ওরা-অমিত দেবনাথ
সূর্য দিগন্তে অস্ত যাচ্ছে। পশ্চিম আকাশ রাঙা হয়ে গেছে শেষ বিকেলের রক্তবর্ণ ছটায়।
টিলার ওপর দাঁড়িয়েছিল দুজন মানুষ – একজন পুরুষ, অন্যজন মহিলা। লোকটার ছোটোখাটো চেহারা, উশ্কোখুশ্কো চুল, ময়লা গায়ের রঙ, কিন্তু চোখের দৃষ্টি উজ্জ্বল – এত উজ্জ্বল যে বেশিক্ষণ তাকিয়ে থাকা যায় না। মহিলার গাত্রবর্ণ উজ্জ্বল, একমাথা সোনালি চুল, পরনে হালকা গরম ফ্রক এবং মহিলা এককথায় নিখুঁত সুন্দরি। দুজনে পাশাপাশি দাঁড়িয়ে কিছু একটা নজর করছিল। লোকটা বিড়বিড় করে বলল, “এইবার দেখা যাবে।”
“তুমি সিরিয়াসলি বলছ?”
“সিরিয়াস মানে? একশোভাগ সিরিয়াস। দাঁড়াও না, শিগগিরি এর একটা ব্যবস্থা করছি।” লোকটা মহিলার দিকে তাকিয়ে রইল খানিকক্ষণ, তারপর বলল, “তুমি আমাকে বিশ্বাস করছ না, তাই না? তোমাকে আমি একটু আলাদা ভেবেছিলাম।”
“আলাদা তো হতেই চাই, কিন্তু পারছি কই? জেরি, তুমি যা বলছ, তা কি সত্যিই বিশ্বাস করা যায়?”
ঘন ভুরুর নিচে জেরির চোখদুটো আরও কঠোর হয়ে উঠল।
“ইউনিস, আমি ভেবেছিলাম,” সে বলল, “তোমার মাথায় হয়তো কিঞ্চিৎ বুদ্ধিশুদ্ধি আছে। দেখো –-”
ইউনিস বাধা দিল। “আমি আমার মাথা যথেষ্ট খাটাচ্ছি, আর খাটিয়েও এটা কিছুতেই বুঝতে পারছি না যে তুমি যা বলছ সেটা কী করে সম্ভব? তুমি কি সত্যিই ভাবছ –”
“শ্ শ্ শ্;” লোকটা বলে উঠল, “ওই ওরা আসছে। ভালো করে নজর করো, ভালো করে। অবশ্য সেটা এদের মধ্যে আছে কি না বুঝতে পারছি না -”
পাহাড়ের ঢালে এবার পাশাপাশি দুজনে শুয়ে পড়ল। পাহাড়ের একটা গুহা থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে বাদুড় বেরিয়ে আসছে, তাদের সংখ্যা অন্তত হাজার দশেক। বেরিয়ে আসছিল তারা গুহা থেকে, ছড়িয়ে পড়ছিল আকাশে কালো ধোঁয়ার মত।
বাইনোকুলারটা চোখে লাগিয়ে ভালো করে দেখতে দেখতেই আচমকা জেরি ইউনিসের হাত চেপে ধরল, চেঁচিয়ে বলল, “দেখো, দেখো, বড়ো ঝাঁকটার ডানদিকে – ওই যে আট নম্বর – না, ন’নম্বর সারিটা। দেখতে পাচ্ছ?”
জেরি বাইনোকুলারটা দিতে যাচ্ছিল, কিন্তু ইউনিস আস্তে করে সেটা সরিয়ে দিল।
“আমি এমনিতেই দেখতে পাচ্ছি,” ইউনিসের গলা শান্ত, শুধু তার নীল চোখদুটো কুঁচকে গেল এক মুহূর্তের জন্য।
“দেখেছ?” জেরির গলায় অসহিষ্ণুতা, “এবার বলো, ঠিক না ভুল?”
