রাজপুত্রের বন্ধু-রতনতনু ঘাটী
দুর্বারগড়ের রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্ন এবার পাঁচ বছরে পা দেবে। হইচই পড়ে যাবে সারা রাজ্যে। রাজপুত্রকে দেখতে যেমন রূপবান, তেমনি তার গায়ের রং! একমাথা কোঁকড়া কালো চুল। চোখ-মুখ থেকে বুদ্ধি ঠিকরে পড়ছে। সৌভাগ্যপ্রসন্নর মত অমন ফুটফুটে রাজপুত্র কে কবে দেখেছে?
রাজপ্রাসাদ থেকে এ খবর কেমন করে যেন পৌঁছে গেল মেঘলোকে। নীল আকাশ রাজপ্রাসাদের কার্নিশে নেমে এল শাঁইশাঁই করে। একটা আকাশ-জোড়া সাতরঙের রামধনু উঠল। নীল আকাশ তাকালোই না তার দিকে। হাঁসফাঁস করতে-করতে এসে কপালের ঘাম মুছে বলল, “আমি এই সুখবরটা রাজ্যবাসীর কাছে বয়ে নিয়ে যাব। আমাকে অনুমতি দিন রাজামশাই!”
বাতাস শোঁ শোঁ করে ছুটে এল দিগন্ত থেকে। এক পলকে পেরিয়ে এল মস্ত রাজসরোবর। তারপর ঝাঁপিয়ে পড়ল রাজপ্রাসাদে। রাজামশাইয়ের কাছে এসে বলল, “মহারাজ, আমি এই আনন্দের খবর ছড়িয়ে দিতে চাই গোটা রাজ্যে। আমাকে আদেশ করুন।”
রাজপ্রাসাদের পাশ দিয়ে বয়ে যাচ্ছে কাঁকনকুশি নদী। সে তার ছোট-ছোট ছলাৎ-ছল ঢেউ তুলে রাজসিংহাসনের পায়ের কাছে এসে বলল, “আমি এ খবর সব মানুষের কাছে পৌঁছে দেওয়ার একমাত্র দাবিদার। মহারাজ, আমাকে রাজিনামা দিন!” এদের কথা শুনে মহারাজ সংগ্রামপ্রসন্ন গালে হাত দিয়ে চুপ করে বসে রইলেন সিংহাসনে।
রাজউদ্যান থেকে কিচির মিচির করতে-করতে উড়ে এল একঝাঁক কথা-বলা পাখি। তারা এসে বলল, “ আমরা কি এমন সুসংবাদ পৌঁছে দিতে পারি না মানুষের কাছে? আমরা গান গেয়ে-গেয়ে রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্নর পাঁচ বছর পূর্ণ হওয়ার কথা জানিয়ে আসি পুরবাসীকে। রাজামশাই, আপনি সায় দিলেই আমরা উড়াল দিই এক্ষুনি।” তখন পাখিদের কলকাকলিতে মুখর হয়ে উঠল রাজপ্রাসাদ।
রাজামশাই সংগ্রামপ্রসন্ন সকলকে বললেন, “এমন আনন্দের খবর সকলেই পৌঁছে দাও চারদিকে। তোমাদের সকলকেই অনুমতি দিলাম!”
খবর ছড়িয়ে পড়ল রাজপ্রাসাদ ছাড়িয়ে গোটা রাজ্যে।শুরু হয়ে গেল রাজ্যজুড়ে হইহই।এত হট্টগোলের কারণ কী ? রাজবংশের নিয়ম হল,রাজপুত্রের বয়স পাঁচ পূর্ণ হওয়ার দিনই বিদ্যারম্ভের দিন।একদিন এই রাজপুত্রই তো এ রাজ্যের রাজা হবে। তার বিদ্যারম্ভের দিন আনন্দ না করলে কি মানায় ?
