অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল নতুন বাসায় আসার দিন কয়েকের মধ্যে। অথচ বারুইপুরের প্রান্তে নতুন এই বাসায় এসে সেই প্রথমদিন আরও মুষড়ে পড়েছিল বুবুন। ছোটো এক অ্যাসবেস্টসের ঘর। ভিজে স্যাঁতসেঁতে দেয়াল। আশপাশে দু’একটা বাড়িঘর। দিনদুপুরেও নিঝুম। তবে মায়ের কাছে ভাঙেনি কিছু। বরং মা যখন বলেছিলেন, “কি রে, ভালো নয় ঘরটা? দক্ষিণদিকে কেমন একটা জানলা রয়েছে বল? চমৎকার ফাঁকা ওদিকটা। মাঠের পরে মস্ত এক বাগান, ধানের খেতও দেখা যায়। টালিগঞ্জের বাসার চাইতে ঢের ভালো। তাই না?”
বুবুন ঘাড় নেড়েছিল। তবে সেটা ছিল মাকে সান্ত্বনা দেবার জন্য। হাজার হোক, বয়স তো কম হয়নি। বারোয় পড়ল এবার। বেশ জানে, বাবার স্মৃতি-ভরা ওই বাসা মা নিজেও ছাড়তে চাননি। চাননি বুবুনের কথা ভেবেও। সারাদিন পড়ে থাকতে হয় বিছানায়। মা কাজে বের হয়ে যাবার পর ফাঁকা ঘরে দিন কাটানো যে কী শক্ত! ঘুরে ফিরেই মাথায় ফিরে আসে শুধু বাবার কথা। টালিগঞ্জের পুরোনো বাসায় তবু খোঁজ নিতে প্রতিবেশীদের অনেকেই আসতেন। স্কুলের পুরোনো বন্ধুরাও আসত অনেকে। কত গল্প হত। এখানে এই নতুন জায়গায় কোথায় পাবে তাদের? আর কি কোনওদিন দেখা হবে ওদের সঙ্গে? গোড়ায় এইসব ভেবেই আরও মুষড়ে পড়েছিল ও। কিন্তু সে মাত্র দিন কয়েকের জন্য। বারুইপুরের এদিকটা এখনও বেশ ফাঁকা। বিছানায় শুয়ে জানলা দিয়ে অনেকদূর দেখা যায়। ধানখেত, গাছপালা। দিনভর আকাশে সাদা মেঘের খেলা। পাখির ডাক। টালিগঞ্জের বাসায় এসব ছিল না। মা ভুল বলেনি। কিন্তু সেসব নয়। বুবুন মজে রয়েছে অন্য একটা ব্যাপার নিয়ে।
ঘরের পশ্চিমদিকের দেয়ালে অনেকটা জায়গায় পুরোনো চুনকামের উপর বর্ষার জল চুঁইয়ে বেশ বড়ো একটা ছোপ তৈরি হয়েছে। তাকালেই চোখে পড়ে। দিনের মধ্যে কতবার যে তাই চোখ পড়ে যায় ওই দাগের উপর। সাদা দেয়ালের উপর ময়লা দাগটা গোড়ায় মোটেই দৃষ্টিনন্দন মনে হয়নি। কিন্তু দিন কয়েকের মধ্যে দেয়ালের সেই ময়লা ছোপের ভিতর অন্য কিছু যেন উঁকি মারতে লাগল। গত বর্ষার জলের দাগ। ইতিমধ্যে মিলিয়ে এসেছে অনেকটাই। কয়েক জায়গায় কিছু গাঢ়, পাকা শিল্পীর তুলির কাজ যেন। মামুলি পেনসিলেও বড়ো চমৎকার ছবি আঁকতে পারতেন বাবা। রেখার আলো ছায়ার এই ব্যাপারগুলো বাবার কাছেই শিখেছিল। এক প্রকাশন সংস্থায় কাজ করতেন। হাতে ভালো কোনও বই এলেই এনে পড়তে দিতেন বুবুনকে। অজন্তার উপর ইংরেজিতে লেখা ঢাউস একটা বই এনেছিলেন একবার। পাতাজোড়া নানা রঙের ছবির পর ছবি, তার উপর ছবি। সব জট পাকিয়ে রয়েছে যেন। অজন্তার কথা পড়েছে ও। তবু গোড়ায় সেই ছবি দেখে একটু হক্চকিয়ে গিয়েছিল। কিন্তু পরে বাবা যখন সব বুঝিয়ে