গল্প- শতাব্দি গাছ- সায়ক আমান

Two possibilities exist: either we are alone in the Universe or we are not. Both are equally TerrifyingArthur C Clarke

galposhatabdi (Medium)

বেস ক্যাম্প থেকে বেরিয়ে একবার উপরে তাকালেন ডাক্তার স্টারলিং। হেলিকপটারের গমগমে আওয়াজটা ধীরে ধীরে মিলিয়ে আসছে, চারপাশে তাকালে অন্তত জনা পনের বন্দুকধারী গার্ড চোখে পড়ছে। ডাক্তার স্টারলিংকে বাইরে আসতে দেখে তাদের একজন কপালে হাত ঠেকিয়ে অভিবাদন জানাল। স্টারলিং হাসলেন। মিলিটারির লোকজনকে তিনি সাধারনত এড়িয়ে চলতেই ভালবাসেন।

নীচে তাকালে মনে হয় যেন চারপাশ জুড়ে অন্তহীন মরুভুমি। অথচ এটা মরুভুমি নয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একপ্রান্তে দক্ষিণ নেভাডার কোল জুড়ে একটা মিলিটারি বেস ক্যাম্প। আসল নাম ৪৮০৮ নর্থ। পোশাকি নাম এরিয়া ৫১। এখানে আসার আগে জায়গাটা সম্পর্কে স্টারলিং প্রায় কিছুই জানতেন না। এখানে যে ঠিক কী ধরনের কাজ হয় তা আমেরিকার কিছু উঁচু তলার রাজনৈতিক নেতা আর সেনাবিভাগের লোকজন ছাড়া আর কেউ জানে না। সাধারণ লোকজনকে এটুকুই বলা হয় যে এখানে নবনির্মিত অত্যাধুনিক যুদ্ধাস্ত্রের পরীক্ষা চলে। স্বভাবতই এর চারপাশে জনবসতির চিহ্নমাত্র নেই। তিনদিন আগে জরুরি তলবে এখানে নিয়ে আসা হয়ছে স্টারলিংকে। চিঠিটা পেয়ে প্রবীণ বিজ্ঞানী নিজেও খানিকটা হতবাক হয়েছিলেন। আধুনিক অস্ত্রশস্ত্র সম্পর্কে তাঁর কোনও ধারনাই নেই। তিনি মহাকাশ বিজ্ঞানী, নাসার বিভিন্ন গবেষণাকেন্দ্রে দীর্ঘদিন সিগন্যাল এনালসিস এর কাজ করেছেন। বছরতিনেক হল প্রায় সমস্ত কাজ থেকে অবসর নিয়েছেন বাড়িতে ফুলের বাগান করবেন বলে। এ শখটা তাঁর বহুদিনের।

প্রথমে বাড়ি ছেড়ে কিছুতেই আসতে মন চায়নি তাঁর। বলেছিলেন, “আমার তো বয়স হয়ে গেছে, মহাকাশ বিজ্ঞানে আর তেমন আগ্রহও পাই না, আমার ছেড়ে দাও ভাই।” কিন্তু ভবি ভুলবার নয়। অগত্যা প্রিয় ফুলের বাগান আর পরিবার ছেড়ে তাঁকে আসতে হয়ছে এই জনহীন এই মিলিটারি এয়ার বেসে।

বাইরের খোলা হাওয়ায় কয়েকটা লম্বা নিঃশ্বাস নিয়ে আবার ভিতরে ঢুকে এলেন স্টারলিং। ঠিক সামনেই একটা এলিভেটার, এটায় করে মাটির প্রায় একশো মিটার নীচে অবধি যাওয়া যায়। প্রায় সমস্ত গবেষণার কাজই এখানে মাটির তলায় হয়। মাটির নিচে যে এত ঝাঁ চকচকে অত্যাধুনিক গবেষণাগার যে থাকতে পারে তা নিজের চোখে না দেখলে বিশ্বাস করা কঠিন। এখানেও জনাপাঁচেক সশস্ত্র সেনাপ্রহরী চোখে পড়ে। এলিভেটারে নিচে নামার পর থেকে মোবাইল নিজে থেকেই অকেজো হয়ে যায়। স্টারলিং মুল গবেষণাগারের দিকে পা বাড়ালেন।

গবেষণাগারের ভিতরটা বেশ ছোট। প্রোফেসার আগেই বলেছিলেন, বেশি লোকজন সাথে নিয়ে কাজ করাটা এই বয়সে তাঁর আর ভাল লাগে না। তাঁর অবসরের পরে মহাকাশবিজ্ঞান বেশ খানিকটা এগিয়ে গেছে, সে সব যন্ত্রপাতি ব্যবহার করতে তাঁর খানিকটা অসুবিধা হয়। অবশ্য জেনারেল হেনরি লুকাস কাল নিজে তাঁর সাথে দেখা করে বলে গেছেন যে স্টারলিংএর গবেষণার ব্যাপারে কোনও রকম আপস করা হবে না, যে মুহূর্তে যেটা তাঁর দরকার হবে সাথে সাথে হেলিকপ্টারে হাজির করা হবে।

