গজুমামার সঙ্গে পাহাড়ে —তাপস মৌলিক
গরমের ছুটিতে মামাবাড়ি গেছি দিল্লীতে। সেবার এমন গরম পড়েছে যে স্নানের সময় কেউ যদি ভুল করে গায়ে তেল মেখে ফেলে তবেই হয়েছে, সঙ্গে সঙ্গে ভাজা হয়ে যাবে। গরমে হাঁসফাঁস করতে করতে এক সকালে গজুমামা বলল, “ভাগনে?”
“মামা!”
“গরমে লোকে কোথায় যায়?”
“পাহাড়ে মামা।”
“হুমম, আর পাহাড়ে যখন রোদ্দুর উঠবে?”
“জঙ্গলে ঢুকে যাব মামা।”
“তৈরি হতে কতক্ষণ লাগবে তোর?”
“আধঘণ্টা মামা।”
“চল, লেট’স গো।”
গজুমামার সঙ্গে বেড়াতে যাওয়ার মজাই আলাদা। মামা হেঁজিপেঁজি লোক নয়। এককালে প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে লাঞ্চ করত, রাষ্ট্রপতির সঙ্গে ডিনার। হাইকোর্ট না সুপ্রিম কোর্ট কোথাকার যেন জজ ছিল। ইচ্ছে করলে যাকে-তাকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে দিতে পারত, দলকে দল ধরে জেলে পুরে দিতে পারত, নেহাত মনটা ভাল তাই করত না। বছর দুই আগে হঠাৎ মামা চাকরি ছেড়ে দিল। বলল, “দুত্তোর, সারাদিন খালি খুনে-ডাকাত আর চোরছ্যাঁচড়দের গুষ্টির পিণ্ডি চটকানো, ওসব বেশিদিন করলে অম্বল হয়।” এখন মামা বাড়িতেই থাকে, লম্বা লম্বা সাদাকালো দাড়ি আর গোলগাল একটা ভুঁড়ি রেখেছে, সারাদিন পড়াশোনা করে আর মোটা মোটা জ্ঞানের বই লেখে।
তৈরি হয়ে জুতো পরছি, মামা বলল, “পাহাড় সমগ্র আর জঙ্গল অমনিবাসটা নিয়েছিস তো?”
“হ্যাঁ মামা।”
ও দুটো কিন্তু কোনও বই নয়, দুটো ঝোলার নাম। পাহাড়ে যেতে যেসব টুকিটাকি লাগে সেসব একটা ঝোলায়, আরেকটায় জঙ্গলে ঘোরার দরকারি জিনিসপত্তর, হুট বললেই যাতে বেরিয়ে পড়া যায় তাই গোছানোই থাকে।
দাদু-দিদা বেড়াতে গেছেন মাসির কাছে বেনারস। বাড়িতে শুধু বুড়োদিদা, মানে গজুমামার ঠাকুমা, আর মামাবাড়ির সবাইকে সারাবছর দেখেশুনে রাখার লোক ভুতোদাদু। বুড়োদিদার বয়েস একশর ওপর। হলে হবে কি, দিব্যি আছেন, শুধু কানে একটু খাটো, চোখে একটু ঝাপসা দেখেন, আর শীতকালে বাতের ব্যথায় একটু কাবু হয়ে পড়েন।
গজুমামা বলল, “ঠাকমা, আমরা একটু পাহাড় থেকে ঘুরে আসছি।”
বুড়োদিদা বললেন, “এই রোদের মধ্যে বাজারে যাবি? তা যা, ঘুরে আয়। লেবুর শরবত করে রাখছি, এসে খাবি।”
“উফ্, ঠাকমা, পাহাড়ে, পাহাড়ে, বাজারে না। শীতের খোঁজে।”
“নাপিতের খোঁজে? যা বাবা, দাড়িটা কেটেই আয়। কী বনমানুষের মত চুলদাড়ি রেখেছিস, কতদিন বলছি কেটে আয়, কেটে আয়, ওতে উকুনে বাসা করবে, ছারপোকা হবে। অবশ্য তোর সোনাভাইয়েরও দাড়ি ছিল, তোর চেয়েও লম্বা লম্বা, বললেও কাটত না। কতবার বলেছি কাটো কাটো, আমাকে পাত্তাই দিত না। যা বাবা, কেটে আয়। দুপুরে ইলিশমাছের মাথা আর ছোলা দিয়ে কচুর শাক করেছি, তোর সোনাভাই খুব ভালবাসত।”
একতলায় নামতে নামতে মামা বলল, “না, দুপুরে খাব না। ভুতোকাকাকে বলে যাচ্ছি।”
সোনাভাই হলেন গজুমামার ঠাকুদ্দা, আমার বুড়োদাদু। বুড়োদিদার কথায় কথায় খালি সোনাভাই আর সোনাভাই। তেনার এমন দাড়ি ছিল, তেনার অমন খড়ম ছিল, সোনার ফ্রেমের চশমা ছিল। ওদিকে আবার বলেন সোনাভাই নাকি তাঁকে পাত্তাই দিতেন না। দেবেন কেন? তিনি যা জাঁদরেল কবিরাজ ছিলেন! গজুমামার কাছে শুনেছি, ইংরেজরা তাঁর কাছে ছাড়া চিকিৎসাই করাত না। লর্ড হার্ডিঞ্জ তো ভারতে এসে এমন পেটের ব্যামোয় ভুগতে শুরু করলেন যে দুদিন পর পর দিল্লী আসতেন সিধু কোবরেজের কাছে। শেষমেশ খরচা আর সময় বাঁচাতে রাজধানীটাই কলকাতা থেকে দিল্লীতে উঠিয়ে আনলেন। শুধু কি কবিরাজি? সাহিত্য, বিজ্ঞান, দর্শন – হেন জিনিস নেই যাতে সোনাভাই পণ্ডিত না ছিলেন। তারপর দেশ যখন স্বাধীন হল, সোনাভাই হঠাৎ একদিন কোথায় উধাও হয়ে গেলেন। অনেকদিন পর, গজুমামা যখন ছোট, একবার নাকি বাড়িতে এসেছিলেন। তখন তিনি জটাজূটধারী সন্ন্যাসী। দিন সাতেক ছিলেন, তারপর আবার নিখোঁজ হয়ে যান।
ট্রেন ধরে বিকেলে হরিদ্বার পৌঁছে হর কি পৌরির কাছে একটা হোটেলে উঠলাম। সন্ধেবেলা গঙ্গারতি দেখে রাতে দাদা-বৌদির হোটেলে জম্পেশ খেয়ে এসে ভোঁস ভোঁস করে ঘুমোলাম। পরদিন ভোরবেলা গঙ্গার ধারে এসে দাঁড়িয়েছি, ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা হাওয়া খাচ্ছি, গজুমামা উদাত্ত গলায় আবৃত্তি আরম্ভ করল, “হরিদ্বারে গঙ্গাতীরে
মলয় বাতাস বইছে ধীরে
নরম রোদে পাচ্ছে খিদে
জলখাবারে কী খাবি রে?”
