গল্প-গোবরে পল্টুফুল-রাজীব কুমার সাহা-বর্ষা ২০১৬

galpogobor (Medium)

আমাদের পল্টু। পুরো নাম পল্টুরাম তালুকদার। পল্টু শুধু নামেই তালুকদার অবশ্য। থাকে গাঁয়ের বাইরের দিকে একটা ঝুপড়িতে। বাবা বিড়ি বাঁধে। খুবই টানাটানির সংসার। পল্টুর গায়ে গতরেও তালুকদারির যথেষ্ট অভাব রয়েছে। হাড় জিরজিরে ল্যাকপ্যাকে ছোটোখাট শরীর। তবে ওর শ্মশ্রুবিহীন মুখখানা কিন্তু বেশ মায়াময়। আয়ত চোখদুটোতে জন্ম থেকেই কাজল মাখা। ফলে ওর বার্থ সার্টিফিকেটের কাগজ হাতে না পাওয়া অবধি কেউই চট করে পল্টুর বয়সের আন্দাজ করতে পারে না, সাত কি সতেরো। তাই নিজের গ্রাম অনন্তপুরে তো বটেই, ভিন গাঁয়েও পল্টুকে ‘ডেগাবুড়া’ নামে একডাকে সবাই চেনে।

গ্রাম্য ভাষায় ডেগা মানে কচি। পল্টুর এই ‘ডেগাবুড়া’ নামের জন্যে একমাত্র দায়ী হচ্ছে ওর মুখটা আর চালচলন। পল্টুর মুখে অহোরাত্র শুধু বড়ো বড়ো কথার খই ফোটে, দশটার মধ্যে আটটা কথাই মিথ্যে। হাবভাব, চালচলন আর ওর শারীরিক ভাষার কাছে বোধকরি একজন বছর পঞ্চাশের প্রৌঢ়ও হার মানতে বাধ্য হবেন। এক থেকে দশ পর্যন্ত গুনতে শেখার পরই পড়াশুনোয় ইতি টেনে দিলেও ভূ-ভারতে এ হেন কোনও টপিক নেই যার বিষয়ে পল্টুর জ্ঞান নেই। গোড়ার দিকে কেউ আড়াল থেকে পল্টুকে ‘ডেগাবুড়া’ বলে আওয়াজ দিলে প্রায় আধাবেলা খুব খ্যাপাখ্যাপি করত ও।

এখন অবশ্য হঠাৎ কেউ প্রকাশ্যে ওই নামে ডাকলেও পল্টু রাগ করে না মোটেও। মুচকি হেসে এগিয়ে যায়। বোঝা যায়, ভেতরে ভেতরে বেশ উপভোগই করে নামটা পল্টু। কারণ, পল্টু মনে মনে যাচাই করে দেখেছে লোকের মুখে ‘ডেগাবুড়া’ শুনে ও খেপে উঠলেই আশেপাশের লোকজনসব কিছু একটা ছুতোনাতা করে আড়াল হয়ে যাচ্ছে। ওর বড়ো বড়ো কথার নির্বিবাদী শ্রোতার সংখ্যা দিনদিন কমে যাচ্ছে।

কথা বলতে না পেরে পল্টুর পেট ফুলে জয়ঢাক হয়ে যাচ্ছে। পুরো দিনটাই মাটি। তাই সকালে রোজ সূর্য ওঠার খানিক পরেই কয়েক পা দূরে কলে গিয়ে ওর মালিকের অন্তত বার তিনেক হাঁকাহাঁকির আগে মোটেও দোকানের ধূপ-ধুনোর জল নিয়ে ফিরতে পারে না পল্টু। কারণ, সারাদিনের গপ্পের শুরুটা অন্যান্য দোকানীদের সাথে কলের গোড়াতেই সারতে হয় ওকে। ‘মর্নিং শোজ দ্য ডে’ কথাটির ঘোরতর বিশ্বাসী পল্টু। তাই রোজ গপ্পের ব্রেকফাস্টটা বেশ তাগড়াই না হলে কিছুতেই চলে না ওর। সকালের পারফরমেন্সটার ওপরই বেশি গুরুত্ব দেয় পল্টু। একমাত্র মুখটা দিয়েই ওর তালুকদার পদবীটার প্রতি সুবিচার করে আসছে এ যাবৎ ও।

হ্যাঁ, একটা মুদি দোকানে কাজ করে আমাদের পল্টু। সিদ্ধেশ্বরী স্টোরসে। মুখে যতই হামবড়াই করুক না কেন, পল্টু কিন্তু কখনই ওর কাজে ফাঁকি দেয় না। শুধু ওই সকালের কলের গোড়ার ব্রেকফাস্টটি ছাড়া। দোকানে পল্টুর মুখ আর হাত একসাথে চলে। কোনও খরিদদার দর কষাকষি করে বা জিনিস পছন্দ না করে খালি হাতে দোকান থেকে বেরিয়ে যাবে, পল্টু বেঁচে থাকতে এ কিছুতেই হবার নয়। পল্টু একজন দক্ষ সেলসম্যান। ইঁদুরে টোকা আলুর দাম নামিয়ে, পেঁয়াজের দাম চড়িয়ে কত্ত বেচেছে পল্টু। খরিদদার পেঁয়াজের দাম দু’টাকা বেশি কেন জানতে চাওয়া মাত্রই পল্টু তড়বড়িয়ে বলে উঠছে, “আসল জিনিস কাকু, আসল জিনিস। আজকাল বিষাক্ত ওষুধ ছাড়া কোন জিনিসটা হয় বলুন! তবে আমাদের পেঁয়াজে ওই বিষটি পাবেন না। উত্তরপ্রদেশের হাতে গোনা তিনটে খেতেই এর চাষ হয় মাত্র। একেবারে নির্ভেজাল। গোটা অনন্তপুর সারাদিন চষে ফেললেও এ জিনিসটি হাতে পাবেন না বলে দিলুম। এ পেঁয়াজ শুধু আমরাই আনাই। একেবারে গন্ধেশ্বরীর দিব্যি।” এক শ্বাসে কথাগুলো আওড়ে ডানহাতের একটা আঙুল নাকের ডগা আর বুকের মাঝে ঠেকায়। সিদ্ধেশ্বরী স্টোরসে পল্টু একজন সাধারণ কর্মচারী হলেও দোকানটাকে গ্রামসুদ্ধু সবাই পল্টুর দোকান হিসেবেই চেনে। তাই কানের কাছে হরদম একটা অল ইন্ডিয়া রেডিও বাজতে থাকলেও পল্টুর মালিক কখনও তাড়িয়ে দেননি ওকে।

