অবনিচন্দ্র ঢ্যাং ক্লাসে ঢুকতেই ছাত্র সমুদয় সমস্বরে চেঁচিয়ে উঠল, “স্যার ব্যাঙ! ব্যাঙ!”
চমকে উঠলেন অবনিবাবু। সত্যিই তো! সারা ক্লাসময় পিল পিল করছে ব্যাঙ। আর যেহেতু তার পদবির সাথে ব্যাঙ ভীষণ সুন্দরভাবে মিলে যায় তাই ছেলেগুলোও যেন এই শব্দ উচ্চারণে একটা বাড়তি আনন্দ পায়। ঠিক এই কারণে অবনিবাবু কখনও ব্যাঙ বলেন না। একটু উশকানি পেলেই চারিপাশ থেকে তখন এত ছন্দমেলান কবির আবির্ভাব হয়ে যায় যে বলার নয়। তাই তিনি ভেক শব্দটা ব্যবহার করেন। তা সে ব্যাঙই হোক আর ভেকই হোক, তারা তখন সারা ক্লাসময় অবাধে বিচরণ করে বেড়াচ্ছে।
তবে কি আজ ওদের প্র্যাকটিকাল পরীক্ষা নেবার কথা ছিল! কপালে চিন্তার ভাঁজ পরল অবনিবাবুর। কিন্তু চিন্তা-ভাবনার বিশেষ অবকাশ পেলেন না তিনি। একটা ব্যাঙ খপাৎ করে তাঁর জুতোর ওপর লাফিয়ে এল এবং অনায়াসে প্যান্টের পা বেয়ে অদৃশ্য হল। ব্যাঙবাবাজি পা বেয়ে চার ইঞ্চি উঠছে তো দু ইঞ্চি নামছে। পুরোদস্তুর সেই বাঁদরের অঙ্কের মত। এদিকে অবনিবাবুর সকাতর অনুনয়, চরম অস্বস্তি থেকে রক্ষা পাবার প্রবল চেষ্টায় লম্ফঝম্প দেখে ক্লাসে রীতিমত হাসির রোল উঠেছে।
ইতিমধ্যে ব্যাঙের হাটটাও ভালই জমে উঠেছে। সারা ক্লাসময় তারা লাফালাফি দাপাদাপি করে বেড়াচ্ছে। এ ওর গায়ে ব্যাঙ ছুঁড়ছে। কোনও ছাত্র আঁৎকে উঠছে। আবার কেউ হাসছে। সেই সুযোগে ব্যাঙবাহিনী কখনও কারো ব্যাগে ঢুকছে কখনও পেনসিল বাক্সে। আবার কখনও জলের বোতলের দিকে ছুটছে।
অবনিবাবু কোনওমতে সেই প্যান্ট-মন্ডুক থেকে নিজেকে রক্ষা করে সদর্পে সরোষে সারা ক্লাসের দিকে তার রক্তচক্ষু নিক্ষেপ করলেন এবং জানতে চাইলেন এ হেন চক্রান্তের কারন কী?
ক্লাসে সবাই সরল চাহনিতে এ ওর দিকে তাকাতে লাগল।অতঃপর ক্লাস ক্যাপ্টেন সৌরভই মুখ খুলল, “স্যার আপনিই তো ষোলটা ভেক আনতে বলেছিলেন।”
অবনিবাবু যেন আকাশ থেকে পড়লেন। নিজের কানকে বিশ্বাস করতে পারছেন না, “আমি বলেছিলাম! ষো—লো—টা! কাকে বলেছিলাম? তোমাকে? কখন বলেছিলাম? অ্যাঁ?”
