গল্প- ঘড়ি-আশুতোষ ভট্টাচার্য

galpoghori04 (Medium)  সনাতন হল গিয়ে খানদানি চোর, চুরি হল তাদের সাত পুরুষের পেশা আর তাই সনাতনের ছেলে নিবারণকে শত অনিচ্ছা সত্ত্বেও চুরি করতে হয়। অনিচ্ছা বলছি বটে তবে নিবারণের চুরির হাত ভারী সুন্দর,জেগে থাকা লোকতে সে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারে,পাড়ার বিখ্যাত কুকুররা কঘ কারা কে জানে তাকে দেখলে চিৎকার তো করেই না বরং লেজ টেজ নেড়ে প্রায় কোলে উঠে পড়ে,নাম্বার লকওয়ালা চাইনিজ তালা নিমেষে সংখ্যা মিলিয়ে খুলে দেয়,রেন পাইপ বেয়ে অনায়াসে চার-পাঁচতলা বাড়িতে উঠে পড়ে। শহরে তো আর মাটির বাড়ি নেই তাই সিঁধ কাটাটা সে তেমন আয়ত্ব করতে পারেনি, তবে একবার তার বাবার দেশের বাড়ি চণ্ডীমঙ্গলপুর গিয়ে বাবা শিখিয়ে দেবেন বলেছিলেন কিন্তু সেবার নিবারণের স্কুলের আনুয়াল ফাংশনে নিবারণকে চোরের অভিনয় করতে হয় বলে যাওয়া হয়ে ওঠেনি।

তা সনাতনদের বংশের চুরির গল্প লিখতে গেলে একটা গোটা মহাভারত হয়ে যাবে, তার দাদুর দাদু নাকি জোব চার্ণকের সাথে করমর্দন করার সময় হাতের আংটি বেমালুম লোপাট করে দিয়েছিলেন,সিরাজ-উদ-দৌল্লার পাগড়ি হাপিশ করে দিয়েছিলেন কেউ,কেউ বা টিপু সুলতানের নস্যির ডিবে হাতিয়ে নিয়েছিলেন। সনাতনের দাদু নিশিকান্ত নাকি ছেলেবেলায় রবিঠাকুরের কালির দোয়াত চুরি করেছিলেন, পরে বাবার বকা খেয়ে,নিজের ভুল বুঝতে পেরে তা ফেরতও দিয়ে এসছিলেন। স্বাধীনতা আন্দোলনে তিনি সক্রিয় অংশগ্রহণ করেছিলেন। পাল্টে দিয়ে এসেছিলেন তৎকালীন ভাইসরয়ের চশমা,ফলে বেশ কিছুদিন সেই ভাইসরয় না পেতেন ঠিকঠাক দেখতে না পারতেন সইসাবুদ করতে।

সনাতন এযুগের মানুষ তবে খুব ভক্তিশ্রদ্ধা নিয়ে চুরিবিদ্যা আয়ত্ত করেছে। সেদিন কুমুদবাবু তাঁর ৫০ সালের পুরনো হারকিউলিস সাইকেলে ঠেস দিয়ে বলরামের দোকানে পটল বাছা বাছি আর দরদাম করছিলেন,সনাতন কী যেন উপায়ে সেই সাইকেল চুরি করে হাওয়া। কুমুদবাবু পটল টটল কিনে দেখেন কিনা সাইকেল গায়েব আর তিনি বেশ এক কেরোসিনের জ্যারিকেনে ঠেস দিয়ে দাড়িয়ে আছেন। অবশ্য জ্যারিকেনটা তিনি বাড়ি নিয়ে যান কারণ তাঁর স্ত্রী বহুদিন ধরেই জ্যারিকেন জ্যারিকেন করছিলেন বটে। থানায় জানিয়েও বিশেষ লাভ হয়নি কারণ প্রথমত প্রমানের অভাব আর দ্বিতীয়ত থানার বড়োবাবুর সনাতনের প্রতি দুর্বলতা,  শ্রদ্ধা ভক্তি যাই বল না কেন প্রবল। অবশ্য এরও একটা কারণও আছে। একবার থানার বড়োবাবু চন্দ্রনাথ শ্বশুরবাড়ি গিয়ে তাঁর সার্ভিস পিস্তলটা ফেলেন হারিয়ে,তাতে অবশ্য গুলিটুলি কিছু ছিল না, তবে সে যাই হোক শ্বশুরবাড়ি গিয়ে পুলিশ জামাইয়ের পিস্তল চুরি যাওয়াটাও মোটেই সম্মানের বা কৃতিত্বের কিছু নয়। সেটা আবার চন্দ্রনাথবাবুর এলাকাও নয়। ডাক পড়ল সেই সনাতনের। এক ঘণ্টার মধ্যে সেখানকার সেরা বাটপাড় নবকেষ্টর ট্যাঁক থেকে পিস্তল উদ্ধার করে নিয়ে আসে সে, পিস্তলের জায়গায় গুঁজে রেখে আসে একটা আখের টুকরো, নবকেষ্টর মত অত বড়ো বাটপাড়ও সেটা তখন তখন ধরতে পারেনি।

