গল্প

পিপীলিকাপুরের রানিপিঁপড়ে

রতনতনু ঘাটী

GALPORATAN (Medium)পৌরবীদের আতা বাগানের নীচে পিঁপড়েদের যে একটা নতুন রাজ্য হয়েছে, তার নাম পিপীলিকাপুর। সে রাজ্যের যে হেড, মানে সেই যে রানি-পিঁপড়ে ট্যান্টেনার আজ সকাল থেকে খুব মন খারাপ। রানি-পিঁপড়ের অমন ইংরেজি নাম কেন? কে রেখেছে?

কেন? ওই পিপীলিকাপুরের যে একটা নেতা গোছের পুরুষ-পিঁপড়ে আছে না? সে একবার গিয়েছিল পাকুড় পাতার নৌকোয় চেপে গঞ্জমতী খাল পেরিয়ে পরাগদের বাড়ি। পরাগ ইংলিশ মিডিয়ামে পড়ে কেজি-টু ক্লাসে। পরাগদের স্কুলের নাম ‘বাডস’, মানে ‘ফুলের কুঁড়ি’! পরাগ নাকি সেদিন সকালবেলা বসে জোরে জোরে একটা ফেয়ারি টেল পড়ছিল। সেই গল্পে ‘ট্যান্টেনা’ নামটা শুনেই পুরুষ-পিঁপড়েটার খুব পছন্দ হয়ে গিয়েছিল। পিপীলিকাপুরে ফিরতে ফিরতে ভেবেছিল, “আমাদের হেড রানিপিঁপড়ের তো কোনও নামই নেই। ফিরে গিয়ে আমি আমাদের রানিপিঁপড়ের অমন সুন্দর নামটাই রাখব।”

পিপীলিকাপুরে ওই নামটা শুনে শ্রমিক-পিঁপড়েরা তো বেজায় খুশি। তারা ভাবল, এবার থেকে অন্য রাজ্যের পিঁপড়েদের গলা তুলে বলার মতো একটা কথা পাওয়া গেল বটে! আর সব পুরুষ-পিঁপড়ে যে খুব খুশি হল, এমন বলা যায় না। তবে তারাও মুখ নেড়ে মন-রাখা ভাবে বলল, “তা বেশ! মন্দ কী? ভালোই তো নামটা!”

কিন্তু পিপীলিকাপুর রাজ্যে অনেক রানি-পিঁপড়ে থাকে তো! অন্য রানি-পিঁপড়েরা খুশি হওয়া তো দূরের কথা,হিংসেয় ক’দিন ভাল করে মুখে মুখে লাগিয়ে কথাই বলাবলি করল না নিজেদের মধ্যে। রাগে মুখ ভার করে বসে রইল চুপটি করে আতা গাছের ঝরে পড়া শুকনো পাতার নীচে। যেন একটু পরেই খুব বৃষ্টি নামবে! তাই তার আগে মাথা বাঁচাতে হবে তো, এমন একটা ভাব!

শুধু একটাই রানি-পিঁপড়ে মুখ বেঁকিয়ে বলেছিল, “এ আবার কী নামের ছিরি? এ কি কোনও নাম হল নাকি? ট্যান্টেনা মানেটাই বা কী?”যে নেতা মতো পুরুষ-পিঁপড়েটা অমন সুন্দর নামটা শুনে এসে হেড রানি-পিঁপড়ের ওই নামটা রেখেছিল, সে ছ’টা পায়ে এদিক ওদিক চরকির মতো কয়েকবার পাক খেয়েও এর মানে খুঁজে পেল না। তারপর একটা শুকনো শিউলি ফুলের কুঁড়িকে মাইকের মতো তুলে ধরে ঘোষনা করে দিল, “পৃথিবীতে অত যে কথার পিঠে কথা আছে, তার সব কথার কি মানে আছে নাকি? আমি সকলকে বলে দিলাম, আমাদের রানি-পিঁপড়েরও নামেরও কোনও মানে নেই।”

সে সব তো গেল রানি-পিঁপড়ের নাম নিয়ে নানা কথা। কিন্তু গোটা পিঁপড়ে-রাজ্যের সকলেই আজ খুব চিন্তিত। কেন? রানি-পিঁপড়ে ট্যান্টেনার হঠাৎ আমন মন খারাপ হল কেন?

