গল্প-মক্ষিকানগরের রানিমহল-রতনতনু ঘাটী

galporatantanu (Medium)

সুনন্দদের ঝাঁকড়া জামরুল গাছের একটা মাঝারি ডালে কবে থেকে বেড়ে উঠেছে সুন্দর দেখতে একটা মৌচাক। মৌমাছিরা সকলে একমত হয়ে নিজেদের সেই দেশের নাম রেখেছে মক্ষিকানগর। এই নাম রাখাতে রানি-মৌমাছিরও যে একেবারেই সায় ছিল না তা নয়। সেদিন এই মক্ষিকানগরে সকাল সকালই শুরু হয়ে গেল তুমুল ঝটাপটি, হইহট্টগোল।

মক্ষিকানগরের মৌমাছিরা কাতারে কাতারে মুখ তুলে দেখতে চাইল, আসলে হয়েছেটা কী? এ ওর ঘাড়ের উপর দিয়ে মাথা তুলে দেখতে চাইছে। সে তার কাঁধের উপর পা তুলেও নাগাল পাচ্ছে না ঘটনার। ভরাভরতি হয়ে থাকা তিরিশ-পঁয়ত্রিশ হাজার মৌমাছির এই মক্ষিকানগরের মধ্যে সে যে কী অটলব-পটলব কান্ড, তা বলে বোঝানো যাবে না।

মক্ষিকানগরে একটা নাদুসনুদুস ভবঘুরে পুরুষ মৌমাছি আছে। সারাদিন মৌচাকের এদিক থেকে ওদিকে ঘুরে বেড়ায় সে। এর কথা শুনে কান পাতে। তার কথা শুনে হাটকুই-পাটকুই করে আর-একজনকে বলতে ছুটে যায়। তার কাজের হিসেব নিলে কেউ অঙ্ক কষে বলতে পারবে না, সে সারাদিনে কী কাজ করেছে। কোনও কাজটাজ করার নামই নেই। সে যেন এই মক্ষিকানগরের কুটুম। স্কুলের একটানা কঠিন কঠিন পরীক্ষার পর বাবা-মাকে বলে ক’দিন যেন মামারবাড়ি বেড়াতে এসেছে।

হঠাৎ সে তুমুল হট্টগোলের মাঝখানে দুম করে একটা মস্ত খবর ঘোষণা করে দিল, “আমাদের মক্ষিকানগরে আজ দুই রানি-মৌমাছিতে যুদ্ধ বেধেছে!”

অত মৌমাছি এ ওর মুখ চাওয়াচাওয়ি করল খানিক। কেউ যেন কাউকে চোখের ইশারা করল। তার মানে এতে মক্ষিকানগরের ভালোও হতে পারে।

যুদ্ধের কথা শুনলে কারই বা ভালো লাগে? কথাটা পছন্দ হল না কারওরই। কথাটা মনেও ধরল না তাদের। যাদের একটু আধটু মনে ধরেছিল, তারা হাটকুই-পাটকুই করে ভিড় ঠেলে এগিয়ে যেতে লাগল রানি-মৌমাছির কুঠরির দিকে, সকলে যাকে বলে ‘রানিমহল’। শোনা গেল, যুদ্ধটা বেধেছে নাকি রানিমহলের ঠিক সামনেটায়।

সত্যি কথা বলতে, রানি-মৌমাছির যে রানিমহল, মক্ষিকানগরের ক’জনেরই বা নিজের চোখে দেখার সৌভাগ্য হয়েছে? কেউ কেউ সে বিশাল রানিমহলের শুধু গল্পই শুনেছে, চোখে দ্যাখেনি। যেসব বাছাই শ্রমিক-মৌমাছি রানি-মৌমাছির রানিমহলের চারপাশে পাহারা দেয়, শুধু তাদেরই মুখ থেকে। সেসব কথা বলতে গেলে রূপকথার গল্পকেও হার মানায়।

রানিমা’র এই রানিমহল নাকি লম্বায়-চওড়ায় মস্ত বড়ো। তার ভিতরে সোনাদানা, হিরে-মানিক আছে কিনা কেউ ঠিক করে বলতে পারে না। তবে তার ভিতরের সাজানো-গোছানো দেখলে নাকি চোখ ধাঁধিয়ে যায়, এ কথা সকলেই একবাক্যে স্বীকার করে। তার মধ্যে কত কী যে আছে, তা যারা চোখে দেখেছে, তারাও অঙ্কদৌড়ের মতো ঠিক মনে করে বলতে পারে না সব। তারাও আবার কত কথাই হয়তো বাড়িয়ে বলে কিনা তাই বা কে জানে!

