গল্প-খেলা-ঋজু গাঙ্গুলী

galpokhela01 (Medium)কালীবাড়ির মাঠের পাশে ইঁটের ঢিপিটা যে কবে থেকে আছে, সেটা বোধহয় এখন কারও মনে নেই| কার কাছে যেন শুনেছিলাম, অনেকদিন আগে মিউনিসিপ্যালটি থেকে মাঠের মধ্যে দিয়ে যাওয়া হাঁটা-পথটাকে পাকা করার একটা উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল, আর তারই প্রথম ধাপ ছিল ইঁট বিছোনো| কিন্তু ইঁট আসার পর আর কোন কাজ হওয়ার আগেই মাঠের জমিটির মালিক, মানে মিলিটারি, এই কাজ করতে বারণ করে দেয়| ফলে তখন থেকে শুধু ইঁটগুলোই পড়ে আছে, আর প্রকৃতির স্বাভাবিক নিয়মে সেগুলো এখন একটা ঢিপির আকার নিয়েছে| স্টেশনে যেতে গেলে যেকোন লোককেই এই ইঁটের স্তূপ পেরিয়ে যেতে হয়| আর যেহেতু এটাই আমার ঠেক, তাই গত শনিবার অনিরুদ্ধ যখন এই রাস্তা দিয়ে ট্রেন ধরতে যাচ্ছিল, তখন আমি ওকে দেখতে পেয়েছিলাম|

আমাদের এই কালীবাড়িতে মাসের দ্বিতীয় আর চতুর্থ শনিবার, বিশেষ করে সন্ধেবেলায়, বিশাল ভিড় হয়| নিয়ম করে এখানে পুজো-দেনেওয়ালাদের মধ্যে এক সময়ে আমার ঠাকুমাও ছিলেন| তখন এই নিয়ে ঠাকুমাকে প্রচুর জ্বালিয়েছি, কারণ বেছে-বেছে মাসের দুটো দিনেই ঠাকুরের বেশি জাগ্রত হওয়াটা আমার কাছে একটা বিরাট রসিকতার বিষয় ছিল| এখন অবশ্য ওই দিনগুলোতে আমার মজা হয়না, বরং সাজা হয়| বেশি ভিড় মানেই বেশি জঞ্জাল, বেশি গোলমেলে কাজ-কারবার| এই দুটো দিন প্রচুর উটকো এবং বাজে লোক এই ইঁটের স্তূপের চারপাশে ঘোরাঘুরি করে, থুতু ফেলে, অনেকে তো আরও খারাপ সব কাজকর্ম করে| তাদের ভাগিয়ে নিজের হাঁফ ছাড়ার জায়গাটুকু বের করতে আমাকে নাকানি-চোবানি খেতে হয়| গত শনিবারও ছিল তেমনই একটা দিন| সন্ধে থেকে কাঁসর-ঘন্টার আওয়াজের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে বেড়ে চলেছে লোকের ভিড়| এরই মধ্যে হঠাৎ করে আমার নজর পড়ল একটা ঘাড় গুঁজে হনহনিয়ে হাঁটা লোকের দিকে যার অল্প-বয়সেই মাথাজোড়া টাক, পরনে পাঞ্জাবি আর জিন্স, আর একটা ব্যাকপ্যাক এক কাঁধে নেওয়া| হাটে-মাঠে এমন লোক অজস্র দেখা যায়, কিন্তু দুটো বৈশিষ্ট্য লোকটাকে অন্যদের থেকে আলাদা করে দিয়েছিল: প্রথমত, তার গায়ের রং, যা আর পাঁচজন বাঙালির থেকে অনেক বেশি ফর্সা; দ্বিতীয়ত, হনহনিয়ে স্টেশনে যেতে গিয়েও থমকে দাঁড়িয়ে ইঁটের পাঁজাটার দিকে তার স্থির চোখে তাকিয়ে থাকা| লোকটার দিকে জাস্ট কয়েক সেকেন্ড তাকিয়েই আমি চিনতে পেরেছিলাম: অনিরুদ্ধ! আর সঙ্গে সঙ্গে আমার মাথায় বহু বছর ধরে ঢিমে আঁচে জ্বলতে থাকা একটা পুরনো আগুন দাউদাউ করে জ্বলে উঠেছিল|

*******

মাথার মধ্যে ফ্ল্যাশব্যাক হয়ে পুরনো কথাগুলো পুরোপুরি ভেসে ওঠার আগেই আমার খেয়াল হল যে অনিরুদ্ধ ঘাড় গুঁজে হনহনিয়ে স্টেশনের দিকে হাঁটা লাগিয়েছে| আমিও আর দেরি না করে ওর পিছু নিলাম| যদিও ওর পক্ষে আমাকে দেখতে পাওয়ার সম্ভাবনা খুবই কম ছিল, তবুও আমি কোনো ঝুঁকি নিইনি| যে সুযোগের জন্যে এতদিন ধরে অপেক্ষা করেছি, সেই সুযোগটা এবার যাতে কোনক্রমেই হাতছাড়া না হয় সেজন্যে আমি খুব সতর্কভাবে ওকে অনুসরণ করছিলাম| তবু মনে হলো, অনিরুদ্ধ কিছু একটা আন্দাজ বা আশঙ্কা করছে| ও চারদিকে খুব প্রখরভাবে তাকিয়ে কাউকে খুঁজছিল সেই সময়, সন্ধের স্টেশন-ভর্তি ভিড়ের মধ্যেও| শেষ অবধি ও ট্রেনে উঠল, আর আমিও অন্য একটা কামরায় উঠে চেষ্টা করলাম ওর দিকে নজর রাখতে| হঠাৎ করে মাঝের কোনো স্টেশনে ও নেমে গেল কিনা সেটা বোঝার জন্যে আমাকে এই গ্যালপিং ট্রেনের দুটো স্টপেজেই ওঠানামা করতে হয়েছিল| তবে এই সময় শিয়ালদামুখী ট্রেনগুলোয় বেশি ভিড় হয়না বলে আমি এই অতিরিক্ত ঝামেলাটা ধর্তব্যের মধ্যে আনিনি|

