গল্প পূর্বজন্ম অর্ক পৈতন্ডী শরৎ ২০১৬

golpoPurbojanmo (Medium)                                    অর্ক পৈতন্ডী

আমি মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভের চাকরিটা হঠাৎ ছেড়ে দেওয়ার সবাই খুব অবাক হল। অনেক প্রশ্ন করল, “ছাড়লি কেন?” “মাইনেপত্তর কম ছিল বুঝি?” “খুব খাটাখাটনি করাতো?”

আমি সবার প্রশ্নই কিছু একটা বলে এড়িয়ে গেছি। কারণ আমি জানি আসল কথাটা কেউ বিশ্বাস করবে না। হাসবে। ভাববে আমি পাগল। অন্যদের আর কী দোষ দেব, মাঝে মাঝে আমারই ভাবতে অদ্ভুত লাগে যে এরকম একটা অলৌকিক ঘটনা আমার জীবনে ঘটেছিল। আজ সেই ঘটনার কথাই লিখব।

সেদিন আমি কাজের সূত্রে দমদম ক্যান্টনমেন্টের গ্রিনপার্কে ডঃ অরিজিত মুখোটীর চেম্বারে গিয়েছিলাম। ফেরার সময় দেখি টিপ টিপ করে বৃষ্টি পড়ছে। অন্যদিন হলে বিরক্ত হতাম। আজ যেহেতু আর কোথাও যাওয়ার নেই, সোজা বাড়িই ফিরব, তাই আর ততটা বিরক্ত হলাম না। ঝিরিঝিরি বৃষ্টি গায়ে মেখে তখন বারাসাত যাওয়ার কোন ট্রেন পাব তা ভাবতে ভাবতে স্টেশনের দিকে চললাম।

বেশ হাঁটছিলাম। আচমকা কী হল বুঝতে পারলাম না। মনে হল প্রচণ্ড বমি পাচ্ছে। পরক্ষনেই মনে হল জল তেষ্টা পাচ্ছে। বুকের বাঁদিকে একটা চিনচিনে ব্যথাও যেন অনুভব করতে পারছি।

এই জায়গাটা কেমন যেন চুপচাপ হয়ে আছে। রাস্তায় কোনও দোকানপাটও নেই যে একটু জল চাইব। আমার ব্যাগে জলের বোতল আছে তবে তার শেষ বিন্দুটা বিকেল সাড়ে চারটেয় কলেজ স্ট্রিটের মোড়-এ খরচ করে ফেলেছি।

এমন সময় রাস্তায় বাঁপাশের একটা বিশাল দোতলা বাড়ির দরজা খোলা পেলাম। ভেতরে একটা টিমটিমে নীল আলো জ্বলছে। শরীর এত খারাপ লাগছিল যে অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা না করেই ঐ খোলা দরজা দিয়ে ভেতরে ঢুকে পড়লাম। চোখের দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসছে। তাও যা দেখতে তাতে মনে হল একটা বসার ঘর। সোফাসেট, সেন্টার টেবিল রাখা আছে। আমি “কেউ আছেন” বলে একটা চিৎকার করার চেষ্টা করলাম, কিন্তু গলা দিয়ে এত ক্ষীণ স্বর বেরোল যে আমি নিজেই শুনতে পেলাম না ঠিকমত। অগত্যা দরজা ঠেলে পাশের ঘরে ঢুকলাম। ওখানে একটা সিঁড়ি নজরে এল। দোতলায় লোকজনের গলার আওয়াজ পাচ্ছি যেন। কোনওমতে টলতে টলতে সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় পৌঁছতেই কিছু লোক আমাকে দেখে হাই হাই করে ছুটে এল- “ঐ এসেছে, ঐ এসেছে !!” এত অসুস্থতা সত্ত্বেও আমি অবাক হলাম। ওরা যেন আমার জন্যই অপেক্ষা করছিল। যেন জানত আমি আসব।

