গল্প -ভেজা মাটির গন্ধ-শিবশংকর ভট্টাচার্য

সারা রাত্তির বৃষ্টি হয়েছে। এখন ভোরের আলো ফুটলেও বোঝার তেমন উপায় নেই। সুপারি গাছগুলোর মাথার ওপর আকাশটা ঘন কালো মেঘে ঢাকা। তিনদিন নাগাড়ে বৃষ্টি পড়ছে তো পড়ছেই। থামার কোনও লক্ষণ নেই।

ডাকাতেদিঘির গা দিয়ে যে মেটে পথটা মসজিদ হয়ে তাঁতীপাড়া কুমোড়পাড়া আর জাপটের দিকে ভাগ হয়ে গেছে,শুকনো দিনে সকাল বিকেল সেখানে হাটুরেদের আনাগোনা খুব। দূরদুরান্তের গাঁ থেকে চাষীরা গরুর গাড়িতে ধান,পাট আর আনাজপত্তর নিয়ে অম্বিকা রাজবাড়ি লাগোয়া বাজারে বেচতে যায়।

আজ নিয়ে দিনতিনেক লোকজন চলেনি এ পথে। দিঘির ধারের জঙ্গলে সবচাইতে ভয়ের জায়গা তেঁতুলতলায় জনার্দন পাইকের মোষের গাড়ি আটকে যায় এককোমর সমান এঁটেল কাদায়,তারপর থেকে আর কেউ চলতে সাহস করেনি। পাটের আঁটি বোঝাই সে গাড়ি এখনও পড়ে আছে সেখানেই। শুধু অনেক চেষ্টায় মোষদুটোকে উদ্ধার করা গেছে। তিনদিনের বৃষ্টিতে সে পথ একটা নদী হয়ে বইছে। লালচে ঘোলাটে জলের স্রোত অবিরাম বয়ে চলেছে নিচু জাপটের দিকে। এখানে যে কখনও পথ ছিল বোঝা দায়।

গ্রামের এ পাশটা তুলনায় অনেকটা উঁচু। মসজিদের লাগোয়া ঢালু জমির ওপর মাটির বাড়িগুলো থেকে মাঝে মাঝে গা মোড়ামুড়ি দেবার মত শব্দ উঠছে। ভেঙে পড়তে পারে যখন তখন। পুরোন টালি,চালের পচা খড় খসে খসে পড়ছে। বড়ো ডাকাতেদিঘির জল উপচে পড়ে মাছ ভেসে যাচ্ছে। উঁচু জমিগুলোতেও হাঁটুভর কাদা। কইমাছের দল সারি বেঁধে কানে হেঁটে হেঁটে চলেছে স্রোতের উল্টোদিকে। বক আর ডাহুকদের মচ্ছব লেগেছে সেখানে। মসজিদের পেছনের জঙ্গল থেকে দিনের বেলাতেই ছানাপোনা নিয়ে বেরিয়ে পড়েছে শেয়ালের দল,দূর থেকে তাদের ডাক শোনা যায়। ভয় পেয়ে কান্নার সুর তাদের ডাকে।

আমগাছের ঘন ছাতার তলায় মেটে দেয়ালের ঘরটি এ গ্রামের শেষ সহায়। তারপর থেকেই কশাড় জঙ্গল ঘন হয়ে এসেছে। মানুষের সাড়া এখানে কমই পাওয়া যায় সারা দিনে। এখানে মনা রূদ্রপালের বাস। মনার ভালো নাম কেউ জানে না। কাজ করে বহুদূরে শহরতলির পাট কলে। থাকেও সেখানেই। ঘরে তাকে দেখা যায় মাসে দুমাসে একদিন দুদিনের জন্য। আর বউ রমা থাকে এই ঘরে। একা থাকতে তার ভয় করে। বাঘডাষা গন্ধগোকুল আর বুনো শেয়ালের উৎপাতে এখানে হাঁস মুরগি পালা বা ছাগল পোষানী নেবার উপায় নেই। আগল ভেঙে খেয়ে তছনছ করে রেখে যায়। এই  বৃষ্টিতেও দুটি ছোটো ছেলেকে ঘরে রেখে লোকের বাড়ি কাজ করতে যেতে হয় তাকে। নইলে দুবেলা খাওয়া জোটে না।

