গল্প মৈনাকের নাকমলা-রাজীবকুমার সাহা

galpomoinak01 (Medium)।।১।।

আমরা তখন ক্লাস নাইনে। সবেমাত্র হাফ ইয়ারলি পরীক্ষা শেষ হয়েছে। হঠাৎ একদিন ক্লাসে গিয়ে দেখি পাশের বেঞ্চে এক নতুন বন্ধুর আগমন ঘটেছে। ঘাড় ফিরিয়ে ফিরিয়ে সবাই তাকেই দেখছে। যদিও বন্ধুত্বের পরিভাষাটা ততদিনে আমাদের কাছে একটু পালটে গিয়েছে। সারা ক্লাস জুড়ে বন্ধুত্বের ব্যাপ্তিটা তখন অনেকটাই গুটিয়ে এনে যে যার মতো করে ছ’সাতজনের একেকটা গ্রুপ তৈরি করে ফেলেছে। গ্রুপে যারা আছে বন্ধু বলতে তারাই আর বাকিরা ক্লাসমেট এমন একটা ভাব এসে গিয়েছে। বইপত্র ডেস্কে ঢুকিয়ে পাশে বসা তন্ময়কে নিচু গলায় জিজ্ঞেস করলাম, “হ্যাঁ রে, ছেলেটি কে জানিস?”

তন্ময় দু’দিকে মাথা নাড়ল।

“নাম?”

“উঁহু।”

অগত্যা আমাকেই উঠতে হল। কাছে গিয়ে জিজ্ঞেস করলাম, “তোমার নাম কী ভাই?”

ছেলেটি একটু থতমত খেয়ে বলল, “মৈনাক রায়।” বলেই একটা অদ্ভুত ভঙ্গিতে তাকিয়ে রইল আমার দিকে। পরে দেখেছিলাম ওর একটা চোখ অল্প ট্যারা। তাই হয়ত ওর চাউনিটা আমায় একটু অস্বস্তিতে ফেলে দিয়েছিল। নিজের বেঞ্চে ফিরে যেতে যেতে টেরিয়ে টেরিয়ে দেখলাম, উনি নামেও মৈনাক কাজেও মৈনাক। গায়েগতরে ছোটোখাট একটা পাহাড়ের মতই দেখতে। আমাদের পুরাণে মৈনাক নামে একটা পাহাড়ের কাহিনী আছে না, সেই যেটাতে বাসুকি নামে এক মস্ত বড় সাপকে জড়িয়ে দেবতা আর অসুররা মিলে সমুদ্র মন্থন করেছিলেন অমৃতের লোভে!

আস্তে আস্তে জানতে পারলাম ওর বাবা আমাদের থানায় নতুন বদলি হয়ে এসেছেন। আমাদের স্কুলটা এ নিয়ে মৈনাকের চার নম্বর স্কুল। আমি চটপট ওর সাথে ভাব জমাতে শুরু করলাম। আগেকার স্কুলগুলোতে পড়াকালীন ওর গালগল্প শুনতে শুনতে মনে হল, মৈনাকবাবু লেখাপড়ায় তেমন চৌকশ না হলেও, দুষ্টবুদ্ধি আর দৌড়ঝাঁপে রীতিমত উস্তাদ লোক। ইদানীং হরবোলাতেও নাকি গলা পাকাচ্ছে বলল। ওকে আমাদের গ্রুপের মধ্যে টেনে নিলাম দিনে দিনে। কারণ, অন্য গ্রুপগুলোও ওঁত পেতে আছে।

দু’একদিনেই টের পেয়ে গেলাম যে মৈনাকের প্রধান দুর্বলতা হচ্ছে বিভিন্ন মুখরোচক খাবার। যেগুলো খেলে তোমার আমার পেট খারাপ হয় সেগুলো। সময় থাকতে সেই টোপটা ফেলেই আমাদের গ্রুপের একজন করে নিলাম ওকে। তোমাদের বলতে বাধা নেই, ক্লাসের অনেকেই আমায় আড়ালে আবডালে মিচকে শয়তান বলে ডাকে আমি জানি।

