লোকটা দোকানটার ভিতরে গিয়ে বসল। খুবই পুরনো বইয়ের দোকান। রাস্তা থেকে এতই ভিতরে যে কারোর চোখেই পড়বে না। দোকানের কোন মালিক বা কর্মচারীকেও তো দেখতে পাচ্ছে না সে। দোকানের সারা দেওয়াল জুড়ে থাকে থাকে সাজানো পুরনো বই। চারিদিকে শুধু বই আর বই। লোকটার নাম সুধাংশু দত্ত। শহরতলির প্রাইমারী একটা স্কুলে লাইফ সাইন্স পড়ায় সে। বয়স পয়ত্রিশের চেয়ে সামান্য কিছু বেশি। সুধাংশু বিস্মিত হল। এতবছর ধরে সে বইপাড়াতে আসছে বই কিনতে অথচ এই দোকানটা তো তার আগে কোনওদিন চোখেই পড়েনি! দোকানের ভিতরে বেশ গরম লাগছে। সে গলা থেকে মাফলারটা খুলে রাখল টেবিলে। ডাকাডাকিও করল দু’বার। কেউ তো সাড়াও দিচ্ছে না। দোকানে কি কেউ নেই? তাহলে হয়তো কোনও কাজে বাইরে গেছে। এক্ষুনি চলে আসবে হয়তো। অপেক্ষা করা ছাড়া তো আর কোনও উপায় নেই! সুধাংশু প্রায় মিনিট দশেক ধরে বসে রইল। নাহ! এখনও কারোর দেখা নেই! এদিকে রাত প্রায় ন’টা বেজে গেছে। তাকে ফিরতেও তো হবে বাড়িতে। অগত্যা সে নিজে থেকেই উঠে কিছু বই পড়তে লাগল তাক থেকে নামিয়ে। কিন্তু দেওয়ালে একটা অদ্ভুত জিনিস দেখে তার চোখদুটো আটকে গেল। এই প্রথম সে বই ছাড়া অন্য কোনও বস্তুর দ্বারা এত বেশি মোহিত হল।
একটা দেওয়াল ঘড়ি। খুবই প্রাচীন। কাঠের তৈরি। মাথার দিকে একটা টাকমাথা বয়স্ক মানুষের মুখ খোদাই করা রয়েছে। ঘড়ির ডায়ালটা বয়সের ভারে হলুদ হয়ে গেছে। অদ্ভুত ব্যাপার, ঘড়ির মধ্যে পাচটা কাঁটা রয়েছে এবং তার পাশের সংখ্যাগুলি রোমান বা ইংরেজি কোনও হরফেই লেখা নেই। এক অজানা ভাষায় লেখা আছে বারোটা সংখ্যা। সুধাংশু লোভ সামলাতে পারল না ঘড়িটা একবার নিজের হাতে নিয়ে দেখার। সে তো আর চুরি করছে না। দেখতে ক্ষতি কী?
সে নামিয়ে আনল ঘড়িটা। এরকম অদ্ভুত অমূল্য জিনিসটার ওপরে হাত বোলাতেই তার মধ্যে এক দারুণ রোমাঞ্চ খেলে গেল।
“কে ? কে ওখানে?” হঠাৎ দরজার কাছে এক বৃদ্ধ মানুষের হুঙ্কার ভেসে এল।
সেই আওয়াজে চমকে গেল সুধাংশু। আর যা সর্বনাশ হবার তা সে বুঝে ওঠার আগেই আচমকা হয়ে গেল। ঘড়িটা তার হাত থেকে পড়ে গেল নীচে মেঝেতে।
সুধাংশু ভাবাচ্যাকা খেয়ে গেল। তবু এটা দেখে সে হাঁপ ছেড়ে বাঁচল যে ঘড়িটা ভাঙেনি। একেবারে অক্ষতই রয়েছে – মজবুত কাঠের তৈরি কিনা! কিন্তু ওর কাঁটাগুলি থেমে গেছে। হয়ত ব্যাটারিটা ছিটকে গেছে কোথাও।
সুধাংশু তাড়াতাড়ি ঘড়িটা তুলে বৃদ্ধের হাতে তুলে দিয়ে বলল, “মাফ করবেন, আমি শুধু দেখছিলাম, মানে… বুঝতে পারিনি… ”
বৃদ্ধ কোনও কথা বললেন না। তিনি নীরবে ঘড়িটা তুলে রাখলেন দেওয়ালে। তারপর বললেন, “তুমি এখান থেকে চলে যাও, যা সর্বনাশ হবার তা তো হয়েই গেছে।”
সুধাংশু বুঝতে পারল ঘড়িটা বৃদ্ধের খুব প্রিয় একটা বস্তু। ইস! অসাবধানতার বশে সে কী ভুলটাই না করে ফেলেছে!