তবে বেশির ভাগ মৌমাছি মনে মনে ভাবে, আমাদের রানি-মৌমাছির থাকার ঘর বলে কথা! সে তো অমন আহামরি কিছু হবেই। কেউ কেউ ভাবে, এ কি যে সে মৌমাছির থাকার ঘর নাকি? এ যে মক্ষিকানগরের হেড-মৌমাছির রানিমহল!

তার মধ্যে অমন যুদ্ধের কথা যাদের কানে পড়েছিল, তাদের একজন একটু ভাবুক গোছের। গলা উঁচু করে এক গাট্টাগোট্টা শ্রমিক-মৌমাছিকে বলল, “জানো তো, রানিদের যেমন কত কত দাসদাসী থাকে, আমাদের রানিমা’রও দাসদাসী তুমি গুনে শেষ করতে পারবে না। যদিও তুমি অঙ্কে খুব কাঁচা।”

গাট্টাগোট্টা মৌমাছিটা একটুক্ষণ চুপ করে থাকল। তারপর বলল, “অত দাসদাসী যে থাকে রানিমা’র কাছে, তাদের কাজটা কী?”

ভাবুক মৌমাছি বলল, “ও মা, তাও জানো না? তারা রানিমহলের ভিতরে ঢুকে রানিমা’র খাবারদাবার মুখের কাছে এগিয়ে দেয়। রানিমহলটা ঝক্‌ঝকে তক্‌তকে করে পরিষ্কার করে রাখে। রানিমা কোথায় ডিম পাড়বেন, অনেক ভেবেচিন্তে সে জায়গাটাও ঠিক করে দেয় তারা।” খানিক চুপ করে থেকে ভাবুক মৌমাছি মুখটা নিচু করে বলল, “জানো তো, তাদের কেউ কেউ আবার রানিমা’র গা-হাত-পা টিপে দেয়। কেউ কেউ আবার চুপ করে রানিমা’র পাশে বসে থাকে, নানা গল্পগাছা শোনায়। তারপর যখন রানিমা’র মন জুড়ে আবেশ নেমে আসে, চোখ দুটো ঘুমে ঢুলু করে, তখন কেউ কেউ রানিমা’র মাথায় হাতও বুলিয়ে দেয়। তারপর রানিমা ঘুমিয়ে পড়লে তাদেরও গল্প বলার ছুটি হয়।” গলাটা আরও নিচু করে সে চারদিকে তাকিয়ে দেখে নিয়ে বলল, “এসব কথা যেন ভুলেও পাঁচকান কোরো না!”

সে দু-তিনবার ঘাড়টা দুলিয়ে বলল, “কেন, এসব কি দোষের কথা নাকি?”

ভাবুক মৌমাছি চোখ দুটো বড়ো বড়ো করে বলল, “দোষের নয়? বল কী? এখন হল গিয়ে সমান সমান যুগ। রানি হলেও এসব কাজ করানো নাকি কোনও আইনের বইয়ে লেখা নেই।”

কিন্তু শোনার পর থেকে ‘অঙ্কে কাঁচা’ কথাটা তার গায়ে খচ্‌খচ্‌ করে বিঁধতে লাগল গাট্টাগোট্টা মৌমাছির। সে মুখ ভার করে বলল, “অঙ্কে কাঁচা হই আর পাকাই হই, রাজা-রানির ঘরের ভিতরের খবর রাখার দরকারটা কী? আমার ফুলে ফুলে ঘুরে মধু জোগাড় করার কথা, সেটুকুই ঠিক মতো করি না কেন! যার যা কাজ তার সেই কাজ করে ফেললেই তো হল।”

সে হেসে হেসে বলল, “না না, খবর রাখতে হয় না গো, খবর তো বাতাসে ওড়ে। এই যেমন, আমাদের তো একজন রানি-মৌমাছি ছিল বলেই এতদিন জানতাম। আজ আর-একজন রানি-মৌমাছি কোত্থেকে এলেন শুনি? এ গুজব নয়তো?”