ভাবছি কী খাওয়া যায়, কচুরি না আলুর পরোটা, হঠাৎ একজন মাঝবয়সী মোটামতন লোক, ধুতি আর ফতুয়া পরা, কপালে চন্দনের ফোঁটা কাটা, গলায় তুলসীর মালা, গজুমামার সামনে এসে বলল, “পেন্নাম হই বাবা, এখানে আপনার দর্শন পাব ভাবতেই পারিনি বাবা, আমার কী ভাগ্য!”
এই বলে গজুমামার পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করতে এল। গজুমামা তিন লাফে পিছিয়ে গিয়ে বলল, “ওকি ওকি, চোপ রও। আমি কোনও বাবা-টাবা নই। পায়ে হাত দেবে না খবরদার। একদম জেলে পুরে দেব।”
লোকটা তবু নাছোড়বান্দা, “একটু চরণের ধুলো দিন বাবা। হেঁয়ালি করছেন কেন। আপনাকে আমি ঠিক চিনেছি। সেবারে সেই বদ্রীনাথে দর্শন পেয়েছিলেম। সেই দাড়ি, সেই কন্দর্পকান্তি চেহারা, ও আমার ভুল হবার নয়। আমার দশ বছরের ছেলের পোলিও এক ওষুধে ঠিক করে দিলেন। আপনি সাক্ষাৎ ধন্বন্তরি বাবা।”
গজুমামা আমার জামার কলার খামচে এক টান মেরে বলল, “ভাগনে, পালা।”
সরু একটা গলির ভেতর একটা দোকানে একগাদা কচুরি সাঁটিয়ে দুজনে চারটে করে অমৃতি নিয়েছি, খেতে খেতে মামা বলল, “ভাগনে, কী বুঝলি?”
বললাম, “মামা, এখানে মোটেই ঠাণ্ডা নেই, জঙ্গলও নেই। বদ্রীনাথ চলো।”
ঝোলাঝুলি নিয়ে ঘামতে ঘামতে বাসস্ট্যান্ডে এসে দাঁড়ালাম। যা রোদ্দুর!
মামা বলল, “বুঝলি ভাগনে, সুখশান্তিতে যেমন, তেমনি দুঃখকষ্টেও কাব্যের জন্ম হয়। একটা কবিতা মাথায় এসেছে-
হরদুয়ারে কী রৌদ্র বাবারে
মালুমই হল না এসেছি পাহাড়ে
আরও উত্তরে
বদ্রী চলো রে
গজু হেথা নাহি থাকিবারে পারে। কেমন হল ভাগনে?”
“দারুণ, মামা।”
এদিকে মামার খোলা গলার আবৃত্তি শুনে এক ড্রাইভার আমাদের সামনে এসে খুব নিরীহভাবে বলল, “সাব, উপর যানা হ্যায়?”
শুনেই গজুমামা তেলেবেগুনে জ্বলে উঠল, “উপর যানা হ্যায় মতলব? এয়ারকি পায়া হ্যায়? ধমকি দেতা হ্যায়? জানতা হ্যায় আমি কে হ্যায়? ফাঁসি মে চড়া দেগা, তুম হি উপর চলা যাওগে।”
“উতনা উপর নেহি সাব। আরে রাম রাম। কসুর মাপ কিজিয়ে। গাড়ি চাহিয়ে সাব? কেদার বদরী যানা হ্যায়? রুদ্দরপ্রয়াগ, নন্দপ্রয়াগ, যোশীমঠ?”
“ও আচ্ছা। তো ইয়ে বাত হ্যায়! কিতনা চাহিয়ে?”