আজ রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্নর বিদ্যারম্ভ হবে। রাজ্য-বিরাজ্য থেকে এসেছেন একশো একজন নামী পুরোহিত।দূত পাঠিয়ে তাদের নিমন্ত্রণ করে এসেছেন রাজামশাই নিজে।এ ছাড়া রাজসভার প্রধান পুরোহিত তো আছেনই।
সকাল থেকেই গোটা রাজ্যের আকাশে-বাতাসে উড়ে বেড়াচ্ছে কত না শ্লোক,কত না ব্যাকরণ,কত না কবিতা।বেদগান শুরু হয়েছে সিংহদরজার সামনে ম্যারাপ বেঁধে। কী তার সুরের মাধুর্য ! কী তার সুরের মূর্চ্ছনা !
স্বর্গের নদীর নাম মন্দাকিনী। রাজামশাই সংগ্রামপ্রসন্ন পাঁচজন লোক পাঠিয়ে ছিলেন এক বছর আগে।তার মধ্যে তিনজন ফিরে এসেছে গত কাল।আর দুজন প্রাণে বেঁচে ফিরতে পারেনি।অত দূরের পথ বলে কথা! পায়ে হেঁটে মন্দাকিনী কী চাট্টিখানি দূর ? তিনজন লোক দেবব্রাহ্মণের কাছেও গিয়েছিল। তাঁর কাছ থেকে নতুন কাপড় চেয়ে নিয়েছে। তারপর সেই কাপড়ে থলে বানিয়ে মন্দাকিনীর পাড় থেকে তুলে এনেছে নানা রঙের মিহি বালুকণা। সেসব রঙ রামধনুর গায়েও চোখে পড়ে না। বালুকণা কেন? রাজপুত্রের হাতেখড়ি হবে যে! বালুকণার উপরই তো হাতেখড়ি হওয়ার নিয়ম। সময় হতেই রুপোর রেকাবিতে করে সোনায়-মোড়া চকখড়ি নিয়ে এলেন প্রধান রাজপুরোহিত। তিনি মন্থর গতিতে রুপোর চারকোণা বড়ো পাত্রে ঢাললেন মন্দাকিনীর বহুবর্ণ বালুকণা। রানিমার পাশে এসে বসল বিদ্যার্থীব্রতের বেশে রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্ন। চামর দোলাতে লাগল অসংখ্য দাসদাসী। দু’ হাতে ফুলবৃষ্টি করতে লাগল রাজ্যবাসী। রাজপুত্রের হাত ধরে প্রধান পণ্ডিতমশাই লেখালেন ‘অ’। মহানন্দে শাঁখ বাজাল পুরনারীরা। রাজামশাইয়ের মুখে উপচে পড়ল আনন্দ।
এমন ধুমধাম দুর্বারগড়ের মানুষ এর আগে কখনও দেখেনি। সকলে মহাভোজ খেয়ে ফিরে গেল যে-যার বাড়িতে। একশো একজন মহাপুরোহিত বিদায় নিলেন রাজামশাইয়ের কাছ থেকে। তাঁদের প্রত্যেককে পাত্র উপচে-পড়া মোহর দান করলেন রাজামশাই। পরদিন থেকে শুরু হয়ে গেল রাজপুত্রের বিদ্যালাভ।
।২।
দেখতে-দেখতে রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্ন কত কী যে শিখে ফেলল! পুরাণ, উপনিষদ, রামায়ণ, মহাভারত। রাজপুত্রের পড়া হয়ে গেল বিষ্ণুপুরাণের ধ্রুবর কথা। নিজের আঙুল কেটে একলব্যর দ্রোণাচার্যকে গুরুদক্ষিণা দেওয়ার কাহিনিও পড়ে শেষ করল রাজপুত্র। পড়া হয়ে গেল মহাভারতের অভিমন্যুর কথাও। রামচন্দ্রের যমজ পুত্র কুশ আর লব-এর বড় হয়ে ওঠার গল্পও মুখে-মুখে পড়ল রাজপুত্র।