সনাতনের বয়স হয়েছে তাই ছেলেটাকে বাবা বাছা করে আজ পাঠাল চুরি করতে, নন্দীবাবুর বাড়ি। নন্দীবাবু সম্প্রতি একটা বিদেশি ঘড়ি কিনেছেন,সেটা কব্জা করা দরকার। রাত বারোটায় নিতান্ত অনিচ্ছাসত্ত্বেও নিবারণ বেগুনপোড়া,রুটি আর পাটালি গুড় দিয়ে ডিনার করে বের হল। এই সুত্রে বলে রাখা দরকার, নিবারণ কিন্তু বেশ চালাক চতুর। পড়াশোনায়ও বেশ ভালো ছিল। দশ ক্লাশ পাশ করার পর বাবা বলল, “বেশি পড়াশুনো করে কী লাভ বল? পৈতৃক পেশাটাও তো দেখতে হবে? তুই যদি এখন পাশ টাস দিয়ে দশটা পাঁচটা সরকারি চাকরি করিস তবে স্বর্গে গিয়ে তোর ঠাকুরদা,পূর্বপুরুষদের মুখ দেখাব কী করে? আর তারা যা রাগী হয়তো ১০০ বার কান ধরে ওঠবস করাবে কি হলুদ রোদ্দুরে লাল ডাউন করে দাঁড় করিয়ে রাখবে,আর তুই তো জানিস আমার বাতের ব্যাথাটা মাঝে মাঝেই চাগার দেয়।”

নন্দীবাবুর সদর দরজায় দুটো ভয়াল দর্শন কুকুর তো নিবারণকে দেখে ল্যাজ ট্যাজ নাড়িয়ে একসা। তাদের আদর টাদর করে নিবারণ তো রেনপাইপ দিয়ে সোজা তিনতলায় উঠে গেল। নীচে দাঁড়িয়ে সনাতন তো তাই দেখে হাততালি দেয় আর কি!

দরজার ছিটকিনি খুলে সুড়ুত করে নিবারণ ঢুকে পড়ল নন্দীবাবুর ড্রইং রুমে। তারপর হল কী, নিবারণ ভুল করে ঢুকে পড়ল গিয়ে নন্দীবাবুর ছেলে নিতাইয়ের ঘরে। নিতাই তার থেকে বছর তিন চারেকের ছোট,পড়ে ক্লাস সেভেনে,শুনেছে পড়াশুনো করে না আর মাথাতেও নাকি তেমন বুদ্ধি নেই।

galpoghori01 (Medium)যাই হোক তা দিয়ে আর নিবারণের কী হবে! এদিক-ওদিক দেখতে দেখতে নিবারণ দেখে পড়ার টেবিলে আলো জ্বলছে,সামনে কেসি নাগের অঙ্ক বই খোলা। আর পাশের খাতায় তার কিছু অঙ্ক কষেছে বটে নিতাই কিন্তু তাতে বড্ড ভুলের ছড়াছড়ি। নিবারণ বসে গেল সেগুলো ঠিক করতে। এসব শেষ করে হঠাৎ চোখ গেল পাশে রাখা হোমটাস্কের খাতায়। একটাও অঙ্ক করেনি ছেলেটা। নিবারণ তো ভাবল এক্ষুনি নন্দীবাবুকে ডেকে দেখায় ছেলের কাণ্ডকারখানা। তবে লোভও হচ্ছিল খুব অঙ্কগুলো কষে ফেলবার জন্য। দেখেই বুঝতে পারছিল সেগুলো সব অঙ্কস্যার মুকুন্দবাবুর দেওয়া। প্যাটার্ন দেখেই বোঝা যায়। মারপ্যাঁচ আছে বটে কিন্তু নিবারণ কি আর এসবে ভয় পায়? শেষমেস লোভ সামলাতে না পেরে ফটাফট সবগুলো অঙ্ক করেই ফেলল সে।

ওদিকে সনাতন নীচে দাড়িয়ে দাড়িয়ে মশার কামড় খেয়ে অস্থির। তার কাছে তো মোবাইলও নেই যে কতদুর কী হল জিজ্ঞেস করে! নাকি ঘুমিয়েই পড়ল! যা ঘুমকাতুরে ছেলে!

