গল্প-পুটি ও ভগবান-তন্ময় বিশ্বাস-বর্ষা ২০১৬

galpoputibhogoban (Medium)“মা, খুব খিদে পেয়েছে। তিনদিন কিচ্ছু খাইনি…”

মা বসে আছে একটা লাল রঙের জাইলোয়। বিরক্তিমাখা মুখ। শরীরের ভারে গাড়িটা একদিকে হেলে গেছে। কানে হেড ফোন। চোখের সানগ্লাসে ছায়া ফেলছে একটা বিবর্ণ কচি মুখ। উসকো-খুসকো লাল চুল, ময়লা জামা আর উজ্জ্বল দুটো চোখ।

সাঁই করে বাতাস কেটে জাইলোটা চলে গেল। যেন মুখের ওপর থুতু ছিটিয়ে গেল। সবাই চলে যায়। এভাবেই যায়। যায় না শুধু পুটি। পুটিদের যাওয়ার জায়গা নেই। তারা পড়ে থাকে।

রাস্তা। মাইলের পর মাইল। পিচের অ্যানাকোন্ডা। সে শুধুই শুয়ে থাকে। একভাবে। তার কোনও পরিবর্তন নেই। নেই বদল। শুধু লাল নীল গাড়িগুলো বদলে বদলে যায়। পালা করে পিষে দিয়ে যায় রাস্তাটাকে। পিষে দিয়ে যায় সময়কে।

দু’পাশে সারিসারি দোকানপাট, অফিস আর বিশাল একটা আকাশ। আকাশটাও রোজ রোজ বদলায়। বদলায় প্রতিক্ষণে। রোদ মেখে দৌড়ে বেড়ায় ছেঁড়া-ছেঁড়া মেঘেরা। তারা দলছুট। তারা একলা। বোধহয় পুটির মতোই।

ছোটো ছোটো পা ফেলে এগিয়ে যায় পুটি। এলোমেলো হাওয়া এসে বিলি কাটে চুলে। হাওয়ার তালে তালে তিরতির করে কাঁপে জট পাকানো চুলগুলো। তারা ফিসফিস কী সব যেন বলে!

সামনে একটা কল থেকে ছড়ছড় করে জল পড়ে যাচ্ছে। ভাল্ব নেই। পুটি আঁজলা করে একটু জল খায়। পেটের দৈত্যটাকে শান্ত করে। ঘুষ দিয়ে!

ওর অবশ্য দোষ নেই। সেই তিনদিন আগে ওই কাকুদের সাথে রাস্তা ঝাড় দিয়ে একটু খেতে পেয়েছিল। তারপর আবার একটানা উপোস!

একপাশে একটা মন্দির। কালীমন্দির। এই দুপুরেও বেশ ভিড়। মা নাকি খুব জাগ্রত! পুটির বিশ্বাস হয় না। ওই জিভ বার করা মাসিটা মোটেই কথা শোনে না। সেই কব্বে থেকে পুটি বলে আসছে। ওকে বাড়ি ফিরিয়ে দিতে। কিন্তু কিছুই হয় না। মাসিটা কেবলই দাঁড়িয়ে থাকে। একটানা। তাতেই কত লোক মাসিকে খেতে দিয়ে যায়। ঝুড়ি ঝুড়ি ফল! মিষ্টি! পুটি চাইলেও পায় না। উলটে সবাই তেড়ে আসে। আর মাসি না চাইতেই পায়। কী মজা না! পুটিও বড় হয়ে অমন হবে। ও মাসির থেকে ঢের বেশি সুন্দরী!

মদনকাকু চপ ভাজা শুরু করেছে। পুটি নিশ্বাস বন্ধ করে পেরিয়ে যায়। গন্ধ পেলেই আবার বাচ্চা দৈত্যটা উঠে পড়বে। লাফালাফি শুরু করবে। পুটি কত বোঝায়, দমাদম ঘুষি মারে। কিন্তু হতচ্ছাড়া বোঝেই না।

মদনকাকু খুব পচা। একবার পুটিকে ঝ্যাঁটা দিয়ে…

“অ্যাই বুড়ি, কোথায় যাচ্ছিস?”

পুটি ফিরে তাকায়। সূর্যের আলো এসেছ পড়েছে একজোড়া চশমার কাঁচে। তার আড়ালে হাসি হাসি দু’টো চোখ।

“ভগবানকাকু!”

পুটি ছুট্টে গিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে তার ওপর। এখানে তার কোনও লজ্জা নেই, ভয় নেই। জানে, এই মানুষটা অন্তত ময়লা বলে তাকে দূরে সরিয়ে দেবে না। পুটির ভগবানকাকু!

কাকু সপ্তাহে একবার আসে। আর আসে ঝুড়ি ঝুড়ি হাসি আর আনন্দের দল। তারা পুটিকে ঘিরে নাচানাচি করে। যেন বলে, পুটি আমরাও আছি। আমাদের ভুলিস না। তারপর একসময় তারা মিলিয়ে যায়। কাকু চলে যায়। আবার হানা দেয় সেই পুরনো দুঃখ আর কান্নারা। ঝাঁকে ঝাঁকে। তারা পুটির বড্ড আপন।

“কী রে? তোকে এধার ওধার খুঁজে মরছি। কোথায় গিয়েছিলি?”

