চোর চোর-যশোধরা রায়চৌধুরী
শিশুকুমার সাধুখাঁর বাড়ির একতলার ঐ বড় বড় জানালাওয়ালা, হাওয়া বাতাস খেলার জন্য সারারাত জানালা খুলে রাখা একটা ফ্ল্যাট। সে যে কী বিচ্ছিরি একটা চড়ুইপাখির খোপের মত ঘর!
তবে ওরা এখন ভাগ্যিস আর সে বাড়ির ভাড়াটে নয়, আর থাকেও না গোলাপবালা সরকার লেনের চৌহদ্দির মধ্যে। ওরা এখন থাকে অনেক দূরে, অন্য শহরে। ও পাড়ার চোরেদের কেউ চিনে ফেলবে, এমন কোন সম্ভাবনাই তো নেই এখন আর!
তাই বানিয়ে বললেই বা কি।
নিশুতি রাতে যারা বাড়িতে আসে, তারাই চোর।
সেবার এসেছিল, নলিনীপিশিদের বাড়িতে।
ওরা সেদিন ঘুমুচ্ছিল।
রোজ রাতে যেমন ঘুমোয় আর কি। নলিনীপিশির বর নিতিনপিশে হাঁ করে চিৎ হয়ে, নাক ডেকে। নলিনীপিশির মেয়ে পুঁটি বাবা আর মায়ের মাঝখানে চিঁড়েচ্যাপ্টা হয়ে। আর নলিনীপিশি উপুড় হয়ে, উশখুশ করতে করতে!
সকালে উঠতে হয় নলিনীপিশিকে, পুঁটির স্কুল থাকে বলে। উঠে ঘুমচোখে হাতড়াতে হাতড়াতে রান্নাঘরে গিয়ে, এক বার্নারে ফ্রাইং প্যান অন্য বার্নারে চায়ের জলের পাত্র বসিয়ে, ঘুমচোখে, জলের পাত্রে ডিম ভেঙে দিয়ে আর ফ্রাইং প্যানে জল ঢেলে গুবলেট পাকিয়ে, তারপর পুঁটিকে টেনেটুনে ঘুম থেকে তুলে, স্নানে পাঠিয়ে, স্নান থেকে বের করে আধরান্না হওয়া খাবার খাইয়ে, দুদিকে দুটো ঝুঁটি বেঁধে, ইস্কুলের জামা পরিয়ে, স্কুলবাসের দিকে দৌড়ে দৌড়ে গিয়ে, ওকে বাসে তুলে দিয়ে ফিরে এসে ধপাস করে আবার শুয়ে পড়ার আগেই, হঠাৎ, দেখে ফেলল, জানালার পাশে পিশের অফিসের ফোলিয়ো ব্যাগ কেমন যেন কেতরে রয়েছে!
দেখেই তো খটকা লেগেছে। তারপর ফোলিয়ো ব্যাগ তুলে দেখে কিসসু নেই ভেতরে। শুধু রাশি রাশি কাগজপত্র। অনেক কাজের জিনিশ থাকে ব্যাগে।
বুকটা ধ্বক করে উঠল।
তারপর দেখল, পাশেই জানালাটা খোলা, যেমন থাকে রোজ রাত্তিরে। কেননা ঘরে হাওয়া না খেললে ঘুমোতে পারেই না পিশে, পিশিও না।
তারপর ব্যাগের অবস্থান আর গ্রিল লাগানো জানালার অবস্থান দেখে আন্দাজ করল ডিটেক্টিভের মত, দু মিনিটে, আমাদের নলিনীপিশি। বাইরে! জানালা দিয়ে হাতটুকু ঢুকিয়ে ব্যাগশুদ্ধু বার করে নিতে পারেনি রাতের অতিথি। তাই জিনিশগুলো একে একে বার করে নিয়েছে।
বেরিয়ে এল দ্রুতপায়ে। দেখল, ঠিক ওই জানালার বাইরে ছোট্ট যে প্যাসেজটা, সেইখানে লাইন দিয়ে সাজানো রয়েছে ব্যাগ থেকে একে একে বার করে আনা সবরকম জিনিশ। কাগজ, ফাইল, ডায়েরি, চশমার খাপ, এমনকি পেনড্রাইভ দাঁতনকাঠি মশলার কৌটো পর্যন্ত। ব্যাগটা বড়, আটকে গেছে গ্রিলে। শুধু জিনিশগুলো চালান হয়েছে বাইরের প্যাসেজে। আর তন্ন তন্ন করে খোঁজা হয়েছে। যদি থাকে টাকাকড়ি।
কিন্তু নাঃ। চোরের কম্মো এটা, কিন্তু চোর বাবাজি সফল হননি। কেননা পিশে টাকাপয়সা ওই ফোলিও ব্যাগে রাখেনা।
তবে গেল কী? গেল কী?