চারদিকে ছড়িয়ে পড়ল রাজপুত্রের বুদ্ধির খবর। এক–এক বিষয়ের জন্য রাজপুত্রকে পড়াতে এলেন এক-একজন বিখ্যাত পণ্ডিত। যখন সাত-আট বছর বয়েস হল রাজপুত্রের, তখন বিদ্যালাভের সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হল তরবারি চালনা শিক্ষা, অস্ত্রনিক্ষেপ আর ধনুর্বিদ্যা।
যখন রাজপুত্র আর-একটু বড় হল, দশ বছরে পা দিল, তখন রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্ন একা-একাই ঘোড়া ছুটিয়ে উধাও হয়ে যেতে পারল তেপান্তরে। হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল তোলপাড় করে ফিরে এল রাজপ্রাসাদে। ঢেউয়ের ঝুঁটি জাপটে ধরে সাঁতরে পার হয়ে যেতে লাগল উত্তাল নদী।
একদিন হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গল তছনছ করে ফিরে আসছিল রাজপুত্র। এমন সময় রাজপুত্র হাতির পিঠে থেকে নেমে এল খালি গা একটা শ্যামলা ছেলেকে দেখে। তার সামনে গিয়ে রাজপুত্র নিজের পরিচয় দিল। নিজের নামও বলল তাকে। এও বলল, দুর্বারগড়ের রাজার একমাত্র ছেলে সে। তারপর জিজ্ঞাসা করল, “তোমার নাম কী?” ছেলেটি বলল, “আমার নাম বৃক্ষক কাঠুরে।” রাজপুত্র এত বই পড়েছে, কিন্তু ‘বৃক্ষক’ নামটা কখনও শোনেনি। অবাক গলায় বলল, “বৃক্ষক মানে কী?”
বৃক্ষক ঠোঁট উলটে বলল, “মানে? নাঃ। মানেটা কোন কাজেই লাগবে না তো, তাই জানি না।”
রাজপুত্র হেসে উঠল। বলল, “কাঠুরে আবার কারও পদবি হয় নাকি?”
বৃক্ষক বলল, “হয় না কেন? খুব হয়। আমরা কাঠুরে তো,তাই!আমার বাবার নাম মহাবৃক্ষক কাঠুরে।”
দু’-একটা কথার পর রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্নর ভাব হয়ে গেল বৃক্ষকের সঙ্গে। বৃক্ষক এক গরিব কাঠুরের ছেলে। বাবা সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে-ঘুরে শুকনো কাঠ কাটে। দিনশেষে সেগুলো বিক্রি করতে নিয়ে যায় অনেক দূরের বাজারে। আর বৃক্ষক সারাদিন জঙ্গলে ঘুরে বেড়ায়। কখনও মন হলে গাছের তলায় পড়ে থাকা বীজ কুড়িয়ে মাটিতে পুঁতে দেয়। ঝড়ে পাখির বাসা ভেঙে গেলে সে মগডালে উঠে ফের বাসা বানিয়ে দিয়ে নেমে আসে। আবার কখনও মন হলে,বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখির বাচ্চাকে তুলে রেখে আসে তার বাসায়। মায়ের পালকের নীচে। পাকা ফল গাছ থেকে মাটিতে পড়ে গেলে,সেগুলোও কুড়িয়ে পাখির বাসায় রেখে আসে। পাখির খিদে পেলে খাবে,তাই!মা-পাখিরাও সকলেই বৃক্ষককে চেনে।
বৃক্ষকের মুখে থেকে তার সারাদিনের গল্প শুনে মোহিত হয়ে গেল রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্ন। মনে-মনে বলল, “বাঃ,কী সুন্দর।”
বৃক্ষক বলল, “তুমি অমন করে আমার মুখের দিকে তাকিয়ে আছ কেন?”