“আমার মনে হয়, ওরা শুধুই বাদুড়।”
“রাবিশ!” রাগ ঝরে পড়ল জেরির গলায়, “কাকে বোঝানোর জন্য আমি সময় নষ্ট করছি? আমি তোমাকে পইপই করে বললাম, কীভাবে দেখতে হবে। আর কী, ওরা তো সব উড়ে বেরিয়ে গেল।” তাচ্ছিল্যের দৃষ্টিতে তাকাল জেরি, “তার মানে তুমি কিস্যু বুঝতে পারনি?”
“সত্যিই পারিনি, জেরি। আমি বাদুড় বিশেষজ্ঞ নই। আমি শুধু দেখলাম, ওরা উড়ছিল -”
“শুধু উড়ছিল নয়, শুধু উড়ছিল নয়। ওদের মধ্যে একটা অনেক উঁচুতে উঠেছিল, ঠিক বাজপাখির মত। এই নিয়ে তৃতীয়বার আমি ওটাকে দেখলাম। আমি ওটাকে আলাদা করতে পেরেছি। গায়ের লোম একটু বড়ো, রঙটা একটু আলাদা – তবে এগুলো কোন ব্যাপার নয়। যেটা ঘটনা, সেটা হল – বাদুড় কখনও এত ওপরে ওঠেনা। তার নানা কারণ থাকতে পারে। হয়তো রাত্তিরে ওপরে দমকা হাওয়া থাকে না, হয়তো ওদের পোকামাকড় ধরার সুবিধে হয়। কিন্তু বাদুড়েরা কখনই এত ওপরে ওঠে না।”
সে পকেট থেকে বার করল একটা মোটা মেরুন রঙের নোটবই, কী যেন মিলিয়ে দেখল। তারপর বইটা বন্ধ করে বলল, “ঠিকই আছে। আমি অনেক তথ্য সংগ্রহ করে দেখেছি। এখনই কাজে নামতে হবে। আর দেরি করা যায় না।
“তথ্য কীসের? কীসের কথা বলছ তুমি?”
“কী-সে-র তথ্য?” রেগে গেল জেরি, “ভগবান! তোমাকে কাল রাত্তিরে আমি কী বোঝালাম? কিছুই শোননি দেখছি। শোনো – জন্তুজানোয়ারদের কিছু কিছু নির্দিষ্ট নিয়ম আছে, ওরা সেই নিয়ম ভঙ্গ করে না। যদি তুমি দেখ কোন কুকুর ঘুমনোর আগে পাক খাচ্ছে না, পায়রা মাথা ঝাঁকাতে ভুলে যাচ্ছে, বাদুড় আকাশের অনেক ওপরে উঠছে –”
“কী সব আজগুবি চিন্তাভাবনা মাথায় ঢুকিয়েছ বলতো? ইউনিস জেরির হাত ধরে বলল, “তোমার কি একটু মজাও করতে ইচ্ছে করে না? একটুও এমনি গল্পগুজব করতে? সারাক্ষণ এইসব ভারি ভারি কথাবার্তা?”
জেরি ইউনিসের হাত সরিয়ে দিল, বিড়বিড় করে বলল, “মেয়েরা করবে গভীর চিন্তাভাবনা? তাহলেই হয়েছে!” তারপর বলল, “শোনো, আমি যে কাজটা করতে যাচ্ছি তা যদি সত্যিই সফল হয়, তবে –”
ইউনিস কাটাকাটা গলায় বলল, “জেরি, আমার মনে হয়, তোমার কোন ডাক্তার দেখানো দরকার।”
জেরি হাসল। তিক্ত হাসি।
“ডাক্তার কেন, বল না, পাগলের ডাক্তার?”
