গল্প-হারিয়ে যাওয়া চশমা-জয়দীপ চক্রবর্তী-বর্ষা ২০১৬

golpojaydeep02 (Medium)

পরিদাদু বেতের হাতল দেওয়া চেয়ারটায় বসে জমিয়ে চা খাচ্ছিলেন শাওনের ছোটো মাসি চন্দ্রার হাতে বানানো নিমকি সহযোগে। অরুণাংশু আর সুছন্দা বসেছিলেন সোফায়। সুছন্দা চন্দ্রার সাথে হাত নেড়ে গল্প করছিলেন আর অরুণাংশু চা খেতে খেতেই চোখ বুলিয়ে নিচ্ছিলেন খবরের কাগজে। এখন সকাল ন’টা। শাওনরা এখানে এসেছে কাল বিকেল পাঁচটা নাগাদ।

ছোটোমাসি আগে ডানলপের দিকে একটা ভাড়াবাড়িতে থাকতেন। মাসছয়েক হল এখানে নতুন ফ্ল্যাট কিনে উঠে এসেছেন। জায়গাটা দক্ষিণেশ্বর স্টেশন থেকে বেশি দূরে নয়। স্টেশনে নেমে টোটো অথবা একটি বেসরকারি বাসে উঠে মিনিট দশ বারোর মধ্যেই পৌঁছে যাওয়া যায় রাস্তায় জ্যাম না পেলে।

মাসিরা এই ফ্ল্যাটে আসার সময়ে গৃহপ্রবেশে নেমন্তন্ন করেছিলেন শাওনদের। শাওনের স্কুলে কী একটা পরীক্ষার ঝামেলার জন্যে তখন আসা হয়নি। পরিদাদু এসেছিলেন অবশ্য। সুছন্দা তখনই চন্দ্রাকে বলে দিয়েছিলেন শাওনের পুজোর ছুটি পড়লে আসবেন এখানে। পুজোর ছুটি শুরু হবার সঙ্গে সঙ্গেই চন্দ্রা ফোন করে সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে তাড়া দিচ্ছিলেন। পরিদাদুই বললেন, “চল, লক্ষ্মীপুজো আর কালীপুজোর মধ্যে দিন দুই তিন ঘুরে আসি ওখান থেকে। সুছন্দা একবার মৃদু প্রতিবাদ করে উঠেছিলেন, “এখান থেকে এখানে, তাতে আবার দু তিনদিন থাকার কী আছে? শুধুমুধু শানুর পড়াশুনোর দফারফা হবে। ভুললে তো চলবে না, স্কুল খুলেই অ্যানুয়াল পরীক্ষা ওর…”

“হোক না,”  পরিদাদু মাছি তাড়ানোর ভঙ্গীতে হাতটা মুখের সামনে নাড়িয়ে বললেন, “শানু পড়াশোনায় যথেষ্ট সিরিয়াস। এক আধ দিন না পড়লে পরীক্ষার ফলে এমন কিছু ফারাক হবার কথা নয় ওর।”  

“তুমি তো ওইসব বলেই ওর মাথাটা ঘুরিয়ে দিচ্ছ পরিকাকু,”  সুছন্দা মরিয়া প্রতিবাদ করেছিলেন, “তুমি জানো না কী মারাত্মক ফাঁকিবাজ হয়েছে ও আজকাল।”  

পরিদাদু আড়চোখে একবার শাওনের দিকে তাকিয়ে নিলেন। তারপর বললেন, “তাহলে কী আর বলব বল খুকু। আসলে তোর কথা ভেবেই বলছিলাম। চন্দ্রার বাড়ি যাবি অথচ দক্ষিণেশ্বর বেলুড় যাবি না, আদ্যাপীঠ যাবি না তা কি হয়? আবার শুধু এইসব ঘুরেই যদি চলে আসিস তাহলে আবার চন্দ্রা বিতানের সাথে আড্ডাটাও জমবে না ঠিকঠাক।”  

শাওনের হাসি পাচ্ছিল। সে জানে এ কথায় মা ঠিক ভিজে যাবে। আর হলও তাই। সুছন্দা একটুক্ষণ চুপ করে থেকে বললেন, “তা অবশ্য ঠিকই বলেছ পরিকাকু।”

“তবে?” পরিদাদু হাসলেন, “দুম করে ডিসিশন একটা নিলেই হল?”

শাওন বলল, “মা তুমি দেখো, পুজোর মধ্যেই স্কুলের হোমটাস্ক সব করে ফেলব আমি।”  

“করবি তো ঠিক?”

“করবই,”  বলে মাকে দু হাতে জড়িয়ে ধরল শাওন।

কাল বিকেলে আসার পরে বেরোনোর প্রশ্নই ছিল না। ছোটোমাসি শানুকে দেখে জড়িয়ে ধরে বললেন, “আজ কোত্থাও বেরোনো হবে না কিন্তু বলে দিলাম। আমি আজ নিজে হাতে শানুর জন্যে শাহি পোলাও আর মাটন কষা বানাব। আর অরুণদা তুমি যতবার খুশি চায়ের অর্ডার করতে পার। অসুবিধা নেই। আমি তোমাদের কাছ থেকে জমিয়ে গল্প শুনব আজ। লোকের মুখেই শুধু তোমাদের নানা কান্ডকারখানা শুনছি আর অবাক হয়ে ভাবছি পরিকাকু কী হুলুস্থুলুই না বাঁধাচ্ছে নানা জায়গায়।”

“তুই ভাব চন্দ্রা, ক’মাস আগে সেই যে শিলং যাবে বলে শানুটাকে নিয়ে বেরোল, কী কান্ডটাই না হল বল? পরিকাকুর কবে যে বুদ্ধিশুদ্ধি হবে! ওই ঝামেলায় শানুটাকে নিয়ে যাবার কী দরকার ছিল জেনেবুঝে? আমি যদি ঘুণাক্ষরেও জানতাম শানুকে কিছুতেই যেতে দিতাম না।”

“সেইজন্যেই তো জানাইনি ম্যাডাম,”  চায়ে লম্বা চুমুক মেরে হাসতে হাসতে বললেন পরিকাকু।

বিতানমেসো বললেন, “কিন্তু শানুর সাহসেরও প্রশংসা করা দরকার তোমাদের। ওইটুকু ছেলে ভয় পেয়ে যায়নি তো অন্য ছেলেদের মতন…”

“সে তো বটেই, সে তো বটেই,”  বলে শানুর গাল টিপে আদর করে দিলেন চন্দ্রামাসি।

“আমারও কিন্তু খুব সাহস। আমি রাতে ঘরে একলা শুতে পারি। ভূতের গল্প পড়েও একটুও ভয় পাই না আমি।”  

কথাগুলো হঠাতই চন্দ্রা মাসির ফ্ল্যাটের খোলা দরজার ঠিক বাইরে করিডর থেকে ঠিকরে এল। তারপরেই দরজার পর্দা ঠেলে ভিতরে ঢুকে পড়ল শ্যামলা রঙের একটা রোগাপাতলা ছোট্ট মেয়ে। মাথায় একরাশ ছোটো করে ছাঁটা কোঁকড়া কোঁকড়া চুল।

মেয়েটিকে দেখেই চন্দ্রা মাসি একগাল হাসলেন, “এই তো এসে গেছে, আমি তাই ভাবছিলাম আমার স্নেহা মা এখনও এল না কেন?”

“কাম ইন লিটল প্রিন্সেস।”  বিতানকাকুও বলে উঠলেন হাল্কা গলায়।

মেয়েটি দরজার কাছ থেকে খুব সপ্রতিভ ভঙ্গীতে এগিয়ে এল। বিতানমেসো বললেন, “আলাপ করিয়ে দিই। পরীর মতন সুন্দর এই মেয়েটি আমার ছোট্ট একটা মা। আমার পাশের ফ্ল্যাটে থাকে। ওর নাম…”

“আমার নাম স্নেহাঙ্গী, স্নেহাঙ্গী দাস।”  বিতান মেসোকে কথা শেষ করতে না দিয়ে নিজেই বলে মেয়েটি। তারপর পরিদাদুর দিকে ফিরে বলে, “তুমিই তো পরিদাদু। আর ওটা নিশ্চয়ই শাওনদাদা?”