যাই হোক, যে কাজের জন্য অবসরপ্রাপ্ত বিজ্ঞানীকে এতদুর উড়িয়ে আনা হয়ছে সেই প্রসঙ্গে আসা যাক। এরিয়া ৫১ এ আধুনিক অস্ত্রের গবেষণা চলে বলে মাঝে মধ্যেই বিদেশি বিমান এসে হানাদারি করে যায় আশপাশে। বছরকয়েক হল এই এলাকাটাকে উচ্চনিরাপত্তা এলাকা ঘোষণা করা হয়ছে, বসানো হয়ছে আধুনিক রাডার, রেডিও টেলিস্কোপ। শত্রুপক্ষের যে কোনও বিমান দু মাইলের ধারে কাছে এলেই সতর্ক হয়ে ওঠে সৈন্যরা।

কয়েক সপ্তাহ হল এই টেলিস্কোপে একটা অদ্ভুত ন্যারো ব্যান্ড রেডিও সিগনাল ধরা পড়ছে দিনে দু একবার। ঠিক বাহাত্তর সেকেন্ডের জন্য স্থায়ী হচ্ছে সিগনালটা। তারপর আর ধরা যাচ্ছে না তাকে। এখানকার কর্মরত বিজ্ঞানীরা প্রথমে ভেবেছিলেন যে ব্যাপারটা আশপাশের কোন রেডিও থেকে ঘটছে। এরপরেই ডাক পড়ে স্টারলিংএর। তিনি কাজ হাতে নিয়ে প্রাথমিক কিছু গবেষণা করেই জানান যে বাহাত্তর সেকেন্ডের এই রেডিও সিগনাল পৃথিবীর কোন রেডিও থেকে ট্র্যান্সমিট হচ্ছে না। হচ্ছে সৌরজগতের বাইরের কোনও গ্রহ থেকে। ব্যাপারটা জানাজানি হতেই স্টারলিং-এর সঙ্গে দেখা করেন খোদ জেনারেল হেনরি লুকাস। রেডিও সিগনালের উৎস কোথায় হতে পারে সেই নিয়ে বিস্তর গবেষণা শুরু হয়। অবশ্য সমস্ত ব্যাপারটা গুটিকয়েক বিজ্ঞানী ছাড়া আর কাউকে জানতে দেওয়া হয়নি। যদি সিগনালের কোন ভিনগ্রহী উৎস থাকে তাহলে তার অবশ্যই কোন অর্থ থাকবে। সেইটা খুঁজে বের করতেই ডক্টর স্টারলিং-এর এখানে আসা। অবশ্য তাঁর বাড়ির লোককে এসব কিছুই জানতে দেওয়া হয়নি।

স্টারলিং চেয়ারে বসে একটা কাগজ হাতে তুলে নিলেন, কাগজের উপর থেকে নীচে অবধি প্রচুর সংখ্যা লেখা। রেডিও ট্রান্সমিটারের রিডিং। কাগজের একটা জায়গা লাল কালি দিয়ে গোল করা, একমাত্র সেখানে, নম্বরের সাথে সাথে কতগুলো অক্ষর লেখা আছে। 6EQJ5111 । এই সিগনালটাই ভাঁজ ফেলেছে পৃথিবীর বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীদের কপালে। এর উৎস কোথায়? মহাবিশ্বের ঠিক কোথা থেকে পৃথিবীর বুকে আছড়ে পড়ছে এই সংকেত? প্রায় দিনতিনেকের গবেষণায় এর উৎসের খানিকটা ধারনা করা গেছে। সাজিটেরিয়াস নক্ষত্রপুঞ্জের কাছে অবস্থিত কোন গ্রহ থেকে আসছে এই সংকেত।

দরজার কাছে খসখস শব্দ হতে স্টারলিং মুখ তুলে তাকালেন। তারপর একগাল হেসে বললেন, “এস কেভিন, আজ হাতে বন্দুক নেই যে?”

কেভিন ভিতরে এসে মাথার টুপিটা খুলে টেবিলে রাখল। একটা রিভলভিং চেয়ার টেনে নিয়ে বসে বলল, “আপনি দেখছি মনস্থির করে ফেলেছেন।”

“কী মনস্থির করেছি বল ত?”

“ভিনগ্রহী যে আছে সেটা প্রমান করেই ছাড়বেন।”

বিজ্ঞানীর ঠোঁটের এক কোণায় হালকা হাসি ফুটে উঠল, “হঠাৎ এরকম মনে হল কেন?”

“কেন? আপনিই তো বলেছেন ওই সিগনালটা আসছে ভিনগ্রহ থেকে।”

“সেটা আর নতুন কথা কী?”

“মানে? আপনি বলছেন আগেও এরকম সিগনাল এসেছে?”

“প্রতিদিন আসছে।”

কেভিন আর কিছু বলল না। মাথা নামিয়ে নিল।

“তুমি জানতে চাও কেন আমি বলছি এই সিগনালের পিছনে এলিয়েন থাকলেও থাকতে পারে?”