“যো রেট হ্যায় ওহি দিজিয়েগা সাব। জ্যায়াদা নেহি লেঙ্গে। ফিকর মত কিজিয়ে।”
“তো চলো। অভি চলো। ইধর ম্যায় একমুহূর্ত নেহি রুকতা হ্যায়।”
টাটা সুমোয় চড়ে বিকেলে রুদ্রপ্রয়াগ পৌঁছে ছোট একটা হোটেলে উঠলাম। মন্দাকিনী আর অলকানন্দার সঙ্গম দেখলাম। তারপর ঘুরতে ঘুরতে এসে দাঁড়ালাম সেই জায়গাটায় যেখানে জিম করবেট রুদ্রপ্রয়াগের সেই কুখ্যাত চিতাটা মেরেছিলেন। রাস্তার ধারে সে গাছটা এখনও দাঁড়িয়ে আছে যেটায় চড়ে করবেট গুলি চালিয়েছিলেন। সেটা দেখে গজুমামার কবিত্ব ফের মাথাচাড়া দিল।
“কত ইতিহাস আজও এই গাছে
পাতায় পাতায় লেখা হয়ে আছে
এর ওপর চড়ে
সেই চিতাটিরে
জিম করবেট গুলি করিয়াছে। – ভাগনে, কেমন দিলাম?”
“ওফ, দুরন্ত, মামা।”
পরদিন কাকভোরে রওনা দিয়ে ন’টা নাগাদ যোশীমঠ পৌঁছলাম। রাস্তার ধারে একটা খাবারের দোকানের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি, ভাবছি কী দিয়ে ব্রেকফাস্ট করা যায়। সেখানে দেখি জনাপনেরো সাধুসন্ন্যাসীর একটা জটলা। কেউ দাঁড়িয়ে, কেউ দোকানের সামনে পাতা বেঞ্চিতে বসে খাচ্ছে। বোধহয় বদ্রীনাথ থেকে ফিরছে সব। দোকানের একটা উনুনে বিশাল গামলায় টগবগ টগবগ করে দুধ ফুটছে। আর বেঞ্চে বসে এক জটাজূটধারী দশাসই সাধুবাবা, টকটকে লাল ধুতিচাদর পরা, গায়ে কম্বল, হাতে কমণ্ডলু, একটা বিশাল এনামেলের বাটিভর্তি দুধ খাচ্ছেন। ইনি বোধহয় এই দলের ক্যাপ্টেন। সাধুবাবা এক চুমুক দুধ খান আর ‘আহ্’ বলে তৃপ্তির এক আওয়াজ করেন, সেই ‘আহ্’-এর এত জোর যে দোকানি শুনে বারবার চমকে চমকে উঠছে। আমি অবাক হয়ে এসব দেখছি। এমন সময় সাধুবাবা হঠাৎ আমার দিকে চেয়ে বললেন, “কীসের সন্ধানে ফিরিছ বৎস?”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “না না, আমি না, ও ..।” বলে একটু দূরে মামার দিকে দেখিয়ে দিলাম। মামা তখন পাশের মিষ্টির দোকানে প্যাঁড়া কিনবে না জিলিপি তা ঠিক করতে পারছে না। এদিকে সন্ন্যাসীদের দলের একজন ছোট্টখাট্টো বৃদ্ধা সন্ন্যাসিনী আমার দিকে এগিয়ে এসে বললেন, “উটি তোমার কে হন বাছা? আত্মীয়? আহা, একদম সিধু কোবরেজের মত চেহারা। সেই চোখ, সেই নাক, সেই পাকা আমের মত গায়ের রং। তা তোমরা যাবে কোথায় বাছা? বদ্রীনারায়ণ?”
মামা তখন প্যাঁড়ার ঠোঙা নিয়ে এদিকেই আসছে। হঠাৎ সেই ক্যাপ্টেন সাধুবাবা মামার দিকে তাকিয়ে গম্ভীর গমগমে গলায় আবৃত্তি শুরু করলেন,
“বৃথা তারে খোঁজ ফিরে বদ্রীনাথে এ পর্বতে
সে বসি মগন ধ্যানে কঠোর কঠিন ব্রতে।
পূবে চলি তপোবন, তথা হইতে দক্ষিণে
দুর্গম কুমারী গিরিপথে, ঘনঘোর বনে।”
এইসময় রাস্তায় দাঁড়ানো একটা মিনিবাস হঠাৎ প্যাঁক প্যাঁক করে খুব হর্ন দিতে শুরু করল, আর সাধুবাবাদের দলটাও ‘ব্যোম ব্যোম ভোলে ব্যোম, জয় বদ্রীবাবা কি জয়, কেদারবাবা কি জয়’ ধ্বনি দিতে দিতে হুড়মুড় করে সেই বাসে উঠে পড়ল। বাসটা নিচের দিকে চলে যেতেই জায়গাটা চুপচাপ হয়ে গেল। আর একের পর এক প্যাঁড়া খেতে খেতে মামা বলল, “ভাগনে, কী বুঝলি?”
বললাম, “মামা, বদ্রীনাথ গিয়ে লাভ নেই বুঝলাম। কিন্তু, তপোবন মানে তো মুনিঋষিদের আশ্রম। একালেও কি তপোবন-টন আছে নাকি এদিকে?”
“হুমম, পূবে তপোবন, সেখান থেকে দক্ষিণে।”
আমাদের ড্রাইভার রঘুজী চা খেতে খেতে আমাদের কথা শুনছিলেন। হঠাৎ বললেন, “সাব, তপোবন ইধর এক হ্যায় না! ইয়ে রাস্তা বাঁয়ে সিধা বদ্রী চলা গিয়া, ঔর ডাইনে যানে সে তপোবন। বস্, ছোটি সি এক গাঁও হ্যায়। জ্যায়াদা দূর নেহি।”
“ডাইনে? তার মানে তো পূবদিকই হচ্ছে। উধর গাড়ি যাতা হ্যায়?”