“আমি জানি না, কেন আমি তোমার সঙ্গে ঘুরে সময় নষ্ট করছি,” ইউনিস বিরক্ত গলায় বলল।
জেরি কর্কশ হেসে বলল, “আমিও জানি না কেন আমি লোককে বোঝানোর চেষ্টা করছি। অবশ্য যে কোন নতুন ধারণাই তো লোকের কাছে প্রথমে আজগুবি ঠেকে। এখনও সময় আছে। এখনও যদি মানুষ ওদের সম্পর্কে সাবধান না হয় –”
“ও-ও-ফ্!” বলে উঠল ইউনিস, “আবার সেই ওদের গল্প!”
“আগেরবার আমার একটু ভুল হয়ে গেছিল,” জেরি ইউনিসের কথায় কান না দিয়ে বলে চলল, “আমি কাটাছেঁড়া করে দেখতে চেয়েছিলাম ওদের অঙ্গপ্রত্যঙ্গগুলো অন্যরকম কিনা। এমনকি একবার আমি একটা খরগোশের রক্ত পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনা পাবলিক হেলথ অফিসে পাঠিয়েও ছিলাম। ভেবেছিলাম ওরা কিছু ধরতে পারবে। কিন্তু ওরা রিপোর্টে স্রেফ নেগেটিভ লিখে ছেড়ে দিল। কিছু থাকলেও ওরা খেয়াল করেনি। আশ্চর্য! এটা তো কোন রুটিনমাফিক কাজ নয়, ওদের তো বোঝা উচিৎ ছিল!”
“আচ্ছা, এটা কি ঠিক যে মনুষ্যেতর প্রাণীরা নির্দিষ্ট নিয়ম মেনে চলে?”
“কিছু ক্ষেত্রে নিশ্চিতভাবে। কিন্তু আমি অনেক বেনিয়ম দেখেছি। আর এখন আমার একটা নিশ্চিত ধারণা হয়েছে।”
“সেটা কী?”
“সেটা কী?” জেরি কিছুক্ষণ তাকিয়ে রইল। তারপর বলল, “সেটা বললে তুমি এক্ষুণি পুলিশের কাছে যাবে, বা অন্য কোথাও।” তার গলায় একটা সন্দেহের সুর। ইউনিস ব্যাগ্রভাবে বলল, “না না – আমি কোথাও যাব না, কাউকে বলব না। সত্যি বলছি।”
“বেশ। ধরে নেওয়া যাক, এই যে প্রাণীগুলোর কথা আমি বলছি, এরা আসলে কেউ কোন প্রাণী নয়, এরা একধরণের গুপ্তচর। কোথাকার গুপ্তচর, তা আমাকে জিজ্ঞাসা কোরো না, কিন্তু এরা অসম্ভব বুদ্ধিমান। এরা সর্বত্র ছড়িয়ে পড়ছে – বন্যপ্রাণী বা গৃহপালিত, দু’রকম ভাবেই। এবং আমাদের সমস্ত কার্যকলাপ লক্ষ্য করছে। মামুলি কল্পবিজ্ঞানের গল্প বলে মনে হচ্ছে? কিন্তু এটাই সত্যি। যাই হোক – এরা ভীষণ চালাক এবং লক্ষ্যে স্থির। এদের কিছু কিছু – ধরো প্রায় সবাই – মরে যাবে, তবু মুখ দিয়ে একটা কথাও বার করবে না। কিন্তু সবারই কিছু না কিছু দুর্বলতা আছে। সঠিক পদ্ধতি প্রয়োগ করলে কেউ না কেউ ভেঙে পড়বেই। আমি ঠিক সেই সময়টার জন্য অপেক্ষা করছি। একটা না একটা সময়ে আমি কোন কুকুর বা বেড়াল বা কাঠবেড়ালি বা কোন বাদুড়কে দিয়ে কথা বলাব – অবশ্যই ইংরেজিতে, আর তখনই ওদের সব জারিজুরি, সব গোপন তথ্য ফাঁস হয়ে যাবে। এ বিষয়ে আমি নিশ্চিত।”
ইউনিস হাঁ করে তাকিয়ে রইল জেরির দিকে। বলল, “তার মানে, তুমি জন্তুগুলোকে মারবে? যন্ত্রণা দেবে? ওদের কথা বলানোর জন্য? তুমি কি পাগল?”