“তুমি আমাদেরও চেনো নাকি?” চোখ গোল গোল করে জিজ্ঞেস করলেন সুছন্দা।

“হুঁ চিনি। তুমি তো সুছন্দা আন্টি আর ওটা অরুণ আঙ্কল।”  

“উরিব্বাস,”  অবাক হয়ে বলেন অরুণাংশু, “তুমি আমাদের চিনলে কী করে? আমাদের তো আগে কখনও তুমি দেখোনি?”

“আমি তোমাদের সব গল্প পড়েছি। তাছাড়া চন্দ্রা আন্টির কাছে তোমাদের কত গল্প শুনি আমি প্রতিদিন…”

“ওরে বাবা, জানো না তো, গত দু তিনদিন ধরে আমাকে দু’বেলা জিজ্ঞেস করে যাচ্ছে ও তোমরা কখন আসছ, কদিন থাকবে, আরো কত প্রশ্ন। কালই ও চলে আসত। নেহাত বাড়ি ছিল না তাই। ওর এক বন্ধুর বার্থ ডে পার্টি ছিল কাল সন্ধেয়। ফিরতে রাত হয়ে গিয়েছিল। শরীর টানছিল না নাকি কারো… বাড়ি এসেই ঘুম…”

“আসলে পরিদাদুকে খুব দরকার আমার,”  মুখটাকে গম্ভীর করে বলল স্নেহাঙ্গী।

“তাই নাকি?” পরিদাদু হাসলেন তার দিকে চেয়ে, “কী দরকার আমায় তোমার বলো।”  

“আমাদের একটা জিনিস হারিয়ে গেছে। তোমায় খুঁজে দিতে হবে।”  

“কী জিনিস?”

“চশমা।”  

“চশমা? কার তোমার?”

“উঁহু।”  

“তবে?”

“রাঙাঠাকুমার।”  

“রাঙাঠাকুমা চশমাটা কোথায় হারালেন, বাড়ির বাইরে কোথাও?”

“রাঙাঠাকুমা তো বাড়ির বাইরে বেরোন না।”  

“তাহলে বাড়ির মধ্যেই নিশ্চয়ই আছে কোথাও। খুঁজে দেখো। ঠিক পেয়ে যাবে।”  

“ওটা পাওয়া যায়নি। আমরা অনেক খুঁজেছি। কেউ ওটা চুরি করেছে।”  

“হঠাৎ চুরির কথা মনে হল কেন তোমার? অমন সামান্য একটা জিনিস চোর কেন চুরি করতে যাবে বলো স্নেহাঙ্গী?”

“আমি জানি না। তুমি রাঙাঠাকুমার চশমাটা খুঁজে দাও। তুমি আমার সাথে চলো আমাদের বাড়িতে।”  বলে পরিদাদুর হাতটা ধরে টান দেয় স্নেহাঙ্গী।

শাওন চুপ করে মজাটা দেখছিল এতক্ষণ। এবারে উঠে দাঁড়িয়ে স্নেহাঙ্গীর মাথায় হাত রাখল সে। নরম গলায় বোঝাতে শুরু করল, “স্নেহাঙ্গী শোনো, পরিদাদু তো আর গোয়েন্দা নন যে তোমার রাঙাঠাকুমার চুরি যাওয়া চশমা তিনি খুঁজে বের করে দেবার দায়িত্ব নেবেন। অমন ছেলেমানুষি করে না। ছেড়ে দাও পরিদাদুকে। পরিদাদু বললেন তো, ভালো করে বাড়িতে চশমাটা খুঁজে দেখো, ঠিক পেয়ে যাবে।”  

“পাওয়া যাবে না। কেউ ওটা ইচ্ছে করে লুকিয়ে রেখেছে যাতে আমি না পাই ওটা। ওটা না পেলে আমার খুব অসুবিধা।”  কাঁদো কাঁদো গলায় বলে স্নেহাঙ্গী।

“চশমাটা না পেলে তোমার অসুবিধা কেন, অসুবিধে তো তোমার ঠাকুমার?” অরুণাংশু বলে উঠলেন।

“ঠাকুমা চশমা ছাড়া প্রায় কিছুই দেখতে পায় না ভালো করে। আর দেখতে না পেলে ঠাকুমা আমায় গল্প পড়ে শোনাবে কেমন করে? প্রতিদিন রাতে বা ছুটির দুপুরে রাঙাঠাকুমা আমায় গল্পের বই থেকে নানান গল্প পড়ে শোনায়। আসলে আমি নিজে বাংলা পড়তে পারি না তো…” বলে মাথাটা নামিয়ে ফেলল স্নেহাঙ্গী। বাংলা পড়তে পারে না এ কথাটা বলে ফেলে খুব লজ্জায় পড়ে গেছে সে।

ওর কথা শুনে সকলেই হাসছিল। ওর ছেলেমানুষি বায়নায় আর কথা বলার ধরনে সকলেই মজা পাচ্ছিল খুব। সকলের মুখের ওপরে একবার চোখ বুলিয়ে নিয়ে আবার বলল স্নেহাঙ্গী, “কই চলো। বেশি দেরী করলে রাঙাঠাকুমা আবার পুজোয় বসে যাবে। আর একবার পুজোয় বসে গেলে অনেকক্ষণ কিন্তু আর তোমরা ঠাকুমার সঙ্গে কথাই বলতে পারবে না। অথচ তদন্তের জন্যে ওর সঙ্গে কথা বলাটা তো তোমাদের জরুরি বলো…”

“তুমি খুব গোয়েন্দা গল্প শোনো বুঝি?” অরুণাংশু আবার জিজ্ঞেস করলেন ওকে।

“সে আর বলতে,”  বিতানমেসো হাসতে হাসতে বলেন, “রহস্য আর গোয়েন্দা গল্পের একেবারে পোকা ও।”  

“ওঃ কথা বলে বড্ড সময় নষ্ট করছ তোমরা। চলো।”  স্নেহাঙ্গী আবার তাড়া লাগায়।

পরিদাদু চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়ান। বলেন, “চলো। তোমার কেসটা নিলাম আমি। শুধু তুমি বললে বলেই নিলাম অবশ্য। তা নইলে এমন কঠিন কাজ তো আমায় দিয়ে হবার নয়…”

“ইশ, মিথ্যেকথা খালি তোমার।”  স্নেহাঙ্গী চোখ পাকিয়ে বলে।

পরিদাদু শাওনের দিকে চেয়ে বললেন, “কী রে শানু যাবি আমার সাথে নাকি এখানে বসে গপ্প করবি চন্দ্রাদের সাথে?”

“যাব।”  বলেই লাফিয়ে উঠে দাঁড়ালো শাওন। স্নেহাঙ্গী দরজার দিকে ফিরতে ফিরতেই সামনে হাত বাড়ালো, “এসো…”

স্নেহাঙ্গীদের ফ্ল্যাটটা বেশ বড়ো। আসলে পাশাপাশি দুটো ফ্ল্যাট জুড়ে এই ফ্ল্যাট। রাঙাঠাকুমা ড্রয়িং রুমে একটা সিংগল সোফায় বসে ছিলেন। পাশে পিতলের তৈরি পানের বাটা ও পিকদানি। মহিলা বেশ ব্যক্তিত্বময়ী ও সুন্দরী। ওরা ঘরে ঢুকতেই তিনি উঠে দাঁড়ালেন। বললেন, “দিদি এলে? ওঁদেরকেও ধরে এনেছো দেখছি।”  

পরিদাদু বুকের কাছে হাতদুটো জড়ো করে নমস্কার জানালেন, কিন্তু মহিলার চোখে মুখে কোনো ভাবান্তর হল না। শাওন বুঝতে পারল উনি দেখতে পাচ্ছেন না। পরিদাদুও বুঝলেন। মুখে বললেন আবার, “নমস্কার।”  

“নমস্কার।”  রাঙাঠাকুমাও হেসে হাত দুটো নমস্কারের ভঙ্গীতে ওপরে তুললেন, “বসুন। আমার পাগল দিদিটা খুব বিপদে ফেলেছে তো আপনাদের?”

