গল্প তপনানন্দ সেন ও তাঁর ভূতুড়ে ঘুড়ি অরিন্দম দেবনাথ শরৎ ২০১৬

golpotopananda2 (Medium)অরিন্দম দেবনাথ

হাঃ হাঃ হাঃ ওই দেখ তপনানন্দ সেন পাগল গেট খুলে বেরোচ্ছে।

এই পাড়ায় নতুন বাড়ি করে এসেছি। সবাইকে ভাল করে চিনি না। রিক্সা ধরব বলে চার রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি। মোড়ের মাথায় দাঁড়ান কতকগুলো স্কুল পড়ুয়া ছেলের কথা শুনে সামনে রিক্সা এসে থামতেও, রিক্সায় না উঠে দাঁড়িয়ে রইলাম।

একদিন সকালে তপনানন্দ সেনের সঙ্গে খানিক কথা হয়েছিল। এমনিতে আমি কারো সঙ্গে যেচে আলাপ করতে  পারি না। তবে কেউ কথা বললে আমি নাওয়াখাওয়া ভুলে  ঘন্টার পর ঘন্টা আড্ডা মারতে পারি।

তপনানন্দ সেনের পুরনো দিনের বাগানবাড়ি পার হয়ে আমাদের বাড়ি। একদিন ভোর বেলা প্রাতঃভ্রমণ সেরে বাড়ি ফেরার পথে দেখি কুয়াশা ভেজা জানুয়ারির সকালে পাজামা পাঞ্জাবীর ওপর ফুল সোয়েটার পরা   একজন লোক রাস্তার ধারের ঘাসে হাত বুলিয়ে কিছু খুঁজছে। শীতের সকালে কুয়াশাভেজা ঠান্ডা ঘাসে লোকটাকে হাত ঘষতে দেখে একটু ইতস্তত করে জিজ্ঞেস করলাম, “কিছু হারিয়েছেন না কি?”

আমার কথা শুনে তিনি মুখ ঘুরিয়ে আমার দিকে তাকালেন। ফরসা গোল মুখ। একমাথা চুল, উদ্‌ভ্রান্ত চোখের দৃষ্টি। হাতে বড়ো পাউডারের কৌটোর মত একটা কৌটো। বললেন, “একটা স্ক্রু হারিয়ে গেছে।”

বললাম, “কী সাইজের? এই কুয়াশাভেজা ঘাসের মধ্যে খুঁজে পাবেন কি?”

ভদ্রলোক বললেন, “পেতেই হবে। ওটা চুলের মত সরু টাইটেনিয়াম দিয়ে তৈরি স্ক্রু। প্রায় দশ বছর পরিশ্রম করে তৈরি করেছি।”

golpoTOPANONDO-2 (Medium)বলে সামনের পুরনো দিনের দোতলা বাড়িটার জেলখানার দরজার মত বিশাল লোহার দরজা ঠেলে খুলে ঢুকে গেলেন। গেটের বাইরে একটা কাঠের ফলক। তাতে বাড়ির মালিকের নাম লেখা। তপনানন্দ সেন। বৈজ্ঞানিক। আমি মনে মনে বললাম, লোকটার মাথার স্ক্রুটাই বোধহয় ঢিলে হয়ে পড়ে গেছে। দশ বছর ধরে চুলের মত সরু স্ক্রু বানিয়েছেন।

প্রায় তিন বিঘে জমি পাঁচিল দিয়ে ঘেরা। তার মাঝখানে তপনানন্দের দোতলা বাড়ি। লোহার দরজার ফাঁক দিয়ে যতটুকু দেখা যায় তাতে দেখেছি বাড়ির কম্পাউন্ড  ভর্তি ফুলের গাছ। একটি দারোয়ান ছাড়া, কোন লোকজন দেখিনি। তবে বেশ কয়েকটা ভয়ঙ্কর চেহারার কুকুর দরজার কাছে চুপচাপ বসে থাকে।

মাঝে মধ্যে বিশাল বড়ো বড়ো ঘুড়ি ওড়ে তপনানন্দের বাড়ি থেকে। কোনদিন ঘুড়ির মালিককে দেখিনি। তবে অবিশ্বাস্য দ্রুতগতিতে তপনানন্দের ঘুড়ি উড়ে বেড়ায় আকাশ জুড়ে। আমারও ঘুড়ি ওড়ানোর শখ আছে, কিন্তু শত টেনে খেলেও অত দ্রুতগতিতে ঘুড়িকে ডাইনে- বাঁয়ে বা গোঁত্তা খাইয়ে নীচে নামাতে পারব না। শুনেছি বিদেশে নাকি বিদ্যুৎ-চালিত লাটাই বেড়িয়েছে। তাই দিয়ে বোধহয় লোকটা ঘুড়ি ওড়ায়। কেউ কোনদিন তপনানন্দের ঘুড়ির সাথে পাঞ্জা লড়তে যায়নি। কারণ ওর ঘুড়ির সুতোয় হদিশ কেউ করতে পারেনি।

পাড়ার বাচ্চারা, এমনকি বড়োরাও ওকে আড়ালে আবডালে বলে ঘোড়া বৈজ্ঞানিক পাগলা তপনানন্দ। ঘুড়ি থেকে ঘোড়া।