অনিরুদ্ধ যেদিন আমাদের স্কুলে ভর্তি হল সেদিন থেকেই ও’র সঙ্গে আমার একটা ঠান্ডা একতরফা লড়াই শুরু হয়েছিল| এই লড়াইটা কিন্তু পরীক্ষার রেজাল্ট বা অন্যান্য তুচ্ছ ব্যাপার (টিচারের কাছে কে বেশি পছন্দের, জানলার ধারে কে বসবে, স্কুলের সবথেকে বলশালী ছেলেটি কার বন্ধু, জোকস বলা এবং নানা ধরণের মজাদার ব্যাপারে পারদর্শী ছেলেটির ‘গ্রুপ’-এ কে আছে, ইত্যাদি) নিয়ে ছিল না| লড়াইটা ঠিক যেটা নিয়ে ছিল তা নিয়ে কিছু বলার আগে একটু নিজের কথা বলা দরকার| আমার মা-বাবা আমি ছোট থাকতেই মারা গেছিলেন, তাই আমি আমার মনের-দিক-থেকে-শক্ত অথচ স্নেহময়ী ঠাকুমার কাছেই বড় হয়েছিলাম| এক সময়ে সারদা মিশনের একটা স্কুলের টিচার ঠাকুমার স্নেহটা খুব বেশি পাওয়ার পরেও আমি আশেপাশের পরিবারগুলোকে ঈর্ষার চোখে দেখতাম এবং তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা, যাতে পারিবারিক পিকনিক যেমন আছে, তেমনি আছে হাজার-একটা জটিলতা, দেখে বুকের ভেতরে একটা শূণ্যতা অনুভব করতাম| এই শূণ্যতা ভরাট করার জন্যে অনেকে অনেক কিছু করে, তবে আমি একটা খেলা খেলতাম, যাতে আমার অস্ত্র ছিল: ভয়| যেসব ব্যাপারে অন্য অনেকে ভয় পায়, যেমন: আরশোলা, মাকড়সা, সন্ধেবেলায় লোডশেডিং, নড়বড়ে মই, ইত্যাদি-ইত্যাদি, সেসবে আমার কোন ভয় ছিল না| তাই আবর্জনার মধ্যে পাওয়া নানা রকম জিনিস থেকে আমি আমার ‘খেলনা’ রবারের বা প্লাস্টিকের মাকড়সা, বিছে আর সাপ বানিয়ে নিতাম| তাদের দিয়ে, এবং আরও নানা ভাবে লোকের সঙ্গে নানা রকম প্র্যাকটিকাল জোক করতে আমার দারুণ লাগত| তবে এই খেলাটা আমি খেলতাম খুব সাবধানে, এবং কারও কাছে এই নিয়ে একটিও মন্তব্য না করে| ফলে অন্য অনেক ব্যাপারে সম্পূর্ণ অকারণে নানা রকম অত্যাচার সহ্য করতে হলেও এই নিয়ে আমায় কেউ কিছু বলতে বা করতে পারেনি| এই ‘মেঘনাদ’ রূপটা বজায় রাখার জন্যে ঠাকুমার সঙ্গে আমি এই ধরণের কিছু করতাম না ঠিকই, কিন্তু প্রায় সব সময়েই আমার মাথায় ঘুরত: এর পর কাকে ভয় দেখানো যায়?

অনিরুদ্ধ যেদিন স্কুলে প্রথম এসেছিল, সেদিন অন্যরা কেউ কিছু টের পাওয়ার আগেই আমি ওকে ‘স্বাগত’ জানাবার জন্যে ও বসতে যাবার ঠিক আগে চেয়ারে একটা ভীষণ রকম রিয়েলিস্টিক কাঁকড়াবিছে রেখে দিয়েছিলাম| ওর বসার জায়গাটা ছিল আমার সিটের থেকে কয়েকটা বেঞ্চ দূরে|  বসতে গিয়ে বিছে দেখে ওর মুখ-চোখের অবস্থাটা কী রকম হতে পারে সেটা ভেবে এবং সেই মুহূর্তটা উপভোগ করার জন্যে, আমি ওকে লক্ষ করছিলাম|

অনিরুদ্ধ বসতে গিয়ে একটু থমকেছিল, কিন্তু তারপর ওর সিট থেকে না এসেছিল কোন আওয়াজ, না এসেছিল কোনো লাফঝাঁপ| তবে তাই বলে ব্যাপারটার যে কোন প্রতিক্রিয়াই হয়নি সেটা ভাবলে ভুল হবে| পরের ক্লাসে ইংলিশের স্যার অ্যাটেন্ডেনস নেওয়ার জন্যে রেজিস্টারটা রাখতে গিয়েই মুখ দিয়ে একটা বিচিত্র আওয়াজ করে নিজের চেয়ারটাকে পেছনে ঠেলেছিলেন, এবং টেবিল-চেয়ার শুদ্ধ আছাড় খেয়েছিলেন| ব্যাপারটা যে ঠিক কী, তা বুঝতে আমার একটুও সময় লাগেনি, আর তারপর যে হুলুস্থুল বেধেছিলো তার ফাঁকে টেবিল থেকে মেঝেতে পড়া বিছেটা সরিয়ে নিতেও আমার সময় লাগেনি| কিন্তু সেই একই সময়ে আমার নজর গেছিলো অনিরুদ্ধর দিকে| আমি দেখেছিলাম যে ও খুব নিস্পৃহ হয়ে সবকিছু দেখছে| তারপর কিছুদিনের মধ্যেই বুঝেছিলাম যে অনিরুদ্ধ বড়ো কঠিন প্রতিপক্ষ, যাকে কেউ কিছু করতে গেলে ও এমন কিছু করে যাতে ব্যাপারটা ব্যুমেরাং হয়ে তার দিকেই ফিরে যায়| সেদিন বিছেটা ও স্যারের সামনে নিঃশব্দে রেখে দিয়েছিল এই জন্যেই, যাতে এই ধরণের কীর্তি সাধারণত যারা করে তাদের ওপরেই এই বিশেষ ঘটনাটির দায়, এবং অবধারিতভাবে বেত আর জোড়া-স্কেলের মার নেমে আসে| ক্লাসের প্রধান ‘বাহুবলী’ অমিত থেকে শুরু করে আমাদের নানাভাবে অপদস্থ করে আমোদ-পাওয়া লাইব্রেরিয়ান কৃষ্ণেন্দুবাবু, সবার ওপরেই এই প্রক্রিয়া অনিরুদ্ধ প্রয়োগ করেছিল, যার প্রত্যেকটার বিবরণ দিতে গেলে আমার এই জবানবন্দি আর শেষ হবেনা| তার বদলে মূল কথায় আসি|

