ধারাবাহিক উপন্যাস অন্তিম অভিযান পিটার বিশ্বাস বর্ষা ২০১৬

আগের পর্বগুলো-র পর

সেখানে পাহাড়ের গায়ের পুরু কাদার স্তরে ভাঁজ পড়ছে। প্রাগৈতিহাসিক কোন দানবজীবের মতই নড়েচড়ে সচল হয়ে উঠছে যেন তা। সেখানে গজিয়ে ওঠা প্রাচীন মহীরুহের দল হঠাৎ করেই পায়ের তলার শেকড়ের বাঁধন আলগা হয়ে এলোমেলো দুলছে, তারপর মুখ থুবড়ে পড়ছে কাদার চলমান স্তরের ওপরে। এক দানবিক জলপ্রপাতের মতই ধেয়ে আসছে সেই কাদার স্তর তাঁদের লক্ষ করে।

জিষ্ণুও ব্যাপারটা লক্ষ করেছে। তীক্ষ্ণ নজর চালিয়ে ছুটে আসতে থাকা ধ্বসের গতিপথের একটা আন্দাজ করে নিল সে। তারপর পাহাড়ের ঢালের থেকে উঠে আসা একটা গাছের ডাল ধরে তরতর করে নেমে গেল বাঁদিকের ঢালের নিরাপদ আশ্রয়ে। খানিক নীচে ওপর থেকে সামনে ঝুঁকে পড়া একটা বড়ো পাথরের ছাতার তলার আশ্রয় থেকে প্রফেসর সতর্ক চোখে নজর রাখছিলেন ধেয়ে আসা মৃত্যুদূতের দিকে। তার তীব্র ধাক্কায় শেকড় উপড়ে নেমে আসা অতিকায় গাছগুলো একে অন্যের সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে কানফাটানো শব্দ তুলছিল নির্জন পাহাড়ের গায়।

দশমিনিট কেটে গেল প্রায়। পাহাড়ের মাথা থেকে বিপুল কাদার স্তূপেরা এখনো ক্রমাগত ঝরে পড়ছে পায়ের অনেক নীচে ছুটন্ত নদীর বুকে। মাথার ওপরের পাথরের ছাতার সঙ্গে তার ঘষার তীব্র শব্দ কানে তালা ধরায়। সাবধানে তার একপাশ দিয়ে উঁকি মেরে দেখলেন প্রফেসর একবার। এখান থেকে জিষ্ণুর আশ্রয় নেয়া গাছটাকে পরিষ্কার দেখা যায়। গাছের গায়ে তার মাথাটুকু শুধু দেখা যাচ্ছে ঢালের আড়াল থেকে। মাথার ওপরে পাহাড়চূড়ার অরণ্যের একটা লম্বাটে টুকরো পুরো সাফ হয়ে গেছে ছুটন্ত ধ্বসের ধাক্কায়-

–আর ঠিক তখনই গুরগুর গুমগুম শব্দটা তাঁর দৃষ্টি আকর্ষণ করল। উপড়ে পড়া একটা গাছের শেকড়ের টানে পাহাড়ের গা থেকে খসে এসেছে একটা অতিকায় পাথরের চাঁই। তার গতিপথের দিকে একনজর দেখেই আতংকে হিম হয়ে গেল প্রফেসরের বুকটা। ছুটন্ত ধ্বসের শব্দকে উপেক্ষা করেই প্রাণপণে চিৎকার করে উঠলেন তিনি—“জিষ্ণু—সাবধান—”

জিষ্ণুও দেখেছে তার দিকে সোজা ছুটে আসতে থাকা পাথরের বিরাট চাঁইটাকে। অসহায়ভাবে গাছের ডাল আঁকড়ে ধরে সেদিকে তাকিয়ে আছে সে। খাদের ভেতরে একটা গাছের ডালকে আশ্রয় করে ঝুলতে থাকা ছেলেটার পালিয়ে যাবার কোন জায়গা নেই—

নিজের কর্তব্য স্থির করে নিলেন প্রফেসর। গত সাত বছর ধরে প্রতি মুহূর্তে আক্রমণের আশংকা মাথায় নিয়ে কেটেছে তাঁর। সন্তর্পণে নিজেকে লুকিয়ে রেখে কাজ করে গিয়েছেন তিনি। আজ সাফল্যের মুখে পৌঁছে এভাবে—