একটু বয়স্ক গোছের এক শ্রমিক-মৌমাছি তিনবার ঘাড় নাড়ল বিজ্ঞের মতো। তারপর বলল, “দ্যাখো, বড়োদের বিষয়ে গুজব যে একদম ছড়ায় না, সে কথা বলা ঠিক হবে না। গুজব ছড়ায়, খুবই ছড়ায়।”

সকলে তাকে ঘিরে ধরল, “হ্যাঁ গো, দুই রানি-মৌমাছির কথাও তবে কি গুজব? তা হলে যুদ্ধটুদ্ধ সব ফক্কা কথা?”

সে বলল, “সে আমি তোমাদের বিশদ বলতে পারব না। তবে একটা কথা তোমাদের বলে রাখি, যুদ্ধের গুজব কিন্তু খুব তাড়াতাড়ি ছড়ায়, আর অনেক ভুল খবরও ছড়ায়। এই দ্যাখো না, সকাল হয়েছে কি হয়নি, অমনি শুনলাম, দুই রানি-মৌমাছিতে নাকি তুমুল যুদ্ধ লেগে গেছে।”

খবরের গন্ধ ছড়িয়ে পড়তে না-পড়তেই, যুদ্ধের দিক থেকে ভিড় কিছুটা সরে আসতে লাগল ওই মৌমাছিটার দিকে। সকলে জানতে চাইল, “হ্যাঁ গো, দু’জন রানি-মৌমাছির খবরটা কি তা হলে ঠিক? তা যদি রানি দুজনই হন, তাঁরা না হয় একসঙ্গে থাকুন না রানিমহল ভাগাভাগি করে? আমরা না হয় দুজনকেই মান্য করি আজ থেকে? তা হলেই তো হল? যুদ্ধ কি ভালো জিনিস?”

সে তেমনই বিজ্ঞ বিজ্ঞ মুখ করে বলল, “রানিরা যে একজন আর-একজনকে দেখতেই পারে না। এ কি তোমার আমার কথা? আর যদ্দুর জানি, রাজা-রানিরা যুদ্ধ খুব পছন্দ করেন কিনা! তবে শুনলাম, খানিকটা দূরের বুল্টিদের বাতাবি লেবুর গাছের একটা যে ছোটো মৌচাক আছে, তারই রানি-মৌমাছির নাকি আমাদের এই মক্ষিকানগরের রানি হওয়ার সাধ হয়েছিল বেশ ক’দিন ধরে। তাই তিনি বলা নেই কওয়া নেই, আজ আঁধার থাকতে থাকতেই সাঁত করে ঢুকে পড়েছেন মক্ষিকানগরে। তখন আমাদের রানিমা’র ভোরের ঘুম ভালো করে ভেঙেছে কি ভাঙেনি। পাখিরা তখনও কিচিরমিচির করেনি। বলো দেখি কী কান্ড!”

সকলে একসঙ্গে বলে উঠল, “কেন, কেন? তারা কোথায় ছিল, যাদের উপর এই মক্ষিনগর পাহারা দেওয়ার হুকুম আছে? বিপদ বুঝলে ডানা কাঁপিয়ে ঝন্‌ঝন্‌ শব্দ তুলে তাদেরই তো সকলকে জানিয়ে দেওয়ার কথা? তা হলে তারা কি ঠিকমতো কাজ করছিল না?”

হঠাৎ এসব কথা চাপা পড়ে গেল। রানিমহলের দিক থেকে শ্রমিক-মৌমাছি, পুরুষ-মৌমাছিদের চিৎকার, চেঁচামেচি আর কোলাহল ভেসে এল। তারপর জয়ধ্বনি শোনা গেল, “নতুন রানিমা’র জয়!”

মক্ষিকানগরের সকলেই জানল, এবার তবে যুদ্ধে শেষ। সেই বিষাদের খবরটা ছড়িয়ে পড়ল নিমেষে, মক্ষিকানগরের রানি-মৌমাছির মৃত্যু হয়েছে। হঠাৎ করে কেমন যেন চুপ হয়ে গেল গোটা মক্ষিকানগর! রানি-মৌমাছির অত বড়ো রানিমহলের সামনে থেকে ভিড় পাতলা হতে লাগল। সকলেই উঁকি দিয়ে দেখে যেতে লাগল, অমন দাপুটে রানিমার নিথর শরীরটা পড়ে আছে। তাঁর পাশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে আছে মক্ষিকানগরের আরও কয়েকজন প্রহরী-মৌমাছির নিথর শরীর। তারা প্রাণ দিয়েও রানি-মৌমাছিকে বাঁচাতে পারেনি!