“জরুর যাতা হ্যায়, সাব। কলকাত্তা সে হর সাল কুছ পার্টি আতা হ্যায় তপোবন, উধর সে ট্রেকিং চালু করতে হ্যায়, কুয়াঁরি পাস যানে কে লিয়ে।”
“কুয়াঁরি পাস? মানে, কুমারী গিরিপথ? বলে কী রে ভাগনে! আচ্ছা, উও কুয়াঁরি পাস যানে কা রাস্তা মে জঙ্গল হ্যায় কেয়া?”
“সাব, জঙ্গল তো ইধর চারো তরফই হ্যায়। উও রাস্তা পে তো ভয়ানক জঙ্গল হ্যায়। ভালু হ্যায়, শের হ্যায়, ঔর কেয়া কেয়া হ্যায় পতা নেহি সাব।”
“ঠিক হ্যায়, চলো। তপোবন চলো। ভাগনে, প্যাক আপ, কুইক।”
“মামা, ব্রেকফাস্ট? খিদে পায়নি তোমার?”, আলুর পরোটা মিস হয়ে যাচ্ছে দেখে তাড়াতাড়ি বললাম। কাজ হল। তপোবনে কোথায় কী পাওয়া যাবে কে জানে! তাই পেট পুরে আলুর পরোটা খেয়ে গাড়িতে উঠলাম আমরা।
যোশীমঠ থেকেই বেশ ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা লাগছে। পাহাড় সমগ্রটা খুলে দু’জনে উইন্ডচিটার চড়িয়ে মাফলার জড়িয়ে নিয়েছি। পরিষ্কার ঝকঝকে দিন, নীল আকাশ, চারদিকে সবুজ পাহাড়। একঘণ্টায় তপোবন পৌঁছে গেলাম। ছোট্ট জায়গা। ছোট একটা বাড়ির দোতলায় একটা ঘর ভাড়া নিয়ে উঠলাম। গাড়িটা ছেড়ে দেওয়া হল। গজুমামা সুখলাল বলে একটি লোককে পাকড়াও করল যে কুয়াঁরি পাসের রাস্তা চেনে, আমাদের গাইড হয়ে যাবে। এখান থেকে কুয়াঁরি পাসের পায়ে চলা রাস্তা দক্ষিণ দিকেই গেছে বটে। সুখলাল বলল যেতে দু’তিনদিন লাগবে। মামার থেকে পয়সা নিয়ে সে পথের রেশন কিনতে বেরিয়ে গেল।
পরদিন সকালে শুরু হল আমাদের ট্রেকিং। একটা পাকদণ্ডী পথ তরতর করে পাহাড় বেয়ে জঙ্গলের মধ্য দিয়ে খাড়া উঠে গেছে। সে কী চড়াই! আর কী গভীর জঙ্গল রে বাবা। গা ছমছম করে। বললাম, “মামা, সাধুবাবা ঠিকই বলেছিল। এ যে দেখি ঘনঘোর বন।”
মামা বলল, “হুমম্, জঙ্গল অমনিবাসটা হাতের কাছে আছে তো?”
“হ্যাঁ মামা, সে তো আমার পিঠেই আছে। কিন্তু রঘুজী যে বলছিল এই বনে বাঘ আছে?”
মামা দাঁড়িয়ে পড়ল। ক্ষুব্ধস্বরে বলল, “বাঘ বড়ো না আমি বড়ো?”
“তুমি, মামা।”
“তাহলে চল। ঘাবড়াস না।”
আমি কি আর ঘাবড়েছি? শুধু একটু ভয় ভয় করছে। এদিকে সুখলাল তরতর করে চড়াই উঠে যাচ্ছে। আর আমি ঘেমেনেয়ে হাঁপিয়ে একাকার। মামাও হাঁপাচ্ছে, কিন্তু স্বীকার করবে না। একঘণ্টা চড়াই ভাঙার পর হাঁটুতে ভর দিয়ে ঝুঁকে হ্যা হ্যা করে হাঁপাচ্ছি, মামা বলল, “কী রে, হাঁপ ধরছে?”
“না মামা, এখানে অক্সিজেনটা একটু কম মনে হচ্ছে।”
“জল খা। জল খেয়ে দুবার হাই তুলে নে। জলের একটা অণুতে দুটো হাইড্রোজেন আর একটা অক্সিজেন পরমাণু আছে। হাইয়ের সাথে হাইড্রোজেন দুটো বেরিয়ে যাবে, অক্সিজেন পেয়ে যাবি।”
বোঝো! কী সব ফান্ডা! যাই হোক, একটু বিশ্রাম নিয়ে ফের চড়াই ওঠা শুরু হল। যত এগোচ্ছি জঙ্গল আরও ঘন হয়ে চারপাশ থেকে চেপে ধরছে। পায়ে চলা রাস্তাটাও মাঝে মাঝে কোথায় হারিয়ে যাচ্ছে, আবার একটু পরে তার হদিস পাওয়া যাচ্ছে। পাতার চাঁদোয়া ভেদ করে সূর্যের আলো মাটি অবধি পৌঁছতে পারছে না। গাছে গাছে বাঁদরের দল হুটোপাটি করছে, পাখিরা গান গাইছে। দুপুর নাগাদ একটা ছোট্ট ফাঁকা মতো জায়গা দেখে বসলাম আমরা। চারপাশে গভীর জঙ্গল। খিদেয় পেট চোঁ চোঁ করছে। কিন্তু মামাকে তখন কবিতায় পেয়েছে।
“আহা কত গাছ মাথার ওপরে
আকাশ ঢেকেছে সবুজ চাদরে
সব চুপচাপ
শুধু হুপ হাপ
করি গাছে গাছে খেলিছে বাঁদরে।”
সুখলাল পিঠের বোঝা নামিয়ে প্যাক করা রুটি আলুরদম বার করেছে। এমন সময়, মামার কবিতা শুনেই হোক কিম্বা আলুরদমের গন্ধে, একটা বিশাল কালো ভাল্লুক দেখি গাছের আড়াল থেকে হেলতে দুলতে বেরিয়ে এল। আমি চিৎকার করে বললাম, “মামা, ভাল্লুক।”
মামা বলল, “হ্যাঁ দেখেছি। তোর একটা সবুজ রঙের ভাল্লুক ছিল না?”