দিয়েছিলেন, তখন আর তেমন মনে হয়নি। খুব দামি বই। বাবা পরের দিনই ফিরিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কিন্তু ছবিগুলো একটুও ভোলেনি ও। বুবুনের মনে হল, দেয়ালে ছোপের ভিতর যেন অমনই ছবি আঁকা রয়েছে। খুঁজে বের করে নেবার অপেক্ষা মাত্র। শুধু সাদা-কালোয় এই যা। কাজটা অবশ্য সহজ হয়নি। বাবা থাকলে ঠিক বুঝে নিতে পারত। কিন্তু হাল ছাড়েনি বুবুন। পরের দু’টো দিন ঠায় খুঁজে বেরিয়েছে। একসময় তো দেয়াল-জোড়া কোনও এক দেশের ম্যাপ বলে মনে হচ্ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে তুলির কাজগুলো চোখের সামনে আরও স্পষ্ট হতে শুরু করতে পালটে গেল সব। পরিষ্কার একটি মানুষের মুখ। প্রথমে মনে হল ছবিটা সেই বইতে দেখা বোধিসত্ত্ব পদ্মপাণি। সেই টানা দুই চোখ জুড়ে নিমীলিত অন্তর্ভেদী দৃষ্টি। গূঢ় ব্যাঞ্জনাময় ওষ্ঠপ্রান্ত। আজানুলম্বিত বাহু। মনের পটে আঁকা সেই ছবির সঙ্গে বুবুন যখন মেলাতে শুরু করেছে তখনই মনে হল, একদম ভুল। চোখের সামনে ছবিটা যেন পালটে যাচ্ছে ক্রমশ। বোধিসত্ত্ব নয়, এ ছবি অন্য কারও। চোখের দৃষ্টি, ওষ্ঠপ্রান্ত একেবারেই অন্য রকম। হাঁ করে তাকিয়ে ছিল। অদ্ভুত ব্যাপারটা ঘটল ওই সময়। দেওয়াল-জোড়া সেই ছবির দু’চোখে হঠাৎ যেন পলক পড়ল। তারপরেই নড়ে উঠল ঠোঁট।
“বুবুন, চিনতে পারছ আমাকে?”
“তুমি, তুমি তো ফ্যান্টম!” দারুণ উত্তেজনায় দুর্বল শরীরটা তুলে উঠে বসল ও।
“তবে এখন কিন্তু শুধু তোমার বন্ধু।” মৃদু হাসির সঙ্গে উত্তর এল ওদিক থেকে।
“সত্যি!” খুশিতে হাততালি দিয়ে উঠল বুবুন, “তোমার গল্প কত পড়েছি। বাজারে নতুন বই এলেই বাবা নিয়ে আসতেন। মজা করে দু’জন মিলে পড়তাম। কতদিন ভেবেছি, বড়ো হয়ে ঠিক তোমার মতো হব। তারপর হারিয়ে গেল সব!” গলার স্বর হঠাৎ যেন বুজে এল বুবুনের।
“কেন বুবুন?”
“আমি, আমি যে বড্ড একা ফ্যান্টম। একটুও ভালো লাগে না।”
“আমি তো রয়েছি! কে বলে তুমি একা? সেই প্রথমদিন থেকেই রয়েছি তোমার সঙ্গে। চিনতেই পারনি। আর অমন মা ক’জনের হয় বল তো?”
মায়ের কথায় হঠাৎ চোখ ফেটে জল এসে গেল বুবুনের। আসলে মা’র জন্য বড়ো কষ্ট হয় ওর। বছর তিনেক আগে বাবার হঠাৎ ওই মৃত্যুর পর সেই হাসিখুশি মানুষটা পালটে গেছে কেমন। বুবুন বেশ জানে, মা’র এই পালটে যাবার পিছনে শুধু বাবার মৃত্যুই নয়, ও নিজেও দায়ী। সংসার সামলাতে এখন ছোটো এক মার্চেন্ট অফিসে কাজ করতে হয়। সামান্য মাইনে। বুবুনের চিকিৎসা, সংসারের খরচ সামাল দিতে হিমশিম অবস্থা। খরচ বাঁচাতে তাই টালিগঞ্জের বাসা ছাড়তে হয়েছে। ঝরঝর করে কেঁদে ফেলে বলল, “আমার মায়ের খুব কষ্ট ফ্যান্টম।”
“সে কী বুবুন! তুমি না ফ্যান্টম হতে চেয়েছিলে? আর কাঁদছ এখন?”