কিন্তু দিনে দিনে টের পেলাম ওকে দলে টানাটা ছিল আমার একটা সর্বনেশে ভুল। মৈনাক আমাদের দলে আস্তে আস্তে লিডার হয়ে উঠতে লাগল। নিজে একটা দুটো বই খাতা নিয়ে স্কুলে আসা, বাকিগুলো পাশের জনের কাছ থেকে জোর করে টেনে নেওয়া, হোমওয়ার্ক থাকলে আরেকজনের খাতা টেনে নিয়ে জবরদস্তি কপি করা, চুল টেনে দেওয়া, পেছনে বসে আলতো করে দু’আঙুলে জামা টেনে ধরে কলমের কালি লাগিয়ে দেওয়া ওর নিত্যকার কর্ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। প্রতিবাদ করলে এ ওর কলম, পেন্সিল এনে লুকিয়ে আমাদের ব্যাগে ঢুকিয়ে রেখে চোর সাজিয়ে দিচ্ছে। আর টিফিনের কথা তো বলেই লাভ নেই। কেউ মিনমিনে গলায়ও যদি কিছু প্রতিবাদ করেছে তো আজ তার টিফিন হাপিস হবেই হবে। শেষপর্যন্ত হাল ছেড়ে দিয়ে ওর সাথে কথা অবধি বন্ধ করে দেখেছি আমরা। কোনও লাভ হয়নি। ও নিজের মতো সব চালিয়ে যাচ্ছে, আর রাগে দুঃখে আমাদের গা জ্বলে যাচ্ছে।

     একদিন হয়েছে কী, টিফিন আওয়ারের শেষের দিকে রঞ্জন হঠাৎ ক্লাসে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে বলল, “মৈনাকের খবর পেয়েছিস?”

আমি হতচকিত হয়ে বললাম, “না, কী করেছে? কোথায় ও?”

“ছাদে। নামিয়ে আনছে।”

“কারা নামিয়ে আনছে?”

“গৌরস্যার, মিনুমাসি আর বিমলেন্দু মিলে।”

“কেন? কী হয়েছিল?”

“আরে, একটু আগে বিমলেন্দুদের সাথে ছাদে উঠে মাথা ঘুরে অজ্ঞান হয়ে গেছে হোঁৎকাটা!”

“বলিস কী?” আমার চোখদুটো গোলগোল হয়ে গেল।

“ছাদের আলসেতে বুক দিয়ে দাঁড়াতেই আস্তে আস্তে নাকি বসে পড়ে। তারপর ক্যান্টিনের মিনুমাসি আর গৌরস্যার মিলে জলটল দিয়ে…”

বলতে বলতেই ভেজা বেড়ালের মতো ক্লাসে ঢুকল মৈনাক। ও গ্রুপের বিমলেন্দুরা তখনও কয়েকজন মিলে কর্ডন করে আছে ওকে। আমি উঠে গিয়ে শান্ত গলায় বললাম, “কী হয়েছিল রে মৈনাক?”

জিজ্ঞেস করা মাত্রই মৈনাকের চোখদুটো যেন জ্বলে উঠল। খ্যাঁক করে উঠে বলল, “কী হয়েছে না হয়েছে, তাতে তোর কী র‍্যা? যা যা, নিজের জায়গায় যা।”

তারপর নিজের মনেই গজ গজ করতে লাগল, “জেনে রাখিস মৈনাক কোনও কিছুতেই ভয় পায় না। শুধু আজ সকালের খাওয়াটা ঠিক জুত করে খেতে পারিনি বলে… ওসব ভয় ডর আমার নেই, বুঝলি?”

