বিকালের সোনালী রোদ মেখে দাঁড়িয়ে আছে বাড়িটা। বয়স কম করেও ১০০ বছর। চারদিকে নোনা লাগা দেয়াল আর গাছের থাবা। অনেকটা জায়গা জুড়ে কোন এককালে বাগান ছিল। আজ জংলা গাছের কবলে তাও বিলুপ্তপ্রায়।
বাগানটার তুলনায় বাড়িটা ছোটোই। দোতলা। তবে কতটা বাসযোগ্য সেই বিষয়ে যথেষ্ট সন্দেহ জাগে। সুশান্ত এগিয়ে যায়। পাতার ফাঁক দিয়ে রোদ আসে, আলো ছায়া মেখে। সাদা কালো কিছু ছায়া পেরিয়ে যায়। পেরিয়ে যায় সাদা কালো স্মৃতির দল। সাদা সুখ, কালো দুঃখ।
সুশান্ত উই ধরা দরজায় নক করল। এখানে আগে কোনদিন আসেনি সে। এখানে তার জেঠু থাকে! তার প্রাণাধিক প্রিয় জেঠু! মনের সেলুলয়েডে ভেসে উঠতে থাকে নানান ছবি। ভেসে ওঠে ছেলেবেলা। কয়েক ফোঁটা। বিশ্বকর্মা পুজো। আকাশ ভরা ঘুড়ি। টুকরো টুকরো আনন্দ। টুকরো টুকরো উচ্ছ্বাস।
“এই লাগা লাগা লাগা লাগা, ভোকাট্টা!” শব্দে ভেসে যেত চারদিক। সুশান্ত মুখভার করে বসে থাকে। ছলছলে চোখে ছায়া ফেলে, ঘুড়ির ফাঁকে ফাঁকে উঁকি মারা ঝাপসা একটা আকাশ।
জেঠু এসে পাশে বসে। ফোলা ফোলা গাল দুটো টিপে দিয়ে বলত, “ কী সুশান্তবাবু? রামগরুড়ের ছানা হয়ে গেছ কেন?”
সুশান্ত ব্যাজার মুখে কোনরকমে বল্ “ ঘুড়ি….”
গলা ধরে আসে। দলাপাকানো একটা কী যেন উঠে আসতে চায় গলা বেয়ে।
“ও বুঝেছি! আচ্ছা ওগুলো কী রে?”
সুশান্ত তাকিয়ে দেখে উঠনের খুঁটিতে বাঁধা কয়েকটা ডোরাকাটা ঘুড়ি! ডোরাকাটা আনন্দ। তারা পাক খাচ্ছে, বাতাসের তালে তালে।
জেঠু সুশান্তের পেটে একটা চিমটি কেটে বলত, “প্যাঁকু”। সুশান্ত খিল খিল করে করে হেসে উঠত। জেঠুও হাসত। নিঃশব্দে। স্নেহমমতা দিয়ে গড়া সেই মুখ। সেই হাসি। হাসলে জেঠুকে ভগবানের মত লাগে। যাদের মন পবিত্র, তাদের হাসিও বড্ড পবিত্র হয়। সুশান্তর মনে হত ঈশ্বর যদি কোথাও থেকে থাকেন, তবে তা ওই মুখের আড়ালে। ওই শরীরের মধ্যে।
তার ফ্রেন্ড ফিলোজফার অ্যান্ড গাইড তার জেঠু। চলে গেল বদলি হয়ে। তার থেকে দূরে। অনেক দূরে। সুশান্ত খুব কেঁদেছিল। তার ঝাপসা চোখের সামনে থেকে জেঠু হারিয়ে গেল। আর ফিরল না!
সময় মানুষকে সব ভুলিয়ে দেয়। তারপর এক এক করে কেটে গেছে অনেকগুলো বছর। হঠাৎই সুশান্ত হাতে পেল চিঠিটা। যেন একটুকরো টাটকা বাতাস।
সুশান্ত,
কী রে চিনতে পারছিস? নাকি জেঠুটাকে ভুলে মেরে দিয়েছিস? হা হা হা হা—কী? মুখ ভার হয়ে গেল তো? আরে জানি জানি তুই আমাকে ভুলবি না। তোর ঘাড়ে কটা মাথা রে?