“সে আর হবার নয় ফ্যান্টম।” চোখ মুছে বুবুন বলল, “মা বলেনি আমাকে। কিন্তু আমি সব জানি। ডাক্তারবাবু বলেছেন, আমার এ অসুখ সারবার নয়।”
“কিন্তু…” কঠিন দুই চোয়াল আরও শক্ত হয়ে উঠল মানুষটির। দৃঢ় গলায় বলল, “ফ্যান্টমের বন্ধুকে তো এত সহজে হার মানলে চলবে না।”
মানুষটির সেই মুখের দিকে তাকিয়ে উত্তর জোগাল না বুবুনের মুখে। লেখাপড়া, খেলাধুলো দুয়েতেই স্কুলের সেরা ছিল ও। এমন হয়ে যাবে ভাবতেও পারেনি। হঠাৎ বাবার মৃত্যু। তারপরেই সামান্য জ্বরে ক্রমশ কেমন ভেঙে পড়তে লাগল শরীর। ছাড়তে হল স্কুল। হঠাৎ বলল, “ফ্যান্টম, তোমার অসাধ্য কিছু নেই। আমাকে হেল্প করবে একটু?”
কিন্তু ওদিক থেকে উত্তর আসার আগেই ক্যাঁচ করে শব্দ হল। দরজা ঠেলে মা ঘরে ঢুকলেন। চমকে উঠে দেয়াল থেকে চোখ সরাতে বুবুন টের পেল ফ্যান্টমের সঙ্গে কথায় কথায় কখন বিকেল গড়িয়ে সন্ধে নেমে এসেছে টেরও পায়নি। ততক্ষণে মা ঘরে ঢুকে আলো জ্বেলে পাশে এসে বসেছেন। আঁচলে বুবুনের মুখটা মুছিয়ে দিয়ে বললেন, “অন্ধকারে একা কথা বলছিলি বাবা? দরজার ওধার থেকে শুনতে পেলাম যেন।”
“ওই এমনি।” সামান্য অপ্রস্তুত হয়ে বুবুন বলল।
মা বললেন, “এখানে সারাদিন একা থাকিস। ম্যানেজারকে আজও দিন কয়েক ছুটির জন্য বলেছিলাম। রাজি হলেন না।”
মায়ের কথায় বুবুন আড়চোখে একবার তাকাল সামনে দেয়ালের দিকে। ছোপের সেই দাগের মাঝে ফ্যান্টমকে চেনা যাচ্ছে না আর। হঠাৎ বলল, “আমার জন্য খুব ভাবনা হয়, তাই না মা?”
এমন আগেও বলেছে বুবুন। কথা শেষ হবার আগেই কেঁদে ফেলেছে ঝরঝর করে। সামান্য অবাক হয়ে প্রতিমাদেবী স্থির চোখে তাকিয়ে রইলেন ছেলের দিকে। এমনভাবে অনেকদিন কথা বলেনি বুবুন। আর মাকে ওইভাবে তাকিয়ে থাকতে দেখে বুবুন বলল, “আমি এবার ঠিক ভালো হয়ে যাব মা। তুমি ভেব না একদম।”
পরের দিন একটা মজার ব্যাপার ঘটে গেল। আজ মা কাজে বেরিয়ে যাবার পরে অনেক চেষ্টা করেও দেওয়ালের সেই দাগের মাঝে ফ্যান্টমকে খুঁজে পায়নি বুবুন। দুপুরে বিছানায় তাই একটা বই পড়ছিল। হঠাৎ নির্জন ঘরে জানলার ধারে মৃদু চিড়িক শব্দে ঘাড় ফিরিয়ে দেখে সেই চড়াই পাখিটা পাশে শেলফের উপর এসে বসেছে। গত দিন কয়েক ধরে এই সময় রোজই আসে পাখিটা। শেলফে ছোটো এক কাপে বুবুনের জন্য গোটা কয়েক ছোলা আর বাদাম ভিজিয়ে রাখেন মা। কী করে টের পেয়ে গেছে পাখিটা। রোজ ঠিক এই সময় আসে। তারপর কাপের কানায় জুত হয়ে বসে একটা ছোলা নয়তো বাদাম ঠোঁটে নিয়ে উড়ে যায় জানলা