ক্লাসের পড়ায় মন বসুক বা না-বসুক, আমার রেজাল্ট মোটামুটি ভালই হত, কারণ একেবারে নাছোড়বান্দা স্বভাবের বশে পড়াটা রপ্ত না হওয়া অবধি আমি লেগে থাকতাম| সেই একই কারণে প্রথম দিনের ওই অভিজ্ঞতার পরেও আমি হাল না ছেড়ে দিয়ে বরং বোঝার চেষ্টা করেছিলাম, ঠিক কীসে ভয় পায় অনিরুদ্ধ| এক্ষেত্রে সুবিধে করে দিয়েছিল স্কুলে আমাদের দুজনেরই ‘আউটসাইডার’ অবস্থান, যার ফলে কাছাকাছি সিট্ না হলেও টিফিনের সময়ে, ক্লাসের শেষে, স্পেশাল ক্লাসে, এবং স্কুল থেকে ফেরার সময়, আমরা কাছাকাছি এসেই যেতাম| আমাদের মধ্যে এরপর যে সম্পর্কটা তৈরি হয় সেটাকে বন্ধুত্ব না বলে সম্ভ্রম-মিশ্রিত সহমর্মিতা বলাই ভালো| এক রাতে, মেলার মাঠে যখন আগাথা ক্রিস্টির ‘মাউসট্র্যাপ’ অবলম্বনে ‘ইঁদুরকল’ নাটকটা মঞ্চস্থ হচ্ছিল, তখন (বড়দের নাটক হিসেবে বিজ্ঞাপিত হয়েছিল বলেই আমাদের মত অপ্রাপ্তবয়স্করা ঝেঁটিয়ে গেছিল, নইলে রাত জেগে মশার কামড় খেয়ে কেউ দেখে ওইসব?) পাশেই বসা অনিরুদ্ধর মুখ থেকে হয়তো অসতর্কভাবে বেরিয়ে গেছিল: “অন্ধকারকে আমরা এত ভয় পাই কেন কে জানে”, আর প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে আমার মাথার ভেতরে কলকব্জাগুলো ঘুরতে শুরু করেছিল—

**********

ট্রেনের দুলুনিতে কখন যে একটা ঝিমুনি ভাব এসে গেছিল সেটা টের পাইনি| হঠাৎ করে শিয়ালদা স্টেশনে ট্রেন ঢোকা এবং দুঃসাহসী সিট্-অন্বেষীদের ঝাঁপিয়ে ট্রেনে ওঠার চেষ্টা দেখে বুঝলাম যে ভাবনা শেষ হয়ে কাজের সময় এসে গেছে| ট্রেন থামার সঙ্গে-সঙ্গে আমি একটু দূরে একটা স্টলের পাশে পৌঁছে অপেক্ষা করতে থাকলাম| অনিরুদ্ধ নামার পরেই আবার শুরু হল ওকে অনুসরণ করা| ফ্লাইওভারের দিকের গেট থেকে বেরিয়ে এবারও অনিরুদ্ধ হনহনিয়ে হেঁটে চলল বউবাজার স্ট্রিট ধরে, রাস্তার কাদা, খালি ঝুড়ি আর ঠেলা রিকশার সারি পেরিয়ে| ও’র হাঁটার ভঙ্গিই বুঝিয়ে দিচ্ছিল যে এই দিকেই কোথাও ও থাকে, নইলে রাস্তার যা অবস্থা তাতে কোন নতুন লোকের পক্ষে এত তাড়াতাড়ি হাঁটা অসম্ভব হত| একটু পরেই ও ঢুকে পড়ল একটা টিমটিমে আলো আর ঝুঁকে-পড়া স্যাতসেঁতে ক্ষয়াটে বাড়িতে ভরা গলিতে| এই গলিটা বোধহয় কর্পোরেশনের খাতায় নেই, তাই সাড়ম্বরে লাগান ‘ত্রিফলা’ আলোর বদলে এটায় যে আলোগুলো ছিল তাতে ল্যাম্পপোস্টের নিচে ছাড়া অন্য প্রায় কোথাও আলো পৌছচ্ছিল না| উল্টোদিক থেকে আসা সাইকেল, ষাঁড়, মাতাল এবং আবর্জনার স্তুপ এড়িয়ে, আর আলো-ছায়ায় গা মিশিয়ে ও’র পিছু নিয়েও আমি পুরনো কথাগুলোই ভাবছিলাম—

************

অনিরুদ্ধর বাবা রেলে চাকরি করতেন| স্টেশনের ওপর দিয়ে যাওয়া ওভারব্রিজটার নিচেই ছিল রেলের কোয়ার্টারগুলো, যার একেবারে শেষ প্রান্তে একটা মার্কামারা সবুজ-লাল রঙের দু’কামরার কোয়ার্টারে থাকতো ও’রা| তার পরেই ছিল কালীবাড়ির মাঠ| সন্ধের পর দূরের সিগনালে লাল-হলুদ-সবুজ আলো, আর বেশ কিছুটা দূরে হাইরোড দিয়ে যাওয়া ট্রাকের আলোর রেশ, এছাড়া ওই কোয়ার্টারগুলো আর লেভেল-ক্রসিং-এর মাঝে আলোর উৎস বলতে ছিল মন্দির আর তার লাগোয়া কয়েকটা চায়ের দোকান| আমি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম যে ওই অন্ধকার জায়গাটাই হবে অনিরুদ্ধর সঙ্গে আমার ‘খেলা’-র ময়দান| তার সুযোগটা এসেও গেছিল একেবারে অপ্রত্যাশিতভাবে, মাত্র কয়েক দিনের মধ্যেই|

মাঠে খেলতে গেলে অকারণে অনেক গালাগাল আর মার খেতে হত বলে আমি বিকেলটা কাটাতাম ব্রিজের এক মাথায় বই-স্টেশনারি আর অন্যান্য জিনিসের দোকানটায়| মাসে মাত্র দুটোর বেশি কমিকস কেনার অনুমতি বা অর্থ আমার সঙ্গে থাকত না বলে আমার কাজ ছিল দোকানের কাকু’র নজর এড়িয়ে যতোটা সম্ভব পড়ে নেওয়া| সেদিন যখন আমি যথারীতি দোকানের এক পাশে প্রায় অদৃশ্য হয়ে পাতা ওল্টাচ্ছি, তখন এক মহিলা ওই দোকানে এলেন| অনিরুদ্ধর মধ্যে যে বৈশিষ্ট্যগুলো দেখা যায় তার প্রত্যেকটাই থাকায়, অর্থাৎ ভীষণ ফরসা রং, খুব রোগা চেহারা, এবং কেমন-একটা অন্যরকমের ভুরুর সৌজন্যে মহিলাকে চিনতে আমার একেবারেই অসুবিধে হয়নি: অনিরুদ্ধর মা| একে তো আমার স্বভাব কোনোকালেই ‘মিশুকে’ ছিল না, তার ওপরে তখন কথা বলতে গেলেই কাকুর নজরে পড়ে যাওয়ার সম্ভাবনা ছিল| তাই আমি চুপচাপ নিজের পড়া নিয়ে ব্যস্ত ছিলাম| কিন্তু ভদ্রমহিলার কথার মাঝে কয়েকটা টুকরো-টাকরা শব্দ এবং কাকুর মন্তব্যগুলো থেকে আমি এটুকু বুঝে যাই যে পরের শনিবার আর রবিবার ওদের কোয়ার্টারে অনিরুদ্ধ একা থাকবে, কারণ ওই দু’দিন কাগজ দেওয়া হবে না, কিন্তু দুধ দেওয়া হবে| আমি সেই মুহুর্তেই সিদ্ধান্ত নিই যে এর থেকে ভালো সুযোগ যেহেতু আর পাওয়া যাবে না, তাই শনিবার রাতেই একটা চেষ্টা করব অনিরুদ্ধকে ভয় দেখানোর|