যা:, আবার উল্টোপাল্টা বকছি! কী করব বল? বুড়ো হয়ে গেছি। তোকে বড়ো দেখতে ইচ্ছে করছে রে। আমি আর ক’দিন! আজ আছি কাল নেই। ঠিকানা দিচ্ছি চলে আয়।
ইতি,
জেঠু
সুশান্ত এসেছে। ছুটে এসেছে।
ক্যাঁচ শব্দ করে দরজাটা খুলে গেল। ভেতরে জমা হয়ে আছে একরাশ অন্ধকার। যেন কালো ধোঁয়ায় ভরা একটা ঘর। একটু পরেই অন্ধকার সরিয়ে ফুটে উঠল একটা মুখ। মোটা ফ্রেমের চশমা, দুটো উজ্জ্বল চোখ আর একটা বেশ উঁচু নাক। মুখে বয়সের ভাঁজ স্পষ্ট। তবে ভদ্রলোকের শিরদাঁড়া সোজা। বয়সের ভারে এখনো ঝুঁকে যায় নি।
সুশান্ত চিনতে ভুল করে না। এই সেই মুখ! স্নেহ মমতায় গড়া, ভালোবাসায় ভরা।
দুজনেই চুপ করে থাকে। একসাথে যেন বেরিয়ে আসতে চাই হাজার হাজার না বলা কথারা। নীরব কান্নারা।
“সুশান্ত! এসেছিস বাবা….”
ছুটে এসে বুকে জড়িয়ে ধরে জেঠু। শত শত নীরব শব্দ পাক খেতে থাকে তাদের ঘিরে। হলুদ স্মৃতিরা উড়ে বেড়ায়। জোনাকির মত! বয়ে যায় দু’জোড়া চোখ।
“আমি জানতাম। জানতাম তুই আসবি।”
“কেমন আছ জেঠু?”
“আর থাকা! ওই আছি একরকম। চল ঘরে চল।”
সুশান্ত ভেতরে ঢোকে। সামনেরটা সম্ভবত ড্রয়িংরুম মত। বাতাস কেমন ভ্যাপসা ভ্যাপসা। কেমন পুরনো পুরনো। জেঠুর পেছনপেছন একটা ঘরে গিয়ে ঢুকল সুশান্ত। ঘরে চাপ চাপ অন্ধকার। জেঠু একটা জানালা খুলে দিলেন। বিকেলের ম্লান আলোয় অস্পষ্টভাবে দেখা যায় ঘরটা।
ছোট্ট এক চিলতে ঘর। একটা পুরনো আমলের বিছানা আর মাঝারি সাইজের একটা টেবিল। কিন্তু, টেবিলের ওপর ওগুলো কী! আলো-আঁধারি মেখে বসে আছে নানান সাইজের সব কঙ্কাল! পাখির কঙ্কাল! অকারণেই সুশান্তর গাটা ছম ছম করে উঠলো। একটা হালকা স্রোত যেন শিরদাঁড়া বেয়ে হারিয়ে যায়।
“এগুলো আমার একধরণের শখ বলতে পারিস। নানারকমের কঙ্কাল জমানো। আরও আছে।”
সুশান্তে চুলগুলো ঘেঁটে দিয়ে জেঠু বলল “কী রে ভয় পেলি নাকি?”
সুশান্ত জেঠুর দিকে তাকাল। চশমার কাচে সোনালী আকাশের ছায়া। আড়াল করে রেখেছে চোখদুটোকে। তারা যেন আড়ালেই থাকতে চায়। মেখে থাকতে চায় একরাশ রহস্য।
বিশাল একটা মাঠ। কিন্তু, পুরোটা দেখতে পাচ্ছে না সুশান্ত। সাদা সাদা কুয়াশা ছেয়ে আছে চারদিকে। চলতে চলতে নরম ঘাসে পা ভিজে যাচ্ছে সুশান্তর। একটু এগোতেই কুয়াশা সরে গিয়ে বেরিয়ে পড়ে একটা ছোটোমত ঢিবি। আর তার ওপর! তার ওপর, একটা বিশাল আকারের নেকড়ে! তার মুখের প্রতিটা ভাঁজে ফুটে উঠছে হিংস্রতা। জান্তব হিংস্রতা। চোখ দুটো সুশান্তের ওপর স্থির!