দিয়ে। সারাদিনে ওই একবারই আসে পাখিটা। ও ঘাড় ফেরাতে পাখিটা লেজ দুলিয়ে ফের চিড়িক করে ডেকে উঠল আবার। পাখিটা আগে কখনও ডাকাডাকি করেনি। আজ অন্যরকম হবার কারণ বুঝতে বিলম্ব হল না। মা আজ কাপটা ছোটো এক পিচবোর্ডের টুকরো দিয়ে ঢাকা দিয়ে গেছেন। ঘরে ঢুকে ব্যাপারটা বুঝেই ডাকাডাকি শুরু করেছে পাখিটা। মরিয়া হয়ে কাপটার উপর লাফিয়েও উঠল দু’বার। কিন্তু নিরাশ হয়ে সরে বসল আবার। মনটা খারাপ হয়ে গেল বুবুনের। একা বিছানা থেকে উঠতে ডাক্তারের মানা। বের হবার আগে তাই দরকারি সবকিছুই মা ওর বিছানার পাশে মজুত রেখে যান। একবার ভাবল উঠে গিয়ে সরিয়ে দিয়ে আসে ঢাকনাটা। শরীরটা আজ বেশ ভালো মনে হচ্ছে। মা টেরও পাবে না। মনস্থির করে উঠতে যাবে, মানুষের আওয়াজ পেয়ে মুহূর্তে চঞ্চল হয়ে উঠল পাখিটা। সন্দেহ নেই, কাছে গেলেই ভয় পেয়ে উড়ে পালাবে। মনটা ছটফট করে উঠল। ইস, কত আশা করেই না এসেছে বেচারা। কাপের ঢাকনাটা যদি কোনওভাবে পড়ে যায়, বেশ হয় তাহলে। হালকা পিচবোর্ডের টুকরো, জোরে একটু হাওয়াও যদি বইত! আপন মনে এইসবই ভাবছিল বুবুন। হঠাৎ এক ব্যাপার ঘটল। পবনদেব যেন শুনতে পেলেন ওর মনের কথা। মৃদু হাওয়ায় ঢাকনাটা হঠাৎ অল্প শব্দে পড়ে গেল নীচে। হঠাৎ সেই শব্দে গোড়ায় অল্প ঘাবড়ে গেলেও ব্যাপার বুঝে খুশিতে নেচে উঠল চড়াইটা। চিড়িক চিড়িক শব্দে বার দুই নাচানাচি করে শেষে উড়ে বসল কাপটার উপর। তারপর প্রতিদিনের মতো দেখেশুনে একটা ভিজে ছোলা ঠোঁটে তুলে ফুড়ুৎ করে উড়ে গেল জানলা দিয়ে।
সামান্য ব্যাপার। তবু অনেকদিন পর খুশিতে বুকটা ভরে গেল বুবুনের। হাততালি দিয়ে উঠল আনন্দে। হঠাৎ মনে হল, শরীরটা এক লহমায় অনেকটাই ভালো হয়ে গেছে যেন। অনেক ঝরঝরে। সন্ধেয় মা ফিরলেই বলবে ব্যাপারটা, ভুলেও যেন কাপটা আর ঢাকা না দেয়। হাতের বইটা বন্ধ করে ভাবছিল বুবুন। হঠাৎ নির্জন ঘর গমগম করে উঠল।
“কিছু বুঝতে পারলে বুবুন?”
“কী?” চমকে উঠে চোখ ফেরাতেই যথাস্থানে ফ্যান্টমকে দেখতে পেল ও। মুখে মৃদু হাসি।
“বাহ্, ওই যে কাপের ঢাকনাটা হঠাৎ পড়ে গেল।”
“ক-কেন?” ফ্যান্টমের হঠাৎ ওই কথায় অল্প থতমত খেয়ে বুবুন বলল।
“সবাই বলবে, বাতাসে উড়ে পড়েছে কাপের ঢাকনাটা। কিন্তু আমি জানি, তুমি মনেপ্রাণে চাইছিলে তাই ঘটল ব্যাপারটা।”
“যাহ্, তাই হয় নাকি!”
“হয় বন্ধু।” মৃদু অথচ দৃঢ় গলায় উত্তর এল, “আমি ফ্যান্টম, মিথ্যে বলি না। বুবুন, সমুদ্রে ঈল নামে এক জাতের মাছ আছে। নাম শুনেছ?”