রাজপুত্র বলল, “তুমি কী সুন্দর!তোমাকে সময়ের মাপ করতে হয় না। অত সময় মেপে আমার চলতে ভাল লাগে না। এই বিদ্যাভ্যাস,এই অসিচালনা,এই তীরনিক্ষেপ তো এই ফের ঘোড়ায় চড়া,ফের রাজ্যপরিচালনার কৌশল শেখা।”
বৃক্ষক অবাক গলায় বলল, “ও মা!তুমি যে রাজপুত্র! ও’সবই তো তোমায় শিখতে হবে। ও কি না শিখলে চলে নাকি? তোমাকে বড় হয়ে রাজা হতে হবে না?”
“বৃক্ষক, ওসব কথা ছাড়ো। তুমি আমার বন্ধু হবে কি? আমি তোমার কাছে রোজ এসে পাখির বাসা বানানো শিখব। নতুন-নতুন গাছ লাগাব জঙ্গলে। বাসা থেকে পড়ে যাওয়া পাখির বাচ্চাকে তুলে রেখে আসব বাসায়!মা-পাখির কাছে। আচ্ছা বৃক্ষক,আমি যে গাছে চড়তে পারি না? তুমি আমাকে গাছে চড়া শিখিয়ে দেবে তো?”
“গাছে চড়া এমন কিছু কঠিন না। তুমি হাতির পিঠে চড়ে জঙ্গলে আসতে পারো,ঘোড়ায় চড়ে যুদ্ধ করা শেখো,আর এই সামান্য গাছে চড়তে পারবে না? ও আমি তোমাকে ঠিক শিখিয়ে দেব।”
“আমাকে গাছে চড়া শিখিয়ে দিও তা হলে।আমিও তোমার সঙ্গে উঠে যাব গাছের মগডালে পাখির বাসায় পাখির ডিম দেখতে।”
বৃক্ষক বলল, “তা যেও না হয়!তবে সৌভাগ্য,তোমাকে শিখিয়ে রাখি,পাখির ডিমে কিন্তু হাত দিতে নেই। তা হলে ডিম ফুটে বাচ্ছা হয় না। আমার ঠাকুরমা বলেছিল কথাটা। তবে আরও একটা কথা বলি,রাজামশাই তোমাকে আসতে দেবেন কেন?”
“আমি রাজপ্রাসাদে ফিরে গিয়ে তোমার কথা সব বলব। বাবা নিশ্চয়ই আমাকে তোমার কাছে আসতে দিতে রাজি হবেন।”
বৃক্ষকের মুখে একটা তাচ্ছিল্যের হাসি ফুটে উঠল। বলল, “দূর,তুমি যে কী বলো! আমার কথা আবার বলার মতো কথা হল নাকি যে,তুমি রাজপ্রাসাদে গিয়ে আমার কথা বলবে? শুনলে রাজপ্রাসাদের সকলে হেসে উঠবে যে!”
“উঠুক! আমি ফের তোমার কাছে কাল আসব। তুমি এখানেই থেকো কিন্তু!”