নেকড়েটা লাফিয়ে ঢিবি থেকে নামল। তারপর এক পা এক পা করে সুশান্তের দিকে আসছে। সুশান্তের যেন কিছু করার নেই। তার সমস্ত স্বত্বা যেন লুপ্ত। সে অপেক্ষা করে আছে। তার চরম নিয়তির জন্য।
কিন্তু, এ কী! সুশান্তের চোখের সামনেই নেকড়েটা বদলে যাচ্ছে। ঝরে ঝরে পড়ছে তার সমস্ত চোখ কান! ঝরে পড়ছে সমস্ত অঙ্গপ্রত্যঙ্গ! সমস্ত মাংসপেশি! জেগে থাকে শুধু নেকড়ের কঙ্কাল! সেটা একইভাবে এগিয়ে আসছে সুশান্তের দিকে। নিয়তি হয়ে!এবার যেন সুশান্ত নিজেকে ফিরে পেল। সজাগ হয়ে উঠল তার সমস্ত ইন্দ্রিয়। অ্যাড্রিনাল গ্রন্থি জেগে উঠে ছড়িয়ে দিতে লাগলো ভয় আর আতঙ্কের রাশি। সে ঘুরে ছুটতে লাগলো।
একটা কী যেন তার ঘাড়ে এসে পড়ল। সুশান্ত ধড়মড়িয়ে উঠে বসল। টেবিলের ওপর একটা মোমবাতি জ্বলছে। বিচ্ছিরি স্বপ্ন। বাইরে অন্ধকার নেমেছে। মেঘ করে আছে বোধহয়। সুশান্ত উঠে টেবিলের কাছে গেল। মোমবাতির হালকা হলুদ আলো মেখে বসে আছে সারি সারি পাখির কঙ্কাল। পাখির প্রেত! অদ্ভুত নেশা বটে! অনেকে পশু পাখি স্টাফ করে ঘর সাজায় বলে সুশান্ত শুনেছে। কিন্তু এরকম অদ্ভুত জিনিস শোনেনি কোনদিন। আন্দাজে বোঝা যায় শালিক, পায়রা, চড়াই এসবের কঙ্কাল। সুশান্ত ভালো করে দেখে মৃদু চমকাল। একটা কঙ্কালও অক্ষত নয়! হাতুড়ি বা ওই জাতীয় কিছু ভারি জিনিস দিয়ে যেন তাদের মারা হয়েছে। কারো পায়ের হাড় ভাঙা তো কারোর বুকের খাঁচাটা অর্ধেক নেই! একটা অজানা অস্বস্তি সুশান্তকে চেপে ধরল।
সুশান্ত ড্রয়িংরুমের দিকে এগোল। সেখানে একটা মোমবাতি অন্ধকার তাড়ানোর আপ্রাণ চেষ্টা করে চলেছে। একটা রকিং চেয়ারে বসে আছে জেঠু। দেওয়ালে পড়ছে তার দুলন্ত ছায়া।
“কী রে উঠে পড়েছিস? বোস বোস। কত বড়ো হয়ে গেছিস রে!”
সুশান্ত সামনের একটা চেয়ারে বসে। হালকা একটা ক্যাঁচ শব্দ বাতাসে মিলিয়ে যায়। ঘরটা মাঝারি আকারের। সুশান্ত দেখল একপাশে ডাঁই করা আছে আরও কয়েকটা কঙ্কাল। সম্ভবত এগুলো কুকুর, ছাগল এই ধরণের জীবজন্তু। আশ্চর্য এগুলোও অক্ষত নয়!