সেবার সবাই মিলে দিঘায় বেড়াতে গিয়েছিল ওরা। সকালে বীচে বেড়াতে গিয়ে দেখে হাত তিনেক লম্বা একটা বান জাতের মাছ বালিতে পড়ে ছটফট করছে। জেলেদের জালে ধরা পড়েছে। এ মাছ খায় না কেউ। তাই ফেলে দিয়ে গেছে। দেখে বাবা সাবধানে সেটাকে তুলে ছুঁড়ে দিয়েছিলেন জলে। সেদিন বাবার কাছেই শুনেছিল, ওটা নাকি এক জাতের ঈল মাছ। বুবুন বলল সেই কথা।
“খুবই সাধারণ মাছ, তাই না? দক্ষিণ আমেরিকার সমুদ্রে আর এক জাতের ঈল মাছের দেখা মেলে। প্রায় ছয় ফুটের মতো লম্বা সেই ঈলের মুখের গড়ন অবশ্য কতকটা চৌকোনা। এদের নাম ইলেকট্রিক ঈল। নামটা অকারণে নয়। নিতান্তই নিরীহ প্রকৃতির সেই মাছ ইচ্ছে করলেই নিমেষে শরীরের ভিতর এক অ্যামপিয়ার ক্ষমতা সম্পন্ন পাঁচশো ভোল্ট পর্যন্ত বিদ্যুৎ তৈরি করতে পারে। লম্বা দেহটা বাঁকিয়ে শত্রুর শরীরে মাথা আর লেজটা তখন সামান্য ছুঁইয়ে দেয়। আক্রান্ত প্রাণীটা প্রচন্ড বৈদ্যুতিক শক খেয়ে মুহূর্তে নেতিয়ে পড়ে। এমনকি, মারাও যায় কখনও। অবশ্য ঈল মাছের দেহের কোষে এজন্য কিছু অতিরিক্ত ব্যবস্থা রয়েছে। তবে ফ্যান্টম কিন্তু তোমার মতোই মানুষ। সবকিছুই তাকে অর্জন করতে হয়েছে।”
কমিকসের বইতে সেই গল্প পড়েছে বুবুন। দস্যুদের হাতে নিহত বাবার খুলি ছুঁয়ে একদিন একটা মানুষ একটু একটু করে তৈরি করেছিলেন নিজেকে। হয়েছিলেন মুখোশধারী চলমান অশরীরী। দস্যু আর দুর্বৃত্তদের মূর্তিমান আতঙ্ক। তিনিই প্রথম ফ্যান্টম।
নির্জনে দু’জনে তারপর কথা হয়েছিল অনেক। ট্রেনের গোলমালে মায়ের সেদিন দেরি হয়েছিল ফিরতে। উদ্বিগ্ন মানুষটি ঘরে ফিরে প্রায় চমকে গিয়েছিলেন। বুবুনকে এমন হাসিখুশি অনেকদিন তিনি দেখেননি।
দিন কয়েক পরের কথা। সেদিন প্রায় বিকেল হতে চলেছে, অথচ ফ্যান্টমের দেখা নেই। আসলে দেয়ালে সেই জলের দাগ ইতিমধ্যে অনেকটাই ফিকে হয়ে এসেছে। সেই আবছা দাগের মাঝে ফ্যান্টমকে এখন খুঁজে পাওয়াই ভার। মানুষটির আসাও এখন কিছু অনিয়মিত। তবে সেজন্য উদ্বিগ্ন হয়নি বুবুন। বেশ জানে, সময় হলেই ঠিক আসবেন তিনি। অপেক্ষা করছিল। সেই সময়েই এক দঙ্গল ওরই সমবয়সী ছেলে হাজির হল দক্ষিণে জানলার পাশে মাঠে। হাতে পুরনো একটা ফুটবল। দু’দলে ভাগ হয়ে একটু পরেই শুরু হয়ে গেল খেলা। আজকাল সারাদিন আর বিছানায় থাকতে হয় না। জানলা দিয়ে খানিক তাকিয়ে থাকার পর একসময় ওই প্রথম পায়ে পায়ে ঘর থেকে বের হয়ে বাড়ির পিছনে মাঠের ধারে এসে দাঁড়াল। ঠিক ওই সময়েই বলটা হঠাৎ উড়ে এল ওর দিকে। নিজের অজান্তেই সামান্য লাফিয়ে বলটা ধরে ফেলল ও।
“আরে, দুর্দান্ত গ্রিপিং তো তোমার! নতুন এসেছ বুঝি?” সমস্বরে প্রশ্ন করল কয়েকজন।
আলতো করে মাথা নাড়ল বুবুন। তারপর ছোট্ট ভলিতে বলটা পাঠিয়ে দিল মাঠে।
ওপক্ষ কিন্তু থামল না। লম্বা মজবুত চেহারার একজন এগিয়ে এসে বলল, “নিয়মিত খেল নিশ্চয়? গোলকীপার?”