“তা তো একটু ফেলেইছে,”  পরিদাদু হেসে ফেললেন, “আপনার চশমা খুঁজে দেবার গুরুদায়িত্ব আমার ওপরে এসে বর্তেছে।”  

“চশমাটার জন্যে সত্যিই খুব অসুবিধা হচ্ছে,”  রাঙাঠাকুমা বললেন, “এই দেখুন না আপনাদের দেখতেই পাচ্ছি না ভালো করে। তা আমার দাদুভাইটি আসেনি? শাওন?”  

“এই তো আমি,”  বলে নীচু হয়ে তাঁর পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করে শাওন।

“বেঁচে থাকো দাদু,”  বলে হাত দিয়ে শাওনের থুতনি ধরে চুমু খেলেন তিনি, “আমি শুনেছি খুব সাহস আর বুদ্ধি তোমার।”  

শাওন লজ্জা পেয়ে গেল। কথা বলল না কোন। রাঙাঠাকুমা আবার বলতে শুরু করলেন, “বয়স্ক মানুষেরা সাধারণত একটু একাকিত্বে ভোগেন। আমার ছেলে বৌমা দুজনেই পারিবারিক ব্যাবসার কাজে বাইরে বেরোয়। ছোটো ছেলেও সকালবেলাতেই বেরিয়ে যায়। ওর আলাদা ব্যাবসা। মাঝে ব্যাবসার কাজে ওকে বাইরেই বেরোতে হয় কয়েকদিনের জন্যে।”

“আর ওঁর স্ত্রী?” রাঙাঠাকুমার কথার মাঝখানেই বলে ওঠেন পরিদাদু।

“ও ব্যাচেলার। বিয়ে থা করেনি। আমি তো ওই নিয়ে দিন রাত্তির পিছনে পড়ে আছি ওর। ওর বৌদিও। কিন্তু রাহুলের এক গোঁ, ব্যাবসাটাকে আর একটু না দাঁড় করিয়ে সে কিছুতেই বিয়ে করবে না।”  

“রাহুলবাবুর ব্যাবসাটা কীসের?” পরিদাদু সহজ গলায় জিজ্ঞেস করলেন।

“লেদার গুডস। ওর প্রডাক্ট নানান রকমের। তাদের কোয়ালিটিও শুনেছি ভালোই। এক এজেন্ট মারফৎ এক্সপোর্ট করে বলেও জানি।”  

“বাহ। আর আপনার বড়ো ছেলে আর ওঁর স্ত্রী?”

“রাতুলের কাপড়ের ব্যাবসা। ওটাই আমাদের পারবারিক ব্যাবসা। ওর বাবারও ওই ব্যাবসাই ছিল। হাওড়া আর বরানগরে  আমাদের দুটো শো রুম আছে। খুব চালু ব্যাবসা। ওঁর আমলে ব্যাবসা যা ছিল রাতুল তা অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। আমার বৌমা নন্দাও খুব পরিশ্রম করে অবশ্য…”

রাঙাঠাকুমার কথার মধ্যেই এক মহিলা ট্রে তে করে শরবত আর স্ন্যাক্স নিয়ে এলেন পরিদাদু আর শাওনের জন্যে। স্নেহাঙ্গী পরিচয় করিয়ে দিল, “এই হল রানুপিসি। রানুপিসি খুব লক্ষ্মী পিসি। আমায় খুব ভালোবাসে। আমাদের জন্যে রান্না করে, আমায় স্কুলে যাবার সময় হেল্প করে। খাবার সময় রোজ কত গল্প বলে আমায়…”

golpojaydeep01 (Medium)“কীসের গল্প বলে তোমায় রানুপিসি?”

“রাজকন্যার গল্প, ওর গ্রামের নানান মেলা পার্বণের গল্প, ভূতের গল্প…”

“ইশ আমার খুব আফশোস হচ্ছে জানো তো স্নেহা, আমারও যদি অমন একটা মিষ্টি পিসি থাকত, কত গল্প শুনতে পেতাম আমি। তোমাকে ঠাকুমাও তো গল্প শোনান বললে?”

“হ্যাঁ শোনায়ই তো। ঠাকুমা গল্পের বই এর পোকা একেবারে। বাবাকে দিয়ে লাইব্রেরি থেকে নিয়মিত বই আনায় আর আমাকে পড়ে শোনায়। চশমাটা নেই বলে ঠাকুমা পড়তে পারছে না আর আমারও নতুন নতুন গোয়েন্দা গল্পগুলো শোনা হচ্ছে না।”

“আপনি বুঝি খুব গোয়েন্দা গল্প পড়েন?”

“পড়ি। আমার দিদিও ওই ধরনের গল্প শুনতে খুব ভালোবাসে। কাজেই আপনি আমার বাড়িতে আসবেন এটা আমাদের কাছে খুব উত্তেজনার ব্যাপার। কিন্তু আমার কপাল দেখুন, ভালো করে আপনার মুখটা দেখতেই পাচ্ছি না।”  বলে অসহায় ভঙ্গীতে মাথা নাড়লেন রাঙাঠাকুমা। পরিদাদু কথাটা আমল দিলেন না। বললেন, “কবে থেকে পাচ্ছেন না চশমাটা?”

“তরশু থেকে। ওইদিন সকালেও গল্প পড়ে শুনিয়েছি দিদিভাইকে। তারপর দুপুর থেকে কোথায় যে গেল চশমাটা। দুপুরে শোবার সময় মাথার বালিশের পাশেই রেখেছিলাম বলে মনে হচ্ছে এখনও। অথচ বিকেলে ঘুম থেকে উঠে আর খুঁজে পেলাম না।”

“ও,” পরিদাদু উঠে দাঁড়ালেন। ঘরে পায়চারি করতে করতে বললেন, “কোন ঘরে শুয়েছিলেন?”

“আমার বেডরুমে।”  

“আমি যাব একবার ও ঘরে? বিছানার খাঁজে টাঁজে বা তোশকের নীচে টিচে ঢুকে যেতে পারে। আপনার পক্ষে তো নিশ্চিত ভালো করে খুঁজে দেখা সম্ভব হয়নি…”

“ওরা দেখেছে। রাহুল, রানু, স্নেহা… তবু আপনি চাইলে দেখতে পারেন,”  বলে হাঁক পাড়লেন তিনি, “রানু, ওঁকে একবার আমার ঘর থেকে ঘুরিয়ে নিয়ে আয় না মা…”

রানুপিসি এলেন। বললেন, “আসুন।”  

শাওন জিজ্ঞেস করল, “আমি যাব তোমার সঙ্গে পরিদাদু?”

“চল।”  পরিদাদু সম্মতিসূচক মাথা নাড়লেন।

“আমিও যাব,”  বললে স্নেহাঙ্গী।

“তাহলে তুমিই বরং ওঁদের আমাদের পুরো বাড়িটাই ঘুরিয়ে দেখিয়ে টেখিয়ে দাও, আমি হাতের কাজগুলো সেরে ফেলি সেই ফাঁকে,”  রানুপিসি স্নেহাঙ্গীর মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করে দিয়ে বললেন।

“এসো,”  স্নেহাঙ্গী পর্দা ঠেলে একটা ঘরে ঢুকে বলল। শাওন আর পরিদাদুও ঢুকে পড়লেন তার পিছু পিছু। ঘরটা বেশ বড়ো। ঘরের একধারে একটা সেকেলে মস্ত পালঙ্ক। তার ওপরে কাঠের নকশা কাটা সুন্দর করে। পালঙ্কের ওপরে পরিপাটি করে গুছিয়ে রাখা বিছানা। মাথার বালিশের পাশে মলাট বন্ধ করা একটা বাংলা থ্রিলার। পরিদাদু বইটা হাতে নিয়ে উলটে পালটে দেখলেন খানিক। দুয়েকটা পাতা ওল্টালেন। বইটা নাকের কাছে ধরলেন একবার। তারপর আবার নামিয়ে রাখলেন যেখানে বইটা ছিল, সেখানেই। ঘরের অপর প্রান্তে সাদা মার্বেলের একটা সিংহাসন। সেই সিংহাসনে ভারী সুন্দর করে সাজানো রাধাকৃষ্ণের যুগল মূর্তি। পেতলের। দুটি বিগ্রহেরই হাতে পায়ে গলায় গয়না দিয়ে সাজানো। বিগ্রহের পায়ের কাছে ফুল, তুলসিপাতা আর চন্দন দেওয়া রয়েছে অত্যন্ত পরিপাটি করে। পরিদাদু জিজ্ঞেস করলেন, “এই বিগ্রহের পুজো কে করেন? বাইরের পুরোহিত নাকি…”