পুটি রিনরিনে গলায় বলে, “কোত্থাও না।”

“উঁউউ, বললেই হল। অ্যাই, আবার ভিক্ষা করছিলি না? যাক গে, চল চল, তোর বাড়ি যাই। আমার কিন্তু খু-ব খিদে পেয়েছে।”

বুঁচকি কোমরে হাত দিয়ে ঠোঁট উলটায়, “উফফ! ভগবান, তুমি কি আর বড়ো হবে না?”

ভগবান হাসে। হাসলে তাকে ভারি ভালো লাগে পুটির। কাঁচা পাকা গোঁফ দু’টো ঠেলা মারে গালে। গাল দু’টো টোল খায়। চোখ দু’টো এই এত্তটুকুনি হয়ে যায়। পুটির মনে হয়, দূর, ওই মন্দিরটাই ছাই আছে। ঠাকুর তো আছে এখানে। তার ভগবানকাকুই তো ঠাকুর।

রাস্তার এদিকটা একটু নির্জন। এখানেই একপাশে পুটির ‘বাড়ি’। একটা বড় কার্ডবোর্ডের পেটি আর ক’টা ছেঁড়া বস্তা। দু’জনে মিলে তাতেই জুত করে বসে। প্যাকেট থেকে খাবার বার করে খেতে থাকে। কাকু খায় নামমাত্রই। ভগবানদের কি খিদে পায় না? হবে হয়তো! কাকু তো আর কালীমাসির মতো নকল ভগবান নয়!

জায়গাটা নির্জন। নইলে দেখা যেত, প্যান্ট শার্ট পরা একজন শিক্ষিত মধ্যবয়স্ক মানুষ পথে বসে আছে। আর পাশে কালিঝুলি মাখা বছর ছয়েকের একটা মেয়ে! আস্তে আস্তে বাতাস ভরে ওঠে দু’জনের কলকলানিতে। ঘরে ফেরা পাখিরাও যেন গলা মেলায়। ভাগ করে নেয় সমস্ত সুখ। সমস্ত দুঃখ।

একসময় কাকু উঠে পড়ে। পুটি একটা আঙুল ধরে। কাঁদোকাঁদোভাবে বলে, “আবার কবে আসবে কাকু?”

কাকু হাসে। হাসে ভগবান। গোধূলির আলো মাখা সেই মন ভোলানো হাসি।

তিনি দুষ্টুমি করে বলেন, “আর হয়তো আসব না রে। আমাকে তো ভুলেই যাবি।”

পুটির ঠোঁট ফুলে ওঠে। সে আছড়ে পড়ে ভগবানের কোলে। মুখ গুঁজে ডুকরে ওঠে। মাথা ঝাঁকিয়ে বলে, “তুমি ছাড়া আমার কেউ নেই ভগবান। আমাকে ছেড়ে…’’

কান্নারা হানা দেয়। মুছে দেয় কথাদের। কান্নারা বড্ড অবাধ্য।

“আরে, দেখি দেখি দেখি। পাগলি বুড়ি আমার।”

ভগবান হাঁটু গেড়ে বসে। চোখের কোলে জেগে ওঠা মুক্তোটাকে আঙুল দিয়ে ঝেড়ে ফেলে।

“এভাবে কক্ষনও কাঁদবি না। বুঝলি? সবাই ভিতু বলবে।”

তারপর পুটির নখটা টিপে দিয়ে বলে, “বুঁচকি বুড়ি একটা।”

বুঁচকি চোখ পাকায়। কাকুর কপালে ছোট্ট একটা থাবা মেরে বলে, “বোঁচা বুড়ো।”

দু’জনেই হেসে ওঠে। একরাশ মুক্তো ভেসে যায়। বাতাসে ভর করে। দূরে। বহুদূরে।

এই সময়টা পুটির খুব ঝিমুনি আসে। কিন্তু ঘুম হয় না। চোখের সামনে ভসে ওঠে টুকরো-টুকরো ছবি। আবার মিলিয়ে যায়। কুয়াশায়।

আগে এমন হত না। এখন হয়। মাঝে মাঝেই। আজ একটার পর একটা ছবি ভেসে যাচ্ছে। মাটির রাস্তা… বাড়ি… একটা বাস…। আবার সব মিলিয়ে গেল!