“বোধয়।”

“বেশ তাহলে শোন। ধরে নাও এই গোটা মহাবিশ্বটা হল একটা বিরাট বড়ো পুকুর। এবার তুমি তার মাঝে একটা ঢিল ছোঁড়, যেখানে ছুঁড়লে তার চারপাশের জল কাঁপতে থাকবে। কাঁপতে কাঁপতে জলে হালকা ঢেউ উঠবে। সেটা চারদিকে এগিয়ে যাবে। আমাদের এই মহাবিশ্ব ঠিক পুকুরের মতই। আর জলটা হল বায়ু। যখনই ঢিল ছুঁড়ে তুমি জলে ঢেউ তুললে, সাথে সাথে একটা তরঙ্গ একদিক থেকে আর একদিকে ছুটে যাবে। আমাদের গ্যালাক্সিতে সব থেকে বেশি পাওয়া যায় হাইড্রোজেন, অর্থাৎ ভিনগ্রহিরা যদি আমাদের গ্রহে কোন সংকেত পাঠাতে চায় তাহলে তারা হাইড্রোজেন লাইনেই পাঠাবে। হাইড্রোজেন লাইনের ভ্যালু প্রায় 1420 mhz. আমরা এখানে যে সিগনালটা পেয়েছি তার ফ্রিকোয়েন্সি 1420 mhz.”

“কিন্তু সেটাতো পৃথিবী থেকেও পাঠানো হতে পারে?”

“নাহ, এত হাই ফ্রিকোয়েন্সির সিগনাল এখানে ব্যাবহার করা নিষিদ্ধ।”

কেভিন দুবার মাথা দুলিয়ে কিছু ভাবার চেষ্টা করল। সমস্ত ব্যাপারটা তার কাছে গুলিয়ে গেছে, স্টারলিং তার দিকে তাকিয়ে একটু হেসে বললেন, “এলিয়েনরা থাকলেই বা তোমার কী? তারা তো…”

কথাটা শেষ না করেই তিনি উঠে পড়লেন, তাঁর চোখে মুখে কেমন যেন স্থম্ভিত ভাব। তাঁকে হঠাৎ করে এরকম উদ্বিগ্ন হয়ে উঠতে দেখে কেভিন খানিকটা চমকে গেল, সে কিছু বলতে যাচ্ছিল, প্রফেসার তাকে থামিয়ে দিলেন, মাথায় একটা হাত দিয়ে চাপা গলায় বললেন, “এখন এস, আমার কিছু কাজ আছে-”

কেভিন বেশি কিছু না ভেবে চলে গেল, এসব পাগলাটে খামখেয়ালি লোকেদের তার এমনিতেই পছন্দ হয় না। মুহূর্তে মুহূর্তে এদের মন বদলায়, এখন আবার কী পাগলামি চেপেছে কে জানে!

সে চলে যেতে প্রফেসার সামনের অতিকায় স্ক্রিনের উপর ঝুঁকে পড়লেন। একটা অসম্ভব ব্যাপার মাথায় আসছে, যেখানে সিগনালের উৎস বলে ধরা হছে সেখানে কোনও গ্রহ এমন কি কোন নক্ষত্রও নেই। তাহলে সিগানালটা আসছে কোথা থেকে? একটু আগেই একটা সম্ভনার কথা মাথায় এসেছিল তাঁর, সেটাকেই একবার খতিয়ে দেখতে ইচ্ছা করল। সিগনালে পাওয়া আলফানিউমেরিক ডিজিটগুলোকে সংখ্যায় ভেঙে ফেললে কি মহাকাশের কোন নির্দিষ্ট জায়গা নির্দেশ করে? অর্থাৎ আলফানিউমেরিক ডিজিট দিয়ে কি কোন ভিনগ্রহের প্রাণী তাদের অবস্থান বোঝাতে চায়?

স্ক্রিনের নীচের দিকে হাত ছোঁয়াতে স্ক্রিন জুড়ে একটা নতুন উইন্ডো ফুটে উঠল, ধীর গতিতে তার উপর কয়েকটা সংখ্যা টাইপ করলেন স্টারলিং, কিছুক্ষণ সব শান্ত, কয়েকটা যান্ত্রিক শব্দের পর স্ক্রিনে যা ফুটে উঠল সেটা দেখে প্রবীণ প্রোফেসারের মনে হল তাঁর পা দুটো অবশ হয়ে আসছে, সমস্ত শরীর থেকে ফেটে বেরোচ্ছে অসহ্য উত্তাপ। না, কোন গ্রহ নয়, যদি যন্ত্রের হিসেব ভুল না হয় তাহলে সিগনালটা আসছে ৩০ লক্ষ আলোকবর্ষ দূরে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের বাইরে অন্য কোন গ্যালাক্সি থেকে।

পরদিন সকালটা অন্য দিনের মতই ঝলমলে। আকাশের এক কোনে হালকা মেঘ জমছে, তাও সূর্য থেকে বহু দূরে তারা। চারপাশে যতদুর চোখ যায় অনন্ত শূন্যতা।  একটু দুরেই একটা ছোট লেক আছে, ভোরের প্রথম আলো তার উপর পরে জলটাকে সোনালি করে তুলেছে। মনে হচ্ছে খয়েরি নরম বালির প্রান্তরে হঠাৎ করে কেউ খানিকটা তরল সোনা ঢেলে দিয়েছে। লেকের ধারে বসে ছিলেন স্টারলিং, এই সকালে বাইরে না বেরোলে তাঁর মাথা কাজ করে না, যন্ত্রপাতির একটানা শব্দে বিরক্তি লাগে। বাইরে বেরোতেই বাড়ির কথা মনে পড়ল। ভোরে বাড়ির ব্যালকনিতে দাঁড়িয়ে উপরে তাকালে ঠিক এরকমই একটা আকাশ দেখা যায়। জ্যাকেটের পকেট থেকে ফোনটা বের করে দেখলেন তিনি, এখানে খুব অল্প নেটওয়ার্ক পাওয়া যায়। বাড়ির নম্বরটা ডায়াল করার চেষ্টা করলেন, কিছুক্ষণ অপেক্ষা করার পর অপারেটার মিহি গলায় জানাল, “ the number is not available right now.”

