ছোটোরা নিচু হয়ে লাইনের পাশে বসে যন্ত্রপাতি দেখছে অবাক হয়ে। বড়োদের কারও কারও স্মৃতির পুরোন রেলগাড়িরা বহুদুর থেকে ছেলেবেলার বাঁশি শোনায়। ডুবন্ত সুখে চোখ ঝাপসা হয়ে আসে।
আদ্যিকালের বামনমার্কা ইঞ্জিনের সাথে দুটি কামরা আর গার্ডের গাড়ি- সাকুল্যে এই! ততক্ষণে সকাল হয়ে এসেছে। ফিটফাট গার্ডবাবু সবজে-লাল নিশেন হাতে প্ল্যাটফরমে এসে ভারী অবাক!
‘দল বেঁধে কোথায় চললেন আপনারা! কী কাজ? এ গাড়িতে তো এ রকম দল যায় না!’
হেঁকে উঠলো পুরো দল, ‘কোন কাজ নেই! আমরা চলেছি ছুটির দিনের রেলগাড়িতে মজা করতে।’
গার্ডসাহেব হেসে বললেন, ‘মজা কোথায়, এ হল বি-ডি-আর! মন্দ লোকে বলে- বড়ো দুঃখের রেল।’
টিং টিং ঘন্টা পড়লো, সবজে নিশেন উড়লো, নীল জামা ড্রাইভার বাঁশির শেকল টানতেই- কু-উ-উ-উ-উ! বাব্বা! এইটুকু শরীরে কি জোর আওয়াজ। যেন খ্যাপা হাতি!
চললো রেলের গাড়ি ঘস্-ঘস্-ঘস্স।
বাঁকড়ো শহর ভুলতে বসেছে ক্ষুদে লাইনটাকে, তাই বাঁচোয়া! ঝোপঝাড় পোস্কার করেনি কেউ। এখানে ওখানে ছড়িয়ে ছিটিয়ে বিস্তর গাছপালা লতাপাতা যেমন ইচ্ছে বেড়েছে, নানান রঙের ফুলটুল ফুটিয়ে পথটার বাহার খুলেছে বেশ! হেলেদুলে চলছে মজার রেলের গাড়ি এর উঠোন ওর খিড়কিদোরের গা ঘেঁষে। জানালা পথে আগ্রহী লতাপাতারা ঢুকে আসছে আলাপ জমাতে, কচিকাঁচাদের নরম হাতের আদর খেয়ে পিছিয়ে পড়ছে ফের। গাছপালা ছিঁড়তে বারণ। বড়োদেরও গপ্পোগাছা গানটান চলছে। তার সাথে সমানতালে চলেছে জিলিপি সিঙাড়া কেক মিষ্টি আর মাটির ভাঁড়ে ফ্লাক্সবাহিনী লাল চা। দলের সবচাইতে ছোটোটার বেআইনী আবদার ‘আমিও ভাঁড়ে করে চা খাব।’ বেশ তাই সই!
চলতে চলতে ছবি পাল্টাচ্ছে ট্রেনের জানালায়। ক্ষেপে উঠে স্বভাবের তুলনায় একটু জোরেই চলছে ট্রেন। মাঝে মাঝেই চরাচর কাঁপিয়ে হুইসেল দিচ্ছে কারণে অকারণে। দুর্বল রেললাইন ট্রেনের দুরন্তপনায় আপত্তি জানিয়ে নানারকম আওয়াজ করছে, শুনে ছোটোর দল হেসেই কুটিপাটি! গাল্লু বলল ইঞ্জিনটা ছোটোভাইদের হাত ধরে পুজো দেখাতে নিয়ে যাচ্ছে। দেখছ না মাঝে মাঝে কেমন হ্যাঁচকা টান মারছে! ছোটোভাইরা কি আর অত তাড়াতাড়ি হাঁটতে পারে?