“না না, রাঙাঠাকুমা নিজেই রোজ পুজো করে দু’বেলা। পুজো না করে জলও খায় না সকাল সন্ধে। এই রাধাকৃষ্ণ একেবারে ঠাকুমার নিজের ছেলেমেয়ের মতন। পুজোর পরে দুজনের চিবুক ধরে যখন আদর করে না দেখলে তুমি অবাক হয়ে যাবে। মনে হয় সত্যিই যেন কোনো মানুষকে আদর করছে।”  স্নেহাঙ্গী পরিদাদুর কথা শেষ হবার আগেই বলে উঠল খলবল করে।

“আর এই ফুল সাজানো, চন্দনের টিপ দেওয়া…” পরিদাদু আবার জিজ্ঞেস করলেন।

“রাঙাঠাকুমাই করে এসব। ঠাকুরের পুরো ব্যাপারটাই ঠাকুমার নিজের হাতে করা চাই। অন্যদের অ্যালাও করতে চায় না কিছুতেই…”

“হুঁ,”  পরিদাদু মাথা নাড়লেন, “পরশুও করেছিলেন?”

“হুঁ,”  একটু ভেবে নিয়ে এক দিকে ঘাড় কাত করে জবাব দিল স্নেহাঙ্গী।

“কাল?”

“হ্যাঁ।

“আজ?”

“আজ?” বলে দু’দিকে মাথা নাড়াল স্নেহাঙ্গী, “না আজ করেনি। সাধারণত পুজোর আগে ঘরের দরজা খোলেই না রাঙাঠাকুমা। আজ খুলে বাইরে বেরিয়ে এসেছিল। খুব রাগ করছিল কেউ চশমাটা খুঁজে দিতে পারল না বলে। বার বার রানুপিসিকে বকছিল। তারপর মাকে বলল রাধারানি আর শ্রীকৃষ্ণের ফুল চন্দন দেবার জন্যে। চোখে দেখতে পাবে না, কোথায় ফুল দিতে কোথায় ফুল দেবে, কোথাকার চন্দনের ফোঁটা কোথায় গিয়ে পড়বে…”

“মা দিলেন?”

“দিলেন।”  

“রানুপিসি কী করছিলেন তখন?”

“বাড়ির কাজ কর্ম সারছিল মুখ বুজে। খুব গম্ভীর আর মনখারাপ মনখারাপ ভাব ছিল রানুপিসির মুখে। আমার কষ্ট হচ্ছিল ওকে দেখে।”  

“তোমার বাবা আর কাকা কী বললেন?”

“বাবা বোঝানোর চেষ্টা করছিল বার বার চশমাটা বাড়ির বাইরে কোথায়ই বা যাবে। আছে কোথাও। ঠিক পাওয়া যাবে।”  

“আর কাকা?”

“কাকা কিছু বলেনি তো…তাড়াতাড়ি কাজে বেরিয়ে গেল আজ। খেয়েও গেল না। বলল তাড়া আছে। বাইরে খেয়ে নেবে। রাঙাঠাকুমা আমাকেও বকেছে আজ। তাই আমি ভাবলাম এক্ষুনি তোমায় ডেকে আনি। তুমি ঠিক চশমা খুঁজে বের করে দেবে।”

“তোমাকে বকলেন কেন?”

“জানি না,”  বলেই মাথাটা নীচে নামিয়ে নিল স্নেহাঙ্গী। পরিদাদু ঠাকুরের সিংহাসনের কাছে গিয়ে আরো কিছুক্ষণ বিগ্রহের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তারপর বললেন, “চল শানু বাইরে যাই।”    

রাঙাঠাকুমা মুখে পান পুরে দিয়ে চিবোচ্ছিলেন। খুব মিষ্টি একটা গন্ধ পাচ্ছিল শাওন। পানের মশলার। ওরা সেই ঘরে ঢুকতেই তিনি পানের পিক ফেললেন পিকদানিতে। তারপর চোখ ছোটো করে বললেন, “পাওয়া গেল?”

“নাহ,”  পরিদাদু খুব নির্বিকার গলায় বললেন। তারপর রাঙাঠাকুমার দিকে চেয়ে বললেন, “আপনার চশমাটা তরশুদিন হারিয়েছে বললেন না?”

“হ্যাঁ তাইতো বললাম।”  

“তারপর থেকে আর স্নেহাঙ্গীর গল্প শোনা হচ্ছে না আপনার কাছে।”  

“কী করে হবে? পড়তেই পারছি না। আগের বইটা কবে থেকে পড়ে রয়েছে বাড়িতে। শেষ করাও হল না যে নতুন বই আনতে পাঠাব আবার। ভাল্লাগে না বাপু। চশমাটা সত্যিই কোথায় যে গেল!”

“পেয়ে যাবেন।”  পরিদাদু নিশ্চিন্ত মুখ করে বললেন। তারপর স্নেহাঙ্গীকে আদর করে দিয়ে বললেন, “তাহলে স্নেহা মা, আমরা আসি এখন।”  

রানুপিসি সেই সময়েই প্লেটে করে মিষ্টি নিয়ে এলেন। বললেন, “তা হয় নাকি। প্রথম এলেন এ বাড়িতে…”

পরিদাদু না করলেন না। মিষ্টি খেতে খেতেই রাঙাঠাকুমার ঠাকুরের সিংহাসন, তার সাজানো এবং বিগ্রহের খুব প্রশংসা করতে লাগলেন। তারপর বললেন, “আপনার বৌমা আর রাতুলবাবু রাহুলবাবুর সাথে আলাপ হল না বলে খারাপ লাগছে।

“রাতে এস না আবার পরিদাদু,”  স্নেহাঙ্গী আবদেরে গলায় বলল।

“দেখি,”  বলে পরিদাদু হাসলেন। তারপর রাঙাঠাকুমার পিছনদিকে দেওয়ালে টাঙ্গানো তাঁর ঘরে রাখা রাধাকৃষ্ণের বাঁধানো ছবিটার দিকে একদৃষ্টে চেয়ে রইলেন চুপ করে। তাঁর দু চোখের মাঝখানে ভাঁজ পড়ে গেল হঠাত। আপন মনেই বলে উঠলেন তিনি, “আশ্চর্য!”

“কী আশ্চর্য পরিদাদু?” অবাক হয়ে জিজ্ঞেস করল শাওন।

শাওনের প্রশ্নটাকে আমলই দিলেন না পরিদাদু। রাঙাঠাকুমার দিকে চেয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “ শ্রীকৃষ্ণের গলায় ওই যে নীল পাথরের সুন্দর লকেটটা…”

“ওটা অরিজিনাল নীলকান্তমণি। ওটা সারা বছরই ওঁর গলায় থাকে। আর শ্রীরাধার গলার লকেটটা বার্মিজ চুণী। আমার শাশুড়ির আমল থেকেই ওই হারদুটো ওদের গলাতে অমন করেই পরানো আছে।”   

“তার মানে দুটোই বেশ দামি।”  

“তা তো নিশ্চয়ই। তবে আমার তো ওদের গলায় ওগুলো দুললেই ওগুলোকে দামি মনে হয়। নইলে কেবল সাধারণ পাথর বা কাচের সাথে ওগুলোর পার্থক্য বুঝি না বাপু আমি।”  

“হুঁ।”  বলে গম্ভীর মুখে কিছুক্ষণ চুপ করে রইলেন পরিদাদু। তারপর বললেন, “আমার বিশ্বাস আপনার হারিয়ে যাওয়া চশমাটা আপনি হয়ত কালই খুঁজে পেয়ে যাবেন। কাল সন্ধেবেলা আমি আসব। আজকের রাতে আমায় বাকি দু একটা অংক মিলিয়ে নিতে দিন। তারপর বিশদে কালই কথা হবেখন। আর আপনার কাছে একটা অনুরোধ চশমাটা পাবার আগে স্নেহা বা রানুদেবীকে আর বকাবকি করবেন না। ওরা সত্যিই হয়ত হারানো চশমার ব্যাপারে কিছু জানে না।”  

রাঙাঠাকুমা কিছু বললেন না। তাঁর চোখ কুঁচকে গেল পরিদাদুর কথায়। মিষ্টির পাত্র শেষ করে পরিদাদু উঠে পড়লেন। রাঙাঠাকুমাকে হাতজোড় করে নমস্কার করে বললেন, “আসি। কাল দেখা হচ্ছে তাহলে।”  

“আসুন।”  রাঙাঠাকুমাও প্রতিনমস্কার জানালেন।  

রাঙাঠাকুমার ফ্ল্যাট থেকে বেরিয়ে আবার চন্দ্রা মাসির ফ্ল্যাটে ফিরে এসেই পরিদাদু বললেন, “খুকু তোরা আজ নিজেদের মতন একটু ঘুরে টুরে নে। আমি একটু বেরোব।”  সুছন্দা অবাক হয়ে বললেন, “এ আবার কী কথা?”