“আমি জানতাম তুমি আমার কথা বিশ্বাস করবে না।”
“জেরি, তুমি কি বুঝতে পারছ যে তুমি অসুস্থ? তুমি একধরণের মানসিক রোগে ভুগছ?”
“সে তো বটেই! লুই পাস্তুর প্রথম জীবাণুর কথা বলাতে তাকেও লোকে পাগল বলেছিল। আইনস্টাইন সময়ের মোচড়ের কথা বলাতেও তাই, অথবা –”
“ওইসব অন্যরকম জন্তু – মানে তুমি যেগুলোকে কাটাছেঁড়া করেছিলে – ওদের তুমি পেয়েছিলে কোথায়?”
“আমি তো তোমায় আগেই বলেছি যে আমি রেডউড ক্যানিয়নে একটা চালাঘরে থাকি। ওখানে অনেক রকম জন্তুজানোয়ার আছে – খরগোশ, হরিণ, ইঁদুর, রেকুন, কাঠবেড়ালি, গিরগিটি, বেজি, শেয়াল – আরও কত কী। যখনই আমার কোনোটাকে অস্বাভাবিক মনে হয়, আমি সেগুলোকে ধরার চেষ্টা করি বা গুলি করি। এতে অবশ্য আমার প্রচুর হয়রানি হয়েছে। আমার বেশ কিছু প্রতিবেশী আমার নামে রিপোর্ট করেছে। আমাকে জরিমানাও দিতে হয়েছে। কিন্তু আমি ওসবের তোয়াক্কা করিনি। তবে এখন আমি একটু অন্যরকমভাবে সমস্যাটার কথা ভাবছি। আমি ভাবছি আমার সমস্ত পরীক্ষাগুলো টেপ করে আর ছবি তুলে রাখবো। যদি আমার পরীক্ষা সফল হয়, তবে ওগুলোই হবে তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। তখন আর কেউ আমাকে অবিশ্বাস করবে না।”
“তুমি সত্যি সত্যিই তাহলে ভাবছ যে ওইসব ছোটোছোটো জন্তুগুলোকে যন্ত্রণা দিলে, নির্যাতন করলে ওগুলো কথা বলে উঠবে, তাও আবার ইংরেজিতে। এবং সেগুলো তুমি টেপ করে রাখবে, ছবিও তুলবে।”
“নিশ্চয়ই,” জেরি জামার পকেটে রাখা নোটবইটা দুবার চাপড়ে বলল, “এখানে সব লেখা আছে। একশোটারও বেশি কেস। সেগুলো প্রমাণ করছে আমিই ঠিক। সব আমার অভিজ্ঞতা – যেমন ধরো, কিছু কিছু বেড়াল অস্বাভাবিক আচরণ করছে। তারা শরীরের কিছু অংশ পরিষ্কার করতে পারছে না। তার মানে এগুলো সত্যিকারের বেড়াল নয়, কারণ বেড়ালছানারা ছোটো থেকেই এগুলো শিখে ফেলে। মোরগ লড়াইয়ের ফাঁকে ফাঁকে খাবার খুঁটে খাচ্ছে না, কারণ এটা আসল মোরগ নয়। ছুঁচো পোকা ধরছে, কিন্তু সেটার মাথা কামড়ে খাচ্ছে না। আমি ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলে যেতে পারি। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে এগুলো স্রেফ নিয়মের ব্যতিক্রম, কিন্তু এগুলো থেকেই আস্তে আস্তে পুরো ব্যাপারটার একটা ছবি ফুটে ওঠে। আমি কিন্তু জীবজগতের মধ্যেও একটা ওলটপালট দেখতে পাচ্ছি। আমার ভুলও হতে পারে, কিন্তু আমি নিশ্চিত, আমার ভুল হচ্ছে না। বিপদ কিন্তু ঘনিয়ে আসছে। এখনও যদি বিশ্ববাসীকে সাবধান না করা যায়, তবে একদিন – খুব শিগগিরি – এরাই পৃথিবীর দখল নেবে। আমরা তৈরি থাকলে অবশ্য আলাদা কথা –”
ইউনিস একদৃষ্টে জেরির দিকে তাকিয়েছিল, এবার ধীরে ধীরে মাথা নাড়ল। “আচ্ছা, তোমার এরকম কখনও মনে হয়নি যে এই -মানে চর, গুপ্তচর- এরা এত সহজে তোমার ফাঁদে পা দেবে না?”