অনন্তপুরে পল্টুর আরেকটা পরিচিতিও আছে। আমাদের পল্টু বড্ড পেটুক ছেলে। আসলে এই পেটুক পল্টুরামকে নিয়েই আজকের গল্প। ভীষণ খেতে ভালোবাসে পল্টু। তাই গ্রামে কোথাও আচার-অনুষ্ঠানের আগাম খবর পেলেই ওর মনটা নেচে উঠে। যদিও বেশিরভাগ নেমন্তন্নবাড়িতেই পল্টুদের নেমন্তন্ন থাকে না। কারণ, পল্টুরা খুবই গরিব। নিতান্তই বাধ্য বাধকতা না থাকলে এই শ্রেণীর লোকদের বাড়িতে নেমন্তন্ন করে এনে খাওয়াতে গেলে মানীদের মান থাকে না। পল্টুর স্বজাতিরা অবশ্য একে অপরকে নেমন্তন্ন করে হামেশাই। কিন্তু পল্টুর মতো বলিয়ে কইয়ে আর কোপ্তা-কালিয়া খাইয়ে লোক ওসব বৈষ্ণবসেবার নেমন্তন্নের ধারও মাড়ায় না। পল্টুর নজর সবসময় কোকিলের মতো, গাছের মগডালে। কাকের মতো আস্তাকুঁড়ে নয়। তাই অনন্তপুরের কোনও এলেমদার লোকের বাড়িতে কোনও আচার-অনুষ্ঠানে দু’তিনদিন আগে থেকেই ছটফট করতে থাকে ও। ওই বাড়ির লোকদের সাথে কারণে-অকারণে যেচে কথা বলা শুরু করে, অযথা আগুপিছু ঘুরঘুর করে। মায় সেই বাড়ির চাকর-বাকরদেরও বেশ তোল্লা দেয় তখন। দোকানে সদাই নিতে এলে চলতি খরিদদারকে আটকে রেখে ওদের আগে ছেড়ে দেয়। কে জানে, হঠাৎ যদি বেড়ালের ভাগ্যে শিকে ছেঁড়ে! আচমকা কেউ যদি মুখ ফসকে পল্টুকে নেমন্তন্ন করে বসে! এক্ষেত্রে ওর নিজস্ব ‘পেক্টিস’এর কথা মনে বিশেষ স্থান দেয় না সে। প্রেস্টিজকে হামেশা পেক্টিস বলে পল্টু।

অনন্তপুরে হাতে গোনা জনাকয়েক যারা নিজেদের সম্ভ্রান্ত বলে মনে করেন, হরিনারায়ণ চট্টোপাধ্যায় তাদের মধ্যে একজন। কাল বাদে পরশু উনার একমাত্র নাতির মুখেভাত। অত্যন্ত কৃপণ স্বভাবের লোক এই হরি চাটুজ্যে। বছরে এক দু’বার পুজো-আর্চ্চা বা ব্যাপার-স্যাপারে গ্রাম ঝেঁটিয়ে নেমন্তন্ন করেন ঠিকই, তবে বেলা শেষে এক-তৃতীয়াংশ লোককেই হয় আধপেটা নয় না খেয়ে ঘরে ফিরে এসে ঢকঢক করে দু’গ্লাস জল খেতে হয়। হরি চাটুজ্যের মতে প্রতিবারই রান্নার ঠাকুর কারসাজি করে অল্প কিছু রাঁধাবাড়া করে বাকিটা লুকিয়ে পুঁটলি বেঁধে নিয়ে যায়। তবে এবারের ব্যাপারটা ভিন্ন। এবার নাতির মুখেভাতের দায়িত্ব পুরোটাই ছেলে রজত কাঁধে তুলে নিয়েছে। বাবার উপর ভরসা করার চেয়ে নিজের মান-সম্মানটাই বড়ো করে দেখেছে বোধহয়। রজত বিখ্যাত একটা বিস্কুট কোম্পানিতে চাকরি করে ব্যাঙ্গালোরে। বাবার পুরনো রান্নার ঠাকুরকে বাতিল করে নতুন উড়িয়া পাণ্ডা ঠিক করা থেকে শুরু করে বাজার হাটের ব্যবস্থা পর্যন্ত পুরোটাই এবার নিজের হেপাজতে রেখেছে। তবে ফোন, স্ত্রীর এটিএম কার্ড আর ঘনিষ্ঠ দু’একজন বন্ধু-বান্ধবের মাধ্যমে। কারণ, অনুষ্ঠানের দিন দুপুরের পর ছাড়া রজত বাড়ি আসতে পারছে না, ছুটি নেই।

সব দেখে শুনে হরি চাটুজ্যে ব্যাজার মুখে নেমন্তন্ন করতে বেরোলেন। সকাল সকাল আট-দশটা বাড়ি ঘুরে এসেই হরি চাটুজ্যে সিদ্ধেশ্বরী স্টোরসের বারান্দার টুলটায় এসে হাঁফ ছেড়ে বসলেন। এক টিপ নস্যি ঠেসে নোংরা রুমালটা দু’বার নাকের দু’দিকে ডলে হাঁক দিলেন, “কই হে জগদীশ, বেচাকেনা কেমন চলছে হে?”

সিদ্ধেশ্বরী স্টোরস তথা পল্টুর মালিক জগদীশ সরকার গদগদ হয়ে কিছু একটা উত্তর দিতে যাবেন, হঠাৎ পল্টু এক লাফে দোকান থেকে বেরিয়ে এসে বলল, “ইস, কী গরমটাই না পড়েছে! অঘ্রাণ শেষ হতে চলল তবু তাপের কমতি নেই। একটা কোল্ড ড্রিংস খান না জ্যাঠামশাই। দিই এনে? আরাম পাবেন।”

হরিনারায়ণ আমতা আমতা করারও সময়টুকু পেলেন না। পল্টুর পটু হাত ততক্ষণে ফ্রিজের দরজা ফাঁক করে ফেলেছে। জগদীশ সরকার আড়চোখে কটমট করে তাকাতেই পল্টু নিচু স্বরে বলল, “বুড়ো চলে গেলে রজতদার খাতায় টুকে রাখবেন। রজতদা কখনও হিসেব চেয়ে পেমেন্ট করে না। আর চাইলে এই শর্মাকে দেখিয়ে দেবেন। ওটির দাম তো দেবেনই, বাড়তি আরও পাঁচটা বাড়িতে প্যাক করে নিয়ে যাবেন। এই বলে রাখলুম।”

কোল্ড ড্রিঙ্কসে খুব কাজ দিয়েছে শেষপর্যন্ত। হরিনারায়ণ জগদীশের সাথে পল্টুকেও নেমন্তন্ন করে গেলেন। যদিও পল্টুর নেমন্তন্নটা জগদীশ সরকারের মতে হরি চাটুজ্যের দিকে পল্টুর আকুতি ভরা করুণ চোখে তাকিয়ে থাকার ফল। কারণ, জগদীশকে হরি চাটুজ্যে তার বাড়িতে আগামী পরশু চাট্টি ডাল-ভাতের নেমন্তন্ন করার সময় পল্টু নাকি আরও ঘন হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দাঁত কেলিয়ে বলেছিল, “কাজকম্মের বাড়ি, দরকার পড়লে কিন্তু ডাকবেন জ্যাঠামশাই। লজ্জা করবেন না। এ গাঁয়ে কত বড়ো বড়ো কাজকম্ম এই পল্টুর হাতের ওপর দিয়ে গেল!”

হরি চাটুজ্যে একটু মুচকি হেসে বাড়ির পথ ধরলেন।

আজ গেল, কাল গেল, শেষে পরশু এল। আজ চাটুজ্যে বাড়িতে নাতির অন্নপ্রাশন। সকাল থেকেই পল্টুর মনে বেশ ফুর্তি আজ। কাল রাতে বালিশে মাথা দিয়েও অনেকক্ষণ জেগেছিল ও। আজ দোকান খুলে ধূপের জলের ঘটিটা হাতে নিয়েও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করল। প্রায় আধঘণ্টা দেরি করে কলে গেল। গিয়ে দাঁড়াতেই পাশ থেকে একজন জিজ্ঞেস করল, “কি রে পল্টু, আজ এত দেরি কেন?”