অগত্যা স্টারলিং ইনবক্স এ ঢুকলেন, ঢুকতেই তার ঠোঁটের কোনায় অজান্তে একটা হাসি ফুটে উঠল। ইনবক্সে সবার উপরে যে নামটা দেখাচ্ছে সেটা তাঁর স্ত্রীর। মিয়া উস্তিনভিচ। মেসেজটা বেশি বড় নয়। লেখা আছে – “no flowers on the Canadian plant. Will it ever blossom?”

নিজের অনুপস্থিতিতে গাছগুলোর দেখাশোনার দায়িত্ব স্ত্রীকেই দিয়ে এসেছেন, বছরকয়েক আগে কেনা কানাডিয়ান সেঞ্চুরি প্ল্যান্টগুলোতে এখন ফুল আসেনি, অবশ্য আসার কথাও নয়। হঠাৎ প্রফেসারের মনে পড়ল কাল সকালের কথা, এই একটা গুণ তাঁর ছোটোবেলা থেকেই আছে, দরকার পড়লেই যেকোনো চিন্তা মাথা থেকে সরিয়ে রাখতে পারেন। এখন ব্যাপারটা আবার মাথায় আসতেই তিনি উঠে পড়লেন, যদি সিগনালটা অন্য গ্যালাক্সি থেকে এসে থাকে তাহলে তা হাইড্রোজেন লাইন ব্যাবহার না করে অন্য কোনও পদ্ধতিতে পাঠানো হয়ছে। কিন্তু মহাকাশে নিজেদের লোকসান জানিয়ে কী বলতে চায় তারা? পৃথিবীর মানুসের পক্ষে অতদুর মহাকাশ পাড়ি দেয়ার কথা কল্পনা করাও মুর্খামি।

এলিভেটার থেকে নেমেই কেভিনকে দেখা গেল, অন্য সঙ্গিসাথীদের সাথে দাঁড়িয়ে ছিল সে, প্রফেসার কে নামতে দেখেই এগিয়ে এল।

“কাল যে ল্যাব থেকে তাড়িয়ে দিলেন, কি হয়ছিল বলুন তো?”

স্টারলিং একবার ভাবলেন কথাটা কেভিনকে বলা উচিত হবে না। লোকটা খালি গুলিগোলাই চালাতে জানে। পৃথিবীর বাইরে প্রাণ আছে কিনা জানার থেকেও তার কাছে বেশি দরকারি কিম্ভুত চেহারার এলিয়েনরা অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পৃথিবী দখল করতে আসছে কিনা। তাকে হাতছানি দিয়ে কাছে ডাকলেন প্রোফেসার। কাঁধে একটা হাত রেখে বললেন, “আধঘণ্টা পরে দুকাপ কফি নিয়ে মনিটর রুমে এস, কথা আছে।”

মনিটর রুমটা ল্যাবের থেকে বেশ বড়ো। প্রায় ছ মিটার উঁচু, মেঝেটা স্ফটিকের মত স্বচ্ছ। চারপাশ জুড়ে অনেকগুলো রাডারের মত দেখতে যন্ত্র, একটা বিরাট স্ক্রিনে নজরদার ক্যামেরায় পাওয়া ছবি দেখান হছে। ঘরে ঢুকে কেভিন একটু থমকে দাঁড়াল, টেবিলের উপর মাথা রেখে কী যেন ভাবছেন প্রোফেসার, মাথার পিছনে সাদা কাল মেশানো চুল পাতলা হয়ে এসেছে। হাতদুটো টেবিল থেকে নিচে ঝুলছে। হাতের পাশে কফির মগটা রেখে কেভিন তার পিঠে হাত ছোঁয়াল, সাথে সাথে তিনি চোখ মেলে চাইলেন। সবসময় লেগে থাকা হাসিটা আজ কিন্তু দেখা গেল না। বিবর্ণ মুখে তিনি কেভিন কে বসতে ইশারা করলেন। সে বসতে বললেন, “তোমাকে একটা কথা আগেই বলা উচিত ছিল, বলা হয়নি।”

“কী কথা?” কিছু যেন একটা আঁচ করতে পেরেছে কেভিন।

“এখনি এ নিয়ে তেমন মাথা ঘামিয়ো না, তবে জেনে রাখলে ভাল।”

“আপনি খুলে বলবেন?”