“উল্টোটাও হতে পারে। ওরা তো জানে না যে ওদের রহস্যটা আমি ধরে ফেলেছি। কাজেই ওরা ইচ্ছে করেও ফাঁদে পড়তে পারে যাতে আরো কাছ থেকে মনুষ্যপ্রজাতির কার্যকলাপ লক্ষ্য করতে পারে।”
ইউনিস উত্তর শুনে হাঁ হয়ে গেল। বলল, “আচ্ছা, এরকমও তো হতে পারে, এরা যেহেতু চর, হানাদার, তাই তুমি ওদের গোপন রহস্য জেনে ফেলেছ দেখে ওরা তোমাকে মেরে ফেলতে পারে?”
“পারেই তো,” ঠান্ডাগলায় জবাব দিল জেরি, “কিন্তু আমার ধারণা, ওরা কোন অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে আসেনি। এটা ওদের পক্ষে ঝুঁকির ব্যাপার হয়ে যাবে। ওদের মধ্যে কেউ যদি, ধরা যাক গাড়ি চাপা পড়ে, আর দেখা যায় তার শরীরে অদ্ভুত কোন অস্ত্র আছে, তাহলেই তো সব ধরা পড়ে যাবে। কাজেই আমার মনে হচ্ছে, ওরা এখন এসেছে শুধুই প্রাথমিক খোঁজখবর নিতে। এমনও হতে পারে যে ওরা বহু দূর থেকেও নিজেদের মধ্যে যোগাযোগ করতে পারে। তবে এ ব্যাপারে আমার সন্দেহ আছে, কারণ তাহলে আমি যেগুলোকে অ্যাদ্দিন ধরেছি বা মেরেছি, সেগুলো নিয়ে ঝামেলায় পড়ে যেতাম।”
“সব উত্তরই তো জেনে গেছ দেখছি,” ইউনিস তেতো গলায় বলল, “আর এখন তুমি তাহলে ওইসব নিরীহ, ছোটো ছোটো প্রাণীগুলোর ওপর ফের অত্যাচার শুরু করবে?”
“সবাই যে ছোটো ছোটো প্রাণী, তেমন ভেবো না। আমি এমন হরিণ দেখেছি, যেটা আসল হরিণ নয়, আর এমন ভাল্লুক দেখেছি, যেটা মৌচাকের পাশ দিয়ে চলে গেছে মধু না খেয়ে।”
“আমি কি আসতে পারি তোমার কান্ডকারখানা দেখতে?”