“হ্যাঁ, সে তো ছোটবেলায়। হাত থেকে পড়ে ভেঙে গেল।”
“এটা পুষবি? এটা অবশ্য কালো, তবে নাদুসনুদুস আছে।”
এসব কথাবার্তায় ভাল্লুক বাবাজী কী বুঝল কে জানে, হঠাৎ থমকে গিয়ে উল্টোদিকে ঘুরে ফের বনের মধ্যে সেঁধিয়ে গেল। মামা বলল, “কী, কেমন দিলাম?”
বলতে যাচ্ছিলাম, “মামা, দারুণ”, কিন্তু তখন আমার চোখ পড়েছে পাশের একটা গাছের একটা নিচুমতন ডালে। সেখানে একটা চকরাবকরা চিতা আমাদের দিকে চেয়ে ঘাপটি মেরে বসে আছে, শুধু লাফ দেওয়ার অপেক্ষা। আবার চিৎকার করলাম, “মামা, চিতাবাঘ।”
“হুঁ, দেখেছি তো। ঘাবড়াস না। জঙ্গল অমনিবাস থেকে বন্দুকের লাইসেন্সটা বার কর।”
তাড়াতাড়ি ব্যাগ ঘেঁটে লাইসেন্সটা বার করলাম, “করেছি, মামা।”
“করেছিস? এবার লাইসেন্সটা চিতাটার দিকে তুলে দেখা।”
ওমা, কী কাণ্ড! লাইসেন্সটা চিতাটার দিকে দেখাতেই সেটা কেমন জবুথবু হয়ে গিয়ে ঝুপ করে গাছের ডাল থেকে খসে পড়ল। তারপর সে নড়েও না চড়েও না। মামা উঠে পড়ে বলল, “এই রে, ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেছে। সুখলাল, জলদি পানি লে আও। আরে, সুখলাল কাঁহা গিয়া?”
কিন্তু, ত্রিসীমানায় সুখলালের আর কোনও খোঁজ পাওয়া গেল না। মামা বলল, “ব্যাটা ভয়ে পালিয়েছে। ডরপোক। যাক্ গে। ভাগনে, একটা জলের বোতল নিয়ে আয়। চিতাটার মাথায় আস্তে আস্তে ঠাণ্ডা জল ঢালতে হবে।”
মাথায় জল দিতেই চিতাটা ধড়ফড় করে উঠে বসে, মামার দিকে তাকিয়ে কেমন ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে, তিড়িং করে এক লাফ মেরে চোঁচা ছুট দিল। তাকে আর দেখাই গেল না। মামা বলল, “চল ভাগনে, এবার রুটি আলুরদমটার সদ্গতি করা যাক। খিদেটা ভালোই চাগাড় দিয়েছে।”
খেয়েদেয়ে ভুঁড়িতে হাত বোলাতে বোলাতে মামা বলল, “চল, এগোনো যাক।”
“কিন্তু সুখলাল তো ভাগলবা। অত মাল বইবে কে? রাস্তাই বা চিনব কী করে?”
“আরে দক্ষিণদিকে তাক করে এগোলেই হবে। এতে এত হাতিঘোড়া আছেটা কী? আর ওসব চাল ডাল হাঁড়ি ডেকচি স্টোভ কেরোসিন এখানেই পড়ে থাক, ফেরার সময় দেখা যাবে। শুধু বিস্কুটের প্যাকেটগুলো নিয়ে নে। বিস্কুট খেয়েই থাকব, তাছাড়া গাছের ফলমূল আছে। পারবি না ভাগনে?”