পুজো দেখতে যাবার ব্যাপারটা হলেও হতে পারে! ভোরের কুয়াশাভাব কেটে গিয়ে সোনারঙের রোদ উঠেছে ততক্ষণে। গাড়ির জানালায় ফুলে ফুলে সাদা শিউলির বন। বনের মাঝ বরাবর আঁকা বাঁকা দুলন্ত কাশবনে ছাওয়া ছোটো এক নদী। নদীর ধারে সাদা বালির চরায় ছোট্ট শামিয়ানার তলায় আলো আলো মুখ করে দিব্যি দুজ্ঞাঠাকুরটি। রেলের গাড়ি ঝন্ঝনানি গরগরানি থামিয়ে থিতু হল। এ কোথায় এলাম? স্টেশন কই? থামবে কতক্ষণ? জানালায় সবাই মিলে উঁকিঝুঁকি স্টেশনের খোঁজে, হদিশ নেই স্টেশনের! গার্ডসাহেব হাসিমুখে উদয় হলেন।
‘একী বসে আছেন যে! ঠাকুর দেখবেন না? চলুন চলুন?’
বলামাত্তর ঝুপ ঝাপ করে গাড়ি খালি। সবাই ছুটল ঠাকুর দেখতে। কেউ গেল শিউলিবনে ফুল কুড়োতে কেউ গেল নদীর ধারে। গাড়ি ছেড়ে দেবার ভয় নেই। গার্ডসাহেব নিজেই বসে আছেন নদীর ধারে উল্টোন নৌকোর পিঠের ওপর চেপে। নদীটির শান্ত বুকে নীল আকাশের ছায়া। দুলছে কাশফুল উড়ছে রেলগাড়ির ধোঁয়া। ছবি ধরা রইল সাহেবমামার ক্যামেরায়। ট্রেন ছাড়বার ধরাবাঁধা সময় নেই আজ। আপ্পুর ছোটো হাতের মুঠোয় সবজে নিশান ধরিয়ে গার্ডসাহেব বললেন- তুমি এটা নাড়লেই গাড়ি চলবে। শুনেই আপ্পু নিশেন লুকিয়ে ফেলেছে জামার তলায়, পাছে নড়ে যায়!
খানিক বাদে অবশ্য চলল আবার রেলগাড়ি আপ্পুর ইশারায়। সাহেবমামা ক্যামেরা কাঁধে চড়ে বসেছে গার্ডসাহেবের ক্ষুদে কামরার মাথার ওপর। চলতি গাড়ির ছাতের ওপর দিয়ে দিব্যি হেঁটে বেড়াচ্ছে সে। গার্ডসাহেব নিজের জায়গা ছেড়ে এসে উঠলেন আমাদের কামরায়। সবাই মিলে গলা ছেড়ে গাওয়া গানের টান ছেড়ে কি থাকা যায়? গানের গলা ভালো মানুষটার, ভারী মিশুকে। এক বাদলা দিনের পাগলা ঝড়ে দুঃখের রেলের দুর্দশার গল্প শোনালেন তিনি।