হুলস্থুল হাঁউমাঁউ করে ডেকে তুলেছে পিশি, পিশেকে। উঠে ব্যাপারটা বুঝে উঠতেই পিশের তিনকাপ চা লেগে গেছে। তারপর ভাল করে দেখে শুনে বলেছে পিশে, নাঃ ব্যাটারা যত বুদ্ধিমানই হোক। আমার বুদ্ধিকে টেক্কা দিতে পারবে না। আমি তো টাকা রাখি প্লাস্টিকে। মানে, ক্রেডিট কার্ড ডেবিট কার্ডেই বেশির ভাগ টাকা তুলি, অল্প করে তুলে, খরচ করি। তাইই। কিসসু নিতে পারেনি।
কিন্তু টর্চটা কোথায় গেল?
পিশের ব্যাগে টর্চ থাকে রাত্তিরে ফেরার সময় রাস্তার আলোটালোগুলো সবসময় জ্বলে না বলেই। সেই টর্চ আর খুঁজেই পেল না যখন, বুঝল চোরের দরকারি অন্তত একটা জিনিস ব্যাগ থেকে খোয়া গেছে।
অন্য ঘরে পিশে পড়াশুনো করে, পাশের প্যাসেজ ঘুরে চলে গেছে সেই দিকে। ওঃ মা! সেই ঘরে এতক্ষণ যাবার কথা তো মনেই হয়নি! এখন হঠাৎ কী মনে হওয়াতে ওইদিকে গিয়ে দেখে, সর্বনাশ, জানালার গ্রিলে একটা লম্বামত কঞ্চি ঠেশ দিয়ে রাখা কেন?
তারপর একে একে উদ্ধার হল, কী কী চুরি গেছে। গ্রিলের ছোট ফুটোয় হাত ঢোকেনা, কঞ্চি ঢোকে। কঞ্চি ঢুকিয়ে দিয়ে ডগায় ফাঁশিয়ে , একে একে জিনিশগুলো খুব কায়দা করে, তুলে নিয়ে তারপর গ্রিলের ফাঁক দিয়ে বার করে নিয়েছেন চোর বাবাজি। এভাবেই, কম্পিউটারের পাশে রাখা ঘড়িটা হাওয়া! টাকার পেটমোটা ব্যাগটা পড়ে আছে জানালার বাইরে, তবে ক্রেডিট কার্ড ডেবিট কার্ড খোয়া যায়নি, গেছে দুশো তিরিশটাকা আর কিছু খুচরো!
তাহলেও, দুঃখ কম নাকি! ওই ঘড়িটা বিয়েতে পেয়েছিল পিশে। আর একটু হলে মোবাইল ফোনটাও যেত, ওটা বাঁশের কঞ্চি দিয়ে তুলে আনতে গিয়ে পারেনি, জানালার একেবারে কোণায় সিঁটিয়ে পড়ে আছে মোবাইলটা। যাক ।
২
এরপর থেকে আর নলিনীপিশি ঘুমোতেই পারত না। রোজ ঘুম থেকে উঠে পড়ত মাঝরাত্তিরে, মনে হত বাড়ির আশেপাশে কারা যেন ঘুরে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একদিন মাঝরাতে উঠে জানালায় দেখেছিল কে যেন টর্চ মারছে। চোখে আলো লাগল। সে রাত তো ঘুমোতেই পারল না , পিশেকে ডেকে তুলে হাউমাউ করে বলল, এ বাড়িতে, এ পাড়াতে আর থাকব না। চোরের আড্ডা।
জানালায় ইতিমধ্যেই ভাল করে ছোট ছোট ফুটো ওয়ালা জাল লাগিয়ে নিয়েছিল নলিনীপিশি। কাজেই চোর বাবাজি হাত ঢুকিয়ে ম্যানেজ করতে পারবেন না। কঞ্চি ঢোকালেও, জিনিশ টেনে বার করতে পারবে না।
কিন্তু ওই যে, গরমের সময়ে রাত্তিরে জানালা না খুলে শুলে ঘুম আসে না পিশির। জানালা বন্ধ রাখলে ঘরটা যেন একেবারে একটা গুদোমঘর হয়ে যায়।