“কঙ্কাল গুলোর কথা ভাবছিস তাই তো?” জেঠুর গলা ভেসে আসে।
“না ওই আর কি…” সুশান্ত একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ে।
“এটা শখ না বলে, আমার একটা রোগের উপসর্গ বা ফসল বলতে পারিস।”
“রোগ?”
“হ্যাঁ রোগ। দাঁড়া তোকে তাহলে গল্পটা বলি। চায়ের বদভ্যেস আছে?”
“না, আমি চা খাই না।”
“সেকী রে! ছোটোবেলায় তো আমার কাছে খালি বায়না করতিস, জেঠু চা খাব, চা খাব!”
সুশান্ত শুধু একটু হাসে।
“ওয়েল। শোন তাহলে। বদলি হয়ে চলে গেলাম একেবারে দক্ষিণ ভারতে। তামিলনাড়ুর একটা ছোট্ট গ্রাম। যাকে বলে একেবারে অজ পাড়া গাঁ। সেখানকার স্বাস্থ্যকেন্দ্রের আমি হেড। কদিনের মধ্যেই জায়গাটাকে ভালোবেসে ফেললাম। পাহাড়, নদী যতদূর তাকাও সবুজ আর সবুজ। অল্পদিনের মধ্যেই গ্রামের মানুষ আমাকে দেবতা বানিয়ে বসল। সেই নিঃস্বার্থ শ্রদ্ধা ভক্তি না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না।”
একটা দীর্ঘশ্বাস ভেসে আসে। জেঠুর চশমার কাচে তির তির করে কাঁপছে দুটো মোমবাতির শিখা। একটা টিকটিকি কোথা থেকে টিকটিকি করে ডেকে উঠল।
“৩০টা বছর! পাক্কা ৩০ টা বছর আমি ওখানে ছিলাম,” জেঠু বলে যায়, “পাহাড়ি নদীর মত সময় বয়ে গেছে। চোখে চশমা লেগেছে, চুলে রুপোলী রেখা। এরকমই একটা সময়ে ঘটনাটা ঘটল। তারিখটা ছিল ৩০ই মে। সারাদিন অঝোরে বৃষ্টি পড়ছিল। সেই বৃষ্টি মাথায় করে গ্রামের কয়েকজন ধরে আনল লোকটাকে। লিকলিকে শরীর, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ। খালি গা, পড়নে শুধু একটা নীল চেকচেক লুঙি। উন্মাদের মত চিৎকার করছে। লিকলিকে শরীরে অমানুষিক জোর। চারজন মিলেও ধরে রাখতে পারছে না। আর লোকটার চোখে যেন রক্ত জমে আছে! রক্তও বুঝি এত লাল হয় না!
“আমি অবস্থা বুঝে একটা ঘুমের ইনজেকশন দিলাম। কিছুক্ষণের মধ্যেই লোকটা ঝিম মেরে গেলো। আস্তে আস্তে এক সময় ঘুমিয়ে পড়ল। ঘুমনোমাত্রই তার সাথের লোকগুলো পালিয়ে গেলো।
“আমি চেক করে দেখলাম ঘুমন্ত অবস্থাতেও লোকটার প্রেশার আর হার্ট-বিট অসম্ভব রকমের হাই! টেম্পারেচার ১০৮- ১০৯ এর ঘরে ঘোরাফেরা করছে। এই অবস্থায় লোকটা বেঁচে আছে কী করে সেটা ভেবে অবাক হয়ে গেলাম। বৃষ্টির জন্য সেদিন কম্পাউন্ডার আসেনি। আমি একাই ছিলাম। স্যালাইন ট্যালাইনের ব্যবস্থা করে পাশে বসে থাকলাম। কখন দরকার লাগে!