“হ্যাঁ মামা, পারব।”
“তবে ওঠ, চল। ভয় কী? মামা-ভাগনে যায় যেখানে, আপদ বালাই নাই সেখানে।”
উঠে দাঁড়িয়ে এগোতে এগোতে মামা বিকট হেঁড়ে গলায় গান ধরল,
“হাতি মেরা সাথী
ভালু মেরা নাতি
খাই দাই গান গাই দিবা কিবা রাতি।”
আবার চলা। আবার চড়াই। কোন দিকে যাচ্ছি মামাই জানে। অনেকটা চড়াই উঠে কিছুটা আবার নামলাম। ফের উঠলাম, ফের নামলাম। এমনি কতবার যে উঠলাম আর নামলাম সে হিসেব রাখতে কম্পিউটার লাগবে। জঙ্গল তো জঙ্গলই, আরও যেন ঘন হচ্ছে ধীরে ধীরে। বিকেল হয়ে এসেছে। পাতার ফাঁক দিয়ে আসা রোদটা কেমন হলদেটে হয়ে গেছে। মামা আগে আগে যাচ্ছে, একটু পেছনে আমি। এমন সময় গাছপালার আড়াল থেকে বেরিয়ে এল বিশাল এক বাঘ, একেবারে আমার সামনে। ঘড়ড়াম করে মাটিকাঁপানো এক হুঙ্কার ছাড়ল সে। আমি তো গেছি! চিৎকার করে বললাম, “মামা, বাঘ। খেয়ে ফেলল।”
মামা সামনে থেকে ঘুরে দাঁড়িয়ে দ্বিগুণ চিৎকার করে বলল, “অ্যাই, খবরদার। আমার ভাগনের গায়ে হাত দিবিনা বলে দিচ্ছি। ভাল হবে না। ৫০৬ নম্বর ধারায় মামলা করে দেব।”
বাঘটা মামার কথায় পাত্তা না দিয়ে আরও দু’পা এগিয়ে ফের ঘ্রাউম করে হুঙ্কার ছাড়ল। কী বলব, বাঘটা আমার এত কাছে যে হাঁ করে হুঙ্কার দেবার সময় ওর মুখের ভেতর সবকটা দাঁত, মায় আলজিভটা অবধি দেখতে পেলাম। এবারে আর রক্ষে নেই। ভূতের সামনে পড়লে লোকে রামনাম জপে জানি, বাঘের সামনে কী জপ করে তাই ভাবছি, এমন সময় আমার পেছন দিক থেকে কে যেন খুব রাশভারী গলায় বলে উঠল, “অ্যাই বাঘা, কী হচ্ছে কী? দেখছিস না বাচ্চা ছেলে, ভয় পাচ্ছে?”
ওমা, অবাক হয়ে দেখলাম, বাঘটা সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে বসে পড়ে গলা দিয়ে একটা আদুরে ঘড় ঘড় আওয়াজ করে ল্যাজ নাড়তে লাগল। পেছন থেকে সেই মোটা গলা আবার বলল, “ভয় নেই বৎস, ও কিছু করবে না। পোষা বাঘ। ও আমার পর্ণকুটিরের প্রহরী।”
এতক্ষণ বাঘটার দিক থেকে চোখ ফেরাতে পারছিলাম না, পেছন ফিরে আরও অবাক হয়ে গেলাম। দেখি শ্বেতশুভ্র ধুতিচাদর পরা দিব্যকান্তি দীর্ঘদেহী এক সন্ন্যাসী ধীর পায়ে আমার দিকে এগিয়ে আসছেন। তার মুখে ধবধবে সাদা দাড়ি, মাথায় জটা, হাতে একটা মোটা বাঁশের লাঠি। পেছন থেকে অস্তগামী সূর্যের নরম রোদ তার গায়ে পড়ে স্বর্ণচ্ছটার মত ঠিকরে উঠছে। আমায় দেখে তিনিও মনে হল আশ্চর্য হয়েছেন। কাছে এসে কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে বললেন, “আরে! গজু না?”
আমি ভয়ানক ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “না না, আমি না, ও ..।” বলে মামার দিকে দেখিয়ে দিলাম। মামা ততক্ষণে কাছাকাছি চলে এসেছে। হঠাৎ ‘সোনাভাই, তুমি!’ বলে এগিয়ে এসে সেই সন্ন্যাসীর পায়ে গড় করে প্রণাম করে ফেলল। তারপর উঠে বলল, “ও নয়, আমিই গজু। ও আমার ভাগনে গুলু। ওরে ভাগনে, হাঁ করে দেখছিস কী? প্রণাম কর, প্রণাম কর। ইনি তোর বুড়োদাদু, আমার ঠাকুদ্দা, আমাদের সোনাভাই, স্বনামধন্য সিদ্ধেশ্বর কবিরাজ। সোনাভাই, তোমার ভুল নয়, আমাকে যখন তুমি দেখেছ তখন আমার এই গুলুর মতই বয়স।”
সন্ন্যাসী বললেন, “হুমম্, তোমার বাল্যবয়সের মতই দেখতে। নরাণাং মাতুলক্রমঃ।”
নরাণাং মাতুলক্রমঃ? কিন্তু, আমি তো দেখছি নরাণাং ঠাকুরদাক্রমঃ। পাশাপাশি গজুমামা আর সোনাভাইকে দেখেই বুঝেছি কী আশ্চর্য মিল তাঁদের চেহারায়। সোনাভাই অবশ্য আরও ফর্সা আর লম্বা, মামার মত ভুঁড়িও নেই তাঁর। বয়স অনেক বেশি হলেও মামার থেকে ফিট দেখাচ্ছে তাঁকে। এক হাত আমার কাঁধে, আরেক হাত মামার কাঁধে রেখে তিনি বললেন, “এসো, আমার কুটিরে এসো।”
সন্ধে হয়ে গেছে। ডালপালা আর লতাপাতা দিয়ে বানানো ছোট্ট একটা কুটিরের মাঝখানে কাঠকুটো দিয়ে আগুন জ্বালানো হয়েছে। আগুন ঘিরে বসেছি সোনাভাই, গজুমামা আর আমি। দরজার বাইরে বাঘা শুয়ে আছে। সোনাভাই কিছু মিষ্টি আলু সেদ্ধ করে একটা বাঁশের চুবড়িতে রেখেছেন। বিটনুন মাখিয়ে আমি আর গজুমামা একটা একটা করে সেই আলু খাচ্ছি। ওফ্, অমৃত!
