গল্প-ড্রাগন আঁকা কৌটো-অদিতি ভট্টাচার্য-বর্ষা ২০১৬

galpodragon01 (Medium)“আরে আরে, ওরকম করে ধরছ কেন? ঠিক করে ধরো, সাবধানে নামাও, তোমার দেখি কোনও যত্নই নেই,” অমলবাবু চেঁচিয়ে উঠলেন, বেশ রেগেই।

ইশ, আরেকটু হলেই সাদা স্নোবলটার ঘাড় মুচড়ে যাচ্ছিল! কত পরিশ্রম, কত ধৈর্যের ফসল এই ফুলগুলো আর এ ব্যাটা সেসব কিছুই না বুঝে ধড়াধধড় নামাচ্ছে! কোনও যত্নের ধার ধারে না। ফুলগাছের একটা পাতা ছিঁড়লেও যে কীরকম লাগে তা যদি এ বুঝত। দেখতে দেখতে সবক’টা টবই ভ্যান থেকে নামিয়ে নির্দিষ্ট জায়গায় রাখা হয়ে গেল।

“টাকাটা দিন দাদা,” ভ্যানচালক সুদেব হাত পাতল।

“নেহাত স্নোবলটা অক্ষত আছে তাই আর কিছু বললাম না। নয়তো…… নাও ধরো তোমার টাকা,” অমলবাবু বললেন, এখনও যে রাগ পড়েনি তা ভালোই বোঝা যাচ্ছে।

“কী বললেন দাদা? এসস্নো…… কী যেন? কী হয়েছে?” অবাক হয়েই জিজ্ঞেস করল সুদেব।

“কিচ্ছু বলিনি, কিচ্ছু হয়নি, যত্তসব!” অমলবাবু গজগজ করতে করতেই পার্কের ভেতর ঢুকে গেলেন।

পত্র পুষ্প প্রদর্শনীর জন্যে পার্কের একটা অংশ ঘেরা হয়েছে। প্রতি বছরই শীতকালে এই পার্কে এই প্রদর্শনী হয়। প্রদর্শনী জনসাধারণের জন্যে উন্মুক্ত হবে আগামীকাল থেকে। আজ যাঁরা প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন তাঁরা তাঁদের ফুল, ফল, সবজি নিয়ে এসেছেন। বিচারকরা সব দেখবেন খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে, তারপর প্রতিটি বিভাগে প্রথম তিনজন স্থানাধিকারীকে নির্বাচন করবেন। আজ বিকেলেই ফলাফল জানা যাবে।

অমলবাবুর এখানে সকাল সকাল আগমনের হেতুও তাই। প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন উনিও। বাগান করা ওনার নেশা, আজ নয়, বহু বছর যাবৎ। তবে অবসর গ্রহণের পর বাগানের পেছনে আরও বেশি সময় দিতে পারছেন। শীত পড়ার আগে থেকে তো স্নান, খাওয়া ছাড়া দিনের বেশিরভাগ সময়টাই ওনার ঠিকানা বাগান। চারাগাছ বসানো, সার দেওয়া, জল দেওয়া, গাছের গোড়া খোঁড়া – কাজ কী কম! ওনার স্ত্রী মাঝেমাঝেই রাগারাগি করেন, “এইবার শরীর খারাপ হল বলে, খাটনিরও তো একটা সীমা আছে, নাকি!” বলে। উনি অবশ্য বিশেষ কানে তোলেন না এসব কথা। এবার খেটেছেন খুব বাগানের পেছনে এবং ফলও পেয়েছেন। দেখার মতো ফুল হয়েছে। গোলাপ, পপি, গাঁদা, চন্দ্রমল্লিকা, পিটুনিয়া, ডালিয়া, ইমপেশেন্স, জিরেনিয়াম, লিলিয়াম, ন্যাশথাশিয়াম, ক্যালাণ্ডুলা – কী নেই! তবে প্রতিযোগিতায় মাত্র চারটে বিভাগেই নাম দিয়েছেন। চন্দ্রমল্লিকার দুটো বিভাগে, ইমপেশেন্স আর গোলাপের একটা একটা বিভাগে। বাগান করার নেশা অনেকদিন থাকলে কী হবে, প্রতিযোগিতায় আগে কখনও নাম দেননি। তাই অনেক ভেবেচিন্তে বেছেবুছে শুধু এই চারটে বিভাগেই ফুল দিয়েছেন।