প্রশ্নটা কানে আসতেই চেহারার ভূগোলটা পালটে গেল পল্টুর। একরাশ বিরক্তির ভান করে বলল, “আর বলো কেন অশোকদা, রজতদাই ফাঁসিয়ে দিল শেষটায়।”

“কেন রে, কী হল আবার?’’ এবার আরেকজনের প্রশ্ন। যারা ছড়িয়ে ছিটিয়ে ছিল এতক্ষণ, আস্তে আস্তে সবাই জড়ো হতে লাগল পল্টুর আশেপাশে। পল্টু এক পলক মেপে নিল চারপাশটা। তারপর ছোট্ট একটা গলা খাঁকরি দিয়ে বলতে শুরু করল, “গত পরশু সকালে দোকানে এসে জ্যাঠামশাই কত করে বললেন, শেষতক আমার হাত পর্যন্ত ধরলেন। আমি রাজি হলুম না কিছুতেই।”

পেছন থেকে একজন মুখ টিপে টিপ্পনী কাটল, “কেন রে, হাত ধরল কেন? তোকে খুব করে নেমন্তন্ন করছিল বুঝি?”

“আরে ধুর, নেমন্তন্ন তো আগেই করেছেন। গত পাঁচদিন ধরেই করছেন যেখানে দেখা পাচ্ছেন। সে নয়, উনি চান আমি নিজে যেন সকালে বাজার থেকে মাছটা কিনে দিই। কোত্থেকে নাকি শুনেছেন মাছ কেনার ক্ষেত্রে আমার জহুরির চোখ। তাই অন্য কাউকে ভরসা করতে পারছেন না। আমি বাপু তৎক্ষণাৎ মানা করে দিলুম। বললুম, কোনও অসুবিধে হবে না। যে কাউকে পাঠিয়ে দিন, গিয়ে শুধু আমার নামটা বলতে বলবেন। মাছ আপনার খারাপ দেবে না। আমায় এবারটি মাপ করবেন জ্যাঠামশাই! দোকানটা খোলা রেখে কী করে যাই বলুন? বুঝতেই তো পারছেন সকালের বাজার।”

এক শ্বাসে কথাগুলো বলে একটু দম নেবার চেষ্টা করল ও। কিন্তু ওর আগ্রহী শ্রোতারা নিতে দিলে তবেই তো! সাথে সাথেই কোনও এক অসহিষ্ণু কণ্ঠের আওয়াজ এল, “তো এখন হয়েছেটা কী বলবি তো? মাছ তো আর কিনতে যাসনি আজ।”

“কে বলল যাইনি? রজতদাই তো ঘোঁট পাকাল শেষে। কাল সন্ধ্যের পর আমার মালিকের ফোনে কল এল রজতদার, সোজা আমাকে চাইল। পরিষ্কার বলল যে, আমাকেই নাকি যেতে হবে মাছ কিনতে। অন্য কেউ গেলে মাছ চিনে আনতে পারবে না। দামেও ঠকে আসবে। যত মানা করছি ততই তেতে উঠছে। এখন, রজতদা এতো করে বলছে, না-ই করি কীভাবে? আপনারা তো সবাই জানেন রজতদা আমাকে নিজের ছোটোভাই হিসেবেই মানে।”

“তা কী মাছ কিনলি রে হরি চাটুজ্যের জন্যে?” এবার একটা উৎসাহী কণ্ঠ কানে এল।

পল্টু সামান্য থতমত খেয়ে নজর লুকোতে লুকোতে বলল, “আমার তো গোড়া থেকেই ইলিশ কেনার ইচ্ছে ছিল। কিন্তু আজ ভোরে ইলিশের চালান আসেনি। যা আছে সব বাসি। মাছওয়ালাই চোখ টিপে ইশারা করল আমায়। তাই বাধ্য হয়ে কাতলই কিনতে হল। রজতদা অবশ্য গাঁই-গুঁই করতে পারে কাতলার কথা শুনলে।”

এবার ভিড়টা আস্তে আস্তে পাতলা হতে শুরু করল। সবাই জানে, হরি চাটুজ্যের বাড়ির কাতলা মানেই সরকারি দিঘির এক বিঘৎ চারাপোনা। আর এর ভেতর পল্টু মানেই চুনোপুঁটি।

দুপুর বারোটা একটার পর থেকেই খিদেটা বেশ চাগাড় দিয়ে উঠতে শুরু করল পল্টুর। ওর দোকান থেকে হরি চাটুজ্যের বাড়িটা খুব দূরে নয়। ব্যান্ডপার্টির অস্পষ্ট বাজনার সুর মাঝে মধ্যেই ভেসে ভেসে আসছে কানে। চাল ডাল মাপার ফাঁকে ফাঁকে কান খাড়া করে রেখেছে পল্টু। বাজনার তালে তালে খিদেটাও যেন পাল্লা দিয়ে বেড়েই চলেছে।

বেলা দেড়টা নাগাদ ক্যাশবাক্স গুছিয়ে চাবিটা পকেটে ফেলে উঠে পড়লেন জগদীশ সরকার। দোকান থেকে বেরিয়ে যাবার মুখে বললেন, “কই রে পল্টু, আমি বাড়ি গেলাম। জামাকাপড় পালটে হরিদার ওখানে যাব। আমি খেয়ে ফিরে এলেই তুই যাস।”

এই কথা বলে দোকানের বারান্দাটা পেরিয়েই আবার ফিরে এলেন জগদীশ। বললেন, “এক কাজ কর নয় পল্টু। তুই-ই বরং খেয়ে আয় এখন চট করে। তুই ফিরলে আমি বাড়ি যাব।”

পল্টু কয়েক সেকেন্ড চিন্তা করল। মনে মনে অঙ্ক করে নিল চটপট। ভাবল, এখন গেলে বেশ সুবিধে করা যাবে না। প্রথম দিকে একটু হাতে রেখেই পরিবেশন করা হয় সাধারণত নেমন্তন্ন বাড়িতে। তারপর মাঝামাঝি লোকসংখ্যার একটা আন্দাজ পেলে দিইয়ে-থুইয়েদের হাত খুলে যায় অনেকটা। পল্টু তাড়াতাড়ি বলল, “না না কাকু, আপনিই যান এখন। আপনি ফিরলে আমি যাব। আপনাকে রেখে আমার একা খেয়ে আসতে মোটেও ভাল লাগবে না। যান যান, দেরি করবেন না। ওদিকে কাকিমা হয়ত বসে আছেন সেজেগুজে।”

জগদীশ সরকার হৃষ্টচিত্তে এই যে দোকান থেকে বেরিয়ে গেলেন, আর সেই ফেরা ফিরলেন সন্ধ্যের মুখে। ঘড়ির কাঁটায় তখন চারটে কুড়ি। অঘ্রানের শেষ। বেলা আর হাতে নেই মোটেও। পল্টু ততক্ষণ নিজের হাত কামড়েছে, চুল ছিঁড়েছে, দফায় দফায় কান পেতে চাটুজ্যে বাড়ির ব্যান্ডপার্টির বাজনা শুনেছে আর কষিয়ে নিজের গালে থাপ্পড় মেরেছে। একটু যে গুড় কিংবা দু’টো বাতাসা ফেলে এক খাবলা মুড়ি বা চিঁড়ে চিবিয়ে পেটটাকে ঠাণ্ডা রাখবে, সে উপায়ও ছিল না। চিঁড়ে মুড়িতে পেট ফুলিয়ে রাখলে অন্নপ্রাশনে গিয়ে খাবে কী?