ঘুম ভাঙার পর হামু আর শিমু ঢেঁকিঘরের দরজার সামনে এসে বসেছে। অঝোর বৃষ্টিতে সব কিছু ঝাপসা ধোঁয়া ধোঁয়া। ঝোড়া বাতাসে গুঁড়ো গুঁড়ো জলের কণায় শীত শীত করে। ঘুম থেকে উঠেই খুব ক্ষিদে পেয়েছে হামুর। চালভাজার কৌটো মা তুলে রাখে অনেক উঁচুতে নাগালের বাইরে। মাচার ওপর থেকে হাত বাড়িয়েও কিছু হল না, লগা দিয়ে টান দিতেই কৌটো নিচে পড়ে খুলে গেল। ওতেও কিছু নেই। ফিরে আবার ঢেঁকিঘরের দরজায় শিমুর পাশে বসে বাইরে উঁকি দিল হামু। কী যে করে এখন! বাইরেটা বৃষ্টির জল পড়ার শব্দ ছাড়া বড়ো চুপচাপ। সকালের আলো ফোটার পর থেকে কোনও পাখির ডাক শোনা যায়নি আজ।

মাথার ওপর চালের ফাটা টালির ফাঁক দিয়ে ঝর ঝর করে জল পড়ছে ঘরের ভেতর। বাঁশের মাচার ওপর চট্‌ কাঁথার বিছানা ভিজে জবজব হয়ে রয়েছে বলে দুভায়ের ঘুম সকাল-সকাল ভেঙে গেছে। মা কাছে না থাকলে বড়ো ভয় করে শিমুর। ভয়ে ভয়ে ছোট্ট মুখটা আরও ছোটো দেখাচ্ছে। কান্না পেলেও দাদার ভয়ে কাঁদবার উপায় নেই ওর। কারো চোখে জল দেখলে হামুর রাগ হয়ে যায়। বেচারা শিমু বাইরে যেতে পারছে না বলে প্যাণ্ট ভিজিয়ে ফেলছে। গিট লাগা দড়ির বাঁধন খুলতে না পেরে ছুরি খুঁজছে হামু, কোথায় যে সব লুকিয়ে রেখে যায় মা!

মা গেছে সেই কোন সকালে মানকচু পাতার ছাতা মাথায় দিয়ে ডাক্তারদাদুর বাড়িতে কাজ করতে। ফিরতে ফিরতে দুপুর গড়িয়ে যাবে। কাজে কোনদিন ছুটি নেই মায়ের। ফিরবে যখন আঁচলে বাঁধা থাকবে চাল ডাল আলুর সিধে, ফিরলে তবে রান্না হবে। মাসের মাইনের বদলে দাদুর বাড়ি থেকে রোজ এই সিধে দেওয়া হয়। মাঝে মাঝে রান্না করা খাবারও দিয়ে দেয় অবশ্য। বাড়ি ফিরবার পথে দাদুর বাড়ির মাচা থেকে দু একটা ঝিঙে, বিলম্বী, শসা বা পুঁই লাউয়ের ডগা তুলে নিয়ে আসে মা। খিদে পেটে মায়ের পথ চেয়ে বসে আছে দু’ভাই।

হামুর মাথায় আর এক চিন্তা। মা ফিরলেও রান্না হবে কী করে! তেলের শিশিতে তেল নেই। নুনের বাটি বৃষ্টির ছাঁটে সেঁতিয়ে উঠেছে। নারকেলের আঁচিতে দু এক চিমটি নুন যা ছিল, এখন আছে খানিকটা ঘোলা জল! রান্না করতে তেল নুন লাগে, পয়সা ছাড়া পাওয়া যায়না ওসব। হামুর পেটে ক্ষিদে, তাই এখন ওর মাথায় সব সময় টাকা পয়সার চিন্তা। দাদুর ভাঁড়ারে ঢুকে নিয়ে আসতেই পারে হামু, কেউ টেরই পাবে না। কিন্তু ও বাড়ির ভাঁড়ারের নুন থেকে মশলায় হাত দিলে মা বকে।

     সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ানো স্বভাব হামুর। বৃষ্টিবাদলা না থাকলে আমের দিনে আম জাম জামরুল করমচা কামরাঙা যা পাওয়া যায় কুড়িয়ে বেড়ায়। পথচলতি হাটুরেদের গাড়ি থেকে এটা ওটা তুলে নিয়ে ছুটে পালালে কেউ জানতেই পারে না। শিমুটা বড়ো হলে ওকেও নিয়ে যাবে সাথে। একা একা কত আর পারা যায়? বনের ভেতর অনেকগুলো বড়ো বড়ো নারকেল, সুপারির গাছ আছে,কেউ ওখানে যায় না তাই খবরও রাখে না। ঝুনো নারকেল যদি পাওয়া যায় সব থেকে ভাল। হারান মালের মুদি দোকান থেকে দু পলা তেল ভরে দেয় শিশিতে এক একটা নারকেলর পিছু, সাথে এক খাবলা নুন! চাইলে দুটো শুকনো লংকাও দিয়ে দেয়। সুপারি পেলেও লাভ আছে। সুপারি পিছু দুটো করে বাতাসা! মাঝেমাঝে রাতের আঁধারে কাছেপিঠের গাছগুলোতেও উঠে যায় হামু। ভাল গাছ বাইতে পারে বলে পাড়ায় এর মধ্যেই খুব নামডাক। মুশকিলও আছে! গাছ থেকে কারো ফল চুরি গেলে প্রথমেই হামুকে এসে ধরে লোকে। দারোগাদাদুর সুপারি পেড়ে নিয়েছিল বলে দাদু এসে হামুর পেটে খামচা দিয়ে চাঁটি মেরে গেল সেদিন। রাগ হলেও কিছু বলেনি হামু। পরদিন দারোগাবাড়ির নারকেল গাছ সাফ! চার পাঁচটা নারকোল এখনও লুকোন আছে কোড়োই গাছের খোঁড়লে। দারোগাবুড়ো লোক পাঠিয়ে তন্নতন্ন করে খুঁজেও পায়নি। আরও কত কী পাওয়া যায়! কমলের পুষ্কুনীতে কলমি আর হিঞ্চেশাকের দাম হয়ে আছে। খুঁজলে পানিফলও মেলে। সাপের ভয়ে কেউ যায় না সেখানে। মায়ের হাতে লাউ, চালকুমড়ো গাছ ভাল হয়। রান্নাঘরের চালের ওপর ফলও ধরেছে তাতে, মাচায় ঝুলছে ঝিঙে। খাবারের অভাব নেই। কিন্তু এক্ষুনি মুখে দেবার মতো কিছু পাওয়া যাচ্ছে না হাতের কাছে। ওদের দু ভায়ের বড্‌ডো ক্ষিদে পেয়ে থাকে সবসময়। খাবার না পেলেই রাগ হয়ে যায়। শুকনো দিনে একরকম, এখন এই একনাগাড়ে বৃষ্টিতে কী করবে বুঝতে পারছে না হামু।

বেলুড়ের পাটকল কতদূর? বাবা থাকে ওখানে। ছুটিছাটায় এসে যায় হঠাৎ হঠাৎ। তখন কী যে ভাল লাগে! ঠিক এই সময়ে চলে আসে যদি! কত কী যে থাকে বাবার কাঁধে আর হাতে! ঝোলানো ব্যাগে, ধুতির কোঁচার খুঁটে, খাকি জামার বড়ো বড়ো দুই পকেটে। বুক পকেটে সেফটিপিন দিয়ে আটকানো টাকা আর কত পয়সা! ব্যাগের মধ্যে তরিতরকারি, আনাজ, লাল সবুজ মাছলজেন্স, পাঁউরুটি। ধুতির কোণার কাপড়ে ভেটকি মাছ চাঁদা মাছের ভেজা পুঁটুলি। খুব মজা হয় তখন। হামু শিমুর মাথার লাল চুলে তেল-চিরুনি পড়ে। বইখাতা নিয়ে হামু পড়তেও বসে যায়। এমনকি দুপুরে শুয়ে থাকলে বাবার পাকা চুলও বেছে দেয়। বাবা চলে আসে যদি এক্ষুনি? কতদিন আসেনি! কেন আসে না?