“এই হিংস্র শ্বাপদসঙ্কুল অরণ্যে আমার খোঁজে যে তোমরা এতদূর এসেছ এতে আমি খুবই প্রসন্ন হয়েছি,” বললেন সোনাভাই।
“হিংস্র না কচু! সব ভিতুর ডিম,” বলে সেই চিতা আর ভাল্লুকের কাণ্ডটা সোনাভাইকে বললাম।
সোনাভাই হা হা করে হেসে উঠলেন, “ওর কারণ অন্য। আমি যখন এই বনে ভ্রমণ করি বাঘা সর্বদা আমার সঙ্গে থাকে। তাই হিংস্র পশুরা আমার কাছে ঘেঁষে না। আমার সঙ্গে শ্রীমান গজুর সাদৃশ্য থাকায় ওই ভল্লুক ও চিতাটি বিভ্রান্ত হয়েছিল। তাই পলায়ন করেছে।”
“আচ্ছা সোনাভাই, দেশ স্বাধীন হবার পর তুমি সন্ন্যাসী হয়ে গেলে কেন?” আমার মাথায় প্রশ্নটা অনেকদিন থেকেই জমা ছিল, সুযোগ পেয়ে করে ফেললাম।
আমার মাথায় হাত বুলিয়ে দিয়ে সোনাভাই হেসে বললেন, “বৎস গুলু, তোমার কৌতূহল আছে। ভাল, খুব ভাল। ইংরেজরা আমার কবিরাজি চিকিৎসার খুবই ভক্ত হয়ে পড়েছিল। ভারত ছেড়ে চলে যাবার সময় তারা আমায় ইংলন্ডে নিয়ে যেতে চাইল। দেখলাম, দেশে থাকতে হলে আত্মগোপন করতে হয়, তাই সন্ন্যাস নিলাম। আমার এই দেশ ছেড়ে আমি কোথায় যাব? কেন যাব?”
“তুমি কি বদ্রীনাথে ছিলে? সেখানে তীর্থযাত্রীদের চিকিৎসা করতে?” গজুমামা বলল।
“হ্যাঁ, বদ্রীনাথে মাঝে মাঝে যাই আমি। সেখানে মানুষের সেবা করার সুযোগ পাওয়া যায়। আমার অধীত কবিরাজি বিদ্যাটিরও অনুশীলন হয়। অন্য সময়ে এটিই আমার সাধনার স্থান।”
“তোমার বয়স কত সোনাভাই তাহলে? দেড়’শ?” আমি জিগ্যেস করলাম।
“হা হা, না বৎস। অত নয়। স্বাধীনতার সময় আমার বয়স ছিল ষাট। এখন তোমাদের হিসাবে প্রায় এক’শ পঁচিশ হবে। তবে আমি ধ্যানযোগে বয়স নিয়ন্ত্রণ করতে পারি। গত পঁয়ষট্টি বৎসরে আমার বয়স বড়োজোর কুড়ি বৎসর বৃদ্ধি পেয়েছে। সে হিসেবে আমি এখন আশি।”
“ধ্যান করলে কি বয়স বাড়ে না?” আমি বললাম।
“তোমার যখন এতই কৌতূহল তখন বলি,” স্মিত হেসে বললেন সোনাভাই, “আচ্ছা, বলো তো, আলোর চেয়ে দ্রুতগতিসম্পন্ন এমন কী আছে বিশ্বে?”
“ইজি, চিন্তা। মনে মনে চিন্তা করে আমি একমুহূর্তে দিল্লী বা কলকাতা চলে যেতে পারি।”
“বাঃ, ঠিক। আর, জানো কি যে আলোর বেগে যদি কেউ ছুটে চলে তবে তার বয়স বাড়ে না?”
“হ্যাঁ, জানি তো। আলোর অর্ধেক বেগে ছুটলেও দশ বছরে আট বছর আট মাস মত বাড়বে।”
“বাঃ, জানো দেখছি। তাহলে বলি শোন, আমি ধ্যানযোগে সময়ভ্রমণ আয়ত্ত করেছি।”
“মানে?” আমি আর গজুমামা একসঙ্গে বলে উঠলাম।
“হ্যাঁ বৎস, ধ্যানযোগে আমি অতীতে ফিরে যেতে পারি, কোনও বিশেষ জায়গায়, দর্শক হিসেবে। আজ সকালেই সময়ভ্রমণে গেছিলাম সিন্ধু সভ্যতায়, সিন্ধু নদের তীরে তীরে ঘুরে বেড়াচ্ছিলাম। কাল রাত্রে গেছিলাম মিশরীয় সভ্যতা দেখতে। এরকম কখনও মায়া, কখনও ইনকা সভ্যতা, কখনও ব্যাবিলন, কখনও গ্রিস- আমি শুধু ঘুরে বেড়াচ্ছি। মানবসভ্যতার ইতিহাস এখন আমার মাথার ভেতর। ধ্যানযোগে এত ঘুরে বেড়াই বলেই আমার বয়স কম বাড়ে।”
আমি আর জগুমামা তো অবাক, একদম চুপ। একটু থেমে থেকে সোনাভাই হঠাৎ বললেন, “শ্রীমান জগু, তোমার হস্তলিপি কীরকম?”