galpoghori02 (Medium)ওদিকে রাতে জল খেতে উঠে নন্দীবাবু ছেলের ঘরে আলো জ্বলছে দেখে উঁকি মেরে দেখেন নিতাই পড়াশুনো করছে। এসব দেখে তিনি যৎপরোনাস্তি আনন্দ ও স্বস্তিলাভ করে আবার ঘুমোতে গেলেন। অঙ্ক শেষ করে রুবিক পাজেল শেষ করে নিবারণের হঠাৎ খেয়াল হল সে একটা ঘড়ি চুরি করতে এসেছে। চুপিচুপি নন্দীবাবুর ঘরে ঢুকে দেখে বাবু ঘড়িটা হাতে পরে ঘুমোচ্ছেন। অনেক চিন্তা করেও হাতে ঘড়ি পড়ে ঘুমনোর কারণটা নিবারণ বুঝতে পারল না। একটু কষ্টও হল বটে কিন্তু নির্বিঘ্নে সে ঘড়িটা নন্দীবাবুর হাত থেকে খুলে,বাবার দেওয়া ঘড়িটা তাঁর হাতে পরিয়ে দিল। নিবারণ চোর বটে কিন্তু সে এসব এথিক্স মেনে চলে। একবার তো এক বাড়িতে চুরি করতে করতে ভোর হয়ে গেছিল,তা সে বাড়ির কর্তা গিন্নির জন্য চা বানিয়ে কাপে ঢেলে পরিপাটি করে রেখে দিয়ে এসছিল।

galpoghori03 (Medium)ঘড়িটা চুরি করে,আসলে চুরি না বলে এক্সচেঞ্জ বলাই ভালো,বেরোনোর পথে নিবারণের হঠাৎ নন্দীবাবুর স্মার্টফোনের দিকে নজর গেল। ব্যাস, বসে গেল খুটখুট করতে। কিছু গেমসও খেলল। এসব খেলতে অন্যদের দেখেছে বটে নিবারণ কিন্তু নিজে কখনো খেলেনি। তবে খেলে দেখল এগুলোতে বিশেষ বুদ্ধি লাগে না। এরপর সেই মোবাইলে কিছু শ্যামাসংগীত,ভক্তিগীতি লোড করে দিল ইন্টারনেট থেকে। তারপর আস্তে আস্তে সেই পাইপ বেয়ে নেমে এল নীচে।

অন্ধকারে বিশেষ কিছু দেখা যায় না,তবু খুঁজতে খুঁজতে নিবারণ দেখল অপেক্ষা করে করে তার বাবা রাস্তার মাথার বটগাছটার নীচে যে বাঁধানো চাতাল আছে তাতে ঘুমিয়ে পড়েছে। বাবাকে ডেকে তুলে ঘড়িটা দিল নিবারণ। বেশ নেড়েচেড়ে দেখে সনাতন ঘড়িটা পরল বটে কিন্তু সময় দেখাটা তার বড় খটমট লাগছিল। ঘণ্টা, মিনিট,সেকেন্ডের কাঁটাগুলো ভারী গুলিয়ে যায় তার। তবু ঘড়িটা পরে তার নিজেকে বেশ রাজা রাজা মনে হতে লাগল। 

পরেরদিন সারা শহর হুলুস্থুল,নন্দীবাবুর বাড়িতে নাকি ভুত এসছিল,সে নাকি নিতাইয়ের অঙ্ক করে দিয়েছে,রুবিক পাজল সমাধান করে দিয়েছে,নন্দীবাবুর মোবাইলে শ্যামাসংগীত কী করে যেন নিজেনিজেই লোড হয়ে গেছে আর সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা নন্দীবাবুর হাতের ঘড়িটা পাল্টে গেছে। ঘড়িটায় রানীর ছবি,আর কাঁটাগুলো বেশ সোনালি রঙের চকচক করছে। থানার বড়োবাবু ঘড়িটা দেখেই বুঝলেন এটা ব্রিটিশ আমলের ঘড়ি,আর ছবিটা রানি ভিক্টোরিয়ার। তিনি খবর দিলেন ইন্ডিয়ান মিউজিয়ামে,ওরা এসে নিয়ে যাক এই মহার্ঘ্য ঘড়ি।

সন্ধ্যায় থানার বড়বাবু রোজকার মত সাইকেল নিয়ে টহল দিতে বেরিয়েছেন, পথে সনাতনের সাথে দেখা। একটা সন্দেহ আগে থেকেই ঘুরছিল বড়বাবুর মনে। হঠাৎ সনাতনকে জিজ্ঞেস করলেন, “কটা বাজল রে?” সনাতন জিব টিব কেটে বলল, “কী যে বলেন স্যার,ঘড়ির কাঁটাগুলো দেখলেই আমার সময় গুলিয়ে যায়,আপনিই নয় দেখে নিন।”

ছবিঃ মৌসুমী