আমি ততক্ষণে কথা বলার ক্ষমতা প্রায় হারাতে বসেছি। ইশারায় বললাম জল খাব। তৎক্ষনাৎ কে একজন একটা কাচের গ্লাসের এক গ্লাস জল নিয়ে এল। আমি মরুদ্যানের সন্ধান পাওয়া পথিকের মত সেই গ্লাসে চুমুক দিলাম এবং সঙ্গে সঙ্গে বুঝতে পারলাম যে গ্লাসের তরল আর যাই হোক না কেন, জল নয়। তবুও এক চুমুকে সেই তরল নিঃশেষ করে ফেললাম আর অবাক হয়ে বুঝলাম শরীরে এখন আর কোনও কষ্ট নেই।

আমি এবার ঘরের ভিতরটা ভালোভাবে লক্ষ করলাম। ঘরটা কেমন যেন ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে আছে। কারণটাও সঙ্গে সঙ্গে বোঝা গেল। ঘরের এককোণে একটা চারকোণা জায়গা ইঁট দিয়ে ঘিরে তার মাঝে আগুন জ্বেলে যজ্ঞ হচ্ছে। সেই আগুনের সামনে একজন দশাসই চেহারার লোক চোখ বন্ধ করে পদ্মাসনের ভঙ্গীতে বসে। তার পরণে লাল ধুতি। গলায় মোটা মোটা রুদ্রাক্ষের মালা। মাথায় জটা, মুখ ভর্ত্তি দাড়ি গোঁফের জঙ্গল। দেখেই কেমন তান্ত্রিক তান্ত্রিক লাগল। দু-একজন লোক মাঝে মাঝে আগুনে ঘি ঢালছে। কাঠ গুঁজে দিচ্ছে। এরা বোধ হয় এই তান্ত্রিকের সহকারী। আরও কয়েকজন ভদ্রলোক সেখানে বসে আছেন। এরা হয়ত এই বাড়িরই লোকজন।

ধোঁয়া ধোঁয়া ঘর। একটা মিষ্টি গন্ধ। খুব সম্ভবত ধূপের। ভয়ঙ্কর চেহারার এক কাপালিক বা তান্ত্রিক। সব মিলিয়ে এক অস্বাভাবিক পরিবেশ। আমি কী করব বুঝে উঠতে পারছিলাম না। চলে যাব না থাকব!

এমন সময় এক সুদর্শন ভদ্রলোক এগিয়ে এলেন আমাকে এই কিংকর্তব্যবিমূঢ় অবস্থা থেকে উদ্ধার করতে। বললেন, “আমার সাথে আসুন। আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি।” আমি বিনাবাক্যব্যয়ে ভদ্রলোককে অনুসরণ করে একতলার বসার ঘরে এলাম। ঘরে এখনও সেই টিমটিমে নীল আলোটা জ্বলছিল। ভদ্রলোক সেটাকে অফ্‌ করে টিউব জ্বাললেন, তারপর একটা সোফা দেখিয়ে আমাকে বললেন, “বসুন।” বসলাম। ভদ্রলোক আমার সামনের সোফাটার দখল নিয়ে বললেন, “আপনার নিশ্চয়ই খুব অদ্ভুত লাগছে সব কিছু, তাই না?” আমি একটা লম্বা দম নিয়ে বসলাম,  “দেখুন, আমি এখানে অফিসের কাজে এসেছিলাম। তখন সুস্থই ছিলাম। কিন্তু বাড়ি ফেরার সময় এত খারাপ লাগতে শুরু করল যেন মনে হচ্ছিল এক্ষুনি মরে যাব। তখনই আপনাদের বাড়ির দরজা খোলা পেয়ে ঢুকে পড়ি। কিন্তু এখানে এসে আপনাদের ভাবভঙ্গী দেখে মনে হল যেন আপনারা জানতেন যে আমি আসব। এটা কি খুব অস্বাভাবিক নয়?”

ভদ্রলোক একটু ইতস্তত করছেন, যেন বুঝতে পারছেন না কথাটা কোথা শুরু করে করবেন। অবশেষে বললেন, “আপনি পূর্বজন্মে বিশ্বাস করেন?”

“কী?” আমি অবাক হয়ে বললাম, “পূর্বজন্ম ?”