অরুণাংশু ভুরু কুঁচকে বললেন, “কী ব্যাপার বলো দিকিনি পরি, ওই বাচ্ছা একরত্তি মেয়েটার ছেলেমানুষি আব্দারটাকে তুমি সিরিয়াসলি নিয়ে নিলে নাকি?”

“প্রথমটা নিইনি জানো তো,”  পরিদাদু হাসলেন, “সত্যি বলতে কি এই চশমা হারানোর ব্যাপারটা মাথায় নিয়ে ওদের বাড়িতে একটু চিন্তাভাবনা করতেই আমি বুঝেও গেলাম ঘটনাটার মধ্যে বেশ একটা ছেলেমানুষি মজাই আছে। কিন্তু অন্য একটা ব্যাপার হঠাৎ চোখে পড়ে যেতেই পুরো ঘটনাটা অন্য দিকে মোড় নিয়ে নিল। মনে হল কী একটা যেন গড়বড় আছে এখানে…”

“জানি না বাপু। কী যে কারো না তুমি… যেখানেই যাবে একটা কিছু ঘোঁট পাকিয়ে উঠবে তোমাকে ঘিরে,”  সুছন্দা গজগজ করতে লাগলেন, “ভাবলাম সকলে মিলে মজা করে ঘুরে আসব মায়ের মন্দিরে একসাথে। তা না এই এক ঝামেলা এসে হাজির হল।”  

পরের দিন সকালেও পরিদাদু কোথায় কোথায় সব ঘুরে এলেন। শাওন জিজ্ঞেস করেছিল দু’একবার কোথায় যাচ্ছে পরিদাদু, কিন্তু তিনি বিশেষ আমল দেননি সে কথায়। দুপুরে ঘুরে আসার পরে তাঁর মুখে হাসি ফুটল। শাওনের পিঠে আলতো চাপড় মেরে বললেন, “সন্ধেবেলা মুখে চুনকালি পড়বে না রে শানু। এ যাত্রাতেও জিতেই গেলাম মনে হচ্ছে।”  তারপরেই চন্দ্রা মাসির দিকে চেয়ে বললেন, “কিরে স্নেহা আসেনি একবারও সকাল থেকে?”

চন্দ্রা মাসি আর শাওন দুজনেই হইহই করে বলে উঠল, “এসেছিল তো। তোমাকে বলব বলেই অপেক্ষায় আছি আমরা তখন থেকে। রাঙাঠাকুমার চশমা পাওয়া গেছে। ওঁর বালিশের পাশে তোষক আর খাটের মাঝখানের খাঁজে ঢুকে ছিল। আজ সকালে স্নেহার মা বিছানা তুলতে গিয়ে দেখতে পেয়েছে।”  

“পেতেই হবে,”  বলে হাসলেন পরিদাদু।

“ব্যাপারটা কী বলো দেখি পরিকাকু?” চন্দ্রা মাসি বললেন কৌতূহলী গলায়।

“সন্ধেবেলাই শুনে নিস নাহয়।”  বলে চেঞ্জ করতে ঘরে ঢুকে গেলেন পরিদাদু।  

সন্ধেবেলা স্নেহাঙ্গীদের বাইরের ঘরে এসে সকলে বসতেই রানুপিসি সকলকে চা আর বিস্কুট দিয়ে গেলেন। নন্দাদেবী খুব আন্তরিকভাবে বললেন, “আজ সকলে কিন্তু আপনারা আমার অতিথি। এখানেই ডিনার করবেন আজকে। রাঙাঠাকুমা একগাল হেসে বললেন, “আর কোনো চিন্তা নেই, আমার চশমা পেয়ে গেছি। মন দিয়ে রাধাগোবিন্দের সেবা করেছি আজ। গল্পের বইও পড়ে শুনিয়েছি স্নেহাদিদিকে…”

“বাহ,”  পরিদাদু হাসলেন, “আপনার চশমাটা না পাওয়ার কথাও তো ছিল না মাসিমা। আপনি তো ভালো করেই জানতেন ওটা হারায়নি।”

“চশমা হারায়নি। মানে?” অবাক হয়ে বলে শাওন।

“হারায়নি,”  পরিদাদু হাসলেন, “ওটা তো ঠাকুমা নাতনীর একটা সাজানো খেলা ছিল তাই না স্নেহাঙ্গী? আমাকে বাজিয়ে দেখে নেবার জন্যে…”

স্নেহাঙ্গী কথা বলল না কোনো। মুচকি হেসে মাথা নামিয়ে ফেলল মাটির দিকে। রাঙাঠাকুমা বাটা থেকে পান বের করে দ্রুত সেজে নিয়ে মুখে পুরলেন। তারপর স্নেহাঙ্গীর দিকে চেয়ে বললেন, “এইরে তোমার গোয়েন্দা দাদু যে ধরে ফেলেছে দেখচি আমাদের প্ল্যানট্‌ল্যানগুলো ..”

“আমি কিন্তু গোয়েন্দা টোয়েন্দা নই,”  পরিদাদু চায়ের কাপে লম্বা চুমুক দিলেন, “আর এটা বোঝার জন্যে গোয়েন্দা হবার দরকারও নেই। চোখকান খোলা রাখলেই বোঝা যায়। তাছাড়া আপনার অসতর্কতাও ছিল খানিকটা…”

“কীরকম, কীরকম?” নড়েচড়ে বসলেন রাঙাঠাকুমা।  

“ওই যে আপনার বিছানায় মাথার বালিশের পাশে রাখা বইটা,”  পরিদাদু বিস্কুটে কামড় দিলেন।

“বইটা পড়তেই পারছিলাম না কদিন…”

“বাজে কথা,”  তাঁকে থামিয়ে দিলেন পরিদাদু, “আপনি দিব্যি বইপত্র পড়ছিলেন। পরশু রাতেও পড়েছেন সম্ভবত…”

“যাহ, কী বলছেন?” রাঙাঠাকুমা বললেন বটে তবে খুব জোর দিয়ে নয়।

পরিদাদু হেসে ফেললেন। তারপর স্নেহাঙ্গীর দিকে চেয়ে বললেন, “কী স্নেহা, পরশুও তুমি তো রাঙাঠাকুমার লাইব্রেরি থেকে আনানো নতুন বইটা থেকে গল্প শুনেছ?”

“হুঁ।”  আবার মাথা নাড়ল স্নেহাঙ্গী লাজুক লাজুক মুখ করে।

পরিদাদু বললেন, “পরশুদিন বইটা লাইব্রেরি থেকে আনা হয়েছে। বই ইস্যু করার তারিখ থেকে দেখলাম। তখনি সন্দেহ হল। তার আগের দিন থেকেই যদি পড়াশোনা বন্ধ আপনার তাহলে বই আনার এত তাড়া কেন? তারপর নিজেই ভাবলাম হয়ত আগের বইটা পড়া হয়ে গেছে বলে আগে ভাগে এনে রেখেছেন। ভেবেছেন চশমাটা খুঁজে পেলেই পড়বেন। তারপর বইটা হাতে  নিতেই পরিচিত জর্দার গন্ধ নাকে এল। বইটার প্রথম দিকের বেশ কিছু পাতা জুড়ে লেগে রয়েছে সেই গন্ধ। মৃদু যদিও, তবু বোঝা যায়। আর আপনাকে দেখলামও, পান মুখে দিয়ে হাতের আঙুলে করে জর্দা তুলে মুখে দেবার অভ্যাস আপনার…”

“মিসটেক, মিসটেক…” পরিদাদুর কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন রাঙাঠাকুমা, “আমার বোকামিই হয়ে গেছে। বইটা ওইভাবে ওখানে ফেলে রাখা এক্কেবারে উচিত হয়নি আমার। ব্যাপারটা এমন হতে পারে মাথাতেই আসেনি। অথচ আসা উচিত ছিল…”

“আরো আছে,”  পরিদাদু বললেন।

“বলেন কী? আরো বোকামি করেছি নাকি?”