“হাতের লেখা? অতি বাজে, অখাদ্য। একেবারে কাগের ঠ্যাং বগের ঠ্যাং।”
“সে বললে তো চলবে না বাবা। হস্তলিপি অনুশীলন কর। আমি যা দেখেছি, মানবসভ্যতার সেই সম্পূর্ণ ইতিহাস আমায় ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য লিখে যেতে হবে। আমি বলব, তুমি লিখবে। ব্যাসদেব যেমন গণেশকে দিয়ে মহাভারত লিখিয়েছিলেন।”
“মহাভারত! ওরে বাবা, সে তো বিশাল ব্যাপার। ওতে নাকি একলক্ষ শ্লোক আছে।”
“ব্যাসদেব ভারতের ইতিহাসের মাত্র তিন-চার’শ বছরের একটি খণ্ডচিত্র দেখেছিলেন। আমি পুরো মানবসভ্যতার ইতিহাস লিখতে চাই। ওতে বিশ লক্ষ শ্লোক থাকবে।”
“বিশ লক্ষ? কিন্তু আমায় কি এখানে বসে লিখতে হবে? না তুমি বাড়ি ফিরে যাবে?”
আমি বললাম, “হ্যাঁ সোনাভাই, ফিরে চলো, আমাদের সঙ্গে। বুড়োদিদা সারাক্ষণ তোমার কথা বলে। তোমার জন্য ইলিশমাছের মাথা আর ছোলা দিয়ে কচুর শাক রান্না করে রেখেছে।”
সোনাভাই হঠাৎ একটু থমকে গেলেন, বললেন, “বুড়োদিদা? তোমার বুড়োদিদা এখনও বেঁচে আছেন? কী আশ্চর্য, সময়ভ্রমণে একবারও আমার নিজের বাড়ি ঘুরে আসার কথা মনে হয় নি।”
“হ্যাঁ, বেঁচে আছে বইকি। দিব্যি আছে। বুড়োদিদাও তো সবসময় তোমার ধ্যান করছে, তার বয়সই বা বাড়বে কী করে? শুধু কানে শোনে না, চোখে একটু ঝাপসা দেখে আর শীতকালে বাতের ব্যথায় খুব কষ্ট পায়।”
“আহা, বাতজ বেদনার জন্য ভল্লুকের চর্বির তেল খুব ভালো ওষুধ। আমি নিয়ে যাব ’খন।”
“তার মানে তুমি আমাদের সঙ্গে যাচ্ছ? দারুণ। হিপ হিপ হুররে।”
সোনাভাই একটু গম্ভীর হয়ে বললেন, “না বৎস, আমার সাধনা এখনও সম্পূর্ণ হয় নি। সময় ভ্রমণে আমি মাত্র কুড়ি হাজার বছর অবধি পেছোতে পেরেছি। আরও পেছোতে হবে। আমায় দেখতে হবে আফ্রিকায় কীভাবে প্রথম মানবসভ্যতার বিকাশ হল, কীভাবে তা ছড়িয়ে পড়ল ইউরোপে। আরও পিছিয়ে জানতে হবে মানুষ কীভাবে শিকার করতে শিখল, আগুন জ্বালাতে শিখল, চাষবাস শিখল, চাকা আবিষ্কার করল। আরও বছর দশেক লাগবে, তারপর ফিরব। আমি বলে যাব, গজু লিখবে।”
“কিন্তু সোনাভাই, অত লেখার কী দরকার? টেপ করে রাখলেই তো হবে।”
সোনাভাই আমার চুলে বিলি কেটে দিয়ে বললেন, “না গুলুসোনা, লিখতে হবে। তাছাড়া তোমার বুড়োদিদা তো বললে কানে শোনেন না, টেপ করে রাখলে তাঁকে শোনাবে কী করে?”
আগুনটা প্রায় নিভে এসেছিল। বাইরে এইসময় একটা জোরালো হাওয়া উঠল, গাছপালায় সরসর করে একটা আওয়াজ, পাখিরা হঠাৎ জেগে উঠে একবার কিচিরমিচির করে উঠল। সোনাভাই বললেন, “ওই দ্যাখো, কথায় কথায় রাত প্রায় শেষ। একটু শুয়ে বিশ্রাম করে নাও। ভোর হলে ডেকে দেব। তোমরা কুমারী গিরিপথের রাস্তা ফেলে বেশ খানিকটা সরে এসেছ। বাঘা তোমাদের রাস্তা অবধি এগিয়ে দেবে। ফিরে যাও। তারপর আমিও আবার আমার ধ্যানে বসব।”
যোশীমঠ থেকে গাড়িতে নিচে নামতে নামতে গজুমামা গম্ভীরভাবে বলল, “ভাগনে,ভালো করে হাতের লেখা প্র্যাকটিস কর।”
“আমি? কেন? লিখবে তো তুমি!”
“আরে সোনাভাইয়ের দশ বছর মানে আমাদের তিরিশ বছরের বেশি। তদ্দিনে আমি বুড়ো হয়ে যাব, অত দিস্তা দিস্তা লেখা আমার দ্বারা হবে না। তাছাড়া সোনাভাইয়ের তোকে খুব পছন্দ হয়ে গেছে। দেখবি শেষ অবধি তোকেই বলবে লিখতে।”
বলে কি! বিশ লক্ষ শ্লোক আমায় বসে বসে লিখতে হবে? শুনে তো আমার সঙ্গে সঙ্গে আঙুল ব্যথা শুরু হয়ে গেল। নাঃ, আঙুলগুলোকে এখন থেকে রেস্ট দিতে হবে। এই লেখা থামালাম।
ছবিঃ শিবশঙ্কর ভট্টাচার্য