বিচারকরা এসে গেছে। তাঁরা কাগজ, কলম নিয়ে গম্ভীর মুখে সারিবদ্ধ ফল, ফুলের টবের সামনে যাচ্ছেন, কাগজে নম্বর লিখছেন। অমলবাবু দূর থেকেই দেখলেন, তারপর চলেও এলেন। ফলাফল জানতে বিকেলে যাবেন।

বাড়ি ফিরেও অমলবাবু বেশ গম্ভীর হয়েই রইলেন। না, কিছুক্ষণ আগে সুদেবের অসাবধানতার জন্যে নয়। কারণ অন্য। সত্যি কথা বলতে গেলে গতকাল সন্ধ্যে থেকেই অমলবাবুর মেজাজ খিঁচড়ে আছে। কারণ, ওনার অত্যন্ত প্রিয় একটি জিনিস হারিয়ে গেছে। একটা ছোটো কৌটো। ইঞ্চি তিনেক লম্বা হবে খুব বেশি হলে। সরু, গোলাকার। সোনালি রঙের, গায়ে গাঢ় নীল আর কালো দিয়ে একটা ড্রাগন আঁকা। সেই কোন ছোটোবেলা থেকে কৌটোটা আমলবাবুর সঙ্গে আছে। আশ্চর্য এত বছরেও কৌটোটার সোনালি, নীল বা কালো কোনও রঙই একটুও চটেনি। জেল্লাও সেই আগের মতোই আছে। কৌটোটাকে অমলবাবু অবশ্য খুব যত্ন করেই রাখতেন। যত্নের কারণ হল, অমলবাবুর বদ্ধমূল ধারণা যে কৌটোটা খুব পয়া। কৌটোটা যখন পেয়েছিলেন তখন ক্লাস সিক্সে পড়েন। সবে বাৎসরিক পরীক্ষা শেষ হয়েছে। অমলবাবু যথেষ্ট দুশ্চিন্তায় ছিলেন। অঙ্ক পরীক্ষাটা একেবারেই সুবিধের হয়নি। তার ওপর ওনার বাবাও সেই সময় খুব অসুস্থ। বাড়ির পরিবেশ সব সময়েই থমথমে।

খেলার মাঠে একটি ছেলে অমলবাবুকে কৌটোটা দিল, বলল, “এ নে, এটা তোকে দিলাম। আমার দাদু নেপালে বেড়াতে গেছিল, এরকম কৌটো এনেছে দুটো। একটা আমার, একটা তোর,” বলেছিল সে।

ড্রাগন আঁকা সোনালি রঙের চকচকে কৌটোটা দেখে খুব পছন্দ হলেও অমলবাবু অবাকও কম হননি। কারণ, এই ছেলেটি একটি মূর্তিমান বিচ্ছু। বন্ধুদের পেছনে লাগাই তার প্রধান কাজ। তবে সঙ্গে তার ভাইও ছিল তখন। আর একগাদা ছেলের সামনে দিয়েছিল বলেই অমলবাবু নিয়েছিলেন। সবার সামনে খুব সাবধানে কৌটোটা খুলে উলটে পালটে দেখেও নিয়েছিলেন।

“তোর ভাগ্য ভালো বলতে হবে, বিজনদা তোকে এত সুন্দর একটা কৌটো দিল,” অমলবাবুর এক খেলুড়ে বন্ধু বলেছিল।