জেরি দারুণ অবাক হয়ে গেল।
“তুমি আসবে? দেখবে? অসম্ভব। জন্তুগুলো যখন যন্ত্রণার চিৎকার করতে থাকে, তখন সেটা সহ্য করা মুশকিল হয়ে পড়ে। না না, তোমাকে আমি আসতে দিতে পারব না।”
ইউনিস উঠে দাঁড়াল। বলল, “তুমি একই সঙ্গে বোকা এবং অসুস্থ মানসিকতার। তোমাকে আমার অসহ্য লাগছে।”
চলে গেল ইউনিস। তার চলে যাওয়া পথের দিকে খানিকক্ষণ তাকিয়ে রইল জেরি। তারপর বলল, “যতই রাগ করুক, ওকে কিছুতেই ল্যাবরেটরিতে নেওয়া যাবে না। ওসব দৃশ্য মেয়েদের জন্য নয়।”
এখন চারিদিকে বেশ অন্ধকার। আড়ষ্ট পায়ে জেরি উঠে দাঁড়াল, তারপর হেঁটে তার গাড়িটার কাছে গেল। তার মনে একটা ক্ষীণ আশা ছিল যে সে হয়তো দেখবে ইউনিস গাড়িতে বসে আছে, কারণ এখান থেকে শহর অনেকটা দূরে। কিন্তু ইউনিস চলে গেছে। জেরি বেশ কয়েকবার তার নাম ধরে ডাকল, তার সত্যিই একা একা ইউনিসকে ছেড়ে যাওয়ার ইচ্ছে নেই। বেশ খানিকক্ষণ ডাকাডাকি করে হাল ছেড়ে দিল জেরি, কাঁধ ঝাঁকিয়ে গাড়ি হাঁকিয়ে দিল শহরের দিকে।
পরদিন সকালবেলা। জেরি তার ল্যাবোরেটরিতে গিয়ে চিন্তা করছে কীভাবে তার কাজ শুরু করা যায়। পাঁচখানা বিশেষ ধরণের প্রাণীকে বন্দি করে রেখেছে সে পরীক্ষার জন্য। পাঁচটাই যথেষ্ট “সন্দেহজনক”। এর মধ্যে একটা ইঁদুর, যেটার আচরণ পুরোপুরি ইঁদুরের মত নয়, আর ইঁদুর কতটা গুপ্তচরগিরি করতে পারবে সে বিষয়ে তার নিজেরই সন্দেহ আছে। আছে একটা ফুটফুটে খরগোশ, কিন্তু সেটা সন্দেহজনক হলেও সেটাকে অত্যাচারের বদলে আদর করতেই বেশি ইচ্ছে করছে। শেষমেস জেরি যেটাকে বাছল, সেটা হল একটা ছোট্টো রেকুন। এইটুকু হলে হবে কি, ব্যাটার হাবভাব একেবারে দস্যুর মতো। এটাকেই আগে শূলে চড়ানো যাক। তবে এটাও ঠিক, জেরি ভালো করেই জানে যে শুধু পর্যবেক্ষণ করে সবসময় সঠিক সিদ্ধান্তে আসা যায় না। রেকুনটা হয়তো আদৌ তার ধারণামতো গুপ্তচর নয়, এটা হয়তো স্রেফ একটা অতি চালাক, অতি ছট্ফটে একটা সাধারণ রেকুন, আর সে যেটাকে নির্দোষ ভাবছে, সেই চুন্নুমুন্নু চোখের ইঁদুরটাই হয়ত গুপ্তচর দলের মাথা। হতেই পারে। তবে কথা হল, কাউকে না কাউকে দিয়ে তো শুরু করতেই হবে।
অতএব, হাতে পাতলা গ্লাভস পরে, জেরি তারের খাঁচা থেকে রেকুনটাকে টেনে বের করল, ছট্ফট্ করতে থাকা প্রাণীটাকে দড়ি দিয়ে আচ্ছা করে বাঁধল টেবিলের সঙ্গে। এমনভাবে বাঁধল, যাতে সেটা নড়াচড়া করলেও পালিয়ে যেতে না পারে।
তারপর, বিউটেন ওয়েলডিং টর্চটা জ্বালিয়ে সে রেকুনটার কাছে গেল।
“শোনো, আমি যা বলছি সবই নিশ্চয়ই বুঝতে পারছ,” জেরি বলল রেকুনটাকে, “না না, না বোঝার ভান করে কোন লাভ হবে না। আমি যা যা বলব, তার সমস্ত উত্তর চাই, না হলে জ্যান্ত পুড়িয়ে মারব। পরিষ্কার ইংরেজিতে জবাব দাও – তুমি কে, কে তোমাকে পাঠিয়েছে এবং কেন। ঠিক আছে?”