ওই ওই, আবার সব আসছে। ভিড় বাস… একটা সাইনবোর্ড…

টলমলে পায়ে উঠে দাঁড়ায় পুটি। সামনেই একটা বাস স্ট্যান্ড। একটা বাস। কন্ডাকটর তারস্বরে চেঁচাচ্ছে। পুটি উঠে পড়ে।

বাস ছাড়ে। টুকরো-টুকরো অন্ধকার ছুটে চলে দু’পাশে। জানলা দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়া ঝাপটা মারে চোখেমুখে। পুটির কোনও হুঁশ নেই।

ভেসে আসে কন্ডাকটরের চেরা গলা, “পলাশপুর, পলাশপুর…”

পুটি ছুট্টে নেমে যায়। কেন সে জানে না। জানার ইচ্ছেও নেই। সে শুধু জানে যেতে হবে। ফিরতে হবে।

সামনে আঁকাবাঁকা রাস্তা। মাটির। গাছের পাতার ফাঁক দিয়ে কাটা-কাটা জ্যোৎস্না এসে পড়ছে পুটির গায়ে। আবার তারা মিলিয়ে যাচ্ছে অন্ধকারে। অতলে। রাস্তাটা যেন চলছে। নিজে নিজে! পুটিকে ভাসিয়ে নিয়ে চলেছে কোনও অজানা দেশে। অজানা শিকড়ে!

একচোখা জোনাকিরা টহল দিচ্ছে দু’পাশে। তারা অপেক্ষায়। কোনও এক চরম মুহূর্তের জন্য।

রাস্তার বাঁকে একটা বাড়ি। দোতলা। পাশে একটা পলাশগাছ। গাছে যেন আগুন ধরে আছে। জোছনা মাখা রুপোলি আগুন। পুটি এগিয়ে যায়। এক ভদ্রমহিলা বোধহয় দরজা লাগাতে এসেছিলেন। পুটিকে দেখে দাঁড়িয়ে পড়েন। তার কালি পড়া চোখদু’টো কী যেন খুঁজতে থাকে। পুটিও দেখে। দু’জনেই কিছুক্ষণ থমকে দাঁড়ায়। জোড়া-জোড়া চোখের ওপর দিয়ে বয়ে চলে হলুদ স্মৃতির ঝড়। হঠাৎ করেই যেন একটা বৃত্ত সম্পন্ন হয়। একে একে মিলে যায় অঙ্ক।

“আলো মা! এসেছিস!”

পুটি অস্ফুটভাবে বলে, “এসেছি।”

ভদ্রমহিলা ছুটে আসেন। স্নেহমমতায় গড়া দু’টো হাত জড়িয়ে ধরে পুটিকে। ডুকরে ওঠে দু’টো শরীর। কান্নার দমকে। একটা চেনা গন্ধ নাকে আসে পুটির। মা মা গন্ধ!

কেউ কথা বলে না। শুধু অক্লান্তভাবে বয়ে যায় দু’জোড়া চোখ। অবিরাম। ফোঁটা-ফোঁটা মুক্তো খসে পড়ে নরম ঘাসের ওপর। ঘাসেরা মাথা দোলায়। বোবা জোনাকিগুলো উড়ে যায়। আবার আসে।

তাদের ঝাপসা দৃষ্টিতে ধরা দেয় না হেডলাইট নেভানো গাড়িটা। তাতে বসে থাকা দু’টো চোখ তাকিয়ে আছে তাদের দিকে।

বিখ্যাত বিজ্ঞানী প্রফেসর সাহা। তার দীর্ঘদিনের সাধনা আজ সফল। সার্থক। মানুষের মস্তিষ্ক বিশাল এক ভাণ্ডার। জন্মের পর থেকে সেখানে জমা হতে থাকে কোটি-কোটি স্মৃতি। সব আমাদের মনে পড়ে না। কিন্তু মস্তিষ্কে থেকে যায়।

প্রফেসার সাহার আবিষ্কৃত হরমোনের প্রভাবে ছোটোবেলার সেই স্মৃতিগুলো জেগে ওঠে।

মায়ের কোলে চড়ে ঘোড়াখেলা, এমন কি মনে পড়ে যায় ছোটোবেলার ঘুম পাড়ানির গান! সব ভেসে ওঠে ছবির মত।

পুটিকে ছয়মাস ধরে খাবারের সাথে হরমোনটা দিয়েছেন। একটু একটু করে। পুটি মনেপ্রাণে চাইত বাড়ি ফিরতে। চাইতো তার মাকে। তাই হরমোন ধীরে ধীরে ছবি এঁকেছে। ধুলো পড়া স্মৃতিগুলো ডানা মেলেছে একে একে। আস্তে আস্তে ভেসে উঠেছে বাড়ির কথা। মায়ের কোলে চড়ে শহরে আসা, তারপর হারিয়ে যাওয়া। সব।

স্মৃতির সরণী বেয়ে আজ বাড়ি ফিরল পুটি। ফিরল আলো।

তার এই ওষুধের কল্যাণে খুব শীঘ্রই লক্ষ লক্ষ হারিয়ে যাওয়া শিশু ফিরে পাবে তাদের ঘর। তাদের পরিবার।

গাড়ির সামনে রাখা ছবিটায় হাত বোলান প্রফেসর। একটা হাসিখুশি মিষ্টি মেয়ে। হয়তো রিগ্ধাও কোনওদিন ফিরে আসবে। এভাবেই। চশমার ফাঁক দিয়ে গড়িয়ে যায় ক’ফোঁটা গরম ধারা। ভগবানও কাঁদে!

ছবিঃ ইন্দ্রশেখর