।।২।।

সেদিন আমাদের স্কুলে বিরাট অনুষ্ঠান। স্কুলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী হিসেবে পঞ্চাশতম অর্থাৎ স্বর্ণজয়ন্তী। বিকেল তিনটে থেকে শুরু হয়ে রাত আটটা অবধি চলবে। নাচ, গান, আবৃত্তি, গল্প বলা, আকস্মিক বক্তৃতা থেকে শুরু করে একেবারে শেষে একটা নাটক দিয়ে অনুষ্ঠানের সমাপ্তি ঘটবে। মাঝে বিশেষ আকর্ষণ মৈনাক রায়ের হরবোলা। আমরা কয়েকজন আগে থেকেই নাটকে নাম লিখিয়ে দিলাম।

অনুষ্ঠান শুরু হল, চলতে চলতে সন্ধ্যা ঘনিয়ে এল। একসময় স্টেজে মৈনাকের ডাক পড়ল। পশু-পাখির বিভিন্ন আওয়াজ নকল করে মৈনাক কসরত দেখাল। আমরা কয়েকজন গোমড়ামুখ করে আর বাকিরা খুশি মনে হাততালি দিল। এবার চা বিরতি, সঙ্গে একটু জলযোগের ব্যবস্থা। আমরা পা চালিয়ে স্টেজের পেছনে গ্রিনরুমের কাছাকাছি যেতেই মনে হল কে যেন সড়াৎ করে আড়াল হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলার স্লেট রঙের অন্ধকারে ঠিক চিনতে পারলাম না। গ্রিনরুমে ঢুকে আমাদের জন্য নির্দিষ্ট করা বেঞ্চের কাছে এসে দেখি তিনটে টিফিনের বাক্স একটার ওপর একটা রাখা আর সবার ওপরে একটা চিরকুট। ‘তোদের টিফিনগুলো আমার ভোগেই লাগল। জানিস তো আমার পারফরমেন্সে কতটুকু এনার্জি লাগে! তাছাড়া ওসব ছাইপাঁশ গিলে তোরা স্টেজে উঠে ডায়ালগ বলতে পারবি না। চোঁয়া ঢেঁকুর তুলবি। — মৈনাক।’

কেন যেন দুম করে মাথাটা গরম হয়ে গেল। খোঁজাখুঁজি করে হোঁৎকাটাকে বের করে নিলাম একচোট। অনেকদিনের জমানো রাগের চোটে তোতলাতে লাগলাম আমি। শেষে মল্লিকস্যার এদিক দিয়ে যাওয়ার সময় হোঁৎকাটা হঠাৎ স্যারের পিছু নিয়ে নিল। একটু এগিয়ে পেছন ফিরে আমায় একটা ঘুষি পাকিয়ে দেখিয়ে স্যারের পেছন পেছন চলে গেল।

আমরা আর কী করব, রাগে দুঃখে গিয়ে স্টেজের পাশে বসে রইলাম। একসময় আমাদের মেক-আপের সময় হল। তারপর নির্দিষ্ট সময়ে স্টেজে উঠে যে যার পার্ট সেরে টেবিল, চেয়ার, বেঞ্চ ক্লাসে তুলে দিয়ে বাড়ির দিকে রওনা হলাম।

galpomoinak02 (Medium)তখন ঘড়ির কাঁটা ন’টা পেরিয়ে গিয়েছে। গ্রাম্য এলাকা, চারদিক ঘুটঘুটে অন্ধকার। সৌরভ, তন্ময় আর আমার বাড়ি একদিকে। তিনবন্ধু মিলে রওনা হলাম পাড়ার দিকে। সৌরভের বাড়ি সবচেয়ে আগে পড়ে। ও বাড়িতে ঢুকে গেল। তারপর তন্ময়। তন্ময় আর আমার বাড়ির মধ্যে বেশ একটা তফাৎ আছে। মধ্যে একটা ফাঁকা জায়গা পড়ে। রাস্তার দু’দিকে ঘন গাছপালা আর ধানক্ষেত। অন্ধকারে রাস্তাটা প্রায় দেখাই যাচ্ছে না। তন্ময় অবশ্য ওর বাবা বা দাদাকে ডেকে এনে রাস্তাটা পার করে দিতে চাইছিল বারবার। আমি রাজি হচ্ছিলাম না। ভাবলাম এক শ্বাসে দৌড়ে পেরিয়ে যাব জায়গাটা। তন্ময়ের ঘরে ঢুকে যাবার অপেক্ষা করছিলাম শুধু। ওর সামনে দৌড় দিলে কাল স্কুলে গিয়ে বলে দেবে।