কিন্তু রানি-পিঁপড়েকে মন খারাপের কারণ জিজ্ঞেস করার মতো ক্ষমতা কারই বা আছে? তাই সকাল থেকে মুখ চাওয়াচাওয়ি কাণ্ড চলছিল পিপীলিকাপুর রাজ্যে। এ ওর মুখের দিকে তাকায় তো ও তার মুখের দিকে। সেদিন সকলের সব হাতের কাজ পড়ে রইল। কেউ খাবার খুঁজতে বেরোল না। কেউ বাসা মেরামত করল না। গোটা রাজ্য জুড়ে আকাশে বাতাসে ভেসে বেড়াতে লাগল হেড রানি- পিঁপড়ের মন খারাপের খবরটা।

অমন সময় সকলেই দেখল, গটমট করে হেড রানি-পিঁপড়ে যেন কোথাও যাচ্ছেন। এ ওর মুখের সামনে মুখ এনে বলল, “রানিমা কোথায় যাচ্ছেন কেউ জানো কি? আগেভাগে খবর পেয়েছ কিছু?”

কেউ বলল, “আমি জানি না।”

কেউ বলল, “রাজা-রানিদের সব কথায় অমন করে মন দিতে নেই!”

কথায় কথায় চোখে কয়েকটা পলক পড়েছে কি পড়েনি, সব শ্রমিক-পিঁপড়ে, সব রানি-পিঁপড়ে, রোদের তাত বাঁচাতে চোখের উপর ছাতার মতো করে হাতের পাতা মেলে ধরে সকলে দেখল, হেড রানি-পিঁপড়ে। তড়বড় করে একটা মস্ত পাহাড়ে উঠে যাচ্ছেন।

একটা পুঁচকে শ্রমিক-পিঁপড়ে। তার নাম টইটই। সে সারাদিন এখানে ওখানে ঘুরে বেড়ায় বলে তার অমন নাম রেখেছেন হেড রানি-পিঁপড়ে। আর একটা পুঁচকে শ্রমিক-পিঁপড়ে, তার নাম আনমনা। নামও রেখেছেন হেড রানি-পিঁপড়ে।সে সব সময় আপন মনে থাকে, ডাকলে তার সাড়া মেলে না বলে তাকে ওই নামেই সক্কলে ডাকে।

আনমনা মুখ ফসকে টইটইকে জিজ্ঞেস করল, “তুই কখনও পাহাড়ে উঠিছিস রে টই?”

টইটই ঘাড় নেড়ে বলল, “না।” তারপর আনমনাকে টইটই জিজ্ঞেস করল , “তুই?”

আনমনা এক বুক শ্বাস ফেলে বলল, “নাঃ! পাহাড়ে চড়ব বললেই কি চড়া যায় নাকি? ওসব শিখতে হয়। তুই কি জানিস, ওসব শেখার জন্যে ইশকুল আছে?”

“কই, শুনিনি তো কখনও?”

আনমনা বলল, “আমাদের রানি-পিঁপড়ে ওই সব ইশকুল থেকে কবেই চার-পাঁচটা পাশ দিয়ে তবে এই পীপিলিকাপুর রাজ্যের রানি হয়ে এসেছেন!”

টইটই কিছু একটা বলতে যাচ্ছিল, তক্ষুনি ওরা দুজনে দেখল, হেড রানি-পিঁপড়ের মাথাটা প্রায় আকাশ ছুঁইছুঁই করছে।

আনমনা পিঁপড়েটা বলল, “দেখেছিস, রাজরানিরা ইচ্ছে করলে কেমন হুট করে আকাশ ছুঁতে পারেন?”

অমন সময় গোটা পিপীলিকাপুরের সব্বাই আকাশের দিকে ঘাড় উঁচু করে দেখল, হেড রানি-পিঁপড়ের মাথায় সাদা মেঘের জরির মুকুট পরা। দিনের বেলা ভুল করে আকাশে উঁকি দেওয়া একটা বিচ্ছু তারা সে মুকুটের চূড়ায় উঠে হিরের জলুস নিয়ে মিটিমিটি করে জ্বলছে আর নিভছে! রানি-পিঁপড়ের দু’কানে দুটো রামধনুর ছোট্ট টুকরো বসানো দুল। আর গায়ে নীল আকাশের ফিনফিনে একটা ওড়না জড়ানো। সে ওড়না আবার আকাশ পারের বাতাস লেগে হলমল করে উড়ছে। কী মিষ্টি দেখাচ্ছে যে রানি-পিঁপড়েকে!

তারপর যা ঘটল, তা দেখে তো সকলেই হাঁ! ও মা! যে পাহাড়টায় উঠেছিলেন রানি-পিঁপড়ে, সেই পাহাড়টাও যে এবার হেলতে দুলতে গটমট করে হাঁটতে শুরু করেছে! সব্বাই মনে মনে ভাবল, পাহাড়টাই বা কোথায় চলেছে?