সে এক ভয়ঙ্কর ব্যাপার! দিনের বেলা রাতের আঁধার! গুম্ গুম্ শব্দ করে বুনো মোষের মতো মেঘের দল রাগ করছে, আগুনে ঝিলিক মারছে এখানে ওখানে। সেলেটের গায়ে আলোর দাগ টেনে সটান বাজ নেবে এল একটা তালগাছের মাথায়। দাউ দাউ আগুন! দেশলাই বাক্সোর মত রেলগাড়ি চলেছে জঙ্গলের মাঝে গা ঢাকা দিয়ে ভীতু বাচ্ছা ছেলেদের মত ফুঁপিয়ে কাঁদতে কাঁদতে। জঙ্গল ছেড়ে খোলা জমিতে যেতেই চিত্তির! দেশলাই বাক্সো দমকা হাওয়ার দাপে কাৎ হতে হতে পড়লো হাত পা শূন্যে তুলে উল্টে। যাত্রী বিশেষ ছিল না তাই রক্ষে। অবশ্য দশ মিনিটের মধ্যে উল্টো হাওয়ার ঠ্যালায় আবার সিধে খাড়া লাইনের ওপর ঠিক্ ঠাক্! কারো চোট হয়নি। শুধু নাগোরদোলায় চাপলে যেমন হয়, মাথা টাথা ঘুরে গেছল আরকি। ঝড় যেন একটু নড়া ধরে নাড়া দিয়ে শাসণ করে
গেল শুধু। জামা কাপড়ের ধুলো ঝেড়ে আবার চল্লো খেলনাগাড়ি নিজের পথে! গপ্পো বটে একখানা! অবশ্যি সত্যি মিথ্যে বোঝা গেল না।
চলে গেল ছোটোখাটো খানকতক্ ইস্টিশন্। প্ল্যাটফরম বলতে ঘাস বিছোন কাঁকুরে জমি, ছাউনি, ইচ্ছেসুখে বেড়ে ওঠা বড়ো ছোটো ক’টি গাছ। টিকিটঘর বলতে একখান করে ঘর ছিল বটে, এখন না থাকার সামিল। জানলা দরজা নেই কারো, দেয়ালেও এখানে ওখানে ইঁট নেই। থাকবার মধ্যে নিশ্চিন্তে জাবর কাটা ক’টা গরুবাছুর। আদ্যিকালের লেখা নামগুলো মুছে যায়নি অবিশ্যি। চোখ ঠাহর করে দিব্যি পড়ে নেয়া যায়। খাতায় তখন লেখা হয়ে ওঠেনি বলে মনেও পড়তে চাইছেনা আর। তবে নাম শুনলেই আদর আদর ভাব আসবে মনে।
ভাবছ টিকিটঘর নেই বলে টিকিট বিক্রিও নেই? উঁই এ কথা বলা যাবে না কোনমতেই! যে বাউল মানুষটা এতক্ষণ ঘুরে ঘুরে গান গেয়ে শোনাচ্ছিল, কী একটা স্টেশন আসতেই সে হয়ে গেল টিকিটবাবু! কমিশন এজেন্ট। নতুন দুজন যাত্রী উঠতে দেখে একগোছা টিকিট হাতে কি তার আকুলিবিকুলি! তারাও নেবে না এ-ও ছাড়বে না! দুজন মিলে অন্তত একখান টিকিট কাটুক তারা তাহলেও খানিক নিয়মরক্ষা গোছের হয়! জোরজবরদস্তি নেই কোনো, হাতে পায়ে ধরাধরি প্রায়। শেষে দুজনকে নগদ দুখানা বিড়ি ঘুষ দিয়ে বিক্রি হল একটা টিকিট!
ওমা! বলতে ভুলেছি নির্জন শালবনের মাঝে সেই একলা ময়ুরটার কথা। সোনা ফেলে আঁচলে গিঁট!