দোকানে ঢুকেই ব্যস্তসমস্ত হয়ে জগদীশ বললেন, “আর বলিস না পল্টু, তোর কাকিমাকে নিয়ে আর পারলাম না। সাজতে গোজতেই তিনটে সাড়ে তিনটে পার করে দিল। যা যা বাবা, শিগগির যা। বেলা পড়ে গেল যে!”

অথচ পল্টু স্পষ্ট দেখতে পেল জগদীশের দু’চোখে এখনও ভরা পেটের দিবানিদ্রার সুখটুকু জড়িয়ে আছে। ক্যাশে বসতে বসতে জগদীশ বললেন, “হরিদা আর যাই করুন নাতির মুখেভাতে জম্পেশ খাইয়েছেন রে পল্টু। একেবারে পোলাও দিয়ে শুরু আর ইয়াব্বড়ো রাজভোগ আর দই দিয়ে শেষ।”

 “তা মাছ কী খাওয়াল কাকু?”

“পাবদা খেলাম রে, পাবদা! হরি চাটুজ্যের বাড়িতে এই প্রথম।”

মুহূর্তে চোখদু’টো চকচক করে উঠল পল্টুর। জগদীশের অনুপস্থিতিতে ছোটো একটা ঝুমঝুমি ও হাতিয়ে রেখেছিল পকেটে। সেটা বাগিয়ে ধরে এক লাফে দোকান থেকে বেরিয়ে গেল।

হরি চাটুজ্যের বাড়িতে যখন পল্টু গিয়ে ঢুকল তখন বাড়ি প্রায় ঠাণ্ডা। শেষ পঙক্তিতে ব্যান্ডপার্টি আর পরিবেশন করেছিল যারা, তারা খেতে বসেছে। দু’চারজন আত্মীয়-স্বজন আর গ্রামবাসীও খাচ্ছেন বটে। গাছগাছালির মাথা থেকে সন্ধ্যে নেমে আসছে চুঁইয়ে চুঁইয়ে। উঠোনের কতগুলো এলোমেলো লাল প্লাস্টিকের চেয়ারের একটাতে ওপাড়ার ব্রজবাবু বসে আছেন কেবল। গেনি খ্যান্তিরা এদিক ওদিক অযথা দৌড়োদৌড়ি করছে। আছাড় খাচ্ছে, রং চটা জামাগুলো ধুলোয় সাদা হচ্ছে, উঠে আবার দৌড়চ্ছে। পল্টু খাবার প্যান্ডেলের পাশে সরে এল একটু। নাহ, এ পঙক্তিতে বসা যাবে না। পাতে মাংস পড়ে গেছে। এই মাঝামাঝি অবস্থায় গিয়ে পাত পাড়া যাবে না। সবুর করতে হবে। ও গিয়ে রজতের ঘরে ঢুকল।

রজতের ছেলে মুন্নাকে দারুণ লাগছে আজ। পরনে গরদের ধুতি পাঞ্জাবির সেট, কপালে আল্পনা আঁকা চন্দন। ছোট্ট টোপরটা পাশে পড়ে আছে। পকেটে হাতটা ঢুকিয়েও বের করে নিল পল্টু। সারা বিছানা জুড়ে নানান দামি দামি খেলনা আর জামাকাপড় ডাঁই করা। ওগুলোর পাশে ওর দশটাকা দামের ঝুমঝুমি? নেভার, পল্টুর ধড়ে প্রাণ থাকতে এ হবে না। রজত কীসের একটা আওয়াজ পেতেই ফিরে তাকাল পল্টুর দিকে। পল্টুও বত্রিশ পাটি দাঁত বের করে এগিয়ে এল। রজত বলল, “সে কি রে পল্টু, তোর এত দেরি কেন? যা যা, বসে পড়। ওদিকের পাট তো প্রায় শেষ হয়ে এল।”

রজতের কথার সাথে সাথে হ্যাংলার মতো দৌড়ে না গিয়ে একটা গয়ংগচ্ছ ভাব ফুটিয়ে তুলল পল্টু। চট করে বলল, “শহরে চালানে গিয়েছিলুম রজতদা। সেখানে অত করে বারণ করলুম, তা কে শোনে কার কথা। ভূপেনবাবু হোটেলে নিয়ে গিয়ে এক পেট খাইয়ে তবে ছেড়েছেন। জানেন খাসিটা আমি বরাবরই লাইক করি। সাথে বেশ বড় সাইজের একটা চিংড়িও গেলালেন জোর করে। আমায় নিজের ছেলের মতো দ্যাখেন কিনা! এখন তো মরে গেলেও খেতে পারব না। আমি তো শুধু মুন্নাকে একটু দেখতে এলুম। তাছাড়া জ্যাঠামশাই যখন দেখা হয়েছে তখনই এত করে বললেন যে… হে হে হে!”

“ভূপেনবাবু কে?”

“আমার মালিকের মালিক গো। উনার কাছ থেকেই তো আমরা বেশিরভাগ মাল কিনি।”

“আচ্ছা আচ্ছা, অল্প করেই কিছু একটা মুখে দিবি চল। আমরাও বসব এবার। ঘরের লোকেরা বাকি রয়েছে, চল।”

“সে ঠিক আছে। তোমায় ব্যস্ত হতে হবে না। আমি যাচ্ছি প্যান্ডেলে। তুমি সবাইকে গুটিয়ে নিয়ে এসো।”

প্যান্ডেলে ঢুকে ব্রজবাবু আর পল্টু বসল এক টেবিলে। হরি চাটুজ্যের বাড়ির লোকেরা ছড়িয়ে ছিটিয়ে বসল। একগাল পোলাওর সাথে বেগুনিতে একটা কামড় বসিয়ে পল্টু খেদোক্তি করল, “কী’রম লজ্জায় পড়লুম বলুন তো ব্রজকাকু! হরিজেঠু পই পই করে বলে দিলেন যে কোনও রকম উপহার-টুপহার যেন না আনি। আর এখানে এসে দেখলুম সবাই উপহার নিয়েই এসেছে। ছিঃ ছিঃ, আমার কী যে খারাপ লাগছে! নয়তো মুন্নার জন্যে একটা খুব দামি জামা পছন্দ করে রেখেছিলুম শহরে গত হপ্তায়।”

ব্রজবাবু তখন ঘাড় গুঁজে একমনে পাতে হাত চালাচ্ছেন। হঠাৎ কোত্থেকে রজত এসে উড়ে বসল পল্টুর পাশের চেয়ারে। হেঁকে বলল, “আমায় কিছু একটু দিয়ে দাও তো ভাই চট করে। বড্ড অবেলা হয়ে গেল।”

পল্টুর তো আঁতকে ওঠার মতো অবস্থা। একে সারাদিন খাওয়া নেই। তিনদিন তিনরাত এই নেমন্তন্নটার অপেক্ষা করেছে, স্বপ্ন দেখেছে। এখন সবচেয়ে দূরের কোণের টেবিলটাতে এসে প্রায় লুকিয়ে বসেছে খেতে। কিন্তু রজতদাও ঠিক এই টেবিলটাতেই বসল এসে? একটু আগেই তো ও বড়াই করে বলেছে যে শুধু রজতদের মন রাখতে ও বসবে একটুখানি পাতে। এখন কী হবে?