“তা কী হয়? কখন কোন দিকে চলে যাব,তার ঠিক আছে নাকি? তোমার মত অত সময় মেপে আমাকে চলতে হয় না সৌভাগ্য। তার চেয়ে এক কাজ করো। আমি তোমাকে এই বাঁশিটা দিচ্ছি। জঙ্গলে এসে তুমি এটা বাজিও। আমি ঠিক শুনতে পাব।”
বলে বৃক্ষক একটা বুনো ফলের আঁটি দিল রাজপুত্রকে। তার ভিতরের শাঁস বের করে আম আঁটির ভেঁপুর মতো বাঁশি বানিয়েছে বৃক্ষক।
তারপর কী মনে হতে রাজপুত্রের হাত থেকে বাঁশিটা নিয়ে বৃক্ষক বলল, “দাঁড়াও,তুমি তো আবার এসব বাজাতে জানো না। রাজপুত্ররা যেমন অনেক কিছু পারে,আবার তেমনি অনেক কিছু পারেও না।এসো সৌভাগ্য,তোমাকে বাঁশি বাজানো শিখিয়ে দিই।”
বলে দু’আঙুলের ফাঁকে কেমন করে ধরতে হবে বাঁশিটা তা দেখিয়ে দিল। তারপর গলার শিরা ফুলিয়ে জোরে ফুঁ দিল বৃক্ষক। একটা মিহি সুরেলা শব্দ ছড়িয়ে পড়ল সারা জঙ্গলে।
গাছ-পাতা খেতে-খেতে রাজপুত্রের হাতিটা কত দূরে চলে গেছে। দু’জনে খুঁজে আনল হাতিটাকে। তারপর রাজপুত্র চড়ে বসল হাতির পিঠে। গাছের ঘন ডালপালা নাড়িয়ে এক সময় জঙ্গলের সবুজে আড়াল হয়ে গেল রাজপুত্র আর তার হাতি।
।৩।
প্রতিদিন সূর্য ওঠার সময় যুদ্ধবিদ্যা শিখতে যেতে হয় রাজপুত্র সৌভাগ্যকে। তখন সবে দিনের শুরু। অস্ত্রগুরু বলেছেন, “সকালবেলা যখন মনে একাগ্রতা থাকে বেশি। মন যখন চঞ্চল হয় না। তখনই অস্ত্রবিদ্যা শেখার সঠিক সময়।”
পরদিন সকালবেলা যুদ্ধবিদ্যা শিখে ফিরে এল রাজপুত্র। এবার বিদ্যাভ্যাসের সময়। রাজপুত্র গিয়ে বসল তার আসনে। আজ পুরাণের পাঠ। পুরাণজ্ঞ পণ্ডিত এসে বসলেন কুশের আসনে। অমন সময় পণ্ডিতমশাই দেখলেন,রাজপুত্রের পাশে আসনের উপর একটা আশ্চর্য ফলের আঁটি পড়ে আছে। রাজপুত্র ফলের আঁটির বাঁশিটি কিংখাবের ভিতরে রেখেছিল। তারপর মনে নেই। কখন পড়ে গেছে খেয়ালই হয়নি।
পুরাণজ্ঞ পণ্ডিত আঙুল তুলে দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, “সৌভাগ্যপ্রসন্ন,ও জিনিসটা কী?”
রাজপুত্র লজ্জায় নতমুখ। নিচু স্বরে বলল,“এটা বাঁশি। বৃক্ষক কাঠুরে এটা আমাকে দিয়েছে। ”
পণ্ডিতমশাই জিজ্ঞেস করলেন, “বৃক্ষক কাঠুরে কোথায় থাকে?”
রাজপুত্র বলল, “সে জঙ্গলে থাকে। বৃক্ষক বলেছে,আমি জঙ্গলে গিয়ে এই বাঁশিটা বাজালেই সে আমার কাছে তক্ষুনি চলে আসবে।”
গম্ভীর হয়ে গেলেন পণ্ডিতমশাই। সেদিনের মতো পড়া বন্ধ হয়ে গেল। পুরাণজ্ঞ পণ্ডিত দৌবারিকের হাতে খবর পাঠালেন,তিনি এখনই রাজামশাইয়ের সঙ্গে দেখা করতে চান।
রাজামশাইয়ের অনুমতি মিলল। পুরাণজ্ঞ পণ্ডিত গিয়ে হাজির হলেন রাজদরবারে। বৃক্ষক এবং তার বাঁশির কথা বললেন রাজামশাইকে।
সব শুনে রাজা সংগ্রামপ্রসন্নর মুখ গম্ভীর হয়ে গেল। ক্ষণেকের জন্যে তিনি সিংহাসনে হেলান দিয়ে বসলেন। তারপর আবার সোজা হয়ে বসে রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্নকে ডেকে পাঠালেন দরবারে।
রাজামশাইয়ের ডাক আসার আগে রাজপুত্রের মুখ থেকে রানিমা সব শুনেছেন। তিনি ভয়ে কাঁপতে লাগলেন। রাজামশাই যা রাগী মানুষ! কী না কী করে বসেন। রানিমাও রাজপুত্রের সঙ্গে গেলেন রাজদরবারে। রাজপুত্র মুখ নিচু করে দাঁড়াল রাজামশাইয়ের সামনে।
রাজামশাই জিজ্ঞেস করলেন, “বৃক্ষক কে সৌভাগ্য?”