রেকুনটা এতক্ষণ প্রাণপণে লাফঝাঁপ, টানাটানি করছিল কষে বাঁধা দড়ির বাঁধন থেকে মুক্তি পাওয়ার জন্য, জেরির গলা শুনে একটু থেমে গেল, তাকিয়ে রইল জেরির দিকে, চক্চকে চোখের পোষ না মানার দৃষ্টি। তারপর আবার টানাটানি শুরু করল দড়িটা, নিঃশ্বাস ছাড়তে লাগল ফোঁস্ফোঁস্ করে, অদ্ভুত সব আওয়াজ বেরতে লাগল গলা দিয়ে।
“হুম! সোজা আঙুলে ঘি উঠবে না মনে হচ্ছে, ভাবলেশহীন মুখে বলল জেরি, “আগুনের ছ্যাঁকা কীরকম হয় বোধহয় জানা নেই বাছাধনের। তুমি যে গ্রহ থেকে এসেছ, সেখানে লোকজন আগুনে পুড়ে মরে না বোধহয়। অবশ্য এরকমও হতে পারে, তোমাদের আসল চেহারায় তোমরা আগুনের ছ্যাঁকা টের পাওনা – অথবা এখন ছদ্মবেশ ধরে আছ বলে ছ্যাঁকা লাগছে না। আবার এও হতে পারে যে ছ্যাঁকা লাগছে না, অথচ এমন ভান করছ যেন খুব যন্ত্রণা হচ্ছে। দাঁড়াও চাঁদু – মুখে বুলি ফোটানোর অনেক রাস্তা আমার জানা আছে। তোর ব্যথা লাগছে না যখন, তখন আমি ঠিক রাস্তায় যাচ্ছি। আগুনটা আরেকটু বাড়িয়ে দিচ্ছি, এবার দ্যাখ কেমন লাগে –”
সে আগুনের শিখাটা আরেকটু বাড়াতেই সেটা নীলবর্ণ ধারণ করল। এবার জেরি সেটা নিয়ে সরাসরি ছ্যাঁকা দিল রেকুনটার বাঁদিকের একটা কানে, অসহায় প্রাণীটা ডাক ছাড়ল একটা, তারপর রীতিমত গোঙাতে লাগল। কানটা নাড়াতে লাগল ক্রমাগত।
“লাগছে তো? লাগবেই,” জেরি বলল, “এ তো কিছুই না। তুই ব্যাটা যদি এখনও মুখ না খুলিস, তবে তোর গা-টা পোড়াতে থাকব। সহ্য করতে পারবি তো?”
দৃশ্যটা যতই ভয়ংকর লাগুক, আমাকে পিছিয়ে এলে চলবে না, জেরি মনে মনে বলল। যদিও প্রাণীটাকে শেষ অবধি জ্যান্ত পোড়াতে হবে ভাবলেই জেরির নাড়ির গতি দ্রুত হয়ে উঠছে, তবুও যন্ত্রণা পেয়ে যদি প্রাণীটা ছদ্মবেশ ছেড়ে নিজমূর্তি ধারণ করে, তাহলে হয়তো ওটা কথাও বলতে পারে।
জেরি যখন আগুনের শিখাটা প্রাণীটার বাঁ পায়ের কাছে নিয়ে এসেছে, ঠিক তখনই তার পেছনে ল্যাবোরেটরির দরজাটা খুলে গেল। আওয়াজ শুনেই ধক্ করে উঠল জেরির বুক, আগুন হয়ে গেল মাথা। পেছন ঘুরে তাকাল সে, যদি তার কোন প্রতিবেশী আবার তার কাজে নাক গলাতে আসে –
“এ কী! তুমি!” জেরি বিস্ময়ের ধাক্কা সামলাতে পারল না। “তোমাকে না বলেছিলাম –”
“না এসে পারলাম না,” দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে আছে ইউনিস, তার চোখ সোজা বেঁধে রাখা রেকুনটার দিকে, সেই নীল চোখ এখন জ্বলছে রাগে, অবিশ্বাসে, ঘৃণায়। “ওঃ, তুমি কি মানুষ! একটা নিরীহ প্রাণীকে তুমি – এখনও ওর ভালো করে চোখ ফোটেনি –”
ইউনিস সোজা তাকাল জেরির দিকে, “এটাকে ধরেছ কেন?”