 একদিন একটু বেশি রাত্রে বাড়ি ফিরছিলাম। অমাবস্যার রাত। তায় লোডশেডিং, রিকশা থেকে  নেমে প্রায় হোঁচট খেতে খেতে এগোচ্ছি। তপনানন্দের পাঁচিলঘেরা বাড়ির পাশ দিয়ে যাচ্ছি, হঠাৎ মাথার উপর ফরফর আওয়াজ শুনে ভয় পেয়ে প্রায় রাস্তার উপর বসে পড়ে আকাশের দিকে চেয়ে দেখি, প্রায় বিছানার চাদরের সাইজের একটা বিশাল ঘুড়ি, তপনানন্দের পাঁচিল ডিঙিয়ে চলে গেল তাঁর বাড়ির ভেতরে। অন্ধকারে ভালো বুঝতে না পারলেও মনে হল ঘুড়ির আকৃতিটা অদ্ভুত। যেন একজন মানুষ বসে আছে ঘুড়ির ওপরে। একজন ঘুড়িপ্রেমী হিসেবে লোভও লাগল। চায়নার অনেক ঢাউস সাইজের ঘুড়ির ছবি দেখেছি। কিন্তু আমি এক-তা বা দো-তার বেশি

বড়ো সাইজের ঘুড়ি কোনদিন ওড়াইনি। তবে নিশ্চিন্ত হলাম। ঘুড়ির মালিক নিশ্চই বদ্ধ পাগল। না হলে কেউ রাতে ঘুড়ি ওড়ায়!

*******

তপনানন্দ সেন, ঢোলা প্যান্ট আর লাল রং এর গেঞ্জি পরে এগিয়ে আসছেন রিক্সা স্ট্যান্ডের দিকে। হাতে একটা বড়ো কৌটো। নিজের মনে বিড় বিড় করে কী যেন বলছেন আর হাসছেন। এক্কেবারে হোঃ হোঃ করে অট্টহাসি। যাকে বলে বদ্ধ পাগল। ব্যারাকপুর স্টেশনে একটা লোককে রোজ দেখি। ঠিক এ’রকম করে নিজের সাথে কথা বলে, আর হোঃ হোঃ করে হাসে, আর লোকজনের সামনে গিয়ে হাত পেতে আকাশের দিকে চেয়ে বলে, “একটা টাকা দেবেন ভাত খাব।”

স্কুল পড়ুয়া ছেলেগুলোর একজন বলে উঠল, “চল পাগলাটাকে ক্ষ্যাপাই।”

পাগলদের কেউ পাগল বললে আমি সহ্য করতে পারি না। কারন পাগল মানে মানসিক ভারসাম্যহীন। এরা অসুস্থ।

আরও একটা খালি রিকশা এসে স্ট্যান্ডে দাঁড়াল, আর দেরি করলে স্টেশানে গিয়ে ট্রেন পাব না। তবু দাঁড়িয়ে রইলাম। দেখি না এই ফাজিল ছেলে গুলো তপনানন্দকে কী করে!

তপনানন্দ কাছে আসতে ছেলেগুলো ঠিক তপনানন্দের মত করেই হোঃ হোঃ করে হাসতে লাগল। একটি ছেলে রাস্তা থেকে একটি পাথরের কুঁচি তুলে ছুঁড়ে মারল তপনানন্দের পিঠে। তবু তপনানন্দ সেন কিছু না বলেই বিড়বিড় করে হাঁটতে লাগলেন। একটি ছেলে সাইকেল চালিয়ে গিয়ে তপনানন্দকে এমনভাবে পেছন থেকে ধাক্কা মারল যে, তিনি টাল সামলাতে না পেরে পড়ে গেলেন।

দুটো ছেলে গিয়ে তপনানন্দকে রাস্তা থেকে তুলে এমন ভাবে ওঁর শরীর থেকে ধুলো ঝাড়ার ভান করে, জামাকাপড় এমন টানাটানি করল যে, লাল গেঞ্জিটা ছিঁড়েই গেল। একজন আবার ভালোমানুষের মত মুখ করে বলল, “শুনলাম আপনি নাকি ঘুড়ি ওড়ানোর জন্য নোবেল প্রাইজ পাবেন? ভুতুড়ে ঘুড়ি!”

 তপনানন্দের যেন হাসির ঘোর লেগেছে। আবার হাঃ হাঃ করে অট্টহাসি হেসে বলল, “পাবই তো! দেখ আমার ঘুড়ি। বলেই সবাইকে আবাক করে দিয়ে হাতের বড়ো পারফিউমের মত কৌটোটার ওপরের নবটা চাপ দিতেই, ভস্‌ ভস্‌ করে লাল ধোঁয়ার মত কী বেরোতে লাগল। কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই লাল ধোঁয়া জমাট বেঁধে, একটা বিছানার চাদরের মত বড়ো শক্তপোক্ত ধাতব লাল চকচকে পাতের মত হয়ে হাওয়ায় ভাসতে লাগল। তপনানন্দ হাতের বড়ো লম্বা কৌটটায় আবার চাপ দিতেই কৌটোর গা থেকে দুটো কব্জা বেরিয়ে এল। কব্জাদুটো ওই ভাসমান ধাতব চাদরের কাছে ধরতেই তা চুম্বকের মত লেগে গেল চাদরটার গায়ে।

চুম্বকের মত লেগে থাকা কৌটোটায় চাপ দিতে তা থেকে ইলেকট্রিক পাখার মত তিনটে ছোটো ছোটো পাখার ব্লেড বেরিয়ে এসে প্রবল গতিতে ঘুরতে লাগল। সবাইকে অবাক করে দিয়ে তপনানন্দকে নিয়ে চাদরটা ভাসতে ভাসতে দ্রুত আকাশের উঁচু থেকে আরও উঁচুতে নিঃশব্দে ঘুড়ির মত উঠে যেতে লাগল।

ছবিঃশিমুল

জয়ঢাকের গল্পঘর