বড়জেঠি ঘরের চৌকাঠে দাঁড়িয়েই খুব রেগেমেগে বলছিল, “মরে যাই,ওরকম ছবি তো আমাদের পিকুই এঁকে দিতে পারে, দু’টো কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং, দু’টো ট্যারা চোখ, আবার আদিখ্যেতা করে ছবির নাম রাখা হয়েছে, তোরা মার। মারবেই তো, অমন ছবি আঁকলে লোকে মারবে না তো কী,ফুলচন্দন দিয়ে পুজো করবে! ধরে মার,ধরে মারই হচ্ছে ওর ওষুদ–ওই যা, পায়েসের দুধটা বোধহয় পুড়ে গেল।” জেঠিমা রান্নাঘরে দিকে উর্ধ্বশ্বাসে দৌড়োল।
ছবিটা পিকুর মেজকাকা এনে দিয়েছিল ছোটকার জন্য। কোথায় নাকি পিকাসোর ছবির মিউজিয়াম আছে, সেখানে নাকি এরকম সব প্রিন্ট পাওয়া যায়। ছোটকা আর্ট কলেজে পড়ে, পিকাসো বলতে অজ্ঞান। দারুণ উত্সাহ সহকারে ছবিটা বাঁধিয়ে এনে জানালার সামনে যেখানে জেঠিমার গুরুদেবের ক্যামেরায় তোলা ছবিটা ঝুলছিল সেটা নামিয়ে রেখে, সেইখানে টাঙিয়ে খুব মন দিয়ে দেখছিল আর পিকুকে বোঝানোর চেষ্টা করছিল – ছবিটা শুধু ডোরা মারকে না, তার আত্মাকেও যেন ধরে ফেলেছে ইত্যাদি প্রভৃতি।
জেঠিমার গুরুদেব এ ঘরের পার্মানেন্ট বাসিন্দা নন। একটু আগেই ছবিটা দেখে দেখে ছোটকা বেজার মুখে একটা ডঙ্কি বেঞ্চে বসে নাদুসনুদুস টাকমাথা মানুষের আসনপিঁড়ি হয়ে বসা ছবি আঁকছিল। বড়জেঠার ফরমাইশ। বাঁকুড়া না বেলেতোড়, কোথায় যেন গুরুজির আশ্রম আছে। বছরে একবার করে এদিকে আসেন। ছোটকার ঘরটা তখন গুরুদেব আর তাঁর শিষ্যসেবকদের দখলে চলে যায়। গুরুদেব বলেন শিষ্যশাবক। হুঁহ, শাবক না হাতি। বাসন মাজতে এসে মিনতিদি বলেছিল, “বাবাঃ, সবক’টার একদম হাতির পানা গতর।”
মা তাড়াতাড়ি আড়ালে ডেকে মানা করে দিল ওরকম বলতে।
কিন্তু এবারেও কেঁচিয়ে দিল সেই মিনতিদিই। ছবিটা যেই নামানো, অমনি গিয়ে মাকে বলতে লেগেছে, “হেই মা গো, কী হবে, তোমাদের সেই হাতিপানা ঠাকুরের ছবি দেখো গে শানের রোপরে রেক্যে দিইছে ছোদ্দাদাবাবু। একন একটা রমঙ্গল না হলিই হয়।”
জেঠিমা ঠিক শুনতে পেয়ে, রান্না ফেলে রেখে সো-জা এসে তদন্তে নামলেন।
নতুন ছবিটা দেখে তো একদম রেগে আগুন, “এটা আবার একটা ছবি, এর জন্য আমার গুরুদেবের ছবির এত হেনস্থা, দেখ সুবল, বাড়াবাড়ি ভাল নয়।”
ছোটকা মিনমিন করে বলতে গেছিল, “এটাও খুব জোরালো ছবি, ডোরা মারের পোর্ট্রেট।”
কিন্তু জেঠিমণি তা শুনলে তো। ভাগ্যিস, পায়েসের দুধে ধরা গন্ধটা উঠছিল।
কাল সকালে নাকি বাড়িসুদ্ধ সবাই মিলে যাওয়া হবে গুরুদেবের আশ্রমে। একটা টেম্পোট্রাভেলর গাড়ি ভাড়া করা হয়েছে, চালডাল সবজি ফল নেওয়া হয়েছে ভেট হিসেবে। তার ওপর ছোটকার ওপর হুকুম ছিল ছবিটা আঁকবার…ছোটকা আর কী করে, গম্ভীরমুখে সে আবার ছবিটা নিয়ে বসল। করুণ হাসি হেসে বলল, “কেমন গামার মত গুরু, দেখেছিস পিকু?”
তা আর নয়,পিকু মনে মনে বলে,যেন কেঁদো বাঘটি,সারা গা চকচক করছে,মাথার পিছনে আবার একটা আলো,ইস!