রাজপুত্র ধীর গলায় বলল, “বৃক্ষক কাঠুরে। আমার বন্ধু। ”
“তার সঙ্গে তোমার দেখা হল কোথায়?”
“জঙ্গলে। আমি হাতির পিঠে চড়ে যখন ফিরে আসছিলাম রাজপ্রাসাদে। তখনই তো তার সঙ্গে দেখা হল। ”
“সে তোমাকে কী বলল?তোমার বন্ধু হতে চাইল?”
তখন রাজপুত্র বৃক্ষকের সব কথা বলল রাজামশাইকে। তার পাখিকে ভালোবাসার কথা,গাছ লাগানোর কথা,পাখির ডিমের কথা,সব। রাজামশাই মন দিয়ে সব শুনলেন।
পুরাণজ্ঞ পণ্ডিত মাথা নাড়তে লাগলেন। তিনি কি রাজপুত্রকে এতদিনে এই শিক্ষা দিয়েছেন?এ কাজ রাজপুত্রের ঠিক হয়নি। রাজামশাই গম্ভীর গলায় বললেন, “সৌভাগ্যপ্রসন্ন,কাল তুমি বৃক্ষককে আমার রাজদরবারে নিয়ে এসো। আমি তার সঙ্গে দেখা করতে চাই।”
সকলে অবাক হয়ে গেল রাজামশাইয়ের আচরণ দেখে। রানিমা হাঁফ ছাড়লেন। কিন্তু এ কী হল? রাজামশাই একটুও রাগলেন না তো!রাজপুত্রকে বকলেনও না?কাঠুরের ছেলেকে জঙ্গল থেকে ধরে এনে কারাগারেও ভরার আদেশ দিলেন না। কাঠুরের ছেলেকে তিনি কিনা রাজপ্রসাদে ডেকে পাঠালেন? পণ্ডিতমশাই মাথা নাড়তে-নাড়তে রাজদরবার থেকে বেরিয়ে গেলেন।
পরদিন ঘোড়া ছুটিয়ে রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্ন চলল বৃক্ষককে রাজপ্রাসাদে নিয়ে আসতে। সঙ্গে আর-একটি ঘোড়ায় রাজসেনাপতি। রাজপুত্র জঙ্গলে গিয়ে কোথাও দেখতে পেল না বৃক্ষককে। তখন সেই বৃক্ষকের দেওয়া বাঁশিতে ফুঁ দিল রাজপুত্র। বাঁশি বেজে উঠল সুরেলা শব্দে। আর অমনি একটা পাখির ছানাকে কোলে করে নিয়ে ছুটতে-ছুটতে এসে হাজির হল বৃক্ষক।
বৃক্ষক রাজপুত্রকে জিজ্ঞেস করল, “সৌভাগ্য,আজ যে তুমি ঘোড়ায় চড়ে এলে? তোমার হাতি কোথা? তোমার সঙ্গে সেনাপতিও এসেছে দেখছি!”