মনের ভেতরটা হঠাৎ একেবারে শান্ত হয়ে এল তাঁর। যা ঘটবার তা ঘটবেই। তাঁকে তাঁর কর্তব্য পালন করে যেতে হবে তবুও। বড়ো হয়ে জিষ্ণু নিশ্চয় সব বুঝবে। ক্ষমা করবে নিশ্চয় তাঁকে।

কোমর থেকে লেজার পিস্তলটা বের করে আনলেন তিনি। কয়েকটা সেকেন্ড সময় পাওয়া যাবে। কর্তব্য স্থির হয়ে যাবার সঙ্গেসঙ্গেই সমস্ত উত্তেজনা, সমস্ত ভয় যেন ছেড়ে গিয়েছে তাঁকে। পাথরের ছাতার নিরাপদ আশ্রয়ে বসে তার ছোট্ট খোলা এলাকাটা দিয়ে নিশানা স্থির করলেন তিনি। একটাই সুযোগ পাওয়া যাবে—

সিঁ-ইঁ-ইঁ-ইঁ—

তীক্ষ্ণ একটা শব্দ উঠল অস্ত্র থেকে বের হয়ে সামনে ধেয়ে যাওয়া লাল আলোর সুতোটাকে ঘিরে। তার তীব্র উত্তাপে কেঁপে ওঠা বাতাসের আর্তনাদ—

খাদের প্রায় কাছাকাছি এসে পৌঁছেছে ছুটন্ত পাথরের চাঁইটা। ঠিক তখনই তার বুকে এক মুহূর্তের জন্য স্থির হল লাল আলোর রেখা। আর তারপরেই একটা বিস্ফোরণ হয়ে গুঁড়ো হয়ে উড়ে গেল পাথরের চাঁই।

ধ্বস থেমে গেছে। পাহাড়ের ঢাল ঘন কাদার স্তূপে ঢাকা। তার ওপরে বারবার পিছল খেতে খেতে জিষ্ণু এসে দাঁড়াল প্রফেসর বোসের সামনে। মুখটা ছাইয়ের মত ফ্যাকাশে হয়ে গেছে তার।

“গুহায় ফিরে চল বাবা। তাড়াতাড়ি—সময় নেই বেশি হা—”

কথাটা সম্পূর্ণ হল না তার। প্রফেসরের ডানহাতটা নিখুঁত লক্ষে উঠে এসে আঘাত করেছে তার খুলির গোড়ায় তৃতীয়  ও চতুর্থ কশেরুকার সন্ধিস্থলে। একটা কাটা গাছের মতন কাদার ওপরে যখন আছড়ে পড়ছে জিষ্ণু তখনও তার ঝাপসা হয়ে আসা চোখের দৃষ্টিতে বিস্ময় মাখানো ছিল।

আকাশ বাতাস চুপ হয়ে গেছে।সন্ধে নেমে আসছিল দ্রুত। চুপ করে কাজ করে চলেছিলেন প্রফেসর। সর্বক্ষণের সঙ্গী ঝোলাটা থেকে বের করে এনেছেন স্বচ্ছ তরলে ভরা একটা ছোটো শিশি—

–জিনিসটা গ্রামপ্রধানকেই একবার ব্যবহার করতে দেখেছিলেন প্রফেসর। একাঘ্নির তৈরি হবার প্রথমদিকে দুর্ঘটনা যে দু একবার ঘটেনি তা নয়। টাইটানিয়াম নিষ্কাষণ প্ল্যান্টের ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডে উম জং-এর মৃত্যু তার মধ্যে একটা। তার ছোটো ছেলেটা নিজের চোখে সে দৃশ্য দেখেছিল।তার মা নেই। মানসিক আঘাতটা বড়ো তীব্র হয়ে লেগেছিল ছেলেটার। খাওয়াদাওয়া বন্ধ হয়ে গিয়েছিল তার।

নিশ্চিত মৃত্যুর দিকে এগিয়ে চলেছে যখন অনাথ ছেলেটা, তখন একদিন গ্রামপ্রধান তার ঘুমন্ত, দুর্বল শরীরটার পাশে এসে বসেছিলেন। যত্ন করে তার মুখটা খুলে সেখানে ঢেলে দিয়েছিলেন কোন এক ছত্রাকের নির্যাস।