যদিও ডোরা মারের ছবিটাও ঠিক সুবিধের লাগল না পিকুর – একটা চোখ সামনে তাকিয়ে আছে তো আরেকটা যেন পাশের বাড়ির পল্টুদের ছাতের দিকে তাকিয়ে। আর মুখেরই কী বা ছিরি, যেন একটা কমলালেবুর আধখানা খোসা ছাড়িয়ে পাশে মেলে রেখেছে কেউ। এরকম ছবি আঁকার পরও ইনি পিকাসোর বন্ধু থেকেছিলেন? যাঃ বাবা। আচ্ছা, ইনিও আর্টিস্ট ছিলেন? তা ইনিও কি শোধ তুলবার জন্য পিকাসোর ছবি এঁকেছিলেন? ছোটকা হুঁ-হাঁ করে পিকুর প্রশ্নের জবাব দেবার চেষ্টা করছিল।
তবে পল্টুদের ছাদে আজ মাঞ্জা তৈরি করার কথা বলে পিকু বেশিক্ষণ ছোটকার আশেপাশে ঘুরঘুর করতে পারল না। তাছাড়া ফিরে কালকের জন্য জিনিসপত্র গুছিয়ে নিতেও হবে। কাজেই একটু পরে পিকু পালাল, আর ছোটকাও নিঃশ্বাস ফেলে কাজটা নিয়ে পড়ল।
কথা ছিল ফেরার দিন গুরুদেবের আশ্রম থেকে ফেরার পথে গাড়ি ঘুরবে রণডিহার দিকে। পানাগড় বাজার থেকে মুরগি কিনে নেওয়া হবে। দামোদরের ধারে, শীতের রোদে পিকনিকের কথা ভাবতেই পিকু, বাবুল, রিনি সবার আনন্দ দেখে কে! কিন্তু সেই আনন্দে যে একটা ফোন এসে একঘটি জল ঢেলে দেবে, তা কে জানত! রাজবাঁধ ছাড়াতেই পিকুর বাবার ফোনটা বেজে উঠল।
বাবা খানিকটা শুনেই খুব গম্ভীর মুখে ছোটকাকে ডাকলেন, “এই সুবল, এদিকে শোন।”
ছোটকাকাও সব শুনেটুনে একদম পচা ডিমের ওমলেট খাবার মত মুখ করে বলল, “না, তাহলে ফেরাই ঠিক।”
সামনের সিটে বসা বড় জেঠিমণি-জেঠুরও দেখা গেল একই মত। পিকুদের ওজর আপত্তি কোনওটাই খাটল না। গাড়ি জিটি রোড ধরে সোজা চলল।
বেলা দুটো নাগাদ ওরা এসে পৌঁছল। পাড়ায় ঢুকতেই পুলিশের গাড়ি। পুলিশ দেখে পিকুর তো চোখ ছানাবড়া। রিনি ঘুমিয়ে কাদা। বাবুল ফিসফিস করে জিজ্ঞেস করে, “কী ব্যপার রে দাদা?”
ওদের গাড়ি এসে দাঁড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে একজন পুলিশ এসে বাবাকে কিছু বলতে শুরু করল। বাবা মা-জেঠিমণিকে বলল বাচ্চাদের আর গাড়িতে রাখা জিনিসপত্র নামিয়ে নিতে। বাবা আর ছোটকা কোথায় যেন গেল।
এদিকে বাড়ির ভেতর লন্ডভন্ড অবস্থা। দরজা ভাঙা। আলমারির দোর খোলা। একটা প্রকান্ড বোঁচকায় ভরা জিনিসপত্র ছোটকার ঘরের দোরে পড়ে। ততক্ষণে রিনি জেগে উঠে সরেজমিন তদন্ত সেরে ফেলেছে, “কাল আমাদের বাড়িতে চোর এসেছিল রে দাদা। ইস! কাল যদি বাড়িতে থাকতাম একটু দেখতে পেতাম। আবার কী মিষ্টি, জিনিসপত্র একটাও নেয়নি। জেঠিমণি, চোরদের দেখতে কি খুব কালো আর রোগা হয়?”
মা’র রাগী-রাগী চোখ দেখে অবশ্য রিনিটা চেপে গেল।
বাবা আর কাকা ফিরল সন্ধ্যার পরে, সঙ্গে একটা সিড়িঙ্গে লোক আর একজন পুলিশ। জানা গেল ইনিই চোর। পুলিশের লোকটা খুব করে কড়কে দিল, “তোর নাম ঠিকানা সব এবার খাতায় উঠে গেছে। এ তল্লাটে ফের যদি ঢুকেছিস…”
লোকটা প্রায় হাউমাউ করে কেঁদে উঠল, “না ছার, অভাবে আমার মাথার ঠিক ছ্যালোনি। আর কখনও…”
বাবা বললেন, “আচ্ছা, হয়েছে। সুবল, এনাকে এবার আসতে বলো।”
ছোটকা পুলিশের লোকটাকে বলল, “স্যার, আপনি তাহলে…”
পুলিশের লোক চলে গেলে বাবা মাকে ডেকে বললেন, “শুনছো? একে দু’টো ডালভাত খাইয়ে দাও।”
জেঠিমণি খুব রেগেমেগে বললেন, “চোরকে বসিয়ে খাওয়ানো জন্মে শুনিনি বাপু।”
কিন্তু খাবার-টাবার বেড়ে পিকুর হাতে দিয়ে বলল, “যাও, তুমিই দিয়ে এসো গে।”
পিকু গল্প শোনার এমন সুযোগ কি হাতছাড়া করবার পাত্র!