“স্যার ক্লাস টেন-এ র শেখর চৌধুরী বলল যে আপনি বলে পাঠিয়েছেন ষোলটা ভেক আনতে।”
“তাজ্জব ব্যাপার! আমি তো টেন-এ এর প্র্যাকটিকাল পরীক্ষার কথা ভেবে –”
কথাটা আর শেষ করলেন না অবনিবাবু। ভুরুটাকে কুঁচকে রইলেন। ফের চিন্তার ভাঁজ পড়ল কপালে। কী ব্যাপার কে জানে! ক্লাস শেষ হলে একবার এ সেকশানে ঢুঁ মেরে যাবেন।
কিন্তু একটু পরেই ব্যাঙেদের শ্রুতিমধুর কোরাসের ঠ্যালায় ক্লাস নেওয়ার দফা রফা। পিরিয়ড শেষ হবার আগেই রণে ভঙ্গ দিয়ে এ সেকশানে গেলেন অবনিবাবু। শেখর চৌধুরীকে তলব করলেন এবং কৈফিয়ত চাইলেন এ হেন কথা বলার জন্য। সরলমতি শেখর জানাল, “হ্যাঁ স্যার আমাকে রামশরণ তো সেই কথাই বলল। অবাক হলেন অবনিবাবু, “এর মধ্যে রামশরণ এল কোত্থেকে? পারিসও বটে তোরা! ও বোঝেটা কি? এখন কী ঝামেলায় যে আমি পড়লাম! আমাকে তো এত বছর দেখছিস।এরকম উদ্ভট আবদার কখনও করেছি? আমাকে একবার জিজ্ঞেস করারও প্রয়োজন মনে করলি না?”
“না মানে স্যার আপনি তো ছিলেন না…”
“এখন হেডস্যারের কানে গেলে কী হবে বল দেখিনি?”
বহ্নিশিখার মত এ খবর তখন সারা স্কুলে ছড়িয়ে পড়েছে। খোদ হেডস্যার উঠে এসেছেন তিনতলায়। ক্লাস টেনের এ, বি, সি , ডি চারটে সেকশনই পরপর। উনিও ক্লাস টেন ডি তে ঢুকে বিস্মিত ব্যাঙেদের এই মহামিছিল দেখে। ছাত্রপিছু ষোলটা ব্যাঙ। পঞ্চাশ জনের ক্লাসে যদি দশজনও অনুপস্থিত থাকে তাহলেও ছশো চল্লিশটা ব্যাঙ মজুত এই শ্রেণীকক্ষে। এই এতগুলো ব্যাঙ একসঙ্গে দেখার সৌভাগ্য নাকি দুর্ভাগ্য আর ক’জনের হয়? ছাত্রছাত্রী একসঙ্গে ক্লাস করতে দেখেছেন কিন্তু ছাত্রের সাথে ব্যাঙেদের এমন যুগলবন্দি! নাঃ এর একটা বিহিত করতেই হবে। এ কী অবস্থা! স্কুলে ডিসিপ্লিন বলে আর কিছু রইল না। শেষে কিনা ব্যাঙেদের দখলে ইস্কুল চলে গেল! কী কান্ড!