চলতে চলতে হঠাৎ গাড়ির শব্দ গেল পাল্টে। রেলে চাকায় সহজ ছন্দের খুশিয়ালি খুনসুটি সুর-তাল হয়ে গেল গম্ভীর, গমগমে। সবাই গানটান থামিয়ে কান পাতল। উঁচু নিচু খোলামাঠ ছেড়ে শালবনের গহণ আঁধারে ঢুকে পড়েছে মজার রেলের গাড়ি। দুষ্টুটা যেন ঘুম ভাঙাতে এসেছে শালবনের। এখানে হাতির কানের মত বড়ো বড়ো পাতা দোলানো শালপিয়াল সেগুন গাছেরা শব্দ ধরে রাখেনা, ফিরিয়ে দেয়। তাই রেলের বাঁশীর প্রতিধ্বনি ফিরে ফিরে আসে। রেশ রেখে যায়। বনের আঁধারে রেলের ধোঁয়ায় রহস্য ঘনায়। রেল গাড়ির ঝক্কর ঝক্কর শব্দ গহন বনের জমাট গাম্ভীর্যকে ঠাট্টা করে এগিয়ে চলে।
সূয্যিঠাকুর উঠে এসেছেন মাথার ওপর। শালবনের পাতাদের নাগাল এড়িয়ে শরতের সোনা রোদ্দুর বনের সবুজ মখমল মেঝের ওপর কোথাও পেতেছে ছোটো বড়ো রুমাল, কোথাও বা খুচরো হয়ে অসংখ্য আলোর সিকি আধুলিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে। এ বনের সবুজ বড়ো মনমাতানো সতেজ, এ রঙকে বলে এমারেল্ড বা পান্না সবুজ। হঠাৎ সবার চোখ ধাঁধালো উজ্জ্বল সাতরঙের কারসাজিতে। পেখম মেলে সাথীহারা ময়ূর পান্নার পটে ছবি হয়ে ফুটে আছে। ছোটোদের আবদারে এগিয়ে যাওয়া রেলগাড়ি থেমে পিছিয়ে এলো ফের। কোথায় কী! বনের ছবি বনেই গেছে হারিয়ে। মন থেকে অবশ্য মুছে গেল না কারও। শালের চাঁদোয়ার তলায় ফের কিছুক্ষণ ছোটাছুটি গড়াগড়ি সবাই মিলে। ভারী রসিক এক কারবারি দোকান ফেঁদেছে এ হেন নির্জনতায়। হাতে হাতে গরম চা, ছোটোদের জন্য গরম দুধ, ‘নানখাটাই’ আর ‘কখনো মেঘ’ বিস্কুটে জমে উঠলো খাওয়াদাওয়া। কাঁচা শালপাতার দোনায় গরম ঘুঘনীটাই বুঝি ছেড়ে যাওয়া যায়!
এখানে ঘর বেঁধে থাকবার কথা মনে এলে দোষ দেয়া যায় না। নিদেন চোখের দেখাটি দেখে যাওয়া মাঝে মাঝে? সময় না পাবার দোষ কি সময়ের, না যে সময় পাচ্ছে না তার মনের?
তা বলে সময় অনন্ত নয় কারো! সবুজ নিশান দুলে ওঠে ফের। পিছিয়ে পড়ে শালের বন। গহন সবুজ থেকে আবার নীল আকাশ, খোলা রোদ্দুর, ধানের ক্ষেতে গড়িয়ে যাওয়া হাওয়ার ঢেউ। ডেকে ডেকে রেলের বাঁশি যেন ক্লান্ত। চলে চলে চাকায় রেলে ঝিমিয়ে পড়া সঙ্গত। জানলার ফ্রেমে পর পর সাজানো চলার নেশায় মাতোয়ারা মুখ, উড়ো উড়ো চুল, হাওয়ায় ধোঁয়ায় লালচে চোখ। অনেকটা পথ চলে এলাম, আবার কবে?
‘বর্ধমান জেলায় এসেছি বহুক্ষণ, রায়না আসতে দেরি নেই।’ দুপুর রোদে ঝিমিয়ে পড়া কি এক স্টেশনে থেমেছে গাড়ি, গার্ডসাহেব জানিয়ে গেলেন। স্টেশন আগলে এক প্রকান্ড বুড়ো বট। অসংখ্য জটার মতো ঝুড়ি নাবিয়ে ধ্যানে বসে আছে। বেশ লম্বা একটা অবসর সবাইকার, ইঞ্জিনের পেটে জল ঢালা হচ্ছে। তেষ্টা পেতেই পরে তার! সেই কোন ঝুঁঝকোবেলা থেকে এই দুপুর অবধি পুজোর ধূনোগন্ধী অলস রোদ্দুরে দুষ্টুমি কম করেনি সে!