রজত পল্টুর কানের কাছে মুখটা এনে ফিসফিস করে বলল, “বিড়ি-টিরি ধরেছিস নাকি আজকাল? তখন তোর পকেটে কীসের যেন একটা আওয়াজ পেলাম, ঝনঝন করছিল দেশলাইয়ের মতো।”

ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে পল্টু তাড়াতাড়ি বলল, “না না, কী যে বল তুমি রজতদা! ও-ওতো দোকানের ক্যাশের চাবির ছড়াটা। জগদীশকাকু খুব বিশ্বাস করেন তো আমায়। সেই যে দুপুরে আমার হাতে দিয়ে বেরোলেন, তাড়াহুড়োর মধ্যে আর ফেরত দেয়া হয়নি।”

“ওহ তাই বল। তা তুই খাচ্ছিস না যে? সেই তো প্রথমবারের এক হাতা পোলাও নিয়েই নাড়াচাড়া করছিস তখন থেকে। আরেকটু নে!”

পল্টু একটা ঢোঁক গিলে বাধা দিয়ে বলল, “না না রজতদা, আমি ওইটুকুই খেতে পারব না পুরোটা। তোমায় বললুম না, শহরে চালানে গিয়ে সেই যে ভূপেনবাবু্‌…”

“ও হ্যাঁ হ্যাঁ, তা যতটুকু পারিস খা। ইচ্ছে বা খিদে না থাকলে কিন্তু জোর করে খাবি না এই অবেলায় একদম। শেষে বদহজম হয়ে ভুগবি।”

হাত ধুতে গিয়ে বেসিনের আয়নায় নিজের চেহারাটার দিকে ফ্যাল ফ্যাল করে তাকিয়ে রইল পল্টু। যতটুকু পোলাও গলার নিচে নেমেছে তাতে পেটের একটা কোণাও ভরেনি। উলটে প্রায় মরে যাওয়া খিদেটা আরও চাগাড় দিয়ে উঠেছে। এই, এই পোড়ার মুখটাই যত নষ্টের মূল। কত চেষ্টা করি হতভাগাকে আটকে রাখতে, কিন্তু বেফাঁস কিছু না কিছু একটা বেরোবেই বেরোবে! কী দরকার ছিল রজতদাকে ভূপেনবাবুর মিথ্যে গল্প শোনানোর? লাভটা কী হল? ঠিক করে দু’গ্রাসও পেটে যায়নি। আহা রে, ব্রজবাবুর পাতের পাবদার সাইজটা কী বড়ো ছিল! পাতে যেন আঁটছিল না পুরোটা। আর পাঁঠার মাংসটা? কী খুশবুই না ছাড়ছিল। গন্ধ শুঁকেই স্বাদটা আন্দাজ করা যাচ্ছিল। রজতদাটাই বা যেন কী, বেছে বেছে শেষে কিনা পল্টুর টেবিলেই এসে বসলি? কেন, গোটা প্যান্ডেলে আর কি কোনও টেবিল চেয়ার ছিল না? অদৃষ্ট, সবই অদৃষ্ট। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে আসছিল পল্টুর।

আড়াল করে নিজের শতচ্ছিন্ন রুমালটা বের করে হাতমুখ মুছে পাশেই বসানো পানের টেবিলটায় গিয়ে দাঁড়াল পল্টু। ভুরু উঁচিয়ে কিমাম-টিমাম দিয়ে একখানা সাঁচিপান অর্ডার করল বেশ হেঁকে। পানওলা ঠোঁটের কোণে একখানা ব্যঙ্গের হাসি ফুটিয়ে পানটা এগিয়ে দিল ওর দিকে। ওটা মুখে পুরে খাবার প্যান্ডেলের পেছন দিকে একটা হাতল ভাঙা চেয়ারে গিয়ে বসল ও। পেটের খিদেয় চোখমুখ যেন আরও শুকিয়ে গেছে। মনটা বারবার চলে যাচ্ছে ব্রজবাবুর পাতের দিকে। অত দামি পানটাও যেন তেতো লাগছে। নাহ, নেমন্তন্ন আজ খেতেই হবে ওকে। ভরপেটই খেতে হবে। কিন্তু কীভাবে? এখন তো আবার গিয়ে পাত পেড়ে বসা যাবে না প্যান্ডেলে।

সন্ধে পেরিয়ে পাতলা অন্ধকার নেমে এসেছে চারদিকে। আর বসে থাকলে হবে না, কিছু একটা করতে হবে। আস্তে আস্তে পল্টু রান্নার একচালাটার দিকে এগিয়ে গেল। তিনদিকে টিনের বেড়া দিয়ে রান্নার জায়গা করা হয়েছিল প্যান্ডেল থেকে একটু দূরে। পল্টু চুপিসারে মুখ বাড়িয়ে দেখল ওখানে একজন মাত্র লোক বসে আছে পেছন ফিরে। গুনগুন করে একটা সুর ভাঁজছে আর একটা চুলোয় তেলের কড়াই বসিয়ে কী যেন করছে। দুপুরের নেতিয়ে যাওয়া বেগুনিগুলো আবার ভাজছে বোধহয়। লোকটি হেডরাঁধুনি নয়। হেডরাঁধুনি উড়িয়া পাণ্ডাটাকে সকালে এক ঝলক দেখেছে ও। এ সেই লোক নয়। পল্টু পায়ে পায়ে লোকটার পাশে গিয়ে দাঁড়াল। লোকটা মুখ উঁচু করে তাকাতেই পল্টু মুচকি হেসে জিজ্ঞেস করল, “কি গো ঠাকুর, খাওয়াদাওয়া হয়েছে তোমাদের, অ্যাঁ?”

লোকটি ফোকলা দাঁত বের করে বলল, “না গো, আমি ঠাকুর নই। রেঁধেছেন তো পাণ্ডা মহারাজ। এখন নাইতে গেছেন। আমি তো জোগাড়ে।”

“তা তোমরা কিন্তু রেঁধেছ বেশ। খুব খেলুম গো পেট পুরে আজ।” এটা সেটা বলতে বলতে ভাব জমাতে শুরু করল পল্টু। আর সন্ধানী দু’টি চোখ চরকির মতো চারদিকে ঘোরাতে লাগল। মনে মনে যা খুঁজছিল পেয়ে গেল অচিরেই। লোকটির পাশেই দু’টো বড়ো বড়ো থালা কলাপাতা চাপা দেয়া রয়েছে। বরাত জোরে থালাগুলোর পাশের টিনের বেড়াটাও একটু উঁচুতেই বাঁধা হয়েছে মাটি থেকে। স্টিলের থালাগুলোর কানাগুলোও বেশ উঁচু উঁচু। যেকোনও একটা থালা টেনে গলিয়ে আনা যাবে টিনের নীচ দিয়ে। তবে কাজটা সারতে হবে খুব তাড়াতাড়ি। উড়িয়া পাণ্ডা স্নান সেরে ফিরে আসার আগেই। এখন চাই শুধু আংটা মতো কিছু একটা।