“না।” মাথা ঝাঁকিয়ে বুবুন বলল, “স্কুলে ফরোয়ার্ডে খেলতাম।”
“আমাদের কিন্তু ভাই ভালো গোলকীপার নেই। খেলবে? সামনেই শিল্ডের খেলা। খুব ভালো হয় তাহলে।”
একমুহূর্ত চিন্তা করল বুবুন। মাত্র ক’দিনে শরীর অনেকটাই যেন ভালো হয়ে গেছে। গোলকিপারে খেলতে পরিশ্রমও কিছু কম। ভালো হত ফ্যান্টমের সঙ্গে একটু পরামর্শ করতে পারলে। কিন্তু সে তো আর এক্ষুনি হবার নয়। অল্প মাথা নেড়ে নেমে পড়ল মাঠে।
বুবুনের এই গল্প এখানেই শেষ হতে পারত। তবুও বলতে হচ্ছে আর একটু। সে আরও কয়েক মাস পরের কথা। বুবুনকে নিয়ে মা সেদিন ডাঃ রায়ের চেম্বারের এসেছিলেন। নামী সাইকিয়াট্রিস্ট। শুরু থেকেই দেখছেন। চেম্বারে যথেষ্টই ভিড়। তবু সেদিন তিনি অনেকটা সময় নিয়ে পরীক্ষা করলেন বুবুনকে। তারপর তাকে বাইরে বসার ঘরে পাঠিয়ে প্রতিমাদেবীকে বললেন, “ম্যাডাম, আপনাকে আগেও বলেছি, ভিতরে চাপা কষ্ট, হতাশা, মানসিক অবসাদ থেকে কখনও নার্ভ সিস্টেমে বড়োসড়ো ক্ষতি হয়ে যায়। তাই থেকে চেপে বসে আরও নানা রোগ। সেরে ওঠা সহজ হয় না সবসময়। কিন্তু বুবুন অবাক করে দিয়েছে আমাকে। এই অল্প সময়ের মধ্যে এতটা উন্নতি আমি কখনও দেখিনি। সন্দেহ নেই, শুধু ওষুধে নয়, নতুন জায়গায় আসার কারণেই ঘটেছে এটা।”
ব্যাপারটা নিয়ে প্রতিমাদেবী নিজেও ভেবেছেন। ছেলেকে জিজ্ঞাসা করেও কোনও উত্তর পাননি। সেই কথাই বললেন।
ডাঃ রায় প্রেসক্রিপসনটা প্রতিমাদেবীর দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “আপাতত কোনও ওষুধের আর দরকার নেই। মাসখানেক বাদে একবার চেক করিয়ে যাবেন।”
ডাঃ রায়ের চেম্বার থেকে বের হয়ে যখন ওরা শিয়ালদহ থেকে ট্রেনে উঠল রাত তখন প্রায় ন’টা। ছুটির দিন, বারুইপুর লোকাল আজ বেশ ফাঁকাই বলা চলে। সোনারপুর এসে খালি হয়ে গেল আরও। জানলার ধারে মায়ের পাশে বসে খানিক আগের কথা ভাবছিল বুবুন। ডাক্তারবাবু আজ নানাভাবে জানতে চেষ্টা করেছিলেন ব্যাপারটা। কিন্তু ফ্যান্টমের কথা ফাঁস করেনি ও। বলেনি মাকেও। বললে বিশ্বাসও করবে না কেউ। তার উপর ইদানিং দেয়ালের সেই দাগ আরও আবছা হয়ে এসেছে। কালেভদ্রে ছাড়া মানুষটিকে দেখাও যায় না। তবে সেজন্য আপশোস হয় না এখন। মায়ের পাশে বসে সেই কথাই ভাবছিল বুবুন। হঠাৎ ওদিকের সিটে চাপা আর্তনাদে চোখ তুলে তাকাল। সোনারপুর থেকে অল্প আগে ট্রেন ছেড়েছে। শেষ মুহূর্তে জনাকয়েক যাত্রীর একটা দল ট্রেনে উঠে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে অনুচ্চ স্বরে নিজেদের মধ্যে কথা বলছিল। তাদেরই জনাচারেক এসেছে ভিতরে। হাতে খোলা ভোজালি উঁচিয়ে সিটের ওধারে বসা এক ভদ্রলোককে ঘিরে ধরেছে। ভীত মানুষটি হাতের অ্যাটাচিটা চেপে ধরেছেন বুকের সঙ্গে।
“যা আছে বের করে দিন বাবু। নইলে জানে মেরে দেব। ভ্যানতাড়া করার সময় নেই একদম।” হাতের ভোজালিটা নাকের ডগায় ঠেকিয়ে গর্জে উঠল একজন।