খানিক বাদে ছেলেটা যখন ঘুম ভেঙে উঠে বসল, তখন তার মুখ থেকে সব দুঃখের চিহ্ন মিলিয়ে গেছে। মিলিয়ে গেছে তার আগের জীবনের সব স্মৃতিও। নতুন একটা নাম দিয়ে তাকে দত্তক নেয় গ্রামেরই অন্য এক নিঃসন্তান পরিবার।

“আপনি হয়ত ওর মঙ্গলের জন্যই এ কাজটা করেছেন মান্যবর,” প্রফেসর পরে একদিন বৃদ্ধকে বলেছিলেন, “কিন্তু নিজের সব স্মৃতিকে হারিয়ে বসা, সে-ও তো মৃত্যুই হল একরকম। তাহলে?”

জবাবে মৃদু হেসে বৃদ্ধ জবাব দিয়েছিলেন, “এ ওষুধের প্রতিষেধকও আছে আমাদের কাছে। আঠারো বছর বয়স হলে তাকে সব কথা জানিয়ে, সে ইচ্ছে করলে তার সব স্মৃতিকে ফের ফিরিয়ে দেয়া হবে।”

ওষুধ ও তার প্রতিষেধক দুটিরই সামান্য কিছুটা নিজের সঙ্গে রেখে দিয়েছিলেন প্রফেসর। তেমন কোন দুর্ভাগ্যের দিন এলে কাজে লাগাবার জন্য। তবে সে দিনটা যে সত্যিই এভাবে তাঁর সামনে এসে দাঁড়াবে তা তিনি কখনো ভাবেননি। আস্তে আস্তে, বড়ো যত্নে অজ্ঞান ছেলেটার মুখ খুলে তার মধ্যে হাতে ধরা শিশিটা উপুড় করে দিলেন তিনি। তারপর ঝোলা থেকে একটা ছোটো তাবিজ বের করে এনে সেটা তার গলায় ঝুলিয়ে দিলেন।

dharaontim01 (Medium)

অন্ধকার নেমে এসেছে। অবশ্য আলো থাকলেও লাভ হত না কিছু চোখের জলে এমনিতেই দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে এসেছে তখন তাঁর। ঝোলা থেকে একটুকরো কাগজ বের করে খসখস করে তাতে কয়েকটা কথা লিখে কাগজটা জিষ্ণুর পকেটে রেখে দিলেন তিনি। তারপর তাকে দুহাতে জড়িয়ে কোলে তুলে নিয়ে কোমরের জেটবেল্টের বোতামে চাপ দিলেন। লেজার রশ্মির সংকেত চিনে নিতে ভুল করবে না লালপিওতের দলের সদাজাগ্রত সেন্সর। ওরা আসবে। আসবেই এখানে। এখন তা শুধু খানিক সময়ের অপেক্ষা। সে সময়টাকেই কাজে লাগাতে হবে প্রথমে। লুকিয়ে প্রাণ বাঁচানো যাবে না আর। একাঘ্নিকে রক্ষা করা দরকার সবার আগে। পৃথিবীর জন্য।

জিষ্ণুর অজ্ঞান শরীরটা কোলে নিয়ে অরণ্যের সবুজ আবরণের মাথা দিয়ে তিরবেগে উড়তে উড়তে প্রফেসরের চোখের সামনে দিয়ে ছবির মিছিল ভেসে চলেছে তখন। সেই ছোট্ট জিষ্ণু—মায়ের হাত ধরে প্রথম হাঁটা—তার মায়ের মৃত্যু—জিষ্ণুকে নিয়ে চাঁদের বুকে—তারপর আস্তে আস্তে তার বড়ো হয়ে ওঠা—কত ছবি—কত স্মৃতি-

পাহাড়ের চূড়া পেরিয়ে বেশ কয়েক মাইল এগিয়ে গিয়ে বাতাসে স্থির হয়ে দাঁড়ালেন প্রফেসর। তারপর কবজিতে বাঁধা গ্রাহক যন্ত্রের নিশানা মেনে নেমে চললেন পায়ের নীচের গভীর জঙ্গলের একটা বিশেষ এলাকার দিকে। কা পোনের যানের গোপন ঘাঁটি। গুহাগ্রামে এলে এইখানেই সে তার যানকে লুকিয়ে রাখে।