অশ্বিনীদাদু লোক ভাল না। বলাইদাদুর কাছে খুব রসিয়ে রসিয়ে গল্প করছিল ওর বাবা নাকি বেলুড়ে আর একটা বিয়ে করেছে,তাই আসে না। বিয়ে করেছে তো বেশ করেছে তাই বলে এখানে আসা যায় না? মিথ্যে কথাও হতে পারে,অশ্বিনীদাদু মিথ্যে ছাড়া কথাই বলতে পারে না! নানারকম ভাবছে হামু ঢেঁকির ওপর শুয়ে শুয়ে।

মার জন্য বড়ো কষ্ট হয়! বাড়িতে থাকলে মা চুপিচুপি কাঁদে। সবসময় চোখে জল নিয়েই রাঁধাবাড়া একাজ-ওকাজ করে বেড়ায়। শিমুটাকে কোলে নিয়ে দুধ খাওয়াতে বসে যখন হামু থাকে কাছেপিঠে। মায়ের মুখে হাসি দেখবার জন্য হয়তো দুটো পেয়ারা কি নারকোল এনে পাশে রেখে দেয়। দেখিয়ে দেখিয়ে শ্লেটে একটা দুটো অঙ্ক কষে ফেলে, মার চোখদুটো দিয়ে তবু জল গড়ায়। বাবা কতদিন আগে গোটা গোটা হরফে একটা চিঠি লিখে পাঠিয়ে ছিল,সেই চিঠিটা মাঝেমাঝে কোথা থেকে যেন বার করে হাতে রাখে। ওতে কী লেখা আছে কে জানে! মা পড়তে টড়তে জানে না বলে শুধু উলটে পালটে দেখে আর কাঁদে। কেন কাঁদে? মাকে কাঁদতে দেখে ছোট্ট শিমুটাও কাঁদে। তখন ওদের দেখে হামুর রাগ হয়ে যায়। বাবার ওপর, দারোগাবুড়োর ওপর, ডাক্তারদাদুর ওপর, মায়ের ওপর, সবার ওপর। পাগল পাগল লাগে তখন। রাগের চোটে কখন যে কী করে ফেলে ঠিক নেই। স্লেট ভেঙে বই ছিঁড়ে কমলের পুষ্কুনীতে গিয়ে সারা গায়ে কাদা মেখে ভূত হয়ে ঢেঁকিঘরে কিংবা চালের ওপর উঠে শুয়ে থাকে। অথবা দা হাতে কোড়োই গাছের বিশাল শরীরে এলোপাথাড়ি কোপাতে থাকে। তখন ওর মাথার ঠিক থাকে না কোনও। মা ছুটে গিয়ে ও বাড়িতে খবর দেয়।

তারপর শুরু হয় মার! ডাক্তারবাড়ির মেজপিসি এসে ধরে নিয়ে যায়। মার চোখ দুটো তখন কেমন যেন ভয় পাওয়া জন্তুর মত দেখায়। মুখে কোন কথা যোগায় না। মেজপিসি দাদুর মেয়ে,খুব রাগী। বড়োদের ইস্কুলে পড়ায়। সবাই ওকে ভয় পায়। মারবার সময় পাটের দড়ি দিয়ে হাত পা বেঁধে বেত দিয়ে দমাদম মারতে থাকে। মারতে মারতে গা কেটে রক্ত পড়লেও ছাড়ে না। শেষে দাদু এসে বেত চেপে ধরে ছাড়িয়ে বাঁধন খুলে দেয়। মার খাবার সময় হামু আগে খুব কাঁদত,এখন আর কাঁদে না। কাঁদে না বলে আরও মার খায়। রাতে শোবার সময় মা আর শিমু গায়ের কাটা দাগগুলোর ওপর প্রদীপের তেল লাগিয়ে দিলে আর ব্যথা থাকে না। বৃষ্টিবাদলার দিনে হামুর রাগ হয় সবচেয়ে বেশি।