“বোকামি ঠিক নয় এটা। আসলে স্নেহার ছোটো মাথায় অত আসেনি। আমি জিজ্ঞাসাবাদ করার সময় বেমালুম বলে দিল পরশু পর্যন্ত আপনিই পুজো আচ্চা সামলেছেন, ফুল সাজিয়েছেন, চন্দনের টিপ পরিয়েছেন বিগ্রহকে। আমার সন্দেহ হল। চশমা ছাড়া আপনি এসব করলেন কী করে… তারপর শুনলাম আজ আপনি নিজে এসব কাজ করতে পারেননি, রাগ করেছেন অন্যদের ওপরে চশমাটা খুঁজে না পাওয়ায়। আমার কাছে ব্যাপারটা জলের মতন পরিষ্কার হয়ে গেল। বুঝলাম যদি চশমাটা হারিয়েই থাকে তবে সেটা পরশু রাতে বা কাল সকালে। তবে সকালে হওয়ার সম্ভাবনা কম। কেননা আপনিই সকলের আগে ঘুম থেকে ওঠেন…”

“ইশ, দিদিভাই মস্ত ভুল করে ফেলেছে দেখচি,”  রাঙাঠাকুমা মাথা নাড়াতে থাকেন আফশোসের ভঙ্গীতে।

“দূর ওটা কোনো ব্যাপারই না। কত পেশাদার অপরাধী ভুল করে ক্লু ফেলে আসে অপরাধের জায়গায়।”  পরিদাদু হাল্কা গলায় বললেন, “তখনই বুঝলাম ব্যাপারটায় গোলমাল আছে। পুরো ব্যাপারটাই হয়ত সাজানো একটা খেলা…”

“তাই তো ছিল,”  স্নেহাঙ্গী বলে উঠল, “কিন্তু কাল সক্কালবেলা রাঙাঠাকুমা কী করে যেন সত্যি সত্যিই চশমাটা হারিয়ে ফেলল। কোথায় রেখেছিল রাতে কে জানে, সকাল থেকেই হুলুস্থুল। একবার আমায় বকে তো আর একবার রানুপিসিকে। বলে কিনা আমরা সত্যিই ওটা লুকিয়ে রেখেছি কেসটা আরো গোলমেলে করতে। ওদিকে পুজোর সময় হয়ে যাচ্ছে…”

“রাগ হবে না বলুন?”  রাঙাঠাকুমা আবার পান মুখে পুরলেন, “আমার ওপরে আস্থা নেই। বললাম চশমাটা দে। তোর পরিদাদু কিছুতেই বুঝবেন না ওটা আমার কাছে আছে। এমন নাটক করব উনি ভাবতেই পারবেন না ব্যাপারটা সাজানো। তা হবে কেন, দুজনেই বলে কিনা চশমাটা কোথায় জানে না…”   

“সত্যিই তো আমরা জানি না। আমি কি রাঙাঠাকুমার চশমা চুরি করেছি যে বলতে পারব ওটা কোথায় আছে?” খুব অভিমানের সঙ্গে বলে স্নেহাঙ্গী, “ভেবেছিলাম তোমাকে আর শানুদাদাকে নিয়ে একটা দারুন মজা করব। তোমাকে হয়ত বলেই ফেলতাম শেষ পর্যন্ত, কিন্তু শানুদাদাকে বলতাম না মোটেই। সবাই তো বলে ওর নাকি খুব বুদ্ধি আর সাহস, দেখতাম নিজের মাথা খাটিয়ে ওটা বের করতে পারে কিনা…”

“পেরে যেতামই তো,”  স্নেহাঙ্গীর দিকে মুখ ভেংচে দিয়ে বলে শাওন।

“তাহলে পরীক্ষা হয়ে যাক,”  পরিদাদু শাওনের দিকে তাকিয়ে মুচকি হাসলেন, “এখন তাহলে বোঝা যাচ্ছে চশমাটা দ্বিতীয়বার আবার লুকোনো হয়েছিল। আর সেবারে লুকোনো হয়েছে স্নেহাঙ্গী আর তোদের রাঙাঠাকুমার অগোচরে। তাহলে বল দিকি চশমাটা কে সরিয়ে রেখেছিল?”

“সিম্পল,”  শাওন হাসে, “পাজলটা এখন অনেক সহজ হয়ে গেছে।”  

“তাহলে বল কে?”

“রানুপিসি।”

“রানু! যাহ, হতেই পারে না। ও খুব লক্ষ্মী মেয়ে,”  রাঙাঠাকুমা বললেন।

“শিওর রানুপিসি। আর কেউ হতেই পারে না। কিন্তু কেন রানুপিসি চশমাটা লুকোতে গেল তা আমি বলতে পারব না কিন্তু।”  শাওন লাজুক গলায় বলে।

“সাবাশ,”  ওর পিঠে আলতো চাপড় মারেন পরিদাদু, “এটুকুই যথেষ্ট তোর পক্ষে। এখন বল তোর লজিকটা কী ছিল?”  

“লজিক ওয়ান, স্নেহাঙ্গী ওর মা বাবার সাথে বন্ধুর বার্থ ডে পার্টিতে গিয়েছিল ওইদিন। ওদের ফিরতে রাত হয়েছিল। অত রাত পর্যন্ত রাঙাঠাকুমা জেগে থাকেন না। চন্দ্রা মাসি বলেছিলেন ওইদিন ওরা সকলেই খুব টায়ার্ড ছিল। ফিরে এসেই শুয়ে পড়েছিল। আর স্নেহার কাকা তো এমনিতেই রোজ রাত করে ফেরেন…”

“তাতে কী হল শানুবাবু,”  পরিদাদু হাসলেন, “তোমাদের রাঙাঠাকুমা ঘুমিয়ে পড়ার পরে ওঁর ঘরে ঢুকে কি চশমাটা চুপি চুপি সরিয়ে ফেলা যায় না?”

“তা যায় অবশ্য।”  শাওন মাথা চুলকোতে থাকে।  

“সুযোগ তো সত্যি বলতে সকলেরই ছিল। রাহুলবাবু, রাতুলবাবু, নন্দাদেবী, তোর রানুপিসি…”

“রানুপিসি তাহলে সরায়নি?” হতাশ গলায় বলে শাওন।

পরিদাদু হা হা করে হেসে উঠলেন। তারপর বললেন, “পুরো ব্যাপারটাই দারুন মজার রে শানু, দারুন লুকোচুরি খেলা একটা।”

“সাসপেন্স না বাড়িয়ে বলেই ফেলো না পরিকাকু ঘটনাটা,”  সুছন্দা বলে ওঠেন এতক্ষণ চুপ করে বসে থাকার পর।

“যা বলেছো,”  অরুণাংশুও সমর্থন করেন তাঁকে।

বিতান মেসো বলেন, “কাকু কুইক, রানু কষা মাংসের যা গন্ধ বের করেছে রান্নাঘর থেকে, বেশিক্ষণ বসে থাকা মুশকিল হাত গুটিয়ে…”

“তা ঠিক,”  পরিদাদু বললেন, “তবে রানু এখানে থাকলে ব্যাপারটা আরো জমত।”  

“ও কী করে থাকবে এখন,”  নন্দাদেবি অপ্রস্তুত গলায় বললেন, “রান্নাঘরে এত কাজ এখন…”

“আসলে চশমাটা ওই তো সরিয়েছিল পরশু রাতে…” পরিদাদু বলে ওঠেন, “শানু প্রেডিকশনটা কিন্তু ভুল করেনি।”  

“সত্যিই রানু,”  অবাক হয়ে বলেন রাঙাঠাকুমা, “এত ভালোবাসি মেয়েটাকে…নিজের মেয়ে বলে বিশ্বাস করি, সেইরকমই দেখি ওকে। আর ওই কিনা। ডাকো ওটাকে।”  