ওদের বাড়ির গেটে দাঁড়িয়ে আর এক দফা ওই হোঁৎকাটার শ্রাদ্ধ শেষ করে তন্ময় ঘরে ঢুকে গেল একসময়। আমিও হাঁটার গতি বাড়াতে বাড়াতে প্রায় দৌড়ের পর্যায়ে নিয়ে এলাম। হঠাৎ চোখের সামনে একটা কিছু দেখে থমকে দাঁড়িয়ে পড়লাম। দেখি কী, অল্প একটু দূরে একটা আগুনের গোলার মতো কী একটা কখনও গোল্লা গোল্লা হয়ে আবার কখনও হিজিবিজি করে অন্ধকারের মধ্যে আঁকিবুঁকি কাটছে। সাথে হা হা হি হি উৎকট শব্দ হচ্ছে। আমার পা দু’টো যেন মাটিতে গেঁথে গেল। সারাটা শরীর ঝিম মেরে মাথাটা দপদপ করতে লাগল। টাকরাটা শুকিয়ে যেন কাঠ। হঠাৎ দেখি আগুনের গোলাটা আস্তে আস্তে এগিয়ে আসছে আমার দিকে। পা দু’টো যেন ছিটকে বেরিয়ে এল মাটি থেকে। উল্টো পায়ে পড়িমরি করে দৌড় লাগালাম তন্ময়ের বাড়ির দিকে।

     পনেরো কুড়ি মিনিট পর একটু ধাতস্থ হয়ে তন্ময়, ওর বাবা, দাদাসহ এসে দেখলাম কিচ্ছুটি নেই। যেন ভোজবাজি! তারপর খুঁজতে খুঁজতে একটা মোটা কাঁঠালগাছের গুঁড়ির পেছন থেকে বেরুল কালো রং করা একটা প্যাঁকাটি। আগায় আধপোড়া একটা ন্যাকড়া জড়ানো।

পরের দিন স্কুলে যাওয়ার আগেই সব জানাজানি হয়ে গেল। চোখ ফেটে জল বেরিয়ে এল আমার। কয়েকদিনের মধ্যেই জানা গেল ঘটনার সাথে শুধু ওই হোঁৎকাটাই নয়, বিমলেন্দুও জড়িত ছিল।

ঘটনাটা অচিরেই সোনাইদার কানেও গেল। সোনাইদার সাইকেলের দোকান। কয়েকদিন যাইনি ওর দোকানে। একদিন বিকেলের দিকে নিজেই পাকড়াও করে নিয়ে গেল। আমার দিকে এক পলক তাকিয়ে একটা মোড়া এগিয়ে দিল। মুখে একটা মুচকি হাসি যেন খেলে গেল দেখলাম। কান দু’টো গরম হয়ে গেল আমার। ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, “বসব না যাও। আর কখনও আসবই না তোমার দোকানে।”

সোনাইদা হাসির পরিমাণটা আরও বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করল, “সে কী রে! কেন? আমি আবার কী করলাম?”

“তুমি শোননি কিছু?”

“হ্যাঁ, তা শুনেছি।”

আমি ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম। কী বলব এরপরে বুঝতে পারছি না। সোনাইদা চোখদুটো কুঁচকে আমার মনটা যেন একটুক্ষণ পড়ল। তারপর হঠাৎ গলাটা খাদে নামিয়ে চোখ টিপে বলল, “বোস, কথা আছে। প্ল্যান করতে হবে। শলা বুঝিস? শলা?”