********

পায়ের নীচে ঘন সবুজ আবরণ অন্ধকার হয়ে গেছে। ওইখানেই কোথাও শুয়ে আছে জিষ্ণু। থাক। তাঁর সামনে এখন অনেক কাজ। হাওয়া কেটে দ্রুত গুহাগ্রামের দিকে ফিরে চলেছিলেন প্রফেসর। কা পোনের কাছে বার্তা গেছে। চব্বিশ ঘন্টার মধ্যে সে ঠিকই উদ্ধার করে নিয়ে যাবে জিষ্ণুকে। তারপর—

একটা ঝাঁকুনি দিয়ে মাথা থেকে চিন্তাটা সরিয়ে দিলেন প্রফেসর। কবজিতে বাঁধা ছোটো সংকেতজ্ঞাপক যন্ত্রটায় তীক্ষ্ণ শব্দ উঠছে। কাছাকাছি এলাকায় আবহমণ্ডলে ঢুকে আসছে কোন মহাকাশযান। ওরা আসছে—

যেখানে প্রথম জিষ্ণুকে বাঁচাবার জন্য লেজার পিস্তলটা চালানো হয়েছিল সেখানটায় দ্রুত ফিরে যেতেযেতেই তাঁর বেতার সংকেতের নির্ভুল নির্দেশে তখন গুহাগ্রামে ঢোকবার মুখটার কিছু ভেতরে ছোটো একটা বিস্ফোরণে পাথরের স্তূপ এসে ঢেকে দিয়েছে তার প্রবেশপথ। সেখানে কেউ ঢুকে এলেও পাথরের স্তূপের পেছনে কী রহস্য লুকিয়ে আছে তার আন্দাজ পাবে না কোন।

“আমি—এখন শুধু আমি জানি ওখানে ঢোকবার রাস্তার কথা। জীবন্ত ওদের হাতে ধরা দেব না আমি—”

পুবের আকাশ বেয়ে তাঁর দিকে দ্রুত ছুটে আসতে থাকা আলোর বিন্দুটার দিকে তাকিয়ে নিজের মনেই বিড়বিড় করে প্রতিজ্ঞাটা বারবার বলে চলেছিলেন একলা মানুষটা। নিজের শরীরে তিনি তখন দ্রুতহাতে বেঁধে চলেছেন পাথর ফাটানো বিস্ফোরকের পুঁটুলিগুলো–

বহুদূরে, মঙ্গলের বুকে একটা নিয়ন্ত্রণকক্ষের পর্দায় তখন ধরা পড়েছে পাহাড়ের গায়ে দাঁড়িয়ে থাকা একলা মানুষটার ছবি। সেদিকে চেয়ে মৃদু হাসলেন লালপিওতে, “এইবার প্রফেসর বোস। ফের দেখা হল আমাদের। কিন্তু বেশিক্ষণের জন্য নয়—” বলতেবলতেই  মাইক্রোফোনে নিচু গলায় নির্দেশ দিলেন তিনি, “একে আমার জীবন্ত দরকার। ওকে সঙ্গে নিয়ে-”

কথাটা শেষ হবার আগেই পর্দার ছবিটা কেঁপে উঠে মিলিয়ে গেল। সেখানে তখন ভেসে উঠেছে এঁকেবেঁকে ছুটন্ত যানের ক্যামেরায় ধরা পড়া রাতের প্রকৃতির এলোমেলো ছবি।

“রিপোর্ট দিন লেফটেন্যান্ট।”

জবাবে যান থেকে কিছু এলোমেলো কথার টুকরো ভেসে এল শুধু—“লোকটা আমাদের দিকে উড়ে আসছে অ্যাডমিরাল—নিশানায় আনবার চেষ্টা করছি আমরা—দূরত্ব কমছে—”

তারপর স্ট্যাটিকের খরখর ছাড়া আর কোন শব্দ এলো না নিয়ন্ত্রণকক্ষের স্পিকার স্পিকার থেকে। পৃথিবীর বুকে, ভারতের উত্তরপশ্চিমের ঘন অরণ্যের ভেতরে তখন আকাশ থেকে মাটিতে নেমে আসছে অতিকায় একটা আগুনের গোলা। চারপাশে বৃষ্টির মত ছড়িয়ে পড়ছিল বিস্ফোরণে ছিটকে যাওয়া যানটার টুকরোটাকরা—

ক্রমশ

জয়ঢাকের সমস্ত ধারাবাহিকের সমস্ত পর্ব একসঙ্গে এইখানে