একটা দেমাকি শ্রমিক পিঁপড়ে চেঁচিয়ে বলল, “আমাদের রানিমা ইচ্ছে করলে কী না পারেন? রানিমাGALPORATAN02 (Medium) চাইলে সমুদ্দুরের জল উপর দিকে উঠতে থাকে। রানিমার মন হলে, দিনের বেলায় মাথার উপর চাঁদ উঠে যায়। পাথরের যে অমন মস্ত পাহাড়, সেও পড়িমড়ি করে তেপান্তরের দিকে হাঁটতে শুরু করে।”

gaporatan03 (Medium)

কথাটা ঠিক-ভুল বিবেচনা করার মতো সময় পেল না কেউ। রানি-পিঁপড়ে তখন মেঘলোক দিয়ে যেন উড়ে চলেছেন বলা যায়। অনেকটা পরির মতো! সেদিকে তাকিয়ে একটা শ্রমিক-পিঁপড়ে আর একটা শ্রমিক পিঁপড়েকে বলল, “জানিস তো, আমার মনে হয়,আমাদের রানিমা মন
খারাপ করে অন্য পিপীলিকাপুরে চলে যাচ্ছেন। ওই যে আমি সেদিন ভালো করে মন দিয়ে খাবার জোগাড় করতে যাইনি! 
রানিমার মনে হয় অভিমান হয়েছে খুব!”

তার কথা শুনে একটা কাজ পাগল শ্রমিক পিঁপড়ে বলল, “ধুর, রাজা রানিদের কখনও মন খারাপ হয় না, এমনকী, অভিমানও হয় না। শুধু রাগ হয় তাঁদের।”

“তা হলে কি আমার উপর রানি-পিঁপড়ের রাগ হয়েছে? তাই তিনি অমন করে চলে যাচ্ছেন?”

তার কথা কারও কানে পৌঁছল বলে মন হল না। সকলে দেখল, রানি-পিঁপড়ে পাহাড়ের পিঠে চড়ে হেলতে দুলতে কোথায় যেন চলেছেন। মুখে রাগের চিহ্ন রাত্র নেই! বরং বেশ একটা গর্বের ভাব ঝরে পড়ছে চোখ মুখ থেকে।

রানিমার গর্ব তো হওয়ারই কথা! আর কোন পিপীলিকা রাজ্যের কোন রানি-পিঁপড়ের আমন সাহস আর ভাগ্য যে, অত উঁচু দিয়ে বেড়াতে যাবেন?”

পিপীলিকাপুরের সকলের মনে হল, রানি-পিঁপড়ে সামনের দুটো পা পতাকার মতো উপরের দিকে তুলে কিছু বলছেন। অত উপর থেকে পষ্ট শোনা যাচ্ছে না।

একটা মিচকে মতো রোগা লিকপিকে পিঁপড়ে ফস করে বলে ফেলল, “রানিমা পিপীলিকাপুরের সকলকে মনে হয় গুডবাই জানাচ্ছেন। আরা দেখা হবে না তো কারও সঙ্গে?”

কেউ সেই গুডবাই শুনতে পেল না বটে, তবে সকলেরই মনে ধরল কথাটা! তখন হঠাৎ করে সকলেরই মন খারাপ হতে শুরু করল আকাশ পারে মেঘ জমে ওঠার মতো করে।মন খারাপ তো অমন জিনিস, একবার কারও মন খারাপ হলে সকলকে ছুঁয়ে ছুঁয়ে যায়। কেউ কেউ চোখের পাতা বন্ধ করতে ভুলে গেল। কেউ আবার দু’চোখ ভাসিয়ে কাঁদতে বসে গেল শুকনো আম পাতার নীচে স্যাঁতসেঁতে কুটিরের নীচে।

কে যেন হঠাৎ শুনতে পেল হেড রানি-পিঁপড়ের কথা। সে বলল, “অ্যাই চুপ,চুপ! একটিও কথা নয়! সকলে কান পেতে শোনো, ওই তো রানিমা বলছেন, ‘তোমাদের দুঃখ যে আর দেখতে পারছি না। আমার দায়িত্ব বলে তো একটা কথা আছে, না কি? আমি তোমাদের জন্যে ভিন পিপীলিকা রাজ্য থেকে সুখ কিনতে যাচ্ছি!’”

তারপর সে একটু চুপ করে থাকল। তারপর কী ভেবে বলল, “কী গো, তোমরা কেউ রানিমার কথাটা শুনতে পাওনি?”