হেডস্যার অবিলম্বে জরুরি মিটিং ডাকলেন হলঘরে। ঘটনাটা খতিয়ে দেখতেই হচ্ছে। শিক্ষকমণ্ডলী, কিছু মুষ্টিমেয় ছাত্র, রামশরণ, তপনবাবু সবাই উপস্থিত হলেন হলঘরে। হেডস্যার কোনরকম ভুমিকা না করে রক্তচক্ষু দান করে, উত্তপ্ত গলায় অবনিস্যারকে জিজ্ঞেস করলেন যে তিনি কাকে ঠিক কী বলেছিলেন তা যেন হুবহু বলেন। প্রয়োজনে দৃষ্টান্তমুলক শাস্তি নেওয়া হবে এরকম অনাচারের জন্য।
অবনিবাবু মাথা চুলকে বললেন, “গতকাল আমি রুটিনে দেখলাম প্রথম পিরিয়ড টেন এ তে বাংলা রয়েছে। আমার পরদিন ফিফথ পিরিয়ডে। সেটায় প্র্যাকটিকাল ক্লাস আছে। পরীক্ষা নেবার কথাও চিন্তা করছিলাম। তাই বাংলার স্যার সুব্রতবাবুকে বললাম, “আপনি ক্লাসে যাচ্ছেন তো, বলবেন কালকে ডিসেকশানের জন্যও ভেক,আরশোলা আনতে হবে।”
“আপনার সঠিক মনে আছে তো অবনিবাবু?” হেডস্যারের কথায় অবনিবাবু মাথা নাড়লেন, “স্পষ্ট মনে আছে।”
সবার চোখ তখন বাংলার স্যারের দিকে পড়ল।
“আমার সাথে কর্মশিক্ষার স্যার সুকুমারবাবুর পিরিয়ড অদলবদল হয়েছিল। সুকুমারবাবু বললেন, উনি জরুরি কাজে বাড়ি চলে যাবেন। ওনার টিফিনের পর পিরিয়ড ছিল। সেটা আমার সাথে চেঞ্জ করায় আমি ওনাকেই তথ্যটা জানালাম ঘোষণা করার জন্য।”
“তা, কী বললেন?”
“ডি সেকশানের জন্যও ভেক আরশোলা আনতে হবে।”
উত্তেজিত হয়ে উঠলেন অবনিবাবু, “ডিসেকশান বলেছি মশাই, ‘ডি’ সেকশান নয়।”
হেডস্যারের মধ্যস্থতায় অবনিবাবু ঠাণ্ডা হলে সবার চোখ স্বাভাবিকভাবেই সুকুমারবাবুর দিকে ঘুরে গেল। তিনি জানালেন যে উনি যথাযথ খবরই পৌঁছে দেবার চেষ্টা করেছেন, “কাল ডি সেকশানের জন্যও ভেক আর শোলা লাগবে।”
খেঁকিয়ে উঠলেন বাংলার স্যার সুব্রতবাবু, “আমারই ভুল হয়েছে মশাই। রাতদিন ওই কর্মশিক্ষার ক্লাস নিয়ে মাথায় কেবল ছুঁড়ি কাঁচি আর শোলা ঘোরে।
“তা আপনি কি সোজাসুজি ছাত্রদের উদ্দেশ্যে কথাটা বলেছিলেন?”
“আরে না না ক্লাস নিয়ে বেরিয়ে নীচে নেমে হুঁশ হল যে কথাটা বলা হয়নি। তাই হোম-সায়েন্সের রহিমবাবুকে বললাম কথাটা বলে দিতে।”
“হ্যাঁ হ্যাঁ আমি তো সঙ্গে সঙ্গে বললাম তপনবাবুকে। উনি ওপরে যাবেন বললেন।”
“তা আপনি ঠিক কী বলেছিলেন বলুন তো!”
“ওইতো অবনিবাবুর ক্লাসে ডি সেকশানকে কেক আর শোলা আনতে বলবে।”
সুকুমারবাবু এ সুযোগ ছাড়বেন কেন? তিনি ফোড়ন কাটলেন, “সাধে কি আর আপনার পেটুক নামে খ্যাতি!”
এবার তপনবাবুর জবাবদিহির পালা। তপনবাবু ইস্কুলের কর্মচারী। মাইনে নেন, ঘণ্টা বাজান। স্যারেদের মত অতও সম্মান ওঁর নেই। ভয়ে ভয়ে আমতা আমতা করে বলে উঠলেন, “হ্যাঁ, আমি তো সেই কথাই বলেছি। ডি সেকশানকে শোলার কেক আনতে বলেছেন অবনিস্যার।”
হেড স্যার ফের বাঙময়, “তা এই কথাগুলো কি ডি সেকশানে সোজাসুজি গিয়ে বলে আসা হয়েছিল?”