“ধরেছি, কারণ এটা ওর খাবার ধুয়ে খেত না – অন্তত যদ্দিন না পর্যন্ত না এটা বুঝতে পেরেছে আমি ওকে নজর করছি,” জেরির উত্তর, “আটকানো জন্তুগুলোর মধ্যে এটা আমার লিস্টে এক নম্বরে আছে। আর ধরেছি তাতে তোমার কী? ওর হয়ে ওকালতি করতে এসেছে! তুমি এখন যাও এখান থেকে।”
“আমি যাব না,” ইউনিস বলল।
“না গেলে ঘাড়ধাক্কা দিয়ে বার করে দেব।”
ইউনিস চট করে একবার চারদিক দেখে নিয়ে বলল, “বের করে দিলে আমি আবার আসব। তোমার ঘরে তো ছিটকিনিও নেই।”
“বেশ, ইচ্ছে হলে থাকো, তবে তোমাকে আমি সাবধান করে দিচ্ছি, ফের যদি আমার কাজে নাক গলাও, তবে কিন্তু আর মেয়ে বলে মানব না, গায়ে হাত তুলব।”
সে রেকুনটার কাছে গিয়ে আবার একটা ছ্যাঁকা দিল সেটার পায়ে। যন্ত্রণায় অসহায় প্রাণীটার মুখ দিয়ে এবার প্রায় মানুষের মত একটা চিৎকার বেরিয়ে এল।
“হুররে! এখন কী মনে হচ্ছে এটা রেকুনের আওয়াজ?” জেরি বলল ইউনিসকে, “জয় ভগবান, এর আগে এরকম আওয়াজ আমি আর কখন শুনিনি। বাজি ফেলছি –”
“এটার ছ্যাঁকা খাওয়ার আওয়াজ তোমার কাছে স্বাভাবিক মনে হচ্ছে, তাই না?” ইউনিস বলল, “তুমি এসব বন্ধ করো বলছি, জেরি।”
“অসম্ভব,” জেরি বলল, “আমি সাফল্যের দোরগোড়ায়, বন্ধ করার প্রশ্নই ওঠে না।” আগুনের শিখাটা আবার এগিয়ে দিল জেরি।
আর তখনই, এক আশ্চর্যজনক নরম, নিয়ন্ত্রিত, জান্তব স্বরে রেকুনটা কথা বলে উঠল।
“ও-ও-হ্!” প্রাণীটা বলল, “আমি আর এত কষ্ট সহ্য করতে পারছি না। লোকটা খুব ঝামেলা করছে।”
“ঠিক বলেছ,” ইউনিস বলল। এবং একটা খাবি খেয়ে জেরি ঘুরে তাকাল ইউনিসের দিকে। দেখতে পেল ইউনিসের হাতে ঝক্ঝক্ করছে একটা উদ্যত পিস্তল।
“আমরা মানুষের ছদ্মবেশেও আছি,” ইউনিস বলল, “বড্ড বেশি জেনে ফেলেছ, এবার ইষ্টনাম জপ করো।” তারপর সে জেরির মাথা লক্ষ্য করে পরপর তিনটে গুলি চালাল।
[ আর্থার পোর্জেস (ARTHUR PORGES) রচিত “দি ফ্যানাটিক” (THE FANATIC) অবলম্বনে।]
ছবিঃ শংখ করভৌমিক