আকাশের রং এখন লিচুর শাঁসের মত। বৃষ্টির কোন বিরাম নেই। ঝরেই চলেছে একনাগাড়ে। কমলের পুষ্কুনির পাড়ের বড়ো বাঁশঝাড়ের মধ্যে কোথাও সাপে ব্যাঙ ধরেছে। কঁক কঁক শব্দটা কানে আসছে অনেকক্ষণ ধরে,এবার ধীরে ধীরে নিস্তেজ হয়ে এল যেন। বৃষ্টির জলের ঝম্‌ ঝম্‌ শব্দ কানে তালা ধরিয়ে দিচ্ছে! বড়ো বড়ো জলের ফোঁটা উঠোনের বয়ে যাওয়া স্রোতে তিরের মত বিঁধে বুদবুদ তৈরি হচ্ছে,ফাটাছে। সুড়সুড় করে একটা বড়ো গাছ বুঝি ভেঙে পড়ল বাঁশঝাড়ের ওপাশে। কানখাড়া করল হামু। বুড়ো কেলিকদম্ব গাছের বড়ো শুকনো ডালটা ভেঙে পড়ল বোধ হয়। দু মনের ওপর ওজন হবে। এক্ষুনি কুড়িয়ে আনতে না পারলে আর কেউ নিয়ে যাবে। এত জোর শব্দ কারো কানে যায়নি কি আর? অশ্বিনীদাদুর কানে গেলে আর উপায় নেই। উঠে দাঁড়িয়ে হামু শিমুর দিকে তাকাল। ডালটা টেনে আনতে পারলে এখন অনেক টাকা। দশ বিশটাকা তো বটেই। মা খুশি হবে খুব। প্যান্টটা খুলে ঘরের ভেতর ছুঁড়ে দিয়ে ছুটল হামু। শিমু ভয় পেয়ে কাঁদছে। ডাকছে পেছন থেকে। হামু ছুটতে ছুটতে চেঁচাল, “ঘরে থাক শিমু।” তারপর হলদিবন ডিঙিয়ে বাঁশ ঝাড়ে ঢুকে গেল।

জঙ্গলের এ দিকটাতে বড়ো একটা কেউ আসে না। সাপ খোপের ভয়ে গরু বাঁধতে চায় না লোকে। বহুকাল আগে মহামারীতে জনশূন্য হয়ে যাওয়া গ্রামের ওপর কয়েকশো বছরে গড়ে ওঠা এই বনের ভেতর এখনও নাকি পুরোন দিনের লোকজন বসবাসের চিহ্ন পাওয়া যায়। এখানে বড়ো বড়ো গাছগুলোর খোঁড়লে নানারকম পাখি আর জীবজন্তুর বাস। মাটির গর্তে যেমন শেয়ালদের বাস তেমনি আছে বড়ো বড়ো বিষাক্ত সাপ। সাপ থাকলে বেজি থাকবে, আর আছে বাগডাশা নামের ভয়ংকর এক প্রাণী। এমনিতে লাজুক ধরনের, লুকিয়ে থাকতেই ভালবাসে। কিন্তু হঠাৎ মানুষের মুখোমুখি হয়ে গেলে ছোটখাট বাঘের মত হিংস্র। এত জোরে এরা ছুটতে পারে যে চোখে দেখতে পাওয়া যায় না। একা পেলে ছোট ছেলেপুলে তুলে নিয়ে গেছে এমন কথাও শোনা যায়। হাঁস মুরগি বা ছাগলের খোঁয়াড়ে ঢুকলে আর উপায় নেই।

বনের মধ্যে দিনের বেলাতেই অন্ধকার হয়ে থাকে। আম কাঁঠাল লিচু নারকেল পেকে মাটিতে পড়ে থাকলেও কুড়িয়ে নেবার লোক নেই। কিছুদিন আগেও ঠ্যাঙাড়ের দল লুকিয়ে থাকত এখানে। ঢেউখেলানো জমির ওপর এই বহুদূর অবধি তার শেকড় গেড়ে আছে। রাতে তো নয়ই, দিনের বেলাতেও এখানে ঢুকবার কথা ভাবতে পারেনা কেউ। বিশেষ করে অতিকায় ভূতুড়ে চেহারার কেলিকদম্ব গাছটাকে ভয় করে সবাই। ঘন বাঁশঝাড়ের আড়ালে হাতির গায়ের মত তার কালো শরীর ভাল করে চোখেও পড়ে না। নবাবী আমলে এই গাছে চোর ডাকাতদের নাকি ফাঁসিতে লটকানো হত। গাছের গোড়ায় তাদের কবর শেকড়ের জালে ঢাকা পড়ে গেছে। বৃষ্টির জলে মাটি ধুয়ে গোলে আজও দেখা যায় চুনের মত সাদা মানুষের কংকাল কালো মাটির গায়ে ফুটে আছে। তাদের কারো কারো হাতে তখনও মর্চে পড়া লোহার শেকল। পোড়া মাটির পাটায় খোদাই করা নবাবের শাস্তি দেবার লেখন। এই বনে কেলিকদম্বের ভাঙা ডাল কুড়োতে ছুটলো হামু।