“হ্যাঁ! পূর্বজন্ম,” ভদ্রলোক এবার কথা খুঁজে পেলেন, “এই ঘটনা পূর্বজন্মের সঙ্গেই জড়িত। অন্তত গুরুদেব তো তাই-ই বলছেন।”

“আপনার গুরুদেব ?” আমি জিজ্ঞেস করলাম।

“যাকে দোতলার ঘরে করতে দেখলেন উনিই আমার গুরুদেব,” ভদ্রলোক বলতে থাকেন, “উনি বেনারসে থাকেন। খুব বড়ো তান্ত্রিক। চন্দনবাবা। বাবাই বললেন যজ্ঞটা করতে। না হলে এই বাড়ির যে অভিশাপ তা কাটবে না।”

অভিশাপ?  আমার মাথা গুলিয়ে যাচ্ছে। বললাম “আপনি দয়া করে আর হেঁয়ালি করবেন না। প্লিজ… সব খুলে বলুন।”

ভদ্রলোক মৃদু হেসে বললেন, “আপনার মনের অবস্থা আমি বুঝতে পারছি। আমি প্রথম থেকে আপনাকে সব বুঝিয়ে বলছি।”

ভদ্রলোক একটু চুপ করে থাকলেন। বুঝলাম উনি মনে মনে গুছিয়ে নিচ্ছেন কি বলবেন। অবশেষে সামান্য গলা ঝেড়ে নিয়ে উনি বলতে শুরু করলেন, “আমার নাম তুণীর হালদার। পেশায় পোস্টাল ক্লার্ক। আপাতত পার্কস্ট্রিট ব্রাঞ্চে আছি। এই বাড়িটা আমি কিনি প্রায় মাসতিনেক আগে! কেনার সময় বাড়িটার বদনাম শুনেছিলাম। কিন্তু বাড়িটা এমন জলের দরে পেয়ে গেলাম যে সে সব গুজবে আর কান দিইনি। কেনার পর বুঝলাম কী ভুলই না করেছি। এ বাড়িতে আর যাই হোক না কেন থাকা অসম্ভব। মাঝে মাঝে এঘর ওঘর থেকে চাপা কান্নার আওয়াজ আসে। কখনও মনে হয় কেউ বুঝি একদম আমার পেছনে দাঁড়িয়ে আছে। ঘাড় ঘোরালেই তাকে দেখতে পাব। অথচ ঘর ফাঁকা। এরপর এই বাড়ির আগের মালিকের কাছে গিয়ে জানতে পারি আসল ঘটনা। আজ থেকে প্রায় সত্তর আশি বছর আগে এই বাড়ি তৈরি করেন এক বৃদ্ধ ব্যবসায়ী। তাঁর দুই ছেলে ছিল একটু পাগলাটে। যাকে বলে মেন্টালি রিটার্ডেড। সব কিছু ঠিকঠাকই চলছিল। মুশকিলটা হল বৃদ্ধ মারা যাওয়ার পর। দেখা গেল উনি কোনও উইল করে যাননি। সুতরাং তাঁর বিপুল সম্পত্তি আর এই বাড়ি দুই ছেলের ভাগে সমানভাবে পড়ল। অদ্ভুতভাবে এর কিছুদিন পরেই সেই পাগল ছোটোভাই নিরুদ্দেশ হয়ে যায়। লোকে বলত সম্পত্তির লোভেই নাকি বড়োভাই ছোটোভাইকে গুমখুন করেছিল। কিন্তু ভাগ্যের পরিহাস দেখুন! সেই বড়োভাইও কয়েক মাসের মধ্যেই মারা যায়। তারপর থেকেই এই বাড়ি হাত বদল হতে থাকে, কিন্তু কেউ টিকতে পারে না এই বাড়িতে। আমিও পারতাম না যদি না আমার গুরুদেব ইতিমধ্যে বেনারস থেকে হঠাৎ এখানে আসতেন। গুরুদেব এই বাড়ির চৌকাঠে পা দিয়েই বললেন, “বেটা, এই বাড়ি কিনে তুই ভালো কাজ করিসনি। এই বাড়িতে দুটো দুঃখী আত্মার শাপ আছে। এই শাপ যতক্ষন না কাটবে, কেউ এ বাড়িতে থাকতে পারবে না।”