“আজ্ঞে না, বিজ্ঞানের স্যার রফিকবাবুকে বলেছিলাম সে কথা,”ভাবুক রফিকবাবু তাঁর গুরুগম্ভীর গলায় বললেন, “তাই বলি ব্যাপারটা কি? আমি তো হতবাক। সোলার কেক। মানে সূর্যের রশ্মি দিয়ে তৈরি কেক আনবে ছাত্রগণ। তাও অবনিস্যারের ক্লাসে! আমি বুঝলাম নিশ্চিত কোথাও ভুল হচ্ছে। আর তপনবাবু তো কানে কম শোনেন। তা ওটা নিশ্চই শোলার ভেক হবে। অবনিস্যার তো আবার ব্যাঙ শব্দটা মুখে আনেন না। আমি ভাবলাম কোনও ডেমনসট্রেশান দেওয়ার জন্যও বুঝি শোলার ব্যাঙের প্রয়োজন।”
“কিন্তু আপনি কথাগুলো কি নিজে গিয়ে সেকশান ডি তে পৌঁছেছিলেন?” হেডস্যার এবার বেশ উত্তেজিত।
“আরে না না তার প্রয়োজনই হয়নি। ওপরে স্যারেদের চা দিতে যাচ্ছিল রামশরণ। আমি ভাবলাম মানে ওপরেই যখন যাচ্ছে তখন ভরসা করে আর কি—” শেষের কথাগুলো কেমন আস্তে হয়ে কেমন যেন মিইয়ে গেল।
“তা রামশরণ কাকে বললি আর কী শোনালি বল।”
হেডস্যারের তলবে একেই মুখ শুকিয়ে গেছে রামশরণের। না জানি কী অপরাধ করে ফেলেছে! এই বুঝি চাকরিটা যায় আর কি!
“হামি তো স্যার চা দিতে টেন এ ছেকশানে গেছিলাম। তো ওহাঁ পে কোনও স্যার তভি ছিল না। ইসি লিয়ে হামি ক্লাস ক্যাপ্টেন শেখারকে বাতায়ে দিয়েছিলাম।”
“তা বলেছিলিটা কী?”
“অবনিস্যার ডি সেকশানকে সোলা ভেক আনতে বলেছে।”
বলাই বাহুল্য, রামশরণের সোলা ভেক ষোলটা ব্যাঙে গিয়ে দাঁড়িয়েছে।
************
হলঘরটা টেন ডি র পাশেই। এক-আধটা ব্যাঙের যে সমাগম হবেই এ আর আশ্চর্য কী! কিন্তু ধীরে ধীরে সেই ব্যাংবাহিনী হলঘরে প্রবেশ করতে লাগল। তাদের সুমধুর ধ্বনিতে আকাশ-বাতাস মুখরিত-গ্যাঙর গ্যাং-গ্যাঙর গ্যাং। হেড স্যার এবার ধৈর্য হারালেন, “বলতে পার ঢ্যাং কী করব নিয়ে এত শত শত ব্যাঙ?”
ততক্ষণে অবনিচন্দ্র ঢ্যাং অবশ্য সন্তর্পণে হলঘরের ওপারে। বেগতিক দেখে সকলেই একে একে প্রস্থান করল। অগতির গতি কেবল রামশরণ দাঁড়িয়ে। অতএব শ্রীরামচন্দ্রকে স্মরণ করে রামশরণের শরণাপন্ন হয়ে হেডস্যার সেই বিপুল ব্যাঙবাহিনীর হাত থেকে বাঁচলেন। রামশরণ বুদ্ধি করে চট করে হলঘরটা আটকে দিল। যেক’টা বন্দি হয়ে থাকে থাকুক।
ক্লাসমণ্ডূকদের হাত থেকে রেহাই পেয়ে হেডস্যার স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। আর বন্দি ব্যাঙকুমারদের কী হল? সে ভাবনা না হয় কোনও অচিনদেশের রাজকন্যার জন্যই তোলা থাক! আমাদের আর ভেবে কাজ নেই!
গ্রাফিকসঃইন্দ্রশেখর