ব্যাপারটাকে বিজ্ঞাপনের ভাষায় সহজ-অথচ-কার্যকরী করার জন্যে আমি যে প্ল্যানটা ছকেছিলাম তার মূল সূত্রগুলো ছিলো এ-রকম:

(১)  আমি আগেও দেখেছিলাম যে বাড়িতে রান্না না হলে অনিরুদ্ধ কালীবাড়ির পাশেই ছোটখাটো একটা হোটেলে খেতে যেত| সেক্ষেত্রে ওকে খাওয়া সেরে রাতে ফিরতে হবে ওই ইঁটের ঢিপিটার পাশ দিয়েই|

(২)  শনিবার সন্ধেবেলায় স্কুলে স্পেশাল ক্লাস শেষ হতে-হতে রাত সাড়ে আটটা বাজবেই| তারপর ও সরাসরি ওই হোটেলে খেতে যাবে| সেখান থেকে বেড়িয়ে ও যখন কালীবাড়ির মাঠে আসবে তখন অন্তত সোয়া ন’টা বাজবেই|

(৩)  আমাদের মফস্বল শহরে রাত ন’টা বাজলে লোডশেডিং হওয়ার ব্যাপারে প্রায় গ্যারান্টি দেওয়া যায়| ফলে দূরে স্টেশনের আলো, আর মন্দিরের টিমটিমে কয়েকটা প্রদীপ ছাড়া ওই সময়ে মাঠ পুরো অন্ধকার হয়ে যাবে|

(৪)  শনিবার রাত বলে, ন’টার পর স্টেশনে ট্রেন থেকে নামা বা ট্রেন ধরতে ছোটা যাত্রীদের ভিড়ে, এবং দিনটা মাসের দ্বিতীয় বা চতুর্থ শনিবার না হওয়ায় প্রচুর ভক্তের উপস্থিতিতে আমার এমন জমাট মঞ্চটা ঘেঁটে যাওয়ার সম্ভাবনাও কমই ছিল|

(৫)  স্পেশাল ক্লাসে যাওয়ার সময়েই আমার ব্যাগে একটা কালো কাপড়, আর মুখে লাল রঙের পুরু সেলোফেন লাগানো দুটো পেনসিল টর্চ থাকবে| ফলে ক্লাসের পর অনিরুদ্ধ যখন খেতে যাবে, তখন আমি ইঁটের ঢিপিটার পেছনে এসে কাপড় জড়িয়ে, বগলের তলায় একটা ভাঙা প্রতিমা থেকে যোগাড় করা দুটো বিশাল সাইজের নকল হাত ফিট করে, আর কপালের থেকে একটু উঁচু লেভেলে হাত তুলে টর্চদুটো ধরে অপেক্ষা করব|

আমার এই পরিকল্পনা ভেস্তে যাবার দুটো মাত্র জায়গা ছিল| ঢিপিটার কাছের ল্যাম্প-পোস্টে ঢিল ছোঁড়ার নিশানা অভ্যাস করে তার একটাকে আমি শনিবার সকালেই নিরস্ত করেছিলাম, যাতে হঠাৎ করে লাইট চলে এলেও আমি ধরা না পড়ি, আর দূরের আলোগুলোর সুবাদে তৈরি হওয়া লম্বা ছায়া আমার পক্ষেই যায়| দ্বিতীয় ব্যাপারটা, মানে হঠাৎ করে স্টেশনের বা মন্দিরের দিক থেকে অনেক লোক যদি অনিরুদ্ধর সঙ্গেই ওই মুহূর্তে মাঠে চলে আসে, নিয়ে আমার কিছু করার ছিল না, তাই ওই নিয়ে আমি মাথাও ঘামাই নি|

*********

অনিরুদ্ধ এমন হঠাৎ করে থেমে গেল, যে আর একটু হলেই মোবাইল কানে চেপে গজগজ করতে থাকা একটা লোক ও’র ওপরে হুমড়ি খেয়ে পড়ত| আমার ক্ষেত্রে সে আশঙ্কা ছিল না, তবু আমিও একটু অবাক হলাম ও’র এই হঠাৎ থেমে যাওয়ায়| তারপর বুঝলাম যে একটা একেবারে হেজে যাওয়া বাড়ির দরজার পাশ দিয়ে ঢুকে যাওয়া একটা নোংরা আর শ্যাওলায় সবুজ তস্য-গলি হল ও’র লক্ষ্য| গলিটাতে অনিরুদ্ধ ঢোকার পরেই আমি ঢুকলাম না, কারণ আমি চাইনি যে ও আমার উপস্থিতি, আমি জানান দেওয়ার আগে, টের পাক| একটু পরে গলিটায় ঢুকতে গিয়েও আমার কেমন যেন ভয়-ভয় করতে থাকল| কিন্তু এতদিন পরে পাওয়া সুযোগটাকে স্রেফ ভয় পেয়ে হাত-ছাড়া করতে একেবারেই ইচ্ছে করছিল না| কিছুটা এগিয়ে, একটা বেঁকে যাওয়া আর মোটা জলের পাইপের আড়ালে দাঁড়িয়ে আমি দেখলাম: কয়েকটা বাড়ি পরেই একটা সবুজ রঙের মলিন দরজার পাশের কলিং বেল-টা টিপলো অনিরুদ্ধ| দরজা খুলে গেল প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই| তৎক্ষনাৎ আমার গলার কাছটা ব্যথায় দপদপ করতে শুরু করল| এই ব্যথাটা আমি চিনি| এটা তখনই হয় যখন আমি বুঝতে পারি যে কেউ খুব বিপদে পড়েছে| তবে এক্ষেত্রে কে বিপদে পড়েছে, এবং কীভাবে, তা নিয়ে মাথা ঘামানোর আগে আমার নজর পড়ল অনিরুদ্ধর দিকে|