বৃষ্টির বড়ো বড়ো ফোঁটা গায়ে এসে বিঁধছে, ছুটন্ত শরীরে সুতোটি নেই হালুর। ক্ষিদে পেলে ওর ভয় থাকে না। লজ্জাও থাকে না। হলদিবনের বাঁপাশে  অতিকায় নিমগাছটার ডাল থেকে বড়োসরো মৌচাক ভেঙে পড়ে আছে। বৃষ্টির শব্দ ছাপিয়ে মৌমাছিগুলোর ভন্‌ভন্‌ শব্দ কানে আসছে। ভেজা পাতার স্তূপের ওপর গড়িয়ে পড়ছে মধু। তার গন্ধে গন্ধে এই বৃষ্টিতেও লালরঙা লাসাপিঁপড়ের দল নেমেছে আশপাশের গাছগুলো থেকে। পাতায় বোনা বড়ো বড়ো পিঁপড়ের বাসা পড়ে আছে কিছু। একে বলে লাসার ডোল। এদের ভয় পায় না এমন কোন প্রাণী নেই জঙ্গলে। ক্ষ্যাপা মৌমাছিরাও উড়ে বেড়াচ্ছে পাগলের মত। তাদের গুণগুণানীতে কান পাতা দায়।

হামুর ভয়ডর নেই। ঘাড়ের কাছে হুল ফুটিয়েছে মৌমাছি,তাড়া করেছে পেছনে। হামু ছুটলো কমলের পুষ্কুনির ধারের মানকচুর বনে। মানকচুর পাতা গায়ে জড়িয়ে নিলে মৌমাছি হুল ফোটাতে পারবে না। মৌচাকটা তুলে আনা যাবে। কত মধু! কলসি ভরে যাবে নিমফুলের মধুতে। শিমুটা বড়ো খুশি হবে। ছুটলো হামু। মৌমাছি কটা কামড়াবে কামড়াক! পরোয়া করে না ও। মাথার ওপর আকাশ যেন আরও কালো হয়ে এল।

golposhibshankar (Medium)

মানকচুর পাতা ছিঁড়তে গিয়েই সাপটাকে দেখতে পেল হামু। সাত বছরের ন্যাংটো ছেলে হামু আর ভেঙে পড়া কেলিকদম্বর বড়ো ডালটার মাঝে বিশাল এক গোক্ষুরা সাপ। পেট ভরা আছে বলে ফনা তুলে নেই এখন। কিন্তু মানুষের পায়ের শব্দ পেয়ে অল্পসল্প মাথা উঁচু করে শরীর এলিয়ে শুয়ে আছে ভেজা বাঁশপাতা বিছানো সুঁড়িপথটা জুড়ে।

প্রকান্ড নীলচে কালো শরীরটা নড়ছে অল্প অল্প। বিদ্যুতের আলো ঝিলিক দিচ্ছে চকচকে আঁশের ওপর। লাল কুঁচফুলের মত চোখদুটো তার স্থির।

নিঃসাড়ে দাঁড়িয়ে পড়েছে হামু। বৃষ্টির ফলা বিঁধে যাচ্ছে খোলা শরীরে। ঠান্ডায় কাঁপছে হিহি করে। মাথার বড়ো বড়ো জট লাগা চুল লেপটে আছে ওর কোঁচকানো ভুরু হিংস্র চোখ দুটোর চারপাশে। ফুলে ওঠা নাকের পাটায় গরম শ্বাস বইছে হামুর, বুকের পাঁজর কাঁপিয়ে আসছিল আদিম কোন মানুষের মত শ্বাসপ্রশ্বাস।