রাজপুত্র হেসে বলল, “রাজামশাইয়ের আদেশ নিয়ে সেনাপতি এসেছেন। তোমাকে এক্ষুনি রাজপ্রাসাদে যেতে হবে। আমি তোমাকে ঘোড়ার পিঠে চড়িয়ে নিয়ে যেতে এসেছি।”
“দাঁড়াও,দাঁড়াও!অত ব্যস্ত হোয়ো না তো!রাজামশাই ডেকেছেন তো কী হয়েছে? দেখছ না,এই ছোট্ট পাখির ছানাটার পা মচকেছে?একটা চিল ঠুকরে দিয়েছিল সকালবেলা। আগে ওর পা’টা জল মালিশ করে ওর মায়ের কাছে বাসায় রেখে আসি। তারপর যাব না হয়!রাজামশাইকে খবর পাঠিয়ে দাও,তার আগে আমার সময় হবে না।”
ঘোড়ার পিঠে চড়ে দাঁড়িয়ে থাকল রাজপুত্র আর সেনাপতি। বৃক্ষক পাখির ছানাটাকে বাসায় মা-পাখির কাছে রেখে ফিরে এল খানিক পরে। বৃক্ষকের কাণ্ড দেখে সেনাপতি গলাটা গম্ভীর করে বললেন, “তোমার এ আচরণ ঠিক হল না হে বৃক্ষক!”
বৃক্ষক কিছুই বলল না। মিটিমিটি হাসল শুধু। তারপর রাজপুত্রের ঘোড়ায় চড়ে বসল। পিছনে ঘোড়া ছুটিয়ে চললেন রাজসেনাপতি। ঘোড়ার ক্ষুরের ধুলোয় দিগন্ত আবছা হয়ে উঠল।
।৪।
বৃক্ষক এর আগে কখনও কোনও রাজপ্রাসাদে যায়নি। সিংহদরজা পেরিয়ে যখন ঘোড়া এসে ঢুকল রাজপ্রাসাদে,তখন রাজপ্রাসাদের সমস্ত পণ্ডিতমশাই, রাজপুরোহিত,মন্ত্রী-দ্বাররক্ষী-সৈন্য-প্রহরী-দাসদাসী বৃক্ষককে দেখতে ভিড় করল। সকলে ভাবল,এক্ষুনি মশানে মাথা কাটার আদেশ অপেক্ষা করছে বৃক্ষকের জন্য।
ঘোড়ার পিঠ থেকে রাজপুত্র সৌভাগ্যপ্রসন্নর সঙ্গে লাফ কেটে নামল বৃক্ষক। একটা হাফ-প্যান্ট আর একটা ছেঁড়া জামা পরে আছে সে। কত পরি-আঁকা তোরণ পেরোল সে,কত পদ্মফুল আর সাপ-আঁকা বড়-বড় দরজা পেরোল,কত শ্বেত পাথরের সিঁড়ি পেরোল। তারপর রাজপুত্রের পিছনে-পিছনে বৃক্ষক এসে পৌঁছল রাজদরবারে। সামনে তাকিয়ে বৃক্ষক দেখল,সোনার রাজসিংহাসনে যিনি বসে আছেন,সোনার মতো তাঁর গায়ের রং। তাঁর মাথার মণি-মাণিক্য খচিত মুকুট। পরনে রত্ন-বসানো পোশাক। হাতে হিরের নকশা-করা রাজদণ্ড। পায়ে রুপোর কারুকাজ-করা নাগরা জুতো। এসব সে কোনও দিন চোখে দেখেনি। বৃক্ষক মনে-মনে ভাবল,ইনিই কি তবে দুর্বারগড়ের মহারাজা? রাজপুত্র একবারও তো বলে দিল না যে, “বৃক্ষক,ইনিই রাজামশাই!”