।।৩।।

ডিসেম্বরের মাঝামাঝি। ক্লাস নাইনের অ্যানুয়াল পরীক্ষা শেষ হয়েছে মাত্র। পরীক্ষা যা দিয়েছি, টেনেটুনে টেনে উঠে পড়ব মনে হয়। মৈনাকের উপর রাগটা মনের কোণে লুকিয়ে থাকলেও ওর সাথে কখনও খারাপ ব্যবহার করিনি। কখনও কোনও প্রতিশোধ নেওয়ার চেষ্টা করিনি। সোনাইদাই বারণ করেছে। বরং মৈনাককে আরও বেশি প্রশ্রয় দিয়েছি, আরও বেশি খাইয়েছি।

গতকাল থেকে স্কুল মাঠে সার্কাস বসেছে। সাথে নাগরদোলা। নানান রকম দোকানপাট মিলিয়ে জমজমাট একটা মেলা মতো বসে প্রতি বছর। চলে দশ বারোদিন। সোনাইদাই এর প্রধান উদ্যোক্তা। ও আর কয়েকজন বন্ধু মিলে অর্গানাইজ করে পুরোটা মেলা।

আজ সন্ধের পর দোকানে গিয়ে সোনাইদার সাথে দেখা করে এসেছি লুকিয়ে। তারপর সন্ধে সাতটা নাগাদ বন্ধুদের সাথে মেলায় বেরিয়েছি। একটু পর মায়ের সাথে মৈনাকও এল। আমাদের দেখতে পেয়েই ছিটকে মায়ের কাছ থেকে চলে এল মৈনাক। আমরা তখন একটা তেলেভাজার দোকানের সামনে। মৈনাকসুদ্ধ পাঁচজনে একে একে পাঁচ রকমের তেলেভাজা খেলাম। পাঁচজন পালা করে খাওয়াল। আমার কিন্তু আজ তেলেভাজা, ময়রা, বাদামভাজা নয়, মনটা পড়ে আছে বিভিন্ন স্বাদের জুস, মিল্ক আর বাদামশেকের দিকে। আস্তে করে মৈনাককে নিয়ে সটকে পড়লাম। তারপর মেলার ভিড়ে নিজে থেকেই হারিয়ে গিয়ে একের পর এক বেশ কয়েকটা গ্লাস জুস আর শেক গিলে একসময় তন্ময়, সৌরভদের দলে গিয়ে ভিড়লাম। পকেটে আর পয়সা নেই, পেটেও আর জায়গা নেই। গলা অব্দি উঠে গেছে জুস আর শেক। শেষবারেরটা খেতে খেতে ঢেঁকুর তুলতে গিয়ে মৈনাকের তো নাকমুখ দিয়ে বেরিয়েও পড়ল খানিকটা।

যাই হোক, এবার আমি নাগরদোলা চড়ার প্রস্তাব দিলাম। কেউ রাজি, কেউ নিমরাজি তো কেউ গররাজি। যে যার মতো করে কৈফিয়ত দাখিল করে অব্যাহতি পেতে চাইছে। মৈনাক একটা দেঁতো হাসি টেনে বলল, “আজ হবে না রে! আমি টাকা পয়সা বেশি আনিনি। যা ছিল তেলেভাজাতেই গেল। কাল হান্ড্রেড পার্সেন্ট হবে। তোদের সবাইকে চড়িয়ে দেব, যা।”

     তন্ময় একটু মুচকি হেসে বলল, “ভয় পাচ্ছিস?”