বারান্দায় এসে শোনে লোকটা বলছে, “বোঁচকাটা নিয়ে যেই ছোট ঘরটা দিয়ে বেইরেছি, দেখি দু’টো ঢ্যাবাপারা চোখ আমার দিকে চেয়ি মিটিমিটি হাসতেচে। আর নম্বাপারা নখওয়ালা হাতের আঙুলগুলো যেন তার নিশপিশ করতেচে। ওঃ, তারপরে আমার আর কিছু মনে নেই গো। এসব পুরনো বাড়িতে ভূত থাকে আজ্ঞে।”
ছোটকা কিছু বলতে যাচ্ছিল। বাবা ইশারায় থামিয়ে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, অনেক পুরনো বাড়ি তো, একটা দু’টো ভূত থেকে যেতেই পারে। আচ্ছা, খেয়ে নিয়ে এবার এসো গে, রতন। কই সুবল, জিনিসগুলো দাও ওকে।”
কাকা ব্যাগ থেকে নতুন লুঙ্গি, হাওয়াই চটি, বাচ্চাদের জামাটামা বের করে রতনকে দিয়ে বলল, “হ্যাঁ, এবার দু’টি খেয়ে নিয়ে বেরিয়ে পড়।”
লোকটা কিন্তু খেতে চাইছিল না। বলল, “ভাতক’টা আমারে দিয়ে দ্যান তা’লে।”
তারপরে বাড়িতে কিনে নিয়ে যাবার জন্য টাকাও পাবে শুনে বারান্দায় বসে খুব তৃপ্তি করে খেয়ে বেরিয়ে গেল।
রতন বেরিয়ে যেতেই জেঠিমণি এসে বলল, “চোরকে এত খাতির করার কী আছে?”
বাবা বলল, “বড়বৌদি, ব্যাটা কাল রাত্রে চুরি করতে ঢুকে দিব্বি পালিয়ে যাচ্ছিল। অথচ কপালের দোষে ছোটকুর ঘরে ভূত দেখে দাঁতকপাটি লেগে মূর্ছা যায়। সকালে পাড়ার লোকে সদর দরজা হাট করে খোলা দেখে ভেতরে এসে ওকে আবিষ্কার করে। মুখে গ্যাঁজলা উঠে আসা, হাত পায়ে খিঁচুনি দেখে পুলিশের লোক ওকে হাসপাতালে দেয়। কপালগুণে বেঁচে গেছে। আর আমাদেরও কিছু খোয়া যায়নি। এর বদলে একটা গরীব মানুষকে একটু দয়া করলে দোষ কী!”
জেঠিমণি বলল, “আচ্ছা সে না হয় দিলে, কিন্তু ব্যাটা এই বাড়িতে ভূত পেলটা কোথায়।”
বাবা একবার ছোটকার গোমড়া মুখটা দেখলেন। তারপর মুচকি হেসে দেখিয়ে দিলেন দেয়ালের দিকে, যেখানে তখনও টাঙানো আছে ডোরা মারের ছবি।
তারপর থেকে মিনতিদি ওই ঘরটা মুছতে আর একলা যেতে চায় না। “অ ছোদ্দাদাবাবু, ওই ভূতের ঘর আমি একলাটি মুছতে পারবনি বাপু, এগবার ডাঁইরে যাও।”
ছোটকা মিনতিদিকে পাহারা দিতে দিতে গজগজ করে, “ভূত না হাতি। ব্যাটার নির্ঘাত ফিটের ব্যামো ছিল। খামোকা ছবির বদনাম করছো সবাই।”
কিন্তু পিকু দেখেছে, তারপর থেকেই জেঠিমণি ঘরে ঘরে সন্ধ্যা দেখানোর সময় ডোরা মারের ছবির সামনেও পিদিম দেখিয়ে একটু দাঁড়িয়ে বিড়বিড় করে কী বলে যান। একদিন খুব সন্তর্পণে কান পেতে পিকু পষ্ট শুনল, জেঠিমণি কেবল বলছেন, “ধোরো মা, দেখো মা।”
তা তো হবেই, এর মধ্যে ডোরা মারের আত্মাও আছে যে!
ছবিঃ মৌসুমী