কী ভেবে বৃক্ষক নমস্কার করল রাজামশাইকে। রাজামশাই একটা আসনে বসার ইঙ্গিত করলেন বৃক্ষককে। সকলে অবাক হয়ে তাকিয়ে আছে তার দিকে। রানিমা এসে দাঁড়িয়েছেন রাজপুত্রের পাশে। অমন রূপবতী মহিলাকে দেখে যেন বিস্ময়ের ঘোর কাটল না বৃক্ষকের। চোখের পলক পড়ল না। বৃক্ষক মনে-মনে ভাবল,ইনিই কি তবে রানিমা?কী ভেবে সে রানিমাকেও নমস্কার করল।
রাজামশাই বৃক্ষককে প্রশ্ন করলেন, “সারাদিন তুমি কী কাজ করো? তোমার দিন কাটে কীভাবে?”
অকপটে বৃক্ষক বলল তার জঙ্গলের সঙ্গে বড় হয়ে ওঠার গল্প। গাছ লাগানোর কথা,পাখির বাসা বানিয়ে দেওয়ার কথা,পাখির ডিম কুড়িয়ে বাসায় রেখে আসার কথা,পা-ভাঙা পাখির বাচ্চাকে সারিয়ে তোলার কথা। সকলে অবাক হয়ে শুনছিল বৃক্ষকের কথা।
এমন সময় সব শুনে পুরাণজ্ঞ পণ্ডিতমশাই এগিয়ে গেলেন রাজামশাইয়ের সিংহাসনের কাছে। ধীর গলায় বললেন, “রাজামশাই,আপনি অনুমতি দিলে আমি বৃক্ষককে দু-একটা প্রশ্ন করতে পারি?”
রাজামশাই মাথা নেড়ে অনুমতি দিলেন। ঝলমল করে উঠল মুকুটের শত-সহস্র মণি-মুক্তো।
পুরাণজ্ঞ পণ্ডিত বৃক্ষককে প্রশ্ন করলেন, “তুমি বলতে পারো,কতগুলো যজ্ঞ শেষ হলে তবে অশ্বমেধ যজ্ঞ করা যায়?”
বৃক্ষক দু’দিকে মাথা নাড়ল,সে জানে না।
ব্যঙ্গের হাসি চিকচিক করে উঠল পুরাণজ্ঞ পণ্ডিতের মুখে। তিনি উত্তর বলে দিলেন, “নিরানব্বইটি।” ফের তিনি বৃক্ষককে প্রশ্ন করলেন, “পৃথিবীতে যে নদীর নাম গঙ্গা,পাতালে যে নদীর নাম বৈতরণী,স্বর্গে সে নদীর নাম কী?”
এবারও বৃক্ষক মাথা নেড়ে বলল,সে জানে না।
এবার জোরে অট্টহাসি হাসলেন পণ্ডিত। বললেন, “অলকানন্দা। তুমি তো কিছুই জানো না!রাজপুত্র তোমার বন্ধু হবে কেমন করে?”
মহারাজা সংগ্রামপ্রসন্ন পণ্ডিতের দিকে হাত তুলে তাঁকে থামতে নির্দেশ দিলেন। সকলে ভাবল,এবার মূর্খ বৃক্ষকের মৃত্যুদণ্ড নিশ্চিত।
এমন সময় মহারাজা বললেন, “না পণ্ডিতমশাই,এই শাস্ত্রকথা যেমন জ্ঞান,তেমনি বৃক্ষক যা জানে তাও তো অনেকে জানে না। ভুলে গেলে চলবে না,সেগুলোও জ্ঞান হিসেবে কিন্তু কম মূল্যবান নয়!আজ থেকে রাজপুত্র প্রকৃতির এই সব মূল্যবান পাঠ শিখবে বৃক্ষকের কাছ থেকে। আজ থেকে বৃক্ষক রাজপুত্রের বন্ধু!”
রাজা সংগ্রামপ্রসন্নর নির্দেশে রাজপুত্র ফের ঘোড়ার পিঠে বসিয়ে বৃক্ষক কাঠুরেকে পৌঁছে দিতে চলল জঙ্গলে। তা না হলে অতখানি পথ বৃক্ষক একা যাবে কেমন করে?
ছবিঃ ইন্দ্রশেখর