এত বড়ো ভেঙে পড়া শুকনো ডাল বড়ো লোভের জিনিস এ সময়ে। ছাড়া যায় না কোন মতেই। তেল নুন মশলা কেনার পয়সা। মুড়কি,এমনকি মাংসও কিনে নেয়া যাবে। পথ ছাড়ছে না হামু। সাপটারও সরে যাবার ইচ্ছে নেই। মাথাটা অল্প উঁচু করে চেয়েই আছে ঠায় হামুর দিকে। নাকে মুখে সাঁ সাঁ শব্দ করছে। যেন ভয় দেখাতে চায়। আফশোষ হচ্ছে হামুর। চিনিকাকুর তেল পাকানো লাঠিটা চুরি করে এনে লুকোন আছে চালের বাতায়। সাপ মারবার অব্যর্থ অস্ত্র! হাতে থাকলে বড়ো ভাল হত এ সময়। তবু ও এদিক ওদিক খুঁজে দেখল, যদি সে রকম শক্তপোক্ত একটা কিছু পাওয়া যায়। কিছুই নজরে পড়ছে না। একটা ইট থাকলেও হত। আফশোষে চোখে জল এসে গেছে ওর। ঘাড়, গলা জ্বালা করছে রাগের চোটে। সাপটাও বোধহয় বাধা পেয়ে রেগে যাচ্ছে। হিস্‌স হিস্‌স শ্বাসের শব্দটা বাড়ছে, চেরা কালো কুচকুচে জিভ দেখাচ্ছে। অল্প হাঁ করলো। ওর গলার কাছটা ফুলে আছে। সোনা ব্যাঙের লম্বা পায়ের ডগা দুটো মুখের বাইরে ঝুলে আছে। গিলতে থাকা ব্যাঙটা এখনও নড়ছে একটু একটু। যেন এবার নিজেই সাপটার পেটে সেঁধিয়ে যাবার চেষ্টায় আছে। পা দুটো টান করে শেষবারের মত ধড়ফড়িয়ে উঠল, সাপটার শরীরও নড়ে উঠেছে সেইক্ষণে। ব্যাঙটা বেশ বড়ো মাপের বলে গিলে ফেলাটা কম কথা নয়।

সুরুত করে আরও একটু ভেতর চলে গেল সোনাব্যাঙটা। চাপা ক্যাঁক ক্যাঁক আওয়াজটাও আর নেই। খড়ম আঁকা ফণাটা এবার মেলে ধরেছে সাপটা। বৃষ্টির ফোঁটা ছিটকে যাচ্ছে ফণায় লেগে। মাথা আরও একটু উঁচু করে চেয়ে আছে। লাল চোখদুটো হামুর দিকে। নজর দিয়ে টেনে নিতে চায় যেন। চিনিকাকু বলে সাপের নজর নাকি ভাল নয়,ঝাপসা দেখে। বাজে কথা। লাল চোখদুটোয় যেন আগুন জ্বলছে। একটু নড়লেও চমকে উঠেছে সাপটা।

হামু দাঁত কিড়মিড় করল। যেন বলতে চায় সম্বন্ধির পো,তুমি ঠাণ্ডা রক্তের বুকে হাঁটা জীব। আমি মনা রূদ্রপালের বড়ো ছেলে,আমাকে তুমি সামান্য জীব ভয় দেখাও! এইরকম কিছু যেন তার বলবার ইচ্ছা। ছোটো ছেলে বলে ভাষায় কুলোচ্ছে না। বাধা পেয়ে ভেতরে ভেতরে ফুঁসছে হামু।

সাত বছর বয়সে এই এক রোগ মাথায় খাটো গিরগিটির মত রোগা হামুর। উঠতে বসতে মেজপিসির কাছে চিনিকাকুর কাছে মার খায় এই জন্য, তবু রাগ যায় না! যত মার খায় রাগ আরো বেড়ে যায়। রাগের চোটে দিকবিদিক জ্ঞান থাকে না। মুখ দিয়ে খারাপ খারাপ গালাগালি বার হতে থাকে।