“থাক না, কাজ আছে যখন ওর,”  পরিদাদু নরম গলায় বললেন, “চশমাটা ও সরিয়েছে ঠিকই, তবে ওকে তো আর অপরাধী বলা যায় না…”

“মানে?” রাতুলবাবু সবে দোকান থেকে ফিরে বসেছিলেন এসে এই ঘরে। পরিদাদুর কথার মাঝখানেই বলে উঠলেন তিনি।

“আপনিও তো ব্যাপারটা জানেন রাতুলবাবু,”  পরিদাদু মোলায়েম গলায় বললেন, “খুব গোপন কিছু তো নয় এটা…”

“না মানে…” বলে দু’বার ঢোক গিলে চুপ করে গেলেন রাতুলবাবু।

রাঙাঠাকুমা অসহিষ্ণু গলায় বললেন, “আমার তো কিছুই মাথায় ঢুকছে না।”  

“আর কী হবে এসব কথা বলে,”  নন্দা বললেন, “চশমাটা যখন পাওয়াই গেছে…”

পরিদাদু আবার হাসলেন, “না চাইলে আমি আর বলব না কিছু। তবে আমার একটা বিচ্ছিরি অভ্যাস আছে জানেন তো। মনে কিছু উটকো প্রশ্ন এলে সেই প্রশ্নের উত্তর না পাওয়া পর্যন্ত আমি ঠিক স্থির হতে পারি না। কাজেই আপনাদের বাড়ি এসে যেই আমার মনে খটকাটা এল আমি সেই খটকা না মেটা অব্দি মাথাটাকে ঘামাতে বাধ্য হলাম।”  

“তোমরা সবাই মিলে আমায় কী লুকোতে চাইছ বৌমা?” রাঙাঠাকুমা চোখ সরু করে বললেন, “ভুলে যেও না আমিও দিনরাত বিস্তর গোয়েন্দা গল্পের বই ঘাঁটি। কাজেই আমার মাথাও যে একেবারেই খেলে না তা নয়। আমি নিশ্চিত রানুকে দিয়ে কেউ এ কাজটা করিয়েছিল এবং তার একটা সুনির্দিষ্ট মোটিভও ছিল। পরিমলবাবু আপনি নিশ্চিন্তে বলুন সে কে? রাহুল কি?”

“নাহ,”  পরিদাদু বললেন, “যদিও আমারও প্রথম ওঁর নামটাই মাথায় এসেছিল।”  

“কেন?” অরুণাংশু জিজ্ঞেস করলেন।

“চশমা সরিয়ে তাঁর লাভবান হতে চাইবার কারণ ছিল।”

“বুঝলাম না কাকু। ঝেড়ে কাশুন এবারে একটু।”  বিতান মেসো বললেন হাল্কা গলায়।

“আসলে এই চশমা সরিয়ে রাখার পিছনে সত্যিই একটা উদ্দেশ্য ছিল।”  পরিদাদু বললেন।

“কী উদ্দেশ্য?” সুছন্দা জিজ্ঞেস করলেন।

“এ বাড়ির রাধাগোবিন্দের গলায় যে বহুমূল্য রত্নহার দুটি আছে সেগুলি সরানো।”  

“কী বলছেন আপনি?” রাঙাঠাকুমা সোজা হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, “কে এ কাজ করেছে?”

“আপনি উত্তেজিত হবেন না প্লিজ,”  পরিদাদু তাঁর দিকে তাকিয়ে হাতজোড় করলেন, “আপনি আর একটু ধৈর্য ধরে বসুন। আমি তো আগেও বলেছি। এই ঘটনার মধ্যে অপরাধ খোঁজার দরকার নেই। পুরো ব্যাপারটাই একটা মজাদার লুকোচুরি খেলা…”

“পরিকাকু তুমি বলো কী ঘটেছে আসলে,”  চন্দ্রা বলে আগ্রহ নিয়ে।

“বলছি, বলছি,”  বলে বড়ো করে দম নেন পরিকাকু। তারপর বলতে থাকেন, “কাল এই ঘরে ওই ছবিটা দেখেই খটকাটা মাথায় এল,”  বলে ঘরে টাঙানো রাধাগোবিন্দের ছবিটা দেখালেন পরিদাদু, “ছবিতে বিগ্রহের গলায় যে হার রয়েছে মাসিমা বললেন পুরোনো আমল থেকেই সারাবছর নাকি সেই হার বিগ্রহের গলায় পরানো থাকে। অথচ ঘরে বিগ্রহের গলায় দেখলাম অন্য হার। অনেকটা এ ধরনেরই, তবু আলাদা। খুঁটিয়ে বিগ্রহের দিকে চাইলে তফাতটা চোখে পড়বেই। তখনই বুঝতে পারলাম এই তফাতটাকে মাসিমার চোখের আড়ালে রাখতেই চশমাটা এবারে সত্যি সত্যিই সরিয়ে দিয়েছে কেউ।”

“উরিব্বাস, এ যে সত্যিকারের গোয়েন্দা গপ্পের মতন ব্যাপার!” চোখ বড়ো বড়ো করে বললেন অরুণাংশু। সঙ্গে সঙ্গে সুছন্দা ধমক দিলেন তাঁকে, “কথা বোলোনা তো এখন খামোকা। পরিকাকুকে বলতে দাও।”  অরুণাংশু একবার সুছন্দার দিকে আড়চোখে তাকিয়ে চুপ করে গেলেন সঙ্গে সঙ্গে।

ব্যাপারটা নজরে আসতেই প্রথমেই সন্দেহ গেল রাহুলবাবুর দিকে। একমাত্র ওঁরই টাকা পয়সার হঠাৎ দরকার লেগে যেতে পারে। কেন না ওঁর ব্যাবসাটা এখনও ঠিক স্টেডি নয়। তাছাড়া না খেয়ে দেয়ে সাত তাড়াতাড়ি ওঁর কাল বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাওয়া…”

“আমিও তো ওইজন্যেই প্রথমে ওই হতভাগাটারই নাম করলাম,”  রাঙাঠাকুমা পিকদানিতে পানের পিক ফেলে বললেন।

“কিন্তু চন্দ্রার ফ্ল্যাটে ফিরে ঠান্ডা মাথায় ভাবতেই মনে হল উঁহু যা ভাবছি ব্যাপার তো তা নয় মোটেই,”  পরিদাদু আবার বলতে শুরু করলেন, “হারগুলো হাতানোই যদি মতলব হয়, আর সেটা রাঙাঠাকুমাকে জানতে না দেওয়াই যদি উদ্দেশ্য হয় তাহলে চশমা সরিয়ে তো তা সম্ভব নয়। চশমা তো আজ না হয় কাল ফেরত দিতেই হবে। না দিলে নতুন চশমাই করে নেবেন উনি। কেননা চশমা ছাড়া বেশিদিন তো ওঁর পক্ষে থাকা সম্ভব নয়। তখন বুঝলাম আসলে এটাও একটা মেক শিফট অ্যারেঞ্জমেন্ট। চশমার মতন হারটাও এক দু দিনের মধ্যে ফিরে আসবে নিশ্চিত। আর তখন রাহুলবাবুর ওপর থেকে সন্দেহটাও সরে গেল। আবার ভাবতে শুরু করলাম তখন অল্প সময়ের জন্যে হারগুলো সরানোর কেন দরকার হল।”

“ওরে বাবা, এ যে মারাত্মক ভুলভুলাইয়া গো পরিদাদু, আমার যে কিছুই মাথায় আসছে না,”  শাওন গালে হাত দিয়ে একমনে শুনতে শুনতে বলে উঠল এবারে।

“একটাই সূত্র তখন মাথার মধ্যে ঘুরপাক খাচ্ছে,”  পরিদাদু আবার শুরু করলেন ধীর শান্ত কন্ঠে।

“কী সূত্র?” রাঙাঠাকুমা জানতে চাইলেন।

“কাল সকালে আপনার অপারগতার জন্যে নন্দাদেবী দেবসেবার যাবতীয় কাজ সেরেছেন নিজের হাতে। অর্থাৎ বিগ্রহের হার একমাত্র তিনিই সরাতে পারেন। এবং তিনিই সরিয়েছেন। নাহলে হার যে পালটে গেছে এ ব্যাপারটা তাঁর চোখে না পড়ার কথা নয়।”

“শেষপর্যন্ত বৌমা ?” খুব হতাশ গলায় বললেন রাঙাঠাকুমা, “কিন্তু কেন?”