সকলেই ঘাড় নাড়ল দু’দিকে।না, তারা কেউ শুনতে পায়নি! তখন হেড রানি-পিঁপড়ে দেখতে দেখতে দিগন্তপারের মেঘের কাছে কাঠি-আইসক্রিমের মতো যেন মিলিয়ে গেলেন! তারই সাদা রংটা গিয়ে লাগল দুপুরের মেঘের গায়ে।

পিপীলিকাপুরের সব পিঁপড়ের মন খারাপ হয়ে গেল! কেউ নাইতে গেল না, কেউ খেতে বসল না, কেউ এককুটি কুটোও নাড়ল না সারাদিন। মন খারাপের ঝাঁক ঝাঁক কালো মেঘ এসে কুয়াশার মতো ঘিরে ধরল গোটা পিপীলিকাপুরকে।

শুধু একটা খুব বুড়ো মতো থুত্থুড়ে শ্রমিক-পিঁপড়ে টুকুস টুকুস করে বেরিয়ে পড়ল খাবার খুঁজতে। তাকে দেখে সকলে মন খারাপে ভারী হয়ে ওঠা মাথা তুলে বলল, “তুমি আবার কোথায় বেরোলে? তোমার বেরনো যে মানা করে দিয়েছেন রানিমা?”

বুড়ো শ্রমিক-পিঁপড়ের মুখে একটা লিকপিকে চাঁদের মতো সরু হাসির রেখা চিকমিক করে উঠল। সে বলল, “তোমার বসে বসে মন খারাপ করো। আমার এখন কি আর বসে থাকলে চলে?”

তারপর নিজের মনে গজগজ করে বলল সেই শ্রমিক-পিঁপড়েটা, “আরে শোনো, শোনো! মা তাকে জন্মদিনে কিচ্ছু দিতে পারেনি বলে একটা ছোট্ট হাতি মায়ের উপর অভিমান করে বন থেকে বেরিয়ে পিপীলিকাপুরের পাশে এসে ঘুমোচ্ছিল। আর আমাদের রানিমা, আদরযত্ন ঠিকমতো হচ্ছে না বলে তাঁর খুব মন খারাপ হল সকালবেলা। পিপীলিকাপুরের সব পিঁপড়েকে ভয় দেখাতে বিবাগী হওয়ার ভান করে তিনি পাহাড় পেরিয়ে তারপর যখন রানিমার পায়ের চাপে হাতিটার পিঠে সুড়সুড়ি লাগল, তখন বাচ্চা হাতিটার মায়ের কথা মনে পড়ে গেল ঝটাস করে! অমনি উঠে দাঁড়াল বনে যাওয়ার জন্যে। রানিমা আর হাতির পিঠ থেকে নামতেই পারেননি! এতক্ষণে আমাদের রানিমা ছোট্ট হাতিটার পিঠে চেপে গভীর জঙ্গলে গিয়ে পিপীলিকাপুরের পথটাই হারিয়ে ফেলেছেন!”

শ্রমিক পিঁপড়েটা বুড়ো হয়েছে তো, তাই তার ঘড়ঘড়ে গলার কথা পিঁপড়ে রাজ্যের কেউ পষ্ট শুনতেও পেল না।এই সব কথা শুনতে পেল শুধু বনশিমুলের ডালে বসে থাকা একটা ছোট্ট বেনেবউ পাখি।

বেনেবউ পাখি আরও একটা কথা শুনতে পেল। বুড়ো শ্রমিক-পিঁপড়ে বলতে বলতে খাবার খুঁজতে চলে গেল, “আরে, সুখ অমন করে কোথাও কিনতে পাওয়া যায় নাকি?”

সেই থেকে প্রতিদিন বিকেলবেলা হলদে, বেগনি, লাল, নীল রং মেখে যখন মেঘেরা সাজতে বসে, আঁকনকুশি নদীর জলে যখন তাদের মিটমিটে ছায়া পড়ে, তখন গোটা পিপীলিকাপুরের সব্বাই হাঁ করে তাকিয়ে থাকে। তারা এখনও বিশ্বাস করে, হেড রানি-পিঁপড়ে তাদের জন্যে সুখ কিনতে গেছেন দূর ভিন পিপীলিকা রাজ্যে! নিশ্চয়ই ফিরে আসবেন! আর মনে মনে সব পিঁপড়েই নিজেকে বোঝায়, “আরে, সুখ কি আর অত সহজ জিনিস যে, হুট বললেই কিনতে পাওয়া যায়? রানিমা’র অমন একটু দেরি তো হবেই!”