ঝেঁপে বৃষ্টি হয়ে যাচ্ছে এখনও। মাথার ওপর থেকে জলের ধারা বইছে সারা গা বেয়ে। হামুর মুখ ফুলে যাচ্ছে মৌমাছির হুলের বিষে। ওর চোখ জ্বালা জ্বালা করলেও নজর সরিয়ে নিচ্ছেনা একপলকের জন্যেও। সাপটা ওর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে এবার মাথা নিচু করে পাক খুলতে খুলতে এঁকে বেঁকে চলে যেতে থাকল হলদিবনের ভেতর দিয়ে কোড়ই গাছের ঝোপের দিকে। ঝোপের আড়ালে সাপের লেজটা মিলিয়ে যাবার পর হামু ছুটে গেল গভীর বনের দিকে। চরাচর কাঁপিয়ে নীল আলোয় চোখ ধাঁধিয়ে বাজ পড়ল কাছেই কোথাও।

 শিমু অনেকক্ষণ কেঁদে কেঁদে দুটো চোখ ফুলিয়ে ফেলেছে। এখন বাজ পড়ার শব্দে ভয় পেয়ে কেমন চুপ মতো দেখাচ্ছে। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে,ফোঁপাচ্ছে। বৃষ্টিটা যেন কমে আসছে এবার। আকাশও একটু পরিষ্কার। জলদুধের মত ঘোলাটে। দশাসই ডালটা টানতে টাতে হালু  ঢেঁকিঘরের পাশে এনে ফেলল। তিন বছরের শিমু মুখে আঙুল দিয়ে হামুর কাদা মাখা ন্যাংটো শরীরের দিকে চেয়ে ফিক্‌ করে হাসলো। হামুর দম ফেলার সময় নেই। মৌচাকের মধু বুঝি সব মেরে দিল পিঁপড়েরা এতক্ষণে। তাছাড়া কেলিকদম্ব গাছের কাছে বৃষ্টিধোয়া মাটির তলায় বড়োসড়ো মেটে আলুর খোঁজ পাওয়া গেছে। পাকঘর থেকে হাঁড়ি আর খন্‌তা হাতে নিয়ে গায়ে মাথায় গামছা জড়িয়ে হামু আবার ছুটে গেল জঙ্গলের দিকে।

বৃষ্টিটা কমে গেছে বলে শব্দও কম। পাখপাখালির ডাক অল্প অল্প শোনা যাচ্ছে শুধু। মেঘেরা এবার উত্তর থেকে দক্ষিণে চলতে শুরু করেছে। শিমু সাহস করে ঘর থেকে বাইরে এসে দাঁড়াল। ঝোপঝাড়ের ফাঁক দিয়ে কমলের পুষ্কুনির জল দেখা যাচ্ছে। ডাহুক পাখি কলমির দামের ওপর লম্বা লম্বা পা ফেলে হেঁটে চলেছে পোকামাকড় ধরার আশায়। সাদা তিলক পরা কালো সরু সন্ধানী ঘাড় এগোচ্ছে পিছোচ্ছে, চঞ্চল লেজ নড়ছে ওপর নিচ। কালো তুলোর গোলার মত চারটি ছানা আছে তার পিছুপিছু। একটা পানকৌড়ি সাপের মত গলা ভাসিয়ে সাঁতার কাটছে মাঝপুকুরের কালো জলে।

মেঘ কেটে গিয়ে এক ঝলক রোদ উঠেছে বৃষ্টি ধোয়া গাছপালার মাথার ওপর। একটা দুটো চিল আকাশে চক্‌কর খাচ্ছে। নরম রোদে বেলা বোঝা যায় না। কোড়োই গাছের বড়ো শিকড়ের ওপর এসে বসল শিমু। পানকৌড়িটা মাছের খোঁজে ডুব দিচ্ছে উঠছে। হঠাৎ ঠোঁটে ছট্‌ফটে এটা মাছ নিয়ে উড়ে গেল বনের কোন উঁচু ডালে। কুবো পাখির ডাক শোনা যাচ্ছে কুপ্‌ কুপ্‌ কুপ্‌। কোথা থেকে উদাস হাওয়া বয়ে গেল এক ঝলক। ছরাকচুর পাতা বেয়ে বৃষ্টির জলের শেষ ফোঁটাটা পড়ল গুঁড়িপানাগুলোর ফাঁকে। একটু ঢেউ গোল হয়ে ছড়িয়ে আবার শান্ত স্থির হয়ে গেল পুকুরের জল। নীল আকাশের ছায়া পড়েছে জলে। আর কোথাও কোনও শব্দ নেই।

ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য

               

     শিবশঙ্কর ভট্টাচার্যের আরো অনেক গল্প—