“নাহ যাই, দোকানে বসি গে। অনেক দেরি হয়ে গেল। আমায় ছাড়া আবার জগদীশ সরকার দিনেও অন্ধকার দেখেন,” বলে বেরিয়ে এসে একটু আড়ালে চলে গেল পল্টু। গা বাঁচিয়ে লুকিয়ে লুকিয়ে হন্যে হয়ে খোঁজাখুঁজি করেও আংটা মতো কিছুই পেল না ও হরি চাটুজ্যের বাড়িতে। “বুড়োকে সবাই কিপটে কি আর সাধে বলে!” মনে মনে হরি চাটুজ্যেকে গালি দিল পল্টু। হঠাৎ কী একটা মনে পড়তেই মুখটা উজ্জ্বল হয়ে উঠল পল্টুর। চাটুজ্যে বাড়ির লাগোয়া একটা আমবাগান আছে। তাড়াতাড়ি সেখান থেকে একটা আঁকশি মতো আমের ডাল ভেঙে নিয়ে এল ও। কিন্তু কপাল খারাপ। হামাগুড়ি দিয়ে টিনের ফাঁকে চোখ রেখে পল্টু দেখল পাণ্ডা বাবাজি ততক্ষণে এসে খেতে বসেছেন গুছিয়ে। জোগাড়ে লোকটি নেই। হয়ত স্নানে গেছে। ওর থালাটি কলাপাতা চাপা দেয়া আছে আগের মতোই। কিন্তু মুস্কিল হল, থালাটি এখন কিছুতেই টেনে বার করা যাবে না। পাণ্ডা মহারাজ ওই থালাটির সামনা সামনি বসে খাচ্ছেন নিজের থালা থেকে। পল্টু মুষড়ে পড়ল একটু। কী করা যায়? কিন্তু ওর জেদ চেপে গেছে তখন থেকে। থালা সে টেনে আনবেই। উঁকি দিয়ে দেখল, রান্নার চুলোগুলোর দিকে পিঠ দিয়ে খেতে বসেছে ঠাকুর। চুলোতে এখনও অনেকটা আগুন বাকি আছে। নিভে যায়নি পুরোটা। পোড়া কাঠের লাল লাল টুকরোগুলো এখনও গনগন করছে। আর একটা চুলোর পাশে কাগজে কাগজে ভাগ করা প্রায় সব মশলাপাতিই পড়ে আছে অল্প-স্বল্প করে। বুদ্ধি খেলে গেল পল্টুর মাথায়। পল্টু টিনের নীচে হাতের ডালটা ঢুকিয়ে অনেক কসরত করে খুঁচিয়ে খুঁচিয়ে নিঃশব্দে কয়েকটা শুকনো লঙ্কা ফেলে দিল একটা চুলোতে। একটু পরেই ফুটফাট শব্দে পুড়তে লাগল লঙ্কাগুলো। আর তীব্র দমবন্ধ করা ঝাঁজে ভরে উঠল চারপাশটা। পাণ্ডা বাবাজি আর যায় কোথা! হেঁচে, কেশে একটিবার মাত্র চুলোর দিকে তাকিয়ে এক দৌড়ে বেরিয়ে গেল জায়গাটা থেকে। সেই ফাঁকে পল্টুও তার কাজ হাসিল করল অনায়াসে। পঞ্চ ব্যঞ্জনে ভর্তি থালাটির কানায় আঁকশিটা লাগিয়ে টেনে বের করে নিয়ে সোজা আমবাগানে।

বাগানে ঢুকে নিরাপদ দূরত্বের একটা জায়গা বেছে নিল পল্টু। ডেকোরেটরের লাগানো লাইটগুলোর একটা আবছা আলো এসে পড়ছিল সেখানে। বেশ গুছিয়ে বসে কলাপাতাটা উলটাল থালা থেকে। বাহ, একেবারে কিচ্ছুটি বাদ নেই দেখছি। পোলাও দিয়ে শুরু হয়ে রাজভোগ দিয়ে শেষ অবধি সবই আছে। তাও আবার পরিমাণের চেয়ে একটু বেশি বেশি করেই। পল্টুর জিহ্বা ঘামতে লাগল কুলকুল করে। নাহ, আর দেরি করা যায় না। হাতটা কাপড়ে ভালো করে বুলিয়ে নিয়ে সোজা পাঁঠার কষায় হাত দিল ও। পোলাওতে মেখে নিয়ে দু’গ্রাস খেয়েছে কি খায়নি, পেছন থেকে কীসের যেন একটা খসখস শব্দ এসে ঢুকল ওর কানে। চিবনো বন্ধ রেখে শব্দটা ভাল করে মালুম করতে যাবে, এমন সময় চারদিক কাঁপানো একটা ঘ্রাউ। পরক্ষণেই আবার ঘ্রাউ ঘ্রাউ। আস্তে করে ঘাড়টা ফেরাতেই পল্টুর সারা শরীরের রক্ত একেবারে জল। মংলু, রজতের পাহাড়ি জাতের দশাসই চেহারার কুকুর! কুকুর তো নয়, একেবারে সাক্ষাৎ দুশমন। কামড়ে দেয়া তো দূর, সামনের পা দু’টো দিয়ে একটু বুলিয়ে দিলেই আর দেখতে হবে না। কাজের বাড়ি, কে কখন গলার চেনটা খুলে দিয়েছে কে জানে। চিন্তা করার সময়টুকু পেল না পল্টু। থালা ফেলে সামনে যে গাছটা পেল তরতর করে বেয়ে উঠে গেল। হাঁটু ছড়ে, কনুই ছড়ে একবারে মগডালে পৌঁছে তারপর শ্বাস ফেলল। এতক্ষণ শুধু জিহ্বাটাই ঘামছিল ওর। এখন জিহ্বাটা শুকিয়ে গিয়ে সারাটা গা ঘামছে, এই অঘ্রানের শেষেও। গাছের গোড়ায় মংলু এখন কী করছে আন্দাজ করতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠল ও।

মংলু একটু পরেই তার কাজ সমাধা করে লম্বা জিহ্বা দিয়ে নিজের নাক আর চোয়াল চাটতে চাটতে বাড়ির দিকে রওনা দিল। পল্টুও কিছুক্ষণ অপেক্ষা করে আস্তে আস্তে গাছ থেকে নেমে এল। হাতপাগুলো এখনও কাঁপছে থরথর করে। গাছের গোড়ায় বসে একটু জিরিয়ে নিয়ে বাড়ির দিকে রওনা দিল ও। আজ আর দোকানে যাবে না। পুরোটা দিন খুবই খারাপ কেটেছে আজ। সারাদিন অভুক্ত থেকে হাত পা অবশ হয়ে আসছে। হরি চাটুজ্যের ভাঁড়ার ঘরটার পেছন দিয়ে নেমে কিছুটা এগিয়ে গেলেই পল্টুদের পাড়ার রাস্তার মুখ। আধো অন্ধকার আধো আলোয় গা বাঁচিয়ে বাঁচিয়ে ভাঁড়ার ঘরটার পাশে আসতেই পল্টুর চোখে পড়ল চাটুজ্যেদের কাজের মেয়েটা এক থালা রাজভোগ আর একটা দইয়ের হাঁড়ি দু’হাতে করে বেরিয়ে যাচ্ছে ভাঁড়ার ঘর থেকে। যাবার সময় ভোলাকে উদ্দেশ্য করে বলে গেল, “অ ভোলাদা, ভাঁড়ার ঘরের দরজাটা বন্ধ করে দাও না একটু। আমার হাতজোড়া।”

“যাচ্ছি, হাতের কাজটা সেরেই যাচ্ছি। তুই যা, আমি আছি,” ভোলা উত্তর দিল। ভোলা এ বাড়ির কাজের লোক।