জটাধর বটের থেমে ঠেস দিয়ে বুড়ো ড্রাইভারদাদা হুঁকো ধরিয়ে বসেছে। ঝড়তিপড়তি খাবারদাবার ভাগাভাগির পর বড়োরা কেউ শুয়েছে ঘাসের বিছানায় কেউবা বাউলদাদাকে পাশে বসিয়ে গান শুনছে চক্ষু মুদে। আপ্পু গেছে গার্ডসাহেবের হাত ধরে রেলগাড়ি চালানো শিখতে। গাল্লু ব্যস্ত খাতায় কলমে।
‘এ গাড়ির আয়ু ফুরিয়ে এসেছে বাবু।’ ড্রাইভারদাদা হুঁকোয় নীলচে ধোঁয়া বাতাসে ভাসিয়ে দিয়ে আনমনে বলল।
‘কেন?’
‘রেল কোম্পানির লাভ নেই!’
মন খারাপ হয়ে গেল। সব লাভই কি টাকার অঙ্কে কষা যায়? মাঝে মাঝে নিষ্কর্মা যাত্রীদের লাভও দেখলে পারত কোম্পানী, লোকসান হলেও।
যাক! মজার রেলের যাত্রায় মন খারাপ করতে নেই। তাই বলে কি মনের দুঃখ কমে? তোলা রইল সেটা বাড়ির জন্য। পেটপুরে ঠান্ডাজল খেয়ে দম নিয়ে মাঠঘাট কাঁপিয়ে ট্রেন হুইশ্যল্ বাজাতেই যে যার আপন আপন জায়গা নিয়ে বসে গান জুড়েছেঃ
‘এবার আমার উমা এলে
আর উমায় পাঠাবো না,
বলে বলবে লোকে মন্দ
কারো কথা শুনবো না।
যদি আসে মৃত্যঞ্জয়
উমা নেবার কথা কয়,
মায়ে ঝিয়ে করবো ঝগড়া
জামাই বলে মানবো না।’
গাইতে গাইতে কখন এসেছে আউসারা, মাঠের মাঝে থেমেছে গাড়ি। বিদায় জানাতে গাড়ি থেকে নেবে এসেছেন ড্রাইভারদাদা, গার্ডসাহেব, বাউলদাদা, সক্কলে। নেবে যেতে হয় তাই নাবতে হল। নেবেছি বটে, কোনদিকেই গাঁ ঘরের কোন চিহ্ন নেই! ধু ধু ধানের ক্ষেত হেলছে দুলছে, মাথা নুইয়ে ঝিমোচ্ছে যতদূর দু’চোখ যায়। আলপথে চলেছি সবাই সারবেঁধে। মাঝে মাঝে দাঁড়িয়ে ট্রেনের দিকে ফিরে হাত নাড়ানাড়ি চলছে। রেল বাঁধের ওপাড় থেকে হাত নাড়ছে মজার রেলের আজব রেলের বন্ধুরা। ছোট্ট শুঁয়োপোকার মত দেখাচ্ছে এখন রেলের গাড়িটাকে। হুইশ্যল বাজালো একবার, শোনা যায় কি যায় না। মিঠে গলায় যেন বলল – মনে রেখো। তারপর নীল আকাশের গায়ে কালো ধোঁয়ার আলপনা এঁকে দিতে দিতে চলে গেল নজরের শেষ সীমা পেরিয়ে!
দূরে নজরে পড়ছে আউসারা গাঁয়ের ঘরবাড়ি। বর্ধমান সদর শহর যাবার বাস পাব ওখানে। মাঠের মাঝে খোড়া চালার এক পূজামণ্ডপ। ধানের বুকে ঢেউ খেলানো পাটবন কাশবন দোলানো হাওয়ার দূর থেকে কানে এসে পৌঁছল দেবীবোধনের ঢাক;
‘ ঢ্যাং কুরা কুড় ঢ্যাং কুরা কুড় কুর কুর কুর তাক্
দুগ্গা মায়ের ছানা পোনা গাঁ শহরের সকল জনা বেঁচে বর্তে থাক্।’
ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য্য