“তখন কত রাত বলতে পারব না। বসে বসে বোধহয় একটা ঝিমুনি এসেছিল। হঠাৎ, বাইরে ভীষণ জোরে একটা বাজ পড়ল। আমার চটকা ভেঙে গেলো। বাইরে তখনো বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে। টিউব লাইটের মত আলো ছড়িয়ে যাচ্ছে ঘরে। আর সেই আলোতেই দেখলাম, লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে। ওই দুটো চোখ আমি জীবনে ভুলব না। ভাঁটার মত জ্বলছে সে দুটো। লাল একদম লাল! আমি কিছু বুঝে ওঠার আগেই সে আমার হাতে একটা কামড় বসাল। চোঁ চোঁ করে কী যেন শুষে নিতে চাইলো। আমি তাকে ধাক্কা দিয়ে সরিয়ে দিলাম। সে পৈশাচিক একটা হাসি হেসে বাইরে ছুটে গেল!
“তখন থেকেই রোগটা দেখা দিল। চোখের সামনে কম্পাউন্ডার, সিস্টার, পেশেন্ট সব অদৃশ্য! আমি, আমি গ্রামটাকে খুব ভালবাসতাম। আমি ওদের ক্ষতি করতে চাইনি। এই বাড়িটা পড়েই ছিল। চলে এলাম নির্বাসনে। কিন্তু সেই রোগটা আমার পিছু ছাড়ল না।”
একটানা বলে থামল জেঠু। ঘরটা অদ্ভুত এক নিস্তব্ধতায় ছেয়ে গেছে। চেয়ারটা খুব জোরে জোরে দোলাচ্ছেন জেঠু। দুলছে দেওয়ালের বাদামি ছায়াটা।
“আচ্ছা….মানে… রোগটা কী?” সুশান্ত একটু অস্বস্তি নিয়েই জিজ্ঞেস করল।
“হুমম, বলছি। আজ খুব গরম। চল বাগান থেকে একটু ঘুরে আসি।”
“আচ্ছা চলো।”
আকাশে মেঘ থাকলেও একটা বেশ বাদামি আভা। চারদিক মোটামুটি দেখা যাচ্ছে। পায়ের নীচে শুকনো পাতা মাড়িয়ে ওরা এগিয়ে চলল।
“তোর বিপ্লবকে মনে আছে? সেই যে ওকে কোলে নিলেই তুই মুখ ফুলিয়ে বসে থাকতিস? তখন তোকে কাতাকুতু ট্রিটমেন্ট দিতে হত। হো হো হো”
জেঠু হেসে ওঠে। তার মুখে জেগে ওঠে সেই পুরনো স্নেহ মমতারা। তারা কোনওদিন পুরনো হয় না।
“বাব্বা! মনে নেই আবার। ছোটোবেলায় আমরা ছিলাম সাপে নেউলে। হি হি হি। তবে ও কোথায় কে জানে। ওর সাথে দেখা হয় না অনেক বছর।”
“হুমম, সাপে নেউলে হলেও তোকে হয়তো এখন থেকে তার সাথেই থাকতে হবে। বড়ো ভালো ছেলে। আমি ডাকতেই এসেছিলো। আমি ওকে এখানেই রেখে দিয়েছি।”
“এখানে! এখানে কোথায়?”
জেঠু একদিকে আঙুল তুলে দেখায়। একটা মরা গাছ। গাছে পাতা বলে কিছু নেই। আর তার গোড়াতেই ঠেস দিয়ে বসে আছে, একটা কঙ্কাল! নরকঙ্কাল! কঙ্কালটার গায়ে তখনো লেগে আছে ছিন্ন ভিন্ন পোশাকের টুকরো। ভয়ের একটা তীব্র স্রোত নেমে এলো সুশান্তের মেরুদণ্ড বরাবর। সাপের মত ছড়িয়ে গেল সমস্ত কোষে কোষে। সমস্ত লোমকূপে।
“সরি সুশান্ত। তোর জেঠুটা সেই রাতেই মরে গেছে। এখন শুধু বেঁচে আছে এই পিশাচটা। রক্তপিশাচ! হ্যা হ্যা হ্যা হ্যা রক্ত রক্ত–”
একটা পৈশাচিক স্বর ভেসে এলো জেঠুর দিক থেকে। একটানে চশমাটা ছুঁড়ে ফেলে দিলেন জেঠু। জোড়া পায়ে লাফ দিয়ে উঠে পড়লেন মড়া গাছটার একটা ডালে!