এই অবধি বলে তুণীরবাবু থামলেন। তারপর আবার বলতে শুরু করলেন, “দুটো দুঃখী আত্মা কারা বুঝতে পারলেন তো ?” একজন সেই পাগল ছোটোভাই যাকে সম্পত্তির লোভে খুন করা হয়েছিল আর দ্বিতীয়টি সেই বড়োভাই যে সম্পত্তি পেয়েও ভোগ করতে পারেনি বলে একরাশ হতাশা নিয়ে মারা গেছে। গুরুদেব বললেন, “সম্ভবত ঐ দুই ভাইয়েরই এখন পুনর্জন্ম হয়েছে। এখন কোনওভাবে যদি ওই দুই ভাইয়ের পুর্নজন্ম হওয়া শরীরকে এই বাড়িতে আনা যায় আর তারা যদি এই বাড়ির সদর দরজার চৌকাঠে হাত রেখে বলেন যে “আমি সব ক্ষমা করলাম” তবেই একমাত্র এই বাড়ির অভিশাপ কাটবে।”

আমি এতদূর অবধি  শুনে তুণীরবাবুকে থামিয়ে দিয়ে বললাম, “এ তো বেশ একটা অলৌকিক গল্প হয়ে গেল। শুনতেও মন্দ লাগে না। কিন্তু এর সাথে আমার কী সম্পর্ক তা তো বুঝতে পারলাম না।”

তুণীরবাবু পকেট থেকে একটা ফটো বের করে আমার হাতে দিয়ে বললেন, “এই ফটোটা দেখুন তো।” বহু পুরোনো হলদে হয়ে যাওয়া একটা সাদা কালো ছবি।

ছবিটা দেখে আমি চমকে উঠলাম নিজেকে চিনতে কোনও অসুবিধা হচ্ছে না। কিন্তু এটা আমার ছবি হতেই পারে না। আমি আজ অবধি চিরদিন বাঁদিকে সিঁথি করে চুল আঁচড়ে এসেছি, কখনও গোঁফও রাখিনি। আর এই ছবিতে আমার মাঝখানে সিঁথি, একটা সরু গোঁফও দেখা যাচ্ছে। অবাক হয়ে বললাম, “এ কার ছবি?” তুণীরবাবু ছবিটা আমার হাত থেকে নিয়ে বললেন, “আমি অনেক খোঁজ খবর নিয়ে ওই দুই ভাইয়ের এক দূরসম্পর্কের আত্মীয়ের সন্ধান পাই। তাঁর কাছ থেকে ঐ দুই ভাইয়ের দুটো ছবি জোগাড় করি। আপনি এখন যে ছবিটা দেখলেন সেটা ঐ পাগল ছোটোভাইয়ের ছবি। দেখলেন তো আপনার সঙ্গে কত মিল? এখন বুঝলেন তো কী করে আপনাকে আমরা দেখামাত্র চিনে ফেলেছিলাম?”

আমি কপালে হাত দিয়ে দেখলাম অতিরিক্ত ঘামছি। এখানে আর এক মিনিটও থাকতে ইচ্ছে করছে না। আমি উঠে দাঁড়িয়ে বললাম, “আমি আসি”। তুণীরবাবু বললেন, “আর বসবেন না? ঠিক আছে তাহলে শেষ উপকারটা করে দিয়ে যান। সদর দরজার চৌকাঠে হাত রেখে বলুন, “আমি সব ক্ষমা করলাম।”

আমি বললাম, “না, বলব না।”

তুণীর বাবু থতমত খেয়ে বললেন, “সে কী? বলবেন না মানে? জানেন, আজ আপনাকে আনার জন্যই এই যজ্ঞ করা হল! এই যজ্ঞ এত শক্তিশালী যে আপনি পৃথিবীর যে প্রান্তেই থাকুন, আসতে বাধ্য হতেন। আর এতদূর এসেও আপনি বলছেন এই সামান্য কাজটুকু করবেন না? আপনি এই কথাটা না বুঝলে আজকের পুরো আয়োজন ব্যর্থ হবে তা জানেন?”