দরজা দিয়ে আসা সি.এফ.এল-এর জোরালো আলোয় অনিরুদ্ধর মুখ দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে ও খুব ভয় পেয়েছে| দরজার ওপাশে দাঁড়িয়ে থাকা একটা দাড়িওয়ালা মুশকো লোক মুখ বাড়িয়ে গলিটার দুটো দিক প্রথমে দেখল, তারপর খুব অভদ্রভাবে পাঞ্জাবির সামনেটা ধরে এক হ্যাঁচকা টানে অনিরুদ্ধকে টেনে নিল বাড়ির ভেতরে| দরজাটা বন্ধ হয়ে গেল তার পরেই| আমি পাইপটার আড়াল থেকে বেরিয়ে এসে বন্ধ দরজার সামনে কিছুক্ষণ দাঁড়ালাম| বেশ বুঝতে পারছিলাম যে আমার খেলার মাঝখানে অন্য কেউ উড়ে এসে জুড়ে বসেছে| আর গলার কাছের ব্যথাটাও বেড়ে চলছিল| শেষ অবধি, আর কিছু না হলেও ব্যথাটার দপদপানির ঠেলায় আমি ঠিক করলাম যে বন্ধ দরজার ওপাশে কী হচ্ছে সেটা আমায় জানতেই হবে| তবে অনিরুদ্ধ, বা তার বাড়িতে এসে আড্ডা জমানো (?) লোকটিকে সেটা বুঝতে দেওয়ার কোন ইচ্ছে আমার ছিল না| অতঃপর খুব চটপট বাড়িটাকে এক চক্কর দিয়েই আমি বুঝতে পারলাম যে এই বহু পুরনো এবং বেশ কিছু পরিবারের বাসস্থান বাড়িটিতে আস্ত বা ভাঙা দরজা আর জানলা প্রচুর, ফলে কাউকে কিছু বুঝতে না দিয়ে আমি অন্য একটা দিক দিয়ে বাড়িটায় ঢুকে পড়লাম| অন্ধকারের মধ্যেও অনিরুদ্ধ যে দিকটায় থাকে সেটা খুঁজে বের করে সেদিকের একটা ভাঙা জানলা দিয়ে একেবারে ও’র ডেরায় ঢুকে পড়তে আমার কোন অসুবিধে হল না| নানা ধরনের বাসন, মিটসেফ, আলমারি, বই, দেয়াল-ঘেঁসা ছোট্ট ঠাকুরঘর, আর তাক-বোঝাই নানা জিনিসে ভরা একটা ঘরে আমি দরজা ঘেঁসে দাঁড়িয়ে পড়লাম| তার পাশের ঘরটা, যেটার দরজা দিয়েই ওই মুশকো অনিরুদ্ধকে টেনে ঘরে ঢুকিয়েছিল, সেই ঘরে তখন একটা রোমহর্ষক নাটক অভিনীত হচ্ছিল| অন্য সময় হলে আমি নাটকটা উপভোগ করতাম, কিন্তু গলার ব্যথা আর অনিরুদ্ধর সঙ্গে হিসেব বরাবর করার ইচ্ছেটা আমার মেজাজ খারাপ করে রাখায় আমি স্রেফ কথোপকথন শোনায় এবং ঘরের বাসিন্দাদের পর্যবেক্ষণ করায় নিবিষ্ট হলাম|

“বেশ খেলালেন আমাদের আপনি| কী বলেন?” ঘরের একমাত্র বনেদি চেয়ারটায় বেশ আরাম করে বসা পাজামা-পাঞ্জাবি পরা লোকটাকে বলতে শুনলাম| লোকটার পোশাক, হাতের ঘড়ি, আঙুলের আংটি, কথা বলার ভঙ্গি, এসবে বেশ পালিশ থাকলেও অনিরুদ্ধের উদ্দেশ্যে বলা কথাটার মধ্যে এমন একটা ইংগিত ছিল যেটা আমার গোটা শরীরে অস্বস্তি ছড়িয়ে দিল|

দাড়িওয়ালা লোকটা দাঁতের ফাঁক দিয়ে একটা বিশ্রী গালাগাল দিলেও সপাট উত্তরটা এল অনিরুদ্ধের মুখ থেকেই, “আমি ছোট কোম্পানির খেলনা বেচি মিস্টার দত্ত, কিন্তু মানুষের জীবন নিয়ে খেলাটা আপনাদেরই একচেটিয়া|”

মিস্টার দত্ত নামক লোকটা এই কথার পাল্টা কী বলে তা খেয়াল করার বদলে আমার নজর পড়ল ঘরের অন্য দুই বাসিন্দার দিকে, যারা এতক্ষণ এতই চুপচাপ ছিল যে মনে হচ্ছিল ঘরের পুরনো খাট, প্লাস্টিকের গোটা দুই চেয়ার, কোনায় রাখা ফ্রিজ, আর ওষুধ-জলের জাগ-গ্লাস রাখা একটা নিচু টেবিলের মতো তারাও আসবাব মাত্র| একজন মহিলা, যার পরনের ঘরোয়া রাতপোশাক, মাথার সিঁদুর, আর মুখে জমাট বেঁধে থাকা ভয় সহজেই তাকে চিনিয়ে দিচ্ছিল অনিরুদ্ধর স্ত্রী হিসেবে| ঘরের অন্য বাসিন্দাটির দিকে তাকিয়ে আমার বুকের ভেতরটা টনটন করে উঠল| একটা নিচু চেয়ারে বসে ছিল যে মেয়েটা তার বয়স খুব বেশি হলে দশ হবে, কিন্তু মেয়েটার বসে থাকার ভঙ্গি আর তার পাশেই রাখা হুইল-চেয়ারটা বুঝিয়ে দিচ্ছিল, যে ওর বয়সে খোলা আকাশের নিচে দৌড়ে বেড়ানো আর নিজের সঙ্গে লুকোচুরি খেলার যে স্বাধীনতাটুকু আমার ছিল, সেটাও ওর নেই| মেয়েটার বিবর্ণ মুখ দেখে আমি বুঝতে পারলাম যে দুনিয়াদারি না করলেও মা আর বাবার মুখ দেখে ও বুঝে গেছে যে ও ভীষণ বিপদের মধ্যে আছে| আর তক্ষুনি আমি বুঝতে পারলাম, আমার গলার ব্যথাটা কার বিপদের কথা ভেবে হচ্ছে|

“কথার খেলাপ আমি করিনি মিস্টার দত্ত|” অনিরুদ্ধর কাটা-কাটা গলাটা শুনে আমার আবার সম্বিত ফিরল| “যে স্পেশাল কনসাইনমেন্টটা খিদিরপুরের গোডাউন থেকে নিয়ে আপনার দোকানে পৌঁছে দেওয়ার কথা আমার ছিল, তাতে খেলনার নামে যে ড্রাগ যাচ্ছে সেটা আমি টের পেয়েছিলাম ওখানে কিছু জিনিস দেখে আর কথা শুনে| আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে বোনাসের লোভ দেখিয়ে আমাকে দিয়ে কোম্পানির গাড়িতে করে আপনি ও জিনিস ঢালাও বিলি করার রাস্তা পরিষ্কার করছেন| বোনাসের টাকাটা আমার মেয়ের জন্যে কাজে লাগত, কিন্তু তাই বলে ড্রাগস?” অনিরুদ্ধর গলার আওয়াজে এমন কিছু ছিল যে মুশকো লোকটা আর নিজেকে সামলাতে পারল না, অনিরুদ্ধকে একটা ধাক্কা মেরে সে ঘরের কোনায় ঠেলেই দিল| ও’র বউ সেদিকে ছুটতে যাচ্ছিল, কিন্তু দত্ত নামের লোকটা খপ করে বাচ্চা মেয়েটার একটা হাত ধরে মুচড়ে দিল| মেয়েটা ব্যথায় কাতরে উঠল, আর ঘরের সবাই একদম স্থির হয়ে গেল|