সুশান্তর চোখের সামনে ধীরে ধীরে বদলে যাচ্ছে জেঠু। সেই স্নেহ, সেই ভালোবাসা ভরা মুখটা চুপসে দুমড়ে যাচ্ছে। জেগে উঠছে একটা পৈশাচিক মুখ! ভাম্পায়ার! সারামুখে একটা অদ্ভুত নীল আভা। যেন কালো কাগজের ওপর শয়তানের তুলির টানে ফুটে উঠছে এক পিশাচের ছবি। তার চোখ দুটো থেকে ঠিকরে বেরচ্ছে সবুজ আলো। বেরোচ্ছে সবুজ পিপাসা । রক্ত পিপাসা!
সুশান্ত ঘাসের ওপর বসে পড়ল। তার যে জেঠুকে সে এত ভালোবেসে এসেছে, যে জেঠুকে দিয়েছে মনের সব থেকে উচ্চতম স্থানটা, সেই জেঠু আজ…
সুশান্ত আর ভাবতে পারল না। হঠাৎ বিচ্ছিরিভাবে হেসে উঠে জীবটা দুটো হাত বাড়িয়ে বাতাসে ভেসে উঠল। এসে নামল সুশান্তর ওপর। সুশান্ত তার চোয়ালের দুপাশে তীক্ষ্ণ দুটো দাঁত দেখতে পাচ্ছে। দাঁতের ফাঁক দিয়ে ফোঁটা ফোঁটা লালা ঝড়ে পড়ছে সুশান্তর মুখের ওপর। সুশান্তর গা ঘিন ঘিন করে উঠল। দাঁতগুলো আস্তে আস্তে নেমে য়াসছে সুশান্তের দিকে—
আর ঠিক তখনই মেঘ সরে গেলো। খুলে গেলো মেঘের জানলা। ফাঁক দিয়ে উঁকি মারল থালার মত একটা চাঁদ। আজ পূর্ণিমা! সমস্ত বাগানটা ভেসে গেলো জ্যোৎস্নায়। আলোকিত হয়ে উঠল প্রেতমঞ্চ!
সুশান্তের দু চোখে টলমল করে উঠে দু টুকরো চাঁদ। দু টুকরো জ্যোৎস্না।
পিশাচটা হঠাৎ সুশান্তকে ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। তার সবুজ চোখ দুটোই এখন হানা দিচ্ছে ঝাঁকে ঝাঁকে বিস্ময় আর আতঙ্কের দল। তার সারা মুখে কে যেন ছড়িয়ে দিয়েছে অজানা ভয়ের ছায়া!
সুশান্ত ঝাঁপিয়ে পড়ল পিশাচটার ওপর। জ্যোৎস্না মেখে ঝাপটা ঝাপটি করতে থাকে দু টুকরো অন্ধকার। দুটুকরো ছায়া।
ভ্যাম্পায়ারটা আপ্রাণ চেষ্টা করছে নিজেকে ছড়ানোর। কিন্তু, পারছে না। ছিন্ন ভিন্ন হয়ে যাচ্ছে তার দেহটা। বয়ে যাচ্ছে নীল রক্ত! তারপর একসময় বাতাসে হারিয়ে গেল একটা আর্তচিৎকার। শেষ আর্তনাদ।
সুশান্ত উঠে দাঁড়ায়। তার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে নীল রক্ত। শয়তানের নীল রক্ত! জ্যোৎস্না এসে খেলা করে তার সারা শরীরে। ঢেলে দেয় রাশি রাশি রুপো। রাশি রাশি করুণা। সুশান্তর চোখ বেয়ে গড়িয়ে যায় এক ফোঁটা মুক্ত। ভেসে যায়। এলোমেলো হাওয়ায় চড়ে। দূরে, বহুদূরে। সেই চোখের জলে মানুষ নেই। সেই জল নেকড়ের! ওয়ারউলফের!
ছবিঃ অর্ক পৈতণ্ডী