প্রোফেসার চেয়ার থেকে উঠে ঘরের অন্য দিকে গেলেন, বলার কথাগুলো বোধয় মনের মধ্যে গুছিয়ে নিলেন, তারপর শুরু করলেন, “ আজ থেকে প্রায় বছর ষাটেক আগের কথা, ডোনাল্ড কিহো নামে এক মহাকাশ বিজ্ঞানী দাবি করেন যে মার্কিন বায়ুসেনা আকাশের গায়ে পৃথিবীর প্রায় সাথে সাথে চাঁদের মত ঘূর্ণায়মান কালো রঙের একটি বস্তুকে দেখেছে। সেটা নাকি পৃথিবীর চারপাশেই পাক খাচ্ছে।

প্রথমে স্বভাবতই ব্যাপারটা কেউ বিশ্বাস করেনি, তো কাগজপত্রে এই নিয়ে অনেক লেখালিখি হতে গবেষণা করে জানা যায় ওখানে সত্যি একটা কিছু আছে, অনেকটা কৃত্রিম উপগ্রহের মতই কিন্তু পৃথিবীর নয়। ১৩০০০ বছর আগে থেকে পৃথিবীর ৭৯ ডিগ্রি দ্রাঘিমা রেখা বরাবর ঘুরছে। এরপরেই  বিজ্ঞানীমহলে সাড়া পড়ে যায়। নাসা অবশ্য ব্যাপারটাকে মিথ্যে বলে ধামাচাপা দিতে চায়। যাই হোক এর ৪০ বছর পরে অর্থাৎ নব্বুই এর দশকে sts-88 মিশনে কিছু অদ্ভুত ছবি আসে, সে ছবি তুমিও ইন্টারনেট খুললেই দেখতে পাবে। ছবিতে দেখা যাচ্ছে একটা ছুঁচলো রকেটের মত মহাকাশযান ক্রমাগত পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে, অবশ্য আকারে সেটা যথেষ্ট ছোট –”

প্রোফেসার কেভিনের মুখের উপর প্রায় ঝুঁকে পড়লেন, “গুপ্তচর আমরা কোথায় রাখি?”

“শত্রুপক্ষে”

“এ স্যাটেলাইটটা যদি ভিনগ্রহী বস্তু হয় তাহলে তারা নিশ্চয়ই আমাদের মিত্রপক্ষ ভাবে না।”

কেভিন কিছু ভাবার চেষ্টা করল আর তারপর মুখে কৌতুকের হাসি ফুটিয়ে বলল,  “ ধুস্‌, আপনি মজা করছেন আমার সাথে।”

স্টারলিং-এর মুখ এখন থমথমে হয়ে আছে। হাতটা মাথার পিছনে বুলাতে বুলাতে বললেন “ বি মাই গেস্ট, যেকোনো বিজ্ঞানীকে জিগেস করে নিও।”

কেভিন আরও কিছু বলতে যাচ্ছিল এমনসময় একটা প্রচণ্ড যান্ত্রিক শব্দে দুজনেই চমকে উঠল, তবে এ শব্দটা তাদের অচেনা না, প্যারালাল ইউনিভার্স নামের রেডিও টেলিস্কোপে আবার ধরা পড়েছে কোনও মহাজাগতিক সিগনাল। ট্রান্সমিসান রুমে ঢুকেই প্রোফেসার ঘড়ি দেখলেন, নাহ কোনও ভুল হবার নয়, প্রতিদিন একই সময়ে এসে পৌঁছায় সিগনালটা, অর্থাৎ সেটা যারা পাঠাচ্ছে, তাদের পৃথিবীর সময়ের হিসেব আছে, শুধু আছে যে তাই নয়, তারা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে! হাইড্রোজেন নয়, প্রাণ নয়, শক্তি নয়, মহাবিশ্বে এক মাত্র ধ্রুবক হল সময়্‌। ৫০ লক্ষ আলোকবর্ষ পার করে সময়কে ধ্রুবক রেখে পৃথিবীকে কিছু বলতে চাইছে কেউ!!

কেভিন প্রায় ঝাঁপিয়ে পড়ল স্ক্রিনের উপরে। সেখানে আবার ফুটে উঠেছে কিছু আলফানিউমেরিক সংকেত। ঠিক বাহাত্তর সেকেন্ড স্থায়ী হবে সেগুলো, তারপর আবার মিলিয়ে যাবে মহাশূন্যে।

হঠাৎ কেভিন লক্ষ করল তার ঠিক পিছনেই কপালে হাত দিয়ে মাটিতে বসে রয়েছেন প্রোফেসার স্টারলিং, তাঁর চোখ মুখ বিস্ফারিত, গোটা মুখ উত্তেজনায় লাল হয় কাঁপছে, যেন কিছুর একটা আকস্মিকতায় নিথর হয়ে গেছেন তিনি। হাঁটু গেড়ে মাটিতে বসে কেভিন তার কাঁধে হাত দিল, “ডক্টর স্টারলিং, কী হয়ছে আপনার?”