যেন কিছুই হয়নি এই রকম একটা ভঙ্গিতে লোকটা বসা অবস্থা থেকে উঠে দাঁড়াল, আর মেয়েটার ঘাড়ের কাছে আঙুলটা একটা বিষাক্ত সাপের মতো আলতো করে ঘষতে ঘষতে বলল, “আর তাই আপনি কাউকে কিছু না জানিয়ে ড্রাইভারকে এমন তাড়া দিলেন যে সে যেখানে সব থেকে বেশি পুলিশ পোস্টিং থাকে, সেই কুইন্স রো-র মুখটায় ট্র্যাফিক আইন ভাঙল| সার্জেন্ট যখন আপনাদের দাঁড় করাল তখন আপনি তাকে আমার দেওয়া ওয়ার্ক-অর্ডার দেখালেন যাতে বলা ছিল যে সকাল সাড়ে দশটার মধ্যে জিনিস পৌঁছে দিতেই হবে| খুব স্বাভাবিকভাবেই সার্জেন্ট কন্টেন্ট চেক করল, এবং তখন আপনি কোনভাবে তাকে আভাস দিলেন যাতে খেলনাগুলো খুব ভালো ভাবে পরীক্ষা করা হয়| সাব্বাশ!” শেষের কথাটা খুব তারিফ করার ভঙ্গিতে বললেও লোকটার মুখ দেখে আমি বুঝতে পারছিলাম যে রাগে সে থরথর করে প্রায় কাঁপছে| হয়তো সেজন্যেই লোকটার এর পরের কথাটা হিসহিসিয়ে বেরোল, “এত বুদ্ধি আপনার! তাও শেষে খেলনা বেচে দিন কাটাতে হয় আপনাকে?” অনিরুদ্ধর মুখে এতক্ষণে, ও’র আর ও’র মেয়ে-বউয়ের এই বিপদের মধ্যেও একটা তীব্র ব্যক্তিগত যন্ত্রণার ছাপ পড়তে দেখলাম, আর আমার চোখের সামনে আবার ভেসে উঠল সেই শনিবারের রাতটা|

***********

সেই রাতে পুরো ব্যাপারটা প্ল্যান-মাফিক এগোচ্ছিল| আমি কোচিং-এর পর সোজা ক্যাম্প করেছিলাম কালীবাড়ির মাঠে ঢিপিটার পেছনে| অনিরুদ্ধ খাওয়া সেরে ফেরার আগে আমি মাথার মধ্যে সম্ভাব্য ঘটনাক্রমটা বারবার ছকে নিচ্ছিলাম| একটা দারুণ উত্তেজনা হচ্ছিল আমার মধ্যে, কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম যে অনিরুদ্ধকে ভয় দেখানোটা সহজ হবে না| শেষ অবধি আমি ঠিক করেছিলাম যে ও’র সামনে না এসে বরং পেছন থেকে আসাটাই নিরাপদ হবে, কারণ তাহলে পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে নিছক কৌতূহলী হয়ে তাকালেও ও কালীবাড়ির একপাশে ছোট্ট ঘরটা, যেখানে শিবলিঙ্গ থাকে আর যেটা নিয়ে প্রচুর গল্প-গুজব চালু আছে, সেখান থেকেই একটা লাল-চোখো লম্বা মূর্তিকে বেরিয়ে আসতে দেখবে, এবং সেক্ষেত্রে এফেক্টটা জোরালো হতে বাধ্য| এই পরিকল্পনায় একটাই সমস্যা হতে পারত, আর সেটা হল মন্দিরের পাশে ঝিমোনো নেড়ি কুকুরগুলো, যারা কালীবাড়ির পেছন দিয়ে আমার সন্তর্পনে শিবমন্দিরটার দিকে এগোনো, আর সেখানে লুকিয়ে থাকা মেনে নাও নিতে পারে| সৌভাগ্যক্রমে, এসব কোন ঝামেলাতেই আমায় পড়তে হয়নি সেই রাতে| আমি অনিরুদ্ধকে কালীবাড়ির কাছাকাছি আসতে দেখেই এক দৌড়ে শিবমন্দিরের পেছনে পৌঁছে যাই| কিছুক্ষণ পরে, যখন কালীবাড়ি আর ওদের কোয়ার্টারের মধ্যের তিনটে ল্যাম্পপোস্টের মধ্যে প্রথমটা অনিরুদ্ধ পেরিয়েছে, তখন আমি মন্দিরের পেছন থেকে বেরিয়ে ও’র পিছু নিই|

পেছনে পায়ের শব্দ পেয়ে অনিরুদ্ধ প্রথমে ঘাড়ের ওপর দিয়ে, তারপর পুরোপুরি ঘুরে দাঁড়িয়ে আমায় দেখে| নিজের মুখে বললে গর্ব শোনাতে পারে, তবে খুব সামান্য জিনিস দিয়েও ভয় দেখানোর মতো স্পেশাল এফেক্ট বানানোয় আমি সেই বয়সেই সিদ্ধিলাভ করেছিলাম| ফলে হঠাৎ করে অন্ধকার এবং নির্জন মাঠে আমাকে ওই “রূপে” দেখে অনিরুদ্ধ যে ভয় পাবে, এ ব্যাপারে আমি প্রায় নিশ্চিত ছিলাম| যেটার জন্যে আমি প্রস্তুত একেবারেই ছিল না সেটা ঘটে যখন ও ছুটে পালানোর চেষ্টা না করে, বরং মুখ দিয়ে একটা গোঁ-গোঁ আওয়াজ করে ওখানেই পড়ে যায়| আমি আত্মপ্রসাদে আর আনন্দে একটু ফুলে উঠলেও অনিরুদ্ধকে নিয়ে চিন্তিত হয়ে পড়েছিলাম, তাই “খেলা শেষ” বলে আমি ও’র কাছে তখন যাই| ও’র গায়ে হাত দিয়ে সেই রাতে কিন্তু আমি চমকে উঠেছিলাম| ও’র গা ছিল বরফের মতো ঠান্ডা| জীবনবিজ্ঞান পড়ার সুবাদে যেটুকু জ্ঞান হয়েছিল, সেটার প্রয়োগ করে আমি তখন ও’র পালস্ রেট বোঝার চেষ্টা করি, এবং আবার ধাক্কা খাই রেডিয়াল ধমনীতে কোন স্পন্দন খুঁজে না পেয়ে| অনিরুদ্ধ মৃত! এমন কিছু হতে পারে, এটা আমার ধারণাতেও ছিল না| ভয়ে কিছুক্ষণ জড়বুদ্ধি হয়ে দাঁড়িয়ে থাকার পর আমি শেষ অবধি ডাক্তার ডাকার সিদ্ধান্ত নিই| আমি জানতাম যে অনিরুদ্ধর যাই হোক না কেন, আমার কপালে অশেষ লাঞ্ছনা আছে, তবুও আমার খেলার এই পরিণতি আমি মেনে নিতে পারছিলাম না| যেহেতু অত রাতে ডাক্তার বলতে একমাত্র সম্বল হতে পারত রেলের কোয়ার্টারগুলোর এক প্রান্তের ওষুধের দোকানের ফার্মাসিস্ট, আমি সেই দিকেই ছোটা শুরু করি| কিন্তু ইঁটের স্তূপটার কাছে যখন পৌঁছে গেছি তখন পেছন থেকে একটা আওয়াজ শুনি: “দীপন!”