বিজন ওই ছেলেটির নাম, অমলবাবুর থেকে সে বছর দুয়েকের বড়োই ছিল।

এর পরপরই অমলবাবুর বাবার স্বাস্থ্যের উন্নতি হতে লাগল, এতটা কেউ আশাও করেনি। পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোলে দেখা গেল অঙ্কে সাতষট্টি পেয়েছেন, যতটা খারাপ হবে ভেবেছিলেন ততটা হয়নি। অমলবাবুর মনে দৃঢ় বিশ্বাস জন্মাল যে কৌটোটা অত্যন্ত পয়া। বিজনকে ধন্যবাদ দেবেন ভেবেছিলেন। কিন্তু সে তখন মামার বাড়ি না মাসির বাড়ি কোথায় যেন বেড়াতে গেছে আর তার কিছুদিন পরেই অমলবাবুরা অন্য পাড়ায় চলে গেলেন। তারপর তো বছর ঘুরতে না ঘুরতেই সে শহর ছেড়ে অন্যত্র। বিজনের সঙ্গে আর দেখা হয়নি।

সেই থেকে এত বছর অমলবাবু কৌটোটা আগলে আগলে রেখেছেন। কখনও কাছছাড়া করেননি। চাকরি সূত্রে হিল্লি-দিল্লি কম করতে হয়নি, কিন্তু কৌটো যথাস্থানেই থেকেছে। আর গতকাল কিনা সেই কৌটোই বাড়ি থেকে হারিয়ে গেল! এখন মনে হচ্ছে দোষ ওনারই। বাড়িতে নতুন ড্রেসিং টেবিল এসেছে, পুরনোটাকে বিদেয় করা হয়েছে, কাঠটা একদম খারাপ হয়ে গেছিল। পুরনো ড্রেসিং টেবিল থেকে সব জিনিসপত্র বের করে রাখা হয়েছিল। অনেক অপ্রয়োজনীয় জিনিস ফেলেও দেওয়া হয়েছে। কৌটোটাও ড্রেসিং টেবিলের একটা ড্রয়ারেই ছিল। নিশ্চয়ই বাতিল জিনিসপত্রের মধ্যে ওটাও চলে গেছে। উনি ফুলগাছ নিয়ে ব্যস্ত ছিলেন, আজ প্রদর্শনীতে দিতে হবে, ওসব দিকে একেবারেই মন দেবার ফুরসত পাননি। ওটা আগেই কোন সুরক্ষিত জায়গায় রেখে দেওয়া উচিত ছিল। ওনার অসাবধানতার জন্যেই এই বিচ্ছিরি কাণ্ডটা ঘটল। এত বছরের জিনিসটা বেমালুম উধাও হয়ে গেল। তাও আবার যে সে জিনিস নয়, এমন একটা বিশেষ জিনিস।

বিকেলে প্রতিযোগিতার ফলাফল ঘোষণা হল। অমলবাবু পার্কে গেছেন জানতে। চন্দ্রমল্লিকার দুটো বিভাগেই উনি পুরস্কার পেয়েছেন। একটায় প্রথম, আরেকটায় তৃতীয়। সুদেবের অসাবধানতায় যে স্নোবলটার ঘাড় আরেকটু হলেই মচকে যাচ্ছিল সেটাই প্রথম স্থান অধিকার করেছে। প্রথমবার প্রতিযগিতায় নাম দিয়েই পুরস্কার প্রাপ্তি, অমলবাবুর মুখ কিন্তু তাও ব্যাজার। ইমপেশেন্স নিয়ে ওনার অনেক আশা ছিল। গোলাপির ওপর রুপোলির ছিটছিট ফুলে টবের ওপরটা একদম ভরে আছে। এত ফুল যে পাতা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না, ফুলের সাইজও খুব ভালো। এসবই কৌটোটা হারানোর ফল, দীর্ঘশ্বাস ফেলে ভাবলেন অমলবাবু। ফুল, ফলের টবগুলোকে তখন প্রদর্শনীর জন্যে সাজানো হচ্ছে। যেগুলো পুরস্কার পেয়েছে সেগুলোর টবের পাশে পাশে কাঠি পুঁতে তার মাথায় কাগজ লাগিয়ে তাতে লিখে দেওয়া হচ্ছে কোন বিভাগে কী পুরস্কার, কার ফুল ইত্যাদি।