মত বদলে ফেলল পল্টু। অনেক হয়েছে, পোলাও-পাবদা কপালে নেই তো নেই, রাজভোগটা অন্তত ছাড়া যায় না। হাতের কাছে অমন সুযোগ রয়েছে যখন। সাতপাঁচ ভাবার আগেই ভাঁড়ার ঘরের দরজা দিয়ে গলে গেল ও। ভোলাও কিছুক্ষণ বাদে এসেই দরজায় তালা মেরে চলে গেল। বুকটা ধক করে উঠল পল্টুর। এখন উপায়? ও বেরোবে কী করে! ধরা পড়লে তো এ জীবন আর রাখা যাবে না। ‘পেক্টিস’-এর বারোটা বেজে যাবে। অন্ধকারের মধ্যে নিঃশব্দে এদিক ওদিক হাতড়াতে লাগল ও প্রাণপণে। হাতড়াতে হাতড়াতে এক সময় একটা দরজাও পেয়ে গেল। সন্তর্পণে ছিটকিনিটা খুলে দেখল এ দরজা শুধু ভেতর দিকেই বন্ধ করা আছে। বাইরে থেকে তালা-টালা লাগানো নেই কিছু। স্বস্তি পেল পল্টু। যাক, এখন ধীরে সুস্থে রাজভোগের পাত্র সাফ করে রাত বাড়লে বেরিয়ে পড়লেই হল। সবুরে মেওয়া ফলে কথাটি শুধু কানেই শুনে এসেছে এ পর্যন্ত পল্টু, কখনও ফলতে দেখেনি। আজ দেখল। এখন আসল জিনিসগুলো খুঁজে পেতে যা দেরি। তবে থাকতে হবে খুবই হুঁশিয়ার। কোনওরকম আওয়াজ যাতে না হয়। হলেই কেলেঙ্কারি।

অন্ধকারে পাগলের মতো রাজভোগ আর দই খুঁজতে লাগল পল্টু। কখনও হামাগুড়ি দিয়ে, কখনও বা উবু হয়ে বসে। আলু-পটল-উচ্ছে থেকে শুরু করে ঘুঁটে অবধি সবই হাতে লাগছে কিন্তু আসল জিনিসের দেখা নেই। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, আলু-পটল হাত বুলিয়ে চেনা গেলেও ঘুঁটেটাকে সন্দেহবশতঃ নাকের কাছে নিয়েই চিনতে হয়েছে ওর। কুছ পরোয়া নেই। এবার রাজভোগটা মিললেই হল। এক সময় মিলেও গেল। হাঁড়িমতো কিছু একটা হাতে লাগতেই ঢাকনাটা তুলে একটা আঙুল ডুবিয়ে দিল ও। আরে, এতো রাজভোগ নয়, দই! যাক ভালই হল। আগে দইটা খেয়ে নেওয়াই ভালো। আগে রাজভোগটা হাতে লাগলে পরে দইটা পানসে লাগত। আহ, দইটা জমে যেন ক্ষীর একেবারে! চটজলদি এক খাবলা তুলে নিয়ে মুখে পুরতেই চোখে সর্ষেফুল দেখল পল্টু। ওয়াক, থুঃ থুঃ! সারাটা মুখ জ্বলে পুড়ে খাক হয়ে যাচ্ছে একেবারে, উফ! চুন রাখার আর জায়গা পাসনি হরি চাটুজ্যে? মরলে নরকেও স্থান হবে না তোর এই বলে দিলুম। যতক্ষণ পারল মনে মনে গালি দিল পল্টু। তারপর কিছুক্ষণ অপেক্ষার পর শুরু হল আবার খোঁজা। অবিরাম থুতু ফেলতে ফেলতে মুখের জ্বলুনিটা একটু কমে গিয়ে এখন প্রচণ্ড ঝিনঝিন করছে গাল-জিহ্বা। হঠাৎ বড়ো একটা থালাতে চিটচিটে কিছু একটা আঙুলে লাগতেই ওর মুখে হাসি ফুটে উঠল। এ নির্ঘাত রাজভোগ না হয়ে আর যায় না।

 ভাবতে না ভাবতেই বিপত্তি। চাটুজ্যে গিন্নি ঢুকছেন ভাঁড়ার ঘরের তালা খুলে। পল্টু তাড়াতাড়ি ও পাশের দরজাটার দিকে সরে গেল। ছিটকিনিটা হাতড়ে পাওয়ার আগেই চাটুজ্যে গিন্নি লাইট জ্বালিয়ে দিলেন ফস করে। পল্টুও নিরুপায় হয়ে দাঁত মুখ খিঁচিয়ে একেবারে প্রেতমূর্তি হয়ে ঘুরে দাঁড়াল। একমুহূর্ত মাত্র সময়, চাটুজ্যে গিন্নি চোখ উলটে আঁক আঁক করতে করতে ভিরমি খেয়ে পড়ে গেলেন ধপাস করে। হাতের থালাবাসন সব মেঝেতে ছিটকে পড়ে ঝনঝন করে উঠল। এই বিকট শব্দে সারা বাড়ি দৌড়ে আসতে শুরু করল। সুযোগ বুঝে পল্টু এক লাফে পাশের গোয়ালঘরে ঢুকে গেল সুড়ুৎ করে। গুটিসুটি মেরে রইল গোয়ালঘরের এককোণে যতক্ষণ না রাত গভীর হয়।

চোখে মুখে জল ছিটিয়ে, গরম দুধ খাইয়ে চাটুজ্যে গিন্নিকে একটু সুস্থ করে তুলল সবাই। তারপর শুরু হল জল্পনা আর কল্পনা। চাটুজ্যে গিন্নির পরিষ্কার কথা, ওটা আলবাত একটা ভূত। তবে মামদো না শাঁকচুন্নি, এত অল্প সময়ের মধ্যে ঠিক চিনে উঠতে পারেননি। অনেকে ভেতরে ভেতরে শিউরে উঠলেন, কেউ কেউ মুখ বেঁকালেন। রজত আর জনাকয়েকের মতে ভূত-টুত সব ফালতু কথা, ওটা নিশ্চয়ই চোর। লাঠিসোটা নিয়ে তিন চারজন একটু এদিক ওদিক খোঁজাখুঁজিও করলেন। তারা সবাই চোরবাদী, আবার ভূতেও সমান বিশ্বাস রাখেন। তাই আর রাত-বিরেতে বিশেষ অগ্রসর হননি।

“হ্যাঁ, চোর ব্যাটা তোমাদের লাঠি খাওয়ার জন্যে এখনও এ তল্লাটে বসে আছে,” রজত বিরক্তি প্রকাশ করে ঘরে ঢুকে দরজায় খিল দিল। মংলু শুধু বারান্দা থেকে একটানা চীৎকার করে যাচ্ছে গোয়ালঘরের দিকে তাক করে। আর গলার চেনটা ছিঁড়ে বেরিয়ে আসতে চাইছে। ওদিকে পল্টুর বাবা আর জগদীশ সরকার মাঝে পল্টুর খোঁজ নিতে এসে হাজির হলেন। কিন্তু কেউই সঠিক হদিস দিতে পারল না।

রাত তখন একটা কি দেড়টা। কাজের বাড়ি, অনেকে ঘুমিয়ে কাদা হয়ে রয়েছে। কেউ বা সবকিছু গোছগাছ সেরে চোখের পাতা চারটে এক করেছে কি করেনি, হঠাৎ মংলু ভীষণভাবে চীৎকার চেঁচামেচি করতে লাগল। চাকর ভোলা ঘুমিয়েছিল বারান্দার ঘরে। কাঁচা ঘুমটা ভেঙে যেতেই খিঁচিয়ে উঠল মংলুর ওপর, “এই পাজি হতচ্ছাড়া, কী হয়েছে আজ তোর সন্ধ্যে থেকে, অ্যাঁ? ঘণ্টায় চৌদ্দোবার আজ শুধু জঙ্গলে যাচ্ছিস আর আসছিস! কী খেয়েছিস আজ? তোর আর কী? আমার হয়েছে যত জ্বালা।”