********

“দীপন!” কলকাতার এক এঁদো গলির এই বাড়িতে, তাও আবার দত্ত পদবি-ধারী ভদ্র চেহারার আড়ালে লুকিয়ে থাকা একটা জঘন্য লোকের মুখে, হঠাৎ নিজের “সন্দীপন” নামের এই সংক্ষিপ্ত সংস্করণটা শুনে আমি আবার বর্তমানে ফিরে এলাম| “অনাথ ছেলেমেয়েদের খেলনা দেওয়ার জন্যে আপনি আর আপনার কয়েকজন বন্ধু এই ফাউন্ডেশনটা চালান, সেটা আমরা জানি|” বেশ নিশ্চিন্তভাবে ঘরের এদিকে-ওদিকে তাকিয়ে আর বাচ্চা মেয়েটার ঘাড়ের কাছটায় সেই গা-ঘিনঘিনিয়ে ওঠার মতো করে আঙুল  বোলাতে-বোলাতে লোকটা বলে চলল, “তাই, আজ আমার ল’ইয়ার আমার বেইলটা করিয়ে দেওয়ার পর যখন আমি জানতে পারলাম যে আপনি আপনার ফাউন্ডেশনের কাজে কোথায় একটা যেন গেছেন, তখনই আমি ঠিক করি যে আপনার ফ্যামিলিকে, আর তার মাধ্যমে আপনাকে একটা সারপ্রাইজ দেওয়া যাক| তাহলে এবার আমার খেলাটা শুরু করা যাক?”

দত্তর মুখে এই শেষ কথাটা শোনামাত্র ওর, আর ওর সঙ্গের লোকটার চোখে আমি এমন একটা ভয়াবহ ইঙ্গিত দেখলাম, যে আমার খুব অস্থির লাগতে শুরু করল| গলার ব্যথাটা ততক্ষণে গলা ছাপিয়ে আমার সর্বাঙ্গে ছড়িয়ে পড়েছে| কিন্তু সেই মুহূর্তে আমার চোখ পড়ল বাচ্চা মেয়েটার দিকে, আর আমার বুক কেঁপে উঠল যখন আমি বুঝতে পারলাম, মেয়েটা একদৃষ্টে আমার দিকেই তাকিয়ে আছে| আমি কতটা অবাক হলাম সেটা ঠিক বুঝিয়ে উঠতে পারব না, তবে তার থেকেও বেশি অবাক হলাম যখন মেয়েটা হঠাৎই রিনরিনে সুরে আমার চোখে চোখ রেখে জিজ্ঞেস করল, “তোমার গলায় কি খুব ব্যথা?” মনে হল, ঘরের মধ্যে সবাই, আর সব কিছু, থেমে গেছে| আমি অনিরুদ্ধর দিকে এক ঝলক তাকিয়ে বুঝলাম, ও আমাকে দেখতে পাচ্ছে না| নাকি পাচ্ছে? সেই রাতের পর থেকে ওকে আর যেই বিশ্বাস করুক আমি করতে পারব না|

**********

আমার নাম ধরে ডাকটা শুনে আমি ছুটন্ত অবস্থাতেই পেছন ঘুরে তাকিয়েছিলাম সেই রাতে| অন্ধকারের মধ্যেও আমার বুঝতে অসুবিধে হয়নি যে অনিরুদ্ধ উঠে দাঁড়িয়েছে| অবাক হয়ে যাওয়ায়, বা অন্য কোন অনুভূতির বশে, আমি একটা আধলায় হোঁচট খাই, আর ঠিকরে পড়ি ইঁটের স্তূপটার ওপর| আমার গলাটা গিয়ে পড়ে একটা ইঁটের কোনায়, আর তারপরেই আমি বর্তমান থেকে অতীত হয়ে যাই!

পরে, নিজের দুমড়ে যাওয়া শরীরটার পাশে দাঁড়িয়ে, অনেক লোকের ভিড়ে ফোঁপাতে থাকা অনিরুদ্ধর মুখেই শুনেছিলাম যে কীভাবে ও আমাকে দেখেছিল বইয়ের দোকানের এক কোনায় দাঁড়িয়ে ও’র মা আর দোকানের কাকুর কথা শুনতে, আর তারপর থেকেই ও তৈরি হতে শুরু করেছিল এই রাতের জন্যে (‘ইঁদুরকল’ দেখতে গিয়ে ও’র ওই মন্তব্যটাও কি আমার জন্যে টোপ ছিল? হয়তো)| রীতিমতো প্র্যাকটিশ করে অভ্যস্ত হওয়ার পর ওর মায়ের প্রসাধনী বাক্স থেকে নেওয়া স্পিরিটের সাহায্যে শরীরের অনাবৃত অংশটা ঠান্ডা করে নিয়েছিল মাঠের মধ্যে চলতে-চলতেই, আর বগলের তলায় একটা টাইট করে বাঁধা কাপড়ের বল গুঁজে সাময়িকভাবে বন্ধ করে দিয়েছিল রেডিয়াল ধমনীকে স্পর্শ করে পালস্ বোঝার পথ|

ওর এসব কথা শুনে রাগ হওয়ার বদলে ওর প্রতি বেশ একটা সম্ভ্রমের অনুভূতিই গড়ে উঠছিল, কিন্তু ঠাকুমাকে দেখে আমার অবস্থা বদলে গেল| ঠাকুমা কিছুতেই মেনে নিচ্ছিল না আমার অবস্থাটা, বার-বার বলছিল, “দিপু, এবার ওঠ| আমি জানি তুই আমায় ভয় দেখানোর জন্যে এভাবে শুয়ে আছিস|” শেষের দিকে গলাটা রোজকার মতো হাসি আর রাগ মেশানো ছিল না, কেমন যেন একটা শূন্যতা আর হাহাকারে ভরে যাচ্ছিল ঠাকুমার গলাটা| আমি তখনই ঠিক করে নিয়েছিলাম যে আমি এর বদলা নেবই|

*********

“মেয়েটা পাগল নাকি স্যার?” মুশকোর ফ্যাঁসফেঁসে গলাটা শুনে আমি আবার বর্তমানে ফিরে এলাম| “ওই দরজায় কেউ তো নেই! তাহলে মেয়েটা কার সঙ্গে কথা বলছে?”