প্রদর্শনীর প্রথম দিনই পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান। অমলবাবু সস্ত্রীক গেলেন। সঙ্গে প্রতিবেশিরাও অনেকে গেলেন। অমলবাবুর বাগান ওনাদের সবার গর্বের বিষয়। অমলবাবুও সবার সঙ্গে আরেকবার প্রদর্শনী ঘুরে দেখলেন। অনেকের সঙ্গে আলাপ হল। অনেকেই ওনাকে ফুলের ব্যাপারে নানান কথা জিজ্ঞেস করছেন। এক ভদ্রলোক তো অমলবাবুর সঙ্গই ছাড়ছেন না প্রায়। ওনার খুব আক্ষেপ যে অনেক চেষ্টা করেও উনি এবার তেমন ভালো ফুল ফোটাতে পারেননি। ইনকাগুলোর সাইজও ভালো হয়নি। ভদ্রলোকের নাম সমর কাঞ্জিলাল। অমলবাবুর বাড়ির কাছাকাছিই নাকি থাকেন। অমলবাবুকে দেখেছেন রাস্তাঘাটে।

“আপনার সাহায্য খুব দরকার আমার। এই প্রথম ফুল করছি, এবার তো মার খেয়ে গেলাম একেবারে, পরেরবার কিন্তু আপনাকে ছাড়ব না। আমার বাড়িতে নিয়ে যাব,” বললেন ভদ্রলোক।

“পরেরবার কেন? চলুন আজই ফেরার পথে একবার ঢুঁ মেরে যাই। অসুবিধে নেই তো আপনার?” অমলবাবু বললেন।

সমরবাবু তো একেবারে হাঁ হাঁ করে উঠলেন, “কী বলছেন! কীসের অসুবিধে? কোনও অসুবিধেই নেই। গেলে বরং অত্যন্ত খুশি হব। চলুন চলুন।”

অমলবাবু গেলেন। ফুলের বিষয়ে নানান পরামর্শ দিলেন।

সমরবাবু কিন্তু চা না খাইয়ে ছাড়লেন না। জোর করে ভেতরে নিয়ে গেলেন, বললেন, “আমার এক কথাতেই আপনি চলে এলেন আর এক কাপ চা-ও না খেয়ে চলে যাবেন, এ কখনও হয় নাকি!”

টা সহযোগে চা খেতে খেতেও ওই ফুলগাছ নিয়েই আলোচনা হচ্ছিল। এমন সময় দেওয়ালে টাঙানো একটা ফটোর দিকে অমলবাবুর চোখ গেল। এক জায়গায় অনেকগুলো ফটো রয়েছে, তারই একটার দিকে। একটি ছোটো ছেলের ফটো।

অমলবাবু কথা বলতে বলতে অন্যমনস্ক হয়ে সেদিকে তাকিয়ে আছেন দেখে সমরবাবু হেসে বললেন, “আর বলবেন না, এসব আমার ছেলের কীর্তি। আমার, আমার স্ত্রীর আর তার নিজের বিভিন্ন বয়সের কতগুলো ফটো এক সঙ্গে এরকম করে সাজিয়েছে। কোলাজ না কী যেন বলে বেশ। আমাদের কি আর অত ফটো আছে? আমার তো আগেকার ওই দুটি মাত্র ফটো, দেখুন না। একটা স্কুলে পড়ি তখনকার আর একটা কলেজে পড়ার সময়। ছেলেরই গাদাখানেক।”

“ওই ছোটো ছেলেটি তার মানে আপনি!” অমলবাবু খুব আশ্চর্য হয়ে বললেন।

“হ্যাঁ… কেন বলুন তো?”