ততক্ষণে দলের আরও কয়েকজন ওদিকে একই কায়দায় ঘিরে ধরেছে আর একজনকে। বুবুন চারপাশে চোখ ঘোরাল। কামরা অনেকটা ফাঁকা হলেও যারা আছে তাদের সংখ্যা বদমায়েশ লোকগুলোর তুলনায় অনেক বেশি। তবু কেমন যেন সিটিয়ে রয়েছে সবাই। ওর পাশের ভদ্রলোক, বেশ লম্বাচওড়া শরীর, দু’চোখে আতঙ্কের ছায়া। কুলকুলিয়ে ঘামতে শুরু করেছেন। পাশে মাও ব্যাতিক্রম নয়। ওকে ওইভাবে চারপাশে তাকাতে দেখে ভীষণ ঘাবড়ে গিয়ে টেনে নিলেন বুকের ভিতর।
মাথার ভিতর হঠাৎ একটা ঝড় টের পাচ্ছিল বুবুন। এমন আগে কখনও হয়নি। ক্রমশ সেই ঝড়টা যেন মাথা থেকে নেমে আসছে সারাশরীরে। কেমন জ্বালা করছে ভিতরটা। হঠাৎ মায়ের হাত ছাড়িয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বলল, “অ্যাই, বন্ধ করুন এসব।”
এমন হবে সম্ভবত ভাবতে পারেনি অন্যপক্ষ। মুহূর্তে সবার চোখ ফিরল ওর দিকে। তারপর প্রতিবাদীর দিকে নজর পড়তে দাঁত বের করে হেসে উঠল কয়েকজন। একজন বলল, “খুব হয়েছে খোকা। এবার বসে পড়ো।”
“বাহ্! বেশ কথা! আমি বসে থাকব আর তোমরা এসব করে যাবে!” কিছুমাত্র না দমে বুবুন বলল।
ওদিকে লম্বাচওড়া ষন্ডা চেহারার একজন মুখভর্তি পান চিবোতে চিবোতে নজর রাখছিল চারপাশে। বুঝতে অসুবিধা হয় না, দলের মূল পান্ডা সে-ই। বুবুনের কথায় তার চোখদু’টো হঠাৎ জ্বলে উঠল। দাঁত কড়মড় করে বলল, “দাঁড়িয়ে দেখছিস কী! ছোঁড়াটাকে ছুঁড়ে ফেলে দে বাইরে। সুভাষগ্রামে ঢোকার আগেই নেমে পড়তে হবে। সময় নেই।”
আতঙ্কে প্রতিমাদেবীর শরীর তখন হিম হয়ে আসছিল। বুবুন এমন করবে ভাবতেই পারেনি। কী করবেন বুঝে উঠতে পারছিলেন না। হঠাৎ লোকটার ওই কথায় যেন সম্বিৎ ফিরে পেলেন। বুবুনের হাত ধরে বললেন, “বুবুন, থাম বাবা। পাগলামি করিসনে।”
কিন্তু বুবুন যেন শুনতেই পেল না সে কথা। আসলে ওর শরীরের ভিতরে তখন তোলপাড় শুরু হয়ে গেছে। জ্বলে যাচ্ছে ভিতরটা। নাকে সেই গরম নিঃশ্বাস। সর্দার লোকটার ওই কথায় মুহূর্তে যেন ফেটে পড়ল সেটা। মায়ের হাত ছাড়িয়ে এগিয়ে গেল লোকগুলোর দিকে। অদ্ভুত ঠান্ডা গলায় বলল, “সে হবার নয় কাকু। তিন বছর আগে আমার বাবাকে এই ট্রেনের কামরা থেকেই ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিলে তোমরা। আজ তোমাদের খোঁজ যখন পেয়েছি, শাস্তি পেতেই হবে।”
বুবুনের কথা হজম করা সহজ ছিল না ওপক্ষের। ও এগিয়ে যেতেই একজন ওকে লক্ষ্য করে জোরে হাত চালাল। কিন্তু ফল হল উলটো। বুবুনের শরীর স্পর্শ করতেই প্রায় স্প্রিংয়ের মতো ছিটকে উঠল তার হাত। অস্ফুট আর্তনাদে দু’পা পিছিয়ে গিয়ে তাকিয়ে রইল হাঁ করে।
“কী হল রে গুলটে?” অধৈর্য সর্দার লোকটা ঝাঁজিয়ে উঠল ওধার থেকে।
“ছোকরা, ছোকরার শরীরে কারেন্ট গুরু।” ঢোঁক গিলে গুলটে বলল, “শক মারছে!”