স্টারলিং কাঁপা কাঁপা হাতে তার জামাটা চেপে ধরে প্রায় ডুকরে উঠলেন,“হা ঈশ্বর! আ…আমি আসতে চাইনি এখানে, যদি জানতাম…”

রাত প্রায় সাড়ে তিনটে। নিউ ইয়র্কের একটা বিলাসবহুল ফ্লাটের বিছানায় গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন ছিলেন হেনরি লুকাস। হঠাৎ মোবাইলটা বেজে উঠতে তাঁর ঘুম ভেঙ্গে গেল। অন্য দিন ঘুমানোর সময় ফোনটা বন্ধ করে দেন তিনি। আজ সেটা করার কথা মনেও ছিল না। গত তিন রাত ঘুম হয়নি। গোটা আমেরিকার এক প্রান্ত থেকে আর এক প্রান্ত ছুটে দৌড়েই কেটে গেছে। প্রাথমিক বিরক্তিটা কাটিয়ে নিয়ে কোনও রকমে একটা হাত বাড়িয়ে ফোনটা কানে ধরলেন হেনরি। ওপাশ থেকে স্টারলিঙের গলা শোনা গেল,

“হিস্ট্রি ইজ ইন আওয়ার হ্যান্ড লুকাস–”

হেনরি প্রথম কিছু বুঝতে পারলেন না। প্রোফেসার বয়স্ক মানুস, ছাত্রাবস্থায় কখনও তাঁকে উত্তেজিত হতে দেখেননি তিনি। দুমিনিট চুপচাপ থেকে তিনি বললেন, “প্রোফেসার, এত রাতে, কী ব্যাপার?”

“পৃথিবী সৃষ্টি হল কীভাবে, প্রাণ এল কীভাবে, কিভাবে মানুষ আগুন জ্বালাতে শিখল, কিভাবে তৈরি হল ইজিপ্টের পিরামিডগুলো?”

“এত রাতে এইসব প্রশ্ন করে কী লাভ প্রোফেসার? এগুলোর উত্তর কেউ জানে না। সিগনালটার অর্থ উদ্ধার করতে পারলেন?” হেনরির বিরক্তিটা দানা বাধছিল। লোকটার কি ভীমরতি হল নাকি?

“ওয়েল, উত্তরগুলো কেউ জানে, জানে বলেই আমাদের জানাতে চাইছে।”

“বলে যান।” দীর্ঘদিন নানা পাগলাটে বৈজ্ঞানিকের সাথে কাজ করার ফলে তাঁদের এই স্বভাবটা ভালই জানা আছে হেনরির। কোনও একটা ব্যাপার নিয়ে মেতে উঠলে স্থানকালপাত্র আর মাথায় থাকে না।

“রেডিও সিগন্যালটা সাজিটেরিয়াস থেকে নয়, আসছিল গ্যালাক্সি ৩c 348 থেকে।”

“ অন্য গ্যালাক্সি!!” একঝটকায় বিছানার উপর সোজা হয়ে বসলেন হেনরি, লোকটা বলে কী! মাথার ঠিক আছে তো?

“হ্যাঁ গ্যালাক্সি। সৌরজগত থেকে ৫ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। অর্থাৎ পৃথিবীর থেকে সেখানে আলো পৌঁছাতে লাগবে পাঁচশো কোটি বছর। আমাদের পৃথিবী সৃষ্টি হয়ছে সারে চারশো কোটি বছর আগে।”

হেনরির সব গুলিয়ে যাচ্ছিল। কোনরকমে উচ্চারণ করলেন, “তাতে কী হল?”

“এই মুহূর্তে একটা টেলিস্কোপ নিয়ে আকাশগঙ্গা ছায়াপথের দিকে তাকালে তারা আমাদের এই ছোট্ট গ্রহটাকে দেখতে পাবে না। কারণ সেটা এখনও সৃষ্টিই হয়নি, পৃথিবী সৃষ্টির ছবি তাদের চোখে পৌছাতে এখনও প্রায় পঞ্চাশ কোটি বছর দেরি।”

হেনরির দিক থেকে কোনও শব্দ এল না। স্টারলিং একটু থেমে আবার বলে চললেন, “আমি জানতে পেরেছি, এই ভিনগ্রহিরা সময়কে নিয়ন্ত্রণ করতে পারে, আলোর ধর্মকে কাজে লাগিয়ে অতীতের ছবি তুলে আনতে পারে, আমি যদি ভুল না হই তাহলে এরা আমাদের গ্রহের ইতিহাস আমাদেরকেই জানাতে চায়। তুমি ভাবতে পারছ হেনরি? হেনরি?”

প্রোফেসার একবার ভাবলেন লাইনটা কেটে গেছে। প্রায় দুমিনিট চুপ করে থাকার পর হেনরি উত্তর দিলেন,“আপনার কোনও ভুল হচ্ছে না তো?”

“না, দুদিন টানা লক্ষ করেছি সিগন্যালগুলো, ভুল হতেই পারে না।”

“ব্যাপারটা আর কাউকে জানিয়েছেন?”

“নাহ, এখান থেকে আর কারো সাথে যোগাযোগ করার উপায় নেই।”

“বেশ, আমরা কালই একদল অ্যাস্ট্রোফিজিসিস্টকে পাঠাচ্ছি। অভিনন্দন প্রোফেসার স্টারলিং। আপনার নোবেলটা এবার আটকায় কে?”