“খুব চেনা চেনা লাগছে আমার। আপনার ছোটোবেলা কোথায় কেটেছে?”

“শ্রীরামপুরে। ওখানেই আমাদের পৈতৃক বাড়ি ছিল।”

“তাই বলি কেন চেনা চেনা লাগছে!” আবিষ্কারের আনন্দে অমলবাবু প্রায় লাফিয়ে উঠলেন, “আমিও যে ছোটোবেলায় বেশ কয়েক বছর শ্রীরামপুরে ছিলাম। বেশির ভাগটা চাতরার ওদিকেই থেকেছি। আমার তো মনে হচ্ছে আপনি বিজনদার ভাই। আগে বুঝতে পারিনি কিন্তু ফটোটা দেখে চিনলাম। হ্যাঁ ঠিক, বিজনদার ভায়ের নাম তো সমরই ছিল।”

“হ্যাঁ বিজন আমার দাদার নাম। কিন্তু আমি তো আপনাকে ঠিক …”

“আরে, আমি অমল। অমলজ্যোতি হালদার। আপনার দাদাকে আমার খুব ভালো মনে আছে। কেন জানেন? কারণটা শুনলে অবশ্য আপনি হাসতেও পারেন, ছেলেমানুষি যত! তা হোক, বলছি শুনুন। বিজনদা আমাকে একবার একটা কৌটো দিয়েছিলেন। সোনালি রঙের, গায়ে ড্রাগন আঁকা, মনে আছে? ওরকম কৌটো আমি আগে কখনও দেখিনি। তা সেই কৌটোটা খুব পয়া, জানেন তো? মানে আমি অন্তত তাই বিশ্বাস করি। কয়েকটা ঘটনায় আমার এ বিশ্বাস জন্মেছে।”

সমরবাবুর মুখটা কেমন যেন হয়ে গেল, ম্লান হেসে বললেন, “পয়া? কী জানি! আমরা তো উলটোটাই জানতাম। দাদু নেপাল থেকে এনেছিলেন। দুটোতেই ড্রাগন আঁকা ছিল। একটার ড্রাগন গাঢ় নীল আর কালো রঙের আরেকটারটা কালচে লাল আর কালো। দাদার দেখে খুব পছন্দ হল, দাদুর কাছ থেকে চেয়ে নিল। এদিকে দাদুর এক বন্ধু ও দুটো দেখে বললেন ও কৌটো নাকি বাড়িতে রাখা ভালো নয়, অমঙ্গল হবে, বিশেষ করে নীল ড্রাগন আঁকা কৌটোটা, তবে দুটোই ফেলে দেওয়াই ভালো। দাদু তক্ষুণি দাদাকে বললেন ফেলে দিতে। দাদা লাল ড্রাগন আঁকা কৌটোটা ফেলে দিল, কিন্তু নীলটা দিল না। মাথায় তখন ওর বদবুদ্ধি চেপেছে যে। এর ক’দিন আগে আপনি দাদাকে দৌড়ে হারিয়েছিলেন, মনে আছে আপনার? দাদার ধারণাও ছিল না যে কেউ ওকে দৌড়ে হারাতে পারে। সেই থেকে হাড়ে চটা ছিল আপনার ওপর। কৌটোটা ও আপনাকে দিয়ে দিল।”

“সে কী! কিন্তু কৌটোটা আমার পক্ষে খুব পয়া ছিল,” অমলবাবু বলে উঠলেন। তারপর একটু ভেবে বললেন, “আসলে বোধহয় পয়া অপয়া বলে কিছু হয়ই না। একটা কৌটোর কী ক্ষমতা আমারদের মঙ্গল বা অমঙ্গল করার? ওটা অপয়া এটা যেমন কুসংস্কার তেমনি ওটা পয়া বলে মনের মধ্যে ধারণা গেঁথে রাখাটাও আমার কুসংস্কারগ্রস্ত হওয়ার পরিচয়। সবই আমাদের মনের দুর্বলতা। আপনার কথা শুনে তো আমার অন্তত তাই মনে হচ্ছে।”