“ইয়ার্কির জায়গা পাসনি?” খেঁকিয়ে উঠল সর্দার লোকটা।
“ইয়ার্কি নয় কাকু। তোমরা শুধু বাবাকেই খুন করনি। গত তিন-তিনটে বছর কেড়ে নিয়েছ আমার জীবন থেকে। সহজে ছাড়া পাবে না আজ।”
“থাম ছোঁড়া। অনেক হয়েছে।” প্রায় বুনো শুয়োরের মতো লোকটা ছুটে এল ওর দিকে।
লোকটা কাছে আসতেই বুবুন তড়িৎগতিতে দুই হাত বাড়িয়ে দিল। বুবুনের হাত তার শরীর স্পর্শ করতেই অস্ফুট আর্তনাদে অত বড়ো চেহারার মানুষটা ছিটকে পড়ল কয়েক হাত দূরে। চরম বিস্ময়ে লোকটা এরপর ওর দিকে তাকিয়ে রইল কয়েক সেকেন্ড। তারপর দাঁত কড়মড় করে উঠে দাঁড়িয়েই পকেটে হাত ঢোকাল। দেখে আর দেরি করল না বুবুন। মুহূর্তে ঝাঁপিয়ে পড়ল তার উপর।
“আঁ-আঁ-আঁ!”
গগনবিদারী আর্তনাদে লোকটা ফের ছিটকে উঠে হুমড়ি খেয়ে পড়ল খানিক দূরে প্রায় দরজার কাছে। দেশি একটা পিস্তল ছিটকে পড়ল হাত থেকে। অস্ত্রটার দিকে একপলক তাকিয়ে বুবুন ফের এগিয়ে গেল তার দিকে। লোকটা তখনও হুমড়ি খেয়ে পড়েছিল সেই ভাবেই। বুবুনকে এগিয়ে আসতে দেখেই আঁতকে উঠে চলন্ত ট্রেন থেকে খোলা দরজা দিয়ে নিমেষে লাফ দিল। বাইরে অন্ধকারের বুক চিরে অস্ফুট একটুকরো আর্তনাদ শুধু ভেসে এল ভিতরে।
দলের বাকিদের জারিজুরি শেষ হতে তারপর আর সময় লাগেনি। তবে সর্দারের মতো তারা আর ট্রেন থেকে লাফিয়ে প্রাণটা দেয়নি। হাত তুলে সারেন্ডার করেছিল তখনই।
খবরটা পরের দিনই বড়ো করে বের হয়েছিল কাগজে। ‘এক কিশোরের তৎপরতায় চলন্ত ট্রেনের কামরায় ডাকাতি করার সময় ধরা পড়েছে একদল দুষ্কৃতি।’ তবে সবটুকু নয়। আসলে অদ্ভুত ব্যাপারটা নিয়ে তেমন উচ্চবাচ্য হয়নি। এক কিশোরের দেহে উঁচু ভোল্টেজের বিদ্যুৎ, এ কি বিশ্বাস করার মতো ব্যাপার! প্রত্যক্ষদর্শী যারা প্রসঙ্গটা তুলেছিল, স্বভাবতই তাদের কথা বিশ্বাস করেনি কেউ। বিশেষ করে বুবুন নিজে সে প্রসঙ্গ এড়িয়ে গেছে বরাবর।
ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য