“সেইটা খুঁজে বের করতেই একটা আস্ত দিন পথে পথে ঘুরে বেড়াতে হয়েছে আমায়। রাতুলবাবুর শো রুম, যেখানে নন্দাদেবী বসেন নিজে, তার আশেপাশের গয়নার দোকান, ব্যাঙ্ক…” পরিদাদু একটু থেমে জল খেলেন দু ঢোঁক। তারপর বললেন, “সহজে কি তথ্য দেয় কেউ? আর দেবেই বা কেন? নাম ভাঁড়িয়ে, পুলিশের লোক পরিচয় দিয়ে, তারপরে ব্যাঙ্কে তো সত্যিই পুলিশ ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন করিয়ে তবে সহযোগিতা পেয়েছি। সব দেখে শুনে তবে পুরো ব্যাপারটা বুঝলাম। আর তখন নিজেরই যা হাসি পাচ্ছিল… কাকে কাকে না চোর ভাবতে যাচ্ছিলাম আর একটু হলে…”

“ওহ, আবার ভনিতা। ভাল্লাগে না বাপু,”  সুছন্দা হাত নেড়ে বলেন, “আসল কথাটা খুলে বলো দেখি ঝটপট…”

“নন্দাদেবী গয়নার দোকানে এই হারদুটোর ছবি দেখিয়ে হুবহু এক দেখতে ঝুটো রত্নের কমদামি হার বানাতে অর্ডার দিয়েছিলেন। সেগুলো বানানো হয়ে যেতে আসল হারদুটো সরানোর দরকার হল। সুযোগ এল আমরা আসছি শুনে ঠাকুমা নাতনির চশমা হারিয়ে যাওয়ার নাটকের স্ক্রিপ্ট লেখা হওয়ার পর। নন্দাবৌদি আর রাতুলবাবু প্ল্যান করলেন সত্যিসত্যিই চশমাটা অন্তত একদিনের জন্যে হাপিশ করে দেবার যাতে মাসিমা বিগ্রহ দেখতে না পান এবং তাদের সেবা করতেও না পান। ওঁদের কথামতন রাতে রানু সরিয়ে রাখল চশমাটা আর সেই সুযোগে পরদিন সকালে নন্দা হারদুটো খুলে বিগ্রহের গলায় অন্য হার পরিয়ে রাখলেন একদিনের জন্যে কেননা আগের দিন মালিকের অসুস্থতার জন্যে দোকান বন্ধ ছিল বলে হারটা তিনি হাতে পাননি। পরের দিন হার হাতে পান তিনি। আসল হার ব্যাঙ্কের লকারে রেখে আসেন তিনি। আমি ওইদিন তাঁর লকার ব্যবহারের খবর নিয়েছি ব্যাঙ্কে। আমার ধারণা ওই হারদুটিই তিনি লকারে রাখতে গিয়েছিলেন সেদিন। আমি কি ঠিক বললাম নন্দাবৌদি?” পরিদাদু নন্দা দেবীর দিকে চাইলেন।

“ঠিক।”  ছোট্ট উত্তর দিয়ে মাথা নামালেন ভদ্রমহিলা।

“ওই নকল হার ঠাকুরের গলায় পরানোর পরে রাঙা মাসিমার চশমা লুকিয়ে রাখার আর তো প্রয়োজন নেই। কাজেই আপনি আপনার চশমা ফেরত পেয়ে গেলেন।”  পরিদাদু রাঙাঠাকুমার দিকে চাইলেন।

“কিন্তু এতসব করার দরকারটাই বা কী ছিল?” রাঙাঠাকুমা একরাশ বিরক্তি গলায় নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

“ফর সেফটি। রাতুলবাবু আর বৌদি নিশ্চিত ওই দামি জিনিসগুলো এমন অরক্ষিত অবস্থায় বাড়িতে রাখতে ভয় পাচ্ছিলেন…”

“এগজ্যাক্টলি,”  পরিদাদুর মুখের কথা কেড়ে নিয়ে বলে উঠলেন রাতুলবাবু, “আপনিই বলুন তো পরিমলবাবু এটা রিস্ক হয়ে যাচ্ছিল না? আমরা কেউ বাড়িতে থাকি না। বাড়িতে লোক থাকা মানে মা আর রানু। দিনকাল ভালো নয়। কখন কী হয়ে যায়… মা এসব কিছুতেই বুঝবে না। আগে অনেকবার বলেছি আমরা অত দামি গয়না সবসময় ঠাকুরের গায়ে পরিয়ে রাখার কী দরকার? খুলে আলমারিতে রেখে দিই বরং। মা রাজি না হয়ে রেগেই আগুন। কী আর করি বলুন। অগত্যা…”

পরিদাদু রাঙাঠাকুমার একেবারে কাছটিতে গিয়ে বসে খুব নরম গলায় বললেন, “রাতুলবাবুর কথাটা মিথ্যে নয় কিন্তু মাসিমা। ওঁরা যথেষ্ট বিবেচনা করেই সিদ্ধান্তটা জানিয়েছিলেন তখন আপনাকে। দিনকাল সত্যিই খুব খারাপ। ওগুলো বাড়িতে থাকলে বিপদ হতেই তো পারে। তার চেয়ে থাক না ওগুলো সেফ কাস্টডিতে। আপনার ঠাকুরের জন্যে যে হার বৌদি গড়িয়ে দিয়েছেন তা তো নিঃসন্দেহে অসাধারণ। আপনি নিজেই তো আগের গুলোর সঙ্গে এগুলোর তফাত বুঝতে পারেননি মাসিমা। আর আপনিই না বলেন দ্রব্যমূল্য দিয়েই শুধু কোনো জিনিসের দামের বিচার হয় না…”

রাঙাঠাকুমা কথা বললেন না কোনো। চুপ করে রইলেন। নন্দা দেবী রাঙাঠাকুমার কাছে এসে কাঁচুমাচু মুখ করে বললেন, “সরি মা, কিছু মনে করবেন না প্লিজ। আমি সত্যি খুব লজ্জা পাচ্ছি এখন…”

রাঙাঠাকুমা তাঁর চশমার মোটা কাচের মধ্যে দিয়ে সকলের মুখের ওপর দিয়ে চোখ বোলালেন খানিক। তারপর সবাইকে অবাক করে দিয়ে হো হো করে হেসে উঠলেন হঠাৎ। তারপর স্নেহাঙ্গীকে বুকে জড়িয়ে ধরে উচ্ছল ভঙ্গীতে বলে উঠলেন, “দেখলে দিদি কান্ডটা। তুমি আমি মিলে তোমার পরিদাদুকে বোকা বানাতে চাইলুম আর তোমার মা বাবা রানু মিলে কিনা আমাকেই কিরকম বোকা বানিয়ে দিল…আর তোমার পরিদাদু হাটের মাঝখানে বোকা বানিয়ে দিল আমাদের সব্বাইকে। এই সমস্ত কিছু বুদ্ধি খাটিয়ে ধরে ফেলে…”

রাঙাঠাকুমার কথায় সকলে উল্লাসে হইহই করে উঠল একসঙ্গে। আর তখনই রানুপিসি ঘরে এসে ঢুকলেন। সকলের দিকে হাসিমুখে তাকিয়ে নিয়ে শাড়ির আঁচল দিয়ে কপালের ঘাম মুছতে মুছতে বলে উঠলেন, “কথায় কথায় রাত তো বেশ হল। রান্নাবান্না কিন্তু রেডি। এখন আপনারা বললেই আমি লুচি বেলা শুরু করতে পারি…”

“নিশ্চয়ই, নিশ্চয়ই,”  প্রথম বলে উঠলেন বিতান মেসো। আর তাঁর সঙ্গে গলা মিলিয়ে দিলেন অন্যেরাও।

 ছবিঃ ইন্দ্রশেখর

জয়দীপ চক্রবর্তীর আগের গল্প ইচ্ছেমতন স্বপ্ন