“এইটা আপনি খুব দামি কথা বলেছেন। আমার দাদাই তো তার প্রমাণ। কৌটোদুটো তো আর ওর কাছে ছিল না। কিন্তু ওর অমঙ্গল কি আর কেউ ঠেকাতে পারল? সে তো আমার দাদু, ঠাকুমা আর ও নিজেই ডেকে এনেছিল। অত্যধিক আদরে আর প্রশ্রয়ে ছোটোবেলা থেকেই বিগড়ে গেছিল। তার পরের কথা আর না বলাই ভালো,” বললেন সমরবাবু। বোঝাই যাচ্ছে ওনার দাদার পরিণতি সুখের হয়নি এবং সে প্রসঙ্গ উত্থাপনে উনিও দুঃখী।

“বাদ দিন, ছাড়ুন ওসব,” অমলবাবু পরিবেশ হালকা করার চেষ্টা করলেন, “কী যেন বেশ বলছিলাম……… হ্যাঁ মনে পড়েছে, বলছিলাম যে গোবর সার দিয়ে টব তৈরি করারও কিন্তু কায়দা আছে।”

সমরবাবুর বাড়ি থেকে কিন্তু বেশ হালকা মনে বাড়ি ফিরলেন অমলবাবু। কৌটো হারিয়ে গেছে বলে আর কোনও দুঃখ নেই মনে। ওসব পয়া-টয়া কিচ্ছু নয়, ওনার যত ভুলভাল ধারণা। নাহলে একই কৌটো একজনের কাছে অপয়া আর অন্যজনের কাছে পয়া! হয় নাকি কখনও এসব! তবে বিজন যে সত্যিই বাজে ছেলে ছিল তা মানতেই হবে। না হলে জেনেশুনে কেউ দেয়! যাক গে, যা হয়ে গেছে হয়ে গেছে, ভেবে আর এখন কোনও লাভ নেই।

“শোনো, তোমার কৌটোর খোঁজ পাওয়া গেছে,” অমলবাবু বাড়িতে ঢুকতে না ঢুকতেই ওনার স্ত্রী বললেন, “তোমার আসতে দেরি হচ্ছে দেখে আমি রমামাসিমার বাড়িতে গেছিলাম। ভাবলাম প্রাইজদুটো দেখিয়ে আনি, তোমার বাগান দেখতে এত ভালোবাসেন। তা গিয়ে দেখি উনি তোমার কৌটো থেকে মশলা বার করে খাচ্ছেন। আমি দেখছি দেখে তাড়াতাড়ি লুকিয়ে ফেললেন কিন্তু ততক্ষণে আমার দেখা হয়ে গেছে। পরশু আমি যখন সব জিনিসপত্র গোছাচ্ছিলাম তখন এসেছিলেন উনি। চতুর্দিকে সব ছড়ানো ছিল, কখন কৌটোটা নিয়েছেন খেয়ালও করিনি। অনেকের কাছে শুনেছিলাম আগে যে ওনার এরকম স্বভাব আছে। কিন্তু আমি অতটা বিশ্বাস করিনি, সাবধানও হইনি। এখন কী করি বলো তো?”

“কী আর করবে? বয়স্ক মানুষ, ছেড়ে দাও। তাছাড়া ওসব পয়া অপয়া বলে কিছু হয় না, বুঝলে? যত্ত সব কুসংস্কার! একটা কৌটোই তো, তার বেশি তো কিছু নয়? বাদ দাও। আর আজকাল ওরকম ড্রাগন আঁকা কৌটো-কাটা বাজারে পাওয়া যায়, পরে দেখেশুনে একটা কিনে আনলেই হবে’খন,” বললেন অমলবাবু।

galpodragon02 (Medium)

ছবিঃ অর্ণব

অদিতি ভট্টাচার্যের সব গল্প