দত্ত বোধহয় কিছু বুঝতে পেরেছিল, তাই ও খুব সংক্ষেপে নির্দেশ দিল, “পাশের ঘরটা দ্যাখ| আমি এদিকটা দেখছি|” দত্তর হাতে কখন যে একটা ছোট্ট, প্রায় খেলনার মতো পিস্তল উঠে এসেছে, আমি টেরই পাইনি| ইতিমধ্যে মুশকো আমার গা ঘেঁসেই ঘরটায় ঢুকল, আর আমি বুঝতে পারলাম, লোকটাকে কব্জা করার এর থেকে ভালো সুযোগ আর আসবে না| সেই রাতে আমি যদি আজকের মতো করে এসব জিনিস পারতাম, তবে গল্পটা এই জায়গায় এসে পৌঁছতে পারত না, কারণ অনিরুদ্ধর নটে গাছটি তাহলে সেই রাতেই মুড়িয়ে যেত| আসলে হঠাৎ করে মারা গেলে সবারই এমন হয় কি না জানিনা, তবে আমি ওই ইঁটের স্তূপ আর কালীবাড়ির মাঝেই রয়ে গেছিলাম| অন্য কোথাও যেতে যতবার চেষ্টা করেছি, কেন জানিনা মোটেই ভালো লাগেনি| আর ঠাকুমার মুখে শোনা অন্য সব জায়গা (স্বর্গ, নরক) আদৌ আছে কি না তাও জানতে পারিনি, কারণ ওপরদিকে আমি কখনও উঠতে পারিনি| তাই আমার জায়গায় যাতে অন্য কেউ আস্তানা গাড়তে না পারে সেটা নিশ্চিত করার জন্যে আমার একমাত্র হাতিয়ারটি সেই দিন থেকে ঠিকমতো ব্যবহারের চেষ্টা করে এসেছি| বছর কুড়ির অভ্যাস, সেও আবার ওই ইঁটের ঢিপির ভারী ভারী ইঁট তুলেই, ফলে দেওয়ালের তাকে রাখা কেজি পাঁচেকের টিনটা তুলে মুশকোর ঠিক ব্রহ্মতালুতে সপাটে বসিয়ে দিতে আমার কোন অসুবিধেই হয়নি| আর তারপর আমি এই কুড়ি বছরে একেবারে দুরুস্ত করে ফেলা আমার দ্বিতীয় বিদ্যাটি কাজে লাগালাম, অর্থাৎ মুশকোর অজ্ঞান শরীরটাকে কব্জা করে বাইরের ঘরে এলাম|

galpoKHELA-2 (Medium) দত্ত মুশকোর শরীরটাকে ঘর থেকে বেরোতে দেখে প্রথমে আশ্বস্ত হয়ে পিস্তলটা অনিরুদ্ধর দিক থেকে নামালেও যেই মুহূর্তে মুশকোর চোখের দিকে তাকাল, সেই মুহূর্তেই ও’র মাথায় ঘুরতে থাকা লাল আলোগুলো জ্বলে উঠেছিল নিঃসন্দেহে| কিন্তু ওকে আর কিছু করার সুযোগ আমি দিইনি| মুশকোর পকেটে থাকা একটা লোহার ছোটো, কিন্তু শিসে দিয়ে ভারী করা, হাতুড়ি ততক্ষণে আমি পেয়ে গেছি, আর সেটা লোকটার কপাল লক্ষ করে ছুড়তে আমার যতটুকু সময় লেগেছিল সেটা এই বাক্যটা পড়তে গিয়ে আপনাদের ব্যয় করা সময়ের চেয়েও কম| তবে আমাকে এটাই খেয়াল রাখতে হয়েছিল যে অনিরুদ্ধ আর তার পরিবার যেন অনর্থক পুলিশি ঝামেলায় না জড়িয়ে পড়ে| তাই টিন আর হাতুড়ি দুটোই আমি বেশ মোলায়েম

করেই ব্যবহার করেছিলাম| ফাউন্ডেশনের নাম শুনেই আমি বুঝতে পেরেছিলাম যে অনিরুদ্ধ ওর মতো করে আমাদের হিসেবটা বরাবর করার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে| তবে আমি বিশেষ ভাবে কৌতূহলী ছিলাম ওর মেয়েকে নিয়ে| তাই মুশকোর শরীরটা ছেড়ে আমি বেরিয়ে এলাম এটা দেখার জন্যেই যে মেয়েটা এখনও আমায় দেখতে পায় কি না| ততক্ষণে অনিরুদ্ধর বউ আর অনিরুদ্ধ ওর মেয়েকে জড়িয়ে ধরে কান্নাকাটি শুরু করেছে| কিন্তু তারই মধ্যে মেয়েটা আবার আমার চোখে চোখ রেখে বলল, “তোমার গলায় কি খুব ব্যথা?”

অনিরুদ্ধ ইলেকট্রিক শক খাওয়ার মতো ঘুরে আমার দিকে তাকাল, আর আমি বুঝতে পারলাম যে ও-ও আমায় দেখতে পাচ্ছে| ওর প্রায় বুঁজে যাওয়া গলা থেকে টুকরো-টাকরা কিছু শব্দ বেরোল, যেগুলোর মধ্যে ‘ক্ষমা’, ‘কৃতজ্ঞ’, ‘ফিরে এসেছিস’ এমন কয়েকটা বোধগম্য হল| তবে আমার সেদিকে খেয়াল ছিল না| কারণ আমি বুঝতে পারছিলাম যে আমার গলায় আর ব্যথাটা নেই| আরও একটা জিনিস আমি অনুভব করলেও বিশ্বাস করতে পারছিলাম না, যদি না অনিরুদ্ধ, ওর বউ, আর ওর মেয়ের চোখের নড়াচড়া আমার অনুভূতিটাকে সত্যি বলে বুঝিয়ে দিত: আমি ক্রমশ ওপরে উঠছি!

আমি এখনও ওপরে উঠছি| মেঘ ছাড়িয়ে উঠে, পায়ের নিচে নীল বলের মতো পৃথিবীকে ফেলে এখন আমি মহাকাশের যেদিকে যাচ্ছি সেদিকটায় অজস্র তারা, নানা রঙের আলো, আর কেমন যেন একটা হালকা সুরের মতো শোনা যাচ্ছে| সুরটা যেন চেনা-চেনা, সন্ধেবেলা ধুনোর ধোঁয়ার সঙ্গে কার গলায় যেন এই সুরটা শুনতাম| ঠাকুমা! আমি আসছি তোমার কাছে| এবার আবার আমায় দেখে ভয় পাবে না তো?

ছবিঃ শিমূল৯৯