আমি আর কিছু শুনলাম না। ঐ অদ্ভুত বাড়ির বসার ঘরের বাইরে বেরিয়ে এসে  দমদম ক্যান্টনমেন্ট রেল স্টেশনের দিকে দৌড় শুরু করলাম।

 বাড়ি ফিরলাম বিধ্বস্ত অবস্থায়। কাউকে কিছু বললাম না। তবে রাত্তিরে ঘুমও হল না। সারা রাত ধরে শুধু ভাবলাম আর ভাবলাম। আজ কি দল বেঁধে কিছু লোক আমায় বোকা বানাল? নাকি এই সবকিছুই সত্যি! আমি পূর্বজন্মে পাগল ছিলাম এবং সম্পত্তিলোভী বড়দার হাতে খুন হয়েছিলাম? সত্যিই কি পূর্বজন্ম বলে কিছু হয়?

রাত্রিবেলা ঘুমোতে দেরি হয়েছিল বলে সকালে উঠতে দেরি হয়ে গেল। সেদিন আমাকে শিয়ালদা যেতে হবে। তাড়াহুড়ো করে রেডি হয়ে ডাউন বনগাঁ লোকালে নিজেকে গুঁজে দিলাম।

ট্রেন তখন মধ্যমগ্রাম স্টেশনে দাঁড়িয়েছে। আমি এক হাতে ট্রেনের হাতল ধরেছি, অন্য হাতে ভারি ব্যাগ। আচমকা মনে হল কেউ আমার পকেটে হাত ঢুকিয়েছে। সর্বনাশ, বাঁ পকেটে মোবাইল আছে। আমি ট্রেনের হাতল ছেড়ে সঙ্গে সঙ্গে সেই হাতটাকে চেপে ধরলাম। ঐ সময়ই ট্রেন ঝাঁকুনি দিয়ে চলতে শুরু করল। এক সেকেণ্ডের জন্য আমি একটু টাল হারাতেই এক ঝাট্‌কায় আমার হাতটা ছাড়িয়ে আমার পাশে দাঁড়ানো ছেলেটা অদ্ভুত কায়দায় চলন্ত ট্রেন থেকে প্ল্যাটফর্মের প্রায় শেষ প্রান্তে নেমে গেল। আমি এক ঝলক ছেলেটার মুখ দেখেছি। বছর পঁচিশেক বয়স হবে। মুখে খোঁচা খোঁচা দাড়ি। ডান ভ্রু’র উপর লম্বা কাটা দাগ। পকেটে হাত দিয়ে দেখলাম মোবাইলটাই গেছে। এখন আর চেঁচামেচি করে লাভ নেই। সত্যিই সময়টা খারাপ যাচ্ছে আমার। কয়েকদিনের ছুটি নিয়ে কোথাও একটু হাওয়া বদল করে আসতে হবে।

বিকেলবেলা ঠিক করলাম আমি আবার ওই বাড়িতে যাব। আজই। এই আমার বরাবরের অভ্যেস। কোনও ঘটনার শেষ না দেখলে মনটা ঠিক শান্তি পায় না। আজও সারাদিন মনটা খচ্‌ খচ্‌ করল। সকালে তার উপর মোবাইলটাও চুরি হয়েছে। এরকমই নানারকম দ্বিধাদ্বন্দ্ব মনে পোষণ করে আমি গ্রিনপার্কের সেই বাড়ির সামনে পৌঁছলাম যখন তখন বাজে ঠিক আটটা দশ। একটু রাত হলেই পাড়ার চারপাশটা কেমন জানি নিস্তব্ধ হয়ে যায়। রাস্তাঘাটে আজও কোনও লোক নেই। তুণীরবাবু বাইরের বসার ঘরটায় বসেছিলেন। আমাকে দেখেই বললেন, “কাল আপনার সামান্য ছেলেমানুষীর জন্য কত বড়ো সর্বনাশ হল আপনি জানেন?” আমি কী উত্তর দেব! চুপ করে রইলাম।