     মৈনাক তখন তেলে বেগুনে জ্বলে উঠল, “ভয়! যা যা মেলা বকিস না। ওসব আমি পাই-টাই না। অমন নাগরদোলা আমি কত…”

     “মৈনাক নাগরদোলা চড়তে ভয় পায় না, কিন্তু দোতলার ছাদে উঠে নীচে তাকালেই…” আমি ফুট কাটলাম। সাথে সাথেই হাসির একটা ফোয়ারা বয়ে গেল। মৈনাক তো চটে লাল। কী বলবে ভেবে পাচ্ছে না। থমথম করছে গোটা মুখখানা।

     একটু পরেই তোতলাতে তোতলাতে বলল, “ঠি-ঠিক আছে। কাল নয়, আ-আজই চড়াব তোদের।”

     আমি লজ্জা লজ্জা মুখ করে মিনমিনে গলায় বললাম, “একটা টিকিট কম কাটিস ভাই। আমি কিন্তু চড়ছি না। আমার ভীষণ ভয় করে।”

     দু’চোখ ভরা আকুতি নিয়ে মৈনাকের দিকে তাকাতে ও কটমট করে তাকিয়ে বলল, “ভীতুর ডিম কোথাকার! আবার সর্দারি ফলাতে এসেছ কেন এখানে? কই রে, চল তোরা।”

     বলে হনহন করে হাঁটা দিল নাগরদোলার টিকিট কাউন্টারের দিকে। আমরাও পিছু নিলাম দ্রুত পায়ে। এত সহজে মৈনাক ফাঁদে পা দেবে বুঝতে পারিনি। ভেবেছিলাম আরও অনেক ঘোরপ্যাঁচ কষতে হবে, তারপরও না হলে সরাসরি চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে দিতে হবে। কিন্তু না, প্রথম খেপেই ওই হোঁৎকাটার মাথায় রক্ত চেপে গেছে। আমি প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে দেখলাম, না, জিনিসটা ঠিকই আছে।

     নাগরদোলার গেটের ওপারে টিকিটের কাউন্টার পার্ট হাতে নিয়ে যে যার সিটে বসে লোহার শিকের আগলটা লাগিয়ে দিয়েছে। আস্তে আস্তে নাগরদোলার বিরাট চাকাটা ঘুরতে শুরু করেছে। হালকা একটা গোঁ গোঁ আওয়াজ করে একটু একটু করে স্পিড নিচ্ছে। আমি মুখে একটা মলিন হাসি টেনে গেটের বাইরে দাঁড়িয়ে আছি। গেট বলতে তিন চার ফুট উঁচু লোহার একটা জানালা বা রেলিঙের মতো। সবকিছুই দেখা যাচ্ছে। দেখতে পাচ্ছি, তন্ময়রা সবাই বেশ রিল্যাক্সড মুডেই বসে আছে বা হালকা ভয়টাকে বেশ ভাল ভাবেই গোপন করে রেখেছে। কিন্তু মৈনাকবাবাজি শক্ত হয়ে যেন কাঠ হয়ে গেছে। নাগরদোলার হালকা দুলুনিটাকে কিছুতেই ব্যালেন্স করতে পারছে না। ফলে ওর আর তপেশের খাঁচাটা বেশি করে দুলছে। তপেশ বারবার মৈনাককে কী যেন বুঝিয়ে চলেছে। আমার সামনে দিয়ে ওরা সাঁৎ সাঁৎ করে বারতিনেক নেমে আবার উঠে গেল। স্পষ্ট দেখতে পেলাম মৈনাক নামার সময় চোখ বুজে ফেলছে আর সিটটাকে আঁকড়ে ধরে রাখছে আবার ওপরে ওঠার সময় চোখ খুলে মিটিমিটি তাকাচ্ছে।

আমার কাউন্টডাউন শেষ। এবার খেল দেখাবার পালা। প্যান্টের পকেটে হাত ঢুকিয়ে জিনিসটা বাইরে এনে মুঠোর মধ্যে রাখলাম। মৈনাকদের খাঁচাটা নেমে আসছে। চিৎকার করে বললাম, “মৈনাক সর্বনাশ হয়েছে! তোর সিটের একটা নাটবল্টু খুলে পড়ে গেছে নীচে। এই দেখ আমার হাতে।”