স্টারলিং-এর গলায় এখনও উত্তেজনার স্রোত বইছে। তিনি স্মিত হেসে বললেন, “এই বয়সে আর এসব ভাল লাগে না। অনেকদিন বাড়ির বাইরে, আমার ফেরার ব্যবস্থা কর।”

“আমাদের টিম সাইটে পৌঁছালেই আপনার ছুটি।”

ফোনটা রেখে হেনরি উঠে এলেন। মাথাটা এখনও কেমন যেন গুলিয়ে আছে। একটা সিগারেট ধরালেন তিনি, তারপর ল্যাপটপটা খুলে তাড়াহুড়ো করে হাত চালালেন কি-বোর্ডের উপরে।

এরিয়া ৫১-এ গ্রুম লেকের ধারে বালির উপর বসে  জলের দিকে একটানা চেয়েছিল কেভিন। একটু আগেই তার কাছে কতগুলো নির্দেশ এসেছে। তার বাকি সঙ্গিসাথীদের সেটা জানানো হয়নি। জানানো হয়নি স্টারলিংকেও। মাটিতে একটু দুরেই পরে আছে P11-lsat রাইফেলটা। আর দেরি করলে চলবে না। এখুনি উঠতে হবে-

-হঠাৎ কেভিন থেমে গেল। একটু দূরে আস্তে আস্তে ফুটে উঠছে প্রোফেসার স্টারলিঙের শরীরটা। বালির উপর দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে তার দিকেই এগিয়ে আসছেন। মুখে সারাক্ষণ লেগে থাকা সেই হাসিটা।

প্রোফেসার তার পাশে এসে বসলেন। কেভিন একটাও কথা বলল না। লেকের জলের উপর দিয়ে ঠাণ্ডা হাওা বয়ে আসছে।

বেশ কিছুক্ষণ চুপচাপ থাকার পর  প্রোফেসার একটা বড় নিশ্বাস নিয়ে উপরে তাকালেন।, আকাশে অগণিত উজ্জ্বল তারা ঝলমল করছে, সম্মোহিতের মত কী যেন দেখতে দেখতে বললেন, “তুমি ভগবানে বিশ্বাস কর কেভিন?”

“হুম।”

“উপরে তাকাও। কত বড়ো এই মহাবিশ্ব তা কল্পনাও করা যায় না। তার উপর রোজ নাকি বেড়ে চলেছে। আর আমরা? প্রবল হারিকেনের মুখে এক দানা ধুলর মত, কোন গুরুত্ব নেই, সারাক্ষণ শুধু আমাদের অস্তিত্বের কারণ খুঁজছি- ডেস্টিনি, ডেস্টিনি খুঁজছি।

এইটাই মেনে নেওয়া কঠিন, এই অবিশ্বাস্য নগণ্যতা, অসহ্য। পঞ্চাশ থেকে ষাট, ষাট থেকে সত্তর আশি নব্বই একশো বছর কোনওরকমে বাঁচার চেষ্টা, অথচ এই মহাকালের তুলনায় সেটা কিছুই নয়, চোখের পলক ফেলার মত, মাঝে মাঝে খুব হতাশ লাগে, মনে হয় মানুষ হয়ে জন্মেছি তার কোনও কারণ নেই? নিশ্চয়ই আছে। আমার বাড়ির ঠিক নিচেই একটা ছোট বস্তি আছে, বৃষ্টি এলে বস্তির বাচ্চাছেলেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে ফাঁকা রাস্তায় উন্মাদের মত ফুটবল খেলে, গোল দিয়ে আনন্দে গান গাইতে গাইতে নাচে, তখন আমার মনে হয় হয়ত কোন কারণ নেই। এই বিরাট আকাশের নীচে যে আমরা, আমাদের মুল্যও শুধু আমাদের কাছে।”

“মানে আপনার মৃত্যুভয় নেই?”

“আছে, আমার বাড়ি আছে, স্ত্রী আছে, বাড়ির ঠিক সামনেই মস্ত ফুলের বাগান আছে, আনেকদিন বাড়ির বাইরে, পোষা কুকুরটা হয়ত দুঃখে খায়নি এই কদিন, তাদের মধ্যে থাকলে আর আকাশের দিকে চোখই পড়ে না। এদের ছেড়ে যেতে মন চাইবে না। চোখ বুজলেই আর কিছু নেই, অন্ধকার, এটা মেনে নেওয়া খুব কষ্টকর, আমরা চেহারায় না হলেও বয়সে এই মহাবিশ্বের সমান হতে চাই।”

“হুম।”

স্টারলিং এবার কেভিনের দিকে তাকালেন, “তোমার কী হয়ছে বল তো? হুম হুম করছ যে? এই খ্যাপা বিজ্ঞানী কে আর সহ্য করতে হবে না। নতুন রিসার্চ টিম আসছে।”

কেভিন মাথা নামিয়ে নিল। কোনও রকমে ভাঙাগলায় বলল, “আমার কাছে একটা নির্দেশ আছে।”

“কী নির্দেশ?”

“আপনাকে দেখামাত্র গুলি চালানোর।”

কথাটা বলে কেভিন শক্ত করে ধরল রাইফেলটা। মুহূর্তের জন্য সে প্রোটোকল ভুলে গেছিল, মৃত্যুদণ্ড পাওয়া অপরাধীর সামনে যেকোন অস্ত্র রাখাই বিপজ্জনক। অন্ধকারে প্রফেসারের মুখটা ভালো করে দেখা যাচ্ছে না। কেভিন সেদিকে তাকাতে পারল না। রাইফেলটা হাতে ভারি হয়ে আসছে। এত জটিল হিসেবের মাঝে এই ছোট্ট হিসেবটা মাথায় আসেনি স্টারলিং-এর? পৃথিবীর কোন ধর্ম, বিজ্ঞানকে ইচ্ছামত আবিষ্কারের অনুমতি দেয় না, সব সত্যি উদ্‌ঘাটনের অনুমতি দেয় না। কারণ সেটা হলে তাসের ঘরের মত ভেঙে পড়বে তাদের সাজানো বুজরুকি, আর সেইসঙ্গে তাদের উপর মানুষের বিশ্বাস।