তুণীরবাবু ক্রুদ্ধ গলায় বললেন, “এই যজ্ঞ দু’দিনের বেশি করা যাবে না। তাই গুরুদেব ঠিক করেছিলেন প্রথম দিন ছোটোভাইয়ের পূনর্জন্মপ্রাপ্ত আত্মাকে আনবেন আর পরদিন ঠিক একইভাবে বড়োভাইয়ের আত্মাকে আনবেন। কারণ একই দিনে  দু’জনকে একসাথে আনলে একজনের প্রাণহানির আশঙ্কা থাকে। অথচ আপনার জন্য সেই ভয়ঙ্কর ঝুঁকির কাজটাই করতে হচ্ছে।”

তুণীরবাবু চুপ করলে আমি বললাম, “কালকের আচরণের জন্য আমি খুবই লজ্জিত। আপনি অসুবিধায় পড়ুন তা আমি চাইনি। আপনি যা বলবেন তাই-ই করব। তারা আগে আপনি  কি আমাকে ঐ বড়োভাইয়ের ছবিটা দেখাতে পারেন?”

তুণীরবাবু পকেট থেকে কালকের মতই আর একটা ফটো বের করে আমার হাতে দিলেন, এই ফটোটা হাতে নিয়েও আমার অস্বস্তি শুরু হল। ছবির লোকটাকে আমি কোথায় যেন দেখেছি। আচমকা বাইরে একটা কোলাহল শুরু হল। তার কিছুক্ষণের মধ্যেই আমার হাতে ধরা ছবির মানুষটাই যেন বসার ঘরের খোলা দরজা দিয়ে ঢুকেই দরজার ছিটকিনিটা আটকে দিল। হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “কিছু লোক আমাকে তাড়া করেছে। পেলেই মেরে ফেলবে। আমাকে বাঁচান।”

তুনির বাবু উচ্ছসিত হয়ে বললেন, “আজকে যজ্ঞ সফল হল। বড়োভাই এসেছে।”

এতক্ষণে আমি লোকটার বাঁ ভ্রু’র উপরের কাটা দাগটা দেখতে পেয়েছি। এ সেই বনগাঁ লোকালের পকেটমার। যে আজই আমার মোবাইল ফোন হাতিয়েছে। আমি চিৎকার করে উঠলাম, “তুণীরবাবু! এই লোকটাকে ধরে রাখুন। এ একজন পকেটমার। আজই আমার  মোবাইল চুরি করেছে বনগাঁ লোকাল থেকে।”

আমার কথা শেষ হল না। লোকটা তীব্র বেগে দরজা  খুলে ছুটে বাইরে বেরিয়ে গেল। সঙ্গে সঙ্গে একদঙ্গল লোক ওর উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। চলতে লাগল অবিরাম কিল ঘুসি চড়। তুণীরবাবু হায় হায় করে উঠলেন। আমি আর দাঁড়ালাম না । কালকের মতই দৌড়ে ওখান থেকে পালিয়ে এলাম।

পরদিন সকালে খবরের কাগজের পাতায় একটা ছোটো খবর চোখ আটকাল। খবরটা এরকম-

গণপ্রহারে মৃত্যু

আপ বনগাঁ লোকালে এক মহিলার সোনার হার ছিনতাই করে পালাবার সময় এক ছিনতাইকারীকে দমদম ক্যান্টনমেন্ট স্টেশনে সংলগ্ন গ্রিনপার্ক অঞ্চলে উত্তেজিত জনতা ধরে ফেলে তারপর চলতে থাকে বেদম প্রহার পুলিশ ঘটনাস্থলে পৌঁছন’র আগেই ছিনতাইকারী যুবকের মৃত্যু হয়েছে

আমি কাগজটা রেখে দিয়ে প্যাড আর কলম টেনে নিলাম। রেজিগনেশন লেটার লিখব। এমন চাকরি আর করব না যেখানে এত ঘুরে বেড়াতে হয়। কে জানে আবার কোন্‌ সাধুবাবার খপ্পরে পড়ে যাব!

ছবিঃ লেখক

জয়ঢাকের গল্পঘর