একটু পরে কথাটা রাষ্ট্র হয়ে গেল মক্ষিকানগরে। যে মক্ষিকানগরে সারাদিন ধরে চলে নানা ব্যস্ততা। কেউ মধু জোগাড় করতে বেরিয়ে যায় দূরের মানালিদের জুঁই-বেল ফুলের বাগানে। কেউ মৌচাকের ভিতরের ময়লা আর নোংরা সাফাই করতে লেগে পড়ে। কেউ কেউ মৌচাকটা কী করে আরও বড়ো করা যায়, সে নিয়ে শুরু করে দেয় নানা প্ল্যান। কেউ মৌচাকে কতটা মধু জমা আছে, তার নিত্যদিনের মাপজোখ করতে থাকে। কেউ কেউ সৈন্যদের মতো ঢাল-তলোয়ার কোমরে ঝুলিয়ে বুক উঁচিয়ে মক্ষিকানগর পাহারা দিতে ঠায় দাঁড়িয়ে পড়ে সারা দিনের জন্যে। আজ সব থেমে থাকল।

নতুন রানি-মৌমাছির ঘনঘন শ্বাস পড়ছে। চোখ জ্বলছে আগুনের মতো। তাঁর হাতে-পায়ে লেগে আছে মক্ষিকানগরের এতদিনের রানি-ইতিহাসের ছেঁড়াখোঁড়া টুকরো। প্রহরীদের মধ্যে যে সবচেয়ে বড়ো মৌমাছি, সে মিন্‌মিন্‌ করে পড়ে থাকা প্রহরী-মৌমাছিদের দিকে হাত দেখিয়ে নতুন রানি-মৌমাছিকে বলল, “রানিমা, শ্রমিক-মৌমাছিদের বলি, রানিমহলের বাইরে এক কোনায় এদের জন্যে একটা শহিদ বেদি…”

কথাটা শেষ করতে দিলেন না নতুন রানি-মৌমাছি। গম্ভীর গলায় বললেন, “তার কোনও দরকার নেই!” তারপর তর্‌তর্‌ করে রানিমহলের সোনালি মোমের মায়াময় তোরণের উপর উঠে গেলেন তিনি। সোজা হয়ে দাঁড়িয়ে সামনের দুটো পা উঁচু করে ঘোষণা করলেন, “কে আছ, আমার বিজয়-নিশান নিয়ে এস!”

রিন্টিদের গোলাপ বাগানের ফুলের পাপড়ির একটা ছোট্টো টুকরো কখন যেন উড়ে এসে জড়িয়ে গিয়েছিল মক্ষিকানগরের গায়ে। দুটো শ্রমিক-মৌমাছি সেই টুকরোটা টানতে টানতে নিয়ে এল নতুন রানি-মৌমাছির সামনে। তিনি সামনের দুটো পায়ে সেই গোলাপ পাপড়ির ছোট্টো টুকরোটা নিশানের মতো তুলে ধরে ঘোষণা করলেন, “আজ থেকে আমিই মক্ষিকানগরের রানি-মৌমাছি!” বলে তিনি রানিমহলের ভিতরে ঢুকে গেলেন। ফের মক্ষিকানগরের রাজ্যের চাকা গড়াতে শুরু করল নিজের নিয়মে। গাছে গাছে উড়ে বেড়াচ্ছে বসন্ত আসার খবর।

হঠাৎ সমস্ত মৌমাছি যে-যার নিজের নিজের কাজে যাওয়ার আগে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখল, সবে হাঁটতে শিখেছে এমন কয়েকটা খুদে মৌমাছি গুট্‌গুট্‌ করে কোথায় যেন চলেছে। সকলে ঘাড় উঁচু করে জিজ্ঞেস করল, “অ্যাই ছোটোরা, তোমরা আবার এখন কোথায় চললে?”

তারা বলল, “না গো, আমাদের হাতে একটুও সময় নেই! আমরা এখন রানিমহলে যাচ্ছি, নতুন রানি-মৌমাছির সিংহাসন সাজাতে!”