প্রোফেসারের ডান হাতটা এখনও কেভিনের পিঠের উপর রাখা, মিলিটারি পোশাকটা শক্ত মুঠোয় চেপে ধরা। পাঁচ মিনিট কেউ কোন কথা বলল না, যেন দুটো মাটির পুতুল, পাশাপাশি বসানো আছে।

“আমি একটা ফোন করব। বাড়িতে।” স্টারলিঙের গলা আশ্চর্যরকম শান্ত।

“লাভ নেই, আপনি পালাতে পারবেন না, চারদিক ইলেকট্রিক বেড়া দিয়ে ঘেরা। আমি নিজে হাতে আপনাকে হত্যা করতে পারব না, আপনার কাগজপত্র আর এখানকার সব যন্ত্রপাতি নষ্ট করতে মিলিটারি ট্রুপ আসছে, তারাই হয়ত…”

“আমি পালাব না। ভয় নেই, আমি বাড়িতে ফোন করে রিসার্চের ব্যাপারে কিছু জানাব না।”

“তাহলে?”

“উস্তিনা আমার স্ত্রী, তাকে কয়েকটা কথা বলব।”

“আমি দেখছি, জানি না হবে কী না।”

কথাটা বলে কেভিন উঠে পড়ল। স্টারলিং ও উঠে দাঁড়ালেন। মাথা নিচু করে হাঁটতে থাকলেন বালির উপর দিয়ে। জীবনের এই শেষ কয়েকটা মুহূর্ত নষ্ট করার কোনও মানে হয় না। স্বর্গ নেই, নরক নেই, কতগুলো ব্যাকটেরিয়া আর ডিকম্পজিটারের হাতে রক্তমাংসের যন্ত্রটা ছেড়ে দেয়ার আগে, কিছু করা উচিত।

খুব ক্ষীণ একটা শব্দ পাওয়া যাচ্ছে উপর থেকে। হেলিকপটার। তারা কত দূরে এসেছে বোঝা যাচ্ছে না। কয়েক সেকেন্ডের মধ্যে কেভিন বাইরে বেরিয়ে এল। প্রোফেসারের হাতে তুলে দিল একটা ফোন। ছোটো রিভলভারটা নিজের পায়ের দিকে তাগ করে গুলি চালাল, গুলির আঘাতে খানিকটা দূরে ছিটকে পড়ল তার শরীরটা। প্রোফেসার বাড়ির নম্বর ডায়াল করলেন। ওপাশ থেকে উস্তিনার গলা শোনা গেল,

“হ্যালো…”

“উস্তিনা, আমি রিচার্ড।”

“ওফ, শেষ পর্যন্ত ফোন করলে তাহলে! এরা তো আমায় কিছুই জানায় না। কাজ শেষ হল তোমার?”

“না, শেষ হয়নি, আর একটু সময় লাগবে।” আকাশের এককোণে হেলিকপটারগুলোকে উড়ন্ত বাজপাখির মত দেখা যাচ্ছে। স্টারলিং বুঝলেন আর বেশি সময় নেই।

“শোন, আমি একটা কথা বলার জন্য কল করলাম।”

“তা নাহলে আর কেন করবে? বল।”

“আমার কানাডা থেকে কেনা গাছগুলো সেঞ্চুরি প্ল্যান্ট। গাছটার একটা বিশেষত্ব আছে। জীবনকালে মাত্র একবার ওই গাছে ফুল আসে। মৃত্যুর ঠিক আগে, সারা শরীর ফুলে সেজে শুকিয়ে যায় আস্তে আস্তে। মানে, আর কুড়ি বছর পর ফুল ফুটবে আমাদের গাছগুলোতে, ততদিন ওগুলোকে বাঁচিয়ে রেখ।”

কথাটা শুনে কেমন যেন থমকে গেল উস্তিনা। জিজ্ঞাসা করল, “তুমি ফিরবে কবে?”

হেলিকপটারগুলো একদম মাথার উপরে এসে আকাশ ঢেকেছে। প্রফেসারের কথা আর শোনা যায় না। চোদ্দ বিলিয়ন বছরের পুরনো এই মহাবিশ্ব, চোদ্দশো কোটি, আর মানুসের বয়স তিরিশ লক্ষের বেশি হবে না। এখনও তার রূপকথার গল্প শোনার বয়স, মহাবিশ্বের সব সত্যি জানার বয়স হয়নি তার। ওই সেঞ্চুরি প্লান্টগুলোর মতই। ফুল ফুটতে বহু দেরি।

golposhatabdi (Medium)চারটে হেলিকপটার থেকে ছুটে আসা গুলির ঝাপটায় দু মিটার দূরে ছিটকে পড়লেন প্রোফেসার স্টারলিং। হাত দুটো দুপাশে ছড়িয়ে রক্তাক্ত শরীরে নিথর হলেন তিনি। রাতের আকাশে অজস্র আলোকবিন্দুতে চেয়ে রইল তার চোখ।