সব শুদ্ধু, একটা চোরের জন্যই শেষ মেশ ওই পাড়া ছাড়তে হল নলিনীপিশিকে।
৩
এর অনেক বছর পর, একটা নতুন পাড়ায় দোতলায় দিব্যি আরামে ছিল নলিনীপিশি আর পিশে। এতদিনে অনেকটা বড় হয়ে গেছে পুঁটিও। এখন কলেজে পড়ে। পিশের অফিস পিশির অফিস, দুটোই দিব্যি চলছিল। কিন্তু হঠাৎ একদিন পুঁটি দেখল, কী যেন একটা হয়েছে। বাবা মা দুজনেই ফিসফিসিয়ে কথা বলে শুধু। খুব যেন অশান্তিতে আছে। মাঝে মাঝে কম্পিউটার খুলে ঘন্টার পর ঘন্টা বসে কাজ করে বসে বাবা। মা, বাবাকে বোঝায়, এত খেটো না ব্যাপারটা নিয়ে। আর তা ছাড়া, তুমি ত আর সারা পৃথিবীর সব অন্যায় থামাতে পারবে না, এই একটা চুরি ধরলেই কি আর তোমার দেশ শুদ্ধ পবিত্র হয়ে যাবে?
কী ব্যাপার, একদিন জিগ্যেস করেই বসল পুঁটি। জানল বাবার অফিসে একটা ভীষণ গোপন অডিটের কাজ হচ্ছে। কাজটা বেশ কিছুদিন ধরে চলছে, কিন্তু যদি ঘুণাক্ষরেও খবরের কাগজ আর টিভির নিউজের লোকেরা জানতে পারে এটার কথা, তাহলে আর রক্ষে নেই। সব জায়গায় খবরটা ছয়লাপ হয়ে যাবে। এটা একটা বিশাল মাপের স্ক্যাম।
স্ক্যাম মানে কি,পুঁটি বিলক্ষণ জানে। যাকে বলে পুকুর চুরি। একটা চোর যখন মানিব্যাগ, ঘড়ি বা মোবাইল ফোন চুরি করে, আমরা চীৎকার করি। কিন্তু আমাদের দেশে বড় বড় চোরেদের দল আছে, তাদের দেখলে চোর বলে চেনা যায় না। মানুষের জন্য সরকার থেকে অনেক টাকা বরাদ্দ করে, কিন্তু মানুষের কাজে লাগার বদলে , তার থেকে অনেকটা ওই চোরেদের পকেটে গিয়ে ঢুকে পড়ে। কেউ জানতে পারে না। বা জানলেও বলতে পারে না।
এখন পিশে যে ডিপার্টমেন্টে কাজ করে, সেই ডিপার্টমেন্টে ইন্টারনাল অডিট নামে একটা বিভাগে পোস্টিং পেয়েছে। সে দলটার কাজই এই। অফিসের ভেতরে কেউ কোন টাকা নয়ছয় করছে কিনা, কেউ গোপনে পুকুর চুরি করছে কিনা, সেটা জানাই কাজ।
আর, পিশেমশাই হঠাৎ, বেশ বড় বড় চোরেদের একটা বিশাল চুরি ধরে ফেলেছে। এই রিপোর্ট বানাতেই এখন হিমসিম পিশে। সাহায্য করছে পিশিও ।
পুঁটি খ্যাঁক খ্যাঁক করে হাসতে থাকে। আগে, অনেক বছর আগে, নিজের মাকে না ঘুমিয়ে চোরের চিন্তায় রাত কাটাতে দেখেছে, তবে এবারের মত নয়।
বড়ো বড়ো চোরেদের হাতে কঞ্চি থাকে না। তারা রাত বিরেতে এসে টর্চের আলোও ফেলেনা। শুধু , সবার অজান্তে সব গরিব মানুষের টাকা চলে যায় তাদের ব্যাঙ্ক অ্যাকাউন্টে।
রিপোর্টটা বেরোনর পর পিশেকে ডিপার্টমেন্ট বিশেষ স্বীকৃতি দিয়েছিল। আর, জেলে গেছিল বেশ কিছু ধুরন্ধর চোর।
গ্রাফিক্সঃ ইন্দ্রশেখর
জয়ঢাকের সমস্ত গল্পের লাইব্রেরি এই লিংকে