গজগজ করতে করতে চোখ কচলে দরজার দিকে এগিয়ে গেল ভোলা। মংলুর নিত্যদিনের প্রয়োজন অপ্রয়োজনগুলো ভোলাই সবচেয়ে বেশি বোঝে। তাই রজত যেহেতু বাড়ি থাকে না, মংলুর পুরো দায়িত্ব ভোলার ওপরেই ন্যস্ত করা আছে। ভোলা সন্ধ্যে থেকেই টের পেয়েছে মংলুর পেটে আজ গোলমাল হয়েছে। এখন হয়তো আবার জঙ্গলে যাবার জন্যে চেঁচাচ্ছে। তাই দরজা খুলে বেরিয়ে এসে মংলুর চেনটা আলগা করতেই এক লাফে গোয়ালঘরের সামনে গিয়ে দাঁড়াল মংলু। সাথে অবিরাম শুধু ঘ্রাউ ঘ্রাউ। পল্টু তখন কুটুস কুটুস করে হরি চাটুজ্যের গোয়ালঘরের পুরনো দরমার বেড়া ভেঙে পেছন দিকে সরে পড়ছিল। মংলু ছাড়া পেয়ে গেছে টের পেতেই ওর চোখে মুখে তীব্র আতঙ্ক ছড়িয়ে পড়ল। পাশাপাশি মংলুও কিছু একটা টের পেতেই গোয়ালঘরের পেছন দিকে ছুট লাগাল। পল্টুর তখন মরণপণ অবস্থা, চোখ বুঝে দিল এক লাফ। গোয়ালঘরের পাশেই ছিল একটা বড়োসড়ো গোবর জমিয়ে রাখার গর্ত। আর ওই গর্তের কানায় ছিল পল্টুর শুধু পা রাখার অপেক্ষা। ব্যস, আর যায় কোথা। পা হড়কে সড়াৎ করে একেবারে গোবরের গর্তের নীচে। আধা ঢেলা আধা ট্যালট্যালে গোবরের মধ্যে প্রায় কোমর অবধি ঢুকে গেল ওর। উঠে আসার সুযোগ বা শক্তি কোনওটাই নেই তখন। মংলু শুধু একবার গর্তের পাশে এসে চীৎকার করছে, আবার সাথে সাথেই দৌড়ে যাচ্ছে ভোলার কাছে। ভোলা থতমত খেয়ে দাঁড়িয়ে আছে উঠোনের মাঝখানে। কী করবে বুঝে উঠতে পারছে না। রামনাম করতে করতে উলটো দৌড় দেবে, নাকি এক পা দু’পা করে এগিয়ে দেখবে? কারণ, সন্ধ্যে থেকেই ভোলার চোখের সামনে এ বাড়িতে ভূতের উপদ্রব চলছে। একবার রান্নার ঠাকুরদের খাবার অদৃশ্য হয়ে যাচ্ছে, আরেকবার গিন্নিমাকে ভূতে পাচ্ছে। এখন আবার কী না কী হবে কে জানে। বেশ ভয় ধরে আছে ভোলার মনে তখন থেকেই। তারপর হঠাৎ সম্বিৎ ফিরে পেতেই ভোলা ডেকে ডেকে জড়ো করল বাড়ির সবাইকে, “চোর চোর, না না, ডাকু ডাকু, না না ভূ-ভূত, ভূত! ও বাবু, ও গিন্নিমা, ও দাবাবু শিগগির বেরিয়ে এসো সবাই, শিগগির এসো। ও মাগো, ভূতে মেরে ফেললে গো!”

মংলু একই কাজ করে যাচ্ছে অনবরত। একবার গর্তের কিনারায় আরেকবার উঠোনে, গর্তে নামার চেষ্টা করছে মাঝেমাঝে। কিন্তু নরম কিনারায় পা টিকছে না। পল্টুর তখন যে কী অবস্থা বলে বোঝানো দুষ্কর। নেহাৎ গোবরের মাঝে আটকে আছে, তাই বসুন্ধরা দ্বিধা হও আকুতিটুকুও করতে পারছে না মনে মনে। ওদিকে যে যা হাতের কাছে পেয়েছে তাই বাগিয়েই বেরিয়ে এসেছে সবাই। হরি চাটুজ্যের হাতে একটা পাকানো লাঠি। সবাই জড়ো হয়ে গর্তের পাশে আসতেই পল্টু ভেউ ভেউ করে কেঁদে উঠল, “ও জেঠু, আমায় মেরো না, আমি পল্টু গো, তোমাদের পল্টু। ও জ্যাঠামশাই, আমায় তোমরা মেরো না। আমি সারাদিন কিছু খাইনি…গন্ধেশ্বরীর দিব্যি বলছি!”

হরি চাটুজ্যে চোখ পাকিয়ে বললেন, “এই হতভাগা ডেগাবুড়া, উঠে আয়, উঠে আয় বলছি এখুনি।”

পল্টুর গলা দিয়ে স্বর বেরুচ্ছে না। চিঁ চিঁ করে বলল, “চেষ্টা তো করছি কিন্তু কী করে উঠবো? চারদিকে তো গোবর আর গোবর। হাত রাখি কই?”

ভোলা শুধু ছোটাছুটি করছে। এই মারে তো সেই মারে অবস্থা। পল্টু কাঁদো কাঁদো হয়ে বলল, “তুমি ও’রম করছ কেন গো ভোলাদাদা? আমি পল্টু পল্টু। চিনতে পারছ না? তোমাদের ডেগাবুড়া পল্টু! আমিও তো মানুষ গো! আমায় মেরো না।”

ভোলা দাঁত খিঁচিয়ে উঠল, “তুমি মানুষ নও, গোবরে পদ্মফুল। দাঁড়া দেখাচ্ছি মজা তোকে আজ।”

 সাথে সাথেই একটা হাসির রোল উঠল। তারপর যখন দড়িদাঁড়া ফেলে, গাছের ডাল-টাল ফেলে কোনও রকমে পল্টুকে টেনে তোলার তোড়জোড় চলছে এমন সময় রজত কোত্থেকে দৌড়ে এসে বাধা দিল, “এক মিনিট, এক মিনিট, ওকে এখনই তুলবে না কেউ। ও আগে বলুক এখানে সে কীভাবে এল। তারপর টেনে তুলবে ওকে। নয়তো ছাড়া পেয়েই দৌড়ে পগার পার হয়ে যাবে। অ্যাই পল্টে, শিগগির বল কী হয়েছিল। নয়তো…”

 “বলছি, বলছি। আমি সব বলছি। আগে একটু চুলকে নিই, বড্ড কুটকুট করছে গো।”

পল্টু তারপর একে একে বলে গেল আদ্যান্ত। কেউ কটমট করে তাকাল, কেউ টিটকিরি দিল, কেউ বা হেসে গড়িয়ে পড়ল। তারপর টেনে হিঁচড়ে বের করা হল পল্টুকে গোবরের গর্ত থেকে। গর্ত থেকে বেরিয়েই বাড়ির দিকে একছুট লাগাল পল্টু। ভোলা আর রজত তৈরিই ছিল। পল্টু পালাতে পারল না। ওরা টেনে ওকে কলতলায় নিয়ে গিয়ে সাবান ঘষে স্নান করাল প্রথমে। তারপর দুপুর বেলার বাড়ন্ত খাবার একটা পুঁটুলি বেঁধে হাতে দিয়ে পল্টুকে বাড়ি এগিয়ে দিয়ে এল।

ছবিঃ ইন্দ্রশেখর

এই লেখকের আরো একটা গল্প