মৈনাক ততক্ষণে আবার ওপরে ওঠে যাচ্ছে। চেহারার এক্সপ্রেশনটা দেখতে পাইনি ভাল করে। তবে ভাবভঙ্গীতে বুঝতে পারলাম কথাটা কানে গেছে। কারণ, সাথে সাথেই এদিক ওদিক আর নিচের দিকে একবার তাকিয়ে মৈনাক পাশে বসা তপেশকে আঁচড়াতে খামচাতে লাগল। তাতে খাঁচাটা আরও দুলে গিয়ে নীচে নামতে শুরু করল। আর নীচে নেমে আবার উঠতে গিয়েই কেলেঙ্কারি! হঠাৎ দেখলাম মৈনাকদের পরের খাঁচাগুলোর সবাই যতটুকু পারে ঘাড় পিছনে নিয়ে ওপরের দিকে তাকাচ্ছে আর চোখ মিটমিট করছে। পরক্ষণেই সবাই মাথা নিচু করে মুখ মুছছে আর কাপড়চোপড় ঝাড়ছে। ওদের মাথায় হালকা গরম জলের বৃষ্টি হচ্ছে। বেশ কয়েকজনের চিৎকার চ্যাঁচামেচিতে অপারেটর ঘাবড়ে গিয়ে দুই রাউন্ড বাকি থাকতেই নাগরদোলার ইঞ্জিন বন্ধ করে দিল। আমি হাঁ করে কতক্ষণ দাঁড়িয়ে ছিলাম জানি না। হঠাৎ সম্বিত ফিরে পেতেই ভিড়ের মধ্যে কাউকে ঠেলে, কাউকে মাড়িয়ে চোঁ চা দৌড়।

 আস্তানা একটাই। সোনাইদার দোকান। দোকানে ঢুকে হাঁপাতে হাঁপাতে সোনাইদাকে থাম্বস আপ দেখালাম। সোনাইদা মুচকি হেসে একটা মোড়া এগিয়ে দিল। তারপর সব শুনে বলল, “ওই গরম জলের বৃষ্টির চান্সটা কিন্তু ফিফটি ফিফটি ছিল। তা হ্যাঁ রে, মৈনাকবাবু এখন কোথায়? বাড়াবাড়ি কিছু হয়নি তো আবার?”

“না। হোঁৎকাটা নাগরদোলা থেকে বেরিয়ে গেটের কাছাকাছি পর্যন্ত আসতেই তো আমার হুঁশ হল। দিলাম দৌড়।”

কতক্ষণ পর বাবা এসে হানা দিল সোনাইদার দোকানে। গলা অব্দি মিল্ক আর বাদামশেক গিলে জোর বাথরুম পেয়েছিল অনেক আগে থেকেই। সারতে গিয়েই হয়তো নজরে পড়ে গিয়েছিলাম। বাবা ঢুকে কান ধরে হিড়হিড় করে টেনে নিয়ে গিয়েছিল বাড়িতে। তারপর দরজা বন্ধ করে চ্যাঙাব্যাঙা করে পিটিয়েছিল আমাকে।

পরে খবর নিয়ে জেনেছিলাম, মৈনাক সেদিন ভেজা প্যান্টের ওপর ওর মায়ের গায়ের চাদর পেঁচিয়ে মেলা থেকে বেরিয়েছিল। এই ঘটনার  পর থেকে আমাদের দলের সাথে মৈনাকের পাকাপাকিভাবে ছাড়াছাড়ি হয়ে যায়। কথা বলা, এমনকি তাকানো পর্যন্ত বন্ধ। তারপর মাধ্যমিক পরীক্ষার দু’মাসের মধ্যেই মৈনাকের বাবা বদলি হয়ে যান। মৈনাকও চলে যায় স্কুল ছেড়ে। ও এখন কোথায় থাকে, কী করে আমরা কেউ জানি না।  কোনও দিন সামনে দিয়ে চলে গেলেও চিনতে পারব কিনা কে জানে! বড় সাধ হয় একটি বার ওর হাতদু’টি চেপে ধরে ক্ষমা চেয়ে নিতে।

ছবিঃ মৌসুমী