সুধাংশু আর কথা না বাড়িয়ে অপরাধীর মতো বেরিয়ে যাবার জন্য প্রস্তুত হল।
দরজার কাছে যেতেই বৃদ্ধ বলে উঠল, “যাচ্ছ যাও, সময় থেমে গেছে… সাতদিন আগে একজন এসেছিল। একই ভুল। লাল টুপি। যদি ফিরতে না পারো তার সাথে দেখা হলেও হতে পারে। আর কিছু না। আর কিছু না।”
বৃদ্ধের কথা কিছুই বুঝতে পারল না সুধাংশু। তিনি বোধহয় খুবই শোক পেয়েছেন। কে জানে, তার মনের কোথায় আঘাত দিয়ে ফেলেছে সে ভুল করে। সুধাংশু আর একমুহুর্তও দাঁড়াল না। দোকান থেকে বেরিয়ে সে বাড়ি যাবার জন্য শর্টকাট নিল। পার্কের পাশ দিয়ে একটা রাস্তা আছে সে শুনেছিল। আজ সেই রাস্তা দিয়েই না হয় যাওয়া যাক!
সুধাংশু হেঁটে যাচ্ছে পার্কের গা লাগোয়া সমান্তরাল রাস্তাটা ধরে। রাত প্রায় এগারোটা হয়ে গেছে। এদিকের গলিগুলো এত সাংঘাতিক গোলমেলে তা কি আর আগে জানা ছিল? সুধাংশুর বিরক্ত লাগল। তখন থেকে হেঁটেই চলেছে তবু সে ট্রামরাস্তাটা খুঁজে পাচ্ছে না কিছুতেই। এতই গলি-গালা এদিকটায় যে বারবার পথ ভুল হয়ে যাচ্ছে। তার ওপরে আবার অন্ধকারও। একরকম চড়কিপাক খেতে খেতে সে এই পার্কটার সামনেই এসে পড়ছে। হ্যাঁ, এই তো সেই ত্রিফলা! ওদিকে একটা টিউবকল আছে। এই রাস্তা দিয়েই সে একটু আগেই বেরোল না? ধুর! উত্তর কোলকাতার গলিগুলো এরকম বিদঘুটে কেন হয়!
রাত বাড়ছে। ডিসেম্বর মাস একে, ঠান্ডাও লাগছে বেশ ভালোমতই। গলার মাফলারটাও কোথায় গেল? কোনও দোকানে আবার ফেলে এল না তো? ওর যা ভুলো মন। কলেজ স্ট্রীট থেকে কিছু বই নিতে এসেছিল সুধাংশু। কিন্তু শেষ অব্দি কেনা হল না। কিন্তু প্রতিবারই এদিকে এলে কিছু না কিছু নিয়েই যায় সঙ্গে করে। এবারে কেন যে কিছু কিনল না ওই জানে। তাই নিজের হাতটাও বেশ অস্বস্তিকরভাবে ফাঁকা ফাঁকাই লাগছে তার।
সুধাংশু পার্কটার ঠিক মাঝামাঝি জায়গাতে এসে দাঁড়াল। ধুর! আর ভালো লাগছে না তার। একটু আগে তাও দু’একজন লোক ছিল রাস্তাতে। এখন তো কেউ নেই। এত রাতে, শীতের সময় কেই বা বাইরে থাকবে? সুধাংশুর বিরক্ত লাগছে। এবার তো ট্যাক্সিও পাওয়া যাবে না আর। পার্কের চারদিকে সে গুনে দেখল মোট দশটা গলি আছে। সে মোটামুটি প্রায় ন’টা দিয়েই ঢুকেছে। অবশ্য পথ ভুল করছে কি না সে বিষয়েও সন্দেহ রয়েছে তার। সবক’টা গলিই একই রকম লাগছে তার। একটা প্ল্যান করা যাক। সুধাংশু গলিগুলোকে মার্ক করবে ঠিক করল। তাহলে সেই গলিতে পরেরবার সে ঢুকবে না। নয়তো একই গলিতে বারবার ঢুকে পড়ছে হয়ত।
সে একটা লাল ইটের টুকরো খুঁজতে লাগল। একটু দূরেই রাস্তার পাশে কয়েকটা ঢিল খুঁজে পেল সুধাংশু। যেই সে ঢিলটা তুলতে যাবে অমনি একজন ভদ্রলোককে এদিকেই আসতে দেখল সে। যাক তাহলে, কেউ তো একজন আসছে! ভদ্রলোককে জিজ্ঞেস করে যদি রাস্তা পাওয়া যায়!
ভদ্রলোকের মাথায় লাল টুপি, গায়ে কালো জ্যাকেট। খুব হন্তদন্ত হয়ে হেঁটে আসছেন এদিকেই। ভদ্রলোককে দেখে সুধাংশু কিছু বলতে যাবার আগেই ভদ্রলোক কাঁচুমাচু মুখ করে বলল, “দাদা, গিরীশ পার্কের রাস্তাটা কোনদিকে একটু বলতে পারবেন? খুব তাড়া আছে! আসলে আমি এদিকে প্রথম আসছি।”
ও হরি! সুধাংশু মনে মনে হতাশ হল। কাকে সে জিজ্ঞেস করতে যাচ্ছিল রাস্তার কথা! এ তো নিজেই জানে না! সুধাংশু বলল, “আমিও ঠিক জানি না, আসলে এদিকের গলিগুলো একই রকম তো! গুলিয়ে গেছে। তবে যতদূর মনে হচ্ছে, আপনি ওই সামনের লাল বাড়িটার পাশের গলিটা ধরলে হয়তো পেয়ে যাবেন। বা ওই বাড়িতে একটু জিজ্ঞেস করে দেখতে পারেন।”
লোকটার ভীষণ তাড়া ছিল বোঝাই গেল। ধন্যবাদটাও ঠিক করে জানাল না। শুধু হাত নেড়ে ‘আচ্ছা’ বলে সেই দিকেই হন্তদন্ত হয়ে ছুটে গেল। সুধাংশু দূর থেকে দেখল লোকটা বাড়ির সামনে গিয়ে কলিং বেল বাজাল। কিন্তু কেউ দরজা খুলল না। লোকটা আবার দু’বার বাজাল। এবারেও কেউ সাড়া দিল না। শেষে লোকটা হতাশ হয়ে বাড়ির পাশের গলিটাই ধরল। সুধাংশু বাড়িটার সামনে এসে দাঁড়াল। বাড়ির নাম ‘রক্তকরবী’। দোতলা বাড়িটার গায়ে মাধবীলতা বেয়ে উঠেছে। দোতলার ব্যালকনির দরজাটাও খোলা রয়েছে আর ভিতরে দোতলার ঘরটা দেখাও যাচ্ছে কিছুটা। অথচ কেউ নেই বাড়িতে! কী আর করা যাবে! আজ সত্যিই খুব খারাপ কপাল তার। সুধাংশু মার্ক করল বাড়ির গলিটা। ও বাড়িটার পাশে এসে দেওয়ালে একটা ক্রস চিহ্ন আঁকল তার হাতের ঢিলটা দিয়ে। তারপর সেই মার্ক করা গলি দিয়ে ঢুকে পড়ল।
কিছুক্ষণ হাঁটার পর বেশ অন্ধকার হয়ে গেল রাস্তাটা। এদিকে আলো তেমন নেই। সুধাংশুর দেখতে অসুবিধা হচ্ছে বেশ। তবু কোনওরকমে পা ফেলে ফেলে এগোতে লাগল। দূরে গলির শেষে একটা আলো দেখা যাচ্ছে বটে। সেদিকেই হাঁটতে লাগল সে। আলোর কাছাকাছি এসে সুধাংশু দেখল সামনেই একটা পার্ক। পার্কের সামনে আসতেই সুধাংশুর বিরক্ত লাগল। এই পথেই তো একটু আগেই সে এল। অন্তত তাই তো মনে হচ্ছে। ঠান্ডা বাড়ছে এদিকে লাফিয়ে লাফিয়ে। সুধাংশু ঘড়িতে সময় দেখল – প্রায় এগারোটা বাজে। মাফলারটাও সে ফেলে এসেছে কোথায়! ধুর! সুধাংশু মনে মনে ফন্দি আঁটল। সে গলিগুলোকে মার্ক করবে যাতে তার আর রাস্তা গুলিয়ে না যায়। সে একটা লাল ঢিল জাতীয় কিছু খুঁজতে লাগল দেওয়ালে দাগ দেবার জন্য। একটু দূরে রাস্তায় অনেকগুলো ঢিল দেখতে পেয়ে সুধাংশু এগিয়ে গেল। হঠাত সে দেখল একটা লোক লাল টুপি আর জ্যাকেট পরে তার দিকেই এগিয়ে আসছে হন্তদন্ত হয়ে।
‘রক্তকরবী’র ডাইনিং টেবিলে পরিবারের সবাই একসাথে খেতে বসেছে। রাত এগারোটা বাজে। বাড়ির সবাই একে অন্যের মুখের দিকে তাকিয়ে আছে। এমন সময় কলিং বেলটা বেজে উঠল।
সবাই সবার দিকে মুখ চাওয়াচাওয়ি করছে। কেউ দরজা খুলতে এগিয়ে গেল না।
টিং টং। টিং টং। টিং টং।
যাক, আজকের মত শেষ হল! আর বাজবে না।
সবাই আবার নির্লিপ্তভাবেই খেতে লাগল। আজ তিনদিন ধরে এই এক ভূতুড়ে জিনিস হয়ে চলেছে ওদের বাড়িতে। রাত এগারোটা বাজলেই কে যেন তিনবার বেল বাজিয়ে পালিয়ে যায়। অথচ বাড়ির কর্তা ব্যালকনি থেকে দেখেছে, কাউকেই দেখা যায়নি। কাল পুলিশে রিপোর্ট করবেন বলে ঠিক